রবীন্দ্রনাথের প্রেম, রবীন্দ্রনাথের নিঃসঙ্গতা
শনিবারের চিঠি উৎসর্গ: শনিবারের চিঠি’র
প্রেমিকাদের , যাঁরা কবিতার মতোই নান্দনিক এবঙ নিঃসঙ্গতার
মতোই শাশ্বত।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে
একটি ধারাবাহিক লেখার সূচনা করেছিলাম ১৪১৮ সালে, রবীন্দ্র মহাপ্রয়াণ দিবসের
প্রক্কালে; ইচ্ছে ছিলো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা পুরোটা শেষ করবো এবঙ বেশ
তৃপ্তিবোধ করবো, আলোড়িত হবো এই ভেবে যে- আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছি, এবঙ
প্রশ্ন করেছি তাঁকে, চেষ্টা করেছি তাঁকে বিব্রত করে তোলবার এবঙ শেষ পর্যন্ত আমি
সুখী হয়েছি, আমার রক্তকণিকাগুলো হীরকখণ্ডের মতো দীপ্তি ছড়িয়ে সুখী হয়েছে। আমি এবঙ
আমার সত্তা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু করা হয়নি সেটা। মহাপ্রয়াণের সুর মহামহিমায় সরোদে তোলা ছিলো- হয়তো এই দিনটির
জন্য, এই সময়টির জন্য- পঁচিশে বৈশাখের কয়েকদিন আগের এই মুহূর্তটির জন্য। ১৪১৮ এর
শনিবারের চিঠি বদলে গেছে, সবাই বদলায়, তখনকার চেয়ে এখন হয়তো আরও একটু এগিয়েছে
শনিবারের চিঠি, কিঙবা পিছিয়েছে- অতএব তখনকার বোধ কিঙবা আবেগের সাথে এখনকার
উপস্থাপনা না-ও মিলতে পারে।
যেমন, ‘ভগ্নহৃদয় কাব্য’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বউদি কাদম্বরী দেবীকে একটি কবিতার মাধ্যমে ‘তোমারেই
করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। ১৮৮০ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘ভারতী’তে এটি ছাপা
হয় কবিতা হিসেবে। কিন্তু তার তিন মাস পরে এটি প্রথম গাওয়া হয় মাঘোৎসবের সময়ে,
ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবে। দু-এক পঙক্তির কেবল পরিবর্তন করতে হয়েছিল মূল কবিতার।
তবে তার প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবঙ আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি। তিনি
বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি,
বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন
উদারপন্থি বলে। রবীন্দ্রনাথ তার থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার
কবরটির সংস্কার করা দূরে থাকে, কেনসাল গ্রিনে গিয়ে একবার দেখেও আসেননি বলে মনে হয়।
সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দ্বারকানাথের সব ব্যবসায়িক
কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এহেন রুচি ছিলো তার! তার
প্রেম হলো :কামগন্ধ নাহি তায়।
কিন্তু নারীদেহের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না, তার প্রশঙসা করেননি, তা
দিয়ে আকৃষ্ট হননি, তা নয়, অথবা প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগাযোগ নেই এমন অসম্ভব কথাও
তিনি বলেননি। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো
কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু
আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি
নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেখতে পাই দেহের পরাজয়।
তিনি দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ইউরোপীয়দের মতো,
তাঁর মধ্যে কোলকাতার সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবারের সদস্য। সবার ওপর, তাঁর পরিচয়,
তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সবকিছু মিলে তিনি কতো নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন,
আজ শত চেষ্টা করলেও তা আর জানা যাবে না।
তবে তার প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবঙ আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি। তিনি
বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি,
বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন
উদারপন্থি বলে। রবীন্দ্রনাথ তার থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার
কবরটির সংস্কার করা দূরে থাকে, কেনসাল গ্রিনে গিয়ে একবার দেখেও আসেননি বলে মনে হয়।
সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দ্বারকানাথের সব ব্যবসায়িক
কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এহেন রুচি ছিলো তার! তার
প্রেম হলো :কামগন্ধ নাহি তায়।
কিন্তু নারীদেহের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না, তার প্রশঙসা করেননি, তা
দিয়ে আকৃষ্ট হননি, তা নয়, অথবা প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগাযোগ নেই এমন অসম্ভব কথাও
তিনি বলেননি। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো
কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু
আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি
নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেখতে পাই দেহের পরাজয়।
তিনি দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ইউরোপীয়দের মতো,
তাঁর মধ্যে কোলকাতার সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবারের সদস্য। সবার ওপর, তাঁর পরিচয়,
তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সবকিছু মিলে তিনি কতো নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন,
আজ শত চেষ্টা করলেও তা আর জানা যাবে না।
বিয়ের পর কাদম্বরীকে লেখাপড়া শিখিয়ে জ্যোতির উপযুক্ত করে তোলার সূচনা হয় তখন
থেকেই। তিনি আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছিলেন খুবই কম। কিন্তু সে তুলনায় শিখেছিলেন
অনেক বেশি। রীতিমতো সাহিত্যের সমঝদার হয়ে উঠেছিলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে বড়ো
হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। তিনি ছিলেন একটু বন্ধুত্ব, একটু ভালোবাসার কাঙাল।
সেই একাকী, নিঃসঙ্গ কালো হরিণ চোখ মেয়েটি হঠাৎ বাইরের বাড়ি থেকে অন্তঃপুরে উপস্থিত
হলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনও তাঁকে আগে দেখেছেন বলে জানা যায় না। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স
মাত্র সাত, কাদম্বরীর থেকে এক বছর নয় মাসের ছোটো। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই স্নেহের
প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ এবঙ হীনমন্যতায় কাতর ও নিঃসঙ্গ কাদম্বরী দুজন দুজনের খেলার
সাথি হয়ে উঠলেন। বালক রবি স্কুল থেকে ফিরেই তার ঘরে উপস্থিত হতেন। ধীরে ধীরে
দু'জনই কৈশোরে পৌঁছে গেলেন। তাদের বন্ধুত্বের চরিত্র খানিকটা বদলে যেতে আরম্ভ
করল। সেই ভালোলাগা, ভালোবাসা নানা পর্যায়ে নানা রূপে প্রকাশ পেয়েছে। কাদম্বরী
দেবীর আগেই বলেছি সাহিত্যে ছিলো কৌতূহল। তিনি রবির সাহিত্য-সঙ্গিনীতে পরিণত হলেন।
তার বিশেষ আগ্রহ ছিলো কাব্যে, গানে, উপন্যাসে। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার মাপে নয়, তিনি
ছিলেন সত্যিকার সাহিত্য-রসিক। ভালোভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের রস
আস্বাদন করতে শিখেছিলেন। সেই রস গ্রহণের ক্ষমতাই তিনি সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন
স্নেহের দেবরের মধ্যে। সাহিত্য-সঙ্গীত নিয়ে তারা একটি নিজেদের কুঞ্জ সাজিয়েছিলেন।
সেখানে মাত্র একজন লেখক, পাঠকও একজনই। কাদম্বরী দেবী চাইতেন না, রবির লেখা
সত্যিকার পরিণত হওয়ার আগেই, তা প্রকাশিত হোক, অন্য কেউ পড়ূক। এ শুধু তাদের দুজনার।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা যতোই পরিণত হতে আরম্ভ করলো, তিনি ততই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন
আত্মপ্রকাশের জন্য। রবি আর একমাত্র কাদম্বরী দেবীর থাকলেন না। পাঠককুলের হয়ে
উঠলেন। এটা কী রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠুরতা! সেই নিষ্ঠুরতার ক্ষত ঢাকতেই কি তিনি ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন?
কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে
পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময়
কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে
নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে
প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে একমাত্র খেলার সাথি আর বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন।
আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় জুত হলো না, সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, তাকে বিলেতে
পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা
করবেন। আর, তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে আহমেদাবাদ
যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে, আগস্ট
মাসে গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসেবে থাকেন আত্মারাম পাণ্ডুরঙের পরিবারে। তিনি
ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে, কাদম্বরী ছাড়া, এই প্রথম তিনি কোনো নারীর সান্নিধ্যে এলেন। ইঙরেজি ভাষা,
বিশেষ করে ইঙরেজদের সঙস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট
সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পাণ্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন,
তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা
তরখড়। তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইঙরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন
রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার
দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইঙরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরঙ কবিতা
লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন।
মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথি এবঙ
এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী বছর দশেক নিবিড় সান্নিধ্যে
এসেছিলেন একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নবনব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম
পরিবর্তন এসেছে। আনার সঙ্গে সে রকমের কোনো ঘনিষ্ঠতা হলো না। তবে 'নলিনী' যে তাঁর
হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও
পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর
অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতোটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন
আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [১.১.১৯২৭] :
কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে
পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময়
কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে
নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে
প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে একমাত্র খেলার সাথি আর বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন।
আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় জুত হলো না, সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, তাকে বিলেতে
পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা
করবেন। আর, তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে আহমেদাবাদ
যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে, আগস্ট
মাসে গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসেবে থাকেন আত্মারাম পাণ্ডুরঙের পরিবারে। তিনি
ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে, কাদম্বরী ছাড়া, এই প্রথম তিনি কোনো নারীর সান্নিধ্যে এলেন। ইঙরেজি ভাষা,
বিশেষ করে ইঙরেজদের সঙস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট
সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পাণ্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন,
তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা
তরখড়। তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইঙরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন
রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার
দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইঙরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরঙ কবিতা
লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন।
মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথি এবঙ
এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী বছর দশেক নিবিড় সান্নিধ্যে
এসেছিলেন একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নবনব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম
পরিবর্তন এসেছে। আনার সঙ্গে সে রকমের কোনো ঘনিষ্ঠতা হলো না। তবে 'নলিনী' যে তাঁর
হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও
পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর
অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতোটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন
আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [১.১.১৯২৭] :
এ থেকেই বোঝা যায়, ভালোবাসাকে দৈহিক করে তোলার মতো স্থূল রুচি তাঁর গড়ে ওঠেনি।
তাঁর বউদিকে তিনি তেমন করে ভালোবাসতেন বলেই মনে হয়। সাত বছর বয়স থেকে তাঁর খেলার
সাথি! সখী, বন্ধু।
আনার সঙ্গে ভালোবাসা অঙ্কুরিতো হয়েছিলো। পল্লবিত হয়নি। কিন্তু আনা অথবা
রবীন্দ্রনাথ কেউই নলিনী নাম কখনো ভোলেননি। 'নলিনী' নামে গান লিখেছেন, কবিতা
লিখেছেন। নাটক লিখেছেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মনে রেখেছেন। এ তো প্রেমই। আনাও যে
তাঁকে ভালোবেসেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবারের কাছে বিয়ের কথাও
বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে চলে যান। এরপর দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান
হয়েছিলো কি-না, তার সঠিক খবর আমাদের জানা নেই।
এরপর রবীন্দ্রনাথ লন্ডন হয়ে যান ব্রাইটনে। তিনি মোটেই ভালো লাগাতে পারেননি নিয়ম আর
পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগতো কেবল ইঙরেজির
অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। ভর্তি হয়ে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কলেজের
সামনের দিকের রাস্তায়, রিজেন্টস স্ট্রিটে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অতিথি হিসেবে
বাস করতে আরম্ভ করলেন ডাক্তার জন স্কটের বাড়িতে।
তিনি ‘ইউরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ এ পরিবারের যে পরিচয় দিয়েছেন
তা অনেকটাই বানানো। সাহিত্যিকরা বানিয়ে বলতেই পারেন, এতে কোনো দোষ নেই। নামগুলো
সবই বদলে দিয়েছেন। একটা প্রশ্ন তখন উঠতেই পারে- কীভাবে সেটা এ তথ্যটা জানা যায়
১৮৭১ আর ১৮৮১ সালের লোকগণনার প্রতিবেদন থেকে। সে বাড়িতে সার্জন জন স্কট ছাড়া আরও
ছিলেন তার স্ত্রী, মেরী, তাদের তিরিশোর্ধ্ব কন্যা, সাতাশ বছর বয়সী মেয়ে ফ্যানি, আর
পঁচিশ বছরের কন্যা লুসি। গৃহভৃত্য ছিলো দু'জন। স্কট পরিবারে একটি পুত্রও ছিলো
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়ো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো পরিবারের ছোট দুই
মেয়ে ফ্যানি আর লুসির।
রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে
লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো এই মেয়েটির
প্রতি। লুসি তাঁর কাছে বাঙলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন আঠারো
আনা। তাঁকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাঙলা ভাষা ইঙরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাঙলা
বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো
শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরঙ এর উচ্চারণ হলো :
'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ
প্রথম সচেতন হলেন বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাঙলা ভাষার
প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ
পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব'
(১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাঙলা
ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাঙলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না।
লুসির আরেকটা অবদান তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইঙরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান
শিখিয়েছিলেন। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা
করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে
'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন।
এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই
পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০
সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো
বাড়িতে ফিরে গেলেন।
১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবঙ তার
পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে
বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষন্ন হয়েছিলেন এ কথা তিনি
নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা
দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু
এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই
নিচের পঙক্তিগুলোতে।
রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে
লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো এই মেয়েটির
প্রতি। লুসি তাঁর কাছে বাঙলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন আঠারো
আনা। তাঁকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাঙলা ভাষা ইঙরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাঙলা
বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো
শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরঙ এর উচ্চারণ হলো :
'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ
প্রথম সচেতন হলেন বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাঙলা ভাষার
প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ
পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব'
(১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাঙলা
ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাঙলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না।
লুসির আরেকটা অবদান তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইঙরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান
শিখিয়েছিলেন। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা
করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে
'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন।
এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই
পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০
সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো
বাড়িতে ফিরে গেলেন।
১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবঙ তার
পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে
বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষন্ন হয়েছিলেন এ কথা তিনি
নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা
দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু
এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই
নিচের পঙক্তিগুলোতে।
কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি
শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন
যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি
হৃদয়ে স্থাপিবে দিবে চির হাসি অশ্রু। (বসন্ত বরষা)
মার্চ মাসে ফিরে আসার পর সবাই তাকে উষ্ণতার সঙ্গে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে,
দীর্ঘ বিরহের পর কাদম্বরী দেবী তাঁকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়াই স্বাভাবিক। মে মাসে
জ্যোতিদাদা আর বউদির সঙ্গে গেলেন বোলপুরে। কিন্তু ততোদিনে তার দিগন্তটা একটু
প্রসারিত হয়েছিলো, তিনি আর একা কাদম্বরীর আদরের দেবর ছিলেন না। সে পরিবর্তন
কাদম্বরী দেবী সম্ভবত অনুভব করতে পারলেন। করতে পেরে থাকলে তার আরও হতাশ এবঙ আরও
নিঃসঙ্গ বোধ করার কথা। কিন্তু তাঁদের এ সময়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার তথ্যও জানা যায়। দুজনে
মিলে ছাদের ওপরে তৈরি করলেন একটি বাগান ‘নন্দনকানন’। সেখানেই
সময় কাটত দুজনার। দুজন পরস্পরের বন্ধু, পরস্পরের ভালোবাসা এবং সান্তনা। 'দুজনে
মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী'। গঞ্জনা দেননি কেউ।
নূতন প্রেম দানা বাঁধছিলো, স্থান বদলে যাওয়ার পরও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে
অন্তত পরবর্তী দু'বছর। এবঙ এই সময়ে কাদম্বরী-রবীন্দ্রপ্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিলো।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি
জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা
নূতন প্রেম দানা বাঁধছিলো, স্থান বদলে যাওয়ার পরও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে
অন্তত পরবর্তী দু'বছর। এবঙ এই সময়ে কাদম্বরী-রবীন্দ্রপ্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিলো।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি
জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা
‘ভারতী’তে প্রেমের উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে লেখেন-
সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।
এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথসহ গোটা ঠাকুরপরিবার সচকিত হয়ে উঠলো। এর মাস
ছয়েকের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন একটি নিরক্ষর গ্রাম্য
মেয়েকে দক্ষিণডিহি থেকে (এখনকার খুলনার কাছে)। যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম ভবতারিণী।
কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
বরাত দিয়ে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, দক্ষিণডিহির ধারে কাছে কোনো
প্রাইমারি স্কুল ছিলো না। সুতরাঙ তিনি স্কুলে যাননি অথবা কোনো পরীক্ষায় অঙশ নেননি।
নিরক্ষর ছিলেন কি-না, সেটা নিয়ে বিতর্ক করলে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি যে
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিলো না।
তা সত্ত্বেও, 'আধুনিকা' জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নেতৃত্ব দিয়ে এই কন্যাকেই পছন্দ করে
আনেন। কাদম্বরীকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করতেন, সেই কাদম্বরী-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের
ওপর শোধ নেওয়ার জন্যই হয়তো ভবতারিণীকে বেছে নিয়ে এসেছিলেন। আর, কাদম্বরীর কাটা
ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মেয়ে পছন্দ করার কাজে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। মানে বোঝা যায়-
সিরিয়ালের নাটকীয়তা রবীন্দ্রনাথের জীবনেও ছিলো।
বিয়ের পর তাই তাকে একটা আধুনিক নাম দেওয়া হলো মৃণালিনী দেবী। তা ছাড়া, লেখাপড়া
শিখিয়ে তাকে তরুণ কবি ও গায়ক এবং অত্যন্ত সুর্দশন রবীন্দ্রনাথের 'উপযুক্ত' করে গড়ে
তোলার চেষ্টা চলে মেয়েমহলে। বিয়ের পরের মাসের হিসাবের খাতায় বর্ণপরিচয়, ধারাপাত,
শ্লেট ইত্যাদি কেনার তথ্য উল্লেখ করেছেন প্রশান্ত পাল।
ওদিকে কাদম্বরী দেবী আরও একবার নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে করলেন।
বিষন্ন হলেন, যাকে এখন বলা হয় ডিপ্রেস্ড। তা সত্ত্বেও নিজেকে জীবন্মৃত অবস্থায়
বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পরের সাড়ে চার মাস। এরপর ৮ বৈশাখ আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু মারা যান পরের দিন রাতে অথবা তার পরের দিন সকালে। চিকিৎসাও করা হয়। আমার
ধারণা, কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য।
অনেক রবীন্দ্র উপাসককে পাওয়া যায় যাঁরা এটা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে-
রবীন্দ্রনাথের বিয়ে করার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। ডক্টর আনিসুজ্জামান, সনজীদা
খাতুন, অমৃত দে তাঁদের একাধিক লেখায় এই বিষয়টি প্রমাণের জন্যে বলেছেন যে,
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি চিঠি থেকে কাদম্বরী এটা
জানতে পারলেন যে, নটী বিনোদিনীর সঙ্গে তার স্বামীর প্রণয় সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু
শান্তিনিকেতনের তরুণ গবেষক কল্পনা বসাকের গবেষণা গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথের
কল্পলোক ও সমাজবাস্তবতা’ থেকে জানা যায় ‘এ কথা আগে থেকেই জানা ছিলো’। সুতরাঙ একে ঠুনকো
অজুহাত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অবশ্য দুঃখ রবীন্দ্রনাথ মৌলবাদীদের হাতে চলে
গেছেন। কল্পনা বসাকের গবেষণা গ্রন্থটি অনুমোদন দেয়নি বিশ্বভারতী।
কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন, কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের
ভালোবাসা বেঁচে থাকলো, যতদিন তিনি নিজে বেঁচে ছিলেন। কতো গান, কতো কবিতায় তাঁর এই
ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে একশত একান্ন বছর পরে কাদম্বরী দেবী আজও অমর
হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাঁদের রোমান্টিক প্রেমের
ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন বউদি। বউদির
অভাবে তার হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠলো। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে
পারলেন না। বস্তুত, মৃণালিনীর সঙ্গে তাঁর এ সময়ে কোনো সম্পর্ক আদৌ গড়ে উঠেছিলো
কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বন্ধু এবং সাহিত্যসঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তবে
প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, বিয়ের দু'বছর পর পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী
লোরেটায় পড়ালেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন। তার কিছু আগে
থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে খানিকটা ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। দৈহিক দিক থেকেও খানিকটা
আকৃষ্ট হন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে মৃণালিনী গর্ভবতী হন এবং অক্টোবরে তাদের প্রথম
সন্তান বেলার জন্ম হয়।
মৃণালিনী দেবী আর ইন্দিরা দেবী একই বয়সের। কিন্তু লেখাপড়া আর মননশীলতায় তাদের
ব্যবধান ছিলো আকাশ-পাতাল। কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথ
সেই ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লেখা আরম্ভ করলেন। প্রথমে স্নেহের কথা, নিজের অভিজ্ঞতার
কথা। ১৮৮৭ সাল থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই তরুণী ইন্দিরাকে ২৫২টি চিঠি লিখেছেন।
বিশেষ করে তিনি যখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরে যেতে
আরম্ভ করেন। একই সময়ে তিনি মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লেখেন মাত্র ১৫টি। তখন
গ্রাম-বাঙলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন, কখনও গান, আর কখনও ইন্দিরা
দেবীকে দীর্ঘ চিঠিতে
কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন, কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের
ভালোবাসা বেঁচে থাকলো, যতদিন তিনি নিজে বেঁচে ছিলেন। কতো গান, কতো কবিতায় তাঁর এই
ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে একশত একান্ন বছর পরে কাদম্বরী দেবী আজও অমর
হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাঁদের রোমান্টিক প্রেমের
ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন বউদি। বউদির
অভাবে তার হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠলো। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে
পারলেন না। বস্তুত, মৃণালিনীর সঙ্গে তাঁর এ সময়ে কোনো সম্পর্ক আদৌ গড়ে উঠেছিলো
কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বন্ধু এবং সাহিত্যসঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তবে
প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, বিয়ের দু'বছর পর পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী
লোরেটায় পড়ালেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন। তার কিছু আগে
থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে খানিকটা ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। দৈহিক দিক থেকেও খানিকটা
আকৃষ্ট হন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে মৃণালিনী গর্ভবতী হন এবং অক্টোবরে তাদের প্রথম
সন্তান বেলার জন্ম হয়।
মৃণালিনী দেবী আর ইন্দিরা দেবী একই বয়সের। কিন্তু লেখাপড়া আর মননশীলতায় তাদের
ব্যবধান ছিলো আকাশ-পাতাল। কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথ
সেই ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লেখা আরম্ভ করলেন। প্রথমে স্নেহের কথা, নিজের অভিজ্ঞতার
কথা। ১৮৮৭ সাল থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই তরুণী ইন্দিরাকে ২৫২টি চিঠি লিখেছেন।
বিশেষ করে তিনি যখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরে যেতে
আরম্ভ করেন। একই সময়ে তিনি মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লেখেন মাত্র ১৫টি। তখন
গ্রাম-বাঙলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন, কখনও গান, আর কখনও ইন্দিরা
দেবীকে দীর্ঘ চিঠিতে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে যা এখনও অছিন্ন এবং অমলিন হয়ে আছে। অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে,
‘ছিন্নপত্রাবলী’র চিঠিগুলো সম্পূর্ণ পাঠ নয়, সম্পাদিত। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বর্জিত।
রবীন্দ্রনাথের সে সাহস ছিলো না। কিন্তু ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কেবল নিসর্গের
সৌন্দর্য বর্ণনা আর স্নেহসম্ভাষণ ছিল না। রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের তথ্য এবং বিশ্লেষণ
থেকে মনে হয়, ভালোবাসার অঙ্কুরও দেখা দিয়েছিলো কবির হৃদয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি
তাৎপর্যপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ইন্দিরার বয়স যখন উনিশ তখনকার একটি পত্র থেকে-
ইন্দিরার বয়স ছাব্বিশ, সাতাশ হয়ে যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের কথাও সূচনা
হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, চিঠিগুলোয় আরও আনুষ্ঠানিকতা দেখা
যাচ্ছে। ১৮৯৯ সালে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর চিঠির ভাষা এবং সম্ভাষণ দুই-ই
পাল্টে গেল। এমনকি চিঠি লেখার ধারাও গেলো শুকিয়ে।
এর অল্পদিন পরেই মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন। মৃণালিনী দেবী মারা যাওয়ায় তিনি ব্যথা
পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি কবির প্রণয় যে গভীর ছিলো, মনে হয় না। বিশেষ করে তিনি
তাকে চৌদ্দ-পনেরোটি চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে কোনো কোনো চিঠিকে বেশ নির্দয় বলেই
মনে হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। চিঠিপত্রে কাজের
কথা যতো থাকে, তার থেকে মনের আবেগ-অনুভূতির কথা কমই থাকে। এ কথা মনে রাখলেও,
মৃণালিনীকে লেখা নিচের চিঠিটি অসাধারণ বলতে হবে।
সঙক্ষেপে বলা যায় : এই ছিল মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্কের আসল চেহারা।
মৃণালিনী মারা যাওয়ার পর তার অভাব নিশ্চয় অনুভব করে থাকবেন। মাতৃহীন সন্তানদের
বাড়তি দায়িত্বও পড়েছিলো তার কাঁধে। কিন্তু তার স্মৃতি তাকে ব্যাকুল করতো এমনটা
ভাবা মুশকিল। আর মৃণালিনী যখন মারা যান, তখন তার বয়স সাতাশ, আর কবির বয়স মাত্র
চল্লিশ। দেহের চাহিদার সঙ্গে অন্তরের খিদেয় কখনও কখনও নিশ্চয় ব্যাকুল হয়ে উঠতেন।
কিন্তু কার অথবা কাদের জন্য, তা জানা যায় না। কিন্তু অতি সুদর্শন কবি ও গায়ক
রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিশ্চয় বহু নারীই আকৃষ্ট হয়েছে। তিনি নিজেও কি আকৃষ্ট হননি
বহু নারীর দিকে? বয়স যখন সত্তরের কোঠায়, তখন পেছনের দিকে তাকিয়ে তিনি লিখেছিলেন-
কাহারে করিয়াছিনু দান
ষোলো বছর বয়সে রানু যখন শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে কবিকে ছাড়লেন, তখন কবির মনে হয়েছিলো
তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার সে সময়কার অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ পেয়েছে কেবল
তখনকার গান আর কবিতা থেকে। এর বহু বছর পরেও তার কথা মনে রেখে, তিনি গান লিখেছেন
তার বয়স তখন চৌত্রিশ। বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আট বছরের চেয়ে বেশি টেকেনি। তার একাধিক
বন্ধুও জুটেছে। কিন্তু সেভাবে কোথাও বাসা বাঁধেননি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে উনত্রিশ
বছরের ছোট। তাঁকে দেখে তার ঘনিষ্ঠতা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বহু বছর পরে
আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, তিনি তার নৈকট্য চেয়েছিলেন। অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের
সন্তান ছিলেন তিনি। সমাজের ওপরতলায় তাঁর অবাধ বিচরণ। একটি বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকার
সম্পাদক। বহু গ্রন্থের লেখিকা। বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার নেশাও ছিল
তাঁর।
অপরপক্ষে স্নেহ ও ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার রূপে, গুণে, সেবাযত্নে
আর ব্যক্তিত্বে অচিরেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে আনা তরখড়কে বাঙলা নাম
দিয়েছিলেন নলিনী। এবারে ভিক্টোরিয়া শব্দের কথা মনে রেখে তার নাম দিলেন ‘বিজয়া’।
ভিক্টোরিয়া প্রথমে নদীর ধারের যে বাড়িতে রেখেছিলেন, সেখানে কবির সেবাযতœ করতো
ভৃত্যরা। সেই সেবাযত্নের অনেকটাই তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। কবি বিজয়াকে নিয়ে
কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। এগারো নভেম্বর নূতন প্রেমের আভাস পেয়েই বোধ হয় বউদির
সঙ্গে কৈশোরক প্রণয়ের কথা মনে পড়ে। পরের দিন
ভিক্টোরিয়া প্রথমে নদীর ধারের যে বাড়িতে রেখেছিলেন, সেখানে কবির সেবাযতœ করতো
ভৃত্যরা। সেই সেবাযত্নের অনেকটাই তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। কবি বিজয়াকে নিয়ে
কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। এগারো নভেম্বর নূতন প্রেমের আভাস পেয়েই বোধ হয় বউদির
সঙ্গে কৈশোরক প্রণয়ের কথা মনে পড়ে। পরের দিন ‘বিদেশী ফুলের’ প্রতি তার
কৌতূহল প্রকাশ করেন। পনেরোই নভেম্বর লিখলেন :
মাধুর্যের সুধায়; কত সহজে করিলে আপনারি
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা
বুয়েন্স আইরিসে থাকার কথা ছিলো মাত্র কদিনের। কিন্তু স্বাস্থ্য খারাপ থাকায়
ডাক্তার তাকে চিলি-সফর বাতিল করার পরামর্শ দিলেন। ভেবেছিলেন, চিলি থেকে
শান্তিনিকেতনের জন্য কিছু টাকা যোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু সে আশা বিসর্জন দিয়ে
দু'মাস থাকলেন সেখানে। আমার ধারণা, সেখানে থাকার আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিলেন
ভিক্টোরিয়া।
কবির সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য উনত্রিশ বছরের। কিন্তু ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছর
বয়স্ক কবির কপালে একটিও রেখা দেখতে পাননি। অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার বয়স
নিয়ে ভাবেনওনি। দেখেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ভিক্টোরিয়া কবির নৈকট্য [‘নিয়ারনেস’] কামনা
করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্ক বিষয়ে আগের মতোই কোথাও কিছু লেখেননি। তবে
কবিতায়, গানে তার ভালোবাসাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি, নিজের মনের মতো। যেমনটা
পেরেছিলেন আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ বক্তব্য এবং আচরণে। মুখে তিনি যা-ই বলে থাকুন না
কেন, ভিক্টোরিয়ার সঙ্গ তিনি খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কেউ সে অর্থে কারও মন বুঝলেন
না, হয়তো দুই ব্যক্তি বলেই নয়, দুই সংস্কৃতিও তার পেছনে কাজ করে থাকবে। ভিক্টোরিয়া
নিজেই কবিকে লিখেছেন,
ভিক্টোরিয়া সম্ভত কবির মন এবং দেহ উভয় প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে এ
ব্যাপারে যে রুচি কাজ করেছিলো, তা-ই ভিক্টোরিয়াকে তার আরও কাছে আসতে দেয়নি ‘কাছে থেকে
দূর রচিলো, কেন যে আঁধারে’।
পঁয়ষট্টি বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক
ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন,
তাদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তার যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই
ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে
আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন
অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু
ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য
দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ
ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত। বিশেষ
করে যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে।
অপরপক্ষে, ইন্দিরা যেনো
পঁয়ষট্টি বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক
ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন,
তাদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তার যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই
ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে
আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন
অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু
ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য
দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ
ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত। বিশেষ
করে যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে।
অপরপক্ষে, ইন্দিরা যেনো ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন’। রবীন্দ্রনাথ তার ঘুম
ভাঙান। প্রেম নিবেদন করতে পারেননি সরাসরি, কিন্তু তার কাছে লেখা ২৫২টি চিঠিতে তিনি
যেমন করে তার মনের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন, এমন কারও কাছে দেননি। তার মধ্য দিয়েই
জানা যায়, প্রেমের ব্যাপারে, তার মনের গহিনে কী দ্বন্ধ চলেছিলো প্রবৃত্তির সঙ্গে
বিবেকের। সমাজ ও রীতিনীতির সঙ্গে স্বাভাবিক প্রণয়ের লড়াই চলেছিলো। কখনও
নিয়ম-নীতিকে ভেঙে তছনছ করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার উদ্দাম প্রণয়ের
স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। এখানে আরও লক্ষ্য করার বিষয় : এ পর্যায়ে তার প্রণয়
স্বপ্নের সীমানা নিকটাত্মীয়দের ঘিরেই। এ সীমানা পেরিয়ে তিনি পা বাড়াননি। সেই
সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন, নিজেকেই নিজে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। আত্মধিক্কারে
তিনি কখনও কখনও আত্মহত্যা করার মতো কঠোর পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবে দেখেছেন।
এই সমীনার বাইরে তাকে এক নন্দিনী এসে টেনে বের করলেন। হাতে তার রক্তকরবীর গুচ্ছ
ছিলো কি-না, তা জানা নেই। কিন্তু রাজাকে তিনি মুক্তি দিলেন তার সীমানা থেকে। রানুর
থেকে ভানুর বয়স ছিলো বিয়াল্লিশ বছর বেশি। কিন্তু এই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী তাকে
মুগ্ধ করেছিলেন তার দৈহিক সৌন্দর্য আর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ভিক্টোরিয়া
ওকাম্পোর সঙ্গেও বয়সের পার্থক্য ছিলো উনত্রিশ বছর। দক্ষিণ আমেরিকার তখনকার সবচেয়ে
বিখ্যাত নারী মননে আর ফ্যাশনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য চেয়েছিলেন দেহ ও মন
উভয়ের। কোনো বাধা ছিলো না আত্মীয়তার অথবা দেশীয় রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের।
কিন্তু বাধা ছিলো একেবারে অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের আজন্ম লালিত ভিক্টোরীয়-ব্রাহ্ম
রক্ষণশীল শুচিবায়ুগ্রস্ত রুচি তাকে অর্গলমুক্ত সাধারণ মানুষের মতো হতে দেয়নি।
আলিঙ্গন চেয়েছেন, নিবিড় আলিঙ্গন। কিন্তু প্রিয়ার দেহকে তিনি ভরে দিতে চেয়েছেন
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এসব কিছুর পরও এই সমীনার বাইরে তাকে এক নন্দিনী এসে টেনে বের করলেন। হাতে তার রক্তকরবীর গুচ্ছ
ছিলো কি-না, তা জানা নেই। কিন্তু রাজাকে তিনি মুক্তি দিলেন তার সীমানা থেকে। রানুর
থেকে ভানুর বয়স ছিলো বিয়াল্লিশ বছর বেশি। কিন্তু এই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী তাকে
মুগ্ধ করেছিলেন তার দৈহিক সৌন্দর্য আর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ভিক্টোরিয়া
ওকাম্পোর সঙ্গেও বয়সের পার্থক্য ছিলো উনত্রিশ বছর। দক্ষিণ আমেরিকার তখনকার সবচেয়ে
বিখ্যাত নারী মননে আর ফ্যাশনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য চেয়েছিলেন দেহ ও মন
উভয়ের। কোনো বাধা ছিলো না আত্মীয়তার অথবা দেশীয় রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের।
কিন্তু বাধা ছিলো একেবারে অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের আজন্ম লালিত ভিক্টোরীয়-ব্রাহ্ম
রক্ষণশীল শুচিবায়ুগ্রস্ত রুচি তাকে অর্গলমুক্ত সাধারণ মানুষের মতো হতে দেয়নি।
আলিঙ্গন চেয়েছেন, নিবিড় আলিঙ্গন। কিন্তু প্রিয়ার দেহকে তিনি ভরে দিতে চেয়েছেন
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এসব কিছুর পরও ‘আঁধার রাতের এক একলা’ রবীন্দ্রনাথ আবিস্কৃত হন। বিষন্ন প্রজ্ঞায় তিনি খুঁজে পান না কাউকে,
কোনো এক শিপ্রানদীতীরে ‘পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে’ তিনি আর খুঁজে পান না।
সাহিত্যের ক্যাথারসিস ছেড়ে একজন রবীন্দ্রনাথ তখন আকাশ পেরোনো নিঃসঙ্গতা নিয়ে বুকের
কাছের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন। আকাশ তখন অন্ধকার, বাতাসের ব্যাকরণে সূর্যমুখী
সুখ, কবিতার খাতায় হরিণীর পোট্রেট, সকল শব্দেরা প্রাঙমুখী.. ..।
কেবল রবীন্দ্রনাথ একা- আমাদের প্রতিদিনের নিঃশ্বাসের মতো একা, কোনোদিন প্রশ্বাসের
সঙ্গে তার দেখা হয় না।
অতঃপর আবার রবীন্দ্রনাথ; এক টুকরো স্মিতহাস্য ভালোলাগার মতো।
তথ্যসূত্র
১. ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ, গোলাম মুরশিদ
২. ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ
৩. রবিজীবনী, প্রশান্ত পাল
৪. রবীন্দ্র জীবনে নারী, মুহাম্মদ জমির হোসেন
৫. মৈত্রেয়ী ও রবীন্দ্রনাথ, হাসনাত আবদুল হাই
শনিবারের চিঠি উৎসর্গ: শনিবারের চিঠি’র প্রেমিকাদের , যাঁরা কবিতার মতোই নান্দনিক এবঙ নিঃসঙ্গতার মতোই শাশ্বত।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে
একটি ধারাবাহিক লেখার সূচনা করেছিলাম ১৪১৮ সালে, রবীন্দ্র মহাপ্রয়াণ দিবসের
প্রক্কালে; ইচ্ছে ছিলো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা পুরোটা শেষ করবো এবঙ বেশ
তৃপ্তিবোধ করবো, আলোড়িত হবো এই ভেবে যে- আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছি, এবঙ
প্রশ্ন করেছি তাঁকে, চেষ্টা করেছি তাঁকে বিব্রত করে তোলবার এবঙ শেষ পর্যন্ত আমি
সুখী হয়েছি, আমার রক্তকণিকাগুলো হীরকখণ্ডের মতো দীপ্তি ছড়িয়ে সুখী হয়েছে। আমি এবঙ
আমার সত্তা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু করা হয়নি সেটা। মহাপ্রয়াণের সুর মহামহিমায় সরোদে তোলা ছিলো- হয়তো এই দিনটির
জন্য, এই সময়টির জন্য- পঁচিশে বৈশাখের কয়েকদিন আগের এই মুহূর্তটির জন্য। ১৪১৮ এর
শনিবারের চিঠি বদলে গেছে, সবাই বদলায়, তখনকার চেয়ে এখন হয়তো আরও একটু এগিয়েছে
শনিবারের চিঠি, কিঙবা পিছিয়েছে- অতএব তখনকার বোধ কিঙবা আবেগের সাথে এখনকার
উপস্থাপনা না-ও মিলতে পারে।
তবে তার প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবঙ আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি। তিনি বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন উদারপন্থি বলে। রবীন্দ্রনাথ তার থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার কবরটির সংস্কার করা দূরে থাকে, কেনসাল গ্রিনে গিয়ে একবার দেখেও আসেননি বলে মনে হয়। সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দ্বারকানাথের সব ব্যবসায়িক কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এহেন রুচি ছিলো তার! তার প্রেম হলো :কামগন্ধ নাহি তায়।
কিন্তু নারীদেহের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না, তার প্রশঙসা করেননি, তা দিয়ে আকৃষ্ট হননি, তা নয়, অথবা প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগাযোগ নেই এমন অসম্ভব কথাও তিনি বলেননি। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেখতে পাই দেহের পরাজয়।
তিনি দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ইউরোপীয়দের মতো, তাঁর মধ্যে কোলকাতার সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবারের সদস্য। সবার ওপর, তাঁর পরিচয়, তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সবকিছু মিলে তিনি কতো নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন, আজ শত চেষ্টা করলেও তা আর জানা যাবে না।
তবে তার প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবঙ আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি। তিনি বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন উদারপন্থি বলে। রবীন্দ্রনাথ তার থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার কবরটির সংস্কার করা দূরে থাকে, কেনসাল গ্রিনে গিয়ে একবার দেখেও আসেননি বলে মনে হয়। সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দ্বারকানাথের সব ব্যবসায়িক কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এহেন রুচি ছিলো তার! তার প্রেম হলো :কামগন্ধ নাহি তায়।
কিন্তু নারীদেহের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না, তার প্রশঙসা করেননি, তা দিয়ে আকৃষ্ট হননি, তা নয়, অথবা প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগাযোগ নেই এমন অসম্ভব কথাও তিনি বলেননি। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেখতে পাই দেহের পরাজয়।
তিনি দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ইউরোপীয়দের মতো, তাঁর মধ্যে কোলকাতার সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবারের সদস্য। সবার ওপর, তাঁর পরিচয়, তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সবকিছু মিলে তিনি কতো নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন, আজ শত চেষ্টা করলেও তা আর জানা যাবে না।
বিয়ের পর কাদম্বরীকে লেখাপড়া শিখিয়ে জ্যোতির উপযুক্ত করে তোলার সূচনা হয় তখন থেকেই। তিনি আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছিলেন খুবই কম। কিন্তু সে তুলনায় শিখেছিলেন অনেক বেশি। রীতিমতো সাহিত্যের সমঝদার হয়ে উঠেছিলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে বড়ো হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। তিনি ছিলেন একটু বন্ধুত্ব, একটু ভালোবাসার কাঙাল। সেই একাকী, নিঃসঙ্গ কালো হরিণ চোখ মেয়েটি হঠাৎ বাইরের বাড়ি থেকে অন্তঃপুরে উপস্থিত হলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনও তাঁকে আগে দেখেছেন বলে জানা যায় না। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত, কাদম্বরীর থেকে এক বছর নয় মাসের ছোটো। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই স্নেহের প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ এবঙ হীনমন্যতায় কাতর ও নিঃসঙ্গ কাদম্বরী দুজন দুজনের খেলার সাথি হয়ে উঠলেন। বালক রবি স্কুল থেকে ফিরেই তার ঘরে উপস্থিত হতেন। ধীরে ধীরে দু'জনই কৈশোরে পৌঁছে গেলেন। তাদের বন্ধুত্বের চরিত্র খানিকটা বদলে যেতে আরম্ভ করল। সেই ভালোলাগা, ভালোবাসা নানা পর্যায়ে নানা রূপে প্রকাশ পেয়েছে। কাদম্বরী দেবীর আগেই বলেছি সাহিত্যে ছিলো কৌতূহল। তিনি রবির সাহিত্য-সঙ্গিনীতে পরিণত হলেন। তার বিশেষ আগ্রহ ছিলো কাব্যে, গানে, উপন্যাসে। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার মাপে নয়, তিনি ছিলেন সত্যিকার সাহিত্য-রসিক। ভালোভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে শিখেছিলেন। সেই রস গ্রহণের ক্ষমতাই তিনি সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন স্নেহের দেবরের মধ্যে। সাহিত্য-সঙ্গীত নিয়ে তারা একটি নিজেদের কুঞ্জ সাজিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র একজন লেখক, পাঠকও একজনই। কাদম্বরী দেবী চাইতেন না, রবির লেখা সত্যিকার পরিণত হওয়ার আগেই, তা প্রকাশিত হোক, অন্য কেউ পড়ূক। এ শুধু তাদের দুজনার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা যতোই পরিণত হতে আরম্ভ করলো, তিনি ততই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন আত্মপ্রকাশের জন্য। রবি আর একমাত্র কাদম্বরী দেবীর থাকলেন না। পাঠককুলের হয়ে উঠলেন। এটা কী রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠুরতা! সেই নিষ্ঠুরতার ক্ষত ঢাকতেই কি তিনি ‘নষ্টনীড়’ লিখেছিলেন?
কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময় কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে একমাত্র খেলার সাথি আর বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় জুত হলো না, সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, তাকে বিলেতে পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করবেন। আর, তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে আহমেদাবাদ যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে, আগস্ট মাসে গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসেবে থাকেন আত্মারাম পাণ্ডুরঙের পরিবারে। তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে, কাদম্বরী ছাড়া, এই প্রথম তিনি কোনো নারীর সান্নিধ্যে এলেন। ইঙরেজি ভাষা, বিশেষ করে ইঙরেজদের সঙস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পাণ্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন, তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা তরখড়। তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইঙরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইঙরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরঙ কবিতা লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন। মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথি এবঙ এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী বছর দশেক নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছিলেন একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নবনব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। আনার সঙ্গে সে রকমের কোনো ঘনিষ্ঠতা হলো না। তবে 'নলিনী' যে তাঁর হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতোটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [১.১.১৯২৭] :
কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময় কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে একমাত্র খেলার সাথি আর বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় জুত হলো না, সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, তাকে বিলেতে পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করবেন। আর, তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে আহমেদাবাদ যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে, আগস্ট মাসে গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসেবে থাকেন আত্মারাম পাণ্ডুরঙের পরিবারে। তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে, কাদম্বরী ছাড়া, এই প্রথম তিনি কোনো নারীর সান্নিধ্যে এলেন। ইঙরেজি ভাষা, বিশেষ করে ইঙরেজদের সঙস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পাণ্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন, তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা তরখড়। তাঁরই ওপর দায়িত্ব পড়লো রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইঙরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়ো। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইঙরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরঙ কবিতা লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন। মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগলো। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথি এবঙ এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী বছর দশেক নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছিলেন একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নবনব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। আনার সঙ্গে সে রকমের কোনো ঘনিষ্ঠতা হলো না। তবে 'নলিনী' যে তাঁর হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতোটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [১.১.১৯২৭] :
এ থেকেই বোঝা যায়, ভালোবাসাকে দৈহিক করে তোলার মতো স্থূল রুচি তাঁর গড়ে ওঠেনি। তাঁর বউদিকে তিনি তেমন করে ভালোবাসতেন বলেই মনে হয়। সাত বছর বয়স থেকে তাঁর খেলার সাথি! সখী, বন্ধু।
আনার সঙ্গে ভালোবাসা অঙ্কুরিতো হয়েছিলো। পল্লবিত হয়নি। কিন্তু আনা অথবা রবীন্দ্রনাথ কেউই নলিনী নাম কখনো ভোলেননি। 'নলিনী' নামে গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। নাটক লিখেছেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মনে রেখেছেন। এ তো প্রেমই। আনাও যে তাঁকে ভালোবেসেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবারের কাছে বিয়ের কথাও বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে চলে যান। এরপর দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছিলো কি-না, তার সঠিক খবর আমাদের জানা নেই।
এরপর রবীন্দ্রনাথ লন্ডন হয়ে যান ব্রাইটনে। তিনি মোটেই ভালো লাগাতে পারেননি নিয়ম আর পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগতো কেবল ইঙরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। ভর্তি হয়ে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কলেজের সামনের দিকের রাস্তায়, রিজেন্টস স্ট্রিটে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অতিথি হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করলেন ডাক্তার জন স্কটের বাড়িতে।
তিনি ‘ইউরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ এ পরিবারের যে পরিচয় দিয়েছেন তা অনেকটাই বানানো। সাহিত্যিকরা বানিয়ে বলতেই পারেন, এতে কোনো দোষ নেই। নামগুলো সবই বদলে দিয়েছেন। একটা প্রশ্ন তখন উঠতেই পারে- কীভাবে সেটা এ তথ্যটা জানা যায় ১৮৭১ আর ১৮৮১ সালের লোকগণনার প্রতিবেদন থেকে। সে বাড়িতে সার্জন জন স্কট ছাড়া আরও ছিলেন তার স্ত্রী, মেরী, তাদের তিরিশোর্ধ্ব কন্যা, সাতাশ বছর বয়সী মেয়ে ফ্যানি, আর পঁচিশ বছরের কন্যা লুসি। গৃহভৃত্য ছিলো দু'জন। স্কট পরিবারে একটি পুত্রও ছিলো রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়ো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো পরিবারের ছোট দুই মেয়ে ফ্যানি আর লুসির।
রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো এই মেয়েটির প্রতি। লুসি তাঁর কাছে বাঙলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন আঠারো আনা। তাঁকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাঙলা ভাষা ইঙরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাঙলা বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরঙ এর উচ্চারণ হলো : 'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ প্রথম সচেতন হলেন বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাঙলা ভাষার প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাঙলা ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাঙলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না।
লুসির আরেকটা অবদান তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইঙরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান শিখিয়েছিলেন। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে 'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন।
এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো বাড়িতে ফিরে গেলেন।
১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবঙ তার পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষন্ন হয়েছিলেন এ কথা তিনি নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই নিচের পঙক্তিগুলোতে।
রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো এই মেয়েটির প্রতি। লুসি তাঁর কাছে বাঙলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন আঠারো আনা। তাঁকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাঙলা ভাষা ইঙরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাঙলা বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরঙ এর উচ্চারণ হলো : 'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ প্রথম সচেতন হলেন বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাঙলা ভাষার প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাঙলা ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাঙলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না।
লুসির আরেকটা অবদান তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইঙরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান শিখিয়েছিলেন। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে 'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন।
এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো বাড়িতে ফিরে গেলেন।
১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবঙ তার পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষন্ন হয়েছিলেন এ কথা তিনি নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই নিচের পঙক্তিগুলোতে।
কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি
শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন
যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি
হৃদয়ে স্থাপিবে দিবে চির হাসি অশ্রু। (বসন্ত বরষা)
মার্চ মাসে ফিরে আসার পর সবাই তাকে উষ্ণতার সঙ্গে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, দীর্ঘ বিরহের পর কাদম্বরী দেবী তাঁকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়াই স্বাভাবিক। মে মাসে জ্যোতিদাদা আর বউদির সঙ্গে গেলেন বোলপুরে। কিন্তু ততোদিনে তার দিগন্তটা একটু প্রসারিত হয়েছিলো, তিনি আর একা কাদম্বরীর আদরের দেবর ছিলেন না। সে পরিবর্তন কাদম্বরী দেবী সম্ভবত অনুভব করতে পারলেন। করতে পেরে থাকলে তার আরও হতাশ এবঙ আরও নিঃসঙ্গ বোধ করার কথা। কিন্তু তাঁদের এ সময়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার তথ্যও জানা যায়। দুজনে মিলে ছাদের ওপরে তৈরি করলেন একটি বাগান ‘নন্দনকানন’। সেখানেই সময় কাটত দুজনার। দুজন পরস্পরের বন্ধু, পরস্পরের ভালোবাসা এবং সান্তনা। 'দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী'। গঞ্জনা দেননি কেউ।
নূতন প্রেম দানা বাঁধছিলো, স্থান বদলে যাওয়ার পরও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে অন্তত পরবর্তী দু'বছর। এবঙ এই সময়ে কাদম্বরী-রবীন্দ্রপ্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিলো।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা
নূতন প্রেম দানা বাঁধছিলো, স্থান বদলে যাওয়ার পরও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে অন্তত পরবর্তী দু'বছর। এবঙ এই সময়ে কাদম্বরী-রবীন্দ্রপ্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিলো।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রেমের উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে লেখেন-
সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।
এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথসহ গোটা ঠাকুরপরিবার সচকিত হয়ে উঠলো। এর মাস ছয়েকের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন একটি নিরক্ষর গ্রাম্য মেয়েকে দক্ষিণডিহি থেকে (এখনকার খুলনার কাছে)। যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম ভবতারিণী। কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, দক্ষিণডিহির ধারে কাছে কোনো প্রাইমারি স্কুল ছিলো না। সুতরাঙ তিনি স্কুলে যাননি অথবা কোনো পরীক্ষায় অঙশ নেননি।
নিরক্ষর ছিলেন কি-না, সেটা নিয়ে বিতর্ক করলে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিলো না। তা সত্ত্বেও, 'আধুনিকা' জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নেতৃত্ব দিয়ে এই কন্যাকেই পছন্দ করে আনেন। কাদম্বরীকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করতেন, সেই কাদম্বরী-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের ওপর শোধ নেওয়ার জন্যই হয়তো ভবতারিণীকে বেছে নিয়ে এসেছিলেন। আর, কাদম্বরীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মেয়ে পছন্দ করার কাজে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। মানে বোঝা যায়- সিরিয়ালের নাটকীয়তা রবীন্দ্রনাথের জীবনেও ছিলো।
বিয়ের পর তাই তাকে একটা আধুনিক নাম দেওয়া হলো মৃণালিনী দেবী। তা ছাড়া, লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে তরুণ কবি ও গায়ক এবং অত্যন্ত সুর্দশন রবীন্দ্রনাথের 'উপযুক্ত' করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে মেয়েমহলে। বিয়ের পরের মাসের হিসাবের খাতায় বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, শ্লেট ইত্যাদি কেনার তথ্য উল্লেখ করেছেন প্রশান্ত পাল।
ওদিকে কাদম্বরী দেবী আরও একবার নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে করলেন। বিষন্ন হলেন, যাকে এখন বলা হয় ডিপ্রেস্ড। তা সত্ত্বেও নিজেকে জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পরের সাড়ে চার মাস। এরপর ৮ বৈশাখ আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মারা যান পরের দিন রাতে অথবা তার পরের দিন সকালে। চিকিৎসাও করা হয়। আমার ধারণা, কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য।
অনেক রবীন্দ্র উপাসককে পাওয়া যায় যাঁরা এটা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে- রবীন্দ্রনাথের বিয়ে করার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। ডক্টর আনিসুজ্জামান, সনজীদা খাতুন, অমৃত দে তাঁদের একাধিক লেখায় এই বিষয়টি প্রমাণের জন্যে বলেছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি চিঠি থেকে কাদম্বরী এটা জানতে পারলেন যে, নটী বিনোদিনীর সঙ্গে তার স্বামীর প্রণয় সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের তরুণ গবেষক কল্পনা বসাকের গবেষণা গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথের কল্পলোক ও সমাজবাস্তবতা’ থেকে জানা যায় ‘এ কথা আগে থেকেই জানা ছিলো’। সুতরাঙ একে ঠুনকো অজুহাত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অবশ্য দুঃখ রবীন্দ্রনাথ মৌলবাদীদের হাতে চলে গেছেন। কল্পনা বসাকের গবেষণা গ্রন্থটি অনুমোদন দেয়নি বিশ্বভারতী।
কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন, কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা বেঁচে থাকলো, যতদিন তিনি নিজে বেঁচে ছিলেন। কতো গান, কতো কবিতায় তাঁর এই ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে একশত একান্ন বছর পরে কাদম্বরী দেবী আজও অমর হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাঁদের রোমান্টিক প্রেমের ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন বউদি। বউদির অভাবে তার হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠলো। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে পারলেন না। বস্তুত, মৃণালিনীর সঙ্গে তাঁর এ সময়ে কোনো সম্পর্ক আদৌ গড়ে উঠেছিলো কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বন্ধু এবং সাহিত্যসঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তবে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, বিয়ের দু'বছর পর পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী লোরেটায় পড়ালেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন। তার কিছু আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে খানিকটা ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। দৈহিক দিক থেকেও খানিকটা আকৃষ্ট হন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে মৃণালিনী গর্ভবতী হন এবং অক্টোবরে তাদের প্রথম সন্তান বেলার জন্ম হয়।
মৃণালিনী দেবী আর ইন্দিরা দেবী একই বয়সের। কিন্তু লেখাপড়া আর মননশীলতায় তাদের ব্যবধান ছিলো আকাশ-পাতাল। কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথ সেই ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লেখা আরম্ভ করলেন। প্রথমে স্নেহের কথা, নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ১৮৮৭ সাল থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই তরুণী ইন্দিরাকে ২৫২টি চিঠি লিখেছেন। বিশেষ করে তিনি যখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরে যেতে আরম্ভ করেন। একই সময়ে তিনি মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লেখেন মাত্র ১৫টি। তখন গ্রাম-বাঙলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন, কখনও গান, আর কখনও ইন্দিরা দেবীকে দীর্ঘ চিঠিতে
কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন, কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা বেঁচে থাকলো, যতদিন তিনি নিজে বেঁচে ছিলেন। কতো গান, কতো কবিতায় তাঁর এই ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে একশত একান্ন বছর পরে কাদম্বরী দেবী আজও অমর হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাঁদের রোমান্টিক প্রেমের ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন বউদি। বউদির অভাবে তার হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠলো। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে পারলেন না। বস্তুত, মৃণালিনীর সঙ্গে তাঁর এ সময়ে কোনো সম্পর্ক আদৌ গড়ে উঠেছিলো কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বন্ধু এবং সাহিত্যসঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তবে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, বিয়ের দু'বছর পর পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী লোরেটায় পড়ালেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন। তার কিছু আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে খানিকটা ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। দৈহিক দিক থেকেও খানিকটা আকৃষ্ট হন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে মৃণালিনী গর্ভবতী হন এবং অক্টোবরে তাদের প্রথম সন্তান বেলার জন্ম হয়।
মৃণালিনী দেবী আর ইন্দিরা দেবী একই বয়সের। কিন্তু লেখাপড়া আর মননশীলতায় তাদের ব্যবধান ছিলো আকাশ-পাতাল। কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথ সেই ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লেখা আরম্ভ করলেন। প্রথমে স্নেহের কথা, নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ১৮৮৭ সাল থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই তরুণী ইন্দিরাকে ২৫২টি চিঠি লিখেছেন। বিশেষ করে তিনি যখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরে যেতে আরম্ভ করেন। একই সময়ে তিনি মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লেখেন মাত্র ১৫টি। তখন গ্রাম-বাঙলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন, কখনও গান, আর কখনও ইন্দিরা দেবীকে দীর্ঘ চিঠিতে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে যা এখনও অছিন্ন এবং অমলিন হয়ে আছে। অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে, ‘ছিন্নপত্রাবলী’র চিঠিগুলো সম্পূর্ণ পাঠ নয়, সম্পাদিত। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বর্জিত। রবীন্দ্রনাথের সে সাহস ছিলো না। কিন্তু ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কেবল নিসর্গের সৌন্দর্য বর্ণনা আর স্নেহসম্ভাষণ ছিল না। রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের তথ্য এবং বিশ্লেষণ থেকে মনে হয়, ভালোবাসার অঙ্কুরও দেখা দিয়েছিলো কবির হৃদয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ইন্দিরার বয়স যখন উনিশ তখনকার একটি পত্র থেকে-
ইন্দিরার বয়স ছাব্বিশ, সাতাশ হয়ে যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের কথাও সূচনা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, চিঠিগুলোয় আরও আনুষ্ঠানিকতা দেখা যাচ্ছে। ১৮৯৯ সালে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর চিঠির ভাষা এবং সম্ভাষণ দুই-ই পাল্টে গেল। এমনকি চিঠি লেখার ধারাও গেলো শুকিয়ে।
এর অল্পদিন পরেই মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন। মৃণালিনী দেবী মারা যাওয়ায় তিনি ব্যথা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি কবির প্রণয় যে গভীর ছিলো, মনে হয় না। বিশেষ করে তিনি তাকে চৌদ্দ-পনেরোটি চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে কোনো কোনো চিঠিকে বেশ নির্দয় বলেই মনে হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। চিঠিপত্রে কাজের কথা যতো থাকে, তার থেকে মনের আবেগ-অনুভূতির কথা কমই থাকে। এ কথা মনে রাখলেও, মৃণালিনীকে লেখা নিচের চিঠিটি অসাধারণ বলতে হবে।
সঙক্ষেপে বলা যায় : এই ছিল মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্কের আসল চেহারা। মৃণালিনী মারা যাওয়ার পর তার অভাব নিশ্চয় অনুভব করে থাকবেন। মাতৃহীন সন্তানদের বাড়তি দায়িত্বও পড়েছিলো তার কাঁধে। কিন্তু তার স্মৃতি তাকে ব্যাকুল করতো এমনটা ভাবা মুশকিল। আর মৃণালিনী যখন মারা যান, তখন তার বয়স সাতাশ, আর কবির বয়স মাত্র চল্লিশ। দেহের চাহিদার সঙ্গে অন্তরের খিদেয় কখনও কখনও নিশ্চয় ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। কিন্তু কার অথবা কাদের জন্য, তা জানা যায় না। কিন্তু অতি সুদর্শন কবি ও গায়ক রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিশ্চয় বহু নারীই আকৃষ্ট হয়েছে। তিনি নিজেও কি আকৃষ্ট হননি বহু নারীর দিকে? বয়স যখন সত্তরের কোঠায়, তখন পেছনের দিকে তাকিয়ে তিনি লিখেছিলেন-
কাহারে করিয়াছিনু দান
ষোলো বছর বয়সে রানু যখন শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে কবিকে ছাড়লেন, তখন কবির মনে হয়েছিলো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার সে সময়কার অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ পেয়েছে কেবল তখনকার গান আর কবিতা থেকে। এর বহু বছর পরেও তার কথা মনে রেখে, তিনি গান লিখেছেন
তার বয়স তখন চৌত্রিশ। বিয়ে হয়েছিলো, কিন্তু আট বছরের চেয়ে বেশি টেকেনি। তার একাধিক বন্ধুও জুটেছে। কিন্তু সেভাবে কোথাও বাসা বাঁধেননি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে উনত্রিশ বছরের ছোট। তাঁকে দেখে তার ঘনিষ্ঠতা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বহু বছর পরে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, তিনি তার নৈকট্য চেয়েছিলেন। অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। সমাজের ওপরতলায় তাঁর অবাধ বিচরণ। একটি বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক। বহু গ্রন্থের লেখিকা। বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার নেশাও ছিল তাঁর।
অপরপক্ষে স্নেহ ও ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার রূপে, গুণে, সেবাযত্নে আর ব্যক্তিত্বে অচিরেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে আনা তরখড়কে বাঙলা নাম দিয়েছিলেন নলিনী। এবারে ভিক্টোরিয়া শব্দের কথা মনে রেখে তার নাম দিলেন ‘বিজয়া’।
ভিক্টোরিয়া প্রথমে নদীর ধারের যে বাড়িতে রেখেছিলেন, সেখানে কবির সেবাযতœ করতো ভৃত্যরা। সেই সেবাযত্নের অনেকটাই তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। কবি বিজয়াকে নিয়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। এগারো নভেম্বর নূতন প্রেমের আভাস পেয়েই বোধ হয় বউদির সঙ্গে কৈশোরক প্রণয়ের কথা মনে পড়ে। পরের দিন
ভিক্টোরিয়া প্রথমে নদীর ধারের যে বাড়িতে রেখেছিলেন, সেখানে কবির সেবাযতœ করতো ভৃত্যরা। সেই সেবাযত্নের অনেকটাই তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। কবি বিজয়াকে নিয়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। এগারো নভেম্বর নূতন প্রেমের আভাস পেয়েই বোধ হয় বউদির সঙ্গে কৈশোরক প্রণয়ের কথা মনে পড়ে। পরের দিন ‘বিদেশী ফুলের’ প্রতি তার কৌতূহল প্রকাশ করেন। পনেরোই নভেম্বর লিখলেন :
মাধুর্যের সুধায়; কত সহজে করিলে আপনারি
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা
বুয়েন্স আইরিসে থাকার কথা ছিলো মাত্র কদিনের। কিন্তু স্বাস্থ্য খারাপ থাকায় ডাক্তার তাকে চিলি-সফর বাতিল করার পরামর্শ দিলেন। ভেবেছিলেন, চিলি থেকে শান্তিনিকেতনের জন্য কিছু টাকা যোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু সে আশা বিসর্জন দিয়ে দু'মাস থাকলেন সেখানে। আমার ধারণা, সেখানে থাকার আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ভিক্টোরিয়া।
কবির সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য উনত্রিশ বছরের। কিন্তু ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছর বয়স্ক কবির কপালে একটিও রেখা দেখতে পাননি। অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার বয়স নিয়ে ভাবেনওনি। দেখেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ভিক্টোরিয়া কবির নৈকট্য [‘নিয়ারনেস’] কামনা করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্ক বিষয়ে আগের মতোই কোথাও কিছু লেখেননি। তবে কবিতায়, গানে তার ভালোবাসাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি, নিজের মনের মতো। যেমনটা পেরেছিলেন আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ বক্তব্য এবং আচরণে। মুখে তিনি যা-ই বলে থাকুন না কেন, ভিক্টোরিয়ার সঙ্গ তিনি খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কেউ সে অর্থে কারও মন বুঝলেন না, হয়তো দুই ব্যক্তি বলেই নয়, দুই সংস্কৃতিও তার পেছনে কাজ করে থাকবে। ভিক্টোরিয়া নিজেই কবিকে লিখেছেন,
ভিক্টোরিয়া সম্ভত কবির মন এবং দেহ উভয় প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে এ ব্যাপারে যে রুচি কাজ করেছিলো, তা-ই ভিক্টোরিয়াকে তার আরও কাছে আসতে দেয়নি ‘কাছে থেকে দূর রচিলো, কেন যে আঁধারে’।
পঁয়ষট্টি বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তাদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তার যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত। বিশেষ করে যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে।
অপরপক্ষে, ইন্দিরা যেনো
পঁয়ষট্টি বছরের তাঁর প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তাদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তার যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত। বিশেষ করে যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে।
অপরপক্ষে, ইন্দিরা যেনো ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন’। রবীন্দ্রনাথ তার ঘুম ভাঙান। প্রেম নিবেদন করতে পারেননি সরাসরি, কিন্তু তার কাছে লেখা ২৫২টি চিঠিতে তিনি যেমন করে তার মনের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন, এমন কারও কাছে দেননি। তার মধ্য দিয়েই জানা যায়, প্রেমের ব্যাপারে, তার মনের গহিনে কী দ্বন্ধ চলেছিলো প্রবৃত্তির সঙ্গে বিবেকের। সমাজ ও রীতিনীতির সঙ্গে স্বাভাবিক প্রণয়ের লড়াই চলেছিলো। কখনও নিয়ম-নীতিকে ভেঙে তছনছ করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার উদ্দাম প্রণয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। এখানে আরও লক্ষ্য করার বিষয় : এ পর্যায়ে তার প্রণয় স্বপ্নের সীমানা নিকটাত্মীয়দের ঘিরেই। এ সীমানা পেরিয়ে তিনি পা বাড়াননি। সেই সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন, নিজেকেই নিজে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। আত্মধিক্কারে তিনি কখনও কখনও আত্মহত্যা করার মতো কঠোর পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবে দেখেছেন।
এই সমীনার বাইরে তাকে এক নন্দিনী এসে টেনে বের করলেন। হাতে তার রক্তকরবীর গুচ্ছ ছিলো কি-না, তা জানা নেই। কিন্তু রাজাকে তিনি মুক্তি দিলেন তার সীমানা থেকে। রানুর থেকে ভানুর বয়স ছিলো বিয়াল্লিশ বছর বেশি। কিন্তু এই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী তাকে মুগ্ধ করেছিলেন তার দৈহিক সৌন্দর্য আর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গেও বয়সের পার্থক্য ছিলো উনত্রিশ বছর। দক্ষিণ আমেরিকার তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত নারী মননে আর ফ্যাশনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য চেয়েছিলেন দেহ ও মন উভয়ের। কোনো বাধা ছিলো না আত্মীয়তার অথবা দেশীয় রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের। কিন্তু বাধা ছিলো একেবারে অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের আজন্ম লালিত ভিক্টোরীয়-ব্রাহ্ম রক্ষণশীল শুচিবায়ুগ্রস্ত রুচি তাকে অর্গলমুক্ত সাধারণ মানুষের মতো হতে দেয়নি। আলিঙ্গন চেয়েছেন, নিবিড় আলিঙ্গন। কিন্তু প্রিয়ার দেহকে তিনি ভরে দিতে চেয়েছেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এসব কিছুর পরও এই সমীনার বাইরে তাকে এক নন্দিনী এসে টেনে বের করলেন। হাতে তার রক্তকরবীর গুচ্ছ ছিলো কি-না, তা জানা নেই। কিন্তু রাজাকে তিনি মুক্তি দিলেন তার সীমানা থেকে। রানুর থেকে ভানুর বয়স ছিলো বিয়াল্লিশ বছর বেশি। কিন্তু এই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী তাকে মুগ্ধ করেছিলেন তার দৈহিক সৌন্দর্য আর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গেও বয়সের পার্থক্য ছিলো উনত্রিশ বছর। দক্ষিণ আমেরিকার তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত নারী মননে আর ফ্যাশনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য চেয়েছিলেন দেহ ও মন উভয়ের। কোনো বাধা ছিলো না আত্মীয়তার অথবা দেশীয় রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের। কিন্তু বাধা ছিলো একেবারে অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের আজন্ম লালিত ভিক্টোরীয়-ব্রাহ্ম রক্ষণশীল শুচিবায়ুগ্রস্ত রুচি তাকে অর্গলমুক্ত সাধারণ মানুষের মতো হতে দেয়নি। আলিঙ্গন চেয়েছেন, নিবিড় আলিঙ্গন। কিন্তু প্রিয়ার দেহকে তিনি ভরে দিতে চেয়েছেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু এসব কিছুর পরও ‘আঁধার রাতের এক একলা’ রবীন্দ্রনাথ আবিস্কৃত হন। বিষন্ন প্রজ্ঞায় তিনি খুঁজে পান না কাউকে, কোনো এক শিপ্রানদীতীরে ‘পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে’ তিনি আর খুঁজে পান না। সাহিত্যের ক্যাথারসিস ছেড়ে একজন রবীন্দ্রনাথ তখন আকাশ পেরোনো নিঃসঙ্গতা নিয়ে বুকের কাছের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন। আকাশ তখন অন্ধকার, বাতাসের ব্যাকরণে সূর্যমুখী সুখ, কবিতার খাতায় হরিণীর পোট্রেট, সকল শব্দেরা প্রাঙমুখী.. ..।
কেবল রবীন্দ্রনাথ একা- আমাদের প্রতিদিনের নিঃশ্বাসের মতো একা, কোনোদিন প্রশ্বাসের সঙ্গে তার দেখা হয় না।
অতঃপর আবার রবীন্দ্রনাথ; এক টুকরো স্মিতহাস্য ভালোলাগার মতো।
তথ্যসূত্র
১. ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ, গোলাম মুরশিদ
২. ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ
৩. রবিজীবনী, প্রশান্ত পাল
৪. রবীন্দ্র জীবনে নারী, মুহাম্মদ জমির হোসেন
৫. মৈত্রেয়ী ও রবীন্দ্রনাথ, হাসনাত আবদুল হাই
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন