তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রেম, প্রকৃতি ও সমাজ চেতনা

মাহফুজ সাদি

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক ছিলেন। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পলেখক। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন।

লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স পাস করে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখনকার আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধে। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
এরপর তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন (১৯৩০)। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারপর নিজ গ্রামে চলে যান এবং সাহিত্যসাধনায় আত্ম নিয়োগ করেন। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’।
১৯৪০ সালে তিনি কলকাতার বাগবাজার চলে যান এবং ১৯৪১ সালে চলে যান বরানগর। তখন পুরো বিশ্বে বেজে চলেছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ১৯৪২ সালে তিনি বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে তাঁকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি মনোনীত করা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি কানপুরে বসবাসকারী বাঙালীদের দ্বারা আয়োজিত ‘কানপুর বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এ সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণে যান। এরপরের বছর তিনি এফ্রো-এশিয়ান লেখক সঙ্ঘের কমিটি গঠনের প্রস্তুতিমূলক সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন গমণ করেন। এরপর তিনি তাসখন্দে অনুষ্ঠিত এফ্রো-এশিয়ান লেখক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
মাঝখানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন।
তারাশঙ্কর চার দশকের বেশিকাল ধরে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী ছিলেন। এসময়ে তিনি প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পের বই, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনী, ১টি কাব্যগ্রন্থ, ১টি প্রহসন লিখেছেন।
তাঁর জীবদ্দশায প্রকাশিত মৌলিক ও সংকলন গ্রন্থের এবং মরণোত্তর প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ: ত্রিপত্র (১৯২৬)। উপন্যাস: চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২), পাষাণপুরী (১৯৩৩), নীলকণ্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৫), প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৩৬), আগুন (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), মন্বন্তর (১৯৪৪), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬), ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬), অভিযান (১৯৪৬), সন্দীপন পাঠশালা (কিশোরপাঠ্য সংস্করণ, ১৯৪৮), পদচিহ্ন (১৯৫০), উত্তরায়ণ (১৯৫০), হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৫১), তামস তপস্যা (১৯৫২), নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), চাঁপাডাঙার বৌ (১৯৫৪), পঞ্চপুত্তলি (১৯৫৬), বিচারক (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৫৮), বিপাশা (১৯৫৯), রাধা (১৯৫৯), মানুষের মন (১৯৫৯), ডাকহরকরা (১৯৫৯), মহাশ্বেতা (১৯৬১), যোগভ্রষ্ট (১৯৬১), না (১৯৬১), নাগরিক (১৯৬১), নিশিপদ্ম (১৯৬২), যতিভঙ্গ (১৯৬২), কান্না (১৯৬২), কালবৈশাখী (১৯৬৩), একটি চড়–ইপাখি ও কালো মেয়ে (১৯৬৩), জঙ্গলগড় (১৯৬৪), মঞ্জরী অপেরা (১৯৬৪), সংকেত (১৯৬৪), ভুবনপুরের হাট (১৯৬৪), বসন্তরাগ (১৯৬৪), স্বর্গমর্ত্য (১৯৬৫), বিচিত্রা (১৯৬৫), গন্না বেগম (১৯৬৫), অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬), হীরাপান্না (১৯৬৬), মহানগরী (১৯৬৬), গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬), শুকসারী কথা (১৯৬৭), শক্করবাঈ (১৯৬৭), মণিবৌদি (১৯৬৯), ছায়াপথ (১৯৬৯), কালরাত্রি (১৯৭০), রূপসী বিহঙ্গিনী (১৯৭০), অভিনেত্রী (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), শতাব্দীর মৃত্যু (১৯৭১), কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড (কিশোর উপন্যাস, ১৯৭২)।
ছোটোগল্প-সংকলন: ছলনাময়ী (১৯৩৭), জলসাঘর (১৯৩৮), রসকলি (১৯৩৯), তিন শূন্য (১৯৪২), প্রতিধ্বনি (১৯৪৩), বেদেনী (১৯৪৩), দিল্লী কা লাড্ডু (১৯৪৩), যাদুকরী (১৯৪৪), স্থলপদ্ম (১৯৪৪), তেরশো পঞ্চাশ (১৯৪৪), প্রসাদমালা (১৯৪৫), হারানো সুর (১৯৪৫), ইমারত (১৯৪৭), রামধনু (১৯৪৭), শ্রীপঞ্চমী, কামধেনু (১৯৪৯), মাটি (১৯৫০), শিলাস্থান (১৯৫২), বিস্ফোরণ (১৯৫৫), কালান্তর (১৯৫৬), বিষপাথর (১৯৫৭), রবিবারের আসর (১৯৫৯), পৌষলক্ষ্মী (১৯৬১), আলোকাভিসার, চিরন্তনী (১৯৬২), অ্যাক্সিডেন্ট (১৯৬২), তমসা (১৯৬৩), আয়না (১৯৬৩), চিন্ময়ী (১৯৬৪), একটি প্রেমের গল্প (১৯৬৫), তপোভঙ্গ, দীপার প্রেম (১৯৬৬), নারী রহস্যময়ী (১৯৬৭), পঞ্চকন্যা (১৯৬৭), শিবানীর অদৃষ্ট (১৯৬৭), গোবিন সিংয়ের ঘোড়া (১৯৬৮), জয়া (১৯৬৮), এক পশলা বৃষ্টি (১৯৬৯), মিছিল (১৯৬৯), উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)।
নাটক: কালিন্দী (১৯৪২), দুইপুরুষ (১৯৪৩), পথের ডাক (১৯৪৩), বিংশ শতাব্দী (১৯৪৫), দ্বীপান্তর (১৯৪৫), যুগবিপ্লব (১৯৫১), কবি (১৯৫৭), কালরাত্রি (১৯৫৭), সংঘাত (১৯৬২), আরোগ্য নিকেতন (১৯৬৮)।
প্রহসন: চকমকি (১৯৪৫)। প্রবন্ধ সংকলন: সাহিত্যের সত্য (১৯৬১), ভারতবর্ষ ও চীন (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী (১৯৭১)। স্মৃতিকথা: আমার কালের কথা (১৯৫১), বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী (১৯৫৩), আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম খণ্ড (১৯৫৩), কৈশোর স্মৃতি (১৯৫৬), আমার সাহিত্য জীবন, দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬২)। ভ্রমণসাহিত্য: মস্কোতে কয়েক দিন (১৯৫৯)।
রচনা-সংকলন: তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৪৭), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প (১৯৫৩), স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৫৪), গল্প-সঞ্চয়ন (১৯৫৫), ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫৬), রচনাসমগ- প্রথম খণ্ড (১৯৫৯), প্রেমের গল্প (১৯৬১), ছোটদের ভালো ভালো গল্প (১৯৬২), গল্প-পঞ্চাশৎ (১৯৬৩), কিশোর সঞ্চয়ন (১৯৬৬), ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৬৯)।
তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালি কলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি।
‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসটির মূল বিষয় তৎকালীন হিন্দু সমাজের রূপ ও আচার, প্রেম, জীবনসংগ্রাম, মনের বিভিন্ন দিক ইত্যাদি। প্রেম এ উপন্যাসের মুল উপজিব্য বিষয়। মুলত একটি মানুষকে ঘিরেই উপন্যাসটি আবর্তিত। সে মানুষটি হল নিতাই, নিতাইচরন। নিতাই খুব নিচ বংশের ছেলে, পুর্ব পুরুষের পাপে সে অতিষ্ট। চোর, ডাকাত, খুনিদের বংশে জন্মেও সে চায়, ‘জন্মের চেয়ে কর্মকে বড় করে দেখতে’। সে সুমিষ্ট কন্ঠে জগৎকে জয় এবং বংশের পাপ লোচন করতে যায়। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
রেলস্টেশনে অবস্তানের পর সুযোগ পেয়ে নিতাই গ্রামের আসরে কবি গান গেয়ে বনে যায় নাম করা কবিয়াল। নিতাই ঠাকুরঝিকে মনে মনে ভীষন ভালবাসিত। কিন্তু প্রকাশ করিত না। একদিন রাজা ঠাকুরঝিকে কালো-কুচ্ছিত বলে বকাঝকা করলে নিতাই তার রাগ ভাঙ্গায় সবার অগোচরে এই বলে, ‘কাল যদি মন্দ হবে কেশ পাকিলে কাদ কেনে?/ কালো চুলে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?’ ভালবাসা আর ভয় একসাথে একাকার হয়ে যায় এখানে এসে, ‘চাদ দেখে কলঙ্ক হবে বলে কে দেখে না চাদ?/ তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভালো ঘুচুক আমার দেখার সাধ।’ এর মধ্যে ঠাকুরঝিও তার ভালবাসার আচ করতে পারলেও বিধিবাম। বুঝতে পারে বাস্তবতা আরও গভীরভাবে।
এক পর্যায়ে বাসন্তির সাথে প্রেম জমে উঠে নিতাইয়ের। নিতাইয়ের ভাষ্য, ‘এই খেদ মোর মনে, ভালবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে। হায় জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে?’ কিন্তু বাসন্তি পরজীবনে পাড়ি দেয়ায় শোকে-দুঃখে পাগলপ্রায় নিতাই ঝুমুর দল ছেড়ে বৈরাগী হয়। অবশেষে ট্রেনে চেপে দেশে ফেরে নিতাইচরন। ততদিনে সে মস্তকবি আর ঠাকুরঝিও গত। তাই নিতাইয়ের শেষ ইচ্ছা প্রতিভাত হয় রাজার সাথে মায়ের দরবারে গিয়ে... ‘জীবন এত ছোট কেনে?’
‘ডাক হরকরা’ তারাশঙ্করের আরেকটি সেরা গ্রন্থ। রাত্রির বাঁধা উপেক্ষা করে যারা ব্রিটিশ ভারতের কোণায় কোণায় ডাক পৌঁছে দিত, সেসব ডাক-হরকরার সংগ্রামী জীবন নিয়ে লেখা সুকান্তের কবিতা রানার এর আগেই তুলেছি। সেই সূত্র ধরেই একজন ডাক বহনকারীকে নিয়ে লেখা তারাশঙ্করের একটি গল্প। এটি এক নীতিবান ডাক বাহক ও তার দুশ্চরিত্র সন্তানকে নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ গল্প।
তারাশঙ্করের ‘আমার সাহিত্য জীবন’ও একটি দারুণ বই। এই বইয়ে বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা।
তাঁর রচনার বিষয় এবং রচনার চরিত্রগুলোর দিক থেকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হল গ্রাম্যজীবন ভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী, আর দ্বিতীয়টা হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। একটা ভাগ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পর্যন্ত। আর একটা ভাগ ‘মন্বন্তর’ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ তারাশঙ্করের প্রথম ধারার শেষ পর্বের মহাকাব্যিক উপন্যাস। জীবনবোধের প্রথম থেকেই রাজনীতির উপস্থিতির কারণেই তিনি ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাস ত্রয় রাজনৈতিক মহাকাব্যিক অনুষঙ্গে লিখতে সমর্থ হন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে।
তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে জন্মভূমি বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি নিজে জমিদার বংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহর জীবনের বিকাশ। সমাজের এ নীরব পরিবর্তন তাঁর রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
এছাড়াও আদিমতান্ত্রিক ঐতিহ্য, প্রেম, অপ্রেম, পরকীয়া, সৌখিনতা, বিলাসিতা, বৈরাগ্য, বৈষ্ণব সহজিয়াভাব, অবহেলা, প্রবঞ্চনা, তঞ্চকতা, দ্বন্দ্ব- সংঘাত, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, ভাঙা-গড়ার কাহিনী বিধৃত করেছেন নানা অনুষঙ্গে, নানা আঙ্গিকে, নানা ঘরাণায়।
তাঁর একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ত্রিপত্র’ (১৯২৬) প্রকাশ করেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে আগাগোড়া কাব্যগ্রাহী। পরবর্তীকালে তাঁর লেখা গল্প- উপন্যাসের কাব্যিক গদ্যের উপস্থিতি উজ্জ্বল মহিমায় ভাস্বর। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ (১৯৩৯) এর প্রথম কয়টি ছত্র থেকে আমরা তাঁর গদ্যের কাব্যিক অনুষঙ্গকে নিরীক্ষণ করতে পারি। “অনাবৃষ্টির বর্ষায় খররৌদ্রে সমস্ত আকাশ যেন মরুভূমি হইয়া উঠিয়াছে; সারা নীলিমা ব্যাপিয়া একটা ধোঁয়াটে কুয়াশাাচ্ছন্ন ভাব। মাঝে মাঝে উত্তপ্ত বাতাস হু হু করিয়া একটা দাহ বহিয়া যায়।” ‘রসকলি’র মতো গল্পে, ‘কবি’ ও ‘রাইকমল’-এর (১৯৪৩) মতো উপন্যাসে রোমান্স আর রসঘন অনুষঙ্গ তারশঙ্করের কবিতা প্রীতিরই উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে।
তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন। বিশেষ করে তার রচিত ছোট গল্পগুলো একেকটি হীরকখন্ডতুল। তিনি বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান কারিগর ও নির্মাতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প রচনায় হাত না দিলে হয়তো তারাশঙ্করই হতেন বাংলা ছোটগল্পের জনক।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’, ‘কালিন্দী’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’ ও ‘বেদেনি’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন প্রখ্যাত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায়।

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৭), ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬), আরোগ্য নিকেতনের জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৫৫), একই উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৮) উপাধি লাভ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন