নজরুল : কবিতার চেয়েও বড়

জগলুল আসাদ
কাজী নজরুল ইসলাম: কবি ও মানুষ
নজরুলের জীবন অনেক সময় তাঁর কবিতার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, আবার তাঁর জীবনের সাথে কবিতাকে মিলিয়ে পড়লে কবিতাও হয়ে ওঠে মহত্তর । কবি নজরুল তাঁর জীবনকে করেছিলেন বেদনার মতো টলোমলো, আনন্দের মতো চঞ্চলা ও অনিশ্চিত । নজরুলে নফসানিয়াত আর রুহানিয়াত, ধর্ম-অধর্ম, শাস্ত্র ও শাহাওয়াত মিলেমিশে থাকে । যার যা প্রয়োজন তা সে নিতে পারে নজরুল-ভাণ্ড থেকে। নজরুলের এই ইলাস্টিসিটি তাঁকে প্রিয়তা দিয়েছে পাঠক সমাজে।
নজরুলের বিশিষ্টতা হচ্ছে, তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। মিছিলে বিক্ষোভে ও প্রতিবাদে । পশ্চিমা নন্দনতত্ত্বকে কেবলা না করেই তিনি নির্মান করেছিলেন তার নিজস্ব শিল্পভুবন। বাংলাভাষার রমণীয় গীতিময়তার মধ্যে তিনি যোগ করেছেন পৌরুষ । কবিতায় তার ব্যক্তিগত হাহাকারও হয়েছে সকলের । নজরুলে দীর্ঘশ্বাস আছে, প্রার্থনার মত আকুল পংক্তি আছে, বিক্ষুব্ধ স্বর আছে, দ্রোহের অগ্নিও আছে, ভাষার তুর্কি নাচন আছে, ছন্দের গীতল ভঙ্গিও আছে। নজরুলে "উন্নত শির" আছে, আবার কলকাতার বাবু সমাজের কাছে মাঝে মাঝে "নতশির" সমর্পনের শা'আইর বা নিদর্শনও আছে । নজরূলে শুধু দুকূলপ্লাবী আবেগ নয়, মস্তিস্কের সুমিত ব্যবহারও আছে । বহুভাষার রসুইঘর তার কাব্যশরীর । নজরুল ময়দানের শ্লোগানেও ব্যবহার্য, ব্যক্তিগত নিভৃতিতেও সে সমান চিত্তহারী। একটুকরো অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে অনুসন্ধান করবার অভীপ্সা এখনো হাজির প্রথাবদ্ধ- বন্ধা কলমে । বহুমাত্রিক নজরুলের প্রত্যাশাও করে কাব্যমোদী । অশ্রুমতি ও প্রার্থনাকুল নজরুলের আকাঙ্ক্ষী আমি ; আমি উপভোগ করি তাঁর অশ্রু ও অগ্নি---উভয়ই।

প্রত্যেক কবিকেই মতাদর্শের চাপ সইতে হয়।নজরুলকে সইতে হয় সবচেয়ে বেশি। নিজ নিজ বাসনা অনুযায়ী নির্মিত হন একগুচ্ছ নজরুল। ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে দেখাতে হয়, নজরুল তাঁর কাব্যে ও গানে কী অপূর্ব মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন ইসলামের মর্মশাঁস ! কাব্যের রেটরিকের ঐতিহ্য না বুঝলে তাকে তাকফির-তাবদিও করা যায় সহজেই। মার্ক্সিস্টদের দেখাতে হয় নজরুল কীভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এক অগ্নিঝরা কন্ঠস্বর, কীভাবে নিপীড়িতের পক্ষে তিনি বিপ্লবের স্বপন বোনেন । নজরুলের বিখ্যাত অসাম্প্রদায়িকতার খরিদ্দারের সংখ্যা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যদিও একে সমস্যায়িত করবার চৌকস মেধা হাতে গোণা । রবীন্দ্রনাথকে হামদ-নাত লিখতে হয় নাই , নজরুল কিন্তু ভজন-কীর্তন লিখছেন, সর্বসম্প্রাদায়কে তিনি এক বুকে রাখতে পেরেছেন বলেই তিনি বাংলার মহা অসাম্প্রদায়িক কবি----অনেকের পছন্দ এভাবে বলাটা। নজরুল মোল্লা ও পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে বলবেন, এমত বাসনা অনেকের । কেউ হয়তো নজরুলের প্রেমের কবিতা ও গানের ভক্ত; প্রেমাকাংখা ও প্রেয়সীর রূপে বিভোর যে নজরুল,বুকের তলে জমে থাকা প্রেমতপ্ত বেদনা ও অশ্রুর রূপকার যে নজরুল, সেই নজরুলও প্রিয়, বড় এক অংশের কাছে। খন্ড খন্ড নজরুল অখন্ড নজরুলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী । প্রত্যেকেরই আছে টুকরো টুকরো নজরুল,যে নজরুলকে ভার বহন করতে হয় বিবিধ মতাদর্শের ও প্রেমাকুতির।

শুধু সুর ও ছন্দে মোহিত হয়ে থাকা,একটা চিত্রকল্পের সৌন্দর্যে বিহ্বল হয়ে থাকা কিংবা একটা অন্তমিলের তীব্র দ্যুতিতে মোহাবিষ্ট হওয়ার কাল বহুদিন হলো বিগত হয়েছে! সহজ আনন্দ, নিস্পাপ পাঠ বলে আর কিছু নাই ! তবুও মনে হয়,কবিতার প্রাণভোমরা গভীর জলাশয়ের কোন এক রুপালি কৌটায় কিভাবে যেন লুকিয়ে থাকে! ধ্বনি ও দ্যোতনা,ধরা ও অধরা,ভাষা ও ভাষাতীত,ভাব ও বাহনের যুগ্মতায় গড়া কবিতার প্রাণ ও শরীরের ঘ্রাণ কজনেই বা পায়!! আদি ও অকৃত্রিম, সহি ও আসল নজরুল বইলা কিছু নাই; যা আছে তা হলো পাঠকের প্রত্যাশার নজরুল ।'কেজো' শব্দের বিবিধ ব্যঞ্জনাকে স্মরণে রেখেই বলা যায়: কবি ও কবিতাকে শেষ বিচারে 'কেজো' হতেই হয়।প্রত্যেক পাঠকের নিজ নিজ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নজরুলের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আর জানাই সবাইকে ঈদ মুবারক। "রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ"। আমাদের কারো ঈদ যেনো নজরুল ছাড়া পূর্ণ হয়না, সে "সেকুলার" বা "স্যাক্রিড" যে পরিসরেরই হোক না কেন!

২৫.০৫.২০২০
ঈদ-উল-ফিতর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন