জনপ্রিয় সাহিত্য


মোজাফ্ফর হোসেন

আপনি মানেন আর না মানেন, বাঙালি লেখকরা খুব চেষ্টা করলে শরৎচন্দ্রের মতো অথবা বিরাট মেধা হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ভারি বা সিরিয়াস সাহিত্য উৎপাদন করতে পারবেন। কিন্তু যাকে তাঁরা হালকা বা চটুল জনপ্রিয় সাহিত্য বলে বলে দূরে ঠেলে রাখেন, আসলে সেটা করার ক্ষমতা বা মেধা কোনোটাই তাঁদের নেই। বিশ্ব-কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো কথিত সিরিয়াস সাহিত্য আমাদের আছে, কিন্তু গোয়েন্দা, অ্যাডভেন্সার, ভৌতিক, সায়েন্স ফিকশন, ফ্যান্টাসি, রহস্য বা ক্রাইম থ্রিলার, কমিক্স এসব সাহিত্যে আমাদের দৌড় কতটুকু? উল্লেখ্য, আমাদের জনপ্রিয়-ধারার সাহিত্য যা আছে তার একটা বিরাট অংশ মৌলিক না।


এগুলোকে হালকা সাহিত্য বলতে পারেন। কিন্তু আর্থার কোনাল ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, জে কে রলিং, স্টিফেন কিং, ব্রাম স্ট্রকার, ড্যান ব্রাউন, পিটার জেমস, জেমস প্যাটারসন, জর্জ মার্টিন, ব্রান্ডন স্যান্ডারসন এঁদের মতো লেখকদের কথা তো বাদই দিলাম, ইউরোপ-আমেরিকার তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের মতোও এই ধারার সাহিত্য বাঙালি লেখকরা উৎপাদন করতে পারেননি।
সিরিয়াস সাহিত্য যারা করেন, সেখানেও ন্যারেটিভে ভেরিয়েশন খুব কম। এডগার এলান পো থেকে অ্যাটউড কিংবা সন্ডার্স-মুরাকামি যেভাবে ফ্যান্টাসি এবং রিয়েলিজম মিলিয়ে গল্পটা বলেন, কজন বাঙালি লেখক সেটা করতে পেরেছেন? এনিমেল ফার্ম, ডক্টর জেকিল অ্যান্ড হাইড, মেটামরফোসিস এরকম অনেক সিরিয়াস সাহিত্যের উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে গল্পটা আরো বেশি বিখ্যাত বা মনোগ্রাহী হয়েছে বলার টেকনিকের কারণে। এইরকম এলিগরি তৈরি করতে গেলে ফ্যান্টাসি সাহিত্যের টেকনিক লাগে। কিন্তু আমাদের সিরিয়াস সাহিত্যের লেখকরা-তো মনেই করেন, এসব হালকা মেধার কাজ। কাজেই?

কাজেই যেটা হয়, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বাস্তবতার কারণে অনেক গল্প আমাদের লেখকরা লিখতে পারেন না। সরাসরি অনেক গল্প বলা যায় না। এলিগরির আশ্রয় নিলে পৃথিবীর যে কোনো বিষয়ে গল্প লেখা সম্ভব। এতে শিল্পের দিকটাও অক্ষুণ্ণ থাকে। একটা উদাহরণ দিই। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা নিয়ে সত্তরের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক ভয়ে কেউ কোনো উপন্যাস লেখেনি। এখনও কেউ কেউ লিখছেন না সেটা বক্তব্যধর্মী হয়ে যাবে বা দলীয় রাজনৈতিক লেখা হয়ে যাবে এই ভয়ে। যারা লিখেছেন সেটা কিছুটা হয়েছেও। মানে শিল্প বলে কিছু থাকবে না। অর্থাৎ বাস্তববাদী সাহিত্যের যে স্টাইল সেটা এক্ষেত্রে কাজে লাগান যাচ্ছে না। কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে দুর্দান্ত পলিটিকাল এলিগরি লেখা সম্ভব ছিল। এতে শিল্প যেমন অক্ষুণ্ণ থাকত তেমনি বঙ্গবন্ধুবিরোধী সরকার কিছু করতে পারত না। কারণ গল্পটা বলা হয়েছে হয়ত এনিমেল ফার্মের মতো কোনো মোড়কের ভেতর দিয়ে। জর্জ সন্ডার্স 'লিঙ্কন ইন দ্য বার্ডো' উপন্যাসে লিংকের মৃত্যু নিয়ে যেটা করেছেন সেটাও স্মরণীয়। উনি সরাসরি লিখলে বুকার পেত না। উপন্যাসের থিম না, স্ট্র্যাকচার পাইয়ে দিয়েছে।
সিরিয়াস কথাসাহিত্য যতদিন ন্যারেটিভে এই ধরনের বৈচিত্র্য না আনতে পারবে ততদিন বাংলা কথাসাহিত্য একটা গলিতেই ঘুরপাক খাবে। এই জন্য শুধু গল্প না, গল্প বলার শৈলী ও স্টাইল নিয়ে ভাবতে হয়। অনেক সময় গল্পের চেয়ে এটাই বেশি করে ভাবতে হয়। নিরীক্ষা করতে হয়। অনেক সময় স্ট্রাকচার নিজেই গল্পের চেয়ে বড় গল্প হয়ে ওঠে, যেটা মেটামরফোসিসে হয়েছে। এসব কথা আমি বলি বলে অনেক লেখক হাসেন।

এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রশ্নটা হলো, জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। আমি নিজে এই ধারার সাহিত্যের পাঠক না হলেও এটা তো জানাই যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সাহিত্যেও সিংহভাগ পাঠক পড়ুয়া উল্লিখিত জনরাগুলো পছন্দ করেন। ফলে বাংলাদেশে বিদেশি থ্রিলার-ফ্যান্টাসি-হরর-ডিকেক্টিভ-কমিক্স সাহিত্যের একটা বড় মার্কেট আছে। দেশি প্রকাশনা ক্ষেত্রকে ‘শিল্প’ হিসেবে দাড় করাতে হলে জনপ্রিয় ধারায় নিজস্ব মৌলিক সাহিত্য দরকার। হুমায়ূন আহদেমের মৌলিক সৃষ্টি ছিল হিমু। জনপ্রিয় হয়েছে। তিনি দেশি বইয়ের মার্কেট চাঙ্গা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হতে চলল। আমাদের নিজস্ব জনপ্রিয় থ্রিলার-ফ্যান্টাসি-হরর-ডিকেক্টিভ-কমিক্স সাহিত্য দাঁড়ায়নি। যা লেখা হয়েছে এসব ধারার স্মার্ট পাঠককে দিলে হাসে। বলে: কিছুটা দাঁড়িয়েছে মানে বিদেশি গল্পের সস্তা অনুকরণ, মৌলিক যা খুবই দুর্বল। সবচেয়ে মেধাবিলোকের কাজ দুর্লব মেধার লোকরা করতে এলে যা হয়!

একবার আমাকে একজন বড় লেখক বললেন, আমাদের সাহিত্য-ঐতিহ্য ও পাঠকের মনন এসব লেখার জন্য সহায়ক না। তাকে বলেছিলাম, দেশের হয়ত নব্বইভাগ পাঠক এই ধারার বইগুলো পড়ে। ফলে পাঠকের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন টিকবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন সাহিত্য-ঐতিহ্য নিয়ে। আমেরিকার কথা বাদ দিলে, তারা এতে চ্যাম্পিয়ন, ব্রিটিশদের মতো বাস্তববাদী কাটখোট্টা মনমানসিকতা সম্পন্ন সমাজও এই ধারায় এগিয়ে। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, তারাই ভৌতিক সাহিত্যে বাজিমাত করছে। রিয়েলিজম সাহিত্যে যারা জনক-পর্যায়ে তারাই ‘আনরিয়েল’ অর্থাৎ ফ্যান্টাসি সাহিত্যে মাস্টার। আর আমরা জ্বিন-ভূতে বিশ্বাস করেও আমাদের ভৌতিক সাহিত্য দাঁড়াল না। জ্বিন আমাদের সাহিত্যে কোনো অবদান রাখতে পারল না। অথচ ধর্মীয় কারণে হলেও এদেশের শতভাগ মুসলিম জ্বিনে বিশ্বাস করেন।

আর সামাজিক প্রেক্ষাপট শুধু না, সাহিত্যের ঐতিহ্যেও আমরা দেখব, ভারতীয় সাহিত্যের প্রাণ মহাভারত-রামায়ণ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ‘ফ্যান্টাসি’ একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। মোট কথা, আমরা জাতিগতভাবে খুব অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় না হলেও ভৌতিক ও ফ্যান্টাসি জায়গায় আমাদের কেউ পেছাতে পারবে না।
সব মিলে সাহিত্য-ঐতিহ্য, সামাজিক প্রেক্ষাপট, পাঠকের মানসিকতা — এসবে দোষ না চাপিয়ে লেখকের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলি।
সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতা নিয়ে কথা উঠলে খালি তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। গ্রো আপ ম্যান!! আন্তর্জাতিকতা একটা টোটালিটি থেকে ধরতে হবে।
চলচ্চিত্র??

একি কথা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও। নায়ক-নায়িকা-নায়িকার বড়লোক বাপ-দুষ্টু/ধর্ষক ভিলেন আর ‘কঠিন বাস্তবতা’ ছাড়া কিছু আছে আমাদের গল্পে? গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে নির্মিত দুর্দান্ত দুটা করে হরর, থ্রিলার, গোয়েন্দা মুভির নাম করেন তো?? মানছি সায়েন্স ফিকশন তৈরির উপযুক্ত নয় আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি, কিন্তু এত এত ক্রাইম, ৫টা ক্রাইম থ্রিলার মুভি তো হতে পারত। এত এত ভূতে বিশ্বাস, ৫টা ভূতের মুভি? তা-না, একটা বিছানার দৃশ্য তাও নায়িকা কাপড়চোপড় খোলেনি, একটা প্রজাপতি, আর্ধেক ঘাসফড়িং, দুটো গাছের পাতা, একটা করুনসুরের গল্প--এই দিয়ে নাম পড়িয়েছে আর্ট ফিল্ম। এই আজব কিসিমের জনরা এরা বানাইছে। বললে বলবে বাজেট নাই। তো ড্রামা মুভিই যদি বানাইতে চাইবে একটা ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন, এ সেপারেশন’ বানাক। একটা ছবি একঘরের মধ্যে হয়ে গেছে, অন্যটাও নামমাত্র খরচে। গল্প লাগে, গল্প। মেধা লাগে, মেধা। আছে ওসব? তা-না যেখানে যেটা করার সেটা না করেও রাজনীতি করবে। মসজিদ কমিটির রাজনীতি। এফডিসির রাজনীতি। শিল্পীসমিতির রাজনীতি। মর তোরা। দেশের বাজার বিদেশি বইসিনেমায় ভরে যাক। আর আপনারা সরকারি অনুদানের জন্য চক্কর কাটেন। আর সরকারের কাছে সর্বদা দাসত্বের প্রমাণ দিয়ে যান। আর মিডিয়াকে বলেন, ওয়েব সিরিজের কারণে অশ্লিততায় ভরে গেল দেশ। বসান ঘরে ঘরে সেন্সর বোর্ড। শিক্ষিত চেতনাধারীদের চোটে দুর্নীতি ছাড়া দেশ থেকে সব ভেগে যাক।

[**দুয়েকজন ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত নন। যেমন সত্যজিতের কথা কেউ বলতে পারেন। কিন্তু আমি ওভারঅল সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা বলছি]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন