বাখতিনের উপন্যাসতত্ত্ব

মোহাম্মদ আজম

আজকের বক্তৃতার বিষয় বাখতিনের ‘ভাষার দর্শন ও সাহিত্যতত্ত্ব’ কে ঠিক করেছে জানি না; কিন্তু শিরোনামটি যথার্থ হয়েছে। বাখতিন দর্শনেরই চর্চা করেছেন; যে অর্থে দর্শন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক বোধ-বোধি বা সিদ্ধান্ত হাজির করে, সে অর্থেই। আর কাজটা তিনি করেছেন ভাষাকে আশ্রয় করে। তাই বাখতিনের আলোচনায় ভাষাদর্শন নামটি বেশ উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু দর্শন আর ভাষার দর্শনে দখল না থাকায় এ বিষয়ে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরে বাখতিনের উপন্যাসচিন্তা নিয়ে কথা বলব। আলোচনাটা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বের দিক থেকেই হবে।
উপন্যাস বাখতিনের প্রধান আলোচ্য বিষয়। বলা যায়, উপন্যাসের একেবারেই নতুন সংজ্ঞায়ন আর জীবনের সাথে শিল্পের সম্পর্কের নতুন দিকনির্দেশ করে বাখতিন তাঁর সমগ্র আলোচনার জন্য নতুন প্রণালি-পদ্ধতি ঠিক করে নিয়েছেন। তাঁর প্রধান রচনাগুলো, যেমন, প্রোবলেমস অব ডস্তয়ভস্কিস পোয়েটিকস (১৯২৯/ ১৯৬৩), র‌্যাবেলিয়াস অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড (১৯৬৮), দি ডায়ালজিক ইমাজিনেশন (১৯৩০-৪০/ ১৯৭৫), উপন্যাসকে কেন্দ্রে রেখেই লিখেছেন।

উপন্যাস এখনো বিকাশমান। এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো এখনো বিকশিত হয়নি। মহাকাব্য বা ট্র্যাজেডির মতো অধিকাংশ সাহিত্যরূপ শুধু পুরনোই নয়প্রাচীনও (প্রত্নতাত্ত্বিক) বটে। এগুলোর বেশিরভাগই আবির্ভূত ও বিকশিত হয়েছে লিখনশৈলী আর পুস্তকের আবির্ভাবের আগে। উপন্যাসই একমাত্র ব্যতিক্রম। অন্য সাহিত্যরূপ পাঠ মৃতভাষা পাঠের মতো; উপন্যাস শুধু জীবিত ভাষার মতোই নয়এমন এক ভাষার পাঠযা এখনো তরুণ। অন্য সাহিত্যরূপগুলো এ জমানার আগেই পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছিল। একালে সেগুলো যখন লেখা হয়েছেতখন নতুন জমানার সাথে খাপ খাইয়েছে- কখনো ভালো হয়েছে, কখনো মন্দ। কিন্তু উপন্যাস এযুগে বিকশিত একমাত্র সাহিত্যমাধ্যম।
উপন্যাসের একালে অন্য সাহিত্যরূপগুলোও কিছু পরিমাণে উপন্যাসায়িত হয়েছে- দ্বিবাচনিক হয়েছে; হাসিব্যজস্তুতি, ঠাট্টা ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, উপন্যাসের প্রভাবে এ সাহিত্যরূপগুলোতে ‘অনিরূপিত’ বৈশিষ্ট্য ঢুকেছে, অর্থের মুক্তি ঘটেছে এবং সমকালীন বাস্তবতা- যে বাস্তবতা চলমান, এখনো শেষ হয়নি- গ্রাহ্য হয়েছে। যুগের প্রধান সাহিত্যরূপ হয়ে ওঠার এই জার্নিতে উপন্যাস অন্য সব রূপের নবায়ন ঘটিয়েছে- বিশেষত এর রচনা-প্রক্রিয়া আর সবকিছু আত্মীকরণের দিক থেকে।
দুর্ভাগ্যের কথা, সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা উপন্যাস আর ইতিমধ্যে বিকশিত সাহিত্যরূপগুলোর মধ্যকার লড়াইকে সীমিত করে ‘ঘরানা’ বা ‘প্রবণতা’র মধ্যে নিয়ে আসেন। উপন্যাসায়িত একটি কবিতাকেধরা যাকতাঁরা বলেন ‘রোমান্টিক’ কবিতা। অবশ্যই এটা রোমান্টিক। কিন্তু এ কথা বললেই কথা শেষ হয়ে যায় না। সাহিত্য ও ভাষার যে নিয়তি একালে অনিবার্য হয়ে উঠেছে তার তুলনায় এই ‘ঘরানা-প্রবণতা’ দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির বিশ্লেষণ মাত্র।

উপন্যাসের ধরন-ধারণ সম্পর্কে বিস্তর কাজ হয়েছে। কিন্তু সাহিত্যরূপ হিসাবে উপন্যাসকে চিহ্নিত করার কাজ হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিকশিত অন্য সাহিত্যরূপের মতো করে, তাদের তুলনায়, উপন্যাসকে দেখা হয়েছে। কিন্তু এ কাজগুলো সাহিত্যরূপ হিসাবে উপন্যাসের কোনো সামগ্রিক পরিচয় দেয় না। পরিচয় দেবার চেষ্টা হয়েছে কিছু বৈশিষ্ট্যযোগে; কিন্তু পরক্ষণেই আরো বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো আগেরগুলোকে বাতিল করে দেয়। যেমন, যদি বলা হয় উপন্যাস বহুস্তর, তাহলে বলা যাবে: একক স্তরের মহৎ উপন্যাসও আছে। যদি বলি জটিল মাধ্যম, তাহলে বলতে হয়: জনপ্রিয় সরল উপন্যাসও অনেক। উপন্যাসকে ভালবাসার আখ্যান বলা হয়েছে, কিন্তু ইউরোপের ভালো উপন্যাসের অনেকগুলোতেই ভালবাসার নামগন্ধ নাই। উপন্যাস গদ্যে লেখা হয় বললে চলছে না, কারণ পদ্যেও অনেক লেখা হয়েছে।
ফিল্ডিং থেকে শুরু করে হেগেল পর্যন্ত অনেকেই নতুন সাহিত্যরূপ হিসাবে উপন্যাসকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের আলোচনার সারসংক্ষেপ এরূপ:
     ১। উপন্যাস কাব্যিক হবে নাকল্পসাহিত্যের অন্যসব শাখায় ‘কাব্য’ কথাটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সে অর্থে।
     ২। উপন্যাসের নায়ক ট্র্যাজেডির মতো হবে না। ভালোর সাথে তার মধ্যে মন্দও থাকবে; নিচুতার সাথে উঁচু; হাস্যের সাথে গাম্ভীর্য।
     ৩। নায়ক বিকশিত অবস্থায় আবির্ভূত হবে না। হবে বিকাশমান। হবে এমন, যে জীবন থেকে শেখে।
     ৪। উপন্যাস সমকালের জিনিস, যে অর্থে মহাকাব্য পুরাকালের।
এ গুণগুলো উপন্যাসকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। কিন্তু এগুলো এটা বোঝায় না যে, উপন্যাস নিজেই নিজেকে পরিবর্তন করে চলছেএবং অন্য সাহিত্যরূপগুলোকেও প্রভাবিত করছে এ যুগের সাহিত্যরূপ হিসাবে।

আধুনিক জমানার সাহিত্যে উপন্যাসের ভূমিকা, এই সাহিত্যরূপের চলমান ঘটমানতা আর অন্যসব সাহিত্যরূপকে প্রভাবিত করার সামর্থ্যরে দিক থেকে বাখতিন উপন্যাসের তিনটি বিশিষ্টতার উল্লেখ করেছেন। ১। এর শৈলীগত ত্রিমাত্রিকতা, উপন্যাসে আত্মীকৃত বহুভাষিক সচেতনতার সাথে এর যোগ; ২। এর প্রভাবে সমকালীন সাহিত্যরূপগুলোর বৈপ্লবিক রূপান্তর; ৩। সমকালীন বাস্তবের সাহিত্যিক রূপায়ণের ক্ষেত্রে উপন্যাস যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো পরস্পর-সম্পর্কিত। ইউরোপীয় সভ্যতার বিশেষ কালে আন্তর্জাতিক ও আন্তর্ভাষিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার বিশেষ বাস্তবতার সাথে উপন্যাসের উদ্ভবের যোগ আছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য মহাকাব্যের সাথে এর সম্পর্ক বোঝা জরুরি। মহাকাব্যেরবাখতিনের মতে, প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য:
     ক) মহাকাব্যের বিষয় জাতীয় অতীত।
     খ) জাতীয় ঐতিহ্য মহাকাব্যের উৎসব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়।
     গ) মহাকাব্যিক দূরত্ব বর্তমান বাস্তবতা- যে বাস্তবতায় গায়ক বা কবি বা পাঠক অবস্থান করে- থেকে মহাকাব্যিক জগতকে আলাদা করে।
মহাকাব্যের বিষয় ‘চূড়ান্ত অতীত’, পবিত্র জাতীয় স্মৃতি- আর এর বর্ণনার ভাষাও ঐতিহ্যগত। সমকালের সাথে যোগরহিত। মহাকাব্য রচিত হয় দূরবর্তী ইমেজে। যে বর্তমান অপূর্ণ- হয়ে উঠছে এমনপুনর্বিচারযোগ্যতার সাথে মহাকাব্যের কোনো সম্পর্ক নাই।
মহাকাব্য সম্পর্কে উপরে যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হল, তা মোটাদাগে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অন্য সাহিত্যরূপগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সময়ের সেই একই ব্যবহার, ঐতিহ্যের সমরূপ ভূমিকা, একই হায়ারার্কিক্যাল দূরত্ব।
সমকালের সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নাই। সমকালীন ঘটনা বা চরিত্র যদি গৃহীত হয়ও, তাহলেও সেগুলো অতীত নিশ্চয়তা-সম্পন্নতা নিয়েই হাজির হয়। বর্তমানের মূল্যায়নের ঊর্ধ্বে থাকে। ঘটনা, মর্যাদা আর অন্যসব অনুষঙ্গের বুননে বর্তমানের সাথে সম্পর্ক হারায়। এখানে মনে রাখা দরকার, এই ‘অতীত’ আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারিক অর্থের অতীত নয়, বরং এটি সময়ের বিশেষরকম মহিমান্বিত ও দূরবর্তী বর্গ।
অন্যদিকে, উপন্যাসের ময়দান এক বাস্তবলিপ্ত অনিরূপিত বর্তমানের জগত, যেখানে মিলিত হতে পারে অভিজ্ঞতার বিচিত্র তল, ভাষা, মতাদর্শ আর দৃষ্টিভঙ্গির বহু রূপ। এই মিলনক্ষেত্রে এসে জোটে সাহিত্য-বহির্ভূত নানা উপাদানও- প্রাত্যহিক জীবন আর আদর্শিক নানা উপাদান। হয়ত নৈতিক স্বীকারোক্তি, দার্শনিক রচনারাজনৈতিক ইশতেহার ইত্যাদিও। উন্মেষের কালেই উপন্যাস ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাস্তবের সাহিত্য-বহির্ভূত নানা রূপে হাত বাড়িয়েছিল। পরের ধাপে চিঠি, ডায়েরি, আত্মস্বীকারোক্তি, কোর্টের বয়ান ইত্যাদি ব্যবহার করেছে।

উপন্যাস তখনই রূপ পেতে থাকে, যখন মহাকাব্যিক দূরত্ব বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। যখন দুনিয়া এবং দুনিয়ার মানুষ পরিচিত হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি আত্মসাৎ করে নিয়েছে, যখন সাহিত্যিক-শৈল্পিক এনতেজাম সমসাময়িক বাস্তবতার- যে বাস্তবতা সবকিছুকে অঙ্গীভূত করে নিতে চায়- স্তরে নেমেছে। প্রথম থেকেই উপন্যাস গড়ে উঠেছে পুরানা অতীতের সুদূর মূর্তিতে নয়, দৈনন্দিন বাস্তবতার গ্রহিষ্ণু ইমেজে। এর আত্মায় আছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর মুক্ত সৃষ্টিশীল কল্পনা।
অন্য সাহিত্যরূপগুলোকে উপন্যাসায়িত করার মানে এ নয় যে, অন্যগুলোর পাশে উপন্যাস নামের এক নতুন বর্গ যুক্ত হল। আদতে উপন্যাসের নির্দিষ্ট কায়দা-কানুনই নাই। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটি নির্দিষ্ট রীতিবিহীন। নমনীয়। উপন্যাস চির-নিরীক্ষাশীল; নিজেকে পরীক্ষা করে এবং নিজের যে কোনো প্রতিষ্ঠিত রীতিকে পরীক্ষার বিষয় করে রাখে। ক্রম-পরিবর্তমান বাস্তবতার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে সম্পর্কিত একটি সাহিত্যরূপের জন্য এর বিকল্পও নাই। ফলে অন্য সাহিত্যবর্গের ‘উপন্যাসায়ন’ মানে কোনো ভিন্ন নির্দিষ্ট বর্গের কানুনের অধীন হওয়া নয়, বরং উপন্যাসায়িত হওয়া তাদের নিজেদেরই মুক্তি ঘটায়- তাদের বিধিবদ্ধ উদ্ভব-বিকাশ থেকে, সেসব বৈশিষ্ট্য থেকে যা তাদের পুরনো করে রেখেছিল। আউটডেটেড করেছিল।

ভাষার ‘কাব্যিক ব্যবহার’ (সংকীর্ণ অর্থে) আর ‘ঔপন্যাসিক ব্যবহার’ এত আলাদা যে, কাব্যিক ভাষার ধারণা দিয়ে উপন্যাসপাঠ ব্যর্থ হতে বাধ্য। উপন্যাসে, বিশেষত লেখকের নিজস্ব ডিসকোর্সে, ভাষার কাব্যিক ব্যবহারও হয়; কিন্তু উপন্যাসের জন্য তা নিতান্তই গৌণ।
উপন্যাসের আদর্শ হিসাবে তিনি নিয়েছেন পুশকিনের ইউজিন ওনেগিনকে। বলেছেন, উপন্যাসে বিভিন্ন ভাষিক ও শৈলীর ধরন একসাথে বিরাজ করে। এই কারণেই একই তলে বা একই রেখায় উপন্যাসের ভাষাকে সংকীর্ণ করা যায় না। বরং এ এমন এক ময়দান যেখানে পরস্পরছেদী তল বা রেখা একসাথে অবস্থান করেযাকে বলা যায়: heterogenous linguistic and stylistic forms। ওনেগিনে এমন শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্করযা সরাসরি লেখকের শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পুশকিনের গীতিকবিতা কিন্তু তাঁর নিজেরই শব্দ, নিজেরই উচ্চারণ। তার মানে এই নয় যেউপন্যাসে বাচিক-আদর্শিক কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই; কোনো কেন্দ্র নাই। থাকে। কিন্তু কোনো একটি ভাষিক তলে লেখককে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে তল বা রেখাগুলোর সঙ্গমস্থলে। এই কেন্দ্র থেকে তলগুলো বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থান করে।
উপন্যাসের শৈলীপাঠের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে: উপস্থাপিত বিশেষ ভাষা ও শৈলীগুলোর পাঠবিভিন্ন ভাষা ও শৈলীর সংগঠন, এগুলোর ধরন-বৈচিত্র্য, ঔপন্যাসিক সমগ্রতার মধ্যে ভাষাগুলোর গ্রন্থনা, ভাষা ও স্বরগুলোর চলন ও রূপান্তর, তাদের সংলাপমুখর পারস্পরিক সম্পর্ক। কবিতার ভাষা প্রত্যক্ষ বচনের ভাষা। তাই কাব্যপাঠশৈলী উপন্যাসের জটিল শৈলীর পাঠে কোনো কাজে লাগার কথা নয়।
উপন্যাসে ডিসকোর্স তার সমস্ত দিক আর সত্যিকার গভীরতাসহ উপস্থাপিত হতে পারে। এ ধরনের উপস্থাপনার চর্চা অনেক আগে থেকেই ছিল। মৌখিক সংস্কৃতিতে অন্যের কথা উদ্ধৃতি-আকারে উপস্থাপনের নমুনা পাওয়া যায়। হাজার বছর আগে থেকেইবিশেষত লোকভাষায়অন্যের কথা, উচ্চারণ, ভাষা সুবিধাজনক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপনের রেওয়াজ ছিল। অর্থাৎ প্রত্যক্ষত উপন্যাস শুরুর আগের প্রাক-ইতিহাসেও উপন্যাসের চর্চা হয়েছে। বাখতিনের মতে, পুরানা জমানায় চর্চিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হাসি আর বহুভাষাসমন্বয় (polyglossia)।
প্যারডি অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। গ্রিকদের কমিক অডিসিউস, কমিক হারকিউলিস প্রমাণ করে, জাতীয় পুরাণের হাস্যরসাত্মক/বিদ্রুপাত্মক উপস্থাপনা সেখানে নিষিদ্ধ বা শাস্তিযোগ্য ছিল না। রোমান ইতিহাসেও এ বস্তু মশহুর। রোমান শিল্পের ইতিহাসে প্যারডি ছাড়া ‘গুরুতর’ (serious) শিল্পকর্মের অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। এমন কোনো গুরুতর শিল্পকর্ম ছিল না যার ‘হাস্যরসাত্মক জমজ (comic double) রচিত হয়নি। দেখা যাচ্ছেআমাদের জানা ইতিহাস প্যারডি বা কমিক রচনার বৈচিত্র্য বা সমৃদ্ধিতে উজ্জ্বল।
প্রশ্ন হল, এই বিচিত্র হাস্যরসাত্মক রচনার ঐক্যসূত্র কোথায়, আর কিভাবেই বা তা উপন্যাসের সাথে যুক্ত?
পুরাকালে প্যারডি-কমেডি কিছু কিছু সাহিত্যরূপ তৈরি করেছে বটে, যেমন স্যাটায়ার, কমেডি, কাহিনিহীন সংলাপ ইত্যাদি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো রূপ হয়ে উঠতে পারেনি। কবিতার প্যারডি নিশ্চয়ই কবিতা নয়। এগুলোর মূল ভূমিকা ছিল প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যরূপ এবং তার ভাষা, শৈলী ও স্বর-সুরকে হাস্যরসাত্মক ও সমালোচনামূলকভাবে হাজির করে মূলে অনুপস্থিত ভাব সম্পর্কে ভোক্তাকে সচকিত করা। উপন্যাসে এ বস্তু ব্যবহৃত হওয়ার মওকা পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, উপাদানগুলো একসুতায় গাঁথা সুসম্পন্ন রূপে ছিল না বটে, কিন্তু প্যারডিকৃত সংলাপ, প্রাত্যহিক জীবনচিত্রহাস্যরস ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য এগুলোকে একটা ধরন দিয়েছে। বাখতিনের মতে, এর সামগ্রিক রূপটা একটা বৃহৎ উপন্যাসের মতোবিচিত্র রূপকল্প ও শৈলীর সমন্বয়ে, নিষ্করুণ সমালোচনায়, মার্জিত বিদ্রুপে এটা বহুভাষাসমন্বয়ের এক পূর্ণরূপ প্রকাশ করেএবং এভাবে যুগের সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠীর বিচিত্র স্বরের উপস্থাপক হয়ে ওঠে। সেকালটা উপন্যাস লেখার জন্য উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল। ইউরোপীয় ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে এই বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলো এক শৈল্পিক সমন্বয় পেয়ে উপন্যাসের রূপ পেয়েছে।

উপন্যাসের গঠনশৈলীগত ঐক্য নিষ্পন্ন হয় নিম্নোক্ত উপাদানে:
     ক) লেখকের প্রত্যক্ষ সাহিত্যিক-শৈল্পিক বয়ান
     খ) প্রাত্যহিক কথ্যবচনের কেতাদুরস্ত উপস্থাপনা
     গ) চিঠি বা ডায়েরির মতো নিম-সাহিত্যবর্গের কেতাদুরস্ত উপস্থাপনা
     ঘ) সাহিত্যিক কিন্তু শৈল্পিক নয় এমন নৈতিকদার্শনিক-বৈজ্ঞানিক, নৃ-বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি উপাদানের ব্যবহার
     ঙ) চরিত্রগুলোর স্বতন্ত্র বাচনের শৈল্পিক উপস্থাপনা
এই বিচিত্র উপাদানগুলো উপন্যাসে শৈল্পিক আকার পায়, সমগ্র উপন্যাসের বৃহত্তর শৈল্পিক কাঠামোর অধীনে বিন্যস্ত হয়, যেখানে সামগ্রিক কাঠামো অন্তর্গত আলাদা কাঠামোগুলোর প্রত্যেকটি থেকে স্বতন্ত্র। উপন্যাসের সামগ্রিক শৈলীর স্বাতন্ত্র্য অঙ্গীভূত কাঠামোগুলোর সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল, যে কাঠামোগুলো সমগ্রের অধীন, কিন্তু তাদের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ থাকে। উপন্যাসের শৈলী খুঁজতে হবে এর অন্তর্গত শৈলীগুলোর নিপুণ সমবায়ে। উপন্যাসের ভাষা এর অন্তর্গত ভাষাগুলোর নিপুণ সমন্বয়। চরিত্রগুলোর স্বতন্ত্র বাচনই হোক, আর প্রাত্যহিক কথ্যবাচনই হোক- উপাদানগুলো প্রথমত এবং প্রত্যক্ষত সম্পর্কিত হবে অন্তর্গত কাঠামোগুলোর সাথে। এ উপাদানগুলোর শাব্দ-আর্থ-বাক্যিক শৈলী চিহ্নিত হবে ওই অন্তর্গত কাঠামোর সাপেক্ষে, যার সাথে এগুলো প্রত্যক্ষত সম্পর্কিত। একই সঙ্গে অন্তর্গত কাঠামোর অংশ থেকেই এগুলো সমগ্রের কাঠামো তৈরি করবে- সমগ্রের মুদ্রা চিহ্নিত করবে; অংশ নেবে সেই প্রক্রিয়ায় যাতে সমগ্র কাঠামোটি একক সামগ্রিকতা পায় আর তাৎপর্য উন্মোচিত হয়।

বাখতিন কাজ করেছেন ভাষা নিয়ে। ভাষা আমাদের কালের যাবতীয় চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু তাঁর আলোচনায় অন্যদের মতো পদ্ধতি তালাশ করতে গেলে হতাশ হতে হবে। তার মানে এই নয় যে তাঁর কথার জোর নাই। আসলে তাঁর ভাষা-ভাবনা উপন্যাস-সম্পর্কিত ভাবনার মতোই। বাখতিনই আমাদের অন্যদের চেয়ে বেশি করে শিখিয়েছেন যেউপন্যাসের কায়দা-কানুন নাই এমন নয়, কিন্তু সনেট বা ওডের নিয়ম থেকে সে নিয়ম তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলাদা।
বাখতিন তাঁর প্রথম কাজ থেকে শেষ কাজ পর্যন্ত ব্যতিক্রমহীনভাবে একটা কাজ করে গেছেন- খুব স্বতন্ত্র ধরনে ভাষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ভাষার অস্তিত্বে তিনি দেখেছেন দুই বিপরীত স্বভাবের বিরোধ আর বিরামহীন লড়াই- একদিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তি, যা একে বিচ্ছিন্ন করতে/আলাদা করতে চায়, অন্যদিকে এক কেন্দ্রমুখী শক্তি, যা উপাদানগুলোকে সামঞ্জস্যে মিলাতে চায়। এই জরস্থুত্রীয় দ্বন্দ্ব সংস্কৃতিতেও আছে, প্রকৃতিতেও আছে; মানুষের চৈতন্যেরও এটা সহজাতআর মানুষের উচ্চারণেও তা বিশেষভাবে কাজ করছে। মানুষের ভাষা হল এই দ্বন্দ্বের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং জটিল আবাস; আর উপন্যাস হল এই ভাষার সর্বোত্তম প্রতিলিপি।
দুটি কথা বলা দরকার। এক. ভাষা কেবল এই দ্বন্দ্বের প্রকাশক বা আশ্রয় নয়; বরং সে নিজেই এই দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ নমুনা। বাখতিন এই দুই দ্বন্দ্বকে বাইনারি অপোজিশন হিসাবে দেখেননি। যেমন দেখেছে কাঠামোবাদী তাত্ত্বিকরা। তাঁর কাছে এই দুই বিপরীত শক্তি ঐতিহাসিকভাবে ভাষার হয়ে ওঠা, অর্থের স্থিতি ও লয়ের সাথে যুক্ত। এটা যান্ত্রিক নয়, বরং মানুষের স্বভাবের মতোই অনির্দিষ্ট।
দুই. পেশাদার ভাষাতাত্ত্বিকদের মতো করে বাখতিনের রচনায় বিবৃত ভাষা বোঝা যাবে না। তাঁর কাছে ভাষা কেবল বিচিত্র উপভাষাতেই বিভক্ত নয়, সামাজিক-মতাদর্শিক অন্য নানা গুরুতর বিভাগেও বিভক্ত: পেশাগত, সাহিত্যরূপগতপ্রজন্মগত ইত্যাদি। যতদিন ভাষা জীবিত থাকবে, ততদিনই এই বৈচিত্র্য আরো বিস্তৃত পরিসরে, আরো গভীরভাবে ভাষার হয়ে ওঠায় প্রভাব ফেলতে থাকবে।
এই দুই বিবাদমান শক্তির গুরুত্বও সমান নয়। কেন্দ্রাতিগ বল স্পষ্টতই অধিক শক্তিশালী এবং সর্বব্যাপী। আমরা যেভাবে ভাষা ব্যবহার করি বা দৈনন্দিন জীবনের গভীর বাস্তবতায় ভাষার মধ্যেই বসবাস করিএটা ভাষার সেই রূপ। অন্যদিকে একরৈখিক ভাষা ভাষার কোনো প্রদত্ত বা যথাপ্রাপ্ত রূপ নয়, বরং তৈরি করে নেয়া রূপ। এটা বৈচিত্র্যের গোলমাল কমিয়ে ভাষার যথার্থ ব্যবহারকে সম্ভব করে তোলে, পারস্পরিক বোধগম্যতা নিশ্চিত করে।
বহুত্বের এক প্রবল-গভীর বোধ বাখতিনকে বিশ শতকের অন্য সকল ভাষা-বিশ্লেষক থেকে বাখতিনকে আলাদা করেছে। ভাষা বাখতিনের কাছে সত্যকার যাপনের মামলা। নির্দিষ্ট স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট দুজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট বিষয়ে বাক-বিনিময় করছে- এরকম অনুমানই তাঁর যাবতীয় বিবেচনার কেন্দ্র। কিন্তু এ দুজন প্রেরক-গ্রাহক মডেলে স্বাধীন সত্তা হিসাবে ভাব-বিনিময় করে না। আর সকলের মতো এরাও একটা নির্দিষ্ট ভাষা-পরিবেশে আছে। শব্দে সুপ্ত আভিধানিক বা মতাদর্শিক অর্থ নয়তারা তাদের মনোভঙ্গির অনুকূল ডিসকোর্স বাছাই করেই সংলাপের শব্দগুলো বিশিষ্ট অর্থে গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে চাইবে। স্বরভঙ্গি, উচ্চারণ, শব্দ-বাছাই, শরীরভঙ্গি ইত্যাদিসহ অন্যের প্রভাবমুক্ত করেই তারা সংলাপ পরস্পরের কাছে পৌঁছাবে।
এই প্রক্রিয়ায় যা বলতে চাওয়া হয়, তা কখনোই যথার্থভাবে বলা যায় না। আমার কণ্ঠস্বর আমাকে সবসময়ই আশ্বস্ত করবে যে আমি একটি গুছানো বাক্যই বলেছি; কিন্তু বাস্তবে আমি আসলে ক্রমাগত অর্থ উৎপাদন করছি- কিছু আমার চাওয়া অর্থ, আর কিছু চাওয়ার বাইরে।
বাখতিন সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন ভাষার কথনক্রিয়ায়- উচ্চারণে; কারণ অর্থের যে ধরনকে তিনি ধরতে চান, তার জন্য উচ্চারণই জরুরি। সাধারণ ভাষা বলে কিছু তাঁর তত্ত্বে নাই। ভাষা তখনই অর্থ প্রকাশ করে যখন তা আবশ্যিকভাবে একে অন্যকে বলে। এ কথা মনে না রাখলে উপন্যাস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বোঝা যাবে না।

মোহাম্মদ আজম: গবেষক, ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন