ফরহাদ মজহার | ২০১৬-০১-০৮
এক
আলীম আজিজ
আমাকে যখন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কে লিখতে অনুরোধ করলেন, আমি টেলিফোনেই
বললাম, মার্কেস মস্তোবড় লেখক, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার প্রতি আমার বিশেষ উত্সাহ নেই।
তার পেছনে এখন সময় দেয়া কঠিন। কারণ সমান মাপের এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বড়
মাপের ঔপন্যাসিক ও গল্পকার বাংলা সাহিত্যে রয়েছেন। আমি তাদের ব্যাপারে আগ্রহী। বিদেশী
লেখকের প্রতি আমার কোনো বিরূপ মনোভাব নেই। কিন্তু আমাদের সাহিত্যিকদের নিয়ে আমরা ভালো
কিছু লিখিনি, লিখতে পারি না। কিন্তু বিদেশীরা কোনো কিছু নিয়ে হইচই করলে আমরাও মাতামাতি
শুরু করে দিই। আমি তারাশংকর কিংবা অমিয়ভূষণ মজুমদার নিয়ে লিখতে চাই, মার্কেস নিয়ে নয়।
তারাশংকর
অনেক বিশাল ঔপন্যাসিক। কিন্তু তাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। তার
সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আগ্রহও রয়েছে। তাকে নিয়ে বেন কনিসবি বায়েরের (Ben Conisbee
Baer) চমত্কার কাজ আছে। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ছাত্র বেন বায়ের বাংলাদেশে এসেছিলেন।
তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আর কাকে নিয়ে তার কাজ করার ইচ্ছা আছে। তার উত্তর ছিল, আখতারুজ্জামান
ইলিয়াস। আমি অবাক হইনি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো সাহিত্যিক নিয়ে কেউ কাজ
করতে চাইলে ইলিয়াসের নামই আসবে। ইলিয়াসের কাজের আন্তর্জাতিক চরিত্র রয়েছে, যা যেকোনো
বিদেশী পাঠককে আকৃষ্ট করে। উপন্যাসে ইতিহাস কীভাবে ব্যবহার হয়, সেদিক থেকে ইলিয়াসের
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভাবায়। হুমায়ূনের ইতিহাস ব্যবহার ভালো, কিন্তু উপন্যাসের প্রচলিত
ধরন থেকে তা আলাদা কিছু নয়। তুলনায় ইলিয়াসের সাহিত্যে ইতিহাস ও চরিত্র উভয় বিষয়ই আমাদের
নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। হুমায়ূনের ইতিহাস চরিত্রগুলোর অবলম্বন হিসেবে হাজির থাকে,
তারা ইতিহাসের বাইরে যায় না। এমনকি অ্যাবসার্ড চরিত্রটিও নয়। ইলিয়াস সম্পর্কে এ কথা
খাটে না। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ পড়ার পর ইলিয়াসের চরিত্রগুলোর
মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবার তাগিদ তৈরি হয়।
ইলিয়াসের
মন্দ দিকটা হচ্ছে ইলিয়াসের ভাষা কাব্য দ্বারা আক্রান্ত; গল্পের চেয়েও বাক্য এখানে প্রধান।
ফলে গল্পের সূত্র পাঠক হারিয়ে ফেলেন। তুলনায় হুমায়ূন আহমেদ গল্পকার। আমি হুমায়ূনকে
যে কারণে বিশেষভাবে পছন্দ করি সেটা হলো, গল্প বলতে গিয়ে প্রতি বাক্যে কবিতা রচনা ঠিক
নয়, এটা হুমায়ূনের চেয়ে ভালো কেউ বুঝেছে বলে আমার জানা নেই।
স্বীকার
করি, সাহিত্য বা শিল্পকলা মাপামাপির বিষয় নয়। মার্কেস সম্পর্কে আমার মন্তব্য পাঠক হিসেবে
নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের স্বার্থে। আসলে বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব বিকাশের একটা ইতিহাস
আছে। সেদিক থেকে এরই মধ্যে তার নিজের কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়েছে, যাকে সাহিত্যচর্চার
জায়গা থেকে শনাক্ত করা দরকার। সে চেষ্টা আমরা করেছি বলে মনে করি না। শনাক্ত করা গেলে
বাংলা সাহিত্য আরো শক্তিশালী জমিনের ওপর দাঁড়াতে পারত। এ কাজটা নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা
করিনি। এর প্রয়োজনও বুঝি না। এখন অনেক তরুণ লেখক যেভাবে লাতিন আমেরিকার ‘জাদু বাস্তবতা’ অনুকরণ করার চেষ্টা করে, সেটা ক্যারিকেচার হয়ে ওঠে।
ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ও এ দোষে খানিক দোষী
বলে মনে হয়। তথাকথিত ‘জাদু বাস্তবতা’ আমরা নকল করার আগ্রহ
বোধ করেছি। কারণ লাতিন সাহিত্যের হাত ধরে ব্যাপারটা এখন আন্তর্জাতিক সাহিত্যালোচনার
কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাফল্য আমাদের মধ্যে হীনম্মন্যতারও
জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। আমরাও তার মতো লেখার চেষ্টা করি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের নিজের
জমিন ও ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে কীভাবে জাতীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে হয়, সেটা আমরা
রপ্ত করিনি। রপ্ত করার চেষ্টাও করি না বা করছি না। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আমি মনে করি, তারাশংকর
বন্দ্যোপাধ্যায় বড় মাপের ঔপন্যাসিক। তাকে আশ্রয় করে বাংলা উপন্যাস বহুদূর এগিয়ে যেতে
পারে; যা বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ করে সম্ভব নয়। তাই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসে আমার
উত্সাহ নেই। আন্তর্জাতিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আমার এক নম্বর আগ্রহ তারাশংকরে। উপন্যাসে
যদি কাউকে নকল করে নবিশি পর্যায় অতিক্রম করার দরকার হয়ে পড়ে, তবে সেটা তারাশংকর। তারাশংকরকে
আমি মার্কেসের মতোই আন্তর্জাতিক স্তরের লেখক বলে মনে করি। শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়।
কেন আমি
এ রকম মনে করি, তারাশংকরের সাহিত্য আলোচনা করে সেটা আজ ব্যাখ্যা করব না। কিংবা লাতিন
লেখকদের সঙ্গে তুলনা করে আমি এখানে কোনো যুক্তিতর্কও হাজির করতে চাইছি না। কিন্তু তাই
বলে একে নিছকই আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার বলে গণ্য করার কোনো কারণ নেই। এ কথার
পক্ষে আমার বলার কথা হলো এই যে, জাদু বাস্তবতার মুন্সিয়ানাটা কাব্যিক; সেটা উপন্যাস
বা গল্পের বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু যেখানে উপন্যাস তার নিজের পরিমণ্ডলে স্রেফ গল্প হিসেবে
হাজির, সেখানে কল্পনা, ইতিহাস ও বাস্তবতার সন্ধিক্ষেত্রগুলো তারাশংকরে সমান দক্ষতার
সঙ্গে এসেছে। এমনকি অনেক সময় দার্শনিক বিবেচনার দিক থেকে তুরীয় মুহূর্তগুলোকে ধরতে
চেয়েছে, যা আমাদের ভাবনার গোড়া ধরে ঝাঁকি দেয়।
ইতিহাস
ও সমাজতত্ত্বের সাহিত্যিক পর্যালোচনা বিচার করলে আমার দাবি, ‘গণদেবতা’ আন্তর্জাতিক সাহিত্যের মানদণ্ডে একটি অসাধারণ উপন্যাস।
যদি উপকথা ও জাদু বাস্তবতার প্রসঙ্গ এর সঙ্গে যুক্ত করি, তাহলে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথার’ সমান পর্যায়ের অন্য
সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিংবা ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ ইত্যাদি।
ব্যক্তিগতভাবে
তারাশংকরের যে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে আমার পছন্দ, সেটা হলো ‘রাইকমল’। এর কারণ হচ্ছে সাহিত্যে দার্শনিক প্রশ্ন উপস্থাপনের
ভঙ্গির জন্য। রাই কিশোরী বয়সে ফুল তুলতে গিয়েই আমকে প্রশ্ন করছে, যে ফুলে ভ্রমর মধু
খায়, সে ফুলে কৃষ্ণপূজা হয় কিনা। যিনি কৃষ্ণ কিংবা জগত্প্রভু, তিনি যদি পরমার্থ হন— অর্থাত্ ভাবের স্বামী— তাহলে এ শরীর তো শুধু
তারই। এর অধিকারী তো জগতে আর কেউ হতে পারে না। রাই যাকে স্বামী হিসেবে তার আধ্যাত্মিক
জগতে স্বীকার করে নিয়েছে— প্রাণে দেহে সে যার সঙ্গে একাকার— তার সঙ্গে বাস্তবের স্বামীর কোনো ফারাক সে করে না। শরীরের সঙ্গে আমাদের
সম্পর্ক নিয়ে এর চেয়ে ভালো উপন্যাস আর কোথাও আছে কিনা আমার সন্দেহ। মনের আর বাস্তবের
দ্বন্দ্ব রাইকমল কীভাবে মীমাংসা করল? পারল কি? বাংলা সাহিত্যের বড় বড় সব লেখকেরই লেখা
আমি পড়েছি। কিন্তু তারাশংকর সম্পর্কে আমার অবস্থান বদলায়নি।
এবার গাব্রিয়েল
গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কে কিছু কথা বলে শেষ করব।
দুই
গাব্রিয়েল
গার্সিয়া মার্কেস। গাবো। তার সম্পর্কে ভেবেচিন্তে বলতে পারার মজুমদারি দাবি করি না।
তন্ন তন্ন করে তাকে পড়িনি। কিন্তু তারাশংকর সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছি, তাকে দৃঢ় করার
জন্য যতটুকু পড়ার পড়েছি। একটা মুগ্ধতা আছে, সেটা পর্যালোচনার নয়, সেটা খানিক বিস্ময়
আর খানিক ঈর্ষার। ফলে এখানে আমি তা একান্তই মন্তব্যমূলক ধরে নিলে অসুবিধা নেই। কিন্তু
ভেবেচিন্তেই বলা।
লিখাটি
লিখতে গিয়ে আমি ভাবছিলাম, তাকে পড়ার আগ্রহ বোধ করেছিলাম কেন? স্বীকার করতে দোষ নেই,
তার খ্যাতি। ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ১৯৬৭ সালে বেরোনোর পর থেকেই তিনি বিখ্যাত। আর ১৯৮২ সালে যখন নোবেল পেলেন,
তখন তার ভাগ্যরাশি তুঙ্গে।
তবু এ লেখা
লেখার সময় ভাবছিলাম, আসলে কি খ্যাতিই একমাত্র কারণ? এখন মনে হচ্ছে, বোধ হয় না। তার
যে বইটি সবার আগে পড়েছি, সেটা হলো ‘কলেরার কালে প্রেমের কেচ্ছা’। এটা তার মা-বাবার প্রেমের গল্প। গাবোর বাবা ফার্মাসিস্ট ছিলেন। বইটি
পড়ে খুব মজা পাচ্ছিলাম। আমি নিজে পেশায় ফার্মাসিস্ট। তাই বারবার গাবোর বাবার সঙ্গে
নিজে মিলে যাচ্ছিলাম।
অস্বীকার
করার জো নেই যে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একালের দুর্দান্ত শক্তিশালী লেখক। যেকোনো
গল্পকারের জন্য ঈর্ষণীয় মানুষ। তার ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’
পড়ার সময় বারবার মনে হয়েছিল, কবিতার বই পড়ছি। গল্পের বুনুনির প্রতি মনোযোগের ঝোঁক ছুটে
যাচ্ছিল। বারবার বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেল পাঠের নিষ্ঠা ভেঙে দিচ্ছিল। এটা নতুন ধরনের
অভিজ্ঞতা। একবার গাবোর লেখা সম্পর্কে এক মার্কিন সমালোচকের মন্তব্য পড়ছিলাম। লিখেছেন,
মার্কেস খুব মজার লেখক। কারণ একই প্যারাগ্রাফে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল’ আর ‘মান্ডেইন’ বিষয়কে
একাকার করে দিয়ে লিখতে মোটেও অস্বস্তি বোধ করেন না। ‘স্পিরিচুয়াল’ কথাটার ব্যবহার মজা
লাগল। আসলে ‘অলৌকিক’ যা একই সঙ্গে আমাদের চিন্তার অস্পষ্ট ক্ষেত্রগুলো নাড়িয়ে দিয়ে
যায়, সেই অর্থে। ‘মান্ডেইন’ মানে দৈনন্দিনের লড়াই-সংগ্রামের বাস্তবতা; যেখানে আমাদের
কল্পনা, সংকল্প আর বাস্তবতা এমনভাবে মিশে যায়, যেখানে একটিকে আর অন্যটি থেকে আলাদা
করে চেনা যায় না। মন্তব্যটি ভালো লেগেছিল ‘জাদু বাস্তবতা’ নামের চটকদার ধারণার চেয়ে
এটা সহজ। কিন্তু যেকোনো ভালো গল্প বা উপন্যাসেরই এ গুণ থাকে। জাদু বাস্তবতা গাব্রিয়েল
গার্সিয়া মার্কেসের নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু একটি চটকদার ধারণা যখন একবার চালু
হয়ে যায়, তখন সেটা বাদাম খাওয়ার মতো খোসা ভাংতে ভাংতে খাওয়া চলতে থাকে। একসময় বিট লবণ
শেষ হয়, তখন বাড়তি জিনিস ধরা পড়ে। বাদাম খেতে তখন বাদামের মতোই লাগে।
আচ্ছা,
বিট লবণ কথাটা এখন হঠাত্ মনে এল কেন? দেখি যে, বাদামওয়ালারা বাদামের ঠোঙা এগিয়ে দেয়ার
সময় লালচে ধরনের লবণ দেয়। ঠিক, এটা বাদামের স্বাদ বদলে দেয়। কিন্তু বাদাম খাওয়া আর
বিট লবণ খাওয়া তো এক কথা নয়। যারা বাদাম খেতে চান, তারা বাড়তি কিছু খেতে চান না। ঔপন্যাসিকও
পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য বাড়তি অনেক কিছুই করেন। কিন্তু বড় লেখকদের লেখালিখির নিজস্ব
কিছু স্বাদ আছে, যা বাড়তিকে বাদ দিয়ে গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া
মার্কেসকে কেন্দ্র করে ‘জাদু বাস্তবতা’ নামের যে ধারণাটি গড়ে উঠেছে, তা এ বিট লবণের
মতো। এটা বাদ দিয়েই তার উপন্যাসের স্বাদ নিতে হবে।
নোবেল পুরস্কার
গ্রহণ করার সময় গাবো যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে তার দাবি ছিল, কল্পনা ও বাস্তবতার
মিশেল দেয়ার অভ্যাস লাতিন আমেরিকার পুরনো রীতি। নতুন কিছু নয়। এমনকি তার দাবি, এ ‘পাগলামি’
স্পানিশ আগ্রাসনের সঙ্গে আমদানি হয়ে এসেছে, লাতিন আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পরও যে পাগলামি
ছাড়তে পারেনি। বক্তৃতায় তিনি ফ্লোরেন্সের এন্টনিও পিগাফেটারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন;
তার লগবুক দিয়ে। এন্টনিও পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ মাগেল্লানের (১৪৮০-১৫২১) জাহাজে
করে দুনিয়া ‘আবিষ্কার’ করার সঙ্গী হয়েছিলেন। মাগেল্লান ১৫১৯-২২ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিজ
আবিষ্কারে যাওয়ার সময় এন্টনিও সঙ্গে ছিলেন।
এন্টনিও
পিগাফেটার তার লগবুকে লিখেছেন যে, তিনি যখন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ অতিক্রম করছেন, তখন
তিনি এমন সব শূকর দেখেছেন, যাদের মাতৃনাড়ি নিচের পেটের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেটা পিঠে।
প্রাণীদের নাভি পেটে না হয়ে পিঠে হওয়া এক কল্পনা বটে! এন্টনিও এমন সব পাখি দেখেছেন,
তাদের কোনো পা নেই। শুধু তা-ই নয়, মেয়ে পাখিগুলো ডিম পাড়ছে পুরুষদের পিঠে। বিশাল সব
মাছখেকো সামুদ্রিক পাখি মাছের জন্য উড়ছে, কিন্তু তাদের কোনো জিহ্বা নেই। তাদের ঠোঁট
চামচের মতো। দারুণ কল্পনা!
এন্টনিওর
লগবইয়ে লেখা আছে, তিনি এমন জন্তু দেখেছেন, যার মাথা আর কান খচ্চরের মতো; খুরগুলো হরিণেরই
খুর, শরীর উটের আর ডাক অশ্বের হ্রেষার মতো কানফাটা। পাতাগনিয়ায় প্রথম যখন এন্টনিওরা
একজন স্থানীয় অধিবাসীর মুখোমুখি হয়েছেন, তখন তাদের সামনে তারা একটি আয়না তুলে ধরে।
বিশাল বপুর মানুষটি নিজেকে দেখে আঁতকে উঠেছিল। জাদু বাস্তবতা তো এভাবেই স্প্যানিশ সামুদ্রিক
আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকায় আমদানি হয়েছে।
মার্কেসের
বক্তৃতার মধ্যে ‘জাদু বাস্তবতা’ নামের আবিষ্কারের প্রতি একটা শ্লেষ ছিল। ভাবখানা এমন
যে, এটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, এটা জাহাজে করে সেই কবেই তো আমদানি
হয়ে এসেছে। বরং মার্কেসের লেখায় সবসময়ই এক গভীর রাজনৈতিক বয়ান হাজির থাকে। আমরা টের
পাই, কল্পনা ও বাস্তবতার বিচিত্র মিশেলের সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা, আগ্রাসন ও যুদ্ধবিগ্রহের
একটা যোগ আছে। কিন্তু সেটা কখন কীভাবে সংক্রমিত হয়েছে, মার্কেস সেটা স্পষ্ট করে কোথাও
বলেন না। কিন্তু এটাই তার রচনার বৈশিষ্ট্য। জাদু বাস্তবতা নামের অরাজনৈতিক, অনৈতিহাসিক
ও সাহিত্যসর্বস্ব কের্দানি নয়।
জাদু বাস্তবতা
নামের ধারণার বিরুদ্ধে অনেকে নানা কারণে আপত্তি জানিয়েছেন। মার্কেসের রচনা পড়তে গিয়ে
আমার আপত্তিটা দানা বেঁধেছে একে একটি বিশেষ ‘ধরন’ (মবহত্ব) বা সাহিত্যিক কের্দানি হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করার খামাখা প্রচেষ্টার কারণে। এ দিয়ে মার্কেসকে বোঝা যায় না। প্রথমত. আমরা
ভুলে যাই, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আদতে একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা কিংবা সংবাদমূলক
তথ্য মার্কেস যেভাবে ব্যবহার করেন, তার তুলনা পাওয়া ভার। তার কল্পনা বা ফ্যান্টাসি
এ তথ্য বা তথাকথিত ‘বাস্তবতা’র ওপর দাঁড়িয়ে এমন সংবেদনা তৈরি করে, যাকে ‘জাদু’ কিংবা
‘বাস্তবতা’ দুটির একটিও ভাবা যায় না। ‘জাদু বাস্তবতা’ নামের ধারণার অস্পষ্টতাকে সেটা
বরং আরো অস্পষ্ট করে তোলে।
সম্ভবত
১৯২৫ সালের দিকে জাদু বাস্তবতা নামের ধারণাটির প্রচল ঘটিয়েছিলেন ফ্রানত্জ রোহ (১৮৯০-১৯৬৫)।
কিন্তু সেটা উপন্যাস সম্পর্কে নয়। ফ্রানত্জ ছিলেন ফটোগ্রাফার ও ছবির সমালোচক। ইউরোপে
একসময় শিল্পীরা নিজেকে কীভাবে প্রকাশ করছেন, সেই ব্যক্তিক দিকটা প্রধান গণ্য করে একটা
শিল্প আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইউরোপ, বিশেষত জার্মান শিল্পীদের মধ্যে এর একটা জোরালো প্রকাশ
ঘটে। এটা এক্সপ্রেশনিজম নামে খ্যাত। ব্যক্তির ইচ্ছা, কল্পনা, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি প্রাধান্যের
বিপরীতে আবার পাল্টা প্রতিক্রিয়াও গড়ে ওঠে; যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা কল্পনা,
ফ্যান্টাসির বাইরে বাস্তব জগেক শিল্পকর্মে গ্রেফতারের আয়োজন চলে। এক্সপ্রেশনিজমের পর
এ পোস্ট-এক্সপ্রেশনিজমের পর্যালোচনা করতে গিয়েই ফ্রানত্জ রোহ ‘ম্যাজিক’ আর ‘রিয়েলিজম’-এর
সন্ধি বোঝাতে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম কথাটার চল করেন। কল্পনা আর বাস্তবতা যেখানে হাত
ধরাধরি করে চলে, কিংবা এমনভাবে হাজির হয়, যাতে তাদের অবিচ্ছেদ্য ভাবা ছাড়া আর কোনো
উপায় থাকে না।
আসলে যেকোনো
সাহিত্য বা শিল্পকর্মের মধ্যেই এ গুণ কমবেশি থাকে। আসলে শিল্পী বা শিল্পের মুন্সিয়ানা
কীভাবে দুইয়ের সন্ধিকে প্রকাশ করে, সে কংক্রিট ব্যাপারটিকে কোনো সাধারণ তত্ত্বে পর্যবসিত
করা বিপজ্জনক; যে কারণে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম দিয়ে বোঝার
চেষ্টা করার অর্থ আগেভাগেই তাকে না বোঝার জায়গায় দাঁড়ানো। কল্পনা ও বাস্তবতা (কিংবা
কল্পনা বা ফ্যান্টাসির সঙ্গে গাবোর বিশেষ ধরনের সাংবাদিকতা বা ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপনের
ধরন সাহিত্যে নতুন ধরনের ফেনোমেনা, যা বোঝার জন্য আগাম কোনো তত্ত্বের দরকার পড়ে না।
এর জন্য দরকার স্রেফ সনিষ্ঠ পাঠ; কোনো প্রকার তত্ত্ববাগীশতা নয়।
তত্ত্ববাগীশতার
মূল্য নেই তা নয়। কিন্তু সেটা সাহিত্যের নয়, দর্শনের বিষয়। সে বিষয়ে আমি এখানে এখন
আর আলোচনা করতে চাইছি না। সেদিক থেকে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আমাকে দর্শনের জায়গা
থেকেও ভাবিয়েছে। সেটা অস্বীকার করার জো নেই। এখানে তা বিস্তৃত ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।
আসলে তারাশংকর
বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) নিয়েই আমার মন্তব্য। গাবোকে দূর থেকে সেলাম জানাতে পারলেই
আমি খুশি। কিন্তু তারাশংকর ছাড়া আমাদের চলবে না। এ কথাটিই শুধু এখানে বলতে চেয়েছি।
৪ জানুয়ারি
২০১৬। ২১ পৌষ ১৪২২। আরশিনগর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন