নজরুল নাটকে শিল্পভাবনা

 ড. আফসার আহমদ

কবির হাতের নাটক লেখা হলে নাটকের ভাষা ও চরিত্র বদলে যায়। নাটক তখন শুধু বস্তুগত জীবনের ভাষাচিত্র হয়ে থাকে না, তা হয়ে ওঠে জীবনের কাব্যরূপ। কাজী নজরুল ইসলামও তেমনি যেসব নাটক রচনা করেছেন তাতে জীবনের হুবহু অনুকরণ ঘটেনি; তা হয়েছে জীবনের ব্যাখ্যা। আর এই ব্যাখ্যা কাব্যের অনুপম ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবনকে প্রতীকায়িত করেছে। নজরুলের লেখা সব নাটক তাই ভিন্নার্থে আলোচনা হওয়া দরকার। অর্থাৎ আমাদের মতে, নজরুলনাট্যের একটি পুনঃপাঠ তৈরি হওয়া প্রয়োজন নতুন কালের নাট্যভাবনার নিরিখে। আর এ কথা সত্য যে, নাটক কিংবা কাব্যরস আস্বাদন কালনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে শাশ্বতকালের আবেদন যখন শিল্পভাবনায় তুঙ্গস্পর্শী থাকে। সেদিক থেকে নজরুল বাংলা নাট্য রচনার ধারায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যের সঙ্গীতময়তাকে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতে পেরেছেন। কারণ নজরুলের নাটকের ভাষা গীত ও কাব্যের যুগলবন্দি রূপ।
এ কথা অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়, নজরুল কবি ও সঙ্গীত রচয়িতা বলেই তাঁর নাটকের সংলাপে কাব্যের আবহ রচিত হয়েছে। এবং একই সঙ্গে নাটকে সঙ্গীতের আধিক্য ঘটেছে। সঙ্গীতের এই আধিক্য অনেকের কাছে বাহুল্য মনে হয়েছে। কারণ তাঁরা নজরুলের ভেতরের গীতের প্লাবনকে অনুভব করেননি। বাঙালির হাজার বছরের গীত-সুধারসের যে ধারাটি নজরুলের মানস-ভুবনকে প্লাবিত করেছে, তারই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নাটকে। এ বিষয়টি হয়তো অনেকের কাছেই তাঁকে সার্থক নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত হতে দেয়নি। সে ত্রুটি কবির নয়, তা ঔপনিবেশিক শিল্পভাবনা-পুষ্ট সমালোচকদের। কারণ তাঁরা বাংলাদেশের হাজার বছরের গেয়মূলক নাট্যপরিবেশনার খোঁজ রাখতে চান না। বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ-ব্যাপ্ত মধ্যযুগের লিখিত ও মৌখিক ধারার অধিকাংশ কাব্য ছিল আসরে আসরে পরিবেশনমূলক। ঔপনিবেশিক ভাবনাপুষ্ট বাংলা নাটকের ইতিহাস রচয়িতারা, যাঁরা বিশ্বাস করেন- ইংরেজরা এদেশ দখল করার আগে কোনো নাটক ছিল না, তাঁদের হাতেই রচিত হয়েছে বাংলা নাটকের বিভ্রান্তিকর ইতিহাস। অথচ হাজার বছর ধরে বঙ্গীয় ভূখণ্ডে নাটকের একটি সমৃদ্ধ ধারা তৈরি হয়েছিল। আর বাংলা নাটকের এই ইতিহাস প্রায় দু'হাজার বছরের। খ্রিষ্টপূর্ব দুইশ' বছর আগে রচিত ভরত নাট্যশাস্ত্রে 'ওঢ্রমাগধী' বলে যে নাট্যরীতির পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে বঙ্গীয় নাট্যধারার উল্লেখ রয়েছে। ভরতের মতো অভিজাত আর্য শাস্ত্রকার বাংলা নাট্যের শক্তিশালী রূপটি অস্বীকার করতে পারেননি বলেই তাঁর নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অনার্যরীতি বলে বাংলা নাটকের রূপরীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি। পরবর্তীকালে এই রীতির নাটকের নমুনার উল্লেখ পাই বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদে। আমরা দেখি, বাংলা নাটকের গড়ন গঠনে সঙ্গীত প্রযুক্ত হয়েছিল বাঙালির শিল্পমানসের অনিবার্য উপাদান হিসেবে। আর এ জন্যই বর্ণনা, সঙ্গীত ও সংলাপের ত্রয়ী বন্ধনে রচিত হয়েছিল হাজার বছরের বাংলানাট্যের শরীর। নজরুল ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের এই বিষয়টির সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই পরিচিত ছিলেন। নজরুলের নাট্যবৈশিষ্ট্য আলোচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।


কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শুরুতে জীবিকার তাগিদে যোগ দিয়েছিলেন গ্রাম্য লেটো গানের দলে। লেটো গানের মধ্যে পাঁচালি, পালা ও লোকজীবনের সঙ্গে অঙ্গীকৃত মানবিক ভাবনার মহৎ প্রকাশ ঘটেছে। ফলে নজরুলের ভেতরে, শিল্পের পথে তাঁর যাত্রার শুরুতে, বয়স যখন কবির ১২/১৩ বছর, সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রাণের যে সুরধারা প্রতিষ্ঠা পেল, তা সারাটা জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়েছে নব নব সৃজনের সার্থক ভুবনে। লেটো গানে পালা রচনার মধ্য দিয়ে নজরুলের নাট্যপ্রতিভার উন্মেষ বলেই সুর ও কাব্য তাঁর পরিণত জীবনে লেখা নাট্য থেকে বিসর্জিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ উত্তরসূরি তাঁকে বলতে পারি এ জন্য যে, রবীন্দ্রনাথের মতোই সুর ও কাব্যময়তাকে বাঙালির শিল্পভাবনার উৎসের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন নজরুল। তাই বলা যায়, বালক কবির হাতে রচিত লেটো গানের পালার মধ্যে সঙ্গীতের যে রূপায়ণ ঘটেছিল, তার পরিণত ও আধুনিক প্রকাশ হল 'আলেয়া' (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), 'ঝিলিমিলি' (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ), 'শিল্পী', 'সেতুবন্ধ' (১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ), 'মধুমালা' (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) প্রভৃতি নাটক। কবিজীবনের শুরুতে নজরুল দর্শকপ্রিয়তাকে মূল বিবেচনায় রেখে রচনা করেছিলেন 'দাতা কর্ণ', 'শকুণি বধ', 'চাষার সং', 'মেঘনাদ বধ', 'কবি কালিদাস', 'আকবর বাদশা' প্রভৃতি নাট্যপালা। এসব পালা গান সুর, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে আসরে আসরে উপস্থাপন করতেন বালক কবি। জীবনে কত না যন্ত্রণা সয়েছেন, কত মানুষই তাকে ছেড়ে গেছে! কিন্তু সুর তাঁকে ছাড়েনি। তা আরও পরিণত হয়ে উঠেছে। বাঙালির শিল্পমানসে সঙ্গীতের যে অনিবার্যতা, তা থেকে নজরুল বিযুক্ত ছিলেন না বলেই সঙ্গীতকে নাটকের পরিপূরক করে নতুন নতুন নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবি তাঁর নাট্যভাবনাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। এর একটি উদাহরণ হলো ১৯২৮ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য একাঙ্কিকা ও রেকর্ড নাট্য রচনার প্রচেষ্টা।

ওই যে লেখার আরম্ভে বলেছিলাম, নজরুলের নাট্যরচনা যেন একটি পূর্ণাঙ্গ সিম্ম্ফনি। জীবনের সব পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেই তা এগিয়ে গেছে শিল্পের অভীষ্টভূমির পানে এবং রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ সিম্ম্ফনি। একেবারেই বৈষয়িক প্রয়োজনে বেঁচে থাকার অবলম্বনরূপে কবি যে রেকর্ড নাটিকাগুলো রচনা করেছিলেন, তাতে সুরের মধ্য দিয়ে শ্রোতার সামনে বহু চিত্রকল্পের সমাহার ঘটিয়েছেন কবি। আর এভাবে তাঁর গাননির্ভর নাট্য প্রযোজনাও সেই বালক নজরুলের ঐতিহ্যমনস্ক বিচিত্র ভুবনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে। কবির এ পর্যায়ের রচনাগুলো অপ্রধান হলেও উল্লেখের দাবি রাখে। আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত একাঙ্কিকা ও রেকর্ড নাট্যের তালিকার মধ্যে 'ছিনিমিনি খেলা', 'খুকী ও কাঠ বেড়ালী', 'জুজুবুড়ির ভয়', 'পুতুলের বিয়ে', 'শ্রীমন্ত', 'আল্লার রহম', 'কবির লড়াই', 'কলির কেষ্ট', 'কানামাছি ভোঁ ভোঁ', 'বনের বেদে' উল্লেখযোগ্য। এসব রচনাকে আমরা নজরুলের নাট্য রচনার প্রস্তুতিকালের নাটক বলে গণ্য করতে পারি। তাঁর নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। তিনি এ সময় উপলব্ধি করেছেন, মঞ্চ ব্যতিরেকে নাটকের প্রায়োগিক শৈলী কখনোই শরীরী হয়ে ওঠে না। আর এভাবে কবিকৃত নাটকগুলো বাংলা নাট্যের হাজার বছরের রূপটি অঙ্গীকরণপূর্বক আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃত নাট্যের সূত্র অনুযায়ী দৃশ্যকাব্য কথাটি হয়তো নজরুলের বিবেচনাকে ঋদ্ধ করেছিল। কারণ নজরুল শুধু মঞ্চায়নের বিষয়টিকে বড় করে দেখেননি। নাটকের পাঠযোগ্যতাকেও বিবেচনায় রেখেছেন। এ জন্যই দৃশ্যকাব্যের শ্রব্য এবং দর্শনের বিষয়টি নজরুল সাঙ্গীকরণ করেছেন তাঁর নাটকে। তবে আমরা দেখেছি যে সঙ্গীতময়তাকে কেন্দ্রে রেখেই দৃশ্য এবং শ্রব্যের এই অদ্বৈত রূপটি গড়ে উঠেছে বাংলা নাটকের হাজার বছরের ধারায়। আর নজরুল তাঁর নাটকে বাংলা নাট্যের ঐতিহ্যের এই ধারাকে অঙ্গীকরণ করেছিলেন বলেই আধুনিক বাংলা নাটকের ধারায় নজরুলের স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পসিদ্ধি। আধুনিক বাংলা নাটকের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নাট্যকার হিসেবে নজরুলের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে গেলে এই শিল্পবোধটির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।

কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ নাট্য নিদর্শন হিসেবে আমরা আলেয়া, ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ, শিল্পী, ভুতের ভয়, মধুমালার নাম উল্লেখ করব। এগুলোর মধ্যে আবার পাশ্চাত্য ঘরানার শিল্পরীতির বিভাজিত পথটি ধরে অনেকেই কয়েকটি নাটককে প্রতীকী, রূপক কিংবা সাংকেতিক ইত্যাকার অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। আসলে কাজী নজরুল ইসলাম যে সময়ে নাটক রচনায় হাত দিয়েছেন, তার অব্যবহিত পূর্বকাল থেকেই রবীন্দ্রনাট্যের জয়যাত্রা শুরু। ইউরোপীয় শিল্পরীতির আলোয় পরিস্নাত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যপ্রতিভার স্টম্ফূরণ ঘটেছে। ফলে নজরুলের নাটক বিশ্নেষণের ক্ষেত্রে ইউরোপমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির রূপক সাংকেতিকতার ধূম্রজালে তাঁর নাট্য রচনার স্বতন্ত্র রীতিটি হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন করে রবীন্দ্রনাট্যের রূপক সাংকেতিকতা বিশ্নেষণ করে থাকেন ঔপনিবেশিক শিল্পভাবনা-পুষ্ট বোদ্ধারা। অথচ রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল ইউরোপীয় রূপক সাংকেতিকতার আদলে কোনো নাটক রচনা করেননি। রূপক কিংবা সাংকেতিকতা তাঁদের নাটকের মূল অবলম্বন নয়; কোনো তত্ত্বের অনুকরণে তাঁরা নাটক রচনা করেননি। রূপক কিংবা কোনো গূঢ়তত্ত্ব যদি তাঁদের নাটকে থাকে তা কেবল মূল শিল্পভাবনার বিচ্ছুরণমাত্র। যেমন, 'মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না' কথাটির মধ্যে যে রূপক 'মনরূপ মাঝি', তার সঙ্গে একটি জনপদের বিস্তৃত জীবনের বহুমাত্রিক চিত্রকল্প উদ্ভাসিত। তা কোনো দুরূহ সংকেতে পর্যবসিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের নাটকে একেবারেই প্রাচ্য ঘরানার শিল্পতত্ত্বের উত্থান ঘটেছে। নজরুলের আলেয়া, ঝিলিমিলি, শিল্পী ও সেতুবন্ধ নাটকের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখব যে রূপক-সাংকেতিকতার ভাবনাটি ইউরোপীয় শিল্পতত্ত্ব থেকে আলাদা হয়ে তাঁদের শিল্পভাবনার সঙ্গে অঙ্গীকৃত হয়েছে। এ বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।

নজরুলের 'আলেয়া' নাটক নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায়। আলেয়া নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণ দেখেই একে প্রতীক নাটক নামে অভিহিত করা হয়। এই ভাবনাটির মধ্যে নজরুলকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা যেমন রয়েছে, তেমন করে নজরুলের মহৎ প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। এই নাটকটি সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আলেয়া প্রায়ই গ্রাম্য জনপদের বিরান প্রান্তরে, বিলের ধারে হঠাৎ জ্বলতে দেখা যায়। জ্বলেই আবার হারিয়ে যায় আলেয়া। আলেয়ার মতো নর-নারীর চিত্তেও হঠাৎ প্রেমের শিখা জ্বলে ওঠে এবং তা অনির্দেশ্য কোন বেলাভূমিতে আবার হারিয়ে যায়। এসব বিবেচনায় এটিকে প্রতীকী নাটক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই মতটির সঙ্গে আমাদের খুব বেশি বিরোধিতা করার নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এই নাটকের গীতিপ্রাবল্য দেখে গীতিনাট্য নামে অভিহিত করলেই আমাদের মধ্যে শিল্পবিচারের মাপকাঠি নিয়ে মতদ্বৈধতা তৈরি হয়। কিংবা গীতের আধিক্যের কারণে যদি একে প্রকৃত নাটকের মর্যাদা না দেওয়া হয়, তবেই শিল্পতত্ত্বের ভাবনাগত বিরোধাভাস তৈরি হয়। গীতের আধিক্য গীতিনাট্য হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের আসরে পরিবেশনমূলক গেয় কাব্যের অভিনয় রূপটি মিছে হয়ে যায়। কারণ হাজার বছরের বাংলা নাট্যের প্রাণটি লুকিয়ে রয়েছে গীতের শরীরে। গীত-সংলাপের ভেতর দিয়েই বিকশিত হয়েছে বাঙালির হাজার বছরের নাট্যরীতি। এই বিচারে নজরুলের আলেয়া তাই গীতিনাটক নয়; পরিপূর্ণ নাটক। গীত তার অবলম্বন, যেমন শরীরকে অবলম্বন করে থাকে আত্মা। নাটকের গঠন কাঠামোর মধ্যেই আলেয়া নাটকের সঙ্গীত প্রোথিত বলে তা নাট্যের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

আলেয়া নাটক প্রেমের আখ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এ নাটকের নায়িকা জয়নন্তীর প্রেম ব্যাকুলতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং আবেগের তীব্রতা শেষ পর্যন্ত নাট্য ঘটনায় ট্র্যাজিক আবর্ত তৈরি করেছে। জয়ন্তী, মীনকেতু ও উগ্রাদিত্যের ত্রিভুজ প্রণয়কাহিনী নাটকের আখ্যানকে পরিণামমুখী করেছে। কিন্তু জয়ন্তী আসলে কাকে ভালোবাসে, তা নিরূপিত নয়। এ যেন রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলা নাটকের প্রতিচ্ছবি। তবে গল্পের জটিলতা ও নাট্যের তীব্র গতির কারণে এটি স্বতন্ত্র ও অনবদ্য হয়ে ওঠে। আলেয়া তাই গীতের বন্ধনে নাটক কিন্তু গীতিনাট্য কখনও নয়। আলেয়া নাটকের সংলাপ রচিত হয়েছে গীত ও কাব্যের দ্বৈত বন্ধনে। এ যে কবির হাতে রচিত নাটক, জীবনের বিচিত্র আকুলতা সেখানে সুরের ধারায় একীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। নাট্যের বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে এতে, কিন্তু কবি বলেই কল্পনার অবাধ প্রবহমানতায় বস্তুনিষ্ঠতার ক্লিশে মোড়কটি ছিন্ন   করে নাট্য চরিত্রের জীবন সংলগ্নতার কাব্যভাষাকে নির্মাণ করেছেন নাটকে। শুধু এই নাটকেই নয়, নজরুলের সব নাটকেই নাট্যরস নিষ্পত্তিতে সহায়ক হয়েছে গীতরস।

বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে লেখা নজরুলের আরেকটি নাটক ঝিলিমিলি। বাস্তব জীবনের প্রেম ও বিরহকে কেন্দ্র করে এ নাটকটি লেখা হয়েছে। নজরুল যতই রোমান্টিক কিংবা বাস্তব বুদ্ধি-বিবর্জিত হোন না কেন, ঝিলিমিলি নাটকের প্রেম পরাস্ত হয়েছে প্রখর বাস্তবতার কাছে। পিতার বাস্তব বুদ্ধির যৌক্তিকতায় ফিরোজা ও হাবিবের প্রেম পরিণতি পায় না। ফলে নজরুলের নাটকে বাস্তবতার ঘাত- প্রতিঘাত একেবারেই নেই যাঁরা বলেন, তাঁরা কবির প্রতি বড় একটা সুবিচার করেন না। বাস্তবতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ঝিলিমিলি নাটকের কাহিনীতে যন্ত্রণা ও চেয়ে না পাওয়ার একটি তীব্র বেদনাবোধের বাণীচিত্র আমরা দেখতে পাই। হাবিব, ফিরোজা ও ফিরোজার পিতা মির্জা সাহেবের অবস্থান থেকে নাট্য ঘটনা ও চরিত্র বিচার করলে দেখব, বাস্তবতাকে নিয়েই গড়ে উঠেছে নাটকটির গল্পের ভুবন। কিন্তু দুঃসহ বেদনাময় পরিসমাপ্তি নাটকটিকে দিয়েছে কাব্যিক পরিব্যাপ্তি। বাস্তব প্রেমের আখ্যানের ভেতর দিয়ে এই নাটকে জীবনের সূক্ষ্ণ অনুভূতি অনুরণিত হয়েছে। এই নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে যেভাবে ফিরোজার না পাওয়ার যন্ত্রণাকে তার কল্পনার ভুবনে শোভন ও সুন্দর করে চিত্রিত করা হয়েছে, তা এক কথায় অনুপম। একে রূপক বলা যেতে পারে এই অর্থে যে, তা প্রাচ্য শিল্পভাবনাজাত জীবন ও প্রেমের নবতর ব্যাখ্যা; ঘটনার অন্ধ অনুকরণ নয়। এই কথিত রূপক সাংকেতিক ধারার আর একটি নাটক সেতুবন্ধ।

সেতুবন্ধ তিন দৃশ্যের একটি একাঙ্কিকা। আমরা এই নাটকে দেখি প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে প্রকৃতি কীভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারার সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুঁজতে পারেন। কিন্তু এই নাটকে নজরুল ইসলাম মানব জীবনের সংগ্রামী উত্থানকে ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের অসীম শক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে এ নাটকে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে। কিন্তু নাটকের শেষে চূড়ান্তভাবে প্রকৃতির জয় ঘোষণা করা হয়েছে। নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ করে নদী শাসন করাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে এই নাটকের গল্প। নাটকের শেষে প্রকৃতির বিজয় ঘোষিত হয়েছে এভাবে, ('তরঙ্গ-সেনাদল আসিয়া পতিত সেতুবন্ধের উপর পড়িয়া তাহাকে গ্রাস করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিপুল সেতুবন্ধ পদ্মা-গর্ভে লীন হইল। উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ-দল- গগন-চুম্বন প্রয়াসী হইয়া উঠিল। ... দেখিতে মেঘ কাটিয়া গিয়া পূর্ব্ব গগন সাতরঙা রামধনু-শোভিত হইয়া উঠিল। অস্তপাট সোনার গোধূলি-রঙে রাঙিয়া উঠিল। সূর্য্যদেব সহস্র কর বর্ষণ করিয়া পৃথিবীকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। পদ্মা তরঙ্গ-শিরে একরাশ ছিন্ন শতদল লইয়া স্বর্গের পানে তুলিয়া ধরিলেন, ঝঞ্ঝার ধূর্জ্জটী-কেশ পরাইয়া দিলেন। দূর মেঘলোকে বিজয়-দামামা-ধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল।)

যন্ত্র। (মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে) আমার মৃত্যু নাই। দেবী! আজ তোমারই জয় হ'ল। দেবতার মতো দানবও বলে,- 'সম্ভবামি যুগে যুগে।' আমি আবার নতুন দেহ নিয়ে আসব। আবার তোমার বুকের ওপর দিয়ে আমার স্বর্গজয়ের সেতু নির্ম্মিত হবে।


পদ্মা। জানি যন্ত্ররাজ। তুমি বারেবারে আসবে, কিন্তু প্রতিবারেই তোমায় এমনি লাঞ্ছনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ফিরে যেতে হবে। পদ্মার ওপর সাঁড়া ব্রিজ নির্মাণ সামনে রেখে নজরুল এই নাটক লিখেছেন। এই নাটকে যন্ত্র পরাজিত হয়েছে প্রকৃতির অমিত শক্তির কাছে। তারপরও এ নাটকে প্রকৃতি ও মানুষের পারস্পরিক এগিয়ে চলার চিত্র পরিস্ম্ফুটিত। একই সঙ্গে মানুষের অমিত সম্ভাবনার কথা উচ্চারিত হয়েছে এই নাটকে। আবার প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিধারাকে ব্যাহত করার ক্ষতিকর দিকটিও দেখানো হয়েছে। ফলে নাটকের দ্বন্দ্ব কোনো সাংঘর্ষিক স্থানে বৃত্তাবদ্ধ থাকে না। জীবনের গতিময়তাকেই প্রতীকী করে তোলে। এই ধারার নাটক রচনা থেকে নজরুল মানসের একবারেই ভিন্নরূপ দেখি মধুমালা নাটকে।

কাজী নজরুল ইসলাম রূপকথার মধুমালা-মদনকুমার, কাঞ্চনমালার গল্প নিয়ে মধুমালা নাটক রচনা করেছেন। রূপকথার অনিবার্য সঙ্গীতময়তাকে মূল বিবেচনায় রেখে এ নাটকে নজরুল বহুসংখ্যক গানের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। শুধু তাই নয়; নাটকটির গদ্য সংলাপও সুর ও কাব্যের যুগল সম্মিলনে অগ্রসর হয়েছে। এই নাটকের চরিত্রগুলো বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে বেড়ে উঠেছে। রূপকথার চরিত্রগুলো পার্থিব সংসারের মধ্যে স্বপ্নের আবহ তৈরি করেছে। মদনকুমার স্বপ্নে দেখা সেই অপরূপা রাজকন্যা মধুমালার সন্ধানে অজানার উদ্দেশে বের হয়। পথে আরেক রাজকন্যা কাঞ্চনমালার সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয়। তারপর কাঞ্চনমালাকে রেখে আবার মধুমালার সন্ধানে চলে যায় মদনকুমার। অবশেষে স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা মধুমালার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। অতঃপর মধুমালা ও মদনকুমার সমুদ্রপাড়ে বেড়াতে গিয়ে বিষণ্ণ যোগিনী কাঞ্চনমালাকে দেখে। মধুমালা কাঞ্চনমালার পরিচয় পেয়ে উপলব্ধি করে, বাস্তব সংসারের ক্লিন্নতায় তার এবং মদনকুমারের প্রেম সার্থক হবে না। অতঃপর মধুমালা সাগরের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

নজরুল রূপকথার একটি যৌক্তিক পরম্পরা তৈরি করেছেন শিল্পবোধের কালোচিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে। কারণ শাশ্বত ও আদি সৌন্দর্য কারও ভোগ্য হতে পারে না। এ যেন পৌরাণিক নারী উর্বশী, যে কারও স্ত্রী, কন্যা কিংবা মাতা নয়। আদ্য সৌন্দর্যের প্রতীক মধুমালা তাই সাগরজলে হারিয়ে যায়। এই নাটকের সংলাপ সুরেলা ও কাব্যিক। এ যেন আবহমান রূপকথার আধুনিক রূপায়ণ। নাটকটিতে রূপকথার আবেদন রয়েছে; কল্পনার চরিত্রগুলোর বিকৃতি ঘটেনি। অথচ বাস্তবতার মোড়কে রূপকথার আবহে নাট্যকার ও দর্শকের কল্পনায় নির্মিত হয়েছে নাটকের বিস্তৃত ভুবন। কবির হাতে নির্মিত হয়েছে দর্শকের মানস প্রতিমা। তাই যাঁরা বাংলা নাট্যের মূল প্রণোদনাকে উপলব্ধি না করে মধুমালা নাটককেও গীতিনাট্য বলতে চান, তাঁদের ঔপনিবেশিক মানসিকতাপুষ্ট শিল্পবিচারের প্রতি বড় জোর করুণা করা যায়; প্রশংসা নয়। নজরুলের মধুমালা দৃশ্য ও কাব্যের সংমিশ্রণে গঠিত বলে এটি সত্যিকার অর্থেই দৃশ্যকাব্য। গীত ও সংলাপের মধ্য দিয়ে এই নাটকের চরিত্রগুলো ক্রমাগত গঠিত হয়েছে। রূপকথা কিংবা ঐতিহ্যের ভেতরে থেকেই নাট্যচরিত্র ও নাট্যঘটনা আমাদের মস্তিস্কের কোষে কোষে ঐতিহ্যের আধুনিক ও বিশ্বাসযোগ্য নাট্য নির্মিতি সম্পন্ন করে।

কাজী নজরুল ইসলামকে এক শ্রেণির ধর্মজীবী সাহিত্য সমালোচক অতিমাত্রায় মুসলমান কবি কিংবা নাট্যকার হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। হাজার বছরের মানবতাবাদী বাঙালির শিল্পধারার উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁকে কমই দেখানো হয়েছে। অনেকেই আবার নজরুলের নাটক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাঁকে উত্তর-তিরিশের মুসলমান নাট্যকারদের প্রেরণার উৎসরূপে বিবেচনা করেছেন। এই মূল্যায়নেও নজরুল খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত। নজরুলের নাটক বিচার করতে হবে হাজার বছরের নৃত্য-গীত ও কাব্যময় বাংলা নাট্যের পটভূমিতে। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক ক্লিশে ইওরোপীয় নাট্যধারার অনুকৃতির বদলে বাংলা নাটকের শাশ্বতকালের সুরধর্মিতা অঙ্গীকরণের ফলে নজরুললের নাটকের সচেতন গীতবহুলতা তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলা নাট্যধারায় কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরসূরি। নজরুল হাজার বছরের আখ্যানধর্মী বাংলা নাট্যের সুর ও কাব্যভাষাকেই অন্বিষ্ট ভেবেছেন ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণায়। কাজী নজরুল ইসলামের নাটক বিশ্নেষণে এই শিল্প বিবেচনাটি আজকের পটভূমিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার দাবি রাখে।
---------------------------------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা : কালের খেয়া, সমকাল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন