মিখাইল বাখতিনের ভাবনা-চিন্তার পটভূমি

 বাখতিন সার্কেলের প্রধান ব্যক্তি তিনজন। সংস্কৃতিতাত্ত্বিক মিখাইল মিখাইলোভিচ বাখতিন (১৮৯৫-১৯৭৫), ভাষাতাত্ত্বিক ভ্যালেন্টিন নিকোলাইভিচ ভলশিনভ (১৮৯৫-১৯৩৬) এবং সাহিত্যের পণ্ডিত পাভেল নিকোলাইভিচ মেদভেদেভ (১৮৯১-১৯৩৮)। তাঁরা কাজ করতেন মুখ্যত দর্শনের ভিত্তিতে; এবং মানববিদ্যা, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, এবং বিচিত্র সংস্কৃতিতত্ত্ব তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে আলোকিত হয়েছে। তাঁদের পূর্বসূত্র পাওয়া যায় নব্য কান্টবাদ বিশেষত মারবার্গ স্কুলে, ম্যাক্স শিলার প্রমুখের ফ্যানমেনলজিতে, এবং রুশ আঙ্গিকবাদীদের কাজে। এছাড়া হেগেল আর রাশিয়ায় চালু নানা মার্কসবাদী ধারা, যেমন গিয়র্গি লুকাচ প্রমুখের কাজও তাঁদের প্রভাবিত করেছিল।

বাখতিন সার্কেলের কাজকে সার্বিকভাবে সংস্কৃতির দর্শন বলা যায়। বাখতিন জর্মন দার্শনিকদের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। অবশ্য সে ঋণ শনাক্ত করা খুব সহজ নয়। জর্মন থেকে উদ্ধৃতি ছাড়াই তিনি লেখায় দেদার ঋণ গ্রহণ করেছেন। এখন অবশ্য বিস্তর নথিপত্র সংগৃহীত হয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে জর্মন ভাববাদীদের কাছে বাখতিনের ঋণের ধরন ও পরিমাণ সম্পর্কে যেমন জানা যায়, ঠিক তেমনি তাঁর নিজের তাত্ত্বিক-প্রায়োগিক গুরুত্বও তুলনামূলক নিশ্চয়তার সাথে শনাক্ত করা যায়।

 

জর্মন মারবার্গ স্কুলের চিন্তাধারা বাখতিন পর্যন্ত পৌঁছেছিল কাগানের হাত ধরে। কোহেনের মৃত্যুর পরে কাগান যে শোকগাথা লিখেছিলেন, তাতে কোহেনের শেষদিকের দর্শনের ধর্মীয় এবং বিশেষত ইসায়ি দিকগুলো নিয়ে তিনি আলোকপাত করেন। কোহেনের কাছে ধর্মের ব্যাপারটা আলাদা আলাদা ব্যক্তির সমষ্টি তৈরির প্রশ্ন। মানুষের সামষ্টিকতার অন্তহীন প্রক্রিয়ার সাথে তা সম্পর্কিত। আল্লার ধারণার মতো আলাদা ব্যক্তির সমস্যা দিয়েও ধর্মকে ব্যাখ্যা করা যায়। একেশ্বরবাদের ক্ষেত্রে আল্লার সাথে মানুষের অব্যাহত সম্পর্ক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের চূড়ান্ত উপাদান। ব্যক্তি আল্লার সাথে একাকার হয়ে যায় এমন নয়, কিন্তু সম্পর্কিত থাকে। এই সত্যের, কোহেন বলবেন, একটা বড় সামাজিক তাৎপর্য আছে; কারণ, ধর্ম নীতি থেকেই উদ্ভূত। তাঁর মতে, একেশ্বরবাদ মানুষের ঐক্যের ধর্ম। ধর্ম সর্বত্রই বিরাজমান, সংস্কৃতির সর্ব-অঙ্গনে। ধর্ম নিজেই দর্শন।

 

কাগান কোহেনের নীতিশাস্ত্রকে রাশিয়ার জনতুষ্টিবাদের [পপুলিজম] সাথে মিলিয়েছেন। বাখতিনের চিন্তায় পরে এ ধারণার প্রতিফলন দেখি, যেখানে বাখতিন জনতুষ্টিবাদীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে উপন্যাসকে যুক্ত করেছেন।

 

বাখতিনের চিন্তার বা নন্দনতত্ত্বের পূর্বসূত্র ঠিকঠাক খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এর গোড়া পোঁতা আছে আলোকায়ন-পরবর্তী নন্দনতত্ত্বের ঐতিহ্যে, বিশেষত কান্টে। কান্টের কাছে নন্দনতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘নিরাসক্তি’ Ñ যে উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা, তার শরীর থেকে উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি মুছে ফেলা। কান্ট জোর দিয়েছেন নান্দনিক বিচারের উপর। অন্যদিকে বাখতিনে জোরটা পড়েছে নান্দনিক তৎপরতার উপর, যে তৎপরতা আন্তঃব্যক্তি-সম্পর্কের একটা আবহ তৈরি করবে, ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তরঙ্গ ঐক্য তৈরি করবে, কিন্তু তাদের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন করবে না। বাখতিনের লেখালেখিতে এ বস্তু প্রায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল, যদিও তার ধরন একই ছিল না।

 

সোস্যুরের ভাষাবিজ্ঞানও বাখতিনকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তিনি সোস্যুরের সমালোচনা করেছিলেন এ কারণে যে, সোস্যুর বিচিত্র অসম শৈলীর সমবায় হিসাবে ভাষাকে না দেখে ব্যক্তিগত শৈলী হিসাবে দেখেছেন। ভাষাকে সোস্যুর দেখেছেন একটা কাঠামো হিসাবে। সমাজের বিচিত্র-বিবিধ ভাষারূপ একত্রে সহাবস্থান করে নতুন কেজো বা ব্যবহারিক স্বভাব অর্জন করে। সোস্যুরের ভাষা-কাঠামো ভাষার এই বাস্তব স্বভাবের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অন্যদিকে তিনি ফরমালিস্টদের, বিশেষত রোমান ইয়াকবসনেরও সমালোচনা করেছেন, কারণ, তারা ভাষাকে মূলত কাব্যিক ডিসকোর্স হিসাবে দেখেছে। কাব্যে কবির কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে একস্বরী বয়ান তৈরি হয়, যা সমাজের বহুস্বরতা বা বহু-বাস্তব-সমন্বিত বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উপন্যাসই কেবল সামাজিক বহুস্বর এবং বহুবাস্তবকে ধারণ করতে পারে।

ব্যক্তির কর্তৃত্বে ব্যক্তি-লেখকের আজ্ঞাবহ হয়ে উপন্যাসের ডিসকোর্স বিশ্লেষণের যে রেওয়াজ সারা দুনিয়ায় প্রতাপশালী ছিল এবং আছে, উপন্যাসের বহুস্বরতার ধারণা তাকে নাকচ করে দেয়।

ভাষাকে মোকাবেলা করার এই বাখতিনীয় কায়দার প্রথম সাক্ষাৎ মেলে ১৯২৬ সালে লেখা ভলশিনভের প্রবন্ধ ‘ডিসকোর্স ইন লাইফ এন্ড ডিসকোর্স ইন পয়েট্রি’ প্রবন্ধে। এ প্রবন্ধ ভলশিনভ লিখেছিলেন এম এ থিসিস হিসাবে। তাঁর পরামর্শকদের মধ্যে ছিলেন এল. ডপ. আইয়াকুবিনস্কি, যাঁকে সংলাপায়িত বচন পাঠতত্ত্বের উদগাতা বলা যায়। ভলশিনভের প্রবন্ধটিকে প্রাগমাটিক শাস্ত্রের প্রথম নমুনা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, এবং এটিই বাখতিন সার্কেলের মার্কসিস্ট অভিধায় পড়ার মতো প্রথম রচনা। এ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, সমাজের অচিহ্নিত মূল্যমানগুলো শিল্পকর্মে ঘনীভূত এবং নির্ণীত হয়ে ফর্মে রূপলাভ করে। সামাজিক কাঠামোর গভীরতর বৈশিষ্ট্যগুলো সফল শিল্পকর্মে আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়। ভলশিনভের ভাষায়, ‘শিল্পরূপ বস্তুত বিষয়বস্তুর জুতসই পরিণতি।’ প্রথম যুগের বাখতিন সার্কেলের চিন্তার প্রকৃতিকে এসবের ভিত্তিতে সামাজিক কাঠামোর সাথে ডিসকার্সিভ মোলাকাত হিসাবে দেখা চলে।

 

এ সময়ে মেদভেদেভ কাব্যতত্ত্বকে এবং ভলশিনভ যোগাযোগকে সামাজিক-সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কাজ করছিলেন। রাশিয়ার মার্কসবাদী চর্চা, বিশেষত নিকোলাই বুখারিনের চর্চার সাথে সমসাময়িক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর একটা মেলবন্ধন তৈরির দিকে নজর ছিল দুজনেরই। ‘দ্য ফরমাল মেথড ইন দ্য লিটারেরি স্কলারশিপ’ (১৯২৮) প্রবন্ধে মেদভেদেভ দেখান, সমাজে বিদ্যমান প্রধান বাস্তবতাগুলো সাহিত্যকে ভিতর থেকে এবং বাহির থেকে প্রভাবিত করে, আর সে কারণেই ব্যক্তি সাহিত্যিকের কলাকৌশলের খোঁজখবর সাহিত্যিক প্রবণতার নিরিখেই হওয়া উচিত।

 

মার্কসিজম এন্ড দ্য ফিলসপি অব ল্যাঙ্গুয়েজ (১৯২৯) কেতাবে ভলশিনভ দেখান, ভাষা আদতে সামাজিক যোগাযোগের ফল, সংলাপের ভিতর থেকে এবং মধ্য দিয়ে এর উদ্ভব। বুহ্লারের অনুসরণে তিনি আরো বলেন, উচ্চারণই ভাষার কেজো একক। এই সামাজিক যোগাযোগতত্ত্ব অনুযায়ী, ভাষা সমাজের আদলেই কাজ করে; ফলে ভাষার বিভিন্ন রূপ সমাজের কোনো না কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণির জীবনদৃষ্টি বহন করে। বাখতিন তাঁর বিখ্যাত দস্তয়ভস্কি-থিসিসে ভাষার কার্যপ্রণালির এ ধারণা ব্যবহার করেছেন। তাঁর ধারণা মোতাবেক, লেখক বিদ্যমান ভাষাগুলোর সমবায়ে একটা ‘বহুস্বরী’ পাটাতন তৈয়ার করেন, যেখানে বর্ণনাকারীর ভাষাসহ সব ভাষাই সমপর্যায়ে থেকে গণতান্ত্রিক মেজাজে সংলাপরত হয়।

 

বাখতিন যখন লেনিনগ্রাডে তখন ফরমালিস্টরা তাদের সৃষ্টিশীল তত্ত্ব ও লেখাপত্র প্রকাশ করছিল। বাখতিন এবং তার বন্ধুরা এসব লেখাপত্রের ব্যাপারে তীক্ষè নজর রেখেছিলেন, আর এই ধারণাগুলোকে নাকচ করে দিয়ে রচনা করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সন্দর্ভ। অবশ্য বাখতিন প্রথম থেকেই ধারণার দিক থেকে, বলতে হয়, ফরমালিস্টদের অগ্রবর্তী ছিলেন। ‘ডিসকোর্স ইন দ্য নভেল’ তিরিশের দশকের লেখা। ভাষা ও সাহিত্যের যেসব দৃষ্টিভঙ্গি এ রচনায় পাচ্ছি, সেগুলো নিঃসন্দেহে কাঠামোবাদ এবং উত্তরকাঠামোবাদী চিন্তার পূর্বসূত্র হিসাবে পাঠ্য। যদিও বলে রাখা ভালো, কাঠামোবাদী বা উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার সাথে বাখতিনের চিন্তার মৌলিক পার্থক্য, এমনকি বাখতিন যখন পশ্চিমে কাঠামোবাদী চিন্তার দিক থেকে পঠিত হচ্ছিলেন তখনো, গোপন ছিল না।

 

১৯২৯-এর দস্তয়ভস্কি থিসিসে বাখতিন দাবি করেছিলেন, বহুস্বরতা দস্তয়ভস্কির উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘বহুস্বরী’ কথাটা অবশ্য আগেই কোমারোভিচ ব্যবহার করেছিলেন। সঙ্গীতের বহুস্বরতার সাথে দস্তয়ভস্কির উপন্যাসের তুলনা করেছিলেন তিনি। অবশ্য তাঁর ভাষ্যমতে, দুই ক্ষেত্রেই রচয়িতার আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বহু স্বর ঐকতানে পৌঁছায়। বাখতিন ঠিক এখানেই তাঁর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে হাজির হন। বলেন, বহুস্বরের প্রতিটি স্বরই স্বয়ংসম্পূর্ণ; এবং তারা একত্রে ক্রিয়া করে একটা শৈল্পিক মুহূর্ত বা ঘটনা হিসাবে। কবিতায় নয়, কিন্তু উপন্যাসে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন স্বর একত্রে উপস্থাপিত হয়, এমনকি যে স্বরগুলো উপন্যাসে যথেষ্ট যত্ন নিয়ে উচ্চকিত করা হয় না, সেগুলোর হাজিরা এবং ব্যক্তিত্বও উপন্যাসে অক্ষুণ্ন থাকে। ১৯২৯-এর বইয়ের পরে ‘ডিসকোর্স ইন দ্য নভেল’ প্রবন্ধে ধারণাটা আরো বিশদ করা হয়। ধারণাটা নিঃসন্দেহে উত্তর-কাঠামোবাদী ভাষাচিন্তার কোনো কোনো দিকের পূর্বসূরি।

 

ব্যক্তির কর্তৃত্বে ব্যক্তি-লেখকের আজ্ঞাবহ হয়ে উপন্যাসের ডিসকোর্স বিশ্লেষণের যে রেওয়াজ সারা দুনিয়ায় প্রতাপশালী ছিল এবং আছে, উপন্যাসের বহুস্বরতার ধারণা তাকে নাকচ করে দেয়। দস্তয়ভস্কি বিষয়ক বইয়ের শুরুতে বাখতিন আগের দস্তয়ভস্কি-বিষয়ক গ্রন্থগুলোর মূল্যায়ন করেছেন। বলেছেন, তাঁরা উপন্যাস ব্যাখ্যা করেছেন হয় সমকালীন সমাজের দর্পণ হিসাবে, অথবা লেখক-মানসের জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ হিসাবে। পরে বাখতিন এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘ডিসকোর্স ইন দ্য নভেল’ প্রবন্ধে কাব্যপাঠের ভঙ্গি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, এ ভঙ্গি কবিতার মতোই উপন্যাসেও ঐক্য খোঁজে, এবং যে বিচিত্র স্বর একীভূত হয়ে উপন্যাসে বহু-বাস্তব-সমন্বিত বাস্তব বা হেটারগ্লসিয়ার প্রতিফলন হয়, তার দিশা পেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

 

ক্রাইম এন্ড পানিসমেন্ট উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে রাসকলনিকভ ঢুকেছিল পাবে, চিন্তামগ্ন অবস্থায়। মাতাল মারমেলাদভ সেখানে তার নিজের কাহিনি বলতে শুরু করে। রাসকলনিকভকে কোনো প্রকার পাত্তা না দিয়েই সে কথা বলে যায়। সে আসলে শ্রোতার মতামত বা উপদেশও চায় নাই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে যেন নিজেকেই নিজের গল্প শোনায়। এখান থেকে বাখতিন সিদ্ধান্ত টেনেছেন, দস্তয়ভস্কি তাঁর উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের সম্মিলন ঘটান না, লেখকের মনের কোনো বস্তুনিষ্ঠ মনজিলে পৌঁছান না, বরং সমপর্যায়ের চরিত্রগুলো নিজেদের আলাদা জগৎ নিয়ে কোনো ঐকতান ছাড়াই একটা ময়দানে একত্রে অবস্থান করে।

 

উপন্যাসের বহুস্বরতা সম্পর্কে বাখতিনের আরেক সিদ্ধান্ত এই যে, বিভিন্ন সামাজিক স্তরের ভাষার যে সমন্বয় উপন্যাসে ঘটে তা সংলাপধর্মী। এ দিক থেকেও বাখতিনের কাছে দস্তয়ভস্কির উপন্যাস আদর্শস্বরূপ। অর্থাৎ, লেখকের প্রচণ্ড প্রতাপে স্বরগুলোর বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়ে তা একস্বরী হয়ে ওঠে না; বরং আলাদা আলাদা ভাবে পরস্পর সংলাপায়িত ভঙ্গিতে সহাবস্থান করে। একেই পরে তিনি সংলাপধর্মী কল্পনা বা ডায়ালজিকেল ইমাজিনেশন বলবেন। বাখতিনের মতে, দস্তয়ভস্কির উপন্যাসে চরিত্রের কথাও — যাকে তিনি ডিসকোর্স নামে চিহ্নিত করেন — অন্য চরিত্রের কথার সাথে সংলাপধর্মী সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে।

 

বাখতিনের লেখালেখি প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, হেটারগ্লসিয়া বা বহু-বাস্তব-সমন্বিত বাস্তবের ধারণা তাঁর লেখায় ‘ডিসকোর্স ইন দ্য নভেলে’র আগে থেকেই ছিল। যদিও অন্য নামে। পুরনো ভাষাবিশ্লেষকরা যাকে একস্বরী ডিসকোর্স হিসাবে চিনতেন তাকেই বাখতিন আগে ‘বহুস্বরী’ এবং পরে ‘বহু-বাস্তব-সমন্বিত বাস্তব’ নাম দেন। এটা আসলে শিল্পকর্মে বিচিত্র সামাজিক স্তরের ও অংশের সহাবস্থান; যেমন, আদালতের ভাষা, সাংবাদিকি ভাষা, প্রাত্যহিক ভাষা ইত্যাদির সহাবস্থান। তদুপরি, উপন্যাসের ডিসকোর্সে সংলাপ বা কথা এমন কোনো উপাদান নয় যা একজন আরেকজনের উদ্দেশে বলে। আক্ষরিক অর্থ প্রদান করেই সংলাপ বা কথাগুলো নিঃশেষ হয় না। বরং বিচিত্র ডিসকোর্সের টানাপড়েনে কথারা এখানে পরস্পর সংলাপধর্মী সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে জিয়ল স্বভাব অর্জন করে।

 

১৯৩০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বাখতিন কার্নিভাল তত্ত্ব গড়ে তুলতে থাকেন। প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান একটা সচল সংস্কৃতিতে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে পারে — নিকোলাই মার প্রমুখের লেখায় এ ধরনের একটা ধারণার প্রকাশ ঘটেছিল। বাখতিনের হাতে তা কার্নিভাল তত্ত্বে রূপ নেয়। এখানে বাখতিন দেখান, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে হাস্যরসের যে বিচিত্র উৎসারণ, তা সাহিত্যিক ফর্মের মধ্যে অঙ্গীভূত হতে পারে। মধ্যযুগে রাস্তার কার্নিভালে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রীতি ও কাঠামো সীমিত পরিসরে ভেঙে দেয়ার অনুমোদন ও চল ছিল। এই বস্তু যখন ‘বড় সাহিত্যে’ স্থান পায় এবং আনুষ্ঠানিক ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি নতুন কাঠামোয় উঠে আসে, তখন সৃষ্টিশীলতার পর্যালোচনামূলক প্রবণতার টানে আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণ ঘটে, আর জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা দূরীভূত হয়। রেনেসাঁসের জমানা জুড়েই এ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছেন বাখতিন, যদিও ফরাসি ঔপন্যাসিক ফ্রাঙ্কোইস র‌্যাবেলাইস তাঁর বেশি মনোযোগ পেয়েছে।

 

জোসেফ স্টালিনের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হলে বাখতিন সার্কেলের কাজ আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঘটনাপরম্পরায় বাখতিনের তাৎপর্যপূর্ণ লেখালেখির বড় অংশটা রচিত হয়েছিল এর পরেই। এ সময়ে বাখতিন সাহিত্যের ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক নতুনপাঠ আনেন, আর তার মধ্যে উপন্যাসকে স্থাপন করেন। এতে লুকাচের পুনঃপাঠ আছে। বাখতিনের উপন্যাসপাঠে গোঁড়া, কর্তৃত্ববাদী লেখককেন্দ্রিকতাকে ‘এককেন্দ্রিক’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করা হয়, সামনে আনা হয় পর্যালোচনাধর্মী গণতান্ত্রিক ‘সংলাপময়তা’র ধারণা।

 

উপন্যাসতত্ত্বের জগতে লুকাসের গ্রন্থ বিশেষভাবে প্রতাপশালী। এ বইটির প্রতিক্রিয়ায় এ সম্পর্কিত বহু লেখালেখি হয়েছে। বাখতিন ১৯২০-এর দিকে থিয়োরি অব দ্য নভেল-এর অনুবাদ শুরু করেছিলেন। তবে লুকাচ নিজে বইটি আর পছন্দ করেন না, এমন সংবাদের ভিত্তিতে ওই প্রকল্প বাদ দেন। ১৯৩০-এর দশকে স্টালিনের সাথে ভিড়ে যাওয়ার পরে, আর কার্যত এক দক্ষিণপন্থি হেগেলীয় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পরে, লুকাচের বইটি রীতিমত কানুনধর্মী [ক্যানোনিকেল] হয়ে ওঠে। উপন্যাসে ‘যুগসত্য’ প্রকাশিত হয় — লুকাচের এ মতের সাথে বাখতিন একমত। লুকাচের মতো বাখতিন এও মনে করেন, আইরনি উপন্যাস রচনার খুব কেন্দ্রীয় উপাদান। কিন্তু লুকাচ যে মনে করতেন, বিশৃঙ্খল দুনিয়ায় শৃঙ্খলা স্থাপন করতে না পারলে, অর্থাৎ কর্তৃত্বপূর্ণ লেখকসত্তার প্রকাশ না ঘটলে, বুঝতে হবে, ঔপন্যাসিক বুর্জোয়া দুনিয়ার ক্ষয়ের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন — বাখতিন সে মত খারিজ করে দেন। ফর্ম নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কারিগরি আর প্যারডির অতিরেক লুকাচের কাছে যেখানে ‘বুর্জোয়া ক্ষয়ে’র চিহ্ন, বাখতিন সেখানে এ উপাদানগুলোর জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক উৎস তালাশেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর কাছে উপন্যাস কিছুতেই সমসাময়িক দৌড়ের-উপর-থাকা সমাজের আশ্রয় নয়, বা এমন কিছুও নয় যার মধ্য দিয়ে প্রগতির নিশানা দেখা যাবে; বরং সমাজে বিদ্যমান জিন্দা বা গতিশীল যে শক্তিগুলো সমাজকে একটা জনপ্রিয়-গণতান্ত্রিক রূপ দিতে পারে, সেগুলোর একত্র-উপস্থাপনা। চূড়ান্ত বিচারে লুকাচ চেয়েছেন মহাকাব্যোচিত সমাপ্তি, আর বাখতিন খোলামুখ সমাপ্তি। লুকাচ আশা করেছেন শক্তিমন্ত বয়ানের উপস্থিতি, বাখতিন চেয়েছেন বহুভাষার পারস্পরিকতা এবং এর মধ্য দিয়ে ডিসকোর্সের পরীক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনার বৃদ্ধি। বলা যায়, লুকাচের বিপরীতে বাখতিনের অবস্থান অনেকটা বামপন্থি হেগেলীয়। বাখতিনের সংলাপধর্মিতা এক অর্থে হেগেলীয় ‘গাইস্টে’র সমরূপ ধারণা। উভয়েই সামষ্টিকভাবে যাপিত জীবনের সমগ্রতা প্রকাশ করে।

 

রেনেসাঁকালীন ফরাসি লেখক র‌্যাবেলাইসকে নিয়ে বাখতিন তাঁর পিএইচডি থিসিস লিখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে, যদিও পেয়েছিলেন ছোট ডিগ্রি। থিসিসের নাম ছিল র‌্যাবেলাইস এন্ড দ্য ফোক কালচার অব দ্য মিডল এজেজ। ১৯৬৫ সালে বই প্রকাশের কালে এর নাম হয় র‌্যাবেলাইস এন্ড হিজ ওয়ার্ল্ড। এ বইতে বাখতিন আনুষ্ঠানিক উৎসব আর লোক-উৎসব বলে দুটি বর্গ প্রস্তাব করেছেন। প্রথমটিতে কর্তৃত্ব বজায় থাকে। তার মানে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধানের আলোকে এ ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু লোক-উৎসবে বিধি-বিধানের নির্দিষ্টতা থাকে না। কাঠামো মান্য করার চাপও থাকে না। ফলে এ ধরনের আয়োজনে প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত সামাজিক শৃঙ্খলার কেন্দ্রাতিগ সমালোচনা হয়। অনুষ্ঠানের ধরনের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ ঘটনা ঘটতে থাকে। বাখতিন লোক-উৎসবের এই দিকটিকেই সামনে এনেছেন।

 

র‌্যাবেলাইস বিষয়ক থিসিসে বাখতিন ওই সময় ও সমাজবাস্তবতার একটা নিপুণ পটভূমি অঙ্কন করে তার সাপেক্ষে র‌্যাবেলাইসের সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। যে ধারণা বা বর্গ ব্যবহার করে তিনি কাজটা করেছেন, সেগুলো তাঁর নিজের উদ্ভাবন; আর সেগুলোকে সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা হিসাবে ব্যাখ্যার কৌশলও তাঁর আবিষ্কার। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তিনি এখানে আবার সামনে এনেছেন। একটি হল মধ্যযুগের কার্নিভালের অভ্যন্তর বহুস্বরতা ও সম্ভাবনা র‌্যাবেলাইসের কথকতায় কিভাবে আধুনিক জমানার ইশারা হিসাবে রূপান্তরিত ও রূপায়িত হয়েছিল, তার বিস্ময়কর জরিপ; অন্যটি হচ্ছে র‌্যাবেলাইসের উপন্যাসে কার্নিভালে প্রদর্শিত উদ্ভট ও হাস্যরসাত্মক শরীরী আকৃতির [গ্রটেস্ক রিয়েলিটি] নিপুণ ব্যবহারের তাৎপর্য। দস্তয়ভস্কি-থিসিসের মতো এ বইতেও বাখতিন দেখিয়েছেন, চরিত্র ও ঘটনার অনিঃশেষ সম্ভাবনা [ওপেননেস] র‌্যাবেলাইসের রচনারও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন