সাহিত্য-সমালোচনার কথকতা

indexdd-hap
হাসান অরিন্দম  
সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রি.পূ.) সেকালে তার দেশে বিজ্ঞজন বলে পরিচিতদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেন তারা আসলে যথেষ্ট বিজ্ঞ নন। তিনি যত্ন ও সতর্কতার সাথে লেখা কিছু কবিতা আলোচনার জন্য নির্বাচন করেন। পরে তিনি উক্ত কবিতাগুলোর কবিদের কাছে কবিতার ব্যাখ্যা জানতে চান। কিন্তু তাতে কবিগণ ব্যর্থ হন। এ থেকে সক্রেটিস সমালোচনা বিষয়ে একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা পেয়ে যান, তা হলো : বিজ্ঞ বলেই কবিরা কাব্য রচনা করেন এমন নয়, তাদের কাব্য রচিত হয় একটি বিশেষ গুণ বা প্রতিভার দ্বারা- যা থাকে সৃজনী উন্মাদনার মূলে। বস্তুত কাব্য রচনা করার শক্তি এবং তা উপভোগ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবার শক্তি অনেকটা আলাদা তিন জাতের।

আত্মপ্রকাশের তাগিদ থেকেই শিল্পের গোড়াপত্তন। নিজের ভাবনা-কল্পনা অপরের কাছে পৌঁছে দেয়া শিল্পী-সাহিত্যিকের মূল অভিপ্রায়। শিল্পকে বলা হলো পরিপার্শ্ব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে অনুভব করার এক বিশিষ্ট কৌশল। সৃজনপ্রায়াসী মানুষ নিজেকে নিজের বাইরে প্রকাশ ও অবলোকন করে আনন্দ অনুভব করে। তবে যেনতেনরূপে ভাব প্রকাশে শিল্প সৃষ্টি হয় না। বহু লোকই কবিতা লেখেন, গানে সুর যোগান, পাথর কেটে মূর্তি গড়েন, রঙতুলিতে ছবি আঁকেন কিন্তু সকল মানুষের এসব কাজ শিল্প হয়ে ওঠে না, বা বলা যায় সহৃদয়-হৃদয়সংবেদী হয় না। কারণ তাতে হয়তো কোনো ফাঁকি বা দুর্বলতা থাকে। অন্যদিকে যেগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের রসবোদ্ধাদের দ্বারা আদৃত হয় তার কিছু উৎকর্ষ আছে।

শিল্প সম্পর্কে সমালোচকদের এক আদি পুরুষ প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ.) তার ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থের দশম খ-ে এ বিষয়ক অভিমত ব্যক্ত করেন। তার মতে পার্থিব লোকে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি তা আসল বা আদর্শের দোষযুক্ত অনুকৃতি। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ সেই অনুকৃতি দেখে আবার অনুকরণ করে তাদের শিল্পকর্ম গড়ে তোলেন। এভাবে শিল্পীরা নকলের নকল করে মূল থেকে তিন ধাপ বিচ্যুত হন। তাই প্লেটোর সিদ্ধান্ত : একান্তই অনুকরণনির্ভর বলে শিল্প-সাহিত্য থেকে শেখার কিছু নেই। প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২) এ ক্ষেত্রে গুরুর সাথে একমত প্রকাশ করেননি। এরিস্টটল মনে করেন অনুকরণের প্রয়াস থেকে শিল্পের জন্ম বটে কিন্তু সেই অনুকৃতির রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করেই মানুষ আনন্দ পায়। তিনি এ বিষয়ে পোয়েটিকস নামে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন, তাতে কাব্য, ট্র্যাজেডি, মহাকাব্য, কমেডি প্রভৃতি বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে। তার এ বিষয়ক অনেক বক্তব্যই আজও শিল্পবিচারের ক্ষেত্রে শিরোধার্য বলে মনে করা হয়। তিনি গুরু প্লেটোর মতো জগতের বাইরে কোনোকিছুর ‘আদর্শ’ অস্তিত্ব কল্পনা করেননি বলে তার কাছে অনুকরণকে খারাপ কিছু বলে মনে হয়নি। বরং তার মতে আপাত কদাকার বিষয়ের অনুকরণেও উৎকৃষ্ট শিল্প সৃষ্টি হতে পারে।
প্রাচীন ভারতে সাহিত্য সমালোচনা সাধিত হয়েছে মূলত অলঙ্কারশাস্ত্র, নন্দনতত্ত্ব ও রসতত্ত্বের মোড়কে। ভারতীয় অধ্যাত্ম-চেতনা প্রভাবিত আর্যঋষিরা সকল কিছুর মধ্যেই বিরাটের অস্তিত্ব অন্বেষণ করেছেন। তাই তারা সবকিছুর মধ্যেই সৌন্দর্যের বীজ লুক্কায়িত দেখেন এবং তারা বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অলৌকিকতাকে প্রাধান্য দেন। কারণ তাদের মতে, লৌকিক আনন্দ অপরিপূর্ণ ও খ-িত আর অলৌকিক আনন্দ অখ- ও পরিপূর্ণ। ভারতীয় সংস্কৃতিতে কাব্যের মুখ্য লক্ষ্য হলো রস-রসানুভূতিজনিত আনন্দ, বস্তুত তা হলো তাদের মতে অসীমের সাথে মিলে যাওয়ার আনন্দ। তাই আচার্য্য বিশ্বনাথ বলেন, ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’। যে বাক্যের আত্মা রস, তা-ই হলো কাব্য। এখানে বলা দরকার উপনিষদে ঋষিগণ ‘রস’ বলতে পরমাত্মাকেই নির্দেশ করেছেন এবং রস ও পরামাত্মা অভিন্ন। পরমাত্মা হলেন সকল আনন্দ, চেতন্য ও সৌন্দর্যের আধার। ফলে অখ- বাক্যার্থেই অপার্থিব আনন্দ, অখ- সৌন্দর্য ও বিশ্বচেতনার প্রকাশ- এই হলো ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের মৌলমর্ম।
পাশ্চাত্য সাহিত্য-সমালোচনার বিকাশ পর্বের এক দিগদ্রষ্টা Quintus Horatius Flaccus বা হোরেস (৬৫-৮ খ্রি. পূ.) তার Epistula ad Pisones বা ‘আর্স পোয়েটিকা’তে শিল্প ও কাব্য সস্পর্কে যে অভিমত প্রকাশ করেন একালের শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে তা গুরুত্ববহ। মূলত এক তরুণের কাছে পত্র আঙ্গিকে লেখা এই রচনায় হোরেস তরুণদের লেখা প্রকাশের জন্য ব্যতিব্যস্ত না হয়ে সত্যিকারের শিল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। কাব্যকে খামখেয়ালি বা পাগলামি বলে মনে করেননি হোরেস। তিনি শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিমিতি ও সামঞ্জস্যের ওপর গুরুত্ব দেন। হোরেস মনে করেন সকলে একই শ্রেণী কিংবা ধারার শিল্প বা সাহিত্যকর্মের জন্য যোগ্য নন, যার-যেদিকে সামর্থ্য বা সম্ভাবনা অধিক তার সেই দিকটাই বেছে নেয়া উচিত। এই তাত্তি্বক মনে করেন কবিরা ভাষা প্রয়োগ ও শব্দ ব্যবহারে নতুনের অন্বেষী হবেন। Peri hypsos বা On the Sublime গ্রন্থের লেখক লঙ্গিনাস সাহিত্যে Sublimity ধারণার প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যিনি মানুষ হিসেবে মহৎ ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী কেবল তার পক্ষেই উচ্চস্তরের মহিমা-চিহ্নিত সাহিত্য রচনা সম্ভব। কারণ তার মতে উৎকৃষ্ট রচনা হলো মহৎ চিত্তের প্রতিধ্বনি। Sublime কথাটি দিয়ে তিনি যে মহিমান্বিত সাহিত্যকে বুঝিয়েছেন সে সাহিত্য পাঠককে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দিতে সক্ষম, তা একবার পড়েই পাঠকের তৃপ্তি মেটে না, যতবার পড়ে ততবারই অনুপ্রাণিত হয়।
মার্কসবাদীরা শিল্পকে একটি সামাজিক উৎপাদন এবং শিল্পীকে ভাবনার উৎপাদক ও শ্রমিক হিসেবে দেখে থাকেন। মার্কসের মতে, অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরেই নির্মিত হয় শিল্প-সাহিত্যের সুপার-স্ট্রাকচার। তাই সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা অপরিহার্য। তার মতে সাহিত্যে রাজনীতি আসতেই পারে, সে কারণে কোনো সাহিত্যকে তুচ্ছ করা চলে না। তবে সাহিত্যকে সাহিত্যরূপেই উত্তীর্ণ হতে হবে।
সমালোচনার প্রথম কাজটি শিল্পী নিজেই করেন নিজের চেতনার ভেতরে। বস্তুত প্রতিটি শিল্পীর মধ্যেই শিল্পীর সমান্তরালে একজন সমালোচক থাকেন, সত্যিকার শিল্পী সযত্নে সেই সমালোচক-সত্তাকে নিজের চেতনায় লালন করেন। তাই দেখা যায় ভাস্কর হয়তো নিজের গড়া মূর্তি নিজের হাতে বিচূর্ণ করেন, রঙ লেপ্টে নিজেই নষ্ট করেন নিজের তেলরঙের ক্যানভাস; কবিরা লেখার মধ্যে অজস্র কাটা-ছেঁড়া করেন, একটি কাঙ্ক্ষিত শব্দের জন্য অপেক্ষা করেন দিনের পর দিন, এক উপন্যাস তৃতীয় বা চতুর্থবার পর্যন্ত লেখা হয়, তবু তৃপ্ত হয় না লেখকের শিল্পিমন। যে কোনো শিল্পীর ভেতর যদি একই সাথে একজন সমালোচক সত্তা না থাকে, না থকে অতৃপ্তি, তাহলে তিনি বেশিদূর এগোতে পারেন না, একই বৃত্তে থমকে যায় তার কাজ, কিংবা তা নিতান্তই অপরিণত রয়ে যায়। লেখক-কবিরা যখন উপলব্ধি করেন এই কথাটা ওভাবে কিংবা ওই শব্দে নয়, ভিন্নরূপে অন্য ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে, এই পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে সফল নির্বাচকই সফল লেখক হন। লেখার কাজ করতে গিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের ভেতর একটা সমালোচক সত্তা বেড়ে ওঠে বলে অনেক লেখক নিজের বা অন্যের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কিছু লিখেও যান। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মোহিতলাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখ বাংলা সাহিত্য সমালোচনার অগ্রপথিক।
সমালোচক-সত্তা থাকে সাধারণ পাঠকের মধ্যেও, তাই তিনি সব লেখকের সকল লেখা পড়েন না। তিনি তার বোধবুদ্ধি আর শিল্পীচেতনার কষ্টিপাথরে যাচাই করে তার পছন্দের লেখক কিংবা লেখা নির্বাচন করেন। এভাবে পাঠকের রুচিও ক্রমে উন্নততর পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। T.S. Eliot সমালোচনার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন, ‘…we might remind ourselves that criticism is as inevitable as breathing and that we should be none the worse for articulating what passes in our minds when we read a book and feel an emotion about it, for criticizing our own minds in their work of criticism. সমালোচনার ক্ষেত্রে এলিয়ট মূলত কবি নয়, কবিতাকেই প্রাধান্য দেয়ার কথা বলেন। তাছাড়া তার মতে এককভাবে একজন শিল্পী বা লেখক গুরুত্বহীন, লেখকের কেউ ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন নন; অতীত কবি বা শিল্পীর সঙ্গে তুলনার মাধ্যমেই তার অবস্থান নির্ণীত হয়। কোনো নতুন সৃষ্টির উৎকৃষ্টতা তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা যায় না, সময় পেরুলে তার প্রকৃত অবস্থান নির্দিষ্ট হয়।
পেশাদার শিল্প-সমালোচকের কাজটি জটিল ও শ্রমসাধ্য। তাকে শিল্প, এর নানা তত্ত্ব-মতবাদ, ইতিহাস, সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিল্পীর জীবন প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। পাশাপাশি তার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন প্রকাশের জন্য চাই যুক্তি ও উপযুক্ত ভাষা। প্রচারিত অর্থে সমালোচনা হলো সাহিত্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন, এ ক্ষেত্রে সমালোচককে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির সমান্তরালে পৌঁছতে হয়, অন্যথায় সে মূল্যায়ন যথাযথ হয় না। Lascelles Abercorombie (এবারক্রম্বি, ১৮৮১-১৯৩৮ খ্রি.) মনে করেন, প্রতিটি শিল্পকর্মই এক-একটি অসাধারণ ঘটনা, সেই অনুযায়ীই এর বিচার করতে হবে এবং সেই বিচার মুখ্যত গুণাগুণে। দেখে যত সহজ মনে হয় এর সূত্রটি মোটেও ততো সহজ নয়। কারণ আমরা তো সহজে লেখকের অভিপ্রায়গুলো জানতে পারি না।
সমালোচক লেখক ও পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করেন, দুর্বোধ্য লেখার সাথে সখ্য সৃষ্টি করে দিতে পারেন তিনি। এটি সাহিত্যের আঙিনায় একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র। রুচি, সহৃদয়তা, বোধ, সূক্ষ্মদৃষ্টি, রুচি-চেতনা ও প্রকাশভঙ্গির গুণে একটি শিল্পকে অবলম্বন করে সমালোচনাও মৌলিক সৃষ্টি হয়ে ওঠে। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন আগে ভাষা, পরে ব্যাকরণ তার অনুগামী হয়; তেমনি সাহিত্যের অনুগামী হলো সাহিত্যতত্ত্ব বা সাহিত্য সমালোচনা। যেখানে সাহিত্য নেই সেখানে সমালোচনার প্রশ্ন অবান্তর। সমালোচকের পক্ষে উন্নাসিক, উদাসীন, অসতর্ক বা নির্দয় হওয়ার সুযোগ নেই। সত্যিকার সমালোচকের দ্বারা শিল্পী-সাহিত্যিকরা উপকৃতও হতে পারেন। লেখক হয়তো প্রায়ই অন্যের সমালোচনা বা পরামর্শের ধার-ধারেন না। কিন্তু সমালোচকের দ্বারা লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অল্পাধিক বদলানো বিচিত্র বা দোষের কিছু নয়। একজন লেখক কোনো একটি সমালোচনায় হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে আহত বোধ করলেন, আবার পরবর্তী কোনো এক সময়ে লেখক উপলব্ধি করতেও পারেন যে ঐ সমালোচক সেদিন যথার্থই বলেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বুদ্ধদেব বসু সমালোচনার কাজটিকে পুরোহিতের পূজার মতো মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু-কৃত ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সমালোচনা মাথা পেতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘… শেষ অংশে যে মন্তব্য দিয়েছে তা পড়ে খুব খুশি হয়েছি। চোখের বালি বেরোবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত।’ আবার সমালোচনা পছন্দ না হওয়ায় লেখক-সমালোচক পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন- এমন দৃষ্টান্তও আছে অনেক। বহু বড় সাহিত্যিক ঈর্ষার শিকার হয়ে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েন। আমরা জানি কেবল নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে সে সময় কত বিরূপ সমালোচনা আর প্যারোডি লেখা হয়েছে। অথচ কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল পঠিত এবং বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচিত।
সমালোচকের নীতি নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার মতো পরিবেশের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে সে সমালোচনা যদি কোনো কারণে একপেশে হয়। আবার লেখক নিজেই তার পছন্দের কাউকে দিয়ে নিজের মর্জিমাফিক আলোচনা করিয়ে নিয়ে তার প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন, কিংবা দুজন লেখক পরস্পরের স্তূতি করবার বিষয়ে অলিখিত সমাঝোতা করেছেন, যা ‘পারস্পরিক পৃষ্ঠ ক-ুয়ন’ বলে অভিহিত- অন্তত এ দেশে তা অহরহই দেখা যাচ্ছে। তাতে সংশ্লিষ্টদের সুদূরপ্রসারি কোনো লাভ হচ্ছে কিনা সেটি পরের কথা, প্রচারে তাৎক্ষণিক তো কিছু প্রসার ঘটেই।
মানবজীবন ও সভ্যতা গতিশীল বলে কালে কালে সাহিত্যের নতুন নতুন আঙ্গিক আসে, আসে নতুন দর্শন, শৈলী ও আন্দোলন; ফলে সমালোচনার রীতি ও ধারাও বদলায়। সমালোচককে তাই সে সবের খবর রাখতে হয়, শাণিত রাখতে হয় নিজের দৃষ্টি। সমালোচককে নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ধারণ করতে হয় বটে, তবে সাহিত্য সমালোচনা পুরোপুরি বিজ্ঞান নয়। অনেক সময় পাঠক টেঙ্ট না পড়ে আগে হয়তো সমালোচনা পড়েন, পরোক্ষভাবে পেয়ে যান মূলের স্বাদ। এমনও হতে পারে, কোনো একটি সমালোচনা পাঠের পর পাঠক মূল লেখাটি পাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তখন ঐ পাঠকও কিন্তু যাচাই করতে পারেন সমালোচককে, বা সমালোচকের দেখানো নতুন পথ তাকে সাহিত্যের রসাস্বাদনে আরও সহৃদয় করে তোলে। ফলে সমালোচক এখানে লেখক ও পাঠক উভয়েরই বন্ধু। সমালোচক শিল্পবোধ, সামাজিক আন্দোলন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ধর্ম-দর্শন, ভাষা-সৌন্দর্যতত্ত্ব প্রভৃতি দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকে দেখতে পারেন। তিনি বিশ্লেষণের পর সাহিত্যের উৎকর্ষ ও সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করতে পারেন।
অন্য শাস্ত্রের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, এখানে সুনির্ধারিত বিষয়ের চেয়ে স্বাধীনতা অধিক। সমাজবিজ্ঞান, কলা বা বিজ্ঞানের অধিকাংশ টেঙ্টের সমালোচনা হয়তো বিশ্বের সমালোচনার মতো আবশ্যক নয়। অন্য শাস্ত্রে বিমূর্ততা তেমন নেই, টেঙ্টই যেখানে মূল ও আবশ্যক প্রকাশ ধারণ করে, সেখানে শিল্পের যথাযর্থ আস্বাদ গ্রহণের জন্য আরও কিছু অন্তর্নিহিত অর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। তাই দেখা যায়, যারা উচ্চপর্যায়ে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে চর্চা করেন তাদের অপেক্ষা বেশি সমালোচনা-গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে হয়।
কারণ শিল্পে কিছু বিমূর্ত বিষয় থাকে, তা যতটা না বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে হয় তার চেয়ে বেশি অনুভব ও উপলব্ধির বিষয়। আর সে কারণেই শিল্পের সমালোচনাও শিল্প হয়ে উঠতে পারে। পাঠক একটি গ্রন্থ পাঠের পর যখন তার সমালোচনা পড়েন তখন সেই পড়াটি আবার নতুন করে যাচাই হয়, তিনি হয়তো যে দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি দেখেননি বা দেখতে পারেননি তেমন জায়গা থেকে আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন সমালোচক, এতে অবশ্যম্ভাবী রূপেই পাঠকের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কেবল সাহিত্য নয়, শিল্পের যে কোনো শাখা-চিত্রকলা, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, ভাস্কর্য-প্রভৃতির বিকাশ ও ক্রমোন্নতির জন্য শিল্পচর্চার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সমালোচনার ধারা গড়ে ওঠা অপরিহার্য। এ রচনার শেষে আবারও মনে করছি; টিএস এলিয়ট সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমালোচনাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই আবশ্যক বলে উপলব্ধি করেছেন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন