শামীম রফিক
‘তুমি অনেক যত্ম করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছো’ মান্না দে-র এই বিখ্যাত গানটি গাইতে গাইতে মাথা
মুছতে থাকে জহির। মনটা তার এত ভাল কেন আজ? ভালই যদি হয় তবে এ রকম গান কেন পছন্দ করল?
নাকি সে দুঃখকে ওভারকাম করেছে বা করতে চাচ্ছে? দুঃখ জিনিসটাই এমন, বড়ই আজব। কখন যে
কিভাবে এবং কার ঘাড়ে চেপে বসবে সে নিজেও জানে না। কি করলে দুঃখ আসবে না তা বলা মুশকিল।
শুধু পড়াশুনা না জানলেই দুঃখ হবে, ভাল চাকুরী না পেলেই দুঃখ হবে, টাকা না থাকলেই দুঃখ
হবে, বাড়ী-গাড়ী না থাকলেই দুঃখ হবে, সুন্দরী বা গুণী মেয়ে না পেলেই দুঃখ হবে এমন নয়।
দুঃখ বিষয়টা একটা অন্যরকম টাইপের বিষয়। সব থাকবে কিন্তু জীবনটা দুঃখে ভরে যাবে। কেউ
কেউ দুঃখী হয়ে যায়, আবার কেউ বা দুঃখ পুষে রাখে। এই দুঃখ জিনিসটা আসেনি বা জীবনে দুঃখ
নেই এমন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন।
এই দুঃখ জিনিসটা তার জীবনে আসবে, কোনদিনও ভাবেনি জহির। কেন আসবে? তার
ধারনা ছিল যেসব কারনে দুঃখ হয়, তার কোনটাই তার নেই বা করেনি। প্রচণ্ড নিয়মতান্ত্রিক
এবং এমন কোন প্রকারের বদভ্যাস নেই যে কারনে সে কোন দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হবে।
কিন্তু কারন একটা আছে, সে ঠিকমত ঘুমায় না, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না। কিছুটা কারন করে
না, কিছুটা কারন করতে পারে না। কেন? জহির চুপ থাকে। লেখকদের জীবনই তো এমন, তার উপর
যদি গুরুত্বটা যদি কম থাকে। সময় কম বলে সে ইচ্ছে করেই কম ঘুমায় কিন্তু খাওয়া দাওয়া
নিয়মিত করে না কেন? এগুলো প্রশ্ন। দুঃখী হবার সম্ভবনা ছিল না, অথচ দুঃখী সে হয়েছে এবং
সকল দিক থেকে। কেন হলো? এখন সে অন্যকিছু বিশ্বাস করে, ভাগ্য নামক ব্যাধিকে আপন বলে
মনে করে। যা অদৃশ্য থেকে দুঃখ নামক বিষয়টা কারো কারো ওপর চাপিয়ে দেয়।
এই ভাবনার কোন শেষ খুঁজে পায় না। কেমন যেনো লাগে, আজকাল। কারো সাথে কথা
বলতে ইচ্ছে করে না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, হাসতে ইচ্ছে করে না, একাকী থাকতে ইচ্ছে
করে-প্রচণ্ড নিরানন্দে ভরে ওঠে জীবন। চাকুরি-বাকুরি করতে ইচ্ছে করে না, কারন তার মনে
হয় যারা তাকে কমাণ্ড করছে তারা সবাই তার চেয়ে মূর্খ এবং কোন সুস্থ মানুষ অর্ডার বা
নির্দেশের জন্য এমন ভাষা বা আচরন বেছে নিতে পারে না। তাছাড়া বয়স চল্লিশের বেশি হলে
মানুষ আর শিখতেও চায় না, শিখাতে চায়, বলতে চায়। এজন্য বেশি বয়সী মানুষেরা কথা বেশি
বলে। এখন স্বাধীন থাকতে ইচ্ছে করে। কাউকে কিছু বলবে না এবং কারো কোন নির্দেশ মানবে
না। বরং জীবনের অর্জন বা ভুলগুলো অন্য কাউকে বলতে ইচ্ছে করে, যদি তাতে কারো কোনো উপকার
হয়।
আজকাল খুব আকাশে উড়তে ইচ্ছে করে। যদি আকাশে উড়া যেতো। কিন্তু উড়তে হলে
তো ডানা লাগবে। ডানাছাড়া কি উড়া যায়? সে অত্যন্ত প্রচেষ্টা ও নিঃসঙ্গতাকে বেছে নিয়ে
উড়বার চেষ্টা করে। অনেকটা সফল হয়। তবে কি এই সফলতাই কাল হয়ে দাঁড়াল? সে তো বলতই, ‘আই এম নট গ্রেট, বাট
ডিফারেন্ট টাইপ অব বয়।’ সে তার ন্যাচার অব জবকে পছন্দ করত না কিন্তু জবটা কোন বিচারে
কম বা ছোট তা আমি বুঝি না। বেতন ও আর্থিক সুবিধায় বড়, স্ট্রাকচার-এ বড়, প্রতিষ্ঠায়
বড়, মেধা ও মননে বড়, ইডুকেশনে ছোট নয়। এই চাকুরিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে
ফ্যাকাল্টি। যেমন : ব্যাংকিং, একাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট, এমবিএ, এমবি ইত্যাদি। তবে ছোট
হয় কি করে , আমি পছন্দ করি না, সেটা আমার ব্যক্তিগত কারন। যারা এই বিষয়গুলো বুঝে বলে
মনে করি তারাও যেমন এ বিষয়টাতে আঘাত করে, যারা বুঝে না তারাও ঠিক একইভাবে আঘাত করে।
কিন্তু কেন? তাহলে তো যাদেরকে বুঝে বলে মনে করি সেখানে একটা সমস্যা আছে। আমি পারলে
কাউকে হেল্প করি, হেল্প নিতে হয় না। যেখানে যে দায়িত্ব আছে পালন করি কিন্তু কেউ খুশি
তো নয়ই বরং বদনাম করে। জহির হ্যাপিকে বলে, আমি মরে গেলে তুমি যদি এভাবে আমার সম্পর্কে
বলো, তবে তো মানুষ আমাকে চিনবে না। ভাববে, সারাজীবন আমাকে যেভাবে চিনেছে বা দেখেছে
সেটা পুরোটাই উল্টো হয়ে যাবে। কেন এমন বলো?
জবাব কোথাও পাইনি। যারা এবাবে জড়িত।
একটি ঘরে একা একা রাত-দিন কাটায় জহির আর অনেক চেষ্টায় যখন ঘুম আসে তখন
নাক ডেকে ডেকে নিরীহভাবে ঘুমায়। কেন সে নাক ডাকে? সে কি পৃথিবীকে কিছু বলতে চাচ্ছে?
নাকি ঘুমের প্রতি অনীহা, নাকি ঘুম তাকে নিতে চায় না? পৃথিবীর সকল নিহত লোকেরা নাক ডেকে
ঘুমায়। ঘুমের মাঝে কখনো ঘোগলী তোলার মতো গক্ গক্ করে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার মতো হয়, তখন
একটু পানি হলে হয়ত আবার জীবনটা ফিরে আসে। কিন্তু সে যে কাউকে ডেকে একটু পানি চাবে,
সে সুযোগ কই? কে আসবে? তবুও ঘুমের ঘোরে ডাকে, মা মাগো, ও মা এক গ্লাস পানি দাও, বাবা
গো এক গ্লাস পানি দাও। আমি মরে যাচ্ছি, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ আসে না।
চোখের জলে বালিশ ভিজলেও ঘুম ছাড় দেয় না। কখন যেনো আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মাঝে কত কথা
মনে পড়ে, কত স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে, এখানে তো মা-বাবা থাকেন না। তবে আমি উনাদের ডাকছি
কেন? আর কাউকে কি ডাকা যাবে না বা যেতো না? আর কারো নাম মনে আসলো না কেন, কেন নামগুলো
ভুলে গেলাম, কেন এতক্ষণ কেঁদে এবং ঐ রকম আওয়াজ করেও কাউকে পেলাম না? কে যেনো লিখেছিলো,
‘অচিনা
লোকের চেয়ে চিনা লোক ভালো/ চিনা পাখির চেয়ে অচিন পাখি ভালো।’ কথাটা বুকের মাঝে দাগ
কেটে গেলো। কোথায় পাবে সেই অচিন পাখি! আমি অচিন পাখি চাই। পাখি নাই, তাহলে খাঁচার ভেতর
যে অচিন পাখি নিত্য আসা যাওয়া করে সে কোথায়? মানুষ পায়নি, তাই পাখিটাই চায়। তখন তার
দুঃখ হয়। কি করলাম জীবনে? এই নিঃশ্বাসটা তাকে আত্মীয়দের ও আত্মজদের মুখোশ উন্মোচিত করতে
সাহায্য করেছে। সেখানে গিয়ে সে দেখে মানুষ আসলে অন্যরকম। হয়তো সবার ক্ষেত্রে এক রকম
নয়। তা তো সে দেখেই নিলো। কিন্তু টাকা দিয়ে কাউকে খুশি করা যায় না-এটা সে প্রথম জানল।
এইটুকু জানার আগেই সে কি করে বুঝবে এটা ভুল? সে তো সন্দেহ বাতিকগ্রন্থ বা নেগেটিভ মানসিকতার
মানুষ নয়। কেউ যদি খুশি থাকে, তবে তাকে যা ইচ্ছা দিলেই খুশি থাকে, না দিলেও খুশি থাকে।
আগে কি করে জানবে জহির? এই দ্বিমুখি আচরণের পর সে অসহায়ত্বটাকে বুঝতে পারে। কিন্তু
সময় এতটা পেরিয়ে যায় যে, তাকে ফিরানো যায় না। বিষয়টা যদি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তো
কথা ছিল না। জঙ্গলের সিংহ বা বাঘ ক্ষুধার্ত হলে যেমন আক্রোশপ্রবন হয়ে পড়ে, প্রতিটা
মানুষ ঠিক তেমন হয়ে পড়ে। অন্ততঃ জহিরের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু কেন? টাকা দিয়েই কি শুধু
ঠিক রাখতে হবে সম্পর্ক? কতটুকু দিলে সম্পর্ক ঠিক থাকে?
তাছাড়া এই সুযোগে কিছু কিছু মানুষ বিভিন্নভাবে অঙ্কগুলো করে। অঙ্কগুলো
পরিষ্কার বুঝা যায়। তারা ভাবে একে আর উপরে উঠতে না দেয়ার এটাই সুযোগ, পুরো ফ্যামিলিটাকে
ধ্বংস করতে চাইলে এটাই সুযোগ। তাছাড়া নিজেদের ব্যর্থতার আগুন তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে
তোলে। কেউ কেউ অসুস্থ মানসিকতার, তারা এটাকেই আনন্দ উপভোগের উৎস মনে করে। জীবন এমন
নয়, হবার কথা নয়। মৃত্যুর সাথে আপোষ করা এই
ছোট্ট জীবন নিয়ে এ রকম খেলা না খেলাই ভালো। কেউ ভাবে এই সংসারকে ধ্বংস করতে চাইলে এটাই
সঠিক সময়, আবার ঘরের মধ্যে জ¦লে আছে অন্য আগুন। চারিদিকে আগুন। এই আগুনের ভয়েই জহির
ভেবেছিলো কোনদিন হয়ত অন্য কোথাও গিয়ে সেল্টার পাবে। কিন্তু সে প্রমাণ যে এত তাড়াড়াড়ি
পাবে ভাবেনি। কল্পনাতীত জবাব পেয়েছে। এত আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কতটা মাংসল থাকা যায়
জহির তা বুঝতে পারে না। কে তাকে সমর্থন করবে? খুব কাছের মানুষগুলো পর্যন্ত বিষয়টাকে
অযৌক্তিক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যায়। কল্পনাও করা যায়নি।
এখন প্রতিটা কথায় হ্যাপি বলছে, এটা তোমার দোষ, ওটা তোমার দোষ, এটা করা
উচিত হয়নি, ওটা করা উচিত হয়নি, এটা আগেই বলেছিলাম, আমার কাছে সব গোপন করেছো। আবার মা
বলছে, তোমার মাথায় কোন বুদ্ধি নেই, তোমার কোন জ্ঞান হলো না, এটা কেউ করে, ওটা কেউ বলে,
এভাবে কেউ করে? আপা বলছে সব ছেড়ে দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ, তুমি আসলেই নির্বোধ,ওদের
একটা নখের সমান জ্ঞানও তোমার হয়নি। চারিদিকের লোকজন কেবল বলছে জ্ঞান নেই, বুদ্ধি নেই,
চালাক নই, নির্বোধ, কেউ বলছে খালুর মতো হয়েছে ইত্যাদি। কেউ বলছে না এটা বোকামি নয়,
ভদ্রতা ও মানবতা-ভাগ্যটা হয়তো ফেভার করেনি। সকল দিক থেকে পরাজয়গুলো ক্রমে কাছে চলে
আসে। তারা তীরের মতো বিদ্ধ করতে থাকে। আর জহির তখন চীৎকার করে ওঠে। মাঝে মাঝেই এমন
হয়। চোখের সামনে শুধু অন্ধকার, ঝাপসা আর মাঝে মাঝে ভূমিকম্প। সে জানে, লেখকদের অন্যান্য
রোগের সাথে ভার্টিগো আর ভেস্টিপুলার নিউরোপ্যাথি নামক রোগ দুটি খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সেটা নরমালিই হয়। কিন্তু সাথে যদি এতকিছু যুক্ত হয় তবে তো কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া
অনাদর ও অবহেলা তো থাকেই।
তখন জহির সবাইকে বলতে থাকে আমি চলে যাচ্ছি খুব শীঘ্রই। আমার হাতে আর
বেশি সময় নেই। সে বুঝতে পারে তার সমস্যাগুলো। সে প্রিডিকশন করতে পারে, মিলেও যায়। এমন
পরিস্থিতিতে মানুষ একঘরে হয়ে যায়। তার সকল সামর্থ্য কমে আসে। সে সুযোগে সকলেই ক্ষতি
করার চেষ্টা করে। সে দেখে এমন পরিস্থিতিতে লোকজন ঝামেলা করে খুব মজা পায়। একটা সত্যি
কথা বললে অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কেউ সত্য কথা বলে না। বলে কাকে খুশি করবে? খুশি
করবে কেন? সত্য ও সঠিক বলবে, খুশি করার কি প্রয়োজন? তারা তো সমস্যা সমাধান করতে চায়
না। সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখতে চায়। তাছাড়া ইমোশনাল ব্লাকমেইল তো থাকেই। প্রথমদিকে জহির
কষ্ট পেলেও এখন কষ্ট পায় না। এখন সে বিষয়গুলো এনজয় করতে শিখেছে। কাছের মানুষগুলো কেমন
হিংস্র হয়ে যায় সেটা সে উপভোগ করে।
এখন তার মনে হয় সমস্যা জিনিসটা খুব খারাপ না। সমস্যা হলে মানুষ চেনা
যায়। তাছাড়া নিজেকে বিচার করবার একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। প্রতিটা মানুষ পশু না মানুষ
তা বুঝা যায়। তাছাড়া মানুষ তো কোন না কোন একটা সময় কিছুটা পশুই থাকে। হ্যাপি কাছ থেকে
এত বেশি ইরিটেড করে যে, তা বেশির ভাগ সময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। অন্য সমস্যাগুলো
তো দূর থেকে হয় কিন্তু এই সমস্যাটা খুব কাছ থেকে হয়। তখন জহিরের চোখে বাবা ও মায়ের
মুখটা ভাসে। বঙ্গভঙ্গের মতো একটি পরিবারের ভাঙন চোখের সামনে দিয়ে কুয়াশার মতো ধোঁয়া
হয়ে ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে। যারা পক্ষ নিচ্ছে কিন্তু সত্যের পক্ষ নিচ্ছে না, তারাই কিন্তু
সমস্যাটা সমাধান করতে পারে। যারা পক্ষ নেয় তাদেরকে পক্ষপাত বলা হয় না, খারাপও ভাবা
হয় না। যারা সত্যি বলে তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমাদেরকে কিনে নিয়েছে।’ আর তাতে সত্য বলতে অনেকেই
ভয় পায় বা কুণ্ঠিত হয়। ভেবে অবাক হয় মা বা বাবা ভাগ হয় কি করে? ওরা ঘরে ঘরে ঘোরে খাবে?
কোনটাই ওদের ঘর নয়, কোথাও ওরা স্থায়ী নয়। একটা মাত্র ব্যাগে বন্ধি থাকবে ওদের জীবন।
সেই ব্যাগটা রাখার জায়গাও পাবে না ঠিকমত। কোন জায়গায় স্বভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে
কিন্তু মন বসতে না বসতেই চলে যেতে হয় অন্য জায়গায়। যাদেরকে জন্ম দিয়েছে, বড় করেছে,
নিজে না খেয়ে খাইয়েছে তারাই কি-না আজ ভাগ করছে, অন্ধকার ও দুর্গন্ধময় ঘুঁপচিতে থাকতে
দিচ্ছে। আবার এ ঘরে তো ও ঘরের দোষ বলতে বাধ্য করে, আবার ওঘরে তো এ ঘরের দোষ বলতে বাধ্য
করে। পক্ষপাতিত্বের দোষ চাপিয়ে দেয়। হায়রে জীবন, হায়রে ক্ষুধা-নিজের সন্তানদের কাছে
শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে এইসব মানুষেরা হার মেনে নেয়। এক সময় দু’ঘরের কাছেই দোষের
করে দেয়। অপমানের বোঝা কাঁধে কিন্তু জহির কি বলবে? সত্য কি তবে বলবে না? অনেক মানুষ
তো এমন ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কিছু কিছু মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে এমন ধোঁয়ার অবতারণা করা
হয়, যাতে তা জীবন্ত বা জটিল হয়ে ওঠে। একটা অলৌকিক অর্থ ছড়িয়ে দেয় দর্শকদের মাঝে। এমনি
একটা মঞ্চ নাটকের কথা জহিরের মনে পড়ে, সে দেখেছিলো ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানো আসামীকে হুইস্কির
গেলাস হাতে দিলেও ধরে রাখতে পারছে না। হয় তার বিবেক আজ আর (মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে)
সায় দিচ্ছে না, নতুবা সে তা গ্রহন করার মতো সামর্থ্যবান না। মৃত্যুর সামনে দাঁড়ানো
শরীরটাকে তার খুব ভারী মনে হচ্ছে। মৃত্যুকে সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কত কষ্টের তা ভোক্তভোগী
ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। কিন্তু মনে হচ্ছে সে আর দেরি করতে চাচ্ছে না। তার ভেতর একটা
ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। যেতে যখন হবে তখন সময়-টময় হিসেব করে কি লাভ। তাড়াতাড়ি চলে গেলেই
ভাল। প্রয়োজনে আমি লিখে দিয়ে যাই সময় হয়ে গেছে। এই অপেক্ষা আর ভাল লাগছে না। এর একটা
সমাধান হোক। পৃথিবীর সকল বিশ্রী বিশ্রী যুদ্ধের বা সমস্যার সমাধান মৃত্যু খুব সহজেই
দিতে পারে। এই যে মানুষের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, এটা কিন্তু মৃত্যুই সমাধান দিতে পারে।
মৃত্যু মানেই শুধু ঘুম আর ঘুম। আর কোন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, কর্পোরেটের রক্তচক্ষু,
মোবাইল ফোন,কোচিং সেন্টার, কনডম কোনকিছুই আর আটকাতে পারবে না। আর কোন কাজ থাকবে না।
কোন ব্যস্ততা থাকবে না। কোন ওয়েটিং ফোনকল থাকবে না। একটা শীতলতা ঘিরে রাখবে। জহির ভাবে,
এমন কোন সম্পদ তো আমার দরকার নেই, যা আমি পকেটে নিতে পারব না। শুধু খাবারের জন্য ও
জীবন ধারনের জন্য যেটুকু দরকার, তারচেয়ে বেশি একজন কবির কেন দরকার হবে? আমি যে সম্পদ
করতে চাই তা মানুষের জন্য। আমার জন্য তো কোনকিছু প্রয়োজন নেই। ওসব নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে
খুব লজ্জা পাই। কারা করে এসব কাড়াকাড়ি? ওরা করুক, ওদের দরকার। ওরা আমাকে ফকির বলে কিন্তু
আমার সৃষ্টি করা একটা লাইন ওরা সারাজীবনে সৃষ্টি করতে পারবে না। একটা কবিতা কেনার মতো
সম্পদ ওদের সম্মিলিতভাবেও নেই। ধনী ও গরিবের পার্থক্য ওরা কি করে বুঝবে? খুব কষ্ট হয়
ওদের মূর্খতা ভেবে। মনে হয় ঐ গরু-ছাগলগুলোকে যদি মানুষ করতে পারতাম। আমি তো বলা মাত্রই
ফকির হয়ে যাই, আবার বলা মাত্রই রাজাধিরাজ হয়ে যাই। এত সহজ আমার এই টার্নিং। এত ক্ষমতা
আমার এই হাতে, এই মাথায়। তাহলে বল্টুর কথায় আমি ফকির বা রাজা হবার কষ্টে কেন ক্লিষ্ট
হয়ে বসে থাকব? ও কি করে বুঝবে-ওটা তো ওর কাজ নয়। ওর কল্পনা তো ৪/৫ লক্ষ টাকার মধ্যে
সীমাবদ্ধ। এত টাকা! কী করব আমি এত টাকা বা সম্পদ দিয়ে? আমি যেখানে ঘুরি, যেখানে উড়ি
সেখানে কল্পনাতীত সম্পদ।
কখনো মনে করিনি বড় চাকুরী করি বা অনেক সম্পদের মালিক। চাকুরীর প্রতি
একটা প্রচণ্ড রকমের ঘৃণা জন্মেছে। এত বিশ্রী ন্যাচারের জব কি করা যায়? তবুও সেখানে
মানুষের ক্রমাগত আঘাত। মাথা নিচু রাখতে রাখতে আমার ঘাড়টা বাঁকা হয়ে গেছে। ব্যাথায় টনটন
করছে। ঘাড়টা কোনদিকে ঘোরানো যায় না। হাঁটুতে ব্যাথা, কাঁধে ব্যাথা, আঙুলের গোড়ায় গোড়ায়
ব্যাথ্যা। সাদা বিছানা আর ঝাপসা চোখের চাহনিতে এখন আর কাউকে খোঁজে পাই না। আমি একা
কেন? কেউ পাশে নেই কেন? মাথার ভেতর ক্রমাগত ভুল রেসপণ্ডগুলো উঁকি দিতে থাকে। তারা পাগলের
মতো দৌঁড়াদৌড়ি শেষে অন্ধ বিশ্বাসে প্রতিস্থাপিত হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।
কেন ও কিভাবে মানুষ শত্রু হয়? উপেক্ষিত হতে হতে হাসপাতালের বেডে সে নিজেকে
একা অনুভব করে। কেন এমন হলো? সে কি কোন ভুল করেছে, দোষ করেছে, কারো কোন ক্ষতি করেছে?
তবে এমন হলো কেন? জহির অনুভব করে তার একজন বন্ধুর প্রয়োজন, সে মেয়ে বন্ধু হলে ভালো
হতো। কিন্তু কোথায় পাবে? সে বন্ধুর সাথে তার দেখা হবার প্রয়োজন নেই কিন্তু একটু কথা-বার্তার
প্রয়োজন আছে। সেটা আন্তরিক কথা। কিন্তু পৃথিবীতে কি আন্তরিক বলতে কি কিছু আছে? হয়তো
আছে কিন্তু তা তার নেই? হ্যাপি যদি প্রশ্ন করে কি দিয়েছো, কুদ্দুস যদি প্রশ্ন করে কি
দিয়েছো-কি জবাব দেবে? সে কিসের মীমাংসা খুঁজবে? মীমাংসা বিষয়টা কি খুব সহজ? ঐ যে বলল
কিছু দেয়নি, একবারও খাবার দেয়নি এর জবাব কি? কিছু দেইনি এর জবাব কি, প্রমান কি? ঐ যে
কথাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে মানুষেরা এর জবাব কি? এর মাঝে একজন এসে বলে গেলো, আপনার মতো ভালো মানুষ এই অফিসে টিকতে
পারবে না। কেন বলল? তবে ভাল হওয়াটা অপরাধ নাকি খারাপ হওয়াটা অপরাধ? তবে জহির কি করবে?
সে যে সীমানায় পৌঁছে যেতে চাচ্ছে, সে যেখানকার কাছাকাছি, যত কষ্ট করে সে এতটা এগিয়েছে
তবে কি সেটা ভুল? না, সেটা কখনো ভুল হতে পারে না।
আমাদের যা কিছু করার ছিল বা আছে তা কি আমরা ভাবি? কেউ স্বীকার করতে চায়
না। কেউ সত্য বলতে চায় না। কেন? কি হবে এত সম্পদ দিয়ে এবং অন্যের ক্ষতি দেখে মজা পেয়ে
? জটিলতাই কি জীবনের একমাত্র উপাদেয় সঞ্জীবনী? এটা, ওটা, সেটা-হলো না, পেলাম না, দিলো
না, হতে দিবো না এসবই কি জীবনের ব্রত?
ঐ যে দলগুলো ভারী হয়েছে, ওরা কি ভাবছে? কি লাভ? তারা হয়তো জানে না, একটা
খোঁচা লাগলে ওরা চিরকালের জন্য ঘরছাড়া হয়ে যেতো। এই সামান্য জ্ঞানটুকু ওদের নাই জেনে
প্রথমবার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর যারা সারা জীবন শুধু মজা দেখেই জীবন কাটায়, তাদের জীবন
কি খুব সুখে কাটে? জীবনের মীমাংসা হলো সব কিছুকে সহজ করে দেখা। এই উপলব্ধি আমরা অনেক
দেরিতে বুঝি। জীবনের কোনকিছুকে সমস্যা মনে করা উচিত নয়। সব সমস্যার মুখোমুখি হয়েও আমাদেরকে
গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছাবার আমি কে? আমি কি পারব সব সমস্যার সমাধান
দিতে? কেউ তো কিছু স্বীকার করে না। ঘরে একা, হাসপাতালে একা, জীবন চলার সবটুকু পথে একা।
এই একার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এই একাটুকুতেও যারা বাঁধা সৃষ্টি করতে চায়।
তারা আসলে এত লোভী এবং নির্বোধ যে, চাওয়াটুকুর অর্থই বুঝে না।
জহির মাঝে মাঝে ভাবে, তার জীবনটা এমন হলো কেন?
বেশি কিছু তো সে চায়নি।
আজকাল নাকি টিকতে হলে খুব বুদ্ধিমান হতে হয়। আমি কি বুদ্ধিমান নই? বুদ্ধিমান
নাকি চালাক? চালাক যে হতে পারব না কোনদিনও। তবে কি আমি টিকতে পারব না? তাহলে হেরে যাওয়াকেই
আমি সঠিক বলে মেনে নিলাম। হেরে গেছি সহোদরের কাছে, হেরে গেছি প্রিয়জনের কাছে, হেরে
গেছি বন্ধুর কাছে, হেরে গেছি সম্পদের কাছে, হেরে গেছি কর্মের কাছে, হেরে গেছি আত্মজের
কাছে, হেরে গেছি ভালোবাসার কাছে। আর কোনো হারবার অবশিষ্ট নেই।
জহিরের মনে পড়ে সীমা’র সাথে ঝগড়া হয়নি, বিবাদ হয়নি, তবে সম্পর্ক নেই
কেন? ও তো আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমার প্রথম স্পর্শে ওর তিনদিন জ¦র ছিল। তারপর
একদিনও মিস হয়নি। আমরা কত ঘোরে বেড়াতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে
সবকিছু। আমি ওকে যেভাবে ভাবি ও সেভাবে নয়। ও চায় স্বামী-সন্তান, সমাজ, আত্মীয়-স্বজন
ও কলিগদের নিয়ে হৈ হৈল্লোড় করে সময় কাটাতে। আমি শুধু ওকে চাই। আমি তো নিঃসঙ্গ ও একাকী
একজন মানুষ। ও তেমন নয়, দলবল নিয়ে হৈ হৈল্লোড় করে সময় কাটাতেই ওর পছন্দ। এছাড়া বিশ^াস
বা ভালোবাসার মধ্যে কোন রকম প্রতারনা বা প্রবঞ্চনা নেই। এটাই গ্যাপ। ঝগড়া-ঝাটি বা অপছন্দও
নয়। যেভাবেই হোক আমি তো ওকে পাচ্ছি না।
এমন ভাবনার পর হাসি পায় জহিরের। নারী না হয় চেয়েছি কিন্তু কলিজা কেন
চাইব। আমি কি কসাই নাকি? মাংসের কারবার তো আমার কাজ নয়। নাক ডাকি ঘুমানোর সময়, সে না
হয় বদভ্যাস। এতে এখনই যদি না পাশে থাকিস তবে তো সময়ে আরো থাকতে পারবি না। সে অনেক দায়ভার
অনুভব করে : পরিবারের জন্য, ছেলে-মেয়েদের জন্য, ভাই-বোনদের জন্য, পাড়া-প্রতিবেশির জন্য,
আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। কিন্তু না পারলে কি করার আছে অথভা সবই কি পারা যায়? সে নিজেকে
পুরোপুরি প্রস্তুত করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। দায়ভার কাঁধেই রাখে। কিন্তু মনে রাখে সবকিছুর
পরও তাকে তো ডেসটিনেশনে পৌঁছাতে হবেই। কিন্তু এত প্রতিকূলতা তাকে ক্রমাগত গ্রাস করতে
থাকে। কাছের লোকদের আঘাত তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। তার বাস্তব আর স্বপ্ন একাকার হয়ে
গেছে। কোনভাবেই একটি ও থেকে আরেকটিকে আলাদা করা যাচ্ছে না। অতীত-বর্তমান, স্মৃতি-বিস্মৃতির
অন্ধকারে সে যে স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ রইল না।
এই রকম পরিচয়হীন রোগী হাসপাতাল রাখতে চায় না কর্র্র্তৃপক্ষ। কিন্তু কোথায়
ফেলবে? তবুও এক সময় তাকে বের করে দেয় হাসপাতাল থেকে। ততদিনে হেনা’স ড্রীম অন্যদের দখলে।
সে কোথায় যাবে? অন্তিম সময়। একটু শুয়ে বিদায় নেবার কথা ছিল। পাশে দু’চারজন লোক থাকবার
কথা ছিল। কিন্তু না তাকে সে সুযোগ আর ভাগ্য দেয়নি।
নিদ্রাহীন, আহারহীন, গোসলহীন উস্কুখুস্কু জহির ঝোঁলা কাঁধে চলে যাচ্ছে।
কোথায় যাবে, জানে না। চোখে ঝাঁপসা দৃষ্টি। নিজেকে বুঝবার মতো অহংকার তার মাঝে জন্ম
নেয়। সে জানে তার গন্তব্য। তাকে যে সেখানে পৌঁছাতেই হবে। শুধু মুখে বিড়বিড় করছে, লেট
মি টাচ দ্যা ডেসটিনেশন...লেটমি...টাচ দ্যা ডেসটিনেশন...আর নেপথ্য থেকে ভেসে আসছে Miles to go before I Sleep.
---------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি
শামীম রফিক
লেখক পরিচিতি
শামীম রফিক
মোবাইল : ০১৯৩৩-৩৩৪৫১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন