বিষাদের ফুল : ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার


খাতুনে জান্নাত 

বিষাদের ফুল : ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারউনিশ শতকের ফরাসি তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি শার্ল বোদলেয়ার; কবি র্যাঁবোর ভাষায়, ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, এক সত্যদ্রষ্টা কবি’। জীবনের ক্লেদ থেকে তুলে এনেছেন কবিতার কুসুম ও কাঁটা। জীবন ফুলশয্যা নয় তবুও কবিতায় বিছিয়ে দেওয়া সৌন্দর্যের আবির ও রূপের অনন্য শ্রী ও কল্পনার ময়ূরপক্সক্ষী একজন মানুষের মধ্যে আসা এসব রোমান্টিকতাকে কীভাবে আরও ব্যাপ্তিময় এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করা যায় সেটা শার্ল ভাবতেন। তার কবিতা শৈল্পিক ও গভীর ভাবের দ্যোতনাসমৃদ্ধ। কবি বোদলেয়ার দুঃখ ও বেদনার অতলে নিবিষ্ট থেকে দেখেছেন জীবনের আসল রূপ ও কবিতায় বিধৃত হয়েছে জীবনরূপের অলঙ্করণ ও সত্যকথন। সৌন্দর্যকে বিশেষ উচ্চতায় তুলে নতুন এক জীবন দর্শনের বাস্তবতা বা রিয়েলিজমের অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন পাঠকের জন্য।

শার্ল বোদলেয়ার (পুরো নাম Charles-Pierre Baudelaire; জন্ম ৯ এপ্রিল, ১৮২১, মৃত্যু ৩১ আগস্ট, ১৮৬৭)। ব্যক্তিগত জীবন ছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতে আকীর্ণ। ৬০ বছরে তার পিতা ফ্রাঁসোয়া বোদলেয়ার একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং আনাড়ি চিত্রশিল্পীর ২৫ বছর বয়সী দ্বিতীয় পতœী ক্যারোলিন তার মা। কবি মাকে খুব ভালোবাসতেন। বিয়ের দু’বছর পর শার্লের জন্ম ও তার বয়স যখন ৬ তখন ফ্রাঁসোয়া মারা যান ১৮২৭ সালে। ঐ বছর ক্যারোলিন জ্যাক অপিক নামের ফরাসি সেনাবাহিনীর এক কর্নেলকে বিয়ে করেন। তার আরেকটি ভাই জন্ম হলে মা তার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন। বোদলেয়ার একা হয়ে পড়েন যদিও জ্যাক অপিক বোদলেয়ারকে ভালোবাসতেন। তাকে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করান।

বোদলেয়ারের লেখালেখির হাতেখড়ি লাতিন কবিতা দিয়ে। হোস্টেলেই কিশোর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। পরে আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি পাস করে বের হন। যদিও আইন নয় তার পেশা কবিতা লেখা এটা মনে মনে স্থির করেন। বিষাদ ও বেদনার ভেতর থেকে তুলে আনেন কবিতার ফুল। নগর জীবনের দক্ষ দ্রষ্টা কবি জীবনের কঠিনতম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে কবিতাকে করেছেন বিশ্ব বিস্তৃত ও আধুনিক কবিদের জন্য নতুনতর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও তিনি রিয়েলিজম অন্যতম রূপকার। তিনি প্যারিস নগরীকে তার কবিতায় অনেকবার স্থান দিয়েছেন, ফরাসি কবিতার পাঠকরা তার কবিতা পড়ে এক অন্য জগতে চলে যেত। শার্ল বোদলেয়ার, স্টেপেন মালার্মে এবং পল ভারলেইন এই তিনজন কবি প্রতীকবাদী সাহিত্যের অন্যতম রূপকার। আধুনিক কবিতা বলতে যা বোঝায়, তা কোনও না কোনোভাবে বোদলেয়ারের কবিতার চিত্তনির্যাস ও তার কবিতার অনুরণন, তেমনি পশ্চিমি কবিতার প্রায় প্রতিটি স্তরেই বোদলেয়ারের কবিতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

নিজেকে ডুবিয়ে দেন সমাজের ক্লেদ, ঘৃণা ও নষ্টের ভেতর। পতিতালয়ে গমন শুরু করেন। মা ও দ্বিতীয় বাবা তাকে কাজের উদ্দেশ্যে ভারতে প্রেরণ করেন ১৮৪১ সালে। তিনি দুঃখ পান মায়ের বিরহে ও দেশ ছেড়ে। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যবশত তার জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ে ও তিনি প্যারিসগামী অন্য একটি জাহাজে ফেরত আসেন ফ্রান্সে। পৈতৃক সূত্রে অনেক টাকা পান ও বিলাসী ও বিনাশি জীবনের ভেতর কাটান।

এ সময় প্রথম গ্রন্থ শিল্পের নন্দনতত্ত্ববিষয়ক Salon de (১৯৪৫-৪৬) প্রকাশিত হয়। তারপর উপন্যাস La Fanfario (১৮৪৭)। পরে লেখেন তার বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ Les Fleurs du mal (১৮৫৭)।

পরবর্তীকালে আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লে অনুবাদে হাত দেন ও লিখে টাকা আয় করতে চান। ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে তার কাজও উল্লেখের দাবি রাখে। ফরাসিতে এডগার অ্যালান পো’র অন্যতম প্রথম অনুবাদক ছিলেন তিনি। ‘যমজ আত্মা’ নামে দুই খ-ে এডগার অ্যালান পো’র গল্প ও প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশ করেন। এরপর আরও তিন খ- বের হয় ১৮৫৮, ১৮৬৩ ও ৬৫ সালে। এই পাঁচ খণ্ড অনুবাদই বোদলেয়ারের সাহিত্যিক জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি বলে মনে করা হয়।

কবিতা
‘কবিতা, মানসী, তুই প্রাসাদের উপাসক জানি।
কিন্তু বল, যখন প্রদোষকালে, হিমেল বাতাসে,
নির্বেদে, নীহারপুঞ্জে জানুয়ারি কালো হয়ে আসে-
নীলাভ চরণে তোর তাপ দিবি, আছে তো জ্বালানি? (পণ্য কবিতা)।
(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)।
তিনি লেখেন,
মারব আমি তোকে, যেন কসাই,
ঘৃণার লেশ নেই, শূন্য মন,
কিংবা শিলাতটে মুশা যেমন!
তাহলে আখি তোর যদি খসায়
আমার সাহারার সান্ত¡নাতে
দুঃখধারা এক উচ্ছ্বসিত
...
ছন্নছাড়া আমি শূন্যবাসী
আপন হৃদয়ের রক্ত গিলে,
কখনো প্রীত হতে শিখিনি বলে
আমার আছে শুধু অট্টহাসি। (আত্ম প্রতিহিংসা)
(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)।
সঙ্গী হয়ে রয় কবিতা সঙ্গিনী
সে-রাতে ছিলাম কদাকার ইহুদিনীর পাশে,
পাশাপাশি দুটো মৃতদেহ যেন এ ওকে টানে;
ব্যর্থ বাসনা; পণ্য দেহের সন্নিধানে
সে-বিষাদময়ী রূপসী আমার স্বপ্নে ভাসে। (সুন্দর জাহাজ)।
(অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু)।

তিনি সমকামী ও পতিতাদের নিয়ে কবিতা লেখেন। প্রেমের প্রতি ঘৃণা ও অবক্ষয়ের কবিতাসহ ঈশ্বর নিন্দা ও স্যাটানিক প্রকৃতির বেশ কিছু কবিতা লেখেন। যার ফলে তার বই ‘ক্লেদাক্ত কুসুম’ বা শয়তানের ফুল Les Fleurs du Mal (১৮৫৭) নিষিদ্ধ হয় আদালতে। তার প্রকাশক দেউলিয়া হয়ে ব্রাসেলসে পাড়ি জমান। ফরাসি বিপ্লবের সে সময়ে তিনিও ব্রাসেলসে চলে যান।

সেখানে পুরোদমে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত তখন ব্রেন স্ট্রোক করেন ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। মা তাকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনেন। তিনি আর সুস্থ হননি। মায়ের কোলেই মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান।

মৃত্যুর পর তার সব কবিতা বিধি নিষেধের পার ভেঙে ছাপা হয়। জীবিতকালে কবিতার কোনও মূল্যায়ন পাননি। তার সমকালের কবিদের দ্বারাও নিগৃহীত হন। জীবিতকালে নিন্দিত ও মৃত্যুর পরে নন্দিত এ মহান কবি আধুনিক কবিতার প্রধানরূপে চিত্রিত হয়ে আছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত। তিনি যখন বলেন,

‘ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগ হলে, বিষ বা ছুরি
এর মধ্যে কোন আনন্দদায়ক নিদর্শন বোনা আছে
এই অনুজ্জ্বল ক্যানভাসগুলোকেও আমরা জীবন হিসাবে গ্রহণ করি-
কারণ আমরা যথেষ্ট সাহসী নই!’
(অনুবাদ : খাতুনে জান্নাত)।
এভাবেই জীবনের টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে মোহগ্রস্ত করে ফেলেন পাঠককে। তার অনেক কবিতায় আধ্যাত্মবাদের ধ্বনিও পরিব্যাপ্ত রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন