ভাষান্তর ও ভূমিকা: ফাতিন আরেফিন
তেরো শতাব্দীর ফাসি কবি, দার্শনিক, সূফি, স্কোলার, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর, ১২০৭। তৎকালীন আফগানিস্তানে জন্ম নেয়া রুমি(বর্তমান তাজিকিস্তান) ১২১৫ থেকে ১২২০ সালের মধ্যে সপরিবারে প্রবাসিত হয়ে বর্তমান তুরষ্কে আসেন। তার অধিকাংশ লেখা পারসিক ভাষায় হলেও, তুর্কী, অ্যারাবিক ও গ্রীক ভাষাও তিনি ব্যবহার করেছেন। রুমির শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ‘মসনবী’, পারসিক সাহিত্য হিসেবে যাতে প্রায় ২৭০০০ লাইন রয়েছে। তার অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ন কাব্যগ্রন্থ- ‘দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ’। এর বাইরেও তিনি আনুমানিক ৩৫০০০ পারসিক শ্লোক এবং ২০০০ পারসিক রুবাইয়াৎ লিখেছেন।
ধারণা করা হয়, বর্তমান বিশ্বের কবিতার সর্বাধিক বিক্রিত বই রুমির। এখন পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশের অধিক ভাষায় তার কবিতা অনুদিত হয়েছে। গত শতাব্দীর শেষদিকে পাশ্চাত্যে রুমির কবিতার অনুবাদের পর থেকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। HarperOne প্রকাশিত ‘Essential Rumi’ সারা বিশ্বে ২৩টি ভাষায় দুই মিলিয়নের অধিক বই বিক্রি হয়। গত দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমেরিকায় কবিতার সর্বাধিক বিক্রিত বই রুমির। রুমির কবিতা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কোলম্যান বার্কসের অনুবাদের পর থেকে। ইউনেস্কো ২০০৭ সালে তার নামে একটি মেডেল চালু করে এবং ঐ বছরকে ‘আর্ন্তজাতিক রুমি বছর’ হিসেবে ঘোষণা করে। আমেরিকার লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিনেমা, গল্প, উপন্যাসে যুক্ত হচ্ছে রুমির সাহিত্যকর্ম। প্রায় ১২টি দেশের জাতীয় কবিরা তার কবিতা দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। এর মধ্যে বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম এবং পাকিস্তানের স্যার আল্লামা ইকবাল অন্যতম।
রুমিকে বলা হয় প্রেম ও ভালোবাসার মহান কবি। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তাবাদ নির্বিশেষে তিনি ঈশ্বর, মানুষ, আত্মা এবং মহাবিশ্বের প্রেমের গান গেয়েছেন। তার উদ্দেপনামূলক কবিতাগুলো প্রচন্ড শক্তি এবং অনুরণন নিয়ে বৈশ্বিক কন্ঠে প্রতিটি মানব রিদয়কে আন্দোলিত করে। তিনি চিত্রকল্প- রুপক হিসেবে তুলে ধরেছেন মানুষের অতি পরিচিত- চারপাশের অনুষঙ্গ। বিষয়বস্তুও বিবরণে তিনি সূক্ষ্ম অর্ন্তদৃষ্টিতে তুলে এনেছেন ফুল, পাখি, নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য, নদী, মাছ ইত্যাদির দার্শনিক চিত্রকল্প যা একইভাবে জীবন্ত রয়ে গ্যাছে শত শত বছর পরেও। অনেকেই রুমির কবিতাকে পারসিক কুরআন হিসেবে অভিহিত করেন। প্রায় কয়েক সহস্রাধিক লাইন কুরআন থেকে পারসিক অনুবাদ হিসেবে তিনি তার কবিতায় সরাসরি ব্যবহার করেছেন। ইতিহাস, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে মানব জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষনে তুলে এনেছেন তার কবিতায়। দাতব্য সেবা, সৃষ্টার অনুভ’তি, ধৈর্য্য, ভালোবাসার মাধ্যমে সহনশীলতা— ৮০০ বছর পর এখনোও, লক্ষ লক্ষ পাঠককে বিমোহিত করছে।
কোলম্যান বার্কসের ইংরেজী অনুবাদে মৌলিকতার ব্যত্যয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিতর্ক থাকলেও এখন পর্যন্ত তার করা অনুবাদই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখানে অনূদিত কবিতাগুলো তার বই নেয়া হয়েছে।
—ফাতিন আরেফিন।
তথ্যসূত্রঃ ‘সেলেক্টেড পোয়েমস’— কোলম্যান বার্কস, জন রাইল- গার্ডিয়ান, জেইন সিব্যাটরি- বিবিসি, উইকিপিডিয়া।
_________________________________
স্থিরতা
মৃত হও, নতুন এই ভালোবাসা— মৃত হও এর অভ্যন্তরে—
তোমার যে পথ, তার শুরু— ঠিক এর অন্যপাশে।
বিস্তৃত আকাশ হও তুমি—
কুঠারে আঘাত হানো কারাগার দেয়ালে
—পালাও, মুক্ত হও—
বেড়িয়ে পড়ো অসীমে,
বেড়িয়ে পড়ো এমন, যেনো কেউ মাত্রই জন্ম নিয়েছে হঠাৎ রঙে
জলদি, এক্ষুনি!
—ঘন মেঘাবৃত তুমি—
সরে পড়ো অন্যপাশে— মৃত হও এবং স্থির…
স্থিরতা একটি নিশ্চিত নিদর্শন যে তুমি মারা গ্যাছো—
তোমার অতীত জীবন যা ছিলো নিরবতা থেকে এক ক্ষিপ্র দৌড়;
আশ্চর্য-নির্বাক করা পূর্ণিমার চাঁদ দ্যাখো— বেরিয়ে এসেছে এখন!
অতিথিশালা
এই মানবসত্তা একটা অতিথি ঘর—
প্রতি সকালেই একজন নতুন মেহমান।
একজন সুখ, একজন হতাশা, একজন ক্ষুদ্রতা,
অপ্রত্যাশিত অতিথি হয়ে আসেন—
ক্ষণস্থায়ী কজন সচেতনতা…
স্বাগত জানাও এবং আপ্যায়িত করো তাদের সবাইকে
—তা যদি এক দঙ্গল দুকখোও হয়,
যা ঠেলে সরায় গৃহের সকল আসবাব সহিংসভাবে,
এরপরও, আন্তরিকচিত্তে গ্রহণ করো সবাইকে—
হয়তো সে তোমাকে পরিষ্কৃত করছে জেনো,
নতুন কিছু আনন্দআগমন উপলক্ষে।
অন্ধকার আশংকা, অপমান, আক্রোশ, ঘৃণা— সবকিছু,
হাসিমুখে এগিয়ে নাও দরোজায়
এবং আমন্ত্রণ জানাও গৃহের ভেতরে।
যেই আসুক না ক্যানো— কৃতজ্ঞ হও,
কারণ এক উপদেষ্টা হিসেবে ঘরে
প্রত্যেককেই পাঠানো হয়েছে অর্ন্তলোক থেকে।
আমি কি বলিনি তোমায়!
আমি কি বলিনি তোমায়—
ছেড়ে যেও না আমায় কখনো,
একমাত্র বন্ধু তো কেবল আমিই—
আমিই চিরবসন্ত জীবনের…
শত-সহস্র বছরও যদি আমাকে ঢেলে
দূরে থাকো তুমি ক্রুদ্ধ রিদয়ে,
তবুও ফিরবে তুমি, ফিরে আসতেই হবে তোমায়—
ক্যানোনা আমিই তোমার গন্তব্য, আমিই তোমার শেষ…
আমি কি বলিনি তোমায়—
মোহে পরো না রঙিন পৃথিবীর,
যেহেতু আমিই সবার সেরা— চিত্রশিল্পী সর্বশ্রেষ্ঠ!
আমি কি বলিনি তোমায়—
তুমি মাছ— যেও না কখনো ঐ শুষ্কভূমিতে
যেহেতু সবচেয়ে গভীর— আমিই সমুদ্র— তোমার জন্য যথেষ্ট!
আমি কি বলিনি তোমায়—
ঝালে আটকে পোরো না পাখিদের মতো
কেনোনা আমিই তোমার ডানা— আলোর শক্তি সঞ্চালক…
আমি কি বলিনি তোমায়—
ওদেরকে ব্যর্থ করো তোমাকে বরফে পরিণত করতে,
যেহেতু, আমিই আলোর শিখা, তোমার যথেষ্ঠতম উষ্ণতা
আমি কি বলিনি তোমায়—
ওরা দূষিত করবে তোমাকে এবং বাধ্য করবে ভুলে যেতে,
আর জেনো— আমিই বসন্ত সর্বগুণের…
আমি কি বলিনি তোমায়—
প্রশ্ন করো না আমার প্রক্রিয়া নিয়ে
কারণ, সবকিছুই নির্দেশিত এবং আমিই এর স্রষ্টা…
আমি কি বলিনি তোমায়—
তোমার রিদয় তোমাকে গৃহে ফিরিয়ে নেবে
কারন সে জানে, আমিই তার প্রভু!
কেবলমাত্রই নিঃশ্বাস
না খ্রিস্টান, ইহুদী— না মুসলিম
না হিন্দু, বৌদ্ধ, সূফী— অথবা জেন
কোন ধর্ম কিংবা সাংস্কৃতিক রীতি থেকে নয়
আমি আসিনি প্রাচ্য থেকে, আসিনি পাশ্চাত্য থেকে
আসিনি সমুদ্রের অভ্যন্তর কিংবা মাটির উপর থেকে
না আমি প্রাকৃতিক, না অলৌকিক—
কোন উপাদানেই তৈরি না,
আমি অস্তিত্বশীল সত্তা নই—
না এই পৃথিবীর, না এর পরের
প্রেরিত হয়নি আদম এবং হাওয়া
অথবা অন্য কোন উৎপত্তি ইতিহাস থেকে
আমার অবস্থান— অবস্থানহীন, আমার গমনপথ— পথচিহ্নহীন
না দেহে না আত্মায়
আমি সংযুক্ত আমার প্রিয়তমের সাথে, যেখানে দেখেছি দুইটি পৃথিবী
একটি হিসেবে, যা ইঙ্গিত দেয় এবং জানায়—
প্রথম, শেষ, ভেতর, বাহির—
এই নিঃশ্বাসটুকুর আশ্রয়ে কেবল মানুষ।
গল্প এবং জল
একটা গল্প হলো পানির মতো, যা তুমি
উত্তপ্ত করো গোসলের জন্য।
এটা ধারণ করে তোমার ত্বক ও আগুণের মধ্যবর্তী সংবাদ,
সাক্ষাত ঘটায় উভয়ের এবং পরিষ্কার করে দেহকে।
কেবল অল্প সংখ্যকই পারে বিশ্রাম নিতে আগুণে—
ইব্রাহিম কিংবা স্যালমান্ডারের মতো
যেক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন কোন মধ্যস্ততাকারীর।
স¤পূর্নতার অনুভ’তি আসে—
কিন্তু তা সচরাচর আনতে প্রয়োজন অর্থের…
যদিও বা সৌন্দর্য আমাদের ঘিরে আছে
কিন্তু তা জানতে আমদের যেতে হয় বাগানে
দেহ নিজেই একটা আবরক
এবং তা তোমার অস্তিত্বের ভেতরে প্রজ্বলিত আলোর
সামান্যই প্রকাশ করে বাইরে।
পানি, গল্প, দেহ, আমাদের করা সমস্তকিছু
এক একটি ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম
যা অজ্ঞাতকে গোপন করে আবার করে প্রকাশ।
অধ্যয়ন করো এসব
এবং উপভোগ করো একে যা একটি রহস্য নিয়ে মুছে যায়
কখনো আমরা তা জানি, অতপর, একটু পরেই তা জানি না।
লহুতে মিশে আছে নৃত্য—১
আমাদের মধ্যে একটি গোপন আবর্তন
আবর্তিত করায় মহাবিশ্বকে,
শির অনবহিত পায়ের
পা অনবহিত শিরের;
কেউই তত্ত্বাবধায়ক নয় কারো—
কেবল তারা ঘুরেই চলে শুধু…
যখন আমি মারা যাই
যখন আমি মারা যাই
যখন আমাকে কফিনে আটকে নাও,
কখনোই মনে করো না তুমি—
এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি আমি
চোখের জল ফেলো না কোন
কোরো না আর্তনাদ কিংবা অনুভব দুঃখ—
আমি পতিত হচ্ছি না কোন দানবের নরকে
যখন আমার লাশ বহিত হয়
আমার চলে যাওয়ায় অশ্র“ ফেলো না
আমি ছেড়ে যাচ্ছি না,
আমি পৌঁছে যাচ্ছি— শাশ্বত ভালোবাসায়
আমাকে যখন কবরে ছেড়ে যাও
বিদায় বোলো না তুমি
কবর তো কেবল একটি পর্দা, যার পেছনে অনন্ত স্বর্গোদ্যান
আমাকে তো দেখবে শুধু কবরে নামাতে
এখন দ্যাখো উঠে আসতে
কিভাবে শেষ হতে পারে ওখানে
যখন সূর্য অস্তমিত হয় অথবা চাঁদ ডুবে যায়
এটা দেখে মনে হয় শেষ
যা অনেকটা সূর্যাস্তের মতো
কিন্তু বাস্তবে, এটা কেবলই নিুগামী হওয়া
তোমাকে যখন কবরে আটকে দেয়া হয়
এটা সেই মুহুর্ত, যখন তোমার আত্মার চির স্বাধীন
তুমি কি দেখেছো কখনো—
পৃথিবীতে বপিত হয়েছে একটা বীজ
যেটা জেগে ওঠেনি নতুন এক জীবন নিয়ে,
ক্যানো তুমি একটা মানুষ নামের বীজের উঠে আসাতে সন্দেহ করবে!
তুমি কি দেখেছো কখনো
ক’পে নোয়ানো কোন বালতি
ফিেের এসেছে খালি,
ক্যানো একটা আত্মার জন্য বিলাপ করো
যদি তা ফিরে আসতে পারে আবার
যেভাবে ইউসুফ ফিরে এসেছে ক’প থেকে!
যখন শেষবারের মতো তুমি
তোমার মুখ বন্ধ করো,
তোমার শব্দ এবং আত্মা
এমন এক জগতে যুক্ত হবে—
যেখানে নেই কোন সময়, যার নেই কোন ঠিকানা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন