একজন র‍্যাঁবোর কথা

ইমর



জীবন ও কবিতা

র‍্যাঁবোর পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত। বাবা সৈন্য, মা গৃহিনী। ইজাবেল নামে এক বোন ছিল র‌্যাঁবোর। বড় এক ভাইও ছিল। র‌্যাঁবোর বয়স তখন দু’বছর – তখনই তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা নয়, র‌্যাঁবোর ছেলেবেলা জুড়ে ছিল মায়ের কঠোর শাসন। মায়ের শাস্তিও ছিল অদ্ভুত রকমের, পড়া না পারলেই ১০০ লাইন লাতিন কবিতা মুখস্থ করতে হত। এরপরও আবৃত্তি ভুল হলে খাবার জুটত না। ৯ বছর বয়েসেই তাই নাকি ৭০০ লাইন লাতিন কবিতা ঠোটস্থ হয়ে গেছিল তাঁর। তাদের বাড়ির নিচেই ছিল বিরাট এক লাইব্রেরি। খুব অল্প বয়সেই সেখানে বসে তিনি ফেনিমোর কুপার, গুস্তাভ আইমোর, জুল ভের্ন থেকে শুরু করে হেগেল ও সোয়েডনবর্গের দর্শন, প্রুদম, ফ্রান্সের লোককাহিনী এবং ইতিহাস ও সাহিত্য, এমনকী প্রাচ্য তথা ভারতীয় ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, ধর্ম প্রচারক এবং দেব-দেবী ও দেবালয় সম্বন্ধেও পড়াশুনো করেন।মাত্র সতেরো বছর বয়সেই অত্যন্ত আলোড়ণ উদ্রেককারী কবিতার মাধ্যমে তিনি প্যারিসের কবিসমাজকে উদ্বেলিত করে তুলেছিলেন। তাঁর মাতাল তরণী কবিতাটি পড়ে সেযুগের ফ্রান্সের অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় প্রতীকবাদী কবি পল ভর্লেন তাঁর প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি সব ধরনের সৃষ্টিশীল লেখালেখি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি আরব এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন।

তবে র‌্যাঁবো স্কুলের নিরস পাঠ্যসূচি ও মায়ের বিচ্ছিরি শাসন পছন্দ করত না। যদিও কাব্যের দিকে ঝোঁক। ভিতরে ভিতরে কাব্যের উদগীরণ টের পাচ্ছিল বালক;

পল ভার্লেইন ছিলেন তখনকার দিনে ফ্রান্সের নামকরা কবি; তিনি প্রতীকবাদী ধারার পথিকৃৎদের একজন। ফরাসি কাব্যের ইতিহাসে তাঁর স্থান অনন্য। পল ভার্লেইন-এর ‘গোধূলি’ কবিতাটি পাঠ করা যাক।

গোধূলি

কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে লাল চাঁদ
নৃত্যরত আবছা তৃণভূমি
ধোঁওয়ার ভিতরে ঘুম, ব্যাঙের ডাক
নলখাগড়ায় সবুজ শিহরণ।

লিলি ফুলেরা ঢাকনা ঢাকে
পপলার ছড়ায় দূরে
দীর্ঘ ঘনিষ্ট, তাদের ভৌতিকতা ছড়ায়
জ্বোনাক পোকার মিটিমিটি আলো ঝোপে

প্যাঁচারা জেগে, তাদের নিঃশব্দ উড়াল
বাতাসে সারিবদ্ধ ভারী পাখনা
আর শীর্ষদেশে পরিপূর্ন নিরানন্দ আলো
ফ্যাকাসে, শুক্রের উত্থান …যেহেতু এখন রাত্রি।

ভিতরে ভিতরে কাব্যের উদগীরণ টের পাচ্ছিল বালক; ভার্লেইন চিঠি লিখলেন র‌্যাঁবো; সাড়া মিলল না। র‌্যাঁবো এবার কবিতা পাঠালেন, পড়ে ভার্লেইন বললেন, ‘দেখা কর, অপেক্ষা করছি।’ ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে প্যারিস পৌঁছলেন র‌্যাঁবো । উঠলেন ভার্লেইন এর বাড়িতেই। বাড়িতে তখন ১৭ বছর বয়েসি পোয়াতি বউ -মাতিলদে। ভার্লেইন চাকরি করতেন; সদ্য চাকরি ছেড়ে বিস্তর মদ খাওয়া ধরেছেন।

১৮৭১ সালের প্যারিস। প্যারিস তখন উত্তাল। শ্রেনিসংগ্রাম চরিতার্থ করে সংগ্রামী জনগন ক্ষমতা গ্রহন করেছে, যাকে বলা হয়- প্যারী কমিউন। যে ঘটনা নিয়ে কার্ল মার্কস লিখেছেন, ‘দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স।’ যে বিপ্লবী সরকারের প্রতি র‌্যাঁবোর বিপুল সমর্থন ছিল।

যা হোক। র‌্যাঁবো ও ভার্লেইন এর মধ্যে তৈরি হল উষ্ণ সম্পর্ক । দুজনকে কথায় পেল আর নেশায় পেল। অ্যাবসিন্থ আর হ্যাসিস হল দুটি ফরাসি নেশা। প্রথমটি তরল আর ২য়টি উদ্ভিজ। দুজনেই বেশ কিছুকাল নেশারাজ্যে ডুবে রইলেন। তাতে বিভ্রম হত, কবিদ্বয় বিভ্রমবশত প্রতীকবাদী পদ্য লিখতেন। আর ছিল উদ্দাম জীবন। যাতে ফরাসি সাহিতচক্র রীতিমতো দিশেহারা।

র‌্যাঁবোর দুর্নীবার টানে সদ্যজাত পুত্র ও স্ত্রীকে ত্যাগ করার কথা ভাবলেন ভার্লেইন । পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে দুজনই লন্ডন চলে গেলেন। থাকতে শুরু করলেন ব্লুলসব্যারি ও কেমডেন টাউন শহরে। স্বেচ্ছা নির্বাসিত কবিদ্বয়ের জীবনে নেমে এল দারিদ্র । তবে আয় হল পড়িয়ে, মানে ইংরেজদের ফরাসি ভাষা শিখিয়ে। তা ছাড়া ভার্লেইন-এর মা টাকা পাঠাতেন। র‌্যাঁবো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়াশোনা করে কাটালেন ।
তবে দুজনের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে।

১৮৭৩ সালের জুনে ভার্লেইন প্যারিস ফিরে যান। তবে অচিরেই র‌্যাঁবোর জন্য বিরহ টের পেলেন প্রতীকবাদী কবিটি। প্যারিস থেকে ব্রাসেলস এ গেলেন ভার্লেইন, দেখা করলেন র‌্যাঁবোর সঙ্গে । লাভ হল না। কথায় কথায় ঝগড়া চলতেই থাকে। যার ফলে ভার্লেইন মদে ডুবে যেতে থাকলেন। সেই ঘোরেই সম্ভবত রিভলবার কেনেন । গুলি করেন র‌্যাঁবোকে; গুলি লাগল বাঁ কবজিতে । প্রতীকবাদী কবিটিকে পুলিশ গেরেপতার করল । ভার্লেইন মানসিক রোগী কিনা -জিজ্ঞাসাবাদ চলল। র‌্যাঁবো অভিযোগ তুলে নিলেও ভার্লেইন কে টানা ২ বছর কারাগারে কাটাতে হয়।
১৮৭৪ সালে র‌্যাঁবো আবার লন্ডন যান। প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ Illuminations;এর মানে রঙিন খোদাই বা রঙের পাত্র। কাব্যগ্রন্থটি র‌্যাঁবোকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

জার্মানির স্টুটগার্টে ১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে ভার্লেইন এর সঙ্গে র‌্যাঁবোর শেষ দেখা । জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ভার্লেইন, গ্রহন করেছেন ক্যাথলিক ধর্ম । র‌্যাঁবোও জীবনে পরিবর্তন চাইছিলেন, হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আত্মমগ্ন হয়ে পায়ে হেঁটে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়ালেন। লেখা ছেড়ে কোনও সিরিয়াস কাজে জড়াবেন ভাবলেন-অর্থ চাই, বিত্ত চাই। নিজের মনের মত লিখতে হলে প্রচুর অর্থ উপার্যন করা দরকার। ১৮৭৬ সালের মে মাসে ওলন্দাজ সৈন্যদলে যোগ দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা গেলেন। ভালো লাগল না। পরে অবশ্য ইউরোপ ফিরে এলেন। ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাসে এলেন। ফোরম্যান হিসেবে পাথরের কোয়ারিতে কাজ নিলেন । বিধি বাম। টাইফয়েড হওয়াতে সাইপ্রাস ছাড়তে হল।

১৮৮০ সালে ইয়েমেনের এডেন বন্দর এলেন কবি। সে নগরীতেই সেটল করলেন। কাজ নিলেন বারডে এজেন্সি তে। স্থানীয় নারীর সঙ্গে মিশতে লাগলেন ঘনিষ্টভাবে; সেই সময় ইথিওপিয়ার এক রক্ষিতা ছিল কবির।

ব্যবসা করবেন বলে চাকরি ছেড়ে দিলেন কবি। ইথিওপিয়ার হারার শহরে এলেন। সেই ইথিওপিয় রক্ষিতার অনুপ্রেরণায় কিনা কে জানে! কফি ও অস্ত্রের ব্যবসায় জড়ালেন। হারার এর গর্ভনর এর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হল।
১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি। ডান হাঁটুতে ব্যাথা অনুভব করলেন। পরে তীব্র যন্ত্রনা। ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেন। এডেন বন্দরে এক ব্রিটিশ ডাক্তার দেখলেন। ডাক্তার বললেন অপারেশন করতে। ফ্রান্সে ফিরে অপারেশন করালেন। ডান পা’টি কেটে ফেলতে হল। পরে দেখা গেল ক্যান্সার। কিছুদিন শার্লিভেল থাকলেন। আফ্রিকা ফিরে যেতে চাইলেন। তখনই স্বাস্থ্যের অবনতি হল। আবার হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ইসাবেলি নামে এক বোনের কথা বলছিলাম। সেই দেখা শোনা করল। লাভ হয়নি। ১৮৯১ সালের ১০ নভেম্বর মারা গেলেন কবি। মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে।

‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি লিখেছেন:

অনেক দেখেছি। প্রতিটি আকাশের নিচে ফিরেছে
দৃষ্টি ।
পেয়েছি অনেক। নগরসমূহের কোলাহল,সন্ধ্যা, এবং
আলোয়, আর সর্বদা।
অনেক জেনেছি। জীবনের সিদ্ধান্ত। ওহ্, শব্দ ও দৃশ্য।
নতুন মায়ায় ও শব্দে প্রস্থান!

র‌্যাঁবো তার এক চিঠিতে বলেছিলেন- “The poet turns himself into visionary a long, drastic and deliberate disordering of all his senses”- সেচ্ছায় সকল ইন্দ্রিয়ের বিশৃঙ্খলা-ই কবির প্রকৃত কাজ হওয়ার দরকার। এ দর্শনই যেন দেখতে পাই তার কবিজীবনে মাতাল জীবনযাপনে।সুশীল ও গৎবাঁধা ও রাস্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে কবিদের তিনি দেখতে পারতেন না।এমনও মিথ আছে যে সুশীল কবিদের এক কবিতার আসরে এক কবির কবিতায় তিনি মূত্রবিয়োগ করেছিলেন প্রকাশ্যে-হাহাহাহাহ!!!

র‌্যাঁবো বলেছিলেন যে কবিকে দ্রস্টা হতে হবে।সেই সূত্রে তিনি শার্ল বোদলেয়রকে প্রথম দ্রস্টা বলে স্বীকৃতি দেন।
অথচ বোদলেয়রকে তৎকালীন ফরাসী দেশ স্বীকৃতি তো দেয়নাই বরং বোদলেয়রকে সে সমাজ একপ্রকার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

র‍্যাঁবোর কাব্যদর্শনের মূল কথাই ছিল স্বেচ্ছাধীন স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে অসীম, অনন্ত ও অচেনা এক জগতের সন্ধান। এ’ জগতের সন্ধান শুধুমাত্র পঞ্চেন্দ্রিয়য় আবদ্ধ অনুভূতির দ্বারা পাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই বোধহয় তিনি কাব্যে আরও আরও প্রতীকের ব্যবহারের দিকে ঝোঁকেন। বিশ শতকে এসে পাবলো পিকাসো এবং জিম মরিসনের মত অনেকেরই তিনি গুরুতে পরিনত হন। এই প্রতিভাবান লেখকের হুট করে আবির্ভাব এবং আকস্মিক চলে যাওয়া এখনও অনেকের কাছে বিষ্ময়ের ব্যাপার।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,বোস্টন ও আর জি,অনলাইন ব্লগ।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন