নীলু চাচার পৃথিবী

শামীম রফিক

আমার আত্মবিশ্বাস কেমন তা আমি কোনদিনও বুঝতে পারিনি। পারবও না। এই না পারাটাকে ঠিক কিভাবে ব্যাখ্যা করব, জানিনা। আমি প্রতিবছর ক্লাসে ফার্স্ট হই কিন্তু সারা বছর টেনশনে থাকি, মনে হয় এবার আর ফার্স্ট হতে পারব না। কেন এমন করি? ইচ্ছে করে করি নাকি অনিচ্ছাকৃতভাবে করি, সেটাই বুঝি না। আসলেই বুঝি না, তা নয়। একেকজনের স্টাইল তো একেক রকম। এই ভীতু ভীতু স্টাইল-ই আমার শক্তির উৎস। ফার্স্ট তো একদিনে হওয়া যায় না। এটা দীর্ঘদিন তিল তিল করে গড়ে ওঠার বিষয়। সুতরাং না বুঝার কিছু নেই। আমি খুব আত্মপ্রত্যয়ী কিন্তু সেটা নিজের কাছে। কারো কাছে সেটা বলতে চাই না। তাছাড়া বড় করে বলতে চাওয়া বা মিথ্যা বলতে চাই না। বার বার সারপ্রাইজ দিতে চাই। এটাও একটা আর্ট বলেই মনে করি। কোথায় আটকে গেছি? কোথাও না। কিন্তু হাত পাততে চাই না। মাথা নত করতে চাই না। আদর্শচ্যুত হতে চাই না। সৎ ও সুন্দর থাকতে চাই। আমি কি হতে চাই কখনো কাউকে বলতে চাই না। কেউ বললে তা মেনে নিই। আমার এই স্বভাবকে কেউ পছন্দ করে কিনা জানিনা। হয়তো করে, হয়তো করে না। তাতে কি এসে যায়? নিজেকে নিজে বুঝতে পারি। এটাই তো অহংকার। এতে দোষ নেই কিন্তু এটা যদি প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তাবে তা দোষের। খুব নিরীহ ও নির্জীবভাবে জীবন কাটে। কেটেই চলে। কিন্তু কোথায় যেনো ছন্দের পতন কেবল চলতেই থাকে। বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারি না। কোথাও কোন ভুল দেখি না কিন্তু কেবলি উপহাস, কেবলি অনাচার, পারিপার্শ্বিক নানা ছন্দ-পতন। যেসব আমাকে নিঃসঙ্গ হতে বাধ্য করে। আমার পরিধির চারিপাশ ঘিরে পুষ্ট হয় এক ভয়ানক ইন্দ্রজাল। চাইলেও তা থেকে পরিত্রাণের পথ খোলা থাকে না। প্রতিদিন সেই পরিধির প্রান্ত ঘিরে আমার বাধ্যগত পদচারনা মানসিক বিপর্যয়েরর পথকে আরো প্রশস্ত করে তোলে।
 
আমরা যে মহল্লায় থাকি সেটা খুব গিঞ্জি। প্রতিটি বাড়িতে কোচিং সেন্টার, প্রতিটি বাড়িতে দোকান-পাঠ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মার্কেট, সুপারমল সব মিলিয়ে ভীষণ কোলাহলপূর্ণ। আমাদের বাড়ির কাছেই চৌরাস্তাটার মোড়ে যে বিদ্যুতের খুঁটিটা আছে ওটার নিচে ঠিক পশ্চিমমুখি হয়ে বসে আছেন নীলু চাচা। মানে নীলু চাচার জুতা সেলাই ও রঙের দোকান। সত্যিই রঙের দোকান। নীলু চাচার জীবনটা আমার জীবনের মতোই ভীষণ রঙিন আর বৈচিত্রপূর্ণ। নীলু চাচা এতই ভাগ্যবান যে, সারাদিন সূর্যটা থাকে উনার কপালের ঠিক উপর। দরদর করে ঝরতে থাকে ঘাম। চাচা গামছা দিয়ে কতক্ষণ পরপর ঘাম মুছেন আর কাজ করেন। জুতা কালির কাজ তো, তাই সেসব কালি নিজের অজান্তেই চাচাকে রাঙায়। কিন্তু আমি তো রঙ নিয়ে কাজ করি না, তবে আমি কেন চাচার মতো রঙে সাজি? এ রকম প্রশ্ন মনে জাগলেও, জুতা কালি শেষ হলে আমি চলে আসি। রাতে খেতে গিয়ে আমিও ঘামি। খুব ঘামি, গোসলের মতো। অনেকদিন ধরেই ঘামছি। যতবার খাই, ঘামি। না খেলেও ঘামি, তবে হয়তো এতটা বেশি নয়। এ কথা কাউকে শুনাতে পারি না। সবাই বলে ঝাল কম খেলেই পারেন। আমি কি খুব ঝাল খাই? সেটাও তো বুঝবার কথা ঘরের লোকদের, পাশের লোকদের। কিন্তু না, সেটা হয় না। কেন, হয় না? সবাই কেন এক রকমভাবে মিলে যায়? আমি কখনো মিথ্যে বলি না। সে রকম প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু এই তো কোন স্বাভাবিক ঘাম নয়। নীলু চাচার মতো ঘাম। নীলু চাচা! হঠাৎ নীলু চাচার কথা মনে পড়ল কেন? অন্য কোন উদাহরণ কি আসতে পারত না? চাচা তো রোদের কারণে ঘামে। কিন্তু আমি? আমি তো রোদে নই, তবে কেন ঘামি? তবে কি আমিও রোদে? তবে কি আমি দেখতে পাচ্ছি না সে রোদ? হতেও পারে। বিষয়টা খুব ভাবায়। আমাকে একা একা সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া তো উপায় নেই, তাই ঠিক করি ও একজন ডাক্তারের কাছে যাই। উনি আমাকে জটিল উপপাদ্যের মতো করে যা বলেন, তা আমার মগজেও ঢুকে না, মনপুতও হয় না। তাই সে বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আর ঘামতে থাকি। রোজ রোজ ঘামি। এখনও ঘামি। লুনা বলে, তুমি কি বেঁচে আছো? তুমি একটা মানুষ হলা?

আমি মানুষ নই? সত্যিই বেঁচে নেই? তবে যে হাঁটছি, অফিস যাচ্ছি, ক্ষুধা পায় শরীর ও মনে।
তুমি তো রাতের বেলা হাঁটো।
তাতে সমস্যা কি? রাতের বেলা হাঁটলে হবে না?
নাহ্।
রাতের বেলা যদি ঘাম ঝরাই? ঘাম ঝরানোই তো আসল কথা। ওর জবাব না পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখি লুনা নেই। থাকে না এভাবে।
আমি ডাকি, তাতে সাড়া না দিলে বলি : অই মহিলা।
ব্যস আর যায় কই? তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। আমি কি মহিলা?
তবে কি, তুমি পুরুষ?
আমিও তোমাকে পুরুষ বলে ডাকি।
সিওর, ডাকো। আমি কি পুরুষ নই?
লুনা আসলরূপে ফিরে যায়। আমার দেরি হলো কেন? কখন অফিস থেকে বের হই? কোথায় যাই? কার সাথে যাই? নানা কথা।
কোথাও ও কারো সাথে গেলে সমস্যা কি?

ভাবি, যে চাহিদা বুঝে না, চাহিদা পূরণের ক্ষমতা যার নাই। কোথাও গেলে তার সমস্যা কি? তার কিসের প্রয়োজন আমাকে? কোন প্রয়োজনে পাহারা দিতে চাওয়া? তাছাড়া নোংরা ভাবে।
তখন আমি ঠিক করি নীলু চাচার কাছে যাব। উনার কাছে বসে থাকবো আর গল্প শুনবো। অফিস থেকে ফেরার পথে যাই এবং কথা বলি নীলু চাচার সাথে। এখন চাচা ঘামছে না। দেখা যায়। আমি নিজেই বুঝতে পারি। এখন তো রাত, রোদ নেই। তাই ঘামছে না।কিন্তু সব ঘাম কি দেখা যায়? সূর্যের উত্তাপে ঘামকে দেখতে পেলেও রাত্রির ঘামকে দেখা গেলো না। কিন্তু আমার তো রাতেও ঘাম হয়। এত ঘাম কোথা কোথা থেকে আসে?

এতদিন খেয়াল করিনি, আজ  খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করি নীলু চাচার সংসার। আসলে সয়সার বললে ভুল হয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাটিতে বিছানো চটের ছালা, যার উপর চাচা বসে আছেন। সমানে লোহা দিয়ে তৈরি মুচিদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জুতার স্ট্যাণ্ড, ওটার অন্য কোন নাম আছে কি-না জানিনা। পাশে একটা কাঠের বাক্স, ডানপাশে ক্রিম, রঙ আর পানির কৌটা, চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো আছে ছেঁড়া-ফাটা, ফ্যাঁকাসে কিছু জুতা, ছেঁড়া চামড়া, ন্যাকরা, ব্রাস ইত্যাদি। মানুষ এসে পা বাড়িয়ে দেয়, চাচা জুতা খুলে নেয়, রঙ করে, সেলাই করে আবার পায়ে পড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ এসে ছুঁড়ে দেয় জুতা সেলাই বা কালি করার জন্য। কোন কোন ছেলের বয়সী মানুষ তুই-তুকারি করে কথা বলে। চাচা কিছু মনে করে না। মনে করে না নাকি মনে করতে নেই। অথবা সহ্য হয়ে গেছে। মানুষের পা : খুব প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য, দৌঁড়ে উপরে ওঠে যাওয়ার জন্য, বিচারের জন্য, এমনকি শাস্তি প্রদানের জন্য। হিংসায় জানোয়ার হতে হলেও পায়ের প্রয়োজন হয়। যারা সফল হয়েছে তারা তো পায়ের উপরই ভর করেছে, কাউকে শাস্তি দিতে হলে আমরা পা-য়ে ধরাই, জুতা পেটা করি, জুতার মালা পরাই। সেই পা। সেই পা নিয়েই তো চাচার পৃথিবী। খুব সামান্য কাজ নয়। তাকে নিয়ে কে কি ভাববে? সে যেনো শাস্তিস্বরূপ পেশাটা পেয়েছে। হ্যাঁ, শাস্তিই তো। আমার মতো। ভালো না লাগলেও করতে হয়। আর সরল বা মানবিকতার সুযোগ নিয়ে অনেকে ইচ্ছেমতো ঘাটায়। তখন মনে হয় পা নয়, হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলে বোধ হয় পায়ে ভর দেবার প্রয়োজন হতো না। অনেকে টাকাটা পর্যন্ত ছুঁড়ে দেয়, যার বেশিরভাগই মাটিতে পড়ে। চাচা তুলে, কপালে ঠেকায়-প্রণাম আর কি, তারপর গুঁজে রাখেন কাঠের বাক্সে। মানুষ যেনো দয়া করছে, যেনো উনি কাজের বিনিময়ে নিচ্ছেন না। যেনো উনি ভিক্ষা করছেন-এ রকম আর কি। ভিক্ষা কথাটা মনে পড়তেই কেন যেনো চমকে উঠি। তবে কি আমিও ভিক্ষুক? জলের জন্য, ক্ষুধার জন্য, মৌলিক হাহাকারের জন্য কি হাত পেইে থাকবো? ভিক্ষা করেই যাবো, সারাটা জীবন? জীবন আর কতটুকু বাকী আছে গুণে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভিক্ষা কি ফেলে দিতে হয়? ভিক্ষা দিতে কেউ বাধ্য নয়। ইচ্ছে হলে দিবে, নইলে দিবে না কিন্তু ফেলে দিবে কেন? কাউকে অপমান করার অধিকার তো কারো নেই। আমি অনেকক্ষণন দাঁড়িয়ে আছি দেখে চাচা বললেন :বাবা, কোন জুতা ছিঁড়েছে?
ছিঁড়েছে! কিন্তু চাচা জানলো কিভাবে?
হ্যাঁ ছিঁড়েছে, কিন্তু সেটা জুতা নয়।
বলতে চাইলে, বলেন।
চাচা, একটু বসে বললে ভালো হতো।
এখানে তো বসার জায়গা নেই।
চারিদিকে এত জায়গা, তবুও বলছেন, বসার জায়গা নেই?
জায়গা কোথায়? কই, আমি তো দেখি না। তবে একটু বসতে পারি না, শুতে পারি না কেন? কোনটা আমার জায়গা? কোনটাই তো আমার জায়গা নয়। তবে সবাই মারে কেন? পুলিশ মারে, নেতারা মারে, প্রতিবেশিরা মারে, গ্রাহকেরা মারে। তাই বুঝতেও পারি না।
তো, আপনি যে ব্যবসা করছেন।
ব্যবসা কথাটা শুনে কেমন যেনো চমকে গেলেন চাচা : কোনটা ব্যবসা? এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকেন চাচা।
কোনো, আপনি যেটা করছেন, এটা কি? ব্যবসা না?
এটা ব্যবসা?
হুঁ। এটা ব্যবসা।
চাচা কোনভাবেই বিশ্বাস করলেন না, এটা ব্যবসা। ব্যবসা মানে বড় বড় দালান-কোঠা, অনেক পুঁজি, অনেক লোকজন, অনেক শরীর ও চোখের গরম।
এটা তো সামান্য। এখানে তো কিছু নাই। মানুষের জুতা মুছে ও সেলাই করে সবার দয়ায় বেঁচে আছি।

এটা দয়া নয়। আর কোনকিছুই সামান্য নয়। করোনা ভাইরাসও তো সামান্য। কিন্তু পৃথিবীকে জনশূন্য করে দিয়েছে। আসলে আমরা সামান্যর কাছেই হেরে যাই। আসল জায়গাটাই হলো মানুষের চেতনার জায়গা। সেখানে যদি সামান্য একটা ধাক্কা লাগে তো মানুষ সারা জীবন দিয়েও সেটা রিপেয়ার করতে পারে না। বড় বড় বিষয় বা জায়গায় ধাক্কা লাগে না। সব ছোট বিষয় দিয়েই এই পৃথিবীটা। চাচা কোন জিনিসই ছোট না।

চাচা, আপনার কাঠের বাক্সটার উপর বসা যাবে? ভেঙে যাবে না তো?
আপনি বসবেন ওটার উপর?বসেন, বসেন বলে চাচা গামছা দিয়ে বাক্সটা মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
আরে করছেন কি? পরিস্কার করা লাগবে না।
আমি টাইটা খুলে ব্লেজারের পকেটে ঢুকিয়ে এবং ব্লেজারটা হাঁটুর উপর রেখে বাক্সের উপর বসি। বসেই থাকি, কোন তাড়া নেই। কত যে শান্তি। এটা আগে জানলে তো মুচিই হতাম। খোলা আকাশের নিচে ব্যবসার মাঝে অন্য রকমের আনন্দ অনুভব করি।
একজন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের সিন্ধুকের উপর জীবনে এই প্রথম বসলাম। সে যে কী অনুভূতি তা বলে বুঝানো যাবে না। প্রকৃতি যেনো কোমল ও শীতল হয়ে উঠলো। একরাশ হিমেল হাওয়া এসে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড সুখ অনুভব করতে লাগলাম। চাচা আমাকে চা খাওয়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। আমি এমনিতে চা-কফি খাই না, বিড়ি-চুরুট খাই না। কিন্তু আজ না বললাম না। ভাবলাম তাতে যদি এই লোকটার ভালোবাসা আহত হয়। হয়তো আর কোনদিন বলার সাহসই পাবে না।
এক কাপ চা খাবেন বাবা?
আমি বললাম : ঠিক আছে।

চা এলো কিন্তু আমি চা খাচ্ছিলাম নাকি বেহেস্তের সুরা-তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। চা খেলে একজন মানুষ এত খুশি হয় এটা যেমন আগে কোনদিন দেখিনি, চা খাওয়ায়ে এত তৃপ্তি তাও আগে দেখিনি।
আচ্ছা চাচা, আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
শুনেছি, হালুয়াঘাট। কিন্তু আমি তো সারাজীবন ঢাকায়ই থাকি।
ঢাকা এলেন কীভাবে?
বাবা মায়ের কাছে শুনেছি, সে অনেক কথা। আমাদের পেশার লোকজন গ্রামে কি করবে? ওখানে তো কাজ নেই। জমি-জমা নেই। দেশে দুর্ভিক্ষ। তাই রাতের আঁধারে পালিয়ে চলে এসেছিলাম ঢাকা। হায়রে ঢাকা!
চাচার কথায় হতাশা আর কষ্টের কুয়াশা আকাশটাকে মুহূর্তেই ঢেকে দেয়।  
ঢাকা, কোথায়?
ঐ যে দেখছেন, ওখানেই। বেশি দূরে নয়।

দেখলাম। আমরা যেখানে বসে আছি তা থেকে একটু দূরে হাসপাতালের সামনে রাস্তার উপর। ওখানে নীল রঙের পলিথিন ব্যাগ উড়ছে। তার পাশে বসে আছে খয়েরী রঙের একটা কুকুর। বাতাসে উড়ছে পলিথিন পতপত করে। আমার মনে হলো ওটা আমাদের জাতীয় পতাকা। ওটা আমাদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বের স্তম্ভ। আমাদের চেতনা আর আবেগের জায়গা। আবার একই সাথে লজ্জা আর হতাশারও। আমরা পতাকা পেয়েছি, আশ্রয় পাইনি। স্বাধীনতা পেয়েছি, খাবার পাইনা। আগে শোষন করেছে বিদেশিরা, আর এখন করছে নিজের মানুষেরা। আমাদের কাছে তো সবই সমান।
ঢাকায় কতদিন আগে এসেছেন?
আমার জন্মই তো ঢাকায়। বাবা ও দাদাকে এই পেশায় দেখেছি।
আপনি কত বছর বয়সে এই পেশায় এসেছেন?
জন্মের পর থেকেই।
জন্মের পরই কি কেউ কোন পেশায় আসতে পারে?
আমি তো বাবার সাথে এখানেই থাকতাম।
কেন?
সেই ছোটবেলায় মা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলো আর ফিরে এলো না।
তারপর এক সময় বাবা আমাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে সেই যে গেলো আর ফিরে এলা না। বাবাও এখন নেই। যখন দেশে যুজ্জু হয় তখনও আমি এখানে। পাকিস্তানি দেখেছি, রাজাকার দেখেছি, কত মানুষের মৃত্যু দেখেছি, কত নারীর কান্না দেখেছি-যা এখনো জীবন্ত আমার কাছে।
তখনও এখানে?
হুঁ। পাকিস্তানিদেরও জুতা সেলাই করতাম।
কেন?
সেলাই না করে কি উপায় ছিল? কোথায় যাব? কি খাব? কার কাছে যাব? তাই এখানেই ছিলাম। বাধ্য হয়েই জুতা সেলাই করতাম। না হলে কি বাঁচিয়ে রাখতো আমাকে?
আমার তখন চাচার প্রতি কেমন যেনো একটা ঘৃনাবোধ জন্ম নিচ্ছিল। তবে কি উনি পাকিস্তানিদের সেবক ছিলেন? এইসব ভাবনার মাঝে চাচা আবার বলে উঠলেন।
একবার এক পাকিস্তানির জুতায় আলপিন উন্মুক্ত রেখেছিলাম। সেজন্য আমাকে অনেক মেরেছিলো। এই দেখেন, দাগগুলো এখনো আছে বলে তিনি পিঠ দেখাতে চেয়েছিলেন।

আপনি ওদের কাজ করতেন কেন? আর আলপিনটাই বা উন্মুক্ত থাকলো কেন? কে বলল, আমি ওদের কাজ করতাম? আমি কি স্বেচ্ছায় করতাম? বাধ্য হয়ে করতাম। আমার দেশটাকে কেড়ে নিবে আর আমি তাদের পছন্দ করব? আমি ইচ্ছে করেই আলপিনটা উন্মুক্ত রেখেছিলাম, যাতে একটু হলেও কষ্ট পায়। ওরা সব নিছে। আমার এই পলিথিনের নিচ থেকে বউডারে তুলে নিলো, ঐ হারামজাদা। কত হাতে পায়ে ধরলাম কিন্তু শুনলো না কোন কথা। চাঁচা কাঁপছে থরথর করে। মানুষ কষ্টে কীভাবে কাঁদে তা কখনো দেখিনি। আজই প্রথম দেখলাম। নিজের কাঁপুনি বা কষ্ট তো আর নিজে দেখা যায় না।

চাচা হাঁপাতে থাকে। কাঁশতে কাঁশতে মুখে ফেনা উঠে আসে। আমি চাচাকে ধরতে চাই।কিন্তু আবার বুঝতে পারি না, কি করব?
চাচা, চুপ করেন। আমি বুঝতে পারছি।
তারপর বহুবার হাতে পায়ে ধরেও ফেরত পাইনি। অনেক কেঁদেছি। বলেছি অনেকদিন তো রাখলেন, এখন ফিরিয়ে দেন। আর কি আছে, সবই তো নিলেন। এখন মানুষটাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু দেয়নি আবার আমার কাছে জুতা পলিশ করাতে এসেছে।
চাচী আর ফেরত আসেনি?
এসেছিলো, দেশ স্বাধীন হবার পর কিন্তু কোন কথা বলেনি, কাউকে চিনেনি। বছর দুই হলো চলে গেছে আমাদেরকে ছেড়ে। কিন্তু যাবার আগে আর কোন কথা বলেনি। আমি অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ইচ্ছে করছিলো : ঐ কুত্তার বাচ্চার চোখ দুইটা তুলে নিই। যুজ্জে যাই নাই, যদি বউটা ফিরে আসে এবং আমাকে না পায় তো কোথায় যাবে সেইজন্য। খানকির বাচ্চারা কয়, আমরা নাকি মানুষ নই। তুমিই কও...?
আপনার ছেলেমেয়ে নাই?
আছে।
কয়জন ছেলেমেয়ে আপনার?ওরা কে কি করে?
দুই ছেলে। ওরা কি করে?
কি আর করবে? বিরক্তি চাচার গলায়। একজন বাবা খায় আর অন্যজন বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী।
কি খায়?
বাবা।
‘বাবা’ মানে কি?
বাবা মানে বুঝ না?
নাহ।
ঐ যে পয়সায় নিয়ে, নাক দিয়ে যে টানে।
ওহ। ইয়াবাহা?
হ্যাঁ, ঐ টাই। নেশা আর কি?
ফিরাতে পারেন না?
কিভাবে ফিরাবো?
কথা শুনলে তো।
এখন কোথায়?
ওরা এখন আমার সাথে থাকে না।
কোথায় থাকে?
জানি না।
জানি না মানে!
দু’জনই হারিয়ে গেছে একজন ইচ্ছায়, অন্যজন অনিচ্ছায়?
ওরা আসে না?
মানুষ হারালে বুঝি আসে?
আপনি খুঁজেননি?
কোথায় খুঁজব, বাবা?
কোথায় খুঁজবে কথাটি খুব ধাক্কা লাগে বুকের মাঝে। 
সত্যিই তো। কোথায় খুঁজবে, কার কাছে খুঁজবে? কে আছে তার? খুঁজে কি পাওয়া যায় মানুষ?খুঁজে কি পাওয়া যায় প্রেম? এসব ভেতর থেকে আসতে হয়। না হলে হয় না।

আসলে কি মানুষের কিছু থাকে? কেউ থাকে? মানুষ হয়ত আসলেই একা। চাচা একা, আমি একা। আসলে কি সবাই একা? সমস্যা থাকলেও তো মানুষের চাওয়া-পাওয়া বিনিময় হয়। চাচা ঐ চটের উপর আর আমি এই কাঠের বাক্সের উপর। আমাদের কোন পাওয়া নেই। আমরা একা। মাথার উপরে আকাশ। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। ওরা স্বাধীন। নাকি ওরাও স্বাধীন নয়? ওদেরকেও কেউ না কেউ ধমক দিচ্ছে। আর ভয়ে ওরা উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশময়। একটা গানের কথা মনে পড়ে : মন মোর মেঘের সঙ্গীতে/উড়ে চলে দিক দিগন্তেরও পানে। আসতে ইচ্ছে করে না, তবুও চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি বাসায়। মাথার ভেতর ভনভন করতে থাকে আজকের সন্ধ্যা আর নীলু চাচা। মাতালের মতো দুলতে থাকি। দরোজায় কলিং বেল টিপতেই মুখোমুখি দাঁড়ায় লুনা।
তো নবাবজাদার সময় হলো ঘরে আসার?
আমি ওকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে চাই। কিন্তু আবার সামনে এসে বলছে : কানে যায় না?
কি?
এতক্ষণ কি কানে কিছু শোনা যায়নি?
হ্যাঁ, না...মানে।  
জানতে চাচ্ছি, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন এবং কার সাথে ছিলেন?
মানে কি?
মানে কি, বুঝেন না?
না তো।
এতক্ষণ কোথায় ও কার সাথে ছিলেন?
নীলু চাচার...বলে তোঁতলাতে থাকি।
নীলু চাচা, মানে কি?
আমার একজন চাচা, উনার সাথে কথা বললাম।
কোন চাচা?
গলির চৌরাস্তার পাদুকা শিল্পি নীলু চাচা।
মানে ঐ যে মুচির দোকান?
হ্যাঁ, ওটাই।
আর ভণ্ডামি করবা না।
মানে কি, আমি কবে ও কখন ভণ্ডামি করলাম?
লুনা আমার ঠোঁটে কি যেনো খুঁজে, মুখের গন্ধ নেয়, শরীরে কী যেনো খুঁজে?
কি দেখছো অমন করে?
কার সাথে সময় কাটালে?
কার সাথে সময় কাটালাম তা কি ঠোঁটে-মুখে ও শরীরে থাকে? সময় কি আবার শরীরেও দেখা যায় নাকি। আমার তো কোন বন্ধু নেই, বান্ধবী নেই, আমি জীবনে একটা সিগারেটেও টান দিইনি, কোনদিন মদ খাইনি, অকারনে কোথাও সময় নষ্ট করি না। তুমি তো সব জান।
জানলেই কি?কখন কি হয়ে যায় তার নিশ্চয়তা কি?পুরুষ মানুষরে কি বিশ্বাস করা যায়?
পুরুষ বা নারী-বলে কথা নয়। খারাপ বা ভাল সবাই হতে পারে। তুমি খুব নারীবাদী।
হ্যাঁ, আমি তো নারীবাদী-ই। তুমি কি? হ্যাঁ।
আমি পুরুষবাদী নই। আমার কাছে সবাই মানুষ।
কথা গোপন করার চেষ্টা, তাই না?
তা হবে কেন?
তাহলে? জবাব কই?
আমার গোপনীয় কিছু নেই। নারী বা পুরুষ : ডুব দেবার মতো মানুষ হয়তো আছে কিন্তু আমি তেমন কারো সাথে পরিচিত হতে পারিনি। এ আমার ব্যর্থতা।
পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?
ইচ্ছা তো থাকেই কিন্তু সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়?
তো যাও, যাকে দিয়ে পূরণ হয় তার কাছে যাও।
এই ডুব সেই ডুব নয়। এটা কোন রক্ত-মাংসের কথা নয়। এটা তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না? শুধু তুমিই বুঝ? আজকেই সব বই-পুস্তক পুড়ে ফেলবো। বই পড়ে আর কি সব বাল-সাল লেখে। মনে করে কিছুই বুঝি না? সব বুঝি।
এই, এ-ই বইয়ে হাত দিবে না। খবরদার। ভুল করেও এসবে হাত দিবে না।
কেনো, ওখানে কি গোপনকিছু লুকানো আছে?
হ্যাঁ, আছে। এবার যাও। হলো তো?
কত্ত বড় সাহস। আমাকে চলে যেতে বলে। ওখানে কি আছে তা আমি দেখবই।
ওসব না দেখে, এ ঘরে ও ঘরে-সব জায়গায় যে সব ময়লা ও আবর্জনার স্তুপ আছে ঐগুলো পরিষ্কার করো।
ও। সে জন্যই তো ঐসব ছবি তুলে সবাইকে পাঠিয়েছো।
দেখেছো তো, কি রিপ্লাই করেছে পশুগুলো? বলতে পারত, কি করবেন ভাই। আমরাও তো বুঝাই কিন্তু...। ধৈর্য্য তো সারাজীবন ধরেছেন, আর ক’টা দিন ধৈর্য্য ধরেন। কিন্তু তা না বলে...এত বড় বেয়াদবি? আমার ঘর থেকে আমাকে বের হয়ে যেতে বলে। এটা কি কারো বাবার ঘর? আমি কারো দয়া-দাক্ষিণ্যে থাকি?
তুমি ছবি পাঠিয়েছো-তাই লিখেছে।

আমি সত্যি সত্যি ছবি পাঠিয়েছি, অন্য কোন কথা বলিনি। এটা পাঠানো যদি অপরাধ হয়, তবে এগুলো রাখা অপরাধ নয়? আমার বাসায় ওদের ময়লা-আবর্জনা কেন? আসলে ছবির সাথে একটা জুতার ছবি দিয়ে বলা উচিত ছিল : ঐ ময়লাগুলো পরিষ্কার কর, নইলে ঐ জুতা মারব। তাহলে ঠিক হতো। এতই যদি ইজ্জতওয়ালা, তবে এখনো কেন পরিষ্কার করে না।

এরপরও এই সত্যিটা স্বীকার করেনি। ভুলটা মেনে নেয়নি। বলেনি, ও অন্যায় করেছে, ওসব বলা উচিত হয়নি। কেউ বলেনি। পুরো ফ্যামিলিটা কি তবে শিক্ষিত পশু? বই পড়েছে, পাশ করার জন্য, চাকুরি পাবার জন্য কিন্তু মানুষ হয়নি। মানুষ হবার জন্য পড়াশুনা করেনি। রাত বাড়ে। অস্থিরতা বাড়ে। নীলু চাচার কথা মনে পড়ে। চাচা এখন কি করছে? নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে নাকি আমার মতো ছটফট করছে। নীলু চাচা কি আমাকে মনে করছে নাকি চাচীকে ভাবছে, ছেলে দুইটাকে ভাবছে? চাচার চোখে কি ঐ পাকিস্তানি খানকি মাগীর ছাওয়ালটার মুখ ভাসছে? চাচা কি ঘামছে?আমার গলার নিচেও তো ঘাম?মানুষের সাথে মানুষের এত মিল কি করে হয়? চাচা তো নিঃসঙ্গ। একাই ঘুমায়। আমিও তো একা ঘুমাই। কিন্তু কেন? চাচা তো একাই খায়। আমিও তো একাই খাই। চাচা রান্না করে খায়। আমিও তো...। আর ভাবতে পারি না। আমি অনুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়ি এবং পৃথিবীর ঘুর্ণন অনুভব করি। বয়সের পুঞ্জীভূত অহংকার আমাকে তিরষ্কার করে। কখনো কুকুর, কখনো সাপ আবার কখনো ভূত আমাকে তাড়া করতে করতে মাঠের শেষপ্রান্তে নিয়ে আসে। এবার আমি বুকের কম্পন অনুভব করি। কিন্তু ঘামের কারনটা এখনো প্রকাশিত নয়। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু কাউকে দেখি না। আমি ভাবি, একটা বয়স আছে যখন চুলের কালোটা সুন্দর, আবার একটা বয়স আছে যখন চুলের সাদাটা সুন্দর। জনশূন্য পৃথিবীটাকে দেখে আমার কেবলি কবরের কথা মনে পড়ে। কবর নাকি খুব নির্জন। পৃথিবী আছে, সব বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, ইণ্ডাস্ট্রি, ক্যান্টনমেন্ট, গোলাবারুদ, যুদ্ধ, প্রেম, যৌণতা-সবই আছে কিন্তু দিন বা রাতে রাস্তা-ঘাটে মানুষ নাই। এ কেমন সিনক্রোন্ইজ, এ কেমন অভিযোজন ও ভারসাম্য? মানুষ কি খুব গৃহহীন হয়ে পড়েছিলো? এই শূন্যতা পূরনের জন্য হয়তো এমনটি প্রয়োজন ছিল? যেমন প্রয়োজন নীলু চাচা ও আমার নিঃসঙ্গতা এবং বন্ধুত্ব। পরদিন নীলু চাচার ওখানে যাই, তার পরদিন...এখন প্রতিদিন যাই। নইলে ভালো লাগে না। এর মধ্যে নীলু চাচা আমাকে তুমি বলতে শুরু করেছে, আমিও শুরু করব। সম্পর্ক তো এমনই-কেবল গহিন থেকে গহিনে নিয়ে যায়। আবার গহিনে হারিয়েও দেয়। যদিও নীলু চাচার হারানো আর আমার হারানো এক রকমের নয়। কিন্তু দু’জনেই নিঃস্ব। 

চাচা, কেমন আছো?
হ্যাঁ, বাবা। আছি।
আচ্ছা চাচা, সারাদিন তোমার কাজ করতে ভাল লাগে?
সত্যি বলতে কি, ভাল লাগে না। কিন্তু এই যে পেট দেখছো, এটার জন্যই।
এই পেটটাই কি সব খায়?
হুঁ। খায় তো।
কতটুকু খায়?
এবার চাচা জবাব দিতে পারে না। চাচার জন্য খুব কঠিন হয়ে যায়। আমি দিন দিন কেমন যেনো কঠিন হয়ে যাচ্ছি। আমি আসলে কঠিন হতে চাই না। কিন্তু কিভাবে যেনো হয়ে যাচ্ছি।
চাচা, সারাদিনে তুমি কতটাকা ইনকাম করো?
এটাও বুঝে না চাচা। মানে কতটাকা আয় করো?
এই ধরো ৩০০/৪০০ টাকা।
এখান থেকে নেতাদের দিতে হয় ১০০ টাকা আর পুলিশকে ১০০ টাকা। বাকী ১০০ টাকা দিয়ে কি খাব?
নেতা কারা?
যারা টাকা নেয়?
কেন নেয়?
নইলে এখানে বসতে দেয় না।
তাহলে ভাড়া দেন না বলেন কেন? আপনি তো ভাড়া দেন এবং তা অন্যদের চেয়ে বেশি দেন। তবে বৈধ না আপনার দেয়াটা।
কিন্তু বৈধ কিভাবে করব? 
এখানে বৈধ করা যাবে না। আপনার বসাটা আইনত বৈধ নয় এবং ঐ টাকা নেয়াটাও বৈধ নয়। আপনাকে বসতে দেয়াটা মানবিক কিন্তু পুলিশ ও নেতা নামধারী মাস্তানের টাকা নেয়াটা মানবিকও নয়, আইনসিদ্ধও নয়। পুলিশ ও নেতা অন্যায় করছেন, দণ্ডনীয় অপরাধ করছেন। কথাটা হয়ত চাচা পুরোপুরি বুঝেননি। কিন্তু তিনি বুঝেছেন, যারা টাকাটা নিচ্ছে তারা ঠিক নয়।

চাচা, মাথা নাড়ছেন। কত কষ্টের টাকা তিনি দিনের পর দিন যাদের দিচ্ছেন তারা এই টাকা দিয়ে ভাত খায় না, বিলাসিতা করে, সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আমি জানি না, এই ব্যবস্থা রোধ করা সম্ভব কি-না। এমন আইন কি করা যায় না, যাতে সম্পদ বাড়ানো বা টাকা জমানোর একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকবে। তারপর যদি কেউ সম্পদ বা টাকা জমায় তবে সেটা অটোমেটিক্যালি সরকারের কোষাগারে চলে যাবে। এর ফলে হয়তো একদিন সম্পদলোভী বা অর্থখেকোদের খাই খাই কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু এই সম্পদ বা টাকা সরকারের কোন অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক আত্মসাৎ করাও রোধ করতে হবে।

আমি যতটুকু জানি, সরকারী, বেসরকারী বা স্টাকচারড্ প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া চাকুরীর পাশাপাশি কোন ব্যবসা বা লাভজনক পেশায় জড়িত থাকতে পারবে না। থাকলে তা আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু কিছু পেশা আছে যেমন : ডাক্তার। উনারা চাকুরী করেন, আর চেম্বারে বসেন, বিভিন্ন ক্লিনিকে রাউণ্ড দেন, টেস্টের কমিশন পান, ওষুধ কোম্পানী থেকে নানা রকমের উপঢৌকন নেন। ওটা কি আইনসিদ্ধ নাকি আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে? জানি না। তবে আলোচনা, উনারা কি সার্বিক টেক্স দেন? কোন কর্মকর্তা যদি সুবিধা নেন, তা ঘুষ-তিনিও জানেন। সেটা প্রকাশ্য নয়। কিন্তু ডাক্তারদের ওটা তো প্রকাশ্য, তাই বলা। উদাহরন হিসেবে যদি বলি : বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক একাধিক ভার্সিটিতে ক্লাস নেন, নানা রকম প্রজেক্টে জড়িত।

এক আত্মীয়কে বলতে শুনেছি, উনার বোন ঘুষ খায় না-সরকারি চাকুরী করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়েন। সত্যি। কিন্তু তিনি বাসায় রঙ করেছেন। অফিস রঙ করানো হয়েছিল তাই উনি সেই রঙ, সেই মিস্ত্রি দিয়ে বাড়ী রঙ করিয়েছেন। উনার বাসায় যে গাড়ীটা আছে সেটা অফিস যাওয়া-আসার জন্য। ওটা এখন উনার বাসায়ই থাকে। উনার বাচ্চারা ব্যবহার করে, হাট-বাজার থেকে শুরু করে আত্মীয়ের বিবাহ পর্যন্ত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতেও কাজে লাগে। তেল ও গ্যাসের বিল ও ড্রাইভারের বেতন তো অফিস দেয়, শুধু ছুটির দিনের জন্য ড্রাইভারকে কিছু বক্শিস দিলেই হয়। তাছাড়া ড্রাইভারের লাভ তো আছেই। বসকে খুশি রাখা বলে কথা। অফিসের মিস্ত্রিকে ডেকে বাসার ফার্নিচার বানানোসহ নানান কাজের জন্য সামাজিক মর্যাদা উনার বৃদ্ধিই পায়। উনি কি আর বে-নামাজী কিছু করতে পারেন? এ রকম অনেককিছু আছে। চাচা সারাদিন হয় সেলাই করে, না হয় পিন ঠুকে, না হয় জুতা রঙ করে। আমিও সারাদিন লিখি আর দৌঁড়ে দৌঁড়ে বসের ধমক খাই। পার্থক্য খুব বেশি নয়। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত সারা বছর-এই রকম। এটাই চাচার অফিস, এখানেই সব। হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। আচ্ছা চাচা, টয়লেট কর কোথায়?
চাচা বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকায়। তখন আমি বুঝতে পারি নিজের ভুল। তাই সংশোধন করে আবার প্রশ্ন করি : চাচা, হাগো কোথায়?
এইবার চাচা লজ্জা পায়। কেন, তোমার চাপছে?
না চাচা। জানতে চাইলাম, এই আর কি?         
ছোটটা পেলে রাস্তার উপর সুযোগ বুঝে সেরে নিই। আর বড়টা চাপলে হাসপাতালের গার্ডদের পাঁচটা টাকা দেই। ব্যস, হয়ে যায়।
ওরা টাকা নিয়ে এটা করতে দেয়?
এ জীবন তো তাই করলাম।
যদি সে সুযোগ না দিতো, তবে?
চেপে রাখতাম। এখনও রাখি। পাঁচ টাকা কামানো তো সহজ নয়। বাধ্য হলেই করি, নইলে চেপে রাখি।
চেপে থাকা যায়? অসুখ হবে তো।
এছাড়া উপায় কি?
গোসল কোথায় করো?
ঐ...।
মানে, প্রায় করো না!
হুঁ।
কয়দিন পর পর করো?
মাসে এক কি দুইদিন।
কষ্ট হয় না? এভাবে ঘুম হয়?
চাচা চোখ মুছে। কোন জবাব দেয় না।
আমি ডাকি : চাচা, ও চাচা, কি হলো?

চাচা বলতে শুরু করলেন, সারারাত ঘুম হয় না। জেগে থাকি। আকাশ দেখি। চাঁদ-তারা দেখি। কুকুর দেখি। মাঝে মাঝে দু’চার জন মেয়ে মানুষ আমার পাশের বেঞ্চে বসে থাকে অথবা ঘোরাঘুরি করে। পুরুষ আকর্ষন করতে চায়। মাঝে মাঝে ছেলে-পুলেরা এসে গল্প করে ও নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি এসে থামে আর তারাও তুলে নিয়ে যায়। কোথায় যায় জানি না। এইসব দেখে দেখে রাত কেটে কখন যে সকাল হয়ে যায় বুঝতেই পারি না।
তখন কি মনে হয় তোমার?
কি আর মনে হবে? আগে হতো। এখন আর তেমন হয় না।
আগে কেমন হতো?
অস্থির লাগতো। ছটফট করতাম।
ইচ্ছে করতো না?
চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। সে সামর্থ্য কই? ঐসব ভাবলে টাকা লাগে।
এখন ইচ্ছে করে না?
নাহ। এখন আর আগের মতো ইচ্ছে করে না।
ওদেরকে কি খুব খারাপ ভাবো?
মোটেও না।
মোটেও না! কেন?
কেন ভাববো? কেউ টাকার জন্য ওসব করে। কেউ খাবারের জন্য করে। বেঁচে থাকার জন্য করে? কার না ইচ্ছে করে একটা সংসার? ঐ রকম সুন্দর বাড়ি গাড়ি? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কি মজা করে? এইভাবে ঝুঁকি নিতে কার ভাল লাগে? ওরা বাধ্য হয়ে করে।
তাহলে যে পুরুষ মানুষেরা আসে তাদের প্রতি ঘৃণা হয় না? খারাপ মনে হয় না?
নাহ।
ওদেরকেও খারাপ মনে হয় না?
নাহ।
ওরা তো পেটের প্রয়োজনে আসে না। ওরা তো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসে।
কোনটা খারাপ? গাড়ীওয়ালাদের কথা আমি জানি না। অন্য যারা আসে, তারা প্রয়োজনেই আসে।
প্রয়োজনে!
হ্যাঁ। একজন শ্রমিক টাকার জন্য সংসার করতে পারে না। টাকা উপার্জনের জন্য মাসের পর মাস বাড়ি যেতে পারে না। তারা কি করবে? তাদের কি প্রয়োজন নেই?
তাই বলে, এভাবে?

তাহলে কি? ওদের জন্য কোন ব্যবস্থা কি আছে? সরকারের উচিত ওদের জন্য স্বল্পমূল্যে এই ব্যবস্থা রাখা। তাতে দু’পক্ষেরই প্রয়োজন মিটতো। ক্ষুধার মতো এটাও তো একটা ক্ষুধা। খাদ্যের ক্ষুধা তো আজন্ম কিন্তু এটা তো সামান্য ক’টা বছর। এই যে আমি, আমার তো এখন প্রয়োজন খুব একটা নেই। তাছাড়া এই স্বল্প আয়ের মানুষেরা তো প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটিও পায় না। এ জন্যই তো ধর্ষণ বাড়ে। তারপর সেটা নিয়ে খবর হয়, ফাঁসি হয়। কিন্তু কেউ ভাবে না কেন ওসব হলো। যাদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এসব করে, তাদের বিচার করেন, ফাঁসি দেন। কিন্তু কে শুনবে গরীবের কথা?
চাচার আক্ষেপ ঝরে পড়ে। তখন আমার মনে হয় ঠিকই তো। ধর্ষণ প্রতিরোধ কমিটি করা হয় কিন্তু যৌণতা নিবারনের ব্যবস্থা করা হয় না। এটা কি ক্ষুধার মতো একটা ক্ষুধা নয়?এর কি কোন প্রয়োজন নেই? তবে ধর্ষণ প্রতিরোধ কমিটি না করে গরীব মানুষদের নুনু কেটে দেয়া হোক। আরো ভাল হয়, যদি সব পুরুষ মানুষদের নুনু কেটে দেয়া হয়। তাহলে আর ক্ষুধা থাকবে না, ধর্ষণ কমে যাবে, অনেক সামাজিক ও অসামাজিক সমস্যা কেটে যাবে। এত টাকা, সময় আর আইনি প্রক্রিয়ায় সময় নষ্ট করা লাগবে না। খুব সহজে পুরুষ ধরুন আর নুনু কাটুন।
তো তুমি আর বিয়ে করোনি কেন?
কি খাওয়াবো?
আগে তো বিয়ে করেছিলে।
তখন তো ক্ষুধার জ্বালা বুঝতাম না।
কেন, তখন ক্ষুধা ছিল না?
ছিল। কিন্তু তখন তো যৌণতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসলে যৌণতা এক ধরনের মানসিক হাহাকার। এ হাহাকার কখনো পেটের ক্ষুধাকেও হার মানায়।
চাচা, মানসিক কেন বললে?শারিরীক নয়?
না, মোটেও শারিরীক নয়। মন না থাকলে শরীর কোথায় থাকবে? শরীরের চালক তো ঐ মন।
আসলে এই সফট্ আলোচনাও সফট্ থাকেনি। তাই গল্পটা অন্যদিকে ঘোরাতে চাচাকে প্রশ্ন করি : চাচা আপনার কি এই কাজটা ভাল লাগে না?
চাচা হাসে। মুখে কিছু বলতে চায় না। বিড়বিড় করে বলে : তাহলে খাব কি?
হ্যাঁ, খাব কি?
খাদ্য হলো সবচেয়ে বড় এক ঘাতকের নাম। আমারও তো ঐ চাকুরি ভালো লাগে না। শুধু পেটের জন্য করি কিন্তু ফাঁকি দেই না। তবে অন্য সুযোগ থাকলে এই চাকুরী করতাম না।
চাচা হা করে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, তুমি কি জীবনানন্দের নাম শুনেছো?
নাহ।
সে কে?
সে একটা মহাপাগল।
কেন?
ঐ পাগল বলেছে, পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চাকুরি বলতে কিছু নেই। কেন বলেছে?
জানিনা।

দেখ, সারাদিন শুধু উপুর হয়ে লিখি আর অর্ডার ফলো করি। কোন স্বাধীনতা নেই। কিছু বলার নেই। ছেচল্লিশ বছর পার করলাম কিন্তু কাউকে কিছু শিখাতে পারিনি। তাহলে কি কিছুই শিখিনি? কি করেছি এই জীবনে? বয়স তো হলো, এখন দ্রুত হচ্ছে। বয়স বাড়লে সময়ের গতি বেড়ে যায়। এখনো কি সেই আগের মতো পারব? তা না হলে কি লেস কোয়ালিফাইড? তাহলে কি টিকে থাকা যাবে না দৌঁড়ে? খালি দৌঁড়?যারা এইসব দৌড়ের কথা বলে আসলে তারা ভিতরে ভিতরে খুব দুর্বল। এই দুর্বলতাকে ঢাকবার জন্যেই তারা এইসব গল্পের অবতারণা করে। আর তার সাথে কিছু অসুস্থ মানুষেরা যুক্ত হয় তাদের সহানুগামী হয়ে।

অরুন, যদি শিক্ষক হতাম-তবে তো ক্লাসে গিয়ে নিজের মতো করে পড়াতাম। মনে হতো আমিই রাজা, আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী। সেটা যে আরামের তা হয়তো নয় কিন্তু তার মধ্যে পাণ্ডিত্য থাকতো, দার্শনিকতা থাকতো, আভিজাত্য থাকতো। নিজেকে সম্রাট সম্রাট মনে হতো। যদি একজন জর্জ-কে দেখেন তো অবাক হবেন। উনি সারাদিন কথা শুনেন আর লিখেন। কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্ত দেন সেটাই চুড়ান্ত। উনাকে কেউ ধমক দেয় না। অনুরোধ করেন। উনাকে দেখলে সবাই স্ট্যান্ডিং অভিয়েশন দেন। উনি যাই করুন, উনার জগতে উনিই সম্রাট। ধরুন, প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার উপর যদিও হুকুম থাকে কিন্তু সেটার একটা সন্মানবোধ আছে, সেটার একটা মাত্রা আছে। উনাকে সবসময় চাকুরী হারানোর ভয় করতে হয় না। উনাকে রেসের ঘোড়ার মতো প্রতিযোগিতা করতে হয় না। উনার প্রতিযোগিতা সন্মানের। যাকে মৃত্যুর মতো চাকুরী থাকার ব্যাপারটাকে প্রতিনিয়ত মনে রাখতে হয় আর শিউরে উঠতে হয় ক্ষুধার কথা ভেবে সেই চাকুরিটা কি করে এক হয়? একজন রিক্সাওয়ালাকে যদি গবেষণার টেবিলে বসিয়ে দেয়া হয় আর একজন গবেষককে যদি রিক্সার ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দেয়া হয়, তবে তো দু’জনেই নন-পারফর্মিং হবে। এটা কি সঠিক টেস্ট? যাকে তার স্থানে রেখেই টেস্ট করতে হবে।

একজন রিক্সাচালকেরও স্বাধীনতা আছে ওদিকে যাব না, এত না হলে যাব না কিন্তু আমাদের এই সুযোগ নেই। একদিন কাজে যাবে না, এটা একজন দিনমজুরও বলতে পারেন কিন্তু আমরা বলতে পারি না। তর্ক করলে একজন রিক্সাচালকের চাকুরি যায় না কিন্তু আমাদের যায়। তাহলে কি আমরা একজন রিক্সাওয়ালার চেয়েও অধম নই? একে কি চাকুরি বলে। মেয়েকে পড়াচ্ছিলাম, act মানে কাজ। তাহলে Work মানে কি? ওকে কোনভাবে বুঝাতে না পেরে পরে বলেছি, act মানে বড়দের কাজ আর Work মানে নিম্ন শ্রেণির মানুষদের কাজ।
তখন ওর প্রশ্ন : তুমি কি act নাকি Work?
আমি যখন বাগানে কাজ করি তখন Work আর যখন টেবিলে বসে কাজ করি তখন act
ছুটির তালিকা আছে কিন্তু ছুটি মিলে না। আরো কত অনিয়ম। নতুনরূপে কৃতদাসপ্রথা। পুঁজিবাদী বা ধনবাদী সমাজব্যবস্থায় কৃতদাস সৃষ্টি করা একটা প্রবল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কতবছর ধরে চলবে প্রতিবাদবিহীন? এমন অনেক কথাই আছে। আমি জীবনানন্দের ঐ কথার সাথে একমত নই। উনি থাকলে শুধু এই কারনেই উনার সাথে আমার বাদানুবাদ হতে পারতো। আমি যুক্তি দিতাম, প্রমাণ চাইতাম। সংশোধন করতে বলতাম। আমি জানি, অনেকে এতে উত্তেজিত হতে পারেন। হলে হোন, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমি স্বাধীনতার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছি। আমি আমার মতো করে বলব, যুক্তি দিয়ে বলব। কেউ শুনলে শুনবে, না শুনলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আমি কারো প্রফেশনকে ছোট করিনি, বরং সঠিক বিচার-ই করেছি।

প্রতিদিন চাচার ঐ বাক্সের উপর বসে থাকি অনেক রাত পর্যন্ত। আর কথা বলি চাচার সাথে। কোন ক্রেতা এলে চুপ করে থাকি।
একজন ভদ্রলোক এসে পা বাড়িয়ে দিয়ে বলল : নে, জুতাটা কালি করে দে। ভাল করে করবি। আগে ভাল করে পরিষ্কার করে নে। চাচা পা থেকে জুতাটা খুলে নেন এবং সাধ্যমত পরিষ্কার করে। তারপর পরম মমতায় রঙ করেন। কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে জুতা পলিশ করেন। কিন্তু লোকটা সারাক্ষন ঘ্যাঁনঘ্যাঁন করতে থাকেন। এটা হয়নি, ওটা হয়নি, সেটা হয়নি। তারপর শুরু হলো দামাদামি। এত কেন? ভাল হয়নি কেন এত দেবো ইত্যাদি। পুরাতন জুতা কতটা চকচক করবে? তাছাড়া সকল জুতায় তো চকচকেও হয় না। অনেক কষ্টে বিদেয় হলো। একজন ছাত্রী মতো মেয়ে এলো জুতার শুকতলী খুলে যাওয়ার কারনে। একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন, তার কাজ শেষ হলে ২০ টি টাকা বের করতে কমপক্ষে ৫ মিনিট সময় নিলো। তারপর সেই টাকার ভাঁজ খুলতে আরো ২ মিনিট সময় নিলো। সব মেয়েরাই কি ওভাবে ভাঁজ করে টাকা রাখে? লুনা রাখে। আমার লুনার কথা মনে পড়ে। একজন চুল কোঁকড়ানো ছাত্র এলো, একজন হিজড়া এলো। সেও জুতার সেলাই করালো। চলে যাচ্ছে দেখে ডেকে চাচা যখন বলল : দে।
কি দেবো?চাচা হাত পেতে আছেন।
হিজড়েটা গান শুরু করল :
‘কি চাস বল
পলিথিনের নিচে চল’-বলে সে হাত চাপড়ে কোমর দুলিয়ে চারিপাশ ঘুরছিলো আর গান করছিলো।
তারপর আমাকে চেপে ধরে শুরু করল :ঐ নাগর দে না, দে।’
এই ছাড়ো।
ওরে সোনা ছাড়বো না। চল, মন ভরে দেবো। চল, আজ তরে নিয়ে যাব।
চাচা রেগে বলছে, ঐ আমেনা ছাড় ওনাকে। চিনিস কত বড় মানুষ?
সেই জন্যই তো চাই। কতদিন বড় মানুষ পাই না।
যা তুই। বিরক্ত করিস না। তোর টাকা লাগবো না।
হিজড়েটা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কানে ভাসে ঐ একটি কথা : কতদিন বড় মানুষ পাই না। ওরাও কি বড় মানুষ পায়? ওরা কারা? আমাকে কতটা বড় ভেবেছে?
তারপর একজন সুন্দরী মহিলা পা বড়িয়ে দিয়ে বললেন : এই বুড়ো, জুতাটা ভাল করে রঙ করে দে। তাড়াতাড়ি করিস। ওখানে দুটো পিনও লাগিয়ে দিস। চাচা জুতা খুলতে গেলে পায়ে একটু হাত লেগে যাওয়ায় ঠাস করে থাপ্পর মারে। বলে, পায়ে হাত দিলি কেন?
মা গো, হাত দিইনি। লেগে গেছে।
ও, মেয়ে মানুষ দেখলে হাত লেগে যায়। তাই না?
মা গো মাফ করে দাও।

বয়স আর কত হবে? মনে হয় ২৩/২৪ বছর। যথেষ্ট সুন্দরী। পছন্দ করার মতো সুন্দরী। শিক্ষিতও মনে হয়। কিন্তু বাবার বয়সী একজন মানুষকে যখন তুই বলে সম্বোধন করছে তখন তাকে আর সুন্দরী লাগছে না। পিপিলিকা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই পাখাটা খুব শীঘ্রই খসে পড়বে। জুতা খুলতে গেলে পায়ে একটু হাত লাগতে পারে না। পায়েই তো লেগেছে। বুকে তো লাগেনি। কিন্তু বুকের থলথলে ছড়িয়ে যে হাজার জনকে দেখাচ্ছেন, তাতে কিছু হয় না? কি আর হয়েছে তাতে? তোমার মতো অনেকেই তো আজকাল বন্ধুদের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে, অনেকে কোলাকুলি করে, চুমু খায়-তাতে কিছু হয় না? এই চাচা যদি ইচ্ছে করেও করে থাকে, তার কি আর কোন সাহস হবে? সে কি পারবে পা থেকে অন্য কোথাও পৌঁছাতে? এরপর একজন মাস্তান মতো লোক এলো। টাকা চাইলে রঙের কৌটায় লাথি মারে। টাকা না দিয়েই চলে যায়। একজন দারোয়ান আসে, টাকা দেয় না। একজন পুলিশ কন্সস্টেবল আসে, সেও টাকা দেয় না। এভাবেই চাচার দিন-রাত চলে।   
অনেক কাস্টমার আসে। কেউ কেউ আবার আমার দিকে কট্মট্ করে তাকায়। মনে করে ফালতু একটা লোক শুধুমাত্র ডিসটার্ব করার জন্য বসে থাকে। ওর কি কোন কাজ নেই। ভাগ্যিস কোন যুবক বা যুবতী এসে যদি বলত : কে আপনি? এখানে সারাক্ষণ বসে কি করেন? আর কোন কাজ নেই?
কি জবাব দিতাম? কিন্তু তেমনটি এখনো ঘটে নাই।

প্রতিদিন বসে থাকি। গল্প করি, চা খাই। এতে আমার কোন অসুবিধা নেই। চাচা মুচি, মেথর, চণ্ডাল হলেও সমস্যা হতো না। উনি তো মানুষ, আবার আমার সাথে অনেক মিল। আমাদের মখমখে ঢাকা জীবনের অনেক মানুষের চেয়ে উনি মহান। আমাদের এই সমাজের জন্য উনার অনেক অবদান কিন্তু উনার জন্য আমাদের কোন অবদান নেই। উনি আমার চোখে মহান। তবে কেন বন্ধুত্ব হবে না? জীবনানন্দ, এটা কি বিশুদ্ধ কাজ বা পেশা? তাহলে কাজের জবাবে মূল্য ছাড়া এসব কি পাচ্ছেন? কাজের বিনিময়ে তো মানুষ বেতন পায়, আরো অন্যকিছু করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। কেন করে? ওটা কি বিশুদ্ধ? অনেকের কাজটা এমন যাতনার নয়, কিন্তু তিনি মানসিকভাবে যাতনাবোধ করেন। আমি সেইসব শৌখিন মানুষদের কথা বলছি না। জীবনানন্দ এখন থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেতো। চাচার চোখে জল। টাকার জন্য নাকি অপমানের জন্য? আমার এই কষ্টটা বুকের গহীনে কোথায় যেনো টুং টাং বেজে উঠলো। আমারও তো টাকা নাই। তবে কি আমিও কাঁদব? কিন্তু আমার চোখ তো কাঁদে না, কাঁদে বুক। বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য কেউ। কেউ ওকে চিনে না। ও বুকের ভেতর থেকে বের হয় না কখনো। আমি তাকে বের করতে চাই, দেখাতে চাই। চাই সবার মতো চোখ থেকে কান্না।

চাচার বয়স কত? উনি কি জানেন? আর কতদিন উনি বাঁচবেন? আমার বয়সগুলো চোখের সামনে চলে আসে। আমিও কি তবে চলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নেবো? আমিও তো এই রকম চর-থাপ্পর, ধমক খেয়ে বেঁচে আছি। আমার অফিস নেই, ঘর নেই, সম্পর্ক নেই, সামনে বা পেছনে কেউ নেই। আমি বড্ড একা। এই একাকীত্ব এক দিনে তৈরি হয়নি। এই যন্ত্রণা একদিনে তৈরি হয়নি? নীলু চাচা, আমি ও আমরা এভাবে বেঁচে আছি। এভাবে মলিন হয়ে যাচ্ছে আমাদের দিনগুলো, স্বপ্নগুলো। আমাদের কর্ম অনিশ্চিত, আমাদের মৌলিকতা অনিশ্চিত, আমাদের বাড়ি-ঘর অনিশ্চিত, এই নিঃশ্বাসগুলো অনিশ্চিত, আমাদের বিদায় চরম অনিশ্চয়তায় ভরা। আমি ভয় পাই, ভীতু হই, ঝরা পাতাদের মতো উড়তে থাকি। চাচা মাথা নিচু করে বুকের ভেতর জমাচ্ছেন যে কষ্টের পাহাড়, তারা একদিন টুক করে তাকে নিয়ে যাবে? আমাকেও কি তাই? কোথায় যাব? আাজ আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আমার যদি ঐ রকম একটা স্বাধীন পলিথিন ঘর থাকতো।  

লুনার কাছে আমার কোন জ্ঞান নেই, কিছু বুঝি না। আমার বইগুলো অপ্রয়োজনীয়। আমার চাঁদ দেখা প্রয়োজনীয়, লেখা অপ্রয়োজনীয়, বৃষ্টিতে ভেজা অপ্রয়োজনীয়। এত বইয়ের কি দরকার? এ গুলো বিক্রি করা দরকার। আমি একটা চাষা, নইলে কি একজন মুচীর দোকানে বসে থাকি? ওখানে বসে চা খাই? মনের দিক থেকে আমি হয়তো কখনো বড় হতে পারব না। চাষা থেকে বের হতে পারব না।  
অনেক রাতে ঘরে আসি আর সাক্ষাত জল্লাদের মুখোমুখি হই। প্রতিদিন মৃত্যু হয়। কিন্তু ঘুমের মাঝে জেগে উঠি। বিশাল বিশাল মাঠের মধ্যে ঘোরে বেড়াই। বাবা আসেন, আমি যাই-মা’কে কখনো নিতে চাই না। কেন নেবো? উনার কি সময় হয়েছে নাকি ওখানে যাওয়ার? পৃথিবীতে যতদিন কোন মানুষকে অন্তত একজন মানুষ ভালোবাসে, তার মৃত্যু হয় না। হতে নেই। নাক-ডাকার অসহায়ত্বে প্রতিদিন একবার করে হলেও শিখতে হয় বেঁচে থাকার অঙ্ক। যেখানে সমস্যা কাটানো কোনভাবেই সম্ভব হয় না, চাচার মুখোমুখি হই। দু’জনে মিলে ভাগাভাগি করে নেই বেঁচে থাকার কাব্যিকতা। সকলে মিলে একমত হয়, বিহিত একটা করতেই হবে কোথায় যায় প্রতিদিন। এতদিন আমি বলিনি। অনেকবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। আজ যে অন্যসভা। অনেকের মুখোমুখি হয়েছি। কেউ একজন গুণ্ডামতো জিজ্ঞেস করলো : কোথায় যাওয়া হয়?
জানি না।
কোথায় থাকা হয়?
কেমন করে জানব?
লুনা বলে : একটা থাপ্পর দিয়ে জিজ্ঞেস কর, কোথায় ও কার সাথে কাটায় এতটা সময়?
আপা, চুপ করো। আমাকে হ্যাণ্ডেল করতে দাও।
সত্য না বললে ঘর থেকে বের করে দেবো।

বুকের মাঝে ধপাস করে ওঠে। এরা কারা? এভাবে মানুষ মানুষের সাথে কথা বলতে পারে? আমার অফিসের চেয়ে কম যায় না। আমি বুঝতে পারি না, কি জবাব দেবো? এসব প্রশ্নের কি জবাব হয়? আমি পড়ার ঘরের দিকে যেতে চাইলে আটকে দেয়। ওখানে যেনো বোমা বানানোর গোপন ফর্মূলা আছে। আমি যেনো সারারাত ওখানে বসে বিশ্বের সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি। আর যুদ্ধবিমান, ড্রোন, আনবিক চুল্লীর সমস্ত ফর্মূলা আমিই আবিস্কার করি। সকলে মিলে পড়ার ঘরটার প্রতি এমন বিশোদগার করতে থাকলো। অবশেষে আমি বললাম : নীলু চাচার দোকানে।
এই, কোন নীলু চাচা?
জানিস, গলির মাথায় ঐ চোরাস্তার মুচির দোকানে।
বলিস কি আপা?   
সর্বনাশ! যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই।
এই কি ভেবেছিলি? এই জন্যেই তোকে ডেকেছি। আমি জানি তুই-ই ঘাড়ে দু’টা লাগায়ে কথা বের করতে পারবি। কিন্তু কি করে ওখানে? এত পড়াশুনা করে মাথাটা গেলো নাকি?
সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলো। তারপর ভাই-বোনের কি সব কথাবার্তা হলো, বুঝতে পারিনি। লুনা এসে বললো : ৫০০ টাকা দাও। ছেলেগুলো, কত জরুরী কাজ ফেলে এসেছে। ওরা তো গাড়ি ভাড়া ও চা কফি কিছু খাবে। লাগবে না?
হ্যাঁ, নাও।

পরদিন ওরা গিয়ে নীলু চাচার দোকানে হামলা করলো। কিন্তু কি ভাঙচুর করবে? চাচার গায়ে হাত-ও দিয়েছে। চাচা আর কাজ করতে পারেনি। গায়ে জ্বর নিয়ে পলিথিনের নিচে চাচা শুয়ে জীবনের গণিত শিখছেন আর জীবনানন্দের কথাই ভাবছেন। আমি চাচাকে না পেয়ে অনেক খুঁজে পলিথিনের নিচে আবিস্কার করি। চাচা কাঁপছেন। আমাকে আর বসতে দিতে চান না। বার বার বলছেন : তুমি চলে যাও। তুমি অনেক বড় মানুষ। আমি না বুঝে ভুল করেছি। তুমি চলে যাও।

চাচার কথাগুলো কানে নিয়ে আমি পথ চলতে থাকি। পা এগোয় না। ভারী হয়ে আসে। আমরা বড় মানুষ! কী দিয়ে মানুষ বড় হয়? সবকিছুই তো চাচার সাথে মিলে যায়। আমি আকাশের দিকে তাকাই। দেখি চাচাও একজন নক্ষত্র হয়ে নিজের গতিপথে চলছে। আমি মাথা নত করতে পারি না। টলতে থাকি।

 
শামীম রফিক
১৩.০৪.২০২০ 

1 টি মন্তব্য: