সামবেদীয়
কেনোপনিষদ্
বা
তলবকারোপনিষদ্
অনুবাদ © অর্ণব দত্ত
ওঁ
কে মনকে চালনে করে মনের দিকে নিয়ে যান? শরীরের প্রধান প্রাণকে কে নিযুক্ত করে তার কর্ম করিয়ে নেন? লোককে কে এই সব বাক্য উচ্চারণ করান? চোখ ও কানকে কোন দেবতাই বা নিজের নিজের কাজে যুক্ত রাখেন? ১ ।।
যিনি কানেরও কান, মনেরও মন, বাক্যেরু বাক্য; তিনিই প্রাণের প্রাণ, চোখের চোখ―এই জ্ঞান অর্জন করে ‘চোখ, কান ইত্যাদি আমার’―এই ধারণা জ্ঞানীগণ পরিত্যাগ করেন। তখন তাঁরা ইহলোকের উর্ধ্বে উঠে অমরত্ব অর্জন করেন ।। ২ ।।
ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না। তাঁকে বাক্য দিয়ে বোঝানো যায় না। মন তাঁকে ধরতে পারে না। আমরা তাঁকে জানি না। কিভাবে তাঁর উপদেশ দিতে হয় তাও জানি না। জানা ও অজানা সকল বস্তুর মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ অথব সবার থেকে আলাদা। যাঁরা ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি― ৩ ।।
যিনি বাক্যের দ্বারা প্রকাশিত নন; বরং বাক্য যাঁর দ্বারা উচ্চারিত হয়, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৪ ।।
লোকে যাঁকে মনের দ্বারা চিন্তা করতে পারে না; কিন্তু যিনি মনকে জানেন বলে ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন, তুমি তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৫ ।।
লোকে যাঁকে চোখে দেখতে পায় না, অথচ যাঁর শক্তিতে লোকে দৃশ্য বস্তুগুলিকে দেখতে পায়, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৬ ।।
লোকে যাঁকে কানে শুনতে পায় না, অথচ যিনি কানের গোচর সকল কথা জানেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৭ ।।
লোকে যাঁকে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আঘ্রাণ করতে পারে না, অথচ যাঁর শক্তিতে ঘ্রাণেন্দ্রিয় নিজের বিষয়ের দিকে যায়, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৮ ।।
যদি তুমি মনে করো যে, তুমি ব্রহ্মকে ভালভাবে জেনেছো, তাহলে বুঝবে ব্রহ্মের স্বরূপ তুমি অল্পই জেনেছো। দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মের স্বরূপ যতটুকু বলে জেনেছো, তাও অল্প। সুতরাং ব্রহ্ম তোমার বিচারের বিষয়। [এই কথা শুনে শিষ্য ব্রহ্মকে বিচার ও অনুভব করে গুরুর কাছে এসে বললেন] আমার মনে হয়, এখন আমি ব্রহ্মকে জেনেছি ।। ৯ ।।
আমার মনে হয় না যে, আমি ভালভাবে ব্রহ্মকে জেনেছি। আবার আমি যে তাঁকে জানি না, এমনও নয়। ‘আমি তাঁকে জানি না এমন নয়, আবার জানি এমনও নয়’―এই বাক্যের অর্থ আমাদের মধ্যে যিনি জানেন, তিনিই তাঁকে জানেন ।। ১০ ।।
যিনি মনে করেন আমি ব্রহ্মকে জানতে পারিনি, তিনিই তাঁকে জেনেছেন। আর যিনি মনে করেন আমি ব্রহ্মকে জেনেছি, তিনি ব্রহ্মকে জানেন না। বড়ো বড়ো জ্ঞানীরা মনে করেন, তাঁরা ব্রহ্মকে জানতে পারেননি। আবার অনেক অজ্ঞানী মনে করেন, তাঁরা ব্রহ্মকে জেনে ফেলেছেন ।। ১১ ।।
ব্রহ্মকে সর্বদর্শী রূপে জানলেই তাঁকে যথার্থ ভাবে জানা হয়। এইরূপ জ্ঞান লাভ করলে অমৃতত্ব লাভ করা হয়। আত্মার স্বরূপ জানলে শক্তি লাভ করা যায়। আর আত্মাকে জানলে অমর হওয়া যায় ।। ১২ ।।
ইহজন্মে ব্রহ্মকে জানতে পারলে মানুষের জন্ম সার্থক হয়। আর ইহজন্মে ব্রহ্মকে না জানতে পারলে সংসারে বার বার ফিরে ফিরে আসতে হয়। জ্ঞানীরা সব কিছুতে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে ইহলোকের পরপারে গিয়ে অমরত্ব অর্জন করেন ।। ১৩ ।।
দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে ব্রহ্ম দেবতাদের জয়ী করেছিলেন। ব্রহ্মের বিজয়ে দেবতারা মহিমান্বিত হলেন। কিন্তু তাঁরা মনে করলেন, এই বিজয় তাঁদের বিজয়। তাই এই মহিমাও তাঁদেরই মহিমা ।। ১৪ ।।
একথা জানতে পেরে ব্রহ্ম তাঁদের সম্মুখে প্রকাশিত হলেন। কিন্তু কেই এই পূজ্য সত্ত্বা, তা দেবতারা বুঝতে পারলেন না ।। ১৫ ।।
তাঁরা অগ্নিকে বললেন, ‘হে সর্বজ্ঞ অগ্নি, কে এই পূজনীয় সত্ত্বা, তা আপনি জেনে আসুন।’ অগ্নি বললেন, ‘তাই হোক ।’ ১৬ ।।
অগ্নি ব্রহ্মের কাছে গেলেন। ব্রহ্ম বললেন, ‘কে তুমি?’ অগ্নি বললেন, ‘আমি সর্বজ্ঞ অগ্নি।’ ১৭ ।।
ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এমন প্রসিদ্ধ নামযুক্ত। কিন্তু তোমার মধ্যে কী গুণ আছে?’ অগ্নি বললেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে, আমি তা পুড়িয়ে ফেলতে পারি।’ ১৮ ।।
ব্রহ্ম তখন অগ্নির সামনে একটি ঘাস দিয়ে বললেন, ‘এটি পোড়াও দেখি।’ অগ্নি ঘাসটির কাছে এসে নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। কিন্তু সেটিকে একটুও পোড়াতে পারলেন না। তখন তিনি ব্রহ্মের কাছ থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘কে এই পূজ্য সত্ত্বা, তা তো বুঝতে পারলাম না।’ ১৯ ।।
তখন দেবতারা বায়ুকে বললেন, ‘হে বায়ু, কে এই পূজ্য সত্ত্বা, তা আপনি জেনে আসুন।’ বায়ু বললেন, ‘বেশ, তাই হোক।’ ২০ ।।
বায়ু ব্রহ্মের কাছে এলেন। ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে?’ বায়ু বললেন, ‘আমি বায়ু। সারা আকাশে আমার যাতায়াত।’ ২১ ।।
ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এমন প্রসিদ্ধ নামযুক্ত। কিন্তু তোমার মধ্যে কী গুণ আছে?’ বায়ু বললেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সব আমি উড়িয়ে নিতে পারি।’ ২২ ।।
ব্রহ্ম তাঁকে একটি ঘাস দিয়ে বললেন, ‘এটি উড়িয়ে নাও দেখি।’ বায়ু সেই ঘাসটির কাছে এলেন। কিন্তু সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও সেটিকে ওড়াতে পারলেন না। তখন তিনি ব্রহ্মের কাছ থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘কে এই পূজ্য সত্ত্বা, তা তো বুঝতে পারলাম না।’ ২৩ ।।
দেবতারা তখন ইন্দ্রকে বললেন, ‘হে ঐশ্বর্যবান ইন্দ্র, কে এই পূজ্য সত্ত্বা, তা আপনিই জেনে আসুন।’ ইন্দ্র বললেন, ‘বেশ তাই হোক।’ এই বলে তিনি ব্রহ্মের কাছে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে ব্রহ্ম তাঁর সামনে থেকে সরে গিয়েছেন।। ২৪ ।।
ইন্দ্র দেখলেন, সেই আকাশেইএক দিব্য স্ত্রীমূর্তি। ইনি উমা হৈমবতী। তাঁকে আবির্ভূত দেখে ইন্দ্র তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পূজনীয় সত্ত্বা কে?’ ২৫ ।।
উমা হৈমবতী বললেন, ‘ইনিই ব্রহ্ম। এঁর বিজয়েই তোমরা গৌরবান্বিত হয়েছো।’ এইভাবে উমা হৈমবতীর বাক্যে ইন্দ্র জানলেন ব্রহ্ম কে।। ২৬ ।।
যেহেতু অগ্নি, বায়ু ও ইন্দ্র ব্রহ্মের নিকটবর্তী হয়েছিলেন এবং তাঁরাই প্রথম তাঁকে ব্রহ্ম বলে জেনেছিলেন, তাই এঁরা অন্য দেবতার থেকে শ্রেষ্ঠতর ।। ২৭ ।।
ইন্দ্রই যেহেতু প্রথম তাঁকে ব্রহ্ম বলে জেনেছিলেন, তাই ইন্দ্র অন্যান্য দেবতার থেকে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন ।। ২৮ ।।
ব্রহ্মের এই প্রকাশ বিদ্যুতের প্রকাশের মতো। দেবতাদের সামনে তাঁর প্রকাশ এক পলকের জন্য মাত্র ।। ২৯ ।।
আত্মবিষয়ক উপদেশ এই যে মন, এই মন যেন তাঁকে জানতে পারে, এই মনের দ্বারা যেন বার বার তাঁকে স্মরণ করা যায়, এই সাধকের সঙ্কল্প ।। ৩০ ।।
তিনি পূজনীয়; তাই তাঁরই উপাসনা করতে হবে―একথা যিনি জানেন, তাঁকে সকল প্রাণী বিশেষভাবে পেতে ইচ্ছা করে ।। ৩১ ।।
গুরু শিষ্যকে বললেন, তুমি বলেছিলে, ‘হে ভগবন্, আমাকে উপনিষদ্ বলুন।’ তাই তোমাকে এই উপনিষদ্ বলা হল। এই উপনিষদ্ অবশ্যই ব্রহ্মবিষয়ক ।। ৩২ ।।
তপস্যা, মনের স্থিরতা, বেদ ও বেদাঙ্গ এই ব্রহ্মকে লাভ করার উপায়। সত্য এই ব্রহ্মের আশ্রয় ।। ৩৩ ।।
এই ব্রহ্মবিদ্যা যিনিই অবগত হবেন, তিনি সকল পাপমুক্ত হয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত হবেন ।। ৩৪ ।।
।।কেনোপনিষদের বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত ।।
।। হরিঃ ওঁ তৎ সৎ ।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন