ছোটগল্পে শিক্ষাভাবনা এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটিকা’

 নিবন্ধ

ছোটগল্পে শিক্ষাভাবনা এবং সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটিকা’

ড.ফজলুল হক সৈকত

শিল্প-সাহিত্য সমাজ এবং মানুষের মানচিত্র প্রকাশ করে- কখনো প্রত্যক্ষরূপে কখনো বা প্রচ্ছন্নভাবে। বাংলা ছোটগল্পে শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার যে ছবি আভাসিত হয়েছে, তা থেকে আমরা প্রয়োজনীয় কিছু পাঠ গ্রহণ করতে পারি, দেখে নিতে পারি আমাদের গলদগুলো।

পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্যও তা হতে পারে দিক-নির্দেশক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ঔপন্যাসিক, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) তাঁর ‘পাঠশালার পণ্ডিতমশায়’ গল্পে স্কুলশিক্ষকের মিথ্যা-পাণ্ডিত্যের অহমিকা আর শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অপ্রাসঙ্গিকতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন কৌতুকাবহ কাহিনির মাধ্যমে। ব্যাকরণের প্রতি পণ্ডিতমশায়ের গভীর অনুরাগ আর সীমিত জ্ঞাননির্ভর আভিজাত্য যে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ঐতিহ্য, তার পরিচয় মেলে বঙ্কিমের এই গল্পটির ক্যানভাসে। ভাষার প্রতি আমরা যে কত উদাসীন এবং শিক্ষাপদ্ধতিও যে বাংলাভাষাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করেনি, তা আমরা গল্পকারের উপলব্ধি থেকে জানতে পারি। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন (১৮৬০-১৯৩৯)-এর ‘আরে অর্থাৎ’ গল্পটি আমাদেরকে এই পাঠ দেয় যে, শিক্ষককে অবশ্যই ভাষা-প্রয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হয়। কথা গুছিয়ে বলতে না-পারা কিংবা কথার মাঝে বারবার অপ্রয়োজনীয় ও বিরক্তি-উদ্রেককারী শব্দ বলার অভ্যাসের কারণে শিক্ষকের জীবনে কী দুর্গতি নামতে পারে, তার উদাহরণ এই গল্পটি। নামকে বিকৃত করে অথবা অন্য কোনো ‘বিকৃত’ নাম দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়ের মধ্যেই বিরাজ করতে দেখা যায়। বিশ্ববিশ্রুত ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এ রকম একটি পরিস্থিতির সাথে গল্প-পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘গিন্নি’ গল্পে। পশুত্বের ওপর দেবত্বের বা কল্যাণবোধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা- এই নিরেট সত্য উপলব্ধির স্বচ্ছ প্রকাশ দেখি যোগীন্দ্রনাথ সরকার রচিত (১৮৬৬-১৯৩৭) ‘জয়-পরাজয়’ গল্পে। বিদ্যাপীঠে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতিবছর প্রাণ দিচ্ছে বহু শিক্ষার্থী; সেশনজটে আটকে পড়ে জীবন থেকে ছিটকে পড়ছে হাজার হাজার কর্মঘন্টা; হতাশা, ক্লান্তি আর অবসাদ দিন দিন গ্রাস করছে তরুণসমাজকে। কখনও কখনও বিপথেও ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের রূপকথা-ব্রতকথার অসাধারণ সংগ্রাহক-সংকলক ঠাকুরমা’র ঝুলিখ্যাত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র (১৮৭৭-১৯৫৭)-এর ‘অখিলেশ’ গল্পটি উল্লেখযোগ্য। বাংলাসাহিত্যে রম্যরচনার জন্য বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) তাঁর ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’ গল্পে শিক্ষার্থীদের পাঠে আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক ফলাফলের ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদানের রীতির কথা তুলে ধরেছেন। তৎকালীন ভারতবর্ষে এবং বর্তমান বাংলাদেশে শিশুর ইচ্ছা ও ঝোঁক অনুযায়ী তার লেখাপড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করার রীতি কিংবা নীতি কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। যে হতে চায় শিল্পী, তাকে আমরা ডাক্তার বানিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি কিংবা শিক্ষক হতে চাওয়া পুত্র বা কন্যাকে বানাই ইঞ্জিনিয়ার অথবা পাইলট। শিশুসাহিত্যিক হেমন্তকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) তাঁর ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন গোয়েন্দা হতে-চাওয়া-বালককে সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষা গিলতে ঠেলে পাঠানোর অশুভ পরিণতি।


পিছিয়ে-পড়া গ্রামীণ পরিবারগুলো যদিও পারিবারিক আয়-ব্যয়, জমিজমা, ফসল-ফলাদি, ধার-দেনা-পাওনা প্রভৃতির হিসাব-নিকাশের জন্য শিক্ষা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, কিন্তু রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা এবং কাদাজল ও ধূলাবালির পথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য রীতিমতো এক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৫০) বলছেন সেই অসুবিধার কথা, তাঁর ‘হারুন-অর-রশীদের বিপদ’ নামক গল্পে। ‘আদু ভাই’ গল্পটির সাথে বাঙালির বিশেষ পরিচয় আছে। সম্ভবত এটিই বাংলাসাহিত্যে সর্বাধিক আলোচিত স্কুল-বিষয়ক গল্প। কোনো শিক্ষার্থী একই শ্রেণিতে দীর্ঘকাল লেখাপড়া করতে থাকলে ‘আদু ভাই’ উপনামে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য বর্তমান বাংলাদেশে সেশনজট নামক যন্ত্রণাও অনেককে তথাকথিত আদুভাই করে তুলছে; জাতির মাথায় চেপে বসছে অবমাননার ভার। ‘আদু ভাই’ গল্পটির রচয়িতা প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৮৯)। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)-এর ‘হেডমাস্টার’ গল্পে স্থান পেয়েছে শিক্ষার্থী-আন্দোলন, ক্ষমতার লোভ ও দলবাজি, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিষয়ক চিন্তার পার্থক্য, লেখাপড়ার চেয়ে টাকাকড়ি উপার্জনের নেশায় পেয়ে-বসা-প্রবণতা, শিক্ষা-সম্পূরক কার্যাবলি বিষয়ে ভিন্নমত, ত্যাগের চেয়ে ভোগের নীতিকে মান্য করার আধুনিক চিন্তাধারা আর পুরনোর ওপর নতুনদের অনাস্থা এবং সবকিছুকে পায়ে দলে বিজ্ঞানের গতিতে জীবনের যাত্রাপথকে সামিল করার বাসনা। বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯) ‘যোগেন পণ্ডিত’ গল্পে স্কুলশিক্ষকের আদর্শ, ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষার্থীদেরকে শাসন ও স্নেহ করার প্রবণতার কথা প্রকাম করেছেন; এই কাহিনিতে খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের প্রাসঙ্গিকতা। পাশাপাশি নতুন যুগের পরিবর্তনের হাওয়া পুরনো ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার গায়ে যে চপেটাঘাত হেনেছে, তার ছবিও আভাসিত হয়েছে। কাহিনির ক্যানভাসে দেখা যায়, যোগেন পণ্ডিত বিদ্যালয়ে পাঠদান করতে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেন; পড়া না পারলে বেতও মারেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭০) শিক্ষকদের নেতিবাচক প্রবণতা আর আন্তঃস্কুল মারামারি প্রতিযোগিতার চিত্র তুলে ধরেছেন ‘জেনারেল ন্যাপলা’ গল্পে। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬) রচিত ‘আমাদের সেকেন্ড পণ্ডিত’ গল্পটিতে প্রকাশ পেয়েছে শিক্ষকের বিদ্যাস্বল্পতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, টাকাকড়ির প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁক প্রভৃতি বিষয়; আর আছে ভাষাদক্ষতার প্রসঙ্গ। শিক্ষককে সম্মান এবং সম্মানী দিতে আমাদের যে অসীম কার্পণ্য- সে কথাও পরিবেশিত হয়েছে শৈলজা’র গল্পটিতে। এছাড়া শিক্ষা-পরিসর, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের নানান প্রবণতা আর বাস্তবতার নিরিখে কিছু তথ্য ও পরামর্শ পাওয়া যাবে সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯০৯-১৯৬৯), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫), আশালতা সিংহ (১৯১১-১৯৮৩), সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২), শঙ্খ ঘোষ (জন্ম : ১৯৩২), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২), আমজাদ হোসেন (জন্ম : ১৯৪২) প্রমুখ গল্পনির্মাতার কল্পনাবিন্যাসে।

আমরা জানি, রম্যরচনার জন্য বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলী (জন্ম: ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪; মৃত্যু: ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) একটি স্থায়ী আসন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। কথানির্মাতা মুজতবা আলীর ভাবনায় সমকালীন শিক্ষা-পদ্ধতি এবং তৎ-সংক্রান্ত মানুষের মানচিত্র পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত তাগিদ থেকে এবং পেশাগত কারণে শিক্ষাভুবনকে তিনি অনুভব করেছেন নিবিড়ভাবে। ভারতের শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী এবং জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে, ১৯২৭ সালে, কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফারসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক পদে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন মুজতবা। অতঃপর তিনি জামার্নি, মিশর এবং ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। এছাড়া পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং ভারতের রেডিওতে মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাভাষায় সৈয়দ মুজতবা সরস-মার্জিত-বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্যধারার প্রবর্তক। ব্যঙ্গ ও রঙ্গ-রসিকতায় তাঁর রচনা প্রদীপ্ত। ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস, সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীল প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর বিপুল সংখ্যক রচনায় পাণ্ডিত্য ও সৃজন-সামর্থ্যরে বিচিত্র অভিব্যক্তি লক্ষণীয়। অন্তত দশটি ভাষায় দক্ষতা অর্জনকারি এই বিরল-প্রতিভা বাঙালি বিদ্বৎজন ভাষাতত্ত্ব ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় রেখে গেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে (১৯৪৯), ময়ূরকণ্ঠী (১৯৫২), চাচাকাহিনী (১৯৫৯), শবনম (১৯৬০), টুনিমেম (১৯৬৩) এবং কত না অশ্রুজল (১৯৭১) বহুল পঠিত ও নন্দিত গ্রন্থ। তাঁর ‘পাদটীকা’ গল্পটি বাংলাসাহিত্যের পাঠকদের কাছে বেশ পরিচিত। অভিজ্ঞতা আর অনুভবের প্রখরতার মিশেলে তিনি এখানে সাজিয়েছেন সমাজ ও মানুষের ছবি ও কথামালা। বিশেষ করে কাহিনির বিষয় এবং পরিবেশনশৈলীর কারণে গল্পটি আজও বাঙালি পাঠকের আনন্দ ও শিক্ষার খোরাক হয়ে আছে (উচিৎশিক্ষার খানিকটা পাঠও রয়েছ বটে!)। এদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার ঐতিহ্যহরণ, ইংরেজ-শাসনের প্রভাব, ভাষা-শিক্ষকের পাণ্ডিত্য-বাহাদুরি-দুরবস্থা, সরকারের তদারকি, শিক্ষাবিভাগের কড়কর্তাদের বিলাসিজীবন, শিক্ষকসমাজের দারিদ্র্য ও অসহায়তা- সবকিছু মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এক গল্প এটি। পাঠককে চুম্বকের মতো যেন আকৃষ্ট করে রাখে পাঠ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এমনকি পড়া শেষ করেও গল্পের আবহ চেতনার মতো জড়িয়ে থাকে সচেতন পাঠকের মনন-অস্তিত্বে। কৌশলী ও সাবধানী শিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পটি আরম্ভ করেছেন এভাবে:

গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। পাঠান-মোগল আমলে যে দুর্দৈব ঘটেনি ইংরেজ রাজত্বে সেটা প্রায় আমাদেরই চোখের সামনে ঘটল। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা ছেলেভাইপোকে টোলে না পাঠিয়ে ইংরেজি ইস্কুলে পাঠাতে আরম্ভ করলেন। চতুর্দিকে ইংরেজি শিক্ষার জয়-জয়কার পড়ে গেল- সেই ডামাডোলে বিস্তর টোল মরল, আর বিস্তর কাব্যতীর্থ বেদান্তবাগীশ না খেয়ে মারা গেলেন। এবং তার চেয়েও হৃদয়বিদারক হল তাঁদের অবস্থা, যাঁরা কোনোগতিকে সংস্কৃত বা বাঙলার শিক্ষক হয়ে হাই-স্কুলগুলোতে স্থান পেলেন। এঁদের আপন আপন বিষয়ে অর্থাৎ কাব্য, অলঙ্কার, দর্শন ইত্যাদিতে এঁদের পাণ্ডিত্য ছিল অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি কিন্তু সম্মান এবং পারিশ্রমিক এঁরা পেতেন সবচেয়ে কম। শুনেছি কোনো কোনো ইস্কুলে পণ্ডিতের মাইনে চাপরাসীর চেয়েও কম ছিল।

-এই যে সামাজিক বাস্তবতা, তার ভেতরের কথাটা যে কী ভয়াবহ, সেকথা সহজেই অনুমান করা চলে। তখন তো সংস্কৃতভাষার কাল। সারা ভারতে কি সাহিত্যে, কি শিল্পে, কি শিক্ষায় সংস্কৃতের প্রভাব ছিল ঢের। তবে ইংরেজির চমকের কাছে তা কিছুটা মিইয়েই গেল বইকি! যে- পণ্ডিত মশাই ‘পাদটীকা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র, তিনি ছিলেন সংস্কৃত ভাষার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধায় আনত। ‘পণ্ডিতসমাজে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রচুর এবং তাঁর পিতৃপিতামহ চতুর্দশ পুরুষ শুধু-যে ভারতীয় সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন তা নয়, তাঁরা কখনো পরান্ন ভক্ষণ করেননি- পালপরব শ্রাদ্ধনিমন্ত্রণে পাত পাড়ার তো কথাই ওঠে না। ’ তবে তিনি শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ব্যাপারে একরকম নির্বিকার ছিলেন। রাগ-বিরাগের ভেতর দিয়েও তাঁর পাঠ-প্রদানে অনীহা এবং শিক্ষার্থীসমাজের প্রতি কটাক্ষ প্রকাশ পেত। ছাত্রদের দিকে তাকাতেন প্রায় অবহেলার চোখে এবং তারা যে কৃষিকাজে মন না দিয়ে বিদ্যালয়ে এসে অযথা সময় নষ্ট করছে, সে কথাটি বারবার মনে করিয়ে দিতেন। তার মানে তিনি বলতে চাইতেন যে, এই প্রজন্মের ছেলেদের (মেয়েরা তো তখনও স্কুলমুখো হয়নি বললেই চলে) বিদ্যা-অর্জনের কোনো যোগ্যতাই নেই; আন্তরিকতা তো আরও পরের কথা। সম্ভবত সে কারণেই পণ্ডিত মশাই ‘যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বকতেন ঢের বেশি, এবং টেবিলের উপর পা দু’খানা তুলে ঘুমুতেন সব চেয়ে বেশি। বেশ নাক ডাকিয়ে এবং হেডমাস্টারকে একদম পরোয়া না করে। কারণ হেডমাস্টার তাঁর কাছে ছেলেবেলায় সংস্কৃত পড়েছিলেন এবং তিনি যে লেখাপড়ায় সর্বাঙ্গনিন্দনীয় হস্তীমূর্খ ছিলেন সেকথাটি পণ্ডিতমশাই বারম্বার অহরহ সর্বত্র উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতেন। ’

পণ্ডিতজির অহমিকা-অবহেলার অন্তরালে বোধ করি গল্পনির্মাতা আরেকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। আর তা হলো- গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অযোগ্য ব্যক্তিদের পদচারণা। যোগ্য ব্যক্তি আমাদের সমাজে যথাযোগ্য পদমর্যাদা ও সামাজিক সম্মান পায় না। অযোগ্যরা থাকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। কাজেই সমাজে এই বৈষম্যের ভেতর দিয়ে ভালো কিছু যে হতে পারে না, তার একটা আবছা ছায়া আমরা দেখি পণ্ডিতমশাই-এর হাবভাবের মধ্যে। সাধারণ হলেও অসাধারণ এই মানুষটির পরিচয় লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘পণ্ডিতমশায়ের বর্ণ ছিল শ্যাম, তিনি মাসে একদিন দাড়ি গোঁফ কামাতেন এবং পরতেন হাঁটু-জোকা ধুতি। দেহের উত্তমার্ধে একখানা দড়ি প্যাঁচানো থাকত- অজ্ঞেরা বলত সেটা দড়ি নয়, চাদর। ’ তিনি স্কুলে বাংলা পড়াতেন। অবশ্য বেছে বেছে যেটুকুতে সংস্কৃতের ছায়া আছে, কেবল সেটুকু পড়াতে পছন্দ করতেন। কিন্তু এ তো গেল ইংরেজ আমলের কথা। তারপর তো নদীর পানি অনেক গড়িয়েছে। ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে। ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন-আলাদা রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। অতঃপর পাকিস্তানে উর্দু-বাংলা সংকটের পথ ধরে ভাষা-আন্দোলন; স্বাধীকারচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামক আরেকটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। ১৯৪৭-এর আগে এবং অব্যবহিত পরে ভাষা-বিষয়ক যে চিন্তার আলোড়ন, তা ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাঙালির মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই-এর সুফল একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সারাপৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিশেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু কষ্টের কথা হলো- বাংলাদেশে, বাংলাভাষার মূল মাটিতে আজও কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভাষার মর্যাদা? বাংলাভাষার শিক্ষকরা কি পাচ্ছেন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা? ভাবতে অবাক লাগে এই স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও ইংরেজি ভাষার কিংবা বাণিজ্যের শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক মূল্য বাংলাভাষার শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি! বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়ার শেখার চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি আমাদের অস্বাভাবিক ঝোঁক যেন বেড়েই চলেছে!- তাহলে কী পেলাম আমরা? কী আমাদের অর্জন? এ লজ্জা আমরা আজ কোথায় রাখি?

সরকারের স্কুল-কার্যক্রম পরিদর্শন এবং সে-উপলক্ষে বিদ্যালয়ের পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীমহলে উত্তেজনা-আনন্দ প্রভৃতির প্রতি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী পাঠকের নজর আকর্ষণ করেছেন। গল্পের ক্যানভাসে আঁকা ছবি থেকে, শিক্ষার নামে যে প্রকৃতঅর্থে তৎকালে মানুষ উচিৎশিক্ষাই বেশি পেয়েছে, তা আমাদের জানতে অসুবিধা হয় না। গল্পকার সম্ভবত প্রকৃত অবস্থা কৌশলে তুলে ধরে তার এক বিহিত-ব্যবস্থা করার আবেদন রেখেছেন সচেতন পাঠকের দরবারে। সঙ্কটতে প্রকাশ করে সম্ভবানার পথকে বোধকরি কিছুটা উসকে দিতেও চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গত, গল্প থেকে তিনটি অংশের পাঠ নেওয়া যাক:

ক) লাটের ইস্কুল আগমন অবিমিশ্র আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। একদিক দিয়ে যেমন বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ কসুর বিন-কসুরে লাট আসার উত্তেজনায় খিটখিটে মাস্টারদের কাছ থেকে কপালে কিলটা চড়টা আছে, অন্যদিকে তেমনি লাট চলে যাওয়ার পর তিন দিনের ছুটি।

খ) সেকেন্ড পিরিয়ডে বাঙলা। পণ্ডিতমশাই আসতেই আমরা সবাই ত্রিশ গাল হেসে গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ইতিমধ্যে রেবতী খবর দিল যে শাস্ত্রে সেলাই-করা কাপড় পরা বারণ বলে পণ্ডিতমশাই পাঞ্জাবী শার্ট পরেন না, কিন্তু লাট সায়েব আসছেন, শুধু গায়ে ইস্কুলে আসা চলবে না তাই গেঞ্জি পরে এসেছেন। গেঞ্জি বোনা জিনিস, সেলাই-করা কাপড়ের পাপ থেকে পণ্ডিতমশাই এই কৌশলে নিষ্কৃতি পেয়েছেন।

গেঞ্জি দেখে আমরা এতই মুগ্ধ যে পণ্ডিতমশায়ের গালাগাল, বোয়াল-চোখ সবকিছুর জন্যই আমরা তখন তৈরী কিন্তু কেন জানিনে তিনি তাঁর রুটিন মাফিক কিছুই করলেন না। বকলেন না, চোখ লাল করলেন না, লাট আসছেন কাজেই টেবিলে ঠ্যাং তোলার কথাও উঠতে পারে না। তিনি চেয়ারের উপর অত্যন্ত বিরস বদনে বসে রইলেন।
পদ্মলোচনের ডর ভয় কম। আহ্লাদে ফেটে গিয়ে বলল, ‘পণ্ডিতমশাই, গেঞ্জিটা কদ্দিয়ে কিনলেন?’ আশ্চর্য পণ্ডিতমশাই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন না, নির্জীব কণ্ঠে বললেন, পাঁচ সিকে। ’

গ) লাট এলেন, সঙ্গে ডেপুটি কমিশনার, ডাইরেকটর, ইনসপেকটর, হেডমাস্টার, নিত্যানন্দ- আর লাট সায়েবের এডিসি ফেডিসি না কি সব বারান্দায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ‘হ্যালো পান্ডিট্’ বলে সায়েব হাত বাড়ালেন। রাজসম্মান পেয়ে পণ্ডিতমশায়ের সব যন্ত্রণা লাঘব হল। বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে সায়েবকে সেলাম করলেন- এই অনাদৃত পণ্ডিতশ্রেণী সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেয়েও যে কিরকম বিগলিত হতেন, তা তাঁদের সে-সময়কার চেহারা না দেখলে অনুমান করার উপায় নেই।

ভারতবর্ষে, ইংরেজ আগমনের আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাঠামো গড়ে ওঠেনি। পণ্ডিতরা তাঁদের নিজ নিজ বাড়িতে জ্ঞান-বিতরণের ব্যবস্থা করতেন। তখনকার সময়ে ব্যক্তিই ছিল এক একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। যার যে বিদ্যার প্রয়োজন পড়তো, সুবিধামতো পণ্ডিতকে খুঁজে নিত। সময়ের বিবর্তনে স্কুলঘর প্রভৃতি স্থানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যাদান আরম্ভ হলো। কিন্তু ভাতে মরলো পণ্ডিতসমাজ। আরেকটি ব্যাপার- শিক্ষিত পণ্ডিতসমাজ তথা মানুষ গড়ার কারিগর আর সরকারের শিক্ষাবিভাগের উচ্চতর প্রশাসনিক পদে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক স্তর ও মর্যাদার যে বিরাট ফারাক, তা আমাদের দৃষ্টিতে এলো। মানুষ বানানোর কারিগরেরা যে কী সম্মান লাভ করে, তা তখন কারো জানতে বাকি থাকলো না। আর সম্মানীর অপ্রতুলতার কারণে তো অনেক শিক্ষক ঠিকমতো সংসারধর্ম পরিচালনা করতেও হিমশিম খেতেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের সাধারণ লোকেরা ভাবতে লাগলো, ‘মাস্টার’দের কপালে ভাত জোটা ভার! শিক্ষক এবং প্রশাসক যে আলাদা শ্রেণীর মানুষ, তার স্পষ্ট পরিচয় আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কিংবা উপাচার্যগণও যে জেলা প্রশাসকদের কাছে অসহায়ভাবে জিম্মি, তার উদাহরণ বোধকরি আমাদের সামনে রয়েছে (কলেজের মাস্টারদের অবস্থা তো আরো খারাপ!)। তাই শিক্ষকরা ‘নামেমাত্র’ নামী লোক হিশেবে ‘কোনোমতে টিকে থাকলেন’। বর্তমান গল্পে সত্যিকারভাবে ‘পাদটীকা-অংশে’ লেখক চলমান সমাজের জীবনধারার সাথে পর্যবেক্ষণশক্তিসম্পন্ন শিক্ষিতসমাজের পার্থক্য-প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। লাট সায়েবের সাথে যে তাঁর কুকুরটাও ‘স্কুল ভিজিট’-এ এসেছিল, তা বেশিরভাগ ‘দিবান্ধ-রাত্র্যন্ধ’ ছাত্রদের চোখে পড়েনি। অবশ্য তাঁর প্রিয় এক ‘অপদার্থ ছাত্র’ তা খেয়াল করেছিল। কিন্তু পণ্ডিতমশাই সব খবর পেয়েছেন। সায়েবের আরদালি’র- পণ্ডিতজির গ্রামের ছেলে, কাছ থেকে জেনেছেন, কুকুরটার একটা পা কীভাবে ট্রেনের চাকায় কাটা গেল এবং এখন তার পেছনে বর্তমানে মাসে ৭৫ টাকা খরচ হয়। অতঃপর তিনি ক্লাসের ছাত্রকে লক্ষ করে বললেন:
 
আমি, ব্রাক্ষ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন, আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল্ তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাক্ষ্মণ-পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

- এই হলো শিক্ষকসমাজের আর্থিক অবস্থা! আর প্রশাসক-শ্রেণীর বিলাসীজীবন- সে তো সকলের জানা কথা! বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষকগণ যে ইংরেজ-আমলের চেয়ে আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে খুব ভালো আছেন বা কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন, তা কিছুতেই বলা যায় না। ভাবতে অবাক লাগে, একুশ শতকের এই বৈশ্বিক বাণিজ্য-প্রবাহের কালে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহোৎসবের সময়ে, গণতন্ত্রের জয়-জয়কারের জামানায় শিক্ষকদেরকে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয় কেবল অর্থনৈতিক কারণে। এই যে অবমাননা, সমাজের বহু-বিবর্তনেও তার কোনো পরিবর্তন হলো না। কত সরকার এলো, কত গেলো। কত ‘অমানুষ’ টাকার জোরে ‘মানুষ’ হয়ে গেলো! বহুতল ভবন আর গ্রুপ অব কোম্পানির চাপে অর্থনীতি, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কম লোপাট হলো না। ঋণ-খেলাপীর সংখ্যাও হু হু করে বেড়ে চলেছে। সামাজিক বৈষম্য আর অদ্ভুত আঁধারে ভরে গেছে সমাজ-রাষ্ট্রের অলি-গলি। কিন্তু ‘মানুষ গড়ার কারিগর’গণ আজও পড়ে রইলেন অবহেলার শেষতম পর্যায়ে। এই ‘নিস্তব্ধ নিপীড়ন’ থেকে জাতি যে কবে, কখন মুক্তি লাভ করবে, তা সমাজ-শিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলী বলে যেতে পারেননি। আমাদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়।

গল্পকে আমরা যদি কেবল গল্প না ধরে সমাজের দেয়াল কিংবা পাটাতন ভেবে বিবেচনার চোখকে প্রসারিত করি, তাহলে দেখবো বাংলা গল্পে তৎকালীন ভারত কিংবা পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালের বাংলাদেশের শিক্ষাভুবনের যে ছবি আভাসিত হয়েছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ পথ ও পাথেয় নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উপাদান সরবরাহ করতে পারে। এখন প্রয়োজন শুধু অনুধাবন করার শক্তি আর গ্রহণ ও প্রয়োগ করার মানসিকতা এবং সামর্থ্য। ‘পাদটীকা’ গল্পটিকে একটি মডেল হিশেবে বিবেচনা করেও আমরা আপাতত শুরু করতে পারি পরিবর্তনের প্রাথমিক ধাপের কাজ। শিল্পী ও দার্শনিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর সমাজ-পর্যবেক্ষণের শক্তি দিয়ে আমাদেরকে জানান দিয়ে গেছেন- চারিদিকে অনিয়ম চলছে, এসবকে আর চলতে দেওয়া যায় না। সময় তো অনেক গেলো। নদীর জলও গড়িয়েছে প্রচুর। অনেক নদী মরেছে। প্রচুর পণ্ডিত মনে কষ্ট নিয়ে পৃথিবীর ওপারে পারি জমিয়েছেন। রাজনীতির চাকা ঘুরতে ঘুরতে কত ভেঙেছে, জোরাও লেগেছে অনেক! তাই মনে প্রশ্ন জাগে, বিদ্বৎসমাজ আত্ম-অবমাননার দহনজ্বালার আর কত প্রহর যাপন করবেন?


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন