খালিদ হাসান তুষার
(লেখকের ফেসবুক থেকে গৃহীত)
আহমদ ছফাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনার লেখার
ভেতর বিশ্বমানের কোন বই আছে কিনা? তিনি দুটো বইয়ের নাম করেছিলেন। একটা এই ওঙ্কার
অন্যটা পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ। দুটোই নিঃসন্দেহে অসাধারণ পুস্তক আর বাংলা
সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক্যাল উপন্যাস হলো ওঙ্কার। জহির রায়হান যদি ভাষা আন্দোলনের
সন্তান হন তাহলে ছফাকে বাঙালি জাতিসত্তার সন্তান বললে সম্ভবত ভুল হবে না। বাঙালি
জাতিসত্তার সত্য নিগূঢ় পরিচয় নির্ধারণে মৌলবী ছফার যে সাহসী ও দুর্বার ভূমিকা তা
তুলনাহীন। ছফার প্রায় সব উপন্যাসই মুক্তিযুদ্ধের এপাশ ওপাশের সমাজ রাজনীতি নিয়ে লেখা।
ওঙ্কার হলো যুদ্ধ শুরুর আগে যে টালমাটাল বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ তার প্রেক্ষিতে রচিত।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
এই শানে নুযুলে তাঁর আরো একখানা উপন্যাস আছে, আলী
কেনানের উত্থান। এটা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে যুদ্ধেরও পরে
গিয়ে--যেদিন শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন।
যাহোক ওঙ্কার উপন্যাসের মাধ্যমে ছফা তাঁর বোবা
বউরে দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন--ভাষার জন্য আকুতি, রক্ত ছেঁড়া টান। ছফা তো ছিলেন
চ্যাতা মেজাজের, তিনি এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে বন্ধুর সাথে কথাকাটিতে রাগ করে হেঁটে
ঢাকা চলে আসেন, তারপরই এই উপন্যাস লেখা। এ উপন্যাসটা ছফার কিছুটা জীবন নির্ভর, তবে
পুরোপুরি নয়। উপন্যাস বয়ান করেছেন লেখক নিজের জবানিতে। বলবার সুবিধায় তাই ধরে
নিচ্ছি উপন্যাসের নায়ক ছফা নিজে।
যেটা বলছিলাম, ওঙ্কার উপন্যাস শুরু হয়েছে ছফার
বাবার পূর্বপুরুষদের হারানো তালুকদারির গৌরব স্বপ্নে। তাঁর পিতা ছিলেন বেশ মেজাজি
এবং সামন্ত অহংকারে বাতাসে পা দিয়ে হাঁটতেন। আবু নসর মোক্তার কূটকৌশলে ছফার পিতার
সব ভিটে মাটি নিজের নামে নিলাম করিয়ে নেয়। পরে এই ফাটকে ফেলে আহমদ ছফার সাথে
মোক্তার সাহেব তার বোবা মেয়েকে বিয়ে দেন। গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে ছফাকে বাড়ি দেন
চাকরি দেন। কিন্তু বউ তার বোবা। এ নিয়ে দুঃখ ক্ষেদ আছে। নিজের সুখ ঐশ্বর্যের
বিবেচনায় ছফা বউয়ের উপর রাগ করতে পারেন না। পাছে শ্বশুর সবকিছু কেড়ে নিয়ে পথে ফেলে
দেয়। ছফার অন্য উপন্যাসের মতই, এ উপন্যাসের নায়কও অথর্ব, প্রতিবাদহীন, নির্বিরোধী।
বউ বোবা হলেও সে মনে প্রাণে কথা বলতে চায়, গান শিখতে চেষ্টা করে--বিফল হয়।
ধীরে ধীরে দেশের অবস্থা বদলে যেতে থাকে।
পাকিস্তানি সামরিক শাসনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকে দেশ মাটি জনগণ। চারিদিক পুলিশ
মিলিটারি মিছিল ঝড়ের মত মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মিছিল আসার শব্দ শুনলেই ছফার বউটা
অন্যরকম হয়ে যায়। সে হাত পা ছুঁড়তে শুরু করে--মিছিলকারীদের ভাষা নিজের কন্ঠস্ত
করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। একদিন প্রচণ্ড বেগবান এক মিছিল আসতে দেখে, আহমদ ছফার
গর্ভবতী স্ত্রী ঘরের দরজা জানালা সব খুলে দেয়। মিছিলরতদের বিক্ষুব্ধ স্বর নিজের
মুখে তুলতে চেষ্টা করে। পারে না। শেষে প্রচণ্ড চাপে স্বরতন্ত্রী ছিঁড়ে 'বাঙলা'
কেবল এই একটা শব্দই উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। তারপর মেঝের উপর পড়ে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে
অবচেতন হয়ে যায়। সংক্ষেপে এই হলো ঘটনা। এখন কথা হলো আহমদ ছফা এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে
কী বোঝাতে চেয়েছেন?
ওঙ্কার প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। ছফা
তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ, লেখায় স্পষ্টই বলেছেন, নয়মাস যুদ্ধ করে আমরা যে স্বাধীনতা
পেলাম সেটা ঠিক উপযুক্ত স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক
প্রস্তুতির অভাব এবং নেতা ও রাজনৈতিক দলের অদূরদর্শীতা আর অপারগতা উল্লেখ করে তিনি
দেখিয়েছেন কিভাবে বগার মত আমাদের এক ঠ্যাং গিয়ে আটকা পড়েছে ভারতে। অর্থাৎ আহমদ
ছফার অজ্ঞান পোয়তি বউয়ের পেটে যে ছাওয়াল রয়েছে সে মৃত হতে পারে, বোবা বিকলাঙ্গ হতে
পারে। মোটকথা সুস্থ নয়। নবীন নতুন বাংলাদের মত সেও নিশ্চল অসুস্থ। আবার ভাষার জন্য
মুমূর্ষু নাড়িছেঁড়া আর্তনাদও ফুটে উঠেছে। এখানে সত্যান্বেষীদের জন্য ভাবনার অবকাশ
রয়েছে।
আহমদ ছফার ভাষা সুষমা সৌন্দর্য ও পরিমিতিবোধ
অসাধারণ। কী কাব্যিক মাধুর্যে লেখা বই ওঙ্কার! বাহ্যিক আকারে ছোট পরিসরের হলেও এর
বিস্তার ও গভীরতা অতলস্পর্শী। তাঁর যে সম্মোহনী ক্ষমতা, তিনি আমাদের টেনে নিয়ে
ছেড়ে দিতে পারেন ইতিহাসের আলো অন্ধকার চোরাগলি পথে। দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন তিক্ত
কোন সত্যের মুখোমুখি। নির্মোহ পিপাসিত পাঠক মাত্রই আহমদ ছফার প্রতি মুগ্ধ আচ্ছন্ন
না হয়ে পারবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন