সুকান্ত-ভাবনা

সন্দীপক মল্লিক


এক ক্ষণজন্মা কবির জীবনঃ কতটুকু ...

ব্যক্তিজীবন শারীরিক-মানসিক-আত্মিক সত্তার বিন্যস্ত বিভাকেই লালন করে : আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিব্যাপ্তিতে হয় আবর্তিত-পরিবর্তিত-সংশ্লেষিত-বিশ্লেষিত। ব্যক্তিজীবন সত্য, সৌন্দর্য এবং কল্যাণ-অভিষিক্ত হওয়ার পরিবেশ-পরিবেশনায় হয় প্রভূষিত। তবে, গ্রহণযোগ্যতার তারতম্য-হেতু তার সত্যায়ত প্রগতিপন্ন  স্থিতির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। বস্তুতঃ ব্যক্তিজীবনের পূর্ণাভ প্রকাশ-বিকাশ, তার সর্বজনীন প্রভাববিস্তারকারী প্রসারণা - বৌদ্ধিক চলচ্ছক্তি - অন্য মানুষ এবং অন্য প্রাণি-উদ্ভিদ-বৃক্ষের সাত্বত ও শাশ্বত কল্যাণের উপায়-নির্ধারণ তার মননের পারাবতকে সম্পূর্ণতা দেয়।উপর্যুক্ত সম্পূর্ণতা-নির্দেশনার ভঙ্গি এ পৃথিবীতে বিচিত্র আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মত-মতবাদ তথা আধ্যাত্মিক প্রভুত্বধারণকারী  নীতি-বিধির আয়তনে সঞ্চয়িত হয়ে আছে। বিশ্বস্ত হয়ে আছে ইহকাল-পরকাল-ভাবনা এবং সেই অনুসারেই সংস্থিত হয়ে আছে অযুত-লক্ষ স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক-যৌক্তিক-অযৌক্তিক নিয়মের বিস্তৃতি !


১.
সুকান্ত ভট্টাচার্য(জন্ম : ১৫ আগস্ট, ১৯২৬ খ্রি. - মৃত্যু : ১৩ মে, ১৯৪৭ খ্রি.) ইহকালের মানবিক বৃত্ত - দৃশ্যদীপ্ত যৌক্তিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিপর্যয়-নিরাকরণকারী বাসনা-শক্তির এক রূপায়ণা। তাঁর মার্ক্সীয় মত-আশ্রয়ী কবিতায়ন-পরিকল্পনায় সংবৃত হয়েছে সত্তা-সত্যাকর্ষক শক্তিরই প্রলম্বন। তাঁর উজ্জ্বলতর উদ্ধৃতির আভরণ এমন :

    চলে যাবো - তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
    প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল..(‘ছাড়পত্র’, ছাড়পত্র)

অবধারিত মৃত্যু-অতিক্রমী এক জাগৃতি-শক্তির শোভিত রূপমা ছিলেন কবি সুকান্ত। প্রত্যক্ষ অশন-বসন-চিকিৎসা-সম্পূরক সাধনাকেই তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর লৈখিক সংহতিতে। ‘জঞ্জাল’ অর্থাৎ কুসংস্কার, কুপ্রবৃৃত্তি, অপ-বিধি, কূপম-ুকতা, অজ্ঞানতা, বকধার্মিকতা, শোষণ, বঞ্চনা, আত্মপ্রবঞ্চনা, হিংসা, দ্বেষ, বিবেকহীনতা, ক্রুরতা, নির্দয়তা, অদূরদর্শিতা, অ-প্রকাশনা, যুক্তিহীনতা, অবৈজ্ঞানিকতা, হীনতা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতাসহ প্রাণসংহারী সব অমানবিক গুণকে নিঃশেষ করার অর্থাৎ ‘সরিয়ে দেবার’ জন্যেই তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন এই বঙ্গজ পটভূমে - এই পৃথিবীতে।  তবে, সহগ হিসেবে উল্লেখ্য যে, অব্যর্থ প্রাকৃতিক দুর্যোগও  শঙ্কিত করে প্রাণিজগৎকে !

সুকান্ত মননপ্রদীপ্ত হয়েছিলেন, শপথসিদ্ধির ওজস্বী পরাগায়নে স্থিত হয়েছিলেন কলকাতার সাত্বত ও শাশ্বত মাঙ্গলিক চর্যায়তনে।   দারিদ্র্যক্লিষ্ট হলেও  বৈশ্বিক পঠন-পাঠনের সমাবর্তনে ছিলো তাঁর সম্পৃক্ততা। প্রথম মহাযুদ্ধ(১৯১৪ খ্রি.)-উত্তর বৈশ্বিক জীবন-নিগ্রহ, অস্থিরতা, মানবিক মূল্যবোধহীনতা, কৃষ্টি-ক্ষয়িষ্ণুতা ইংরেজ বৈশ্যতন্ত্রায়তনিক অপরাধ-প্রগাঢ়তায় ক্ষুব্ধ বঙ্গ-ভারতবর্ষীয় জন-আত্মার অনটনক্লিষ্টতা, পরাধীনতার গ্লানি, স্বাধিকার তথা স্বাধীনতাস্পৃহা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বোধকে পরিশীলিত করেছিলো। এমন তাঁর কবিতালাপ :

        আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস -
    আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
    প্রত্যয় দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।(‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’, ছাড়পত্র)

স্বদেশী শোষকগোষ্ঠীরও নিষ্ঠুর দলন-পীড়ন-শোষণের বৈপরীত্যে শ্রীশুদ্ধ হয়েছিলো যুগসম্বুদ্ধ কবির বাসনাবৃত্ত। সত্যসমুজ্জ্বল পর্যবেক্ষক এবং নিরীক্ষকরূপে তিনি হয়েছিলেন কবিতাশিল্পী। কবির লৈখিক উচ্চারণ :               
   
অবাক পৃথিবী ! আমরা যে পরাধীন
    অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন ..
    দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।(‘অনুভব’, ছাড়পত্র)

স্বার্থপরতার নির্দয় সজ্জা আড়ষ্ঠ করেছিলো উপমহাদেশীয় জনজীবনধারাকে। দেশী-বিদেশী শোষকের মিথ্যে-লালিত অপকীর্তি, তাদের প্রবৃত্তির আঁধার এবং অপভোগী কূটকৌশল জনমনকে করে তুলেছিলো ক্ষুব্ধ ! বিদ্রোহের যথাযথ আয়োজন এভাবেই জনমনকে আচ্ছন্ন করেছিলো। কবি অনুভব করেছিলেন :

বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে
    প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,   
           দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত..(ঐ)

অমৃত-আহ্বানী শক্তির ধারক যে তারুণ্যশোভা, তা নব-জাগৃতির  প্রণোদনা ও প্রেষণাকে আত্মঃস্থ করতে সমর্থ হয় এবং সার্বভৌম মঙ্গলের আধিকারিক-স্বারূপ্যকে লালন করতে প্রয়াসী হয়। সুকান্ত-সত্তার এমনই উর্বর অভিক্ষেপ :

           আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
         পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
          এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয় - (‘আঠারো বছর রয়স’, ছাড়পত্র)



২.
মূলতঃ সমুন্নত-‘শির’ নবীন তরুণ কবি সুকান্ত যুক্তি-জ্যোতির্ময় সত্যকেই উপলব্ধি করেছিলেন। শোষিত অর্থ-মান-যশহীন, সুবিধাবঞ্চিত অন্ত্যজ প্রান্তিক মানবগোষ্ঠীর সত্যায়ত প্রকাশ-বিকাশধারাকেই তিনি তাঁর ন্যায-উজ্জ্বল সৃজনশৈলীর মলূ-দীপ্তিরূপে গ্রহণ করেছিলেন। অপ্রাণিবাচক রূপশ্রীকেও তিনি সজীব প্রাণিবাচকতার ঐশ্বর্যে  শ্রীম-িত করেছিলেন। অখ- মানবিক আন্দোলনকে ত্বরান্বিত  করতে শিল্প-অবয়বকে সুস্থিত করেছিলেন।

‘দেশলাইয়ের কাঠি’ বা ‘সিঁড়ি’-র অবতারণা  এক নতুন শিল্পমগ্নতার অলঙ্কৃত মানবিক সজীবতারই তুল্যাঙ্করূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর কবিতাপটে। ভোগবাহারি ‘মোরগ’-এর রূপমাও এক মর্মসত্যের প্রসাদরূপে হয়েছে শোভিত। দরিদ্র, অনাহারী মৌলিক জীবন-উপভোগ-বঞ্চিত মানবগোষ্ঠীকেই কবি ‘দেশলাইয়ের কাঠি’ এবং ‘সিঁড়ি’রূপে নির্ধারণ করেছেন। গোষ্ঠীটির যথার্থ এবং নিরুপদ্রব পূর্ণায়ত প্রকাশ-ব্যবস্থাপনাই ছিলো কবির শিল্পসৃজনী মূল-মানদণ্ড।

তিনি ছিলেন আত্মনিবেদিত‘আঠারো বছর’-এর প্রোজ্জ্বল সত্যময় জীবনসৌন্দর্যম-িত সত্তার কবিতাময় শক্তি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন