কিছু যুদ্ধের গল্প


শামীম রফিক

আচ্ছা নানুভাই, তোমরা কি করোনা ভাইরাস মহামারী দেখেছো?আবির প্রশ্ন করে।
হুঁ। কিন্তু তুমি কি করে জানলে?
আমাদের জুওলজি বইয়ে লেখা আছে। ভাইরাস চ্যাপ্টারে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, কিন্তু স্যার শুধু বললেন : এক সময় নাকি পৃথিবীতে খুব করোনা মহামারী হয়েছিলো।প্রচুর লোক মারা গেছিলো। সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এতো লোক মারা যায় নি। মানুষ যতটা করোনার জন্য মরেছে, তারচেয়ে বেশি লোক মারা গেছিলো খাদ্যের অভাবে। দুর্ভিক্ষ পৃথিবীতে অনেক দেশে হয়েছে, অনেকবার হয়েছে, কিন্তু সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একসাথে তার আগে আর হয়নি। কে কাকে সহযোগিতা করবে? ফসল হয়নি, শিল্প-কারখানা বন্ধ, কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। এ রকম সমস্যা কেউ ভাবতেই পারছে না। আর কিছু বলেননি, তখন আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছ থেকে শুনবো। আমার নানুভাই তো সবই জানে। সব বিষয়েই তোমার জ্ঞান আছে।
হ্যাঁ রে। খুব মহামারী। সে কথা বলে বুঝানো আসলেই দুঃসাধ্য। পৃথিবী নামক এই গ্রহটা থাকবে কেউ ভাবেনি। কিন্তু কিভাবে এখনো টিকে আছে, জানি না।
স্যার বললেন : ১৯৭১-এ পতাকার জন্য যুদ্ধ হয়েছে, ১৯৭৪-এ খাবারের জন্য যুদ্ধ হয়েছে এবং ২০২০-এ করোনা ভাইরাস ব্যাটেল হয়েছে। আরো অনেক কষ্ট।
জানিস, তখন আমি ঢাকায় ছিলাম না। পোষ্টিং ছিল ঢাকার বাইরে। সেই ২০২০-এ হঠাৎ করে সুনামির মতো পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়ে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই। এর আগে আমরা জানতামই না কোভিড-১৯ কি? প্রথম যখন জানলাম, তখন তো একটা ফানি নিউজ ছিল। প্রথম তো আমরা ভাবতেই পারিনি, এ রকম হবে। এদেশে আসবে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। কতবার কত রকম ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবই তো হয়। আবার কিছু প্রাণহানির পর থেমেও যায়। এবারও সে রকম ভেবেছি। অনেক ধর্ম প্রচারকরা বললেন, নানা রকম কথা। কত মানুষ হাসাহাসি করেছে না বুঝে। প্রথমে চীন, পরে কীভাবে সারাবিশ্বে ছড়ালো বুঝানো যাবে না। আজ এই দেশ তো কাল ঐ দেশ। আজ এতজন আক্রান্ত তো কাল অতজন আক্রান্ত। রাতারাতিই সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়, সংক্রমন এবং মৃত্যুহার প্রতিদিনই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে চলল। আমরা প্রতিদিনই অপেক্ষা করতাম এই বুঝি আমাদের দেশে এলো। আমরা সবাই টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম টিভির নিউজের সামনে। স্যোসাল মিডিয়া তো ছিলই। এদেশে এলে তো রক্ষা নেই। আমরা এমনিতেই গরীব জাতি, তারপর আবার এত জনবহুল দেশ। কি করে আমরা শারীরিক দুরত্ব এড়িয়ে চলব? কাজ না থাকলে আমরা খাব কী? প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রন্থ ছিলাম। আমরা প্রতিদিন খবর দেখতাম, শুনতাম। সবার চোখ থাকতো খবরের দিকে। সকল সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তো সকল খবর। আমরা আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতাম-এই বুঝি আমাদের দেশে এলো। আজকে এতজন আক্রান্ত ও এতজন মৃত্যুবরন করেছে, কাল এতজন আক্রান্তও এতজন মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণের হার বাড়তেই থাকলো। মৃত্যুর সাথে সাথে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, জরুরী অবস্থা,কারফিউ ইত্যাদি। জানিস আগে আমরা লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইনের মানেও বুঝতাম না। এখন বুঝি কোয়ারেন্টাইন মানে কি ভয়াবহ বিষয়। মানুষের কাজকর্ম নেই, সকল বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই বাড়তেই থাকলো। চাকুরী নেই, খাদ্য নেই, করোনার ভয়-পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই অবস্থার পরে শুধু বাংলাদেশেই প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে নেমে যাবে। হলোও অনেকটা। কিন্তু ভয়াবহতা কল্পনার থেকেও বেশি ছাড়িয়ে গেলো। পৃথিবী কাঁপিয়ে আজ এ দেশ তো কাল ও দেশ, সমস্ত পৃথিবী ছড়াতে লাগলো। চীনের পর ইতালীতে সিরিয়াস হলো মহামারী, যুক্তরাষ্ট্রে আরো ভয়ানক হলো, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই আক্রান্ত হলেন, ফ্রান্সসহ সব দেশ হয়ে ভারত, পাকিস্তান হয়ে অবশেষে বাংলাদেশ। আট মার্চ বাংলাদেশে একজন আক্রান্ত ঘোষণা করা হলো। যেনো আমাদের মাথার উপরে হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। ভুল হলো হাইড্রোজেন বোমা দিয়ে অবশ্য এটা বুঝানো যাবে না। পাশাপাশি অবাক কি জানিস!
কি?
আমরা সবাই কেনাকাটা শুরু করলাম। এটা সেটা মজুদ করতে শুরু করলাম। বাজারে এটা নাই, ওটা নাই। পাঁচ টাকার জিনিস একশত টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ প্রয়োজনে জমাচ্ছে, কেউ ব্যবসার জন্য জমাচ্ছে। এক ঘন্টার মধ্যে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংকট দেখা দিলো। কোথায় গেলো সব এত তাড়াতাড়ি!
কেন?
আমরা বাঙালীরা খুব আবেগী আর হুঁজুগে চলি। প্যানিক হই খুব বেশি, এই আর কি?
কেন,এমন হই?
এটা আমাদের দোষ ও গুণ।
একটা জিনিস একসাথে দোষ বা গুণ হয় কি করে?
দোষ এই জন্য যে আমরা খুব হুঁজুগে চলি এবং কানকথায় বিশ্বাস করি। আমাদের স্বকীয়তা বা বিবেচনবোধ খুব কম। অমাদের শিক্ষার অভাব। বাস্তব জ্ঞানের অভাব। আমরা খুব লোভী জাতি, হয়ত অভাব থেকেই এ প্রবণতা। আবার ভাবি শুধু কি অভাব থেকেই, অন্য কোন কারণ কি নেই?
আর গুণ?
এই দোষটাই আমাদের গুণ। এটার জন্যই আমরা সরল হই, জটিলতা আমাদের স্পর্শ করে না। জানিস, যাদের এই রকম দোষ থাকে তারাই মানুষকে ভালোবাসতে পারে সহজে। বুকে ভালোবাসার মূলেই তো এই সরলতা। লোকজন তো ভয়ে তটস্থ। বাজারে স্যানিটাইজার নেই, সাবান নেই, মাস্ক নেই, গ্লোভস নেই। যা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম খুব বেশি। মানুষের নাগালের বাইরে। তাও আবার সবার পক্ষে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এত তাড়াতাড়ি বাজারে ক্রাইসিস হবে কেন? মানুষ এই দুঃসময়ে এই রকম ভাবনা ভাববে কেন?ব্যবসা কি খুব প্রয়োজন? টাকা জীবনের জন্য কতটা প্রয়োজন? আসলে আমরা যারা গরীব দেশের গরীব মানুষ তাদের স্বপ্নে শুধু টাকাই থাকে। আমাদের সব কিছুর আড়ালেই থাকে লোভ।কিন্তু যারা টাকার যুদ্ধে ভালোবাসা হারিয়েছে তারা জানে আসলে কোনটা বেশি প্রয়োজন। ভালোবাসা হারানো যায়, ফিরে পাওয়া যায় না। তবে টাকা বার বার ফিরে পাওয়া যায়। এখনো এই পৃথিবীতে ভালোবাসাই বেশি মূল্যবান। এই অভাগা দেশের মানুষ সেসব ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু একদিন বুঝলেও আর ফিরে আসতে পারে না। ফিরে পাবে না ভালোবাসা নামক এই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটা। উন্নত বিশ্বের মানুষরা ভূগছে। তাদের সব আছে কিন্তু এই ভালোবাসাটা নেই।
কেন, নানুভাই?
নানুভাই, ভালোবাসা হলো জলের মতো। নড়লে পুরোটাই নড়ে, ভাঙলে পুরোটাই ভাঙে। বিশ্বাস আর ভালোবাসা একই জোয়ারের দুই রূপ।
তারপর?
সব তো মনে পড়ে না রে। সেই ২০২০। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তাছাড়া শরীরও তো পারমিট করছে না রে।
তবুও বল। যা মনে আছে তাই বল।
হ্যাঁ রে। তুই তোর মায়ের মতো হয়েছিস। তোর মা-ও এমন গল্প শুনতে পছন্দ করতো। আমাকে ছাড়তে চাইতো-ই না। আমি কত গল্প যে ওকে শুনাতাম। রাতের বেলা মা’কে ওয়াস রুমে যাবার কথা বলে আমার লেখার ঘরে চলে আসতো। গল্প শোনার জন্য, গল্প করার জন্য, বইপত্র নিয়ে নাড়াচড়া করার জন্য, আমি কি করি তা দেখার জন্য। ওর খুব কৌতূহল। জানিস, ও সারারাত ঘুমাতো না-আমার সাথে জাগতো। পারমেন, সিংজ্যান, মটু পাতলুসহ আরো নানা রকমের কার্টুন দেখতো। কাঁথার নিচে শুয়ে মোবাইলে ইউটিউব দেখতো। আমার কাঁধে বসে থাকতো। আমার খুব লাগোয়া ছিল।
তারপর?
যারা বিদেশ ফেরত তারা হোম কোয়ারেন্টাইন বুঝল কিনা জানি না কিন্তু মানলো না। সরকারও তাদের বাধ্য করালো না। ফলে তারা হাট-বাজার, পিকনিক থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত করে নিল। শারীরিক দুরত্ব মানলো না। ফলে মাত্র বিশ দিনের মাথায় সারা পৃথিবীতে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রায় পাঁচলক্ষাধিক মানুষ করোনা আক্রান্ত হলো। আমরা লকডাইনের মধ্যে রোস্টার ডিউটি করি, অফিসে যেতে হয়। অবশ্য আমার চেয়ে তোমার নানুকে বেশিদিন অফিসে যেতে হতো। আমার তো নতুন অফিস, লকডাউনে ঐ অফিসে জয়েন করেছিলাম বলে ডিউটি বুঝে পাইনি, তাই কম যেতে হতো। প্রথমদিকে পুলিশ যেতে বাঁধা দিতো, পরে অবশ্য সে সমস্যা আর ছিল না। আমরা গলায় আইডি কার্ড ঝুঁলিয়ে পায়ে হেঁটে অফিস যেতাম আবার ফিরতাম। যারা কাছাকাছি এলাকায় ছিলাম তাদেরই অফিসে যেতে হতো বেশি। চারিদিকে ভয় আর আতঙ্ক। কখন কার কি হয়। এক সময় এলো সব পরিচিতদের মধ্যে ছড়াতে লাগল। আজ এই বন্ধু, কাল ঐ ভাই, পরশু উমুক, পরদিন তুমুক। ভয় পেতাম আবার পেতাম না। বাংলাদেশে মর্টালিটি রেট বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মহামারী প্রকট আকার ধারন করবে। হলোও তাই।
তারপর?
এ দেশের মানুষ লকডাউন মানে না। পুলিশ যদি লকডাউন মানাতে গিয়ে লাঠিপেটা করে, তো পুলিশেরই চাকুরী যায়। মানুষ রাস্তায় ঘোরে, এ যেনো কোন একটা উৎসব। বউ ও ছোট বাচ্চাকে বাইকে বসিয়ে ঘোরে বেড়াচ্ছে। রিস্ক বুঝছে না। আচ্ছা নিজের রিস্ক বা জীবনের মায়া না থাকলে কে তা দিতে পারে? নিজের জীবন নিজের কাছেই বেশি মূল্যবান। পুলিশ কাছে আসলে লোকজন সরে যায় কিন্তু পুলিশ সরলেই আবার ফিরে আসে। বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শারীরিক দুরত্ব মানে না, মাস্ক পড়ে না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। এর মধ্যেই রোযা শুরু হয়ে গেলো, মানুষ ঈদের বাজারও করতে শুরু করলো। খাবার নেই কিন্তু ঈদের জন্য প্রস্তুতি, হায়রে বাঙালী!
কেন?
কেন আবার কি?বুঝেই না। আহাম্মক আর কি।
তারপর নানুভাই।
এর মধ্যে জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জামায়াত-তাতে রাজনৈতিক প্ররোচনা, বাজারে মানুষ, টিসিবি-র বাসে হাজার হাজার মানুষ আবার মানুষের খাদ্যলুট, মসজিদে মানুষ, গার্মেন্টস কর্মীদের দল বেঁধে গ্রাম থেকে ঢাকায় ঢেকে আনা। গার্মেণ্টস খুলে দেয়া এবং অনেক অফিস খুলে দেয়া। আরো কত কি?
এসব কিভাবে হতো? এই দুর্যোগেও রাজনীতি?
হতো রে। হতো। রাজনীতি আসলে খুব নোংরা জিনিস। তারপর সে যদি হয় আমাদের মতো এইসব লোভী আর অনাহারী দেশে। সরকারে যেতেই হবে, যেতে হলে আদর্শ বিসর্জন দিতে হবে। ফলে আদর্শের সাথে কম্প্রোমাইজ। সরকারে প্রভাবশালী সব ব্যবসায়ী নেতা, বিরোধী দলেও, তারা তো লাভ আর লোকসান গুনেই জীবন চালায়। মানবতা থাকে না। আসলে যাদের জ্ঞানের আলো নেই-তারাই টাকার পেছনে ছোটে ও কম্প্রোমাইজ করে। তেলবাজি করে। আবার উল্টোদিকে আছেন বিরোধী নেতা-কর্মী। তারাও সুযোগ সন্ধানী। যেভাবে পারে সরকারকে ল্যাং মারতেই হবে। শুধু সরকার কি করবে? ব্যালেন্স করার জন্যই তো ঐসব ব্যবসায়ী নেতাদের উপর নির্ভর করেন। আমাদের এসব দেশে সততা দিয়ে কোন লাভ নেই। আমরা ৫০০ টাকার জন্য ভোট বিক্রি করে দেই, আবার ত্রাণের জন্য ফেরেস্তা চাই। তাই কি হয় কখনো? গণতন্ত্রে একজন বিচারপতি আর একজন রাখাল (ভোটের বিচারে) সমান ক্ষমতাবান। কিস্তু চিন্তা ও বিবেচনায় কি সমান? চরম সমালোচনার মুখে গার্মেন্টস কর্মীরা আবার ফিরে যায়। ছড়িয়ে পড়ে করোনা। ধর্ম তো একটা বিশাল ফ্যাক্টর। ঐ বিষয়ে তো কিছু বলাই যাবে না। মানুষ সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা নিতে চায়। ধর্ম তো সরাসরি কিছু করে না। যেখানে মক্কাশরীফে সব লকডাউন করে দেয়া হয়, সেখানে আমাদের ধর্ম কি উড়ে যাবে? ঘরে কি নামাজ পড়া যাবে না? তাছাড়া এটা তো কোন ইচ্ছেকৃত বা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। সাময়িক। এ কথা কে বুঝবে? কাকে বুঝাবে?
তারপর?
সবাই তো মুখরিত, মানুষ লকডাউন মানে না। কিন্তু এর বিপরীতেও কথা আছে।
তাহলে?
যদি শুধু ঢাকার কথা বলি তো, খুঁজে দেখা হলো, যারা লকডাউন মানে না তারা ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার শতকরা কতজন? তাদের কেউ রিক্সাওয়ালা, কেউ ত্রাণের আশায় হেঁটে বেড়ানো আবার কেউ রাস্তায় থাকা লোকজন। বেড়াতে বা কৌতূহলবশত ঘোরতে আসা লোকজন খুব নগণ্য। কিছু ইয়ং ছেলেপুলে আছে-যারা সদা কৌতূহলপ্রবণ। এই রকম গরীব আর জনবহুল দেশে এইটুকু তো হবেই। যদি এটুকুও ঝুঁকিপূর্ণ করোনা ভাইরাসের জন্য। কিন্তু কি আর করা। আমাদের দেশে তো হাট বাজারের জন্য লোকজনকে বাজারে যেতেই হবে। নইলে কি খাবে? অন্যকোন সিস্টেমও তো নাই। আবার অনেকের তো বাজার করার টাকা পর্যন্তও নাই। সরকার সব বুঝে কিন্তু সরকার চাইলেও তো বোতাম টিপে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। খুব কঠিন হয়তো সরকার হতে পারতেন কিন্তু সরকারকে তো সব দিক বিচার করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা যেভাবে ভাবি, সরকার চাইলেও সেভাবে ভাবতে পারে না। তাছাড়া আমাদের তো সবই সীমিত। 
আর কি হলো?
মানুষ লকডাউনে মালবোঝাই গাড়ীর মতো ট্টিপল দিয়ে ঢেকে গাড়ীকে পণ্য পরিবহনের গাড়ী বানিয়ে তাতে বসে, মাছের ড্রামে বসে, আরো নানাভাবে এ শহর ও শহর যেতে লাগল। এতে ভাইরাস আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলাদেশ। সরকার সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করল। এর মধ্যে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানও হয়েছে, অনেককে জরিমানাও করা হয়েছে। ধার্মিকেরা নামাজের উপর বিধিনিষেধ মেনে চলতে নারাজ। একদিকে করোনা সংক্রমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অন্যদিকে খাদ্যের জন্য হাহাকার। করোনা সংক্রমনের পাঁচ-সাতদিনের মধ্যেই খাদ্য সহযোগিতা, নানান ইন্সেন্টিভ ঘোষণা করতে করতে সরকারের তো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেন জানি, বিশেষ শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের জন্য শুরুতেই প্রণোদনা ঘোষণা করতে হলো বিশাল এক এমাউন্ট। সেটা বিশেষ সুদের হার হলেও তারা সেটা নিয়ে নানা কিছু করল। তবে কি সেটা ফ্রি-তে দিলে ভালো হতো? পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা অর্থ্যাৎ ডাক্তার ও নার্সদের প্রণোদনা দিতে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই কিন্তু। ব্যাংকার, পুলিশ, সাংবাদিক এবং আরো যারা সম্পর্কিত সবাইকে কিছু না কিছু প্রনোদনা দিতেই হয়েছে। সবার আগে ব্যবসায়ীদেরকে দিতে হয়েছে। এতো সুযোগ-সুবিধা, কেন? তাহলে গরীবরা কি নিবে? সরকার কোথায় পাবে? জানিস, আমাদের দেশে শান্তির নোবেল শান্তিতে ঘুমিয়েছে। আমরা তাকে দেশের কোন দুর্যোগ বা বিপদে কথা বলতে শুনিনি। শুধু এ সময়ের কথাই বলছি না, কোন সময়ই নেই। কিন্তু কেন? শান্তি তো সবার জন্যই শান্তির। তার সাথে কারো কোন শত্রুতা থাকবে কেন?রাজনীতি থাকবে কেন?
তারপর নানুভাই?
আমাদের দেশে যে করোনা ভাইরাস এসেছে, তা ইতালীয় ভাইরাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মানে ইতালী ফেরত প্রবাসিদের মধ্য থেকেই ছড়িয়েছে। ঐ দেশ থেকে যারা ফিরেছেন, তারা তো কোয়ারেন্টাইন বিষয়টা আমাদের চেয়ে আগে থেকেই জানতেন, তবে মানলেন না কেন? কেন তারা উদাসীনতা দেখিয়ে ছড়িয়ে দিলেন দেশময়? এই ভাইরাস নাকি কমপক্ষে বিশ বা তারও বেশি বার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করেছে। অনেক বহুরূপী ভাইরাস এটা। মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতি আর আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রাখতেই তাদের এই পরিবর্তন। আরো কতবার পরিবর্তন হবে তা সে সময় আমরা জানতাম না। আমাদের প্রস্তুতি কম, যারা ফ্রন্টলাইন ফাইটার তারাই আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপক পরিমাণে। নিম্নমানের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, রোগীদের অজ্ঞতা আর রোগীদের রোগকে গোপন করার প্রবণতা থেকেই এই পরিণতি। তাছাড়া নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা লোকজন, পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা লোকজন, সাংবাদিক, ব্যাংক কর্মী, গার্মেন্টস কর্মীসহ রিলেটেড লোকজন এবং নিম্ন আয়ের লোকজনই বেশি আক্রান্ত হলো। ওরাই যদি আক্রান্ত হয় তো দেশ চলবে কিভাবে? পিপিআই নাকি দুই নম্বর।
দুই নম্বর মানে? 
এখানেও আমাদের ব্যবসা। টাকার জন্য আমরা মানসম্মত পিপিআই সংগ্রহ করিনি।
বলো কি?
হুঁ। নানুভাই। ও কি বুঝলো, জানি না। শুধু ইতালী নয় বিশ্বের অন্য দেশ থেকেও যারা এসেছে তারাও কেউ হোম কোয়ারেন্টাইন মানেননি। সরকারও সে ক্ষেত্রে সঠিক পথে থাকেননি। হাইকোর্ট অবশ্য আগেই এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলো। সরকার যদিও সব প্রস্তুতির কথা বলেছিলো কিন্তু আমরা তা অবশ্য সঠিক নয় বলেই মনে করেছি। তারপর সচেষ্ট হলেও এত সীমাবদ্ধতা দিয়ে কি করে সামাল দেবে?
পরে কি হলো?
সবাই এগিয়ে এসেছিলো। রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী, ছাত্র এবং সকল পেশার জনগণ এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছিলো কিন্তু সমস্যার তুলনায় সামর্থ্য ছিল খুব নগণ্য। নেত্রকোনার ভিক্ষুক নিজামউদ্দিন নিজের জমানো দশ হাজার টাকা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য সরকারী কোষাগারে দান করেছিলো। অথচ উনার ঘরের চাল গাছের পাতা দিয়ে তৈরি। ওখান দিয়ে জল পড়ে, ঘুমাতে পারেন না। সেজন্য বহুবছর ধরে ঐ টাকাটা জমাচ্ছিলো। সেই নিজামউদ্দিন! সেই খবর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কানে পর্যন্ত পৌঁছালে জেলা প্রশাসক নিজামউদ্দিনের সাথে দেখা করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিশ হাজার টাকা নিজামউদ্দিনের হাতে তুলে দেন। আজো সেই নিজামউদ্দিনের কথা ভুলতে পারিনি। জীবনে কোনদিন ভুলব না। আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছিলো কিনা জানি না। তবে খুলে যাওয়া উচিত ছিল। যাই হোক সব কিছু ব্যাপক আকার ধারন করল। কিছু কিছু মানুষ নিজেকে কোয়ারেন্টাইনের নামে গর্তে প্রবেশ করালো। তারা কাউকে ক্ষতি করলো না ঠিক কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের দিকে ফিরেও তাকালো না। তাদের কোন দায়িত্ব নেই।
তারপর?
জানিস, ঐসব মানুষদের আবার বড় বড় কথা। এদেশে এই নেই, সেই নেই, কিছু নেই। এদেশে থাকব না। এই দেশের কপালে। ঐসব মানুষগুলো খুব এক্সট্রিমিস্ট হয়। হায় হায়, এই গেলো, ওই গেলো, কিছু নেই, সব শেষ, কি হবে, সর্বনাশ, এই দেশেই থাকবো না, এই দেশের মায়েরে ইত্যাদি। তাহলে থাকছিস কেন এই দেশে। চলে যা, যেখানে ভালো সেখানে। তোদের মতো তথাকথিত লোকদের দিয়ে দেশের কোন প্রয়োজন নেই। লকডাউনের জন্য ছাত্রদের জীবন নষ্ট হয়ে গেলো। আরে বাবা, বেঁচেই যদি না থাকে তবে পড়বে কিভাবে? এটা কি ইচ্ছে করে ঘটানো কোন ঘটনা। আপদকালীন সময়ে কি নিয়ম থাকে নাকি রাখা যায়? এইসব মানুষেরা সব সময়ই ফ্রন্টলাইনে থাকে। এদের প্রচার-প্রচারনা বেশি থাকে। সতর্ক না থাকলে তো পড়াশুনা আরো পিছিয়ে যাবে? যেখানে জীবনের প্রশ্ন, বেঁচে থাকার প্রশ্ন সেখানে অর্থনীতি, পড়াশুনা-এইসব ভাবার কি প্রয়োজন?
তারপর?
সরকার নানাচাপে কিছু কিছু রপ্তানীমুখি শিল্প-কারখানা খুলে দিলো। গণপরিবহন সীমিতভাবে চালু করল। এই সুযোগে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণরূপে খুলে দিলো। ওরা তো কর্পোরেট হাউস। ওরা এ বছর একশত কোটি টাকা প্রফিট করেছে তো পরের বছর দুইশত কোটি টাকা টার্গেট, পরের বছর চারশত কোটি টাকা, পরের বছর আটশত কোটি টাকা টার্গেট। এভাবে টার্গেট বাড়তেই থাকে। ওদের টার্গেট কমে না। জীবন না থাকলেও টার্গেট থাকে। যদি কোন কারনে একটু কমে তো কর্মী ছাঁটাই। খরচ কমাতে হবে, ভাই। সিনিয়রদের সরিয়ে দাও। ওরা তো বড় বেতন পায়। ঐ একজনের বদলে চারজন কর্মী নাও। অভিজ্ঞতা দিয়ে কোন প্রয়োজন নেই। জুনিয়রদের দিয়ে চালাও। ঐ সিনিয়র লোকটা এই বয়সে যাবে কোথায়, করবে কি? ও কি জুনিয়র ছিল না? ঐ বয়সে যা করেছে, তা কি এখন করা সম্ভব? এটা কি হয় কখনো? তাহলে ঐ যে অফিস প্রধান ওনার বয়স কত?মালিকটার বয়স কত?  কিন্তু তাই হচ্ছে। এত প্রফিট, এত টার্গেট-তারপরও ছাঁটাই কি খুব প্রয়োজন? এত টার্গেটের ফেইস করার পর যদি ছাঁটাইয়ের চিন্তুা মাথায় থাকে তবে কাজ করবে কিভাবে? টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ীর কাছে বা ডিপোজিট ওরিয়েন্টেড কর্মকর্তার সাথে এখানে ওখানে যেতেও হয় কোন কোন লেডি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে। যেতে বাধ্য হতেও দেখেছি। চাকুরী তো করতে হবে। জীবন তো বাঁচাতে হবে। তবুও তো চাকুরী করছে বলা যাবে। আগে তো জীবন! যেভাবেই হোক জীবন তো বাঁচাতে হবে। গোপনে যাই হোক, প্রকাশ্যে তো সন্মান নিয়ে বাঁচা যাবে। অধ্যাপকরা তো সিনিয়র, প্রভাষকদের সমান পরিশ্রম করতে পারে না, তাই বলে কি ছাঁটাই হয়? কোন সরকারী চাকুরীজীবীকে কি ছাঁটাই করা হয়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা অন্যান্য পেশাজীবীদের কি ছাঁটাই করা হয়? শুধু সরকারী চাকুরীজীবীরাই কি সরকারের লোকজন আর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? সরকারী অফিসে কি তা হয়? কেন হয় না? ওখানে মানুষের বয়স হয় না, সিনিয়র হয় না, বেতন বাড়ে না? তাহলে কি শুধু সরকারী চাকুরীজীবীরাই কি মানুষ? ওদের দেখার দায়িত্বটাই কি শুধু সরকারের? সরকার কি শুধু সরকারী চাকুরীজীবীদের সরকার? তাহলে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান উঠিয়ে দিলেই তো হতো। কিন্তু কেন উঠাবে? বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে কি সরকার প্রণোদনা দেয় না? এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কি সুবিধা নেয় না? ইনকাম ট্যাক্স নেয় না? এইসব কর্মচারীরা কি ট্যাক্স দেয় না? ওদের কাছ থেকে অনুদানও বেশি পাওয়া যায়। অন্তত যাদের কাছ থেকে অনুদান পাওয়া যায়, ট্যাক্স পাওয়া যায়, তাদের প্রতি সরকারের কি কোন দায়িত্ব নেই? এইসব লোকেরা কি বেকারত্বের খাতায় নাম লিখিয়ে দেশের বোঝা হচ্ছে না? নাকি মানুষ বয়স্ক হলে তার দায়িত্ব রাষ্টও নিতে চায় না? তাহলে পরিবারের লোকেরা কেমন করে নেবে? নাকি বেকারত্ব দূরের নামে সরকার জুনিয়রদের বসিয়ে সিনিয়রদের বেকার করছে? সিনিয়র হওয়া অভিশাপ? এইসব দেখভাল করার জন্য কোন লোক নেই। তথাকথিত কর্পোরেটের মানে দেশে নতুন করে ক্রীতদাস প্রথা চালু রয়েছে। এই মহামারীর মধ্যেই লক্ষ লক্ষ লোকের চাকুরী চলে গেলো। কিন্তু কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত কারো চাকুরী গেলো না। তবে কি শারীরিক যোগ্যতার মাপকাঠি সরকারী আর বেসরকারী ব্যবস্থা? এই অবস্থায় অগণিত মানুষ করোনা, ক্ষুধার সাথে বেকারত্বের অনিশ্চয়তা কাঁধে নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তাহলে কি এই লোকগুলোও পথের ভিক্ষুক হয়ে দারিদ্রসীমার নিচে লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিবে না? অর্থনীতি কোথায়? কি বলেন অর্থনীতিবিদরা?
তারপর?
তারপর, সব মহামারী আকার আরো জটিল, আরো জটিল থেকে জটিলতর হলো। হুঁ হুঁ করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে গেলো। হাজার হাজার ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত অনেক মানুষ আক্রান্ত হলো, মৃত্যুবরণ করলো। পুলিশ, আর্মি, বিডিআর আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরণ করলো। সাংবাদিক আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরণ করলো। পরিচ্ছন্নকর্মী আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরণ করলো। ব্যাংকার আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরণ করলো। ফুটপাথ ও নিন্মবিত্তরা আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরন করলো। বিভিন্ন পেশার মানুষ আক্রান্ত হলো হাজার হাজার, মৃত্যুবরন করলো। পথে পথে মৃত্যুর মিছিল। কে কাকে সেবা দিবে, কে কাকে দাফন কাফন করবে। একদিকে করোনার হাহাকার আর অন্যদিকে খাদ্যের হাহাকার। শোকের সাগরে ভাসতে থাকলো দেশ ও দেশের মানুষ। সরকার কি করবে? লকডাউন ঘোষনার জন্য, স্বাস্থ্যবিধি ঘোষনার জন্য, নিউজ পেপার প্রকাশের জন্য, জরুরী সেবা প্রদানের জন্য, টিভি নিউজ প্রচারের জন্য কোন লোক নেই। দেশ অন্ধকারে, কেউ কিছু জানতে পারছে না। নেট, ডিশ, ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ করার জন্য কোন লোক নেই। কারো কাছে টাকা থাকলেও কেনার মতো খাবার নেই। এক্সপোর্ট নেই, ইমপোর্ট নেই, প্রোডাকশন নেই। ধনীরা যে বিদেশ থেকে আনিয়ে খাবে অথবা বিদেশে গিয়ে আরাম করবে সে ব্যবস্থাও নেই। সারা পৃথিবীতে হাহাকার। এক যুদ্ধ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। মানুষ আর ভাইরাসের মধ্যে এমন যুদ্ধ দেখে সম্ভবত অন্য গ্রহের লোকেরাও (এলিয়েন) চমকে গেছে। যুক্তরাজ্য করোনা ভাইরাস আবিষ্কার করলো কিন্তু সফল হলো না। নিরন্তর চেষ্টা চলছেই।
তারপর?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে অনেকবেশি মারাত্মক ছিল এই যুদ্ধ।
তুমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছো?
নাহ দেখিনি। তবে পড়েছি।
তবে লকডাউন কতদিন ছিল?
ছয় মাস পর তো আর ঘোষনা করতে হয়নি। তখন কি ছিল তা জানি না।
তবে কি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও জটিল ছিল?
নানুভাই, মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। তবে প্রচুর পড়েছি, গল্প শুনেছি, নাটক ও সিনেমা দেখেছি। তাতে একটা ধারনা জন্ম হয়েছে। ঐ যুদ্ধ আর এই যুদ্ধ এক নয়। তখন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। তখন ছিল দেশের সাথে দেশের যুদ্ধ। সেটা দেখা যেতো, এটা দেখা যায় না। সেটাও অনেক করুন ও হৃদয় বিদারক ছিল। মুক্তিযুদ্ধে আমরা ঘর ছেড়ে পালাতাম কিন্তু এখন আমরা ঘরে বন্দী থাকি। তখন শত্রু চেনা যেতো, লুকিয়ে থাকা যেতো কিন্তু এখন শত্রু দেখা যায় না, নিজের হাতকে পর্যন্ত বিশ্বাস করা যায় না। তখন পৃথিবীর অন্য দেশে চলে যাওয়া যেতো কিন্তু এখন কোথাও যাওয়া যায় না। সে সময় বিদেশী সাহায্য পাওয়া যেতো কিন্তু এখন কোন সাহায্য পাওয়া যায় না। কে কাকে সাহায্য করবে? সাহায্য নিতেও ভয়, যদি ওটাতেই থেকে থাকে আমাদের শত্রু-করোনা। এই শত্রুর জন্য কোন আপনকেও বিশ্বাস করা যায় না। মানুষ অবরুদ্ধ, মানবতা অবরুদ্ধ ও বিতর্কিত।
তারপর?
যুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে, অগণিত মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে কিন্তু করোনায় সে রকম হবার সম্ভবনা কম। তবে করোনায় যত না লোক মরেছে, তারচেয়ে বেশি মরেছে দুর্ভিক্ষে ও কর্মহীনতায়।
তাহলে তোমার মতো কোনটা ভয়াবহ ছিল?
নানুভাই, দুটোই ভয়াবহ ছিল। কিন্তু এটা যতটা অনিশ্চিত ওটা এত অনিশ্চিত ছিল না। যুদ্ধ জয়ের সাথে সাথে আবার সুজলা সুফলা এ দেশ আমাদেরকে ভরিয়ে দিয়েছিল। বিদেশী সাহায্য ছিল। তাই যুদ্ধ পরবর্তী ভয়াবহতা তেমন ছিল না। কিন্তু এবার তো সারা পৃথিবীর একই অবস্থা। ওটা ছিল দুটো দেশের সমস্যা আর এটা হলো সারা পৃথিবীর সমস্যা। ওটাতে কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো কিন্তু এটাতে কর্মহীনতা বেড়েছে।
রাজাকার কারা?
যারা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন, যারা দেশের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, যারা দেশের সব গোপন খবর পাচার করেছিলেন। এখনও রাজাকার আছে।
এখনো রাজাকার থাকে কি করে?
থাকে রে। যারা দেশের শত্রুদের এখনো কোন না কোনভাবে সাহায্য করছে, তাদের শেল্টার দিচ্ছে, পুণর্বাসন করছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা?
হ্যাঁ। এখনো মুক্তিযোদ্ধা আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে।
কেমন?
দেশের জন্য যারা এখনো ভাবে, কষ্ট করে তারাই তো মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ, তাই তো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু ১৯৭১ সালে সীমাবদ্ধ? 
তাহলে ১৯৭৪-এ খাদ্যের জন্য এত হাহাকার হয়েছিল কেন?
নানুভাই, ঐ বছর মাত্র আমার জন্ম হয়েছিল। তাই বুঝবার সুযোগ আমার ছিল না।
কিন্তু ওটা নিয়ে কিছু পড়নি?
নাহ্। ওটা নিয়ে তেমন কোন লেখা নেই।
তবে কোন নাটক বা সিনেমা দেখনি?
নাহ্। তাও নেই।
কেন?
কারন, ওটা যতটা না ঘটনা ছিল, তারচেয়ে রটনা ছিল বেশি।
তার মানে তেমন জটিল ছিল না?
অবশ্যই না। এ দুটোর ধারে কাছেও ছিল না। ক’জন লোক মরেছে ঐ দুর্ভিক্ষে?
নানুভাই। জগতে অনেক রকম অনিয়ম বা রটনা আছে যার প্রয়োজন থাকে কিন্তু ভিন্ন কারণে। বড় হলে তুমিও বুঝবে। এমন অনেক কিছু থাকে যা বুঝা যায় কিন্তু বলা যায় না। অথবা বললেও তা পরিপূর্ণ হয় না।
তুমি এসব নিয়ে কিছু লিখনি?
হুঁ, অনেক লিখেছি। তবে করোনা নিয়ে যতটা লিখেছি ততটা ১৯৭১ নিয়ে লিখিনি, ১৯৭৪ নিয়ে লিখিনি। জানিস, সাম্প্রতিক ঘটনা মানুষকে যতটা নাড়া দেয় অন্য কোনো ঘটনা ততটা দেয় না। মানুষকে যদি কোন ঘটনা উপলব্ধিতে নাড়া না দেয় তবে তো মানুষ তা নিয়ে লিখতে পারে না। আমি তো ১৯৭১ বা ১৯৭৪ দেখিনি কিন্তু ২০২০-এ করোনা যুদ্ধ দেখেছি। আরো লিখব।
আচ্ছা, ঐ সময় কি করে সময় কাটাতে?
অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন করেছিস। আমার ঐ এক বদভ্যাস। রোস্টার ডিউটিতে অফিস করতাম। মাঝে মাঝে এক সপ্তাহ অফিস যেতে হতো না, তখন সব সময় ঘরে থাকতাম। সারাক্ষণ টেবিলে বসে থাকতাম। হয় পড়তাম আর না হয় লিখতাম। মাঝে মাঝে টিভি দেখতাম। একদিন আমি খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম,রাতে কি খাবার?
তখন তোর মা আমাকে বলল :  আব্বু ঘড়িতে তাকাও।
ঘড়ি দেখি কিন্তু বুঝতে পারছি না।
ওরা হাসে। কি দেখলা বাবা?
আমি তো বুঝতে পারছি না।
বাবা রাত ১২ টা বাজে।
আমি লজ্জা পাই। কিছু বলি না। কখন খাই, কখন ঘুমাই, কখন লিখি, কখন জাগি, কখন রাত ১২ টা, কখন দিন ১২ টা কিছুই বুঝতে পারি না। করোনাকে সমর্থন করার কিছু নাই কিন্তু সময়টা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। ছুটি না কিন্তু অফিস নাই। অফিস থাকলেও তেমন চাপ নাই। ঘরে থাকলেও বাজারে যাবার তাড়া নাই। ছুটির মতো কিন্তু কোথাও যাওয়া যাবে না, কেউ আসতে পারবে না, কেউ কোথাও যাবার বায়না করতে পারবে না। এই রকম অদ্ভূত ছুটি জীবনে আর কোনদিন পাব না। আমি সেই সময়টাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজে লাগিয়েছি। তাই কোয়ারেন্টাইন আমার জন্য বিরক্তির ছিল না। অনেকের মুখেই শুনেছি ঘরে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে, আমি কিন্তু তা হইনি। আমার এ রকম আরো সময় দরকার। আরো অনেক সময়। হাতে অনেক কাজ।
আচ্ছা নানুভাই, লিখতে তোমার ভাল লাগে?
হুঁ। খুব ভালো লাগে। না লিখলে তো পাগলই হয়ে যেতাম। ওটাই আমার একমাত্র প্রেম।
কেনো? আর কোন প্রেম নাই তোমার জীবনে?
নারে পাগলা। প্রেমের জন্য আমার কোনো যোগ্যতা নেই।
কেন?
সে গল্প অন্যদিন বলব। সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রেমের জন্য কিছু যোগ্যতা লাগে, যা আমার নেই। 
কেন লিখো?
মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন লিখে। মানুষ যখন দুঃখ পায় তখন লিখে। মানুষের যখন কোন পথ থাকে না তখন লিখে। আমার হয়ত আর কোন পথ নেই। আমার মনে হয় প্রতিটা মানুষেরই স্বপ্ন থাকা উচিত আর নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ বানানোর জন্য ভালোবাসা উচিত। ভালোবেসে না পুড়লে মানুষ নিজেকে চিনবে কি করে? নিজেকে চিনতে গেলেই তো পারিপাশ্বিক সবাইকে চেনা যায়।
যেমন?
আমারও তো করোনা পজিটিভ হয়েছিল। বিধাতার সেন্স অব হিউমার দেখ, যার কেউ নেই তাকে নিয়ে এ কোন তামাশা! প্রথমে আমি কাউকে বুঝতে দেইনি। সবার কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছি।কিন্তু করোনা তো গোপনে রাখার মতো বিষয় নয়।
কেন? হাসপাতালে যাওনি কেন?
কারন, কারন...
কি হলো নানুভাই? তুমি এতটা অন্যমনস্ক কেন হলে?
না মানে।
মানে কি? বলো আমাকে। বলো। আমি কাউকে বলব না।
না, তা নয়।
তাহলে?
তবে শোন, আমার অভিভাবক সমস্যা। যে কারণে হাসপাতালে যেতে চাইনি।
মানে কি?
আমি আগেই জানতাম। তুই এই কথার মানে বুঝবি না।
বুঝিয়ে বল।
আরো বড় হ। তখন যদি বেঁচে থাকি তবে বলব।
আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার খোঁজ নিতে বা সাথে কেউ যেতে চায়নি।
সাথে তো যাওয়া যেতো না, গেলেও তো দেখতে দিতো না।
তা ঠিক। কিন্তু তবুও অনেকে যাবার চেষ্টা করতো এবং যেতো। আমার এক বন্ধুও তখন করোনা পজিটিভ ছিল। ওর বাসা থেকে প্রতিদিনই লোক যেতো যদিও দেখা হতো না কিন্তু খবর জানতে পেতো। আবার বন্ধুও জানতে পেতো বাসার লোক এসেছে। সে এক অন্য রকম ভালোলাগা। তাছাড়া বাসার লোকের সাথে তো হাসপাতালের লোকজন যোগাযোগ রাখতো। মরে গেলে জানিয়ে দিতো। শুধু করোনা দিয়েই এমনটি শুরু নয়, আগেও এ সমস্যা ছিল। যেতে বাঁধা না থাকলেও কেউ যেতো না।
তুমি কি সে জন্যই লিখো?
আমি কি জন্য লিখি, সেটা তো আমিই জানি না। কি চাই আমি?
নানুভাই, তুমি কি নিজেকে পরাজিত ভাবছো?
সে বিচার তো তোদের হাতে। তোরাই ভেবে দেখিস। তবে জয়-পরাজয় নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। আমি শুধু যুদ্ধ করতেই পছন্দ করি।
কিন্তু এত নিরবে কেন?
নিরবতা আমার প্রবণতা। আমি আমার পাওয়ার অব সাইলেন্টকেই কাজে লাগাতে চেয়েছি। কাজই তো থাকবে। আর তো কিছু থাকবে না। থাকে না।
লেখকদের কি আপনজন  থাকতে নেই?
কেন নয়? লেখকদের তো আপনজন আরো বেশি থাকে ও লাগে। তুই তো আমার আপনজন  জানিস, আমার সব কিছু উল্টো হয়ে গেছে। কর্ম, পড়াশুনা, প্রেম, ভালোবাসা এবং অভ্যাস সব আমাকে কেমন যেনো আলাদা করে দিয়েছে। সব জায়গায় অবহেলিত। কোথাও কেউ নেই, অথচ এমনটি হবার কি কারণ?
কেন?
আমি কাউকে খুশী করতে পারিনি, কারো মন জয় করতে পারিনি।
কেন?
জানি না। তুই বড় হয়ে বুঝিয়ে দিস। কত জনের কাছে বুঝতে চেয়েছি কিন্তু বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝি কষ্ট ছাড়া হয়তো শিল্পীর জীবন হয় না। শুধু এ দায়িত্বটা যদি কাউকে দিয়ে যেতে পারতাম, তবে হয়তো শান্তিতে চলে যেতে পারতাম।
তুমি কোথায় যেতে চাও? আমি যদি তোমার দায়িত্বটা নিতে চাই? কথা দাও তবে আর যাবে না কোথাও।
কথা দিতে পারব কিন্তু কথা কি রাখতে পারব? মানুষকে একদিন তো চলে যেতেই হয়। কেউ ফিরে না, কেউ ফিরাতে পারে না। প্রতিটা মানুষ এক নিষ্ঠুর শর্তের সাথে মোলাকাত করে এই পৃথিবীতে এসেছে। এখানে যুদ্ধ হয়েছে, যুদ্ধ আরো হবে। অবশেষে মানুষ জয়ী হয়। মানবতা জয়ী হয়।
করোনা পজিটিভ পরে কি হলো?
কি আর হবে? আমার কোনো টেনশন ছিল না। মরতেও যেমন আপত্তি ছিল না, বাঁচতেও আপত্তি ছিল না। সারাক্ষণ হাসতাম। শুকরিয়া আদায় করতাম। কোনো অভিযোগ ছিল না। ভয় ছিল আমার শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে। মানসিকভাবে সে অক্ষমতাকে অতিক্রম করে অবশেষে ফিরে এসেছিলাম। আমার জীবনে এ রকম যুদ্ধের গল্প আরো অনেক ছিল। প্রতিটা লেখাই আমার গল্প। প্রতিটা লেখাতেই আমি গল্প করি। যুদ্ধ করি। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেই। মানুষ যখন প্রতারণা করে তখন আনন্দ পাই, পরবর্তী প্রতারণার জন্য প্রস্তুতি নেই। দেখি মানুষ কতটা গল্পের জন্য যুদ্ধ তৈরি করে। আমি কতটা যুদ্ধের জন্য গল্প তৈরি করি।
২৫.০৪.২০২০

শামীম রফিক
০১৯৩৩৩৩৪৫১৫


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন