প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, পুরাণ রচয়িতা বলে যিনি কথিত, সেই ব্যাসদেবের পুরাণের ভাষা কিন্তু বাংলা নয়। এক সহস্র শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচারিত এবং পরবর্তীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমসাময়িক (খ্রিস্টীয় ৩য় - ৫ম শতাব্দী) সময়ে সঙ্কলিত হতে থাকা এ পুরাণের ভাষাও বাংলা ছিল না। এমনকি কোন কোন পুরাণের জন্মস্থান বঙ্গদেশ বলে প্রমাণিত হলেও সে রচনার ভাষাও আমাদের এখনকার বাংলা নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেই যায় যে, আমাদের বাংলা শব্দভাণ্ডারে পৌরাণিক শব্দমালা এলো কী করে ? উত্তরটা ঐতিহাসিক।
আমাদের বর্তমান বাংলার আদি রূপ খুঁজতে ধীরে ধীরে পিছুতে লাগলে গৌড় অপভ্রংশ, মাগধি অপভ্রংশ, মাগধি প্রাকৃত ইত্যাদির পথ বেয়ে শেষ পর্যন্ত যে আাদি মাথায় গিয়ে শেষ হয়, তা বৈদিক সংস্কৃত ভাষা। অতএব, পৌরাণিক শব্দের আগমন না থাকাটাই ছিল অস্বাভাবিক। কাজেই সোজা কথায়, আমাদের ভাষায় তৎসম, তদ্ভব, অর্ধতৎসম শব্দের অবস্থানের কারণে এবং ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বলয়ে থাকার কারণে এ পৌরাণিক শব্দগুলো জায়গা করে নিয়েছে আমাদের অজান্তেই (উৎস জানা ছাড়াই) আমাদের উপকথায়, লোককথায়, এমনকি মুখের ভাষায়। এরকম হাজার হাজার শব্দ থেকে মাত্র গুটিকয় উদাহরণ হিসেবে এখানে দেয়া হল।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে / নারদের ঢেঁকি
ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ ছিল একেবারে প্যাঁচালো মানুষ, থুক্কু, মুনি। তাঁর বাহন ছিল ঢেঁকি। দেবতা, মানুষ কিংবা অসুর সমাজে যখনি কোন প্যাঁচ কষার কিংবা ভাঙ্গানোর প্রয়োজন হত, নারদ সেখানেই ঢেঁকিযোগে হাজির হতেন। তাঁর কথা ভেতরে ও বাহিরে এমনি দ্বৈত-অর্থ বহন করত যে, তিনি যখনই কারো পক্ষে কথা বলেছেন, তখন সে পক্ষও নিশ্চিত নয় আখেরে নারদ কোন পক্ষের। মুলত তিনি ওকালতি করতেন ( এবং সভয়ে বলা যায় সেই পৌরাণিক কাল থেকেই এই পেশাটা জেনেশুনে ভাল ও মন্দ দুদিকের পক্ষেই প্যাঁচ খেলে এসেছে )।
যা হোক, নারদ মুনি যে শুধু দেবতাদের পক্ষ নিয়ে মানুষ বা অসুর সমাজেই প্যাঁচ খেলেছেন এমনটা নয়। যখন নিচে অর্থাৎ মর্ত্যধামে কোন কাজ থাকত না, সময়ে সময়ে তিনি স্বর্গধামে ঢেঁকিযোগে গিয়ে দেবসমাজেও স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, অর্থাৎ প্যাঁচ লাগিয়েছেন।
তাঁর এই 'কলহসংগঠক' স্বভাব থেকেই এসেছে - ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ এবং 'নারদের ঢেঁকি'।
মান্ধাতার আমল
সূর্যবংশ তথা রামায়নের রামচন্দ্রের বংশের এক অতি প্রাচীন পূর্বপুরুষ যুবনাশ্ব এবং কালনিমির সন্তান এই মান্ধাতা। দীর্ঘদিন ধরে সন্তান না হওয়ায় মহারাজা যুবনাশ্ব পেরশানিতে পড়ে গেছেন। যোগীমহাপুরুষেরা পরামর্শ দিল এক 'অনিবার্য ফলদায়ক যজ্ঞ' করতে। সে অনুসারে তিনি আয়োজন করলেন। যোগীমহাপুরুষেরা যজ্ঞ শেষে পাওয়া পবিত্র জল একটা পাত্রে নিয়ে রেখে আসলেন রাণির কক্ষে। সে পানি পরদিন প্রত্যুষে পান করলেই গর্ভে পুত্রসন্তান আসবে।
মহারাজা কোন কারণে মহারাণি কালনিমির কক্ষে প্রবেশ করে জল পান করতে গিয়ে ভুলক্রমে সেই যজ্ঞের জলটাই খেয়ে বসলেন। ব্যস ! যজ্ঞের জল তার অনিবার্য ফল দেখাল দশ মাস পরে। রাজা যুবনাশ্ব এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। আদি পিতা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন নাম থাকলেও আদি গর্ভধারক পিতার তালিকায় যুবনাশ্বের আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নাই। সেই পিতৃপ্রসূত পুত্রই মান্ধাতা।
এটা এত প্রাচীন কালের ঘটনা যে, অধিকাংশ মানুষই এ কাহিনি জানে না। তাই বেশি আগের কিছু বুঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘মান্ধাতার আমল’ শব্দটি।
ওঝার ব্যাটা বনগরু (বাতির নিচে অন্ধকার)
ওঝা বলতে এখন আমরা সাপে কাটা রোগির গ্রাম্য চিকিৎসককে বুঝি, কিন্তু এটি আদতে ছিল ব্রাহ্মণ উপাধি। যেমনঃ বাংলা রামায়নের রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা জাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, সর্পবিশারদ নন।
‘ওঝা’ এসেছে ‘উপাধ্যায়’ বা শিক্ষক শব্দ থেকে। বর্তমান সময়ে ব্রাহ্মণের সন্তান জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হয়। কিন্তু প্রাচীন বর্ণপ্রথায় জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারত না। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রমাণ করে তবে সে উপাধি পেতে হত। যেমনঃ “ঐতরেয়া ব্রাহ্মণ” এবং “ঐতরেয়াপনিষদ”-এর লেখক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন শুদ্র দাসপুত্র। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণ বিশ্রবা মুনির পুত্র রাবন কিন্তু স্বভাব ও কর্মফলে রাক্ষস রূপে পরিচিত হয়েছিল, জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নয়।
আবার, বনগরু বলতে বুনোষাঁড় বা মহিষকে বুঝানো হয় যার মাথায় গোঁয়ারের মত স্বভাব ছাড়া আর কোন বিদ্যা নেই। তাই, জ্ঞানীর মূর্খ সন্তান বুঝাতে বিশেষ করে রাবণের উদাহরণ থেকেই ‘ওঝার ব্যাটা বনগরু’ প্রবাদ এসেছে।
হরিহর আত্মা
বিষ্ণু(হরি)আর শিবের(হর)মিলিত রূপ। এমনিতে বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি-পুজা-মন্ত্র-উপাসনা এমনকি ধারাও ভিন্ন। অথচ, পুরাণের কোথাও এও বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির কল্যাণার্থে শিব বিষ্ণুর হৃদয়, বিষ্ণু শিবের। অর্থাৎ, দুই দেহে এক প্রাণ।
এরকম অন্তরঙ্গতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয় - ‘হরিহর আত্মা’।
ধ্রুব সত্য
চরম সত্যের উদাহরণ বোঝাতে আমরা বলি ধ্রুব সত্য। পৌরাণিক রাজা উত্থানপাদ তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুরুচিকে প্রথম স্ত্রী সুনীতির চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। সুরুচির প্ররোচনায় সুনীতিকে তিনি বনবাস দেন। একদিন বনে শিকার করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে রাজা সুনীতির কুটিরে হাজির হন এবং সহবাস করেন। সে সন্তানই ধ্রুব।
শিশুপুত্র ধ্রুব সৎভাইদের সঙ্গে সিংহাসনে বাবার কোলে বসতে চাইলে সৎমা বাধা দেয়। তখন মাতা সুনীতির পরামর্শে ধ্রুব শ্রীহরির ভজনা করে এই অধিকার লাভ করতে কঠিন তপস্যা শুরু করেন। সাধনায় অবিচলিত থেকে ধ্রুব বিষ্ণুকে নামিয়ে আনলেন। বিষ্ণু বর দিতে চাইলে ধ্রুব কামনা করলেন বিষ্ণুর চরণে যেন তিনি আশ্রয় পান, কারণ, বিষ্ণূই ধ্রুব সত্য। বিষ্ণু তাকে সকল তারা ও গ্রহের উপরে ধ্রুবলোকে ঠাঁই দেন। উত্তর আকাশে অবিচল ধ্রুবতারা এই অবিচল সত্যনিষ্ঠারই প্রতীক।
ধ্রুবতারা যেমন প্রতিদিন দেখা দিবেই, তেমনি চিরসত্যের কিছু বুঝাতে ব্যবহার হয় - 'ধ্রুব সত্য'।
ধুন্ধুমার কাণ্ড
আজকালকার দিনে যেমন ফেসবুকে যারেতারে না দেখেই শুধু ফ্রেন্ড করে ফেললে মাঝেমাঝে সমস্যায় পড়তে হয়, দেবতারাও তেমনি তখনকার দিনে ভক্তের প্রার্থনার অ্যাড রিকুয়েস্ট পেলেই এক্সেপ্ট করে ফেলতেন, আর প্রায়ই বিপদে পড়তেন। এরকম প্রচুর উদাহরণ আছে দেবতাদের ফেসবুকেও।
ধুন্ধু ছিল এক অসুর। ব্রহ্মা তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বর দেন যে, কোন অস্ত্রের তেজ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ব্রহ্মার বরেই অসীম শক্তিশালী হয়ে সে ত্রিভুবনে অত্যাচার শুরু করে। তাকে হত্যা করা সহজ ছিল না, কারণ তাকে যে অস্ত্রই মারা হতো, ব্রহ্মার বরে সে সব অস্ত্র হজম করে ফেলত আর সে অস্ত্রের তেজ মুখ দিয়ে বের করত আগুনের হলকা হিসেবে।
ইক্ষ্বাকু বংসের রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে ধুন্ধু কুবলাশ্বের সহস্র পুত্রকে আগুনের হলকায় পুড়িয়ে মারে। তখন ঋষি উতংকের সহায়তায় কুবলাশ্ব ধুন্ধুর দেহকে জলের ধারা দিয়ে ভিজিয়ে দেন, এবং তারপর ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে তাকে ভস্ম করে ফেলেন। ধুন্ধুকে মারার ভয়াবহ এ যুদ্ধ থেকেই এসেছে ‘ধুন্ধুমার কান্ড’।
রক্তবীজের ঝাড়
চন্ডীপুরাণে আছে, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসীম বলশালী অসুর দেবতাদের স্বর্গছাড়া করেছিল। তখন দেবতাদের কাতরতায় দুর্গা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য কৃষ্ণবর্ণ কালিকা রূপের সৃষ্টি করলেন। দুর্গা ও অসুরদের যুদ্ধে প্রথমে মারা পড়ল সেনাপতি ধুম্রলোচন আর চণ্ডমুণ্ড।
এরপর আসে রক্তবীজ নামে এক অসুর। এর আবার এক রহস্য আছে। দেবতাদের বরে তার রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়লেই সে ফোঁটা থেকে আরেক অসুর জন্ম নিবে ! দুর্গা পড়লেন মহাফাপরে - কয়জনরে মারবে ! একজন মরার আগেই পরের জনের ক্লোনিং সম্পূর্ণ ! তখন দুর্গা কালীকে বললেন,” তুমি মুখের হা বড় করো। রক্তবীজের প্রতিটা রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা খেয়ে ফেলো।“
এভাবেই ‘রক্তবীজের ঝাড়’ (যা শেষ হয় না এমন) নিধন হল। আর আমরা পেয়ে গেলাম আরেকটি প্রবাদ।
কালনেমির লঙ্কাভাগ
রামের সাথে যুদ্ধ লড়তে রাবণ সহায়তা চাইলেন মামা কালনেমির কাছে। কালনেমি দেখল এই সুযোগ। যুদ্ধ শুরুর আগেই হিসেব করা শুরু করলেন এ যুদ্ধে জিতলে রাবণের কী কী লাভ আর সে লাভে কিভাবে হিসসা নেয়া যায়। হিসাব শেষে ভাবলেন, সীতার ভাগ দরকার নেই, কিন্তু সোনার লঙ্কা ছাড়ি কেন ? তাই যুদ্ধ জয়ের পর লঙ্কার ভাগাভাগিটা আগেই ঠিক করে নিলেন রাবণের সাথে দরকষাকষি করে।
যুদ্ধের ফলাফলতো সবারই জানা। সেখান থেকেই এসেছে ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’। অর্থাৎ, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
রাবণের চিতা
রাবণহত্যার পর রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী রামকে প্রণাম করলে রাম সীতাজয়ের খুশিতে মন্দোদরীর ভোটার আই,ডি কার্ডে স্বামীর নাম না দেখেই বলে বসলেন - ‘চির সৌভাগ্যবতী হও’।
ভগবান রামের কথা মানেই তো দেব-সংবিধান। তাহলে তো রাবণ আবার বেঁচে উঠবেন। তখন মন্দোদরীর স্বামীর পরিচয় জানতে পেরে রাম তাড়াতাড়ি সে সংবিধানে সংশোধনী আনলেন। বললেন, তার স্বামীর চিতা চির-অনির্বাণ থাকবে। অর্থাৎ, চোখের সামনে স্বামীর স্মৃতি চির জাগরুক থাকবে মন্দোদরীর।
তবে এ আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে রাম যে রাবণ বা তার স্ত্রীর জন্য আরাম বয়ে এনেছেন, তা কিন্তু মনে হয় না। কারণ রাবণও সারাক্ষণ চিতায় জ্বলছে আর তার স্ত্রীও ভুগছে সে যন্ত্রণায়। এবং মনে হয় অভিশাপজাতীয় বোধ থেকেই মনের মধ্যে সবসময় জ্বলতে থাকা আগুন বুঝাতে ‘রাবণের চিতা’ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করা
হস্তিনাপুরের মহারাজ বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সত্যবতী ভীষ্মকে বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে বংশধর সৃষ্টি করতে বলেন। কিন্তু ভীষ্ম স্বীয় প্রতিজ্ঞার কারণে তাতে অসম্মত হন। তখন সত্যবতীর অনুরোধে মহর্ষি বেদব্যাস অম্বিকার গর্ভে সন্তান দিতে রাজী হন।
যদিও বেদের ঋষিরা যজ্ঞ করেই সন্তান উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দিতেন, কিন্তু বেদব্যাস মন্ত্র জানা সত্ত্বেও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কোন রিস্কে যান নাই। তিনি স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলেন।
সহবাসকালে মুখের সামনে বেদব্যাসের ঘোর কালো দেহ, লম্বা জটা-দাড়ি এবং বিস্ফারিত চোখের দীপ্তিতে ভয় পেয়ে অম্বিকা চোখ বুঁজে ফেলেন। সে দোষে অম্বিকার গর্ভের সন্তান ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিহীন হন। যেহেতু অন্ধ রাজা হতে পারবে না, তাই ব্যাসদেব অম্বালিকাতেও একই উদ্যোগ নিলেন।
এবার অম্বালিকা সচেতন ছিলেন। চোখ বন্ধ করে ফেলেন নাই ঠিক, কিন্তু অন্তহীনভাবে উপগত হতে থাকা ব্যাসের স্ফুরিত রক্ত বর্ণ অধর, দীপ্তময় চোখ আর সাদা জটাজুটধারী কালো দেহের ভয়াবহতায় তিনি ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যান। ফলে তাঁর গর্ভস্থ সন্তানও হয় ফ্যাকাশে পাণ্ডুবর্ণের – রাজা পাণ্ডু। ভয় পেলে ফ্যাকাশে হয়ে যাবার এ কাহিনি থেকেই এসেছে ‘পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করা’ কথাটি ।
পাণ্ডববর্জিত স্থান
মহাভারতের পাণ্ডবদের মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াইয়ে আর কাউকে এত ভ্রমণ করতে হয়নি। কখনো রাজসূয় যজ্ঞের জন্য, কখনো রাজ্যজয়ের জন্য, কখনো বনবাসের জন্য, কখনো অজ্ঞাত বাসের জন্য তারা শুধুই এরাজ্য থেকে ও রাজ্যে ঘুরেছেন। তারা হস্তিনাপুরের সীমানা এবং তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত সকল রাজ্য থেকে দূরে থাকার জন্য বহু পথ পাড়ি দিয়েছেন। বিশেষ করে চূড়ান্ত অজ্ঞাতবাসের সময় নাম-পরিচয় গোপন রাখতে তাঁরা সম্ভব-অসম্ভব অনেক স্থানে আশ্রয় নিতে গিয়েছেন। শুধু এড়িয়ে গেছেন সে স্থানগুলো যেগুলো জনপদের সাথে সংযোগহীন আর সভ্যতা বিবর্জিত। এরকম দুর্গম ও অগম্য স্থান বুঝাতেই ব্যবহৃত হয় ‘পাণ্ডববর্জিত দেশ’, অর্থাৎ যা এমনকি পাণ্ডবদেরও বর্জনের উপযুক্ত।
কেষ্টবিষ্টু আর কলির কেষ্ট
শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এক অসাধারণ যুগপুরুষ। অবতার বা ইত্যাদি ধার্মিক সত্ত্বার কথা না তুলেও তাঁকে স্মরণ করতে হবে এক অসাধারণ কূটনীতিক, এক দুর্দান্ত সমরবিশারদ, অত্যন্ত চতুর, প্রয়োজনে কুটিল পরিকল্পনাকারী এবং যুগশ্রেষ্ঠ দূত হিসেবে। আবার একই সাথে তাঁর প্রেমলীলাও অসাধারণ। একইসাথে দুই স্ত্রীকে সামাল দেয়া এবং তার সাথে শতশত গোপিনীকেও যথোপযুক্ত সময় দিয়ে সংসার ঠিক রাখা এক সত্যিকার কর্মীপুরুষের দুর্লভ উদাহরণ !
কৃষ্ণের উপরোক্ত চরিত্রগুণ সমাজের উপরতলায় কেউ যখন আত্নস্থ করে, তখন তার জন্য প্রযোজ্য হয় ‘কেষ্টবিষ্টু’, আর নিচের স্বভাবগুণ (!) যদি সাধনা করে, তবে সে প্রবলপ্রেমিক পুরুষের জন্য প্রযোজ্য ‘কলির কেষ্ট’।
এভাবে দাতা কর্ণ, শকুনি মামা, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, অগস্ত্য যাত্রা, কুরুক্ষেত্র, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, গজকচ্ছপের লড়াই, বালখিল্যতা ইত্যাদি অজস্র প্রবাদ-প্রবচনের সমাহার আছে আমাদের মুখের ভাষায় ও সাহিত্যের পাতায়। আর এগুলোকে জড়িয়ে আছে রামায়ণ, মহাভারত সহ অগণিত পৌরাণিক কাহিনি। মাঝেমাঝে মনে হয় এ শব্দগুলোর ব্যবহার আর এ শব্দগুলোর পেছনের কাহিনি না জানলে আমাদের ভাষাচর্চাটাও যেন অসম্পূর্ণ ঠুঁটো জগন্নাথের মত হয়ে থাকতো। ঐ দেখ, আরেকটা শব্দ বেরিয়ে এল !
বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর ধরে ধরে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব পৌরাণিক শব্দগুলোর কোনটি সরাসরি পুরাণ থেকে এসেছে; কোনটি রামায়ন-মহাভারত হয়ে, কোনটি আবার বেদ-উপনিষদের ব্যাখ্যাদানের প্রসঙ্গ থেকে এসব ছোট ছোট ব্যবহারিক শব্দের বিশাল পৌরাণিক ভিত প্রস্তুত করেছে।
অকালকুষ্মাণ্ড
ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী দু’বছর ধরে গর্ভবতী, অথচ সন্তানের জন্ম হচ্ছে না। ওদিকে পাণ্ডু একেএকে পাঁচ পুত্রের পিতা হয়ে গেছেন। অপুত্রক ধৃতরাষ্ট্রের সিংহাসন হাতছাড়া হয় অবস্থা। দুঃখে ক্ষোভে গান্ধারী নিজেই নিজের গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেললেন। গর্ভপাতের ফলে একটি কুষ্মাণ্ড বা কুমড়া আকৃতির মাংসপিণ্ড বের হয়ে এল। আর মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেল গান্ধারী অকালে এক কুষ্মাণ্ড অর্থাৎ কুমড়া প্রসব করেছেন। সেখান থেকেই এসেছে ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ শব্দটি।
অগস্ত্য যাত্রা
বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি অগস্ত্যের নামে এই ‘অগস্ত্য যাত্রা’। দেবলোকের অপ্সরা যজ্ঞমিত্রকে দেখে সুর্যের এবং উর্বশীকে দেখে বরুণের একইসাথে বীর্যপাত ঘটে। সে বীর্য গিয়ে পড়ে যজ্ঞকুম্ভে। এ দুই প্রাচীন দেবতার বীর্য হতে জন্ম নেয় দুই শ্রেষ্ঠ ঋষি বশিষ্ট ও অগস্ত্য। ঋগ্বেদ মতে অগস্ত্য তাই সূর্য ও বরুণের পুত্র। এই অগস্ত্য আবার ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু।
বিন্ধ্যপর্বতের একবার খেয়াল হল সূর্য যেমন উদয়কালে সুমেরু পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে, তাকেও তেমনি প্রদক্ষিণ করবে। তাই সে তপস্যাবলে ক্রমশ উপরের দিকে বাড়তে শুরু করে। এতে সুর্যের গতিপথ বিঘ্নিত হবার আশংকা তৈরি হল। তখন দেবতাদের অনুরোধে অগস্ত্য তার কাছে গেলেন।
গুরুকে দেখে নত হয়ে বিন্ধ্য প্রণাম করলে গুরু তাকে সোহাগ করে বললেন, “বাবা বিনু, আমি দক্ষিণে যাচ্ছি। এদিকে তোমার উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ফেরার সময় তুমি বাবা আমার বুড়ো হাড়গুলোকে তোমাকে টপকানোর পরীক্ষায় আবার ফেলো টেলো না। তাই আমি যতক্ষণ না ফিরি, তুমি একটু কষ্ট করে এভাবেই দম নিতে থাকো।“ এই বলে অগস্ত্য সেই যে গেলেন, আর সে পথে ফিরলেন না। ফলে বিন্ধ্যের আর বৃদ্ধি হল না। এ কারণেই যে যাত্রায় আর ফেরার সম্ভাবনা নেই বা কম, তাকে ‘অগস্ত্য যাত্রা’ বলে। অগস্ত্যের সে যাত্রা ছিল ১ ভাদ্র। এখনো ভাদ্র মাসের ১ তারিখে কেউ কেউ শুভ কোন কাজে কিংবা দূরের যাত্রায় যায় না।
অনামিকা
মহাদেব শিব একবার ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে চতুর্মুখ ব্রহ্মার একটা মুণ্ডু ঘাড় থেকে খসিয়ে দেন। ব্রহ্মার মুণ্ডুবিয়োগ বলে কথা! না জানি কী সেই মারাত্মক অস্ত্র! কিন্তু স্বর্গীয় ময়নাতদন্তে অস্ত্রের কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না। পরে দেব-ফরেনসিক ল্যাবে জানা গেল মহাদেব শুধু কড়ে আঙ্গুলের পাশের আঙ্গুলের খোঁচাতেই একাজ করে ফেলেছেন। মহাদেবের রাগ থামলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে সে আঙ্গুলকে অভিশাপ দিলেন,”ওরে পাপাঙ্গুল!আজ থেকে তোর কোন নাম থাকবে না।“ সেই থেকে ঐ আঙ্গুলটির নাম ‘অনামিকা’। আবার কারো নাম জানা না থাকলেও এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। (শাস্তিপ্রাপ্ত ঐ বিশেষ আঙ্গুলেই কেন বিয়ের আংটি পড়ানো হয়, বিষয়টি ভাববার মতন।)
গজকচ্ছপের লড়াই
মহাভারতের আদিপর্বের উপাখ্যান গজকচ্ছপের লড়াই। মহর্ষি বিভাবসু ছিলেন স্বভাবে বদরাগি। ঋষি হওয়া সত্ত্বেও ধনসম্পদের মায়ামোহ তিনি কাটাতে পারেন নাই। দুষ্টলোকের প্ররোচনায় মিলমিশ ভুলে গিয়ে সম্পদের ভাগ করতে বসলেন ছোটভাই সুপ্রতীকের সাথে। কিন্তু মনোমত না হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে বিভাবসু ছোটভাইকে হাতি হবার অভিশাপ দিয়ে বসলেন। সুপ্রতীকই বা ছাড়বেন কেন? বড় ভাইকে কচ্ছপ হবার অভিশাপ দিয়ে দিলেন। দুই অভিশাপই ফলে যায়। এখন হাতি আর কচ্ছপ ধনসম্পদ নিয়ে করবেটা কী? কিন্তু রাগের মাথায় সেটা আর চিন্তায় আসলো না তাদের। তারা সে অবস্থাতেই লড়াই চালিয়ে গেলেন অনর্থক এবং অবিরাম।সে থেকেই ভাই-ভাই কিংবা জ্ঞাতিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদকে ‘গজকচ্ছপের লড়াই’ বলা হয়।
চ্যালা-চামুন্ডা
পুরাণ মতে, চন্ড-মুন্ড বধের সময় দেবী দুর্গার ভ্রূকুটি ললাট থেকে চামুন্ডা দেবীর উদ্ভব। দেবীর হাতে অস্ত্র, দন্ড । দেহের বর্ণ গাঢ় নীল পদ্মের মত। দেহ অস্থিচর্মসার। দীর্ঘ রক্তবর্ণ জিহ্বা, বিকটাকার দাঁত। জটাধারী আর বাঘের চামড়াপরিহিতা এই দেবীর সঙ্গিসাথীরাও যেমন তেমন কেউ নয়- ডাকিনী, প্রেতিনী, শাঁখিনী এরা। এমনিতে দেবী নিজেই বিকটাকার মূর্তিধারী, তায় সেরের উপর সোয়া সেরের মত তার সাথে যোগ হয়েছে রক্তহিমকরা ভয়ংকর চেহারা আর স্বভাবের সাথীগুলো। এখান থেকেই মূল নেতা বা ষণ্ডার সাথী বা চ্যালাদের বুঝাতে এসেছে ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ শব্দটি। (ইংরেজিতে হলে ব্যাকরণসম্মতভাবে বলতে পারতাম ‘দ্য চ্যালাস অব দি চামুণ্ডা’।)
ঠুঁটো জগন্নাথ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার পরমভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্মের ভক্তিতে খুশি হয়ে তাঁকে দেখা দেন এবং একটা কাঠের উপর তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন, যে মূর্তিতে তিনি নিজেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন। কাঠ তো পাওয়া গেল, কিন্তু উপযুক্ত কারিগর পাচ্ছিলেন না। একদিন এক রহস্যময় ব্রাহ্মণ এসে জানাল সে ছুতোরের কাজ জানে। কিন্তু সে ব্রাহ্মণ আবার এক শর্ত জুড়ে দেয়। শর্ত হল - সে এক বন্ধ ঘরে কাজ করবে এবং কাজ শেষের ঘোষণা সে নিজে না দেয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বিরক্ত করতে বা দেখতে আসতে পারবে না !
রাজা শর্ত মেনে নিলে কাজ শুরু হল। সবাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের ঠক ঠক শব্দ শোনে আর কৌতূহলে মরে। কিন্তু উঁকি দিতে পারে না। একদিন হঠাৎ ভেতর হতে কোন শব্দ আসা বন্ধ হয়ে যায় ! না কাঠ ঘসার, না কাঠ খোদাইয়ের, কোন শব্দ নাই। সবাই ভাবল ব্রাহ্মণ আবার মরে টরে গেল কিনা ! কারণ, এর মধ্যে খাবার খেতেও ব্রাহ্মণ বাইরে আসে নাই। ছটফটে থাকতে না পেরে সবাই দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ল। গিয়ে দেখে ভেতরে কেউ নেই, শুধু পড়ে আছে হাত-পা ছাড়া এক কাঠের জগন্নাথের মূর্তি। পরে জানা গেল সে ব্রাহ্মন ছিল আর কেউ নয়, স্বয়ং স্বর্গের স্থপতি বিশ্বকর্মা। শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় তিনি অসম্পূর্ণ জগন্নাথ রেখে আবার ফেরত গেলেন। রাজা জানতে পেরে বুক চাপড়ে কাঁদেন আর হায় হায় করেন,”এ ঠুঁটো জগন্নাথ নিয়ে আমি কী করবো? একে আমি ফেলে দিতে পারবো না, এতে তো পুজোও হবে না!” তখন থেকে এরকম অসম্পূর্ণ কাজ যা থেকে কোন ফল আসবে না, আবার কাজটি শেষও করা যাবে না – এমন বুঝাতে এসেছে – ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ শব্দটি।
বিদুরের খুদ
বেদব্যাসের রূপঘটিত কারণে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ আর পাণ্ডু ফ্যাকাশে হওয়ায় সত্যবতী এক সুস্থ ও সুদর্শন বংশধরের আশায় পুণরায় অম্বালিকাকে বেদব্যাসের কাছে পাঠান। কিন্তু অম্বালিকা একবার ‘ন্যাড়া’ হয়েছেন, দ্বিতীয়বার কি আর বেদব্যাসতলায় যাবেন? তিনি এবার শূদ্রবংশীয় এক রূপসী দাসীকে নিজের মত সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেদব্যাস ত্রিকালজ্ঞ ঋষি, বর্তমানের পাশাপাশি অতীত-ভবিষ্যতও দেখতে পান। আশ্চর্যের ব্যাপার, সদ্যমাত্র অতীতে অম্বালিকাকে এত ঘনিষ্ঠ পেয়েও বেদব্যাসের নজর কতটুকু ব্যাসার্ধে আটকে ছিল কে জানে, দাসীতে আর অম্বালিকায় তিনি কোন ফারাক পেলেন না! দাসীকেই অম্বালিকা ভেবেই উপগত হলেন। বেদব্যাসের ঔরসে সে শূদ্র দাসীর গর্ভে জন্ম নিলেন বিদুর।
পূণ্যাত্মা বলে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন বিদুর। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বন্ধের জন্য পাণ্ডবদের দূত হয়ে হস্তিণাপুর আসলেন কৃষ্ণ। দূর্যোধনের আয়োজনের বিশাল রাজভোগ উপেক্ষা করে কৃষ্ণ গেলেন বিদুরের কাছে মধ্যাহ্ন ভোজে। তখন বিদুরের আহার শেষ এবং একেবারে খুদের মত যতসামান্য আহারই ছিল তার ঘরে। কিন্তু সে সামান্য নগণ্য আহারেই তৃপ্ত হলেন কৃষ্ণ, মনে হচ্ছিল যেন ঠেসে রাজভোগ খেয়ে ফেলেছেন। সে থেকেই সামান্য কিন্তু আন্তরিক দান ‘বিদুরের খুদ’ নামে কথিত।
রোমহর্ষক / লোমহর্ষক
পুরাণ মতে, রোমহর্ষণ বা লোমহর্ষণ হলেন বেদব্যাসের অন্যতম প্রধান শিষ্য। বেদ বিভাজনের পর বেদব্যাস রোমহর্ষণকে ইতিহাস ও পুরাণ পাঠের শিক্ষা দান করেন। গুরুর আদেশে তিনি আবার বাকি ঋষিদের এ পুরাণ কীর্তণ করতেন। বেদ-পুরাণ পাঠের সময় উত্তেজনায় তাঁর গায়ের পশম(রোম/লোম) হর্ষিত হচ্ছিল অর্থাৎ শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকেই কোন কারণে উত্তেজনায় গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসেছে ‘রোমহর্ষক/লোমহর্ষক’।
সংজ্ঞা হারানো / সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া
আদিদেব সূর্যের স্ত্রী ছিলেন সংজ্ঞা। স্বামীর তেজ কোনমতে সহ্য করে সংসারটা মোটামুটি চালিয়েই নিচ্ছিলেন। কিন্তু দিনদিন সে তেজ বাড়তে থাকায় একসময় “দুচ্ছাই, নিকুচি করি” বলে চলে গেলেন পিতৃগৃহে। যাবার আগে নিজের ছায়া সৃষ্টি করে রেখে গেলেন স্বামীর জন্য। সুর্যদেব সারা দুনিয়া আলোকিত করলেও এখানে নিজেই রয়ে গেলেন অন্ধকারে। ছায়াকেই সংজ্ঞা ভেবে সংসার করতে লাগলেন। জানতেই পারলেন না যে তিনি ‘সংজ্ঞা হারিয়েছেন’ (অর্থাৎ এ জ্ঞান তাঁর ছিল না)। পরে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি জানতে পারলেন তাঁর তেজের কারণে তাঁর স্ত্রী পালিয়ে গেছে। তখন তিনি বিশ্বকর্মাকে দিয়ে নিজেকে সাইজ করে নিলেন। সংসার টিকিয়ে রাখার মত সহনীয় পর্যায়ে এলে তাঁর স্ত্রী আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে। অর্থাৎ সূর্যদেব ‘সংজ্ঞা ফিরে পান’। সুর্যদেবের সে স্ত্রী হারানো আর পাওয়া থেকেই আমরা পেয়েছি ‘সংজ্ঞা হারানো’ আর ‘সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া’।
ষড়যন্ত্র
তন্ত্র সাধনায় ছয়টি আভিচারিক প্রক্রিয়া বা বন্ধন পালন করা হয়। এগুলো হল- মারণ (প্রাণ হরণ করা), মোহন (চিত্তবিভ্রম ঘটানো), স্তম্ভন (যাবতীয় প্রবৃত্তি নষ্ট করা), বিদ্বেষণ (অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা), উচ্চাটন (স্বদেশ/স্বজাতি/পরিবারের প্রতি বিভ্রম ঘটানো), বশীকরণ (বশে আনা)। এ ছয় প্রক্রিয়া্র লক্ষ্যই হল নিজের স্বার্থ উদ্ধার আর অন্যের ক্ষতি সাধন। এ ছয় বন্ধনপ্রক্রিয়া থেকেই ক্ষতিকর পরিকল্পনা অর্থে এসেছে ‘ষড়যন্ত্র’ কথাটি।
এরকম অজস্র ঘটনাসম্ভূত প্রবাদ আছে আমাদের কাছে। আবার কাহিনি এক অথচ প্রবাদের ব্যবহার উল্টো, এমনও আছে। যেমন- ‘রূপে কার্তিক’।
অনেকেই রূপবান পুরুষ বুঝাতে বলে ‘কার্তিকের মত রূপ’। অথচ কোন পুরাণেই কার্তিকের চেহারা সুন্দর ছিল এমনটা পাওয়া যায় না। বরং কার্তিকের মুখ ছয়টি ছিল বলে জানা যায়। আবার আরেকটি কথা - এতই যদি রূপ থাকত, তবে তার বিয়ের জন্য পাত্রী পাওয়া যায়নি কেন? ( সেনার পতি হওয়া নিয়ে মতান্তর আছে )
শিবের মত পিতা ( যদিও শ্মশানে থাকা শ্বশুরের যৌতুক হিসেবে ছাই আর গাঁজা ছাড়া আর কীইবা দেয়ার মুরোদ থাকে ? ), পার্বতীর মত মাতা ( অবশ্য যে শাশুড়ি ক্ষেপলে চন্ডী-চামুন্ডা, তার সাথে এক সংসারে হাঁড়ি ঠ্যালার ইচ্ছা কোন পুত্রবধূরই বা থাকে ? ), গণেশের মত সিদ্ধিদাতা ভাই ( হতে পারে এত বড় শুঁড়ের ফাঁকে কুতকুতে চোখে কীইবা দেখা যায় ? ) - বায়োডাটায় ফ্যামিলি স্ট্যাটাসের ঘরে এমন হাই রেফারেন্স সত্ত্বেও কার্তিকের মেয়ে জুটল না!
সবচে’ হতাশ ব্যাপার - কার্তিকের নিজের বাহন ময়ূরের হাজার হাজার চোখ। অথচ এ ‘ঘটক পাখি ভাই’ এত চোখ নিয়েও দুনিয়া জুড়ে একটা পাত্রী খুঁজে পেল না! অথচ আমাদের প্রবাদে রূপবান পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি ‘রূপে কার্তিক’ কথাটি।
এরকম হাজার হাজার উদাহরণে যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, পুরাণ শুধু আমাদের দিয়েই গেছে তা কিন্তু নয়, অনেক প্রবাদ আমাদের লোককথা এবং পরিপার্শ্ব থেকেও পৌরাণিক চেহারা নিয়েছে। যেমনঃ ‘সাক্ষি গোপাল’, কিংবা ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ ইত্যাদি।
সাক্ষি গোপাল
পুরীতে তীর্থ করতে এসে এক প্রৌঢ় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এক তরুণ সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলে। খুশি হয়ে প্রৌঢ় নিজের মেয়ের সাথে তরুণটির বিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে প্রৌঢ়টি সে প্রতিজ্ঞা ভুলে যান। তরুণটি তাকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন ঐ প্রতিজ্ঞার কোন সাক্ষি আনতে পারলে তিনি এ বিয়ে দিবেন। তরুণটি জগন্নাথ দেবকে অনুরোধ করল সাক্ষি হয়ে গ্রামে যেতে। জগন্নাথ দেব রাজি হলেন এই শর্তে যে, তিনি তরুণটির পিছন পিছন যাবেন নূপুর পায়ে এবং তরুণটি পেছনে তাকাতে পারবে না। যাত্রা শুরু হল। কিছুদূর যাবার পরেই কৃষ্ণের মাথায় দুষ্টামি বুদ্ধি চাপল। তিনি নূপুর চেপে ধরে হাঁটতে লাগলেন। নূপুরের শব্দ থেমে যাওয়ায় তরুণটি ভাবল পেছনে কেউ আসছে না। সে ফিরে তাকাল। শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। সেই থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে কিংবা চোখের সামনে অঘটন ঘটতে দেখেও নিশ্চেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে বলে ‘সাক্ষি গোপাল’। পুরীর সন্নিকটে সমুদ্রতীরে সাক্ষীগোপাল কৃষ্ণের মূর্তি ও মন্দির আজো সে লোককথার সাক্ষ্য বহন করছে।
হরি ঘোষের গোয়াল
অলস ও নিষ্কর্মা লোকজনের কোলাহলপূর্ণ আড্ডাকে লোকে বলে হরি ঘোষের গোয়াল। নদীয়ার গোপ হরি ঘোষের গোশালায় ছিল পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠী। গরুর ডাক, ঘন্টার ধ্বনি, ছাত্রছাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেচি সব মিলিয়ে এক মহা হুলুস্থূল সেখানে। এই কোলাহল থেকে এই বাগধারার উৎপত্তি। মতান্তরে, কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলের হরি ঘোষের অতিথিশালায় বিনা খরচে থাকা-খাওয়ার সুযোগে আশ্রিত বহু নিষ্কর্মা ব্যক্তির কোলাহল থেকে বাগধারাটি এসেছে।
শুধু এটুকুই নয়, লোকসাহিত্য থেকে পৌরাণিকীতে রূপ নিয়েছে এমন বিশাল কাহিনিও আছে আমাদের। যেমনঃ পদ্মা পুরাণ বা মনসা মঙ্গল। যেহেতু ‘পদ্মা পুরাণ’ মূল পুরাণের মধ্যে পড়ে নি, স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় নয়।
কিন্তু যে পুরাণে সাপ আর মানুষের আজন্ম বিবাদ শুরু, যে পুরাণ থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম হতে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন রহস্যের মায়াজাল ছড়িয়ে সাপের আনাগোনা, যে বিশাল ‘পদ্মা পুরাণে’ সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে শ্রীহরি-শিব-পার্বতী-মনসা হয়ে আমাদের নিজেদের ঘরের বেহুলা-লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর সব একাকার হয়ে গেছে - তাকে পাশ কাটিয়ে যাই বা কিভাবে ?
বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে পুরাণের প্রভাব পর্ব সমাপ্ত। পরের পর্বে পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল নিয়ে কথা হবে।
রেফারেন্স
বাগধারা সংগ্রহ - শৈলেন চক্রবর্তী, প্রবাদের গল্প - বন্দনা গুপ্ত ও পৃথ্বিশ গুপ্ত, প্রবাদের আড়ালে - বন্দনা গুপ্ত, বাংলা শব্দের পৌরাণিক অভিধান - ডঃ মোহাম্মদ আমীন, বাংলা শব্দের উৎস অভিধান - ফরহাদ খান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন