মোজাফফর হোসেন
বাংলাদেশের সাহিত্যে কথাসাহিত্য-কবিতা যতটা পরিণত (mature), সমালোচনা সাহিত্য ঠিক ততটাই অপরিণত (immature)। আমরা এখনো সমালোচনা বলতে হয়ত বিশ্রীভাবে গালিগালাজ করি, নয়ত অযৌক্তিকভাবে চাটুকারিতা করি। হয় তোষামোদ নয় গালি—মোটের উপর এই হলো এখানে সমালোচনার প্রতিষ্ঠিত রীতি। গঠনমূলক সমালোচনা করতে না শিখলে কখনোই কোনো শিল্প-আন্দোলন সম্ভব নয়। প্রখ্যাত আইরিশ কবি টি.এস. এলিয়ট তাঁর ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট’ প্রবন্ধে বলছেন, ‘আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, সমালোচনা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই অনিবার্য, এবং স্পষ্টত আমাদের অনুভূতি প্রকাশে দ্বিধা করা উচিত নয়, যখন কোনো বই পড়ি, তার বিষয়ে আমাদের মনে যে সব ধারণা জন্মায়, তা প্রকাশের মাধ্যমে ওইসব সমালোচনার জন্যে আমাদের মনকে সবল করে তোলা দরকার।’ [তর্জমা: হাসানআল আব্দুল্লাহ]
ব্যবহৃত অর্থে আমাদের সমাজে ‘সমালোচনা’ শব্দটি নেতিবাচক বটে, কিন্তু সাহিত্য-সমালোচনা (literary Criticism) নেতিবাচক কোনো বিষয় নয়। একটি টেক্সটকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ উপস্থাপন করা, সেটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক, অথবা দুটো দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে হতে পারে। কিন্তু এখানে এই সাহিত্যসিদ্ধ-রীতির যথার্থ প্রতিফলন খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। এটি না হওয়ার বিশেষ কারণ হতে পারে, আমরা সহনশীল নই। আর একটা কারণ, আমরা নিজের মতকে সবসময় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পছন্দ করি। শিল্প-সাহিত্যে চূড়ান্ত মত-পথ বলে কিছু নেই। শিল্প-সাহিত্যের অনিবার্য দিক হলো ‘সম্ভাবনা’। আমি কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একটি টেক্সটকে পাঠ করছি, তার বাইরে আর কী কী সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ্য হতে পারে, সবদিক বিবেচনা করে সমালোচনা করলে নৈর্ব্যক্তিক হওয়া সম্ভব। এজন্য সাহিত্য-সমালোচকদের সাহিত্যের একাডেমিক পাঠ প্রয়োজন। মৌলিক লেখার কোনো বাঁধাধরা রীতি না টিকলেও সমালোচনা সাহিত্যের একটা সর্বজনস্বীকৃত অ্যাপ্রোস আছে, সেটা জানা দরকার। সাহিত্যতত্ত্ব (literary theory), সাহিত্যের অলঙ্কার (rhetoric-prosody), আখ্যানশিল্প (the art of narratology) এবং কিছু দার্শনিক বিষয়আশয় না জেনে সমালোচনা করতে গেলে সেটি যৌক্তিক হবে না।
একটি শিল্পকর্ম বা সাহিত্যকর্মকে ব্যাখ্যা করার জন্য গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বলা হয় সাহিত্যতত্ত্ব। সাহিত্যতত্ত্ব হলো সাহিত্যকর্মকে মূল্যায়নের একটি প্রামাণ্য ছক। এই ছকের মধ্যে প্রধানত যে সাহিত্যতত্ত্বগুলো আমাদের সামনে আসে, তা হলো : অবয়ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব, ফরমালিস্ট লিটারারি ক্রিটিসিজম, বিনির্মাণ সাহিত্যতত্ত্ব, লেখক-জীবনীভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব, ঐতিহাসিক সাহিত্যতত্ত্ব, মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব, নারীবাদ সাহিত্যতত্ত্ব, মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্যতত্ত্ব, অস্তিত্ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব, উত্তর-উপনিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব, সামাজিক সাহিত্যতত্ত্ব, পুরাণভিত্তিক বা ধর্মীয় সাহিত্যতত্ত্ব, পাঠক-প্রতিক্রিয়া সাহিত্যতত্ত্ব, পরিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব, বাস্তববাদ সাহিত্যতত্ত্ব; প্রভৃতি।
এত গেল সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে পর্যবেক্ষণের কিছু প্রামাণ্য বিষয়-আশয়। সাহিত্যের সঙ্গে আরও যা জড়িয়ে তা হলো ভাষা এবং নির্মাণকৌশল। এটাকে আমরা কাঠামোও বলতে পারি। অর্থাৎ, একটি সাহিত্যকর্মে কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, আখ্যানভাগে কোন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, লেখকের বলার স্বরটা কেমন, ভাষার অলঙ্করণগুলো কোন ধরনের, এসব বিষয়াদিও চলে আসে।
পশ্চিমে সাহিত্যকে তাত্ত্বিক জায়গা থেকে ধরে ধরে পাঠ করার জন্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক বই আছে। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রকাশনার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অল্প যে ক’টি বই আছে সেগুলো খালি তত্ত্বসংবলিত। তত্ত্বের প্রায়োগিক দিকটা সেখানে গুরুত্ব পাইনি। এই সংকট যত দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে ওঠা উচিত।
এ পর্যায়ে টিকা আকারে সমালোচনা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্য-অলঙ্কার ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি উপস্থাপন করা হলো।
ক. সাহিত্যতত্ত্ব (Litaray Theory) ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
পরাবাস্তববাদ (Surrealism) এবং জাদুবাস্তববাদ (Magic Realism)
সুরিয়ালিজম আর্টমুভমেন্ট বা শিল্পোন্দোলন হিসেবে চিত্রকলা হয়ে অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে আলোচনায় আসে। ফর্মাল মুভমেন্ট আকারে ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরিয়ালিজমে কনসিয়াস বা চেতন এবং সাবকনশিয়াস বা অবচেতনের একটা ইউনিটি বা বন্ধন গড়ে ওঠে। অন্যকথায়, স্বপ্নের সঙ্গে জাগতিক বিষয় যুক্ত হয়ে স্বপ্নবাস্তবতার সৃষ্টি করে। ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব থেকে জানা যায়, মানুষের মনের সিংহভাগই থাকে সাবকনশিয়াস বা অবচেতনের দখলে। মনের অবচেতন ভাগ মানুষের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে সেখান থেকে নানা ভাবনা মানুষের চেতনার জগতে চলে আসে। বিষয়টা ভীষণভাবে ব্যক্তিগত। কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা বিষয়টি যতটা না ব্যক্তিমুখী তার চেয়ে বেশি সমাজমুখী। ম্যাজিক রিয়ালিজমে বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি তৈরি করে তার ভেতর জাদু-উপকরণের প্রবেশ ঘটানো হয়। এই দুয়ের সম্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্য হল বাস্তবতাকে ম্যাজিকের মোড়কে পরিবেশন করে মানুষের চেতনাকে ভিন্নভাবে স্পর্শ করা।
সুরিয়ালিজম এবং ম্যাজিক রিয়ালিজমে জাদু এবং বাস্তবতার মিশেল থাকে। কিন্তু পার্থক্য হলো, একটা জগত আমাদের মনের ভেতর তৈরি হয়, অন্যটা তৈরি হয় আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে। ম্যাজিক রিয়ালিজমে আমাদের চারপাশের চেনাজানা জগতে হঠাৎ করেই অচেনা বা কল্পলোকের কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হয়। টোনটা থাকে খুবই স্বাভাবিক, যেন সত্যিই এমনটা ঘটছে, যেন এমনটি ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পাঠকরা তাতে আশ্চর্য হলেও গল্পের চরিত্ররা চরিত্ররা আশ্চর্য হয় না। কারণ, এখানে সবকিছুকেই সম্ভব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্যারিস রিভিউতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লাতিন কথাসাহিত্যের গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেস তাঁর লেখনীর রহস্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন: যখন আপনি বলবেন, হাতি আকাশে উড়ছে, মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি যদি বলেন, ৪২৫টা হাতি আকাশে উড়ছে। লোকজন আপনাকে বিশ্বাস করলেও করতে পারে। অর্থাৎ, মার্কেস যেটা বোঝাতে চাচ্ছেন, অবাস্তব ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার ভেতর চলে যেতে হবে। পাঠক তখন ধরে নেবে বিষয়টি সত্যিই ঘটছে বা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কেসের ‘এ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ ইনরমাস উইংস’, নিকলাই গোগলের ‘দ্য নোজ’, মুরাকামির ‘দ্য অ্যালিফেন্ট ভ্যানিসেস’ গল্পগুলোর প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। প্রথম গল্পে বাস্তবজীবনে হঠাৎ করেই হাজির হয় ডানাওয়ালা মানুষ। গ্রামের মানুষ ভিড় করে দেখতে থাকে। দ্বিতীয় গল্পে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে উপলব্ধি করে তার নাক উধাও হয়ে গেছে। এরপর সে বিভিন্ন জায়গায় নাকের সন্ধান চালাতে থাকে। একদিন দেখে, তার নাক তার অফিসের পোশাক পরে অফিস করতে যাচ্ছে। তৃতীয় গল্পে, হঠাৎ কড়া প্রহরা থেকে এক জলজ্যান্ত হাতি উধাও। তিনটি গল্পেই এই যাদুতুল্য ঘটনার উপস্থাপন করা হয়েছে সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু বিষয়কে ইঙ্গিত করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, পরাবাস্তববাদের আরেক নাম হল স্বপ্নবাস্তবতা। কাজেই পরাবাস্তব সাহিত্যে এমন পরিপাটি করে কোনোকিছু থাকে না। একটা স্বপ্নময়তা থাকে ভাষা ও চেতনায়। স্বপ্নে যেমন ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতর কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক বা লজিক্যাল কানেকশন থাকে না, এবং সবকিছু কেমন বিবর্ণ মনে হয়। তেমনি এখানেও ঘটনা ও ভাষায় সেই অ্যাবসার্ডিজম বা অযৌক্তিকতা থাকে। উদাহরণ হিসেবে এস টি কোলরিজের ‘কুবলাই খান’ অথবা জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। দুটি কবিতাতেই পরাবাস্তব উপাদান আছে। জীবনানন্দ দাস বলছেন, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে/ সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;/ আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/ আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।/...
পুরো কবিতাজুড়ে আমরা এমনই স্বপ্নবাস্তবতায় ছোঁয়া আমরা পাই।
মুডনির্ভর বা ভাবাশ্রয়ী গল্প
গল্পকে কাহিনির বিন্যাস অনুযায়ী দু’ভাগে বিভক্ত করা চলে। এক. কাহিনি বা গল্পনির্ভর বা ঘটনাশ্রয়ী গল্প; দুই. গল্পহীন গল্প বা মুডনির্ভর গল্প বা ভাবাশ্রয়ী গল্প। গল্পকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই গল্পহীন হয় বলে মনে করি না। তাই এক্ষেত্রে মূডনির্ভর শব্দবন্ধনিটাই আমার আলোচনার জন্য যুতসই বলে মনে করছি। এই দুই প্রকারের গল্পের সঙ্গে গল্পপাঠকদের আকসার সাক্ষাৎ ঘটে। সবখানেই ঘটনা বা গল্পনির্ভর গল্প লেখার চল বেশি বিধায় এটি নিয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ, মপাসাঁ, শেখব, ফকনার, হেমিংওয়ে, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়—এঁদের সকলেই গল্পনির্ভর গল্প লিখেছেন। সংক্ষেপে বলা চলে, এ ধরনের গল্পে গল্পটা পুরোপুরি আদলে থাকে। মানে ঘটনার পর ঘটনা থাকে, নাটকীয়তার ব্যাপার থাকে। ঘটনাগুলোর মাঝে সময় এবং স্থানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়। পাঠককে পুরো গল্পটা আপাতভাবে ধরতে কোনো সমস্যা হয় না। কথাসাহিত্যকে সমাজবদলের হাতিয়ার বিবেচনা করে অনেক কথাসাহিত্যিক প্রত্যক্ষ-বয়ান বা সরাসরি গল্প-বুননের এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছেন। এর বিপরীতে থাকে মূডনির্ভর গল্প। এখানে গল্পটা না বলে গল্পের আবহটা তৈরি করা হয়। পুরো গল্পটা থাকে আবহটার অন্তরালে। অর্থাৎ একটা মোড়কের ভিতরে। কখনও কখনও আলাদা করে গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেনে তবে গল্পটির মর্মার্থ উদ্ধার করা যায়। কোনো কোনো পরাবাস্তব ও জাদুবাস্তব টেকনিকে লেখা গল্পও এই বিভাগে পড়ে। এটি গল্পের জনপ্রিয় ধারা নয়। তবে বর্তমান সময়ে চর্চিত ধারার ভেতরে আনা চলে। হেমিংওয়ের ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লেইস’, দেবেশ রায়ের ‘পায়ে পায়ে’, জেরোম ওয়াইডম্যানের ‘মাই ফাদার সিটস ইন দ্য ডার্ক’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘রূপ সাগরে ডোবে না ঈভ’ প্রভৃতি গল্প এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
নারীবাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Feminist Literary Theory)
নারীবাদ সাহিত্যতত্ত্ব নারীবাদ তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আরো একটু বিশদভাবে বলতে গেলে, নারীবাদের রাজনীতির আওতাভুক্ত সাহিত্যকর্মকে এই সাহিত্যতত্ত্বের আওতায় ফেলে আলোচনা করা হয়। সমগ্র সাহিত্যতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশজুড়ে আছে নারীবাদ সাহিত্যতত্ত্ব। বিশ্বের নারীবাদী আন্দোলনে সাহিত্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাতে যে সকল সাহিত্যকর্ম অর্থাৎ নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছে সেগুলোই এর আলোচ্য বিষয়। যে সকল সাহিত্যকর্মে নারী অধিকারকে নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে বা যে সকল সাহিত্যকর্ম জেন্ডার এজেন্ট বা পুরুষবাদী হিসেবে কাজ করেছে তাও এই তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়। মার্কিন লেখক লিসা গ্রাসিয়া টাটেল ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজমের কিছু উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যেমন : ক. নারীকর্তৃক প্রণীত সাহিত্য-ঐতিহ্যের উন্নয়ন সাধন খ. নারীর সাহিত্যকর্মে বর্ণিত প্রতীকসমূহের নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করা যাতে করে পুরুষবাদী চেতনার আড়ালে সেটি চাপা পড়ে না যায় গ. পুরনো বইগুলো পুনরায় আবিষ্কার করা ঘ. নারীদের লেখা ও নারী লেখকদের নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করা ঙ. সাহিত্যে যৌনরাজনীতি প্রতিহত করা চ. ভাষার যৌনরাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো; প্রভৃতি। নারীকে আমরা জীবতাত্ত্বিক জায়গা থেকে না দেখে সমাজতাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখে এসেছি। ফলে নারীর পরিচয় আর বায়োলজিক্যাল না থেকে হয়ে উঠে সামাজিক। অর্থাৎ সমাজের কিছু মানুষের মনগড়া ধারনা এসে আরোপিত হয়েছে নারীর ওপর। নারী-পুরুষ আর লিঙ্গনিরপেক্ষ থাকেনি। নারীবাদ সাহিত্যতত্ত্বে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে কোনো টেক্সট বা সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করা হয়।
নারীবাদী সাহিত্যিক হিসেবে ভার্জিনিয়া উলফের কথা আসে সবার আগে। তাঁর রচিত প্রবন্ধ ‘অ্যা রুম অব অনস অউন’ (১৯২৯) নারীবাদী সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর নারীবাদী সাহিত্যিক হিসেবে যাঁদের নাম উচ্চস্বরে উচ্চারিত হয়ে আসছে, তাঁরা হলেন: জর্জ এলিয়ট, বেগম রোকেয়া, চার্লট ব্রন্টে, জেন অস্টিন, হেনরিক ইবসেন, টনি মরিসন, কেপ শপা, মায়া এঞ্জেলো, মার্গারেট অ্যাটউড, ক্যাথি আকার, এমি টান, এলিজাবেথ বিশপ, এমিলি ডিকিনসন, চার্লট পার্কিন গিলমান, সিলভিয়া প্লাথ, অমৃতা প্রীতম, এলিস ওয়াকার প্রভৃতি।
মনঃসমীক্ষাবাদী সাহিত্যতত্ত্ব (Psycho-Analytical Literary Theory)
মনঃসমীক্ষাবাদী সাহিত্যতত্ত্ব হলো ফ্রয়েড যে সাইকো-এনালাইসিস শুরু করেছিলেন এবং তার উত্তরসূরি মনস্তাত্ত্বিকরা যেভাবে সেটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার আলোকে একটি লিটারারি টেক্সট বা সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করা। মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে অবচেতনের বিরাট ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। এই সাহিত্যতত্ত্বে সেই ভূমিকাটা আবিষ্কার এবং বিশ্লেষণ করা হয়। একটা সাহিত্যের কোনো চরিত্রকে বুঝতে তার স্বপ্ন-বিশ্লেষণ (dream interpretation), চেতন-অবচেতন মনের প্রক্রিয়া (fuction of conscious-subconscious), অবদমিত আকাঙ্ক্ষা (suppressed desire)—প্রভৃতি বিষয় জানা জরুরী হয়ে ওঠে। সাইকো-এনালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণবিষয়ক তত্ত্বাবলী থেকেই ঈদিপাস গূঢ়ৈষা বা ঈদিপাস কমপ্লেক্স, পেনিস ইনভে প্রভৃতি টার্ম সাহিত্যে এসেছে। ফ্রয়েডের পর কার্ল গুস্তাভ ইয়ং ও জাক লাকাঁ এই তত্ত্বকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
লেখক-জীবনীভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব (Biographical Literary Theory)
লেখার সঙ্গে লেখকের যে সম্পর্ক সেটি এই সাহিত্যতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়। অর্থাৎ সৃজনশীল লেখায়, সেটি গদ্যপদ্য উভয়ের ক্ষেত্রেই, লেখকের আত্মজৈবনিক যে সকল উপাদান থাকে তার আলোকে লেখাকে বিশ্লেষণ করার ধারাকে লেখক-জীবনীভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব বলে। প্রায় প্রতিটা সাহিত্যকর্মকে কমবেশি এই তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা চলে। কেননা, কোনো লেখায় লেখকের জীবন-বহির্ভূত নয়। কোনো না কোনোভাবে লেখকের জীবন, যাপিত ইতিহাস সেখানে থাকেই।
ঐতিহাসিক সাহিত্যতত্ত্ব (Historical Literary Theory)
কোনো সাহিত্যকর্মকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বা ঐতিহাসিক তত্ত্ব-উপাত্তের মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করা এই সাহিত্যতত্ত্বের আওতাই পড়ে। কোন সময়ে, কোন প্রেক্ষাপটে, কোন সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সাহিত্যকর্ম রচিত, সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হয়। এটা ফর্মাল ক্রিটিসিজমের আওতাভুক্ত। এখানে টেক্সটকে প্রামাণ্য দলিল বিবেচনা করা হয়। টেক্সটয়ের বাইরের কোনো বিষয় আলোচনার জন্যে বিবেচনায় আনা হয় না। হিপোলাইত তেইন সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে এই ধারার প্রবর্তন করেন। তেইন এ প্রসঙ্গে বলেন, সাহিত্য শুধুমাত্র একজন বা কতগুলো ব্যক্তির জীবনচিত্র নয়, এর সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি বিষয়াদি। কাজেই এই সমালোচনা রীতিতে বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কোন প্রাচীন সাহিত্যকর্মের উৎপত্তি জানতে হলে এই সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে পাঠ অনিবার্য। এই সাহিত্য-সমালোচনা পদ্ধতি সতেরশো শতকে শুরু হলেও উনবিংশ ও বিংশ শতকে এসে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
অস্তিত্ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Existential Literary Theory)
অস্তিত্ববাদ সাহিত্যতত্ত্বে অস্তিত্ববাদ তত্ত্ব দ্বারা কোনো সাহিত্যকর্মের চরিত্র বা কাহিনিকে বিশ্লেষণ করা হয়। এই তত্ত্বের পুরোধা-পুরুষ ফরাসি দার্শনিক জা পল সাঁৎ। তিনি বলছেন, মানুষ নিজেকে তৈরি করে। এই পৃথিবীটা একটা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখানে মানুষ ভীষণ একা। তাকে তার জীবনের অর্থ তার মতো করে তৈরি করে নিতে হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিতে সবসময় একটা ‘বিকামিং’ বা হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক দেকার্ত বলছেন, আমি চিন্তা করি বিধায় আমি আছি। অর্থাৎ তিনি অস্তিত্বের প্রশ্নে ব্যক্তির ওপর সমস্ত জোর আরোপ করছেন। অস্তিত্ববাদের আরেক দার্শনিক-সাহিত্যিক আলবেয়ার কামু বলছেন, প্রতিটা মানুষ একা। তাকে একটা অপরিচিত পৃথিবীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই পৃথিবীর নিজস্ব কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। শূন্য থেকে আসা সেই ব্যক্তির শূন্যের দিকের যে যাত্রাপথ সেই যাত্রাপথে সে একটা অর্থহীন বা অ্যাবসার্ড জীবন আবিষ্কার করে। এই দার্শনিক ভিত্তির ওপর আলোকপাত করে সাহিত্য-বিশ্লেষণ-পদ্ধতি হলো অস্তিত্ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব।
পাঠক-প্রতিক্রিয়াপদ্ধতি (Reader-Response Literary Theory)
এই সাহিত্যতত্ত্বে লেখার মতো পড়াও সৃজনশীল একটি কাজ হিসেবে গণ্য হয়। এখানে পাঠকের প্রতিক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন পাঠক একটি টেক্সটয়ের কি প্রতিক্রিয়া জানালেন, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি টেক্সটটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলেন। পাঠক যে অর্থকে গ্রহণ করবেন, সেই অর্থই তার কাছে চূড়ান্ত। পাঠক্রিয়া তখনই পূর্ণ হবে যখন সেটি হবে ক্রিয়াশীল এবং একইসাথে সৃজনশীল। এই সাহিত্যতত্ত্বের প্রধান বিষয় হলো, কোনো বিশেষ সাহিত্যকর্মের পাঠককর্তৃক অর্থ উদ্ধার করা। এক্ষেত্রে একজন পাঠকের জ্ঞান, বোধ ও পঠনপাঠনের ওপর নির্ভর করে তার বিশ্লেষণ কেমন হবে।
মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব (Marxist Literary Theory)
মার্কসীয় সমালোচনা সাহিত্যে একটি সাহিত্যকর্মকে ঐ সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাড় করিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। মার্কসীয় দর্শন মতে, সাহিত্য অর্থনীতি নামক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অধিসৌধ বা সুপার-স্ট্রাকচারের অংশবিশেষ। মার্কসীয় সাহিত্য সমালোচকদের কাজ হলো, সাহিত্যে বর্ণিত সমাজব্যবস্থার কোন শাসন-কাঠামো বিদ্যমান, শ্রেণিবৈষম্য আছে কিনা, উৎপাদন ব্যবস্থা কেমন, সম্পদের সুষম বণ্টন আছে কিনা, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক কোন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ভাষাটা কোন শ্রেণির—এসব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা। এই সাহিত্যতত্ত্বে ফর্ম কিংবা কাঠামোর চেয়ে বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যকে পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে লেখক কিংবা চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বুঝলেই চলবে না, সঙ্গে লেখক যে সামাজিক পরিস্থিতি থেকে লিখছেন, তার চরিত্ররা যে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছে সে বিষয়গুলোও বুঝতে হবে। তাই এখানে শিল্পবোধের সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও রাজনৈতিক বোধও গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর-উপনিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Post-Colonial Literary Theory)
পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচার বা উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য হলো সেই সব সাহিত্যকর্ম যা ইউরোপিয়ানদের এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং প্যাসিফিক অঞ্চলে উপনিবেশিক সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা তুলে ধরে। উত্তর-উপনিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব উপনিবেশকালের নানা সমস্যা ও উপনিবেশ উত্তরকালের প্রভাবগুলো উপস্থাপন করে। বিশেষ করে, উপনিবেশ রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে কি ধরনের প্রভাব ফেলে তার ওপর আলোকপাত থাকে বেশি। বেশিরভাগ উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যকর্ম এই পরিস্থিতির ওপর ক্রিটিকের ভূমিকা পালন করে। বিশ্ব যেমন আগের চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে তেমনি উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যের পরিধিও অনেক বেড়ে গেছে। স্থানচ্যুতি ঘটেছে উপনিবেশের সাহিত্যিকদের। ফলে উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যে অস্তিত্বের প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এখানে উল্লেখ্য, উপনিবেশকালীন রচিত সাহিত্যকর্মও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিক্রিয়ায় রচিত বিবেচনায় এই পাঠের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রকৃতিবাদ সাহিত্য সমালোচনা (Ecocriticism)
একটা টেক্সট বা সাহিত্যকর্মে পরিবেশগত বিষয়াদি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সেটি এই সাহিত্যতত্ত্বে আলোচনা করা হয়। একটি উপন্যাসের প্লটে ফিজিক্যাল সেটিং বা বাহ্যিক জগত কিভাবে এসেছে, চরিত্রগুলো পরিবেশ বিষয়ে কতটা সচেতন, চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিবেশের কি সম্পর্ক ও প্রভাব—এসব বিষয়াদি উঠে আসে এই তাত্ত্বিক আলোচনায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন