কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যের কবিতা
খুনে স্বভাবটা মানুষের ভেতর নানাভাবে কাজ করে-
উত্তেজিত মানুষের আচরণকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পারিপার্শ্বের থাকে না, যাদের থাকে
তারা মানুষ হিসেবে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। যে কোন ভিড় কিংবা জটলায় মানুষের উৎসুক মুখ
ঘটনার কেন্দ্রকে আবিষ্কার করতে চায়, কিন্তু ঘটনার কেন্দ্রকে আবর্তন করে যে পরিধি-
সেখানেও ঘটনার ঘনঘটা থাকে। কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কখনো কখনো এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে
লাগানোর দূরূহ চেষ্টা করা বোকামি মনে করতে পারে অনেকে- তাতে তর্ক আনা যেতে পারে,
বিতর্কে বসা যেতে পারে।
দ্বিতীয় ব্রাজিল- কাব্য, রূঢ়কাব্য! যতটা সচেতন
হয়ে স্বাদ গ্রহণ করতে যাবেন ততটা বিস্বাদে ভরে উঠতে পারে আপনার হৃদয়। পাঠের
গভীরতা সঞ্চয়ন করতে যাবার দুঃসাহস না করাই শ্রেয়- তার চেয়ে বরং সহজ পাঠে আগ্রহী
হোন, পাঠক হিসেবে সৎ থাকতে পারবেন বলে মনে করি। “নিষাদযাত্রা” কবিতাটার কথাই ধরুন লিস্ ঘিস্ থেকে আপনাকে যে
প্রত্নভ্রমণ করতে হবে সেটার পূর্বপাঠ না থাকলে মুশকিল হয়ে পড়বে। বলা হয়ে থাকে,
হোর্হে লুই বোর্হেস-এর কবিতা পাঠ করবার আগে লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ও দর্শন পাঠ
জরুরি- নতুবা পাঠক বিরক্তি নিয়ে সরে আসতে পারেন। বোর্হেস এমনই কবি, সৎ কবি-
আপোসের ধার ধারেননি। কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যও এরকম আপোসের ধার ধারেননি- ফলে বাংলা
কবিতায় কারো পাপোশ হননি। ফলে তাঁর কবিতা পাঠ করতে গেলে আপনাকে উত্তরাধিকার খুঁজতে
হবে না কিংবা পূর্বতন কারো প্রভাব খুঁজতে হবে না। কারণ ভবিষ্যৎ বর্তমানের ভেতর
দিয়ে যে অতীতে প্রথিত হতে পারে তা আপনি “ডায়নাকাফে” তে পেয়ে গেছেন- এ শিল্পদর্শনের চর্চা বাংলা
ভাষায় একেবারেই হয়নি, এটা হলফ করে বলতে পারি। শহীদুল জহির বাংলা উপন্যাস ও
ছোটগল্পে এটার প্রয়োগ ঘটিয়ে সফল হয়েছেন। তাঁর “কাঁটা” গল্পটিকে এর চরম উদাহরণ হিসেবে অনেকেই দাবি
করেন এবং সেটা সত্য হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠিত।
“দ্বিতীয় জ্ঞানবতী” কবিতাটা একটা ভৌগোলিক ক্যানভাস তৈরি করেছে-
ইনফ্যাক্ট পুরো “দ্বিতীয় ব্রাজিল” কাব্যটা আপনাকে ভূগোল ও ইতিহাসের একটা জার্নি তৈরি করে দেবে-
কিন্তু এ পর্যটনের অংশীদার হওয়া কঠিন, কারণ একটাই সাধারণ পাঠক শুধু লুতুপুতু
প্রেম কিংবা তত্ত্বের কারিকুরি অথবা শব্দের মারপ্যাচ খোঁজবার চেষ্টা করে এবং সেটা
কবিতায় পেয়ে গেলে তৃপ্তি ঢেঁকুর তুলে সবাইকে জানান দেন। সেটা “দ্বিতীয় ব্রাজিল”
কিংবা “ডায়নাক্যাফে”তে সম্ভব নয়, এখানে দীক্ষিত পাঠক বৈ সাঁতরানো কঠিন- কারণ
দক্ষ সাঁতারু ছাড়া স্রোতময়ী নদীতে নামা বোকামির শামিল।
“ভুটান বালিকা” কবিতাটি তুলনায় আনা যেতে পারে-
রাতের ক্যানভাস কতটা বৈশ্বিক হতে পারে তা ছোট্ট অঞ্চলকে দিয়ে বোঝানো যেতে পারে,
ইলিয়াসের কাৎলাহার বিল কিংবা মার্কেজের মাকোন্দো কিংবা বাঘারুর শীলবাড়ির দিকে
যাত্রা আপনাকে বিহ্বল করে তুলবে- “জল্পেশনামা” ও “প্রকৃতিপাঠ” আপনাকে আপ্লুত করতে
পারবে না- কারণ আপনাকে ও আপনার মধ্যবিত্ত সত্তাকে আক্রমণ করে সে ক্ষত-বিক্ষত করতে
চাইবে।
ছিলাম “দ্বিতীয় ব্রাজিল” ও “ডায়নাক্যাফে”
বিষয়ক এপিটাফ লেখায়- হ্যাঁ “ডায়নাক্যাফে” আপনার মতো সহজ পাঠককে ধাক্কা দিয়ে
জলে ফেলে দেবে- সাঁতরাতে না জানলে আপনি ডুবে যাবেন এবং বইটি ফালতু ও কৃষ্ণপ্রিয়
ভট্টাচার্য একজন এথনিক নৃবিজ্ঞানী বলে টেবিলের এক কোণে কিংবা বুক সেলফের কোন
কোণায় ফেলে রাখবেন অথবা বিরক্তির চরম রূপ দিয়ে সের দরে বিক্রিও করে দিতে পারেন!
তাতে “ডায়নাক্যাফে”-এর কিছু আসে যায় না- ফুটপাতের বইয়ের দোকানে শেক্সপিয়রও পরে
থাকেন!
পাবলো নেরুদার শেষ কাব্য “দ্য লাস্ট কোশ্চেন”
কিংবা মারিও ভার্গাস ইয়োসা’র কবিতার পাঠ আপনার থেকে থাকে কিংবা উমবার্তো একোর যে
কোন বই পাঠ করা থাকে তাহলে “ডায়নাক্যাফে” আপনার কাছে একটা স্বর্ণখনি হয়ে উঠতে
পারে, নতুবা “দ্বিতীয় ব্রাজিল” খুঁজতে আপনাকে লাতিন আমেরিকা যেতে হতে পারে!
রাহেল রাজিব
বিকেলশংকর//১৫ মে ২০২০
ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন