বাখতিনের পলিফনি ও দ্বিবাচনিকতার প্রয়োগ

 অভিনন্দন দাস

ছবিঃ রাশিয়ান সাহিত্যিক এবং দার্শনিক মিথাইল বাখতিন

বাখতিন তাঁর চার পাশের সাম্যবাদী সমাজের দিকে তাকান, তাকিয়ে তিনে দেখতে শেখেন। তিনি বুঝতে পারেন ‘দেখা’ আর ‘তাকানোর’ মধ্যে তফাৎ আছে বিস্তর। বস্তুবাদীরা তাকান আর ভাবাদীরা দেখেন। বস্তুবাদে সীমানা কেবল তাকানোতেই সীমিত আর ভাববাদীরা দেখতে পান যতটা তারা চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্র জুড়ে কমিউনিজমের হাওয়া বইছে, সে হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে আসে পাশের সাম্রাজ্যবাদীদের মীনার। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের রাষ্ট্রে তো কোনও কন্ঠই বড়ো না (ব্যাতিক্রম ‘মহান’ স্ট্যালিন) তবে সাহিত্যে লেখকের কণ্ঠ বড়ো হবে কেন? জীবনের ত্বত্ত্ব উপন্যাসে কেন খাটবে না? লেখক কেন তাঁর চরিত্র গুলিকে ছাপিয়ে তাদের সৃষ্টি কর্তা হয়ে উঠবেন? কেন তাঁর চরিত্র গুলি সোভিয়েতদের মতো খোদার উপর খোদকারি করা থেকে বঞ্চিত থাকবে? এমন প্রশ্নের উত্তরগুলি তিনি খুঁজে পান দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে।

গল্পে-উপন্যাসে নানা চরিত্র আসে যাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়, বাখতিন চেয়েছিলেন– প্রতিটি চরিত্রই তাঁর নিজের মতো করে কথা বলুক, কোনও চরিত্রের মধ্যদিয়ে যেন স্রষ্টার ব্যক্তিগত মত ফুটে না বেরোয়। এটি হলো বাখতিনের বহুস্বর (পলিফনি) তত্ত্ব।

তিনি দেখেন সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী দস্তয়েভস্কি তাঁর প্রবন্ধে সকল বিষয়ে নিজস্ব মত প্রকাশ করেন, কিন্তু তাঁর উপন্যাসে তিনি চরিত্রদের অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা দেন। বাখতিনও হয়তো ভুলে গেছিলেন— এই যে ‘স্বাধীনতা দেওয়া’; এই ইচ্ছেরও জন্ম লেখকের মনে। অর্থাৎ চরিত্রগুলি নায়ক– খলনায়ক সত্তা বর্জিত হলেও তাদের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ পূর্ব নির্ধারিত। এখানেই বাখতিনের তত্ত্ব হয়ে ওঠে স্ববিরোধী । চরিত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে চরিত্রগুলি বেখাপ্পা হয়ে যায়, কেবল যায় আর আসে। কাহিনি যেখান থেকে শুরু হয় আবার সেখানেই শেষ হয়। পাঠক কোনো পরিণতির আভাস পায় না। তাই বস্তুবাদের আলোকে সে যুগের সোভিয়েত সাহিত্যে এমনি একটি তত্ত্বের প্রোয়োজন ছিল যা অস্বীকার করবে সব রকমের অদৃষ্টবাদকে। কিন্তু আজকের সোভিয়েত পতনের পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে বাখতিনের তত্ত্বকে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়াটা দোষের নয়। কারণ লেখকের গলা শুনতে না পাওয়াটাই কথাসাহিত্যের একমাত্র শর্ত হতে পারে না।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বাখতিন উপন্যাসকে পড়ার এক শৈলী আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। আর সেই লক্ষ্যেই তিনি এই দুই তত্ত্বের প্রয়োগ আনেন। আমাদের শেখার বিষয় বিজ্ঞান কিংবা গণিতের সূত্রগুলির মতো সাহিত্যের কোনও তত্ত্ব র্নিদিষ্ট ক্ষেত্র (কথাসাহিত্য) ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেও (নাটক, কাব্য, সিনেমা, চিত্র, ভাস্কর্য) প্রয়োগ করা যায় কীনা।

বাংলা সাহিত্যে বাখতিনের বহুস্বরের স্বার্থক প্রয়োগ দেখা যায় ‘সুকুমার রায়’-এর ‘অবাক জল পান’ নাটকে। গ্রন্থাগারিক ও প্রকাশকেরা সুকুমার রায়ের সমগ্র সৃষ্টিকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করলেও তার আবেদন সেখানেই শেষ হয়ে যায় না। চর্যাপদের সান্ধ্যভাষার মতো তাঁর ব্যাঙ্গগুলিকে পড়ে মনে হতেই পারে তা শিশুদের জন্য লেখা। তবে তাতে লুকিয়ে থাকে গভীর মনস্তত্ত্ব ও সমাজবোধ, যার সত্য উদ্ঘাটন করাটাই প্রতিটি পাঠকের কাছে এক একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। অবাক জল পান নাটকে পথিকের তেষ্টার নিবারণ হয় ঠিকই, তবে মাঝখান থেকে এলোমেলোভাবে কিছু চরিত্র এসে ভীড় করে চলে যায়। তারা কথা বলে নিজের গতিতে ও স্বাধীনভাবে। স্বাধীন এই কারণেই যে, প্রতিটি চরিত্রের পেশার সাথে তাঁদের সংলাপের সঙ্গতি রয়েছে। একটি সংযোগ ব্যবস্থায় আমরা দেখি তিনটি প্রধান চরিত্র প্রেরক, গ্রাহক ও প্রেরক মাধ্যম। একটির ভুলে পুরো ব্যবস্থাটাই খারাপ হয়ে যেতে পারে। আবাক জলপান নাটকে প্রেরকের (পথিক) কোনও দোষ নেই, সমস্ত নাটক জুড়েই গ্রাহক ও প্রেরক মাধ্যম পথিককে বিভ্রান্ত করেছে।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে পথিক বলে ওঠেন- “মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন ?” আর ঝুড়িওয়ালা শোনেন ‘জলপাই’(ফল) কোথা থেকে।’ এখানে লুকিয়ে আছে লেখকের সমাজবোধ ও মনস্তত্ত্ব। একজন ফল বিক্রেতার জগৎ ফল নিয়েই তাই তাঁর মাথায় ফল সংক্রান্ত শব্দ ঘোরা ফেরা করে বেশি। এখানেই উঠে আসে বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা। অর্থাৎ শূন্যে কেউ কথা বলে না, হয়তো কথার অর্থ ভুলভাবে প্রকাশ পায়। পথিকের দেখা হয় বৃদ্ধের সাথে। বৃদ্ধ তাঁর উত্তরের বদলে নিজের অতীত জীবনের কথা বলতে থাকেন– “ঘুমড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি আদত জলের জায়গা। সেখানকার যে জল সে কি বলবো তোমায়।…” পাশের বাড়ীর আরেক বৃদ্ধ তাদের বচসা শুনে বেড়িয়ে আসে। বাঙালি সমাজে প্রতিবেশীর চরিত্র অনেকটা নিন্দুকের মতো। এখানে তাঁর ব্যাতিক্রম হয়নি– “আরে দূর দূর ! তুমিও যেমন ! জিজ্ঞেস করার আর লোক পাওনি? ও হতভাগা জানেই বা কী, আর বলবেই বা কী?

দ্বিতীয় দৃশ্যে পথিকের দেখা হয় এক বিজ্ঞানীর সাথে। নাট্যকার তাঁর নামকরণ কেন ‘মামা’ করলেন তা বিবেচ্য। মামার সংলাপে আমরা জানতে পারি তিনি বিজ্ঞানী-- “জল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন।…” চরিত্ররা তাদের মর্জিতে বকতে থাকে আর পথিক তাঁর মর্জিতে বলে। চরিত্ররা যখন কথা বলে তখন তারা আপনা থেকেই সংলাপে জায়গা করে নেয়। কিন্তু একটু ভাবলে বোঝা যাবে বাখতিনের পলিফনি তত্ত্বটি সফল হতে গিয়েও হয়নি। কারণ চরিত্রগুলির সংলাপ স্বেচ্ছাধীন মনে হলেও তাঁর পুরটাই চলেছে লেখকের আঁকা ছকে। সকুমার রায় চরিত্রগুলিকে স্বেচ্ছাচারিতা করতে দিয়েছেন কেবল হাস্যরস সৃষ্টির লক্ষ্যে।

তাই বাখতিনের বহুস্বর তত্ত্ব একটি ইউটোপিয়া মাত্র। সাম্যবাদী সমাজ-ব্যাবস্থায় যার প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও সাহিত্যে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

1 টি মন্তব্য: