কালিক

ফয়সাল রকি

মতিন মিয়া দেখলো মাঝবয়সী শীর্ণ মহিলাটি এখনো মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। এক হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে মুখ চেপে ধরে রেখেছে, আরেক হাতে একটা প্লাস্টিকের কোকের বোতল। কাঁদছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অপ্রয়োজনে কান্নাকাটি মতিন মিয়া পছন্দ করে না, সে বললো, টাকা কম দিবা চাহিলে তো ভক্তি আইসিবে না। ভক্তি না আইসিলে কি কাম হবে?
মহিলা বললো, হামরা গরীব মানুষ, হামার তো টাকা বেশি নাই। কী করিমো? অনেক দূর থাকি আইচ্ছি, তোহমরা হামাক উদ্ধার করেন।

মতিন মিয়া আশেপাশে তাকায়। মহিলার সাথে দশ-বারো বছর বয়সী একটি বালক এসেছে। সে মহিলার শাড়ির একটি অংশ চেপে ধরে আছে। এই ছেলেটি কি রোগী? হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সে বললো, রুগি কায়? কার তানে পানি নিবেন?

মহিলা ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন, মোর ছোয়া। ছোট থাকিতেই ডাইন পায়োত সমিস্যা। ঠিক করি হাঁটিবা পারে না। বাউ এংনা হাটি দেখা তো।

বালকটি উঠে দাঁড়ায়। হাঁটার কোনো লক্ষণ ওর মধ্যে নেই। মহিলাটি আবার বলে, বাউ হাঁটিন না কেনে? হাঁটেক।

বালকটি এবার দশ বারো কদম হেঁটে দেখালো। ডান পা বাম পায়ের তুলনায় একটু ছোট। সঠিক সময়ে পোলিও-এর টিকা না দেওয়ার ফল। মতিন মিয়া বালক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। খানিকক্ষণ আগে মহিলার দেয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা এখনো ওর হাতে ধরা। সে একবার টাকার দিকে তাকায়, তারপর মহিলার দিকে তাকায়। হতদরিদ্র এই মহিলা ছেলের চিকিৎসার জন্য এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু সকাল থেকে আজ ব্যবসা মন্দা। সূর্য মাথার উপর উঠার অপেক্ষা অথচ এই মহিলা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কাজেই মতিন মিয়া দ্বিধান্বিত হয়। তবে এক বোতল পুকুরের পানির দাম পঞ্চাশ টাকা নেহাত মন্দও নয়।

গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার কাসেম নগরে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান সাহেব মতিন মিয়াকে ডেকে পাঠান। চেয়ারম্যান বাড়ির বৈঠকখানায় পৌঁছালে তিনি মতিন মিয়াকে পুকুর পাড়ের জোড়া নারিকেল গাছ কাটার দায়িত্ব দেন। পাড়ের মাটি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গাছ দুটো প্রায় পানির কাছাকাছি চলে এসেছে। এ অবস্থায় হয় গাছ কেটে ফেলতে হবে নতুবা পুকুরের পাড় বাঁধাতে হবে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ফলন হয় না এমন গাছ থোয়ার দরকার কী? নাকি মতিন মিয়া?

মতিন মিয়া বলে, জ্বে চাচা। তোহমরা ঠিকই কইছেন। গাছ দুইটা আরো আগোত কাটা দরকার আছিল।
চেয়ারম্যান করিম সরকার মুচকি হাসেন। বলেন, তাইলে কাইল সকালেই কাজ শুরু করি দাও।
- জ্বে চাচা।
- দেলোয়ার, মতিনের যা খরচাপাতি লাগে হিসাব করি দিও।
চেয়ারম্যান সাহেবের ডানহাত দেলোয়ার হোসেন মাথা নাড়ে। মতিন মিয়া বিদায় হয়।

পরদিন সকালে তিনজন কাঠুরে নিয়ে সে হাজির হয় পুকুর পাড়ে। গ্রামের মাঝবরাবর আড়াআড়িভাবে যে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে, তার থেকে সামান্য দূরে চেয়ারম্যান সাহেবের পুকুর। দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে জোড়া নারিকেল গাছ। মতিন মিয়া কাঠুরেদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশে প্রায় শতবর্শী আম গাছের মোটা শেকড়ে বসে বিড়ি জ্বালায়। কাঠুরেরা দড়ি দিয়ে নারিকেল গাছ দুটোকে বাঁধে যেন কাটার পর পুকুরে না-পড়ে। এরপর ওদের একজন অপেক্ষাকৃত বড়ো গাছে একটা কোপ দেয়। দ্বিতীয়জন ঐ গাছে আরেকটা কোপ দেয়ার সাথে সাথেই ঘটে- অলৌকিক ঘটনা! গাছ দুটো পুকুরের পাড় থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে প্রায় পনের ফুট ভেতরে চলে যায়। কাঠুরেরা ব্যাপারটা বুঝতে মিনিট খানেক সময় নেয়। এরপর তারা ভয়ে পেয়ে ছুটে আসে মতিন মিয়ার কাছে। একজন দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করে। মতিন মিয়াও দূর থেকে ঘটনাটা দেখে। সে বিড়ি টানা ভুলে যায়, ফলে বিড়ি পুড়ে ওর হাতের আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগে। ইতিমধ্যে যে কাঠুরে গাছে প্রথম কোপ দিয়েছিল সে পালিয়ে গেছে। মতিন মিয়া বলে, আল্লাহর কুদরত দেখিছো মিয়ারা। আল্লাহ খোদার নাম নেও।

সে বাকি দুইজনকে নিয়ে আবার পুকুর পাড়ে যায়। দেখে, গাছ দুটো পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেছে। সেখানেও বহাল তবিয়তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাথায় কোনোভাবেই এর ব্যাখ্যা আসে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামবাসী জমায়েত শুরু করে। নিজের চোখে না দেখলে এরকম ঘটনা কেউ বিশ্বাস করে না। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু পুকুরের মাঝখানে গাছ দুটোকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ অবিশ্বাসও করতে পারছে না। মতিন মিয়া গল্প বানাতে শুরু করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ওর কথা তো সহজে কেউ ফেলতে পারে না। ওর মূল বক্তব্য হলো, গাছ দুটোতে নিশ্চয় আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে তা না হলে ওদের কাটতে গেলে ওরা জীবন বাঁচাতে পুকুরের মধ্যখানে হেঁটে যাবে কেন? এরকম গাছ একশো বছরে একবার জন্মায়।
খবর পেয়ে দেলোয়ার হোসেন আসে। গাছ দেখে মতিন মিয়াকে বলে, মতিন গাছ তো কাটিবা পাইললু নাই, তোর টাকা তো গেইল!

মতিন মিয়া এই ব্যাপারটা নিয়ে তখনো ভাবার সুযোগ পায়নি। দেলোয়ার হোসেনের কথা শুনে ওর মনে হলো, সত্যিই বুঝি আর টাকাটা পাওয়া হলো না। কিন্তু সে কিছু বলে না। মনে মনে ফন্দি আঁটে, চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে আর্জি জানানোর।

কিছুক্ষণ পর কাসেম নগর জুনিয়র হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক মোজাম্মেল হক আসেন। তিনিও যার পর নাই অবাক হন, কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। তিনি বিশ্বাস করেন এ ঘটনার নিশ্চয় একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।

অলৌকিক ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আশে পাশের দুই তিন গ্রাম থেকে মানুষজন গাছ দেখতে আসে। মতিন মিয়া ঘটনায় আরো রং চড়াতে থাকে। ওর কাছে এটা একটা সুযোগ মনে হয়। সে পাশের গ্রামের রহমত আলীর সাথে একটা গোপন চুক্তি করে।

পরদিন জানা যায়, পাশের গ্রামের রহমত আলী গতদিন পুকুরের পানি নিয়ে গিয়েছিল। ওর পরিবার কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিল, কোনোভাবেই জ্বর কমানো যাচ্ছিলো না। মাগরিবের নামাযের পর দরুদে শেফা তিন বার পাঠ করে এই পানি পান করেছিল। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে গাছের কিংবা পুকুরের পানির অলৌকিক ক্ষমতার কথা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজনের ভীড় বেড়ে যায়। তখন মতিন মিয়া পুকুরের পানি বন্টনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। দূর দুরান্ত থেকে যারা পানি সংগ্রহ করতে আসছে তাদের মধ্যে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় তাই এই ব্যবস্থা। তবে গ্রামের বাইরের যারা আসছে তাদের কাছে থেকে সে কিছু দক্ষিণা আদায় করে।

তবে এরমাঝেই একদিন শহর থেকে দুই জন সাংবাদিক আসে। মতিন মিয়া দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা শরীর এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়। এমন সময় সাংবাদিক আসার খবর শুনে তড়িঘড়ি করে ছোটে পুকুর পাড়ে। ততক্ষণে সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হয়ে গেছে। শহর থেকে দুইজন সাংবাদিক এসেছে, তাদের একজন প্রশ্ন করছে এবং আরেকজন মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও করছে। পাঞ্জাবী-টুপি পড়া একজন মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। সে অলৌকিক ঘটনার খুব সুন্দর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে- গাছের তো হাতও নাই পাও নাই। গাছ তো আর নিজে নিজে চলে যেতে পারে না, অবশ্যই ওপরওয়ালার ইশারা আছে। তাঁর ইশারা ছাড়া এমন ঘটনা কখনোই ঘটতে পারে না। খুবই পবিত্র একটা বিষয়।

মতিন মিয়া এসব শুনতে শুনতে খুবই আনন্দিত হয়। সাধারণ মানুষ যদি এমন ভাবে তাহলে ওর জন্য খুব সুবিধা হয়। কিন্তু লোকটাকে সে ঠিক চিনতে পারলো না, সম্ভবত অন্য গ্রাম থেকে এসেছে।
ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন মতিন মিয়ার উপস্থিতির কথা জানায়। আরো জানায় যে, সে গাছ হেঁটে যাবার প্রত্যক্ষদর্শী। এতে মতিন মিয়ার বুক সামান্য ফুলে উঠে । সাংবাদিকরা দ্রুততার সাথে চলমান সাক্ষ্যাৎকার শেষ করে মতিন মিয়ার দিকে নজর দেয়। প্রশ্নের সাথে চলতে থাকে ক্যামেরাও।
- আপনার নাম?
- জ্বে মতিন মিয়া।
- আপনি কি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী? মানে আপনি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন?
- জ্বে। খুবই আইশ্চর্য্য ঘটনা। হামরা আইচ্ছেনো গাছ দুইখান কাটিবা। ঐ দক্ষিণ পাড়োত আছিল জুড়া নারিকেল গাছ। তিনজন কাঠুরে আইচ্ছে। গাছোত রশি বানধিছে। একজন খালি গাছোত একখান কোপ দিল, সাথ সাথ জুড়া গাছ পানিত হাঁটা দিল, একবারে পুস্করুনির ভিতরত। কেমন করি খাড়াই আছে দেখেন। গাছ তো পড়িও যাবা পাইত্তো কিন্তু পড়ে নাই।
- রশি দিয়ে বাঁধা হলো কেন? যাতে পুকুরের পানিতে না পড়ে সেজন্য?
- এইখান হইল গাছকাটার কায়দা। রশি বাঁনধিবা হয়।
- আচ্ছা, গাছে কোপ দেয়ার সাথে সাথে গাছ গভীর পানির দিকে হেঁটে চলে গেল?
- গাছের তো আর পা নাই। মানুষের মতোন হাটি যাবা পারে না। আস্তে আস্তে নামভি গেইছে।
- আপনি নিজের চোখে এই ঘটনা দেখেছেন বলছেন?
- জ্বে নিজ চোক্ষে দেখিছু। জীবন বাঁচেবার তানে গাছ দুইখান পালে গেইল। আল্লাহ চাইলে গাছের কুনো ক্ষতি হবে নাহায়।
- মানে গাছের জীবন আছে। আর আল্লাহ চাইলে গাছকে যতদিন খুশি ততদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। তাই তো?
- জ্বে। সবই তাঁর ইচ্ছা।
- আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন যে, এটা একটা অলৌকিক ঘটনা?
- জ্বে অবশ্যি বিশ্বাস করি। সবায় বিশ্বাস করে। অনেক দূর দুরান্ত থাকি মা-বহিন আসেছে, বোতল ভরি পানি নিয়া যাছে।
- কেন? পানি নিয়ে যাচ্ছে কেন?
- এই পুস্করুনির পানি হইল পবিত্র পানি। এই পানি খাইলে কঠিন ব্যাধী সাড়ে।
- তাই নাকি?
- জ্বে, মাইনষে তো মানেছে।
- আপনি বিশ্বাস করেন?
- এমন আইশ্চর্য্য ঘটনা বিশ্বাস না করি উপায় আছে?
- আমরা শুনেছি এই পুকুরের পানি নাকি বিক্রি হচ্ছে? 
মতিন মিয়া আমতা আমতা করে। সাংবাদিকরা এই খবর পেল কিভাবে সে বুঝতে পারছে না। বললো, এমন কুনো সম্বাদ নাই।
- আমরা অবশ্য পানি বিক্রির খবর নিয়েই এসেছি। যাকগে, পুকুরের মালিক কে?
- হামার চেয়ারম্যান সাব।
- চেয়ারম্যান করিম সরকার?
- জ্বে। খুবে ভালো মানুষ।

- উনি কি পানি বিক্রির টাকার ভাগ নেন?
মতিন মিয়া সাংবাদিকের প্রশ্ন বুঝতে পারলো না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। সাংবাদিক আবার জিজ্ঞেস করলো, চেয়ারম্যান সাহেব কি পুকুরের পানি বিক্রি করা টাকার ভাগ নেন?
ওকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো না। তার আগেই বিএসসি শিক্ষক মোজাম্মেল হককে দেখা গেল পুকুর পাড়ে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, কোন পত্রিকার লোক আপনারা?

সাংবাদিকরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। পত্রিকার নাম বললো।
তিনি বললেন, আপনারা অলৌকিক ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে এসেছেন তাই তো? এটা আসলে অলৌকিক কোনো ঘটনা না। আমি এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারি।

যে সাংবাদিক এতক্ষণ মতিন মিয়াকে প্রশ্ন করছিল সে বললো, আপনি বলছেন- এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা না?
- অবশ্যই না।
- আপনার পরিচয়?
- আমার নাম মোজাম্মেল হক, আমি কাসেম নগর জুনিয়র হাইস্কুলের বিএসসি শিক্ষক।
- স্যার, আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো, আমরা একজন বিজ্ঞানের মানুষ খুঁজছিলাম। সবাই বলছে এটা অলৌকিক ঘটনা কিন্তু আপনি তা মানছেন না। তাহলে আপনি এটাকে কিভাবে দেখেন?
- খুব একটা কঠিন বিষয় না। গাছ দুটো হলো নারিকেল গাছ। নারিকেল গাছের মূল হলো গুচ্ছ মূল, একটা আরেকটা ভেতরে ঢুকে থাকে। গুচছ মূলের ক্ষেত্রে কাণ্ডের নীচে একগুচ্ছ সরু মূল থাকে যা মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। আরেকটা বিষয় হলো, এই পুকুরে মাছ চাষ করা হয়। যখন মাছের জন্য খাবার দেয়া হয় তখন মাছেরা পুকুরময় ঘুুরে বেড়ায়। মাছেরা পাড়ের গাছগুলোর শিকড়ের কাছাকাছি যায়, অনেক সময় শিকড়ের সাথে ঘষাঘষি করে করে এতে ভেতরের মাটি আলগা হয়ে যায়। আর ঐ যে পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন, পাড়ের মাটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় পাড়ে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গাছের নীচের মাটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে। তারপর যখন গাছ কাটার জন্য কোপ দিয়েছে তখন পুকুরের ঢাল বেয়ে গাছ দুটো নীচের দিকে চলে গেছে।

- কিন্তু গাছ দুইটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কেন?
- এজন্য নারিকেল গাছের পাতাগুলো দায়ী। নারিকেল গাছের পাতাগুলো যেভাবে চারদিকে ছড়িয়ে আছে তাতে একটা ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। আর কাজেই গাছ দুটো পড়ে না গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
- আপনার কথা মানলাম। কিন্তু আমরা দেখছি যে অনেক লম্বা দুইটা গাছ পুকুরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। যখন গাছ দুইটা নেমে গেছে তখন কিভাবে ভারসাম্য বজায় থাকলো?
- গাছ দুটো লম্বা হলেও ভরকেন্দ্র কিন্তু নীচে, মাটিতে। গুচ্ছমূলের কারণে আর সম্ভবত গাছ দুটো দীর্ঘদিন পাশাপাশি থাকার কারণে ওদের মূলদ্বয়ের মধ্যে কোনো একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে যার কারণে ভরকেন্দ্র আরো শক্তি পেয়েছে। যদি ভরকেন্দ্র ঠিক না থাকতো তাহলে যেকোনো গাছ যেকোনো দিকে হেলে যেতে পারতো।
- চমৎকার একটা বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।

সাংবাদিক দ্রুতই মোজাম্মেল হকের সাক্ষ্যাৎকার শেষ করে অন্য দিকে ঘুরে গেল। সে সম্ভবত মতিন মিয়াকে খুঁজলো কিন্তু আশেপাশে না পেয়ে অন্য আরেকজনের সাক্ষ্যাৎকার নেয়া শুরু করলো। তারা বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো ব্যাখ্যা চায় না, তারা চায় কেবল রগরগে খবর। যাই হোক, এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রচুর লোকজন আসা শুরু করলো। ফলে মতিন মিয়ার পকেটও ভারী হতে থাকলো। মতিন মিয়া মনে করে, ওপরওয়ালা স্বয়ং তাকে এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কারণ ওর ঘরে আট মাসের গর্ভবতী বউ রয়েছে অথচ কাজকর্মের স্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত নেই। এমন অবস্থায় রুজি রোজগারের মালিক তিনিই। তবে গতকাল থেকে ব্যবসায় খানিকটা ভাটা পড়তে শুরু করেছে। 

আম গাছের ছায়ায় বসে আরেকটা বিড়ি জ্বালায় মতিন মিয়া। এই মহিলা বোধহয় আর বেশি টাকা দিতে পারবে না। বিড়িটা শেষ করে পানি দেবে বলে মনস্থ করে ঠিক তখনি দেখতে পায় ওর বউ রমিলা এই পথেই আসছে। রমিলা আসার আগেই মহিলাকে বিদায় করা দরকার। বোতলের জন্য মহিলার দিকে হাত বাড়ায়। মতিন মিয়া যে হঠাৎ রাজি হয়ে যাবে মহিলা তা বুঝতে পারলো না। বললো, আর তো টাকা দিবা পারিম নাই!
- মুই টাকা চাও নাই। বোতল দেও।

মতিন মিয়া প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে পুকুর ঘাটে গেল। তারপর কিছু একটা দোয়া পড়ে বোতলে পানি ভরলো। আম গাছতলায় ফিরে এসে দেখে রমিলা চলে এসেছে। সে বোতলটা মহিলার হাতে দিয়ে পানি খাবার নিয়ম বর্ণনা করতে থাকে। মহিলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, দাদা, হামরা তো মুসলিম নহাই, হিন্দু। মগরিবের নমায কেংকরি পড়িমো?

মতিন মিয়া আবারো দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। রমিলা খুব সাবধানে মুখ টিপে হাসে। মতিন মিয়া বললো, মুশকিল হই গেইল। তোমহার কায়দা কানুন তো মুই জানো না।
মহিলা বললো, কায়দা কানুন জানিবা নাগিবে নাহায়। তোহমরা মোর বড়ো উপকার কইরলেন। যাই গো দাদা।

মতিন মিয়া ওদের চলে যাওয়া দেখে। তারপর রমিলার দিকে নজর দেয়। বললো, তোক না কইছু- ঘর থাকি বাহির হবু নাই!
- ঘরোত নুন নাই। নুন নাগিবে।
- সেইটা তো মুবাইলত কহিলেও হয়।
- হয়। কয়দিন ধরি ঘর থাকি বাহির হও না, আতাং পাতাং নাগে।
- হুম, এলা ঘরোত যা, নুন নিয়া আইসিম।
- হেন্দু বেটি কয় টাকা দিল?
মতিন মিয়া আমতা আমতা করে। বললো, টাকা দিবে কেনে? পানি নিবা আইচ্ছ, পানি দিছু।
রমিলা আবারো হাসলো। বললো, মোক এক শিশি পানি দিবেন?
- তুই পানি দিয়া কী করিবু?
- মাগরিবের নমায পড়ি পানি খাম।
- কী রোগ হইছে তোর?
- পায়োত পানি আইচ্ছে। এই যে-
রমিলা পায়ের কাপড় তুললো। ইচ্ছা করেই হয়তো একটু বেশি ওপরে তুললো। মতিন মিয়া সেদিকে তাকায়। পায়ে সামান্য পানি এসেছে বোঝা যায়। হঠাৎ ওর মনে হয়, অনেক দিন হলো রমিলার দিকে সে তাকায় না, কাছাকাছি যায় না। এমনকি সে অন্য কোনো মেয়ের দিকেও তাকায় না। গতমাসে একবার গঞ্জে গিয়েছিল। সুযোগ থাকলেও সেদিন সে অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়নি, কাছাকাছি যায়নি। মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেললো। বললো, এই পানিত তোর কাম হবে নাই।
- এই পানিতে কি কারো কাম হয়?

এই প্রশ্নের জন্য মতিন মিয়া মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কয়েক মুহূর্ত সময় নিল, তারপর বললো, কাম না হইলে কি এমনি এমনি পানি নিবা আইসে?
- তাইলে মোর কাম হবে নাই কেনে?
- তুই হুদাই কাথা বাড়াইননা। যা ঘরোত যা।
রমিলা হাসে। যাবার আগে বলে যায়, নুন আনেন, ভুলেন না।
মতিন মিয়া পকেট থেকে বিড়ি বের করলো কিন্তু জ্বালালো না। রমিলার প্রশ্ন ওকে চিন্তায় ফেলে দিল। পানিতে যদি কাজ না হয় তাহলে ওর রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। দু’একদিন পরে আর মানুষজন আসবে না। খুবই চিন্তার বিষয়। সে বিড়ি জ্বালালো।

কাঁচা রাস্তার যে প্রান্তটা গঞ্জের দিক থেকে এসেছে সেদিক থেকে একটা ব্যাটারী চালিত ভ্যান আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো মতিন মিয়া। কাছাকাছি আসতে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া অপরিচিত এক ভদ্রলোককে দেখে। ভাবে, উনি কি গাছ দেখতে এসেছেন? ভ্যান থামার জন্য ইশারা দেয়। আগুন্তককে দেখে সালাম দিল, আসসালামু আলাইকুম।

আগুন্তক সালাম নেয়।
- ভাই কি গাছ দেখিবা আইচ্ছেন?
আগুন্তক সম্ভবত গাছের ব্যাপারটা জানে না। ভুরু কুঁচকে বললো, গাছ?
- জুড়া নারিকেল গাছ।
- না তো।
- ও, তাইলে ভাই যাবেন কুন্ঠে?
- চেয়ারম্যান করিম সরকারের বাসায় যাব।
- চেয়ারম্যান চাচার বাড়িত যাবেন? চলেন। মুইও ওত্তি যাম।

মতিন মিয়া ভ্যানে উঠে বসলো। ভ্যান চলতে শুরু করে। ভদ্রলোকের সাথে একটা কাপড়ের ব্যাগ আছে দেখে সে খানিকটা উৎসাহ দেখায়, ভাই কি চেয়ারম্যান চাচার আত্মীয়?
- না, আত্মীয় না। একটা কাজে এসেছি।
- কয়দিন থাকিবেন?
- দেখি কদিন থাকা যায়। আপনি গাছ নিয়ে কী বলছিলেন?

মতিন মিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। উৎসাহের সাথে সে অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দিতে শুরু করে। পুকুরের পানির অদ্ভুত ক্ষমতার কথা জানাতেও ভোলে না- এই পানিতে এমনসব রোগের চিকিৎসা হয় যা কোনো প্যাথীতে হয় না। ভ্যান চালক ওর অতিরঞ্জিত কথায় বিরক্ত হলেও আগুন্তক খুব মনোযোগের সাথে শুনতে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন