কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রয়াণ ও তাঁর কাব্যদর্শন নিয়ে সামান্য কথা

তুষার গায়েন

বাংলার অগণন নদীর আবর্তে, খরস্রোতে ভেসে যাওয়া জীবন ও বিধ্বংসী বন্যার করালগ্রাস থেকে বার বার বেঁচে ফেরা সংগ্রামী মানুষ, সহস্র বছর ধরে বিবিধ ঔপনিবেশিক শাসন-নিপীড়নে ক্লিষ্ট, কিন্তু আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রামে দীপ্ত বাঙালি জাতির অজেয় জীবনস্পৃহার কাব্যিক রূপসন্ধানে 'সশস্ত্র বাউল' কবি মোহাম্মদ রফিকের দেহাবসান হলো গতকাল ৬ আগস্ট, ২০২৩। ফেসবুক নদীতে এই সংবাদ পেলাম, স্তব্ধ হয়ে রইলাম এবং তাৎক্ষণিকভাবে শোক প্রকাশ করার থেকে মৌন হয়ে থাকার অনুভবই শ্রেয় বোধ হলো।
এইভাবে ভিজে ভিজে কীর্তিনাশা আর কতদূর যাবে,
এই দেশে, বন্যার কি শেষ আছে, বৃষ্টি ও মেঘের
সারা পিঠে এলানো চুলের ঢেউ ভিজে ছপছপ
শীতার্ত বর্ষার ফলা বিঁধে ফেলে সমস্ত শরীর;
[...]
এইভাবে পুড়ে পুড়ে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে,
এই দেশে, খরার কি শেষ আছে? মারি ও মড়ার?
[...]
এইভাবে দুঃখ দৈন্যে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে;
এই দেহ কাল হবে কেউ তাকে ঠিক ছিঁড়ে খাবে
(কীর্তিনাশা : ধ)
পঞ্চাশটি বাংলা বর্ণমালার প্রতিটির জন্য একটি করে মোট পঞ্চাশটি কবিতা নিয়ে অখণ্ড 'কীতিনাশা' কাব্যগ্রন্থ মোহাম্মদ রফিকের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। বহতা সময়ের ক্রূর থাবা যেন এই কীতিনাশার ঢেউ যার কাদাজলে মানুষেরা আবহকাল ধরে সংগ্রামরত। নদী ভাঙে, নদী গড়ে, শস্যদায়িনী এবং প্রলয়ঙ্করী। কুবের গভীর রাতে নদীতে জাল ফেলে, মাছ ধরে, কুপি হাতে অপেক্ষা করে কপিলা। পেলব, মসৃণ নয় বরং ভাষার অন্তর্গত পেশির সবলতায় ধারণ করেন বহমান জীবনের স্রোত। এরপর তাঁর 'কপিলা' ও 'গাওদিয়া' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে, কাব্যগ্রন্থ ট্রিলজির পরম্পরা সৃষ্টি হয়। সংগ্রামী নারীর প্রতীক হিসাবে মধ্যযুগের কাহিনীকাব্য থেকে বেহুলা, মহুয়ার মতো চরিত্রগুলোকে যেমন গ্রহণ করেছেন কবিতায়, তেমনি আধুনিক কালের মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় উপন্যাস 'পদ্মানদীর মাঝি' থেকে কপিলা এবং 'পুতুল নাচের ইতিকথা' থেকে গ্রামের আর্কিটাইপ হিসেবে 'গাওদিয়া', তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'কবি' উপন্যাস থেকে 'বসন'কে নিজের কাব্যদর্শনের মর্মমূলে স্থাপন করে মিথে রূপান্তরিত করেছেন। অনতি-অতীতের সাহিত্যকর্ম থেকে এইভাবে কবিতায় মিথ নির্মাণ বাংলাকাব্যে ব্যতিক্রমী ঘটনা। ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতার বিপরীতে ঐতিহ্যলগ্ন বাংলার নিজস্ব আধুনিকতার নির্ণয়ে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কবিতাকে নিকটবর্তী মনে করতেন এবং তাঁর সে বিচার যথার্থ।
ছাত্র জীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনকে সেভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শ্লোগানধর্মী 'খোলা কবিতা' লিখে আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। 'সব শালা কবি হবে' পঙক্তি জনস্মৃতিতে ঠাঁই পেয়েছে এবং ফেসবুক পোস্টে অধিকাংশ কবি ও লেখকরা সেটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ভালো হতো যদি মোহাম্মদ রফিকের আরো বেশি ব্যঞ্জনাধর্মী ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদী কবিতার পঙক্তি জনচিত্তে স্থায়ী হতো। 'রূপকথা' এমনই একটি কবিতা যার প্রতিবাদী দর্শন ও ঐতিহ্যের অঙ্গীকার দারুণভাবে ডানা মেলেছে।
মানবমুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভাবে তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ও বামপন্থী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের ধস ও বিপর্যয় তাঁকে রাজনৈতিক-দার্শনিক সঙ্কটে নিপতিত করেছিল বলে অনুভব করি। তাই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর তাঁকে আর ঐভাবে সোচ্চার দেখিনি। তিনি অনেকটা অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু কখনো আপোষ করেন নি অথবা কোনো রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতার কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করেননি। তাঁর সাহসী, আত্মমর্যাদাপূর্ণ বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং সাহিত্যের বিপুল পাঠ তাঁর সম সাময়িক অনেক জনপ্রিয় কবির থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কবির কদর করার মতো পরিবেশ বা শিক্ষা কোথায়?
মোহাম্মদ রফিকের কবিতা নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন আছে এবং সমালোচনারও। কিন্তু সেসব সময় সাপেক্ষ ও আন্তরিক অভিনিবেশের কাজ। আমার কৈশোর-তারুণ্যের প্রথমভাগে তাঁর সাথে মেলামেশা করার অনেকটা সুযোগ হয়েছিল যখন কেবল তিনি কবি হিসাবে নিজের পদচ্ছাপ রাখতে শুরু করেছেন। সে সময় দেশ-মানুষ-মানবসভ্যতার অগ্রগমন ও মুক্তি নিয়ে তাঁর স্বপ্ন, চিন্তাভাবনা ও কাব্যদর্শন আমাকে বয়সের তুলনায় অনেকটা পরিণত মনস্ক করে তুলেছিল। কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রয়াণ দিবসে সে কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং তাঁর লোকান্তরিত জীবনের প্রশান্তি প্রার্থনা করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন