সাহিত্য পাঠ ও ইতিহাস: একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

মো. মমিন উদ্দীন
একটি বিশেষ সময়ের সাহিত্য পাঠ ও অনুধাবন করতে হলে ঐ সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানা দরকার কারণ সাহিত্য গড়ে ওঠে সমাজ ও ইতিহাসকে নির্ভর করে। সময়ের সাথে সাথে যেমন সমাজে পরিবর্তন আসে সাহিত্যেও তেমনি পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। তাই সমাজ ও ইতিহাসের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অতি নিবিড়। এককথায় বলা যায় একটি বিশেষ সময়ের মানুষের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ভালো করে না জেনে ঐ সময়ে লিখিত কোন সাহিত্য কর্ম অনুধাবন করা কঠিন। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোট গল্প বা নাটক বা উপন্যাস পাঠ করলে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। আবার নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা নাটক পড়লে ঐ সমাজের–যে সমাজকে ভিত্তি করে মৃত্যুক্ষুধা নাটকটি লিখিত হয়েছে–মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এভাবে প্রতিটি সাহিত্য কর্মই সাহিত্য কর্মটি লিখিত হওয়ার সময়ের সমাজের চিত্র তুলে ধরে। আর এ কারণে সাহিত্যকে সমাজের দর্পন হিসেরে উল্লেখ করা হয়।

তবে এভাবে সাহিত্য পাঠ করার নেতিবাচক দিক আছে। এক্ষেত্রে সাহিত্য আর সাহিত্য থাকে না; সাহিত্য হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ যা সাহিত্যের জন্য অমর্যাদাকর ও ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে সাহিত্য কালের গন্ডি পেরিয়ে সার্বজনীনতো হতে পরেই না, বরং নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে সাহিত্য হয়ে যায় ইতিহাসের জানালা। ইতিহাস পাঠে যেমন পাঠকের স্বাধীনতা থাকে না, সাহিত্য পাঠেও তখন আর পাঠকের স্বাধীনতা থাকে না। তাহলে ইতিহাস থেকে সাহিত্যের পার্থক্য কোথায়? সাহিত্য কি ইতিহাসের শাখা?
যদি বলি সাহিত্য ইতিহাসের শাখা নয়; এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয়, তাহলে সাহিত্য পাঠের ধরণ পরিবর্তন করা দরকার। সাহিত্য পাঠে লেখক, লেখকের জীবনী, লেখকের সময়কালের বা সমাজের চিত্র খুব একটা জরুরী বিষয় হওয়া উচিত নয়। সাহিত্য কর্মটিই মুখ্য। কোন সময়ে সাহিত্য কর্মটি লেখা হয়েছে, সেই সময়ের মানুষের আচার-আচারণ, পোষাক-পরিচ্ছেদ, সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল, সহায়ক পুস্তক থেকে এসব বিষয় জানার চেষ্টা না করে মুল সাহিত্য কর্মে যে অর্থ পাওয়া যায় পাঠকের তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাহলে পাঠকের স্বাধীনতা থাকে একটি সাহিত্য কর্মকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার। সাহিত্য কর্মটিও একটি মাত্র নির্দিষ্ট  কোণে আবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়, কলোর্ত্তীণ ও সার্বজনীন।
একটি সাহিত্য কর্মে লেখক কি বুঝাতে চেয়েছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; পাঠক কি বুঝলো সেটিই আসল কথা। একজন লেখকের দ্বায়িত্ব ও ভূমিকা সাহিত্য কর্মটি লিখিত হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় পাঠকের ভূমিকা যা চলতে থাকে অনন্তকাল ব্যাপি। পাঠকেরা সাহিত্য কর্মটিকে বুঝে নিজেদের মতো করে। একেকজন পাঠক যেহেতু একেক ধরণের চরিত্র ও মনের অধিকারী, তাই তাদের একটি বিষয়কে বুঝার ধরণও আলাদা। ফলে একটি বিষয়ের উপরেই আসে নানান জনের নানান ধরণের ব্যাখ্যা। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা। আর বিচিত্র এই সব তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা সাহিত্য কর্মকে করে মহিমান্বিত।
তবে ইতিহাস বা সমাজকে পুরাপুরি বাদ দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায় না। সমাজের নানা ঘটনা বা চিত্র সাহিত্যের উপাদান হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে ইতিহাস বা সমাজকে সাহিত্যের কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অর্থাৎ সাহিত্য হচ্ছে ইতিহাস বা সমাজের শৈল্পিক উপস্থাপন। এক্ষেত্রে রুশ ফরমালিস্ট বরিস টমাসেভসকির তত্ত্বের কথা মনে করা যায়। টমাসেভসকির মতে ‍Story  এবং Plot এর মধ্যে পার্থক্য আছে: Story-এর ক্ষেত্রে ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়; কিন্তু Plot-এর ক্ষেত্রে ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরী নয়। এক্ষেত্রে লেখক তার ইচ্ছামতো ঘটনাসমূহকে নিজের সুবিধা বা প্রয়োজন মতো সাজাতে পারে যাতে গল্পটি সুন্দর ও মনোহর হয়। এমনকি গল্পের প্রয়োজনে কাল্পনিক ঘটনার সংযোজন বা কোন বাস্তব ঘটনার বিয়োজনও লেখক ঘটাতে পারে। তাই সাহিত্য থেকে ঐতিহাসিক সত্য জানার কোন সুযোগ নেই।
সাহিত্য কর্ম যাতে ইতিহাসের অংশ হিসেবে পঠিত না হয় সে জন্য লেখকেরও ভূমিকা থাকা জরুরী। সাহিত্যে বিষয়বস্তুর উপস্থাপন এমন হওয়া দরকার যাতে তা ইতিহাসে ঘটনা যেভাবে বর্ণিত বা উপস্থাপিত হয় তা থেকে পৃথক হয়। যে সাহিত্য কর্মে এই তত্ত্ব অনুসরণ করা হয় না তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পাঠকদের প্রয়োজন মেটালেও যুগে যুগে সমান গুরুত্বে পঠিত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সময়ের সাথে সাথে সমাজে যেমন পরিবর্তন আসে, পাঠকদেরও প্রয়োজন বদলায়। পরিবর্তন আসে পাঠকদের চিন্তাচেতনায়ও। তাই যুগ বা কালের গন্ডি পেরিয়ে সকল যুগের পাঠকদের কাছে সমান গুরুত্ব পেতে হলে সাহিত্যকে অবশ্যই ইতিহাসবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রুশ বিপ্লবের নিকট পূর্বে বা পরে যে সকল সাহিত্য কর্মে বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বা সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছিল সে সকল সাহিত্য কর্মের দু-একটি আজ ছাত্রদের স্কুল পাঠ্য ছাড়া সকল শ্রেণীর পাঠকদের বিনোদন পাঠ্য হতে পারেনি। অথচ যে সকল সাহিত্য কর্ম মানুষের মনোজগতকে নাড়া দেয়, আবেগ অনুভূতিকে স্পর্শ করে সে সকল সাহিত্য কর্ম কালের গন্ডি পেরিয়ে সার্বজনীন। উদাহরণস্বরূপ, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটম্যাকবেদ,অথেলোকিং লিয়ার  শত শত বছর পেরিয়ে আজও সমান গুরুত্বে পঠিত হয়। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্ত করবী  আজও সমান গুরুত্বে মঞ্চস্থ হয় এবং নাটকটির বৈচিত্র্যময় ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অথচ ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার – এক সময়ের বাজার কাঁপানো উপন্যাস– আজ কালে-ভদ্রে পঠিত হয়।  
এবার একটা সাহিত্য কর্মকে নতুন এ পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যাক। নজরুল ইসলামের ‚বিদ্রোহী“একটি বহুল পঠিত কবিতা। কবিতার প্রতিটি ছত্রে কবির বিদ্রোহী মনোভাব ফুটে উঠেছে। কার বিরুদ্ধে কবির এ বিদ্রোহ ? খুব সহজে এ প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর পাওয়া যায় যদি কবিতাটি লেখার সময় ও প্রেক্ষপট বিবেচনায় নেওয়া হয়। কবির বিদ্রোহ ভারতে বৃটিশ উনিবেসিক শাসকদের বিরুদ্ধে। বৃটিশ উপনিবেসিক শাসকদের বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহ-এ কথাটি আমরা অনুমান করে নিই কবির ব্যক্তি জীবন, কবিতাটি লেখার সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে। এক্ষেত্রে অন্য কোনভাবে কবিতাটি ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। এ পদ্ধতিতে কবিতাটি বিচার করলে বিশাল শক্তিশালী এই কবিতার অর্থ সংকুচিত হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যদি কবির ব্যক্তি জীবন, কবিতাটি লেখার সময় ও প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে আলোচনা করি, তাহলে দেখবো কবির বিদ্রোহ শুধু বৃটিশ উপনিবেসিক শাসকদের বিরুদ্ধে নয়; কবির বিদ্রোহ সেই সব মানুষ বা শক্তির বিরুদ্ধে যারা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং যারা মানুষের অধিকারকে হরণ করে। তাহলেই কবিতাটি হয়ে উঠতে পারে সকল দেশের শোষিত, অধিকার বঞ্চিত সংগ্রামী মানুষের বিদ্রোহের কথা। নজরুলের ‚আমি“ হতে পারে সকল যুগের এবং সকল দেশের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা বিদ্রোহী মানুষের প্রতিভূ। আর নজরুল ইসলাম হতে পারে সকল দেশের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের কবি।
সবশেষে বলা যায়, ইতিহাসকে পুঁজি করে সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে; কিন্তু কোনভাবেই সাহিত্যকে ইতিহাস জানার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়; কারণ সাহিত্য এবং ইতিহাস দুটি আলাদা বিষয়। একজন ঐতিহাসিক কলমকে লেখার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং যা সত্য বলে তার কাছে প্রতিয়মান হয় তাই সে লিপিবদ্ধ করে। অন্যদিকে সাহিত্যিক একজন শিল্পী; আর কলম তার তুলি। তার শিল্পের জন্য যতটুকু কাঁচামালের প্রয়োজন ততটুকুই সে গ্রহন করে। আর শিল্পকে সুন্দর ও নিপুণ করতে ব্যবহার করে তুলির সাথে কল্পনার রং। তাই সাহিত্য সুন্দর; সর্বাংশে সত্য নয়। অন্যদিকে ইতিহাস সত্য; সুন্দর নাও হতে পারে।

২টি মন্তব্য: