আবুল হাসানের পাঁচটি কবিতা

 


তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন, তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হব কালিমা রাখব না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া তোমার ওখানে যাব; তোমার পায়ের নিচে পাহাড় আছেন তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর পাথর সরিয়ে আমি ঝর্নার প্রথম জলে স্নান করব কালিমা রাখব না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া এখন তোমার কাছে যাব তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা— আমি ক্ষত মুছে ফেলব আকাশে তাকাব আমি আঁধার রাখব না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভির দুধের সাদা হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেতে যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না—তোমার চিবুকে তাঁরা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভির দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি কাছে আয় পুরনো রাখাল! আমি কাছে যাব আমি তোমার চিবুক ছোঁব, কালিমা ছোঁব না!

বয়ঃসন্ধি

চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

পানাপুকুরের পাড়ে জলের আয়না আছে, মুখ ধুই আমি কাকে নুইয়ে দিই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

নাসারন্ধ্রে নিমের ফুলের ঘ্রাণ, খয়েরি দুপুরে আমি আলোর আঁধারে কেন ভেসে যাই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!

আমার সুন্দর হতে ভালোই লাগে না; আমি ভয় পাই!

আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল আমার শরীরে এই সোনালি ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরন!

কোথায় লুকাব মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!

উচ্চারণগুলি শোকের

লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না, হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে কোথাও দেখি না, কতগুলি রাজহাঁস দেখি নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি, কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না শিশুটিকে কোথাও দেখি না!

তবে কি বউটি রাজহাঁস? তবে কি শিশুটি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?

অনেক রক্ত যুদ্ধ গেল, অনেক রক্ত গেল, শিমুল তুলোর মতো সোনারুপো ছড়াল বাতাস।

ছোট ভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না, নরম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না!

কেবল পতাকা দেখি, কেবল উৎসব দেখি, স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পাতাকা? তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব?

পাখি হয়ে যায় প্রাণ

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।

ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের মর্মায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেন আমি

চলে যাই আজও সেই বর্নির বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে, যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে জনপদবালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীন শব্দে মেদুর!

মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ তারা নরম যুঁইয়ের গন্ধ মেলার মতো চোখের মাথুর ভাষা আর হরিকীর্তনের নদীভূত বোল! বড় ভাই আসতেন মাঝরাতে মহকুমা শহরের যাত্রাগান শুনে, সাইকেল বেজে উঠত ফেলে আসা শব্দে যখন, নিদ্রার নেশায় উবু হয়ে শুনতাম, যেন শব্দে কান পেতে রেখে : কেউ বলে যাচ্ছে যেন, বাবলু তোমার নীল চোখের ভিতর এক সামুদ্রিক ঝড় কেন? পিঠে অই সারসের মতো কী বেঁধে রেখেছ?

আসতেন পাখি শিকারের সূক্ষ্ম চোখ নিয়ে দুলাভাই! ছোটবোন ঘরে বসে কেন যেন তখন কেমন পানের পাতার মতো নমনীয় হতো ক্রমে ক্রমে!

আর অন্ধ লোকটাও সন্ধ্যায়, পাখিহীন দৃশ্য চোখে ভরে! দিঘিতে ভাসত ঘনমেঘ, জল নিতে এসে মেঘ হয়ে যেত লীলা বৌদি সেই গোধূলিবেলায়, পাতা ঝরবার মতো শব্দ হতো জলে, ভাবতুম এমন দিনে কি ওরে বলা যায়?

স্মরণপ্রদেশ থেকে এক একটি নিবাস উঠে গেছে সরজু দিদিরা ঐ বাংলায়, বড়ভাই নিরুদ্দিষ্ট, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি সাথে করে নিয়ে গেছে গাঁয়ের হালট!

একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহুদূরে গত! বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো

সবার গোচরহীন আছি আজও সুদূরসন্ধানী!

দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি, সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতন একা একজন লোক, যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি শতজীবনের শত কুহেলি ও কুয়াশার গান!

পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলি মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!

ভালোবাসার কবিতা লিখবো না

‘তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি। আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি, আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।

আমার একাকীত্বের এক শতাংশ হাতে নিয়ে তুমি আমার ভালোবাসার মুকুট পরেছো মাথায়! আমাকে শোষণের নামে তৈরি করেছো আত্মরক্ষার মৃন্ময়ী যৌবন। বলো বলো হে ম্লান মেয়ে, এতো স্পর্ধা কেন তোমার?

ভালোবাসার ঔরসে আমার জন্ম! অহংকার আমার জননী! তুমি আমার কাছে নতজানু হও, তুমি ছাড়া আমি আর কোনো ভূগোল জানি না, আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি!

আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও! হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!

আমার অপার করুণার মধ্যে তোমারও বিস্তৃতি! তুমি কোন্ দুঃসাহসে তবে আমার স্বীকৃতি চাও, হে ম্লান মেয়ে আমার স্বীকৃতি চাও কেন? তোমার মূর্খতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে,পৃথিবীটা পুড়ে যাবে হেলেনের গ্রীস হবে পুনর্বার আমার কবিতা! এই ভয়ে প্রতিশোধস্পৃহায় আজো আমি ভালোবাসার কবিতা লিখিনি কোনোদিন ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।

হে মেয়ে হে ম্লান মেয়ে তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা আমি কোনোদিন কখনো লিখবো না!’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন