নারীবাদ, নারীবাদী সাহিত্য এবং বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলন-

feminism
নাজিব ওয়াদুদ
নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, লিঙ্গ বিতর্ক এবং নারীবাদ (Feminism) একেবারেই আধুনিক প্রপঞ্চ, এবং উদ্ভব প্রায় একইসঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। এই শব্দবন্ধগুলি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বুদ্ধিবৃত্তিক আকার পায়, এবং শেষ দিকে জনমুখিনতা অর্জন করে। নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটি শতাব্দীপ্রাচীন, তবে এর বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসের শুরু মোটামুটি ১৮৩০ সাল থেকে। একধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এটি ব্যাপ্ত হয় ১৯২০ সাল পর্যন্ত, এটা ছিল মূলতঃ নারীশিক্ষা ও ভোটাধিকার অর্জনের আন্দোলন। নারীবাদের ইতিহাসে এই কাল-পরিসরকে প্রথম পর্যায় বা তরঙ্গ ধরা হয়। দ্বিতীয় তরঙ্গ বা পর্যায়ের শুরু ১৯৬০ সাল থেকে, এটি সংগঠিত আন্দোলনের কাল। এই পর্যায়ে এসে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নটি প্রকাশ্য ও বহুমাত্রিকতা লাভ করে, শুরু হয় এর বাস্তবায়ন ও অনুশীলনও। পরিবার ও সমাজে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, সর্বস্তরে চাকরি ও কাজ করার অধিকার, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ এবং গর্ভপাত ও জন্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা, ইত্যাদি ছিল এর মূল বিবেচ্য বিষয়।
১৯২১ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সময়টুকুকে এই পর্যায়ের মাঝখানে সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অন্তর্বর্তীকালের মধ্যেই ফ্রান্সের মহিলা দার্শনিক সিমোন দ্য বোভেয়ারের মাইলস্টোনগ্রন্থ দি সেকেন্ড সেক্স (নিজ ভাষায় ১৯৪৯ সালে, ইংরেজি অনুবাদে ১৯৫৩ সালে) প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগ দেশেই তখনও গর্ভপাত এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ ছিল। এই গ্রন্থের অনেক বিষয় এবং দৃষ্টিভঙ্গিই ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়, কালে কালে কিছু-কিছু অগ্রহণযোগ্যও হয়ে পড়ে, তথাপি এই বইটির নৈতিক প্রভাব নারীবাদী আন্দোলনের ওপর এখনও বর্তমান। তার মূল কারণ গ্রন্থটির বিশ্লেষণের পরিসরের ব্যাপকতা। লিঙ্গ বৈষম্যকে সংজ্ঞায়িত ও শনাক্ত করতে গিয়ে বোভেয়ার জীববৈজ্ঞানিক, মনোবৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের সাহায্যে কীভাবে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির লিঙ্গে রূপান্তরিত করা হয়েছে তার চিত্র অঙ্কন করেন। এই গ্রন্থটি নারীবাদকে প্রথম পর্যায়ের নাগরিক এবং শিক্ষাগত অধিকার থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ অনুসন্ধান এবং সর্বব্যাপক নারী স্বাধীনতার আন্দোলনে উন্নীত করতে ভূমিকা রাখে। তিনি নারীত্ব, মাতৃত্ব, বিবাহ, ইত্যাকার নৈতিক ও সামাজিক বোধ ও প্রথাকে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পরে যে বহুবিধ রকমের নারীবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে তার মূল নিহিত বোভেয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গতে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম দিকে মূল স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয় হয় ‘সমমানের কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক চাই’(equal pay for equal work)। এই সমানাধিকারমূলক নারীবাদী (equality feminism) ধারণার উদ্গাতা আমেরিকান নারী নেত্রী বেটি ফ্রিড্যান, তাঁর বইটির নাম দি ফেমিনাইন মিসটিক, এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। বোভেয়ারকে যেমন ইউরোপে দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রনায়িকা হিসেবে গণ্য করা হয়, তেমনি ফ্রিড্যানকে আমেরিকায় একই মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ উইমেন’ (NOW) গঠন করে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন।
নারীবাদী আন্দোলনের শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন সব সময় কম-বেশি বিতর্কের উৎস হয়ে থেকেছে, সেটা হলো, পুরুষ ও নারীর মধ্যকার জন্মগত ও প্রাকৃতিক পার্থক্য কি কাউকে অধিকতর মর্যাদা দেয়, বা কারো মর্যাদাকে অবনমিত করে? দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে এই বিতর্ক থেকে উদ্ভূত হয় এসেনশিয়ালিস্ট ফেমিনিজম। বোভেয়ারের চিন্তাধারার বিপরীতে এই এসেনশিয়ালিস্ট নারীবাদীদের বিশ্বাস এই যে, যেহেতু নারীরা জীববৈজ্ঞানিকভাবে পুরুষদের থেকে আলাদা, সেহেতু তারা মনোবৈজ্ঞানিক ও আবেগগত ভাবেও আলাদা। এই পার্থক্য অনিবার্য ও অপরিহার্য। একজন পুরুষ হওয়া যেমন লজ্জার বিষয় নয়, উপভোগের ব্যাপার, একজন নারীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনি, নারী হওয়া পুরুষ হওয়ার মতোই সমান গর্বের ব্যাপার। তারা মনে করেন, পুরুষ-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা সামাজিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো থেকে নারীকে মুক্ত হয়ে অনন্য নারী পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। বোভেয়ার মনে করেন, লৈঙ্গিক পার্থক্য একটা সাংস্কৃতিক শর্তের প্রতিফল। সমাজই নারীকে ‘অন্য’ অর্থাৎ পুরুষ থেকে ভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যেসব যুক্তি ও বিষয়কে অবলম্বন করে এই পার্থক্য (আসলে বৈষম্য) সৃষ্ট হয়েছে সেগুলিকে শনাক্ত ও দূর করতে হবে যেন নারী পুরুষের সমান হওয়ার যোগ্যতা ও যুক্তি অর্জন করতে পারে। এর বিপরীতে, এসেনশিয়ালিস্টরা মনে করেন, সমানত্বর পূর্বধারণাটিই ভুল, এটি নারীকে পুরুষসমাজে আত্মীকৃত হতে উৎসাহিত করে মাত্র, তার নিজস্বতা থাকে না বা হ্রাস পায়। এই দুই বিপরীত ধারণার বিতর্ক থেকে নারীবাদী চিন্তা নানাদিকে ধাবিত হয়েছে, এবং নারীবাদকে বিভিন্ন নাম ও বৈশিষ্ট্যে পরিচিত করেছে। সে কারণে নারীবাদ, নারীমুক্তি, নারীস্বাধীনতা, নারীর অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ কোনও সর্ববাদীসম্মত ধারণাকে বোঝায় না।
পরবর্তীকালে বোভেয়ারের অ্যান্টি-এসেনশিয়ালিস্ট চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছেন আমেরিকান উগ্রপন্থী নারীবাদী চিন্তাবিদ শুলামিথ ফায়ারস্টোন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ দ্যা ডায়ালেকটিক অফ সেক্স নারীমুক্তি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়কে গতিমান করে। এই গ্রন্থে তিনি পূর্বসূরি বোভেয়ারের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন, নারীকে তার জীববৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। বোভেয়ারের মতো তিনিও মনে করেছেন সন্তানধারণ ও লালনপালনের পদ্ধতিই মূলত নারীমুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা, সেজন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, গর্ভপাত, কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণ, সামাজিকভাবে শিশুপালন, ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারীকে পুরুষ-নির্ভরতা থেকে মুক্ত করার কথা এসেছে তাঁর চিন্তায়। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, একবার যদি জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্য দূর করা যায় তাহলে নারী পুরুষের সমান হয়ে উঠবে। তিনি নারীত্ব ও মাতৃত্ববোধকে কাঙ্ক্ষিত বলে বিবেচনা করতে নারাজ। অবশ্য অনেক নারীবাদীই তাঁর চিন্তাকে অস্বাভাবিক ও উগ্রপন্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা নারীর নারীত্ব ও মাতৃত্ববোধকে নেতিবাচক গুণ বলে মানতে চান না।

আমেরিকান নারীবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ মেরি ডালি আরও উগ্র মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেন তাঁর গ্রন্থ গাইন/ইকোলজি (Gyn/Ecolog)। তাঁর মতে, ধর্ম, আইন এবং বিজ্ঞান পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার হাতিয়ার। তিনি বিশেষভাবে খ্রীষ্টতত্ত্বের ‘প্রভু পিতা’ (God the father) ধারণার কঠোর সমালোচনা করেন এবং একে নারীমুক্তির পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি এমনকি একটি নারীবাদী অভিধানও প্রণয়ন করেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, নারী প্রাকৃতিকভাবেই শান্তি এবং লালন-পালনের প্রতি আগ্রহী, যা তাকে চারপাশের প্রতিবেশ ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি ও সমন্বয়সাধনে সক্ষম করে তোলে। পুরুষরা তার বিপরীত। বোভেয়ার মনে করেন প্রকৃতির সঙ্গে নারীর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসেনশিয়ালিস্টরা প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সঙ্গতি ও সমন্বয়কে গুরুত্ব দেন। এখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে ‘ইকোফেমিনিজম’ (Ecofeminism)| বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শান্তিবাদী আন্দোলন এই ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে। ‘সেপারেটিস্ট ফেমিনিজম’ (Separatist Feminism) নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করে নিতে চায়। এখান থেকে সৃষ্টি হয় ‘লেসবিয়ান ফেমিনিজম’ (Lesbian Feminism)–এর। এরা পুরুষকে পরিহার করে নারীতে নারীতে বিয়ের তত্ত্ব প্রচার করেন। মার্কসবাদী নারীবাদ (Marxist Feminism) ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদ (Socialist Feminism)–এর প্রবক্তারা মনে করেন উৎপাদনব্যবস্থার পুঁজিবাদী ব্যবহার নারীমুক্তির প্রধান প্রতিবন্ধক।
এ রকম আরও অনেক রকম চিন্তা নারীবাদকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব চিন্তা ও দর্শন মূলত ইউরোপ ও আমেরিকাকেন্দ্রিক জীবনযাপনকে বিবেচনায় নিয়ে উদ্ভূত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকায় বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা হিসেবে তো নয়ই, বাস্তব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেও এসব চিন্তাধারা কাজ করেনি, যদিও তার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। এই প্রভাবের মূল কারণ ঔপনিবেশিক শাসন, স্বাভাবিক পন্থায় এর বিস্তৃতি ঘটেনি। জীবনদর্শন এবং সাংস্কৃতিক মূল্যমানের পার্থক্যও বড় কারণ। সেজন্য মধ্যপ্রাচ্য, চীন এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে যে নারীবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটে তা ইউরোপ-আমেরিকার চিন্তাধারা থেকে অনেকটাই পৃথক। উদাহরণস্বরূপ মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর কথা বিবেচনা করা যায়। এসব দেশের সমাজপ্রেক্ষিত ছিল পাশ্চাত্যীয় জীবনধারা থেকে ভিন্নতর। এখানকার মানুষ আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহারে যথেষ্ট পশ্চাদপদ। এরা সাধারণভাবে ধর্মভীরুও। তাছাড়া ইসলাম আগে থেকেই নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির মালিকানা, পিতা-মাতা-স্বামীর সম্পদের স্বত্ত্ব, ইত্যাদি অধিকার দিয়েছে, যা পাশ্চাত্য (খ্রিষ্টীয়) সমাজে ছিল না। অবশ্য পুরুষশাসিত সমাজ নারীদের এসব অধিকার থেকে বাস্তবে অনেকাংশেই বঞ্চিত করেছে, কখনও ধর্মীয় বিধান লংঘন করে, কখনও বা ধর্মীয় বিধানের ভুল বা অপব্যাখ্যা দিয়ে। যাই হোক, মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর পরিস্থিতি পাশ্চাত্য জগৎ থেকে পৃথক ছিল। সেজন্য এখানকার নারীবাদী আন্দোলনগুলো ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। মূলত দুটি ধারাকে এক্ষেত্রে গতিমান হতে দেখা যায়; এক, ইসলামভিত্তিক বা ইসলামী নারীবাদ (Islamic Feminism), দুই, পাশ্চাত্যীয় ধারার আধুনিক ধর্মবিমুখ (Secular) নারীবাদ। ইসলামী নারীবাদ চেয়েছে ইসলামের মৌলিক জীবনদর্শনের মধ্যে থেকেই নারীর সকল অধিকার আদায় করতে ইসলাম সুস্পষ্টরূপে নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ইসলামী বিধানের প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার অপনোদন বা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে। এসেনশিয়ালিস্ট ফেমিনিজম-এর অনেক দৃষ্টিভঙির সঙ্গে ইসলামিক ফেমিনিজম-এর সমিলতা লক্ষ্য করা যায়। এই দুটো ধারাই নারীকে নারী হিসেবেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়, নারীত্ব ও মাতৃত্ববোধ এবং প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সাযুজ্যকে (Ecofeminism) বিশেষ গুরুত্ব দান করে। অন্য (secular) ধারাটি বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত, যদিও কোনও উপধারাই সুস্পষ্টরূপে সংগঠিত নয়, এরা মূলত পাশ্চাত্যের অনুকারক। এদের মধ্যে কখনও কখনও ধর্মের সঙ্গে আপস পরিলক্ষিত হয়, আবার কখনও কখনও অ্যান্টি-এসেনশিয়ালিস্ট চারিত্র্য নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায়, মার্কসিস্ট, সোশ্যালিস্ট, সেপারেটিস্ট প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের ফেমিনিজম-এর বক্তব্য নিয়েও হাজির হয় এদের কোনও কোনও গোষ্ঠী।

আধুনিক অর্থে, প্রাতিষ্ঠানিক নারীবাদী আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তা মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীতে, প্রথমে ইরান ও মিসরে। এরপর আরববিশ্বসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত মিসরীয় আইনবিদ ক্কাসিম আমিনের তাহরির আল-মার’আ (Women’s Liberation) বইটি এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৯২৩ সালে হোজা শারাভি ‘ইজিপশিয়ান ফেমিনিস্ট ইউনিয়ন’ গঠন করেন। ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের ‘রাষ্ট্রীয় নারীবাদ’ (State Feminism) প্রবর্তন করেন। আরব বিশ্বসহ সকল মুসলিম দেশেই নারীবাদের ইসলামী ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারা পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে।
পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সতীদাহ প্রথা (মৃত স্বামীর চিতায় জীবন্ত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা) ছিল সবচেয়ে নৃশংস ও অমানবিক কুসংস্কার। চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়ষ শতকে প্রথমে মুসলিম মুঘল শাসকরা এই প্রথা উচ্ছেদের চেষ্টা করেন। বাদশাহ হুমায়ুন, আকবর, শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেব এই প্রথার বিরুদ্ধে নানারকম আইন জারি করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ফরাশিরা, এবং উনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশরা তাদের স্ব-শাসিত এলাকায় এই প্রথা নিষিদ্ধ করে। ১৮১২ সালের দিকে রাজা রামমোহন রায় বৃটিশ শাসকদের সহায়তায় এই প্রথার বিরুদ্ধে সর্বব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরই প্রেক্ষিতে লর্ড বেন্টিংক ১৮২৯ সালে তৎকালীন বাংলা প্রদেশে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। পরে দ্রুত বৃটিশশাসিত অন্যান্য এলাকায়ও এই প্রথা নিষিদ্ধ হয়। বিধবাদের সারা জীবন অবিবাহিত এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ চালু হয় এবং ১৮৫৬ সালে বৃটিশ শাসকরা ‘বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ জারি করে। প্রায় একই সময় বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, প্রথম পর্যায়ের এইসব আন্দোলন পুরুষদের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছে। এগুলো আসলে ছিল সমাজসংস্কারকামী আন্দোলন, এবং সঙ্গত কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেহেতু এসব সমস্যা মুসলিম সমাজে ছিল না।
এই উপমহাদেশের নারীবাদী আন্দোলনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে দেখা হয়। প্রথম পর্যায়ে (১৮৫০-১৯১৫) ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সংক্রমণের ফলে গণতন্ত্র, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান নাগরিক অধিকার, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নব্য শিক্ষিত সমাজে জাগরণ সৃষ্টি হয়। এই জাগরণ মূলত হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলিম নারীদের মধ্যেও সীমিত আকারে শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। ১৮৭৩ সালে কুমিল্লায় নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। [Sonia Nishat Amin, The World of Muslim Women in Colonial Bengal, 1876-1939 (Leiden: Brill, 1996), cited in Star Weekend Magazine, Volume 7, Issue 31; August 1, 2008] । প্রায় একই সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের নবাব ফেরদৌস মহল এবং খুজিস্তা আখতার সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় মেয়েদের জন্য পৃথক দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়া ১৯০৯ সালে বিহারের ভাগলপুরে মেয়েদের স্কুল গড়ে তোলেন। সেটি ১৯১১ সালে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু সংগঠিত নারীবাদী আন্দেলন বলতে যা বোঝায় তা তখনও শুরু হয়নি, যদিও বেগম রোকেয়া তাঁর সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে সেই কাজটি সম্পূর্ণ একাকীই শুরু করেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯১৫-১৯৪৭) মুসলিমসমাজও শিক্ষা ও নাগরিক অধিকার প্রশ্নে দ্রুত এগিয়ে আসে। কিন্তু এ অগ্রগমন মূলত পুরুষসমাজের। মুসলিম নারীসমাজের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল অশিক্ষা ও অবরোধপ্রথা। এ ব্যাপারে মুসলিম পুরুষসমাজ এগিয়ে আসেনি, নারীরাও সংগঠিত আন্দোলন করতে পারেনি। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত নারীসমাজের শিক্ষা এবং সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষায় বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনার পাশাপাশি লেখনি হাতে তুলে নেন। এ সময় জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন বেগবান হয়। সে আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি হিন্দু নারীরাও যথেষ্ট সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মুসলিম নারীরা এক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে ছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, এদেশের নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে (১৯৪৭-১৯৭০) এসে, ধীরে ধীরে নারীবাদী চিন্তার প্রসার ঘটতে থাকে, নারীরা চাকরি ছাড়াও রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা এমনকি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরই (চতুর্থ পর্যায়) বলতে গেলে এদেশে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকেই নারীবাদ সংগঠিত হতে শুরু করে। বেগম রোকেয়াকেই এদেশের নারীবাদীরা পথিকৃতের আসনে বসিয়ে কাজ শুরু করেন, যদিও তাঁরা পাশ্চাত্যের নানান রকম নারীবাদী তত্ত্ব ও আন্দোলন এবং দেশীয় রাজনৈতিক কর্মকা- দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। বাংলাদেশে মোটা দাগে নারীবাদী আন্দোলনের দুটি ধারাই গতিমানÑ পাশ্চাত্যানুসারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নারীবাদ ও ইসলামী নারীবাদ। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এই উভয় পক্ষই সাধারণভাবে বেগম রোকেয়াকেই তাদের পূর্বসূরির মর্যাদা দান করেন। তার অর্থ হলো বেগম রোকেয়ার চিন্তার মধ্যে উভয় ধরনের উপাদানই কম-বেশি বিদ্যমান।

নারীবাদী আন্দোলনের একটি বড় ফসল ‘নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’ (Feminist Literature ev Feminist Literary Criticism ev Literary Feminism)|এটা নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সাহিত্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে নতুন দৃষ্টিভঙি সৃষ্টির প্রয়াস থেকে এই তত্ত্বের জন্ম। বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের আগে সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্যবিচারপদ্ধতি ছিল পৌরুষীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন। ভার্জিনিয়া উল্ফ, জেন অস্টিন, জর্জ এলিয়ট এবং শার্লট ব্রন্টি ছিলেন ব্যতিক্রম। এই অবধি সাহিত্যকে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাবা হতো। বলা হতো, এতে নারীদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য যে কম তার কারণ তারা লেখালেখিতে এসেছেন কম, এবং যারাও এসেছেন তাদের মধ্যে খুব কম কয়েকজনই উচ্চমান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, এখানে লিঙ্গ-বৈষম্য কাজ করেনি। চিন্তার এই মিথ ভেঙ্গে দিতে সৃষ্টি হয় নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের। এই কাজ আসলে আরো আগেই শুরু করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ। তাঁর ‘একজনের নিজের ঘর (A Room for One’s Own) প্রবন্ধে তিনি নারীদের যে নিজস্বতার প্রয়োজনীয়তা, স্বাত্রন্ত্র্য ও অধিকারের কথা বলেন সত্তর দশকে এসে নারীবাদী সাহিত্যিকরা তারই ধারাবাহিকতায় কাজ শুরু করেন।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রথমতঃ অতীতের নারী লেখকদের রচনা আবিষ্কার ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নারীদের সাহিত্যচর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করে। দ্বিতীয়তঃ পুরুষ ও নারী লেখকদের রচনায় লিঙ্গ-বৈষম্যের প্রেক্ষিত ও চারিত্র্য বিশ্লেষণ করে দেখে। আর তৃতীয়তঃ নারীবাদী দৃষ্টিভঙিতে লেখাকে উৎসাহিত করে। শুরুতে নারী লেখকদের রচনা পর্যাপ্ত সংখ্যায় না পাওয়ার কারণে পুরুষদের লেখায় নারীদের কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। বোভেয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গতেই এই প্রয়াস প্রথম দেখা যায়। তাঁর পরে ১৯৬৯ সালে কেটি মিল্লেত প্রকাশ করেন তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ যৌন রাজনীতি (Sexual Politics) তাঁরা সাহিত্যের উদাহরণ টেনে এনে প্রমাণ করেন যে, পুরুষ লেখকদের সাহিত্যে নারীকে অবনমিতভাবেই দেখানো হয়েছে সবসময়। অবিরত, পুনঃপুনঃ, কিছু-কিছু প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্প এবং ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীকে কোমল, দুর্বল, লজ্জাবনত, ভীরু, কম মেধাসম্পন্ন, আত্মসমর্পিত ও উপভোগ্য হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তাই তাঁরা সাহিত্যকে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বলে স্বীকার করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন এবং একথা প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন যে, সাহিত্যে লিঙ্গ নিয়ে রাজনীতি আছে, যা পুরুষতান্ত্রিক। সুতরাং নারীদের বা নারীবাদীদের নতুন সাহিত্য রচনা করতে হবে যার মধ্যে থাকবে নারীবাদী চেতনার প্রতিফলন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ডালি স্পেন্ডারের মাদার্স অফ দি নভেল এবং জেন স্পেন্সারের দি রাইজ অফ দি উইম্যান নভেলিস্টস গবেষণাগ্রন্থ দুটি এক্ষেত্রে মাইলস্টোনস্বরূপ। তাঁরা দেখিয়েছেন যে নারীরা, সঙ্গত কারণেই সংখ্যায় অল্প হলেও, লিখে চলেছেন। সত্তর ও আশির দশকে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর নারী লেখকদের অনেকগুলি বই এবং অ্যান্থলজি প্রকাশিত হয়। ষাটের দশকে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরুর পর নারীবাদী সাহিত্যের প্রকাশনায় জোয়ার আসে। এ সময় এমনকি প্রচুর নন-ফিকশন এবং সায়েন্স ফিকশন রচিত হতে থাকে নারী লেখকদের দ্বারা। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যতত্ত্ব, যার শাখা-প্রশাখাও ছড়িয়েছে বেশ কিছু, যেমন ‘গে সাহিত্য’ (Gay Literature) এবং ‘লেসবিয়ান সাহিত্য’ (Lesbian Literature)| উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্ব (Post-colonial Literature) এবং উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব (Post-modern Literature) নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বকে শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক করে তোলে।

feminism-2
বেগম রোকেয়া প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই নারীবাদী আন্দোলন এবং নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে বিশ্ব এবং এদেশীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে এত কথার বলার কারণ হলো, তাঁর মূল পরিচয় ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে, আর তাঁর এই পরিচয় বিধৃত হয়েছে তাঁর নারীশিক্ষানুরাগী কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে যেমন, তেমনি সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়েও। তিনি একাধারে নারীশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী, এবং নারীবাদী সাহিত্যের স্রষ্টাও। এদেশে এক্ষেত্রে তাঁকে পথিকৃৎ বলা চলে। আমরা তাঁর সাহিত্যের নিরিখে তাঁর নারীবাদী চিন্তা, আকাক্সক্ষা ও কীর্তি পর্যালোচনা করে দেখার প্রয়াস পাব।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে, রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও ধনী রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে। তখনকার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মতো তাঁর পারিবারিক ভাষাও ছিল উর্দু। বাড়িতে মেয়েদের কিছু ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার চল থাকলেও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা বাড়িতে বসেও বাংলা-ইংরেজি পড়ার সুযোগও পেত না মেয়েরা। সাধারণভাবে রোকেয়ার পরিবারও ভিন্ন ছিল না, কিন্তু পিতার স্নেহময় অনুমোদন ও বড় ভায়ের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বাড়িতে বাংলা শেখার সুযোগ লাভ করেন। ১৮৯৬ সালে তাঁর বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের অবাঙ্গালি আমলা বিপত্নীক সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। স্বামীর উৎসাহে তাঁর লেখাপড়া অব্যাহত থাকে, তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। বড় বোন করিমুন্নেসা চুরি করে সাহিত্যচর্চা করতেন। হয়তো তাঁরই প্রভাবে কিছুটা, এবং কিছুটা স্বশিক্ষা তাঁকে লেখালেখির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তিনি লিখতেন মিসেস আরএস হোসেন নামে। ১৯০২ সালে তাঁর প্রথম রচনা ‘পিপাসা (মহরম)’ প্রকাশিত হয় হরেন্দ্রলাল রায় ও জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় সম্পাদিত ‘নবপ্রভা’ পত্রিকার চৈত্র ও বৈশাখ ১৩০৮-১৩০৯ সংখ্যায়। ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ মতিচুর (প্রথম খণ্ড)। সাতটি চিন্তাশীল প্রবন্ধ নিয়ে এই বইটি রচিত। দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র দীর্ঘ গ্রন্থালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন-
…বঙ্গসাহিত্য ভাণ্ডারে এ শ্রেণীর সর্ব্বপ্রথম গ্রন্থ ‘মতিচুর’ অমূল্য রত্নখণ্ড।
‘মতিচুর’ পড়িতে পড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্ত’, ‘লোকরহস্য’ এবং কালীপ্রসন্নের ‘ভ্রান্তিবিনোদ’ মনে পড়ে। অতুল কাব্যালঙ্কারে, বিপুল রহস্য বিজড়িত রসপূর্ণ যে সুগভীর সমস্যা-প্রশ্নসমুচ্চয়ে কমলাকান্তাদির উৎপত্তি হইয়াছিল, ‘মতিচুর’ও সেইরূপ অগণ্য সমস্যা-ভাব আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে। পার্থক্য কেবল, তাহাদের মূল প্রধানতঃ দর্শনে; ইহার ভিত্তি সমাজ সমস্যার উপরে। ‘মতিচুরে’র ন্যায় গ্রন্থের পক্ষে ইহা অল্প প্রশংসার বিষয় নহে। সুতরাং ইহার গুরুত্বও সামান্য নহে। ‘মতিচুর’ শুধু হিন্দু-মোসলেম সমাজকে নহে, সর্ব্বশ্রেণীর পাঠককেÑ ভাবতরঙ্গে আলোড়িত করিয়াছে। মুসলমান মহিলা লিখিত সর্ব্বপ্রথম বাঙ্গালা গ্রন্থের এ ক্ষমতা কতদূর বিস্ময়কর, তাহা ভাষায় বুঝানো সুকঠিন।
[রোকেয়া রচনাবলী, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৬, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৫৬২]
বেগম রোকেয়ার প্রথম ইংরেজি রচনা, ব্যঙ্গরসাত্মক রূপক রচনা Sultana’s Dream প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ থেকে কমলা সাতথিয়া নাথান ও সরোজিনী নাইডু সম্পাদিত Indian Ladies Magazine পত্রিকায়, ১৯০৫ সালে। এটি গ্রন্থরূপ লাভ করে ১৯০৮ সালে। ইংরেজি পত্রিকা The Mussalman এ Sultana’s Dream -এর একটি সমালোচনা বেরিয়েছিল ১৯০৮ সালের ডিসেম্বরে। তাতে বলা হয়েছিল-
…We have found a genuine pleasure in the perusal of the booklet. It seems to us that Mrs. R. S. Hossain the able authoress is a lady of whom any nation may be proud.
[পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮৭]
শিখা গোষ্ঠীর আবুল হুসেনও এই পুস্তিকার একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন। সেটি ছাপা হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৮ সংখ্যায়।
মতিচুর (দ্বিতীয় খ-) প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এতে রয়েছে প্রবন্ধ, রূপকথা ও গল্পসহ বিভিন্ন ধরনের রচনা। Sultana’s Dream -এর অনুবাদ সুলতানার স্বপ্ন এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। পদ্মরাগ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। নকশা জাতীয় রচনার সংকলন অবরোধ-বাসিনী ১৯৩১ সালে বের হয়। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অনেক ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি তাঁর জীবৎকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। এছাড়াও অনেক লিখিত অভিভাষণ ছিল। তাঁর সমগ্র রচনা, অভিভাষণ ও চিঠিপত্র নিয়ে ১৯৭৩ সালে রোকেয়া রচনাবলী প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। ১৯৮৪, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে তিনটি পুনর্মুদ্রণের পর এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ও শক্তি অর্জন এবং নারীবাদী সাহিত্য রচনার প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়ার রচনাবলী ও কর্মকীর্তি ক্রমশঃ অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

বেগম রোকেয়ার জীবনকাল ১৮৮০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত, আর ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ ১৮৩০ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। নারীবাদী আন্দোলনের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য সিমোন দ্য বোভেয়ারের দি সেকেন্ড সেক্স প্রকাশিত হওয়ার (ফরাশি ভাষায় ১৯৪৯ সালে, ইংরেজি অনুবাদে ১৯৫৩ সালে) ৩৩ বছর আগে, এবং ১৯৬০ সালে দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরুর ২৮ বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রথম তরঙ্গের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল বিবাহ, শিশুপালন, পারিবারিক সম্পত্তি, শিক্ষা এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার অর্জন। শেষ দিকে এসে কেউ কেউ যৌনতা, সন্তান জন্মদান এবং অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নও তোলেন। নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় যথাক্রমে ১৮৯৩ ও ১৮৯৫ সালে। বৃটেনে ১৯১৮ সালে ‘রিপ্রেজেন্টেশন অফ দি পিপল অ্যাক্ট’ পাশের মাধ্যমে, এবং ১৯১৯ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর ফলে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন। বেগম রোকেয়ার নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ক প্রথম লেখা ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery?’ প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে গিরিশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মাসিক ‘মহিলা’ পত্রিকায়। পরের বছর সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকায় এটি ‘আমাদের অবনতি’ নামে পুনর্মুদ্রিত হয়। ১৯০৪ সালে মতিচুর (প্রথম খ-) গ্রন্থে এটি ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সংকলিত হয়। মতিচুর (প্রথম খ-)র অন্যান্য প্রবন্ধগুলিও ১৯০৪-এর আগেই লেখা। Sultana’s Dream ছাপা হয় ১৯০৫ সালে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে এটি পড়ে ছিল অনেকদিন। অর্থাৎ বাস্তবে এটি লেখা হয় আরো আগে। এসব তথ্য একথাই প্রমাণ করে যে, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তিচিন্তা তাঁর একান্ত নিজস্ব, ইউরোপ-আমেরিকার আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত নয়, নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও মানসপ্রবণতা থেকেই উদ্ভূত। তবে লেখাপড়ার কারণে বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার অতীত ও সমকালীন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর জানা-শোনা থাকা অস্বাভাবিক নয়।

বেগম রোকেয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নারীর সার্বিক মুক্তি এবং পুরুষের সমান অধিকার অর্জন। তবে তিনি কাজ করেছেন মূলতঃ নারীশিক্ষার প্রসার এবং অবরোধপ্রথা বিলোপের জন্য। নারী শিক্ষিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন স্থানে ও পর্যায়ে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করবে, অবদান রাখবে, এই ছিল তাঁর আকাক্সক্ষা। এই বিষয়গুলো ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এবং কাল বিবেচনায়ও বেগম রোকেয়ার সমকালীন, যদিও কোনও যোগাযোগ ছিল না। এই বিবেচনায় বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনকে প্রথম তরঙ্গের ভারতীয় বা বাঙ্গালী সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা চলে। তার সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ ছিল মূলতঃ দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বেগম রোকেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পাশাপাশি তার বাস্তব অনুশীলনও করেন তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁর আন্দোলনকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ফেলা যায়। সতীদাহ প্রথা বাতিল এবং বিধবা বিবাহ চালুর আন্দোলন হচ্ছে প্রথম পর্যায়। আর বেগম রোকেয়ার স্ব-সম্প্রদায়, যাদের নিয়েই তিনি প্রধানতঃ কাজ করেছেন, সেই মুসলিম সমাজের প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
বেগম রোকেয়ার উত্থান যে-কালে, সে-কালে ভারতবর্ষের সমাজ, বিশেষত মুসলিম সমাজ, কেবল যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপদ ছিল তাই নয়, চরম রক্ষণশীলও ছিল। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি তখন ছিল সাধারণ ব্যাপার। আশ্চর্যের বিষয়, এইসব বাড়াবাড়ি অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মলঙ্ঘন করেই করা হতো, অথচ তাকে যুক্তিসিদ্ধ করা হতো ধর্মেরই দোহাই দিয়ে। নারীশিক্ষা এবং অবরোধপ্রথার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিই তখন বিরাজমান ছিল।

বেগম রোকেয়া শিক্ষাকেই নারীমুক্তির প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং এর জন্য প্রাণপাত করেছেন। প্রথমে তুলে নিয়েছেন লেখনি, তারপর প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। তিনি বলেছেন-
“শিক্ষা বিস্তারই এইসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ। অন্ততঃপক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; …আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, …শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই।”
[সুবেহ্ সাদেক, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪১]
নিছক সুগৃহিণী হতে গেলেও যে শিক্ষার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য তা তিনি সংসারের নৈমিত্তিক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘সুগৃহিণী’ (মতিচুর (প্রথম খণ্ড) প্রবন্ধে।

তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য লেখালেখির পাশাপাশি জনসংযোগও করতেন। শেষ পর্যন্ত ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর বিহারের ভাগলপুরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পত্তন করেন। এ স্কুলের নামকরণ করেন সদ্যমৃত স্বামীর নামে, ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। আর্থিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা মোকবেলা করে তিনি আজীবন এই স্কুল পরিচালনা করে গেছেন। এই স্কুল নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনকে গতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় ও যুক্তিসিদ্ধ করতে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে নারীশিক্ষা বিষয়ে যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল সেসব উদাহরণ এবং ধর্মীয় বিধানের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন-

“সম্প্রতি তুরস্ক এবং মিসর, ইউরোপ ও আমেরিকার ন্যায় পুত্র ও কন্যাকে সমভাবে শিক্ষা দিবার জন্য বাধ্যতামূলক আইন করিয়াছেন। কিন্তু তুরস্ক আমেরিকার অনুসরণে সোজা পথ অবলম্বন করেন নাই; বরং আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রের একটি অলঙ্ঘনীয় আদেশ পালন করিয়াছেন। যেহেতু পৃথিবীতে সর্ব্বপ্রথমে পুরুষ স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তিনি আমাদের রসুল মকবুল (অর্থাৎ পয়গাম্বর সাহেব)। তিনি আদেশ করিয়াছেন যে, শিক্ষালাভ করা সমস্ত নরনারীর অবশ্য কর্ত্তব্য। তের শত বৎসর পূর্ব্বেই আমাদের জন্য এই শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করে নাই, পরন্তু ঐ আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে এবং তদ্রপ বিরুদ্ধাচরণকেই বংশ-গৌরব মনে করিতেছে। ”
[বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির সম্মেলনে প্রদত্ত সভানেত্রীর অভিভাষণ, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৭]
তাঁর এই আন্দোলন পুরুষ ও নারী উভয় সমাজেরই বিরুদ্ধাচরণের শিকার হয়েছিল। অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে তিনি নারীদের ঘরের বাহির এবং ধর্মদ্রোহী করে তুলতে চাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

“আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রীষ্টানকে খ্রীষ্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই। ”
[অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খ-), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১]
কিন্তু আপোসকামিতাকে প্রশ্রয় দেননি বেগম রোকেয়া। তিনি সুস্পষ্টরূপে বুঝেছিলেন যে-
“যে পর্য্যন্ত পুরুষগণ শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে স্বীকৃত না হয়, সে পর্য্যন্ত তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষাও দিবে না। যাহারা নিজের সমাজকে উদ্ধার করিতে পারিতেছে না, তাহারা আর দেশোদ্ধার কিরূপে করিবে? অর্ধ্বাঙ্গীকে বন্দিনী রাখিয়া নিজে স্বাধীনতা চাহে, এরূপ আকাক্সক্ষা পাগলেরই শোভা পায়! সদাশয় বৃটিশ গভর্ণমেন্ট যেমন ভারতবাসীর উচ্চাকাক্সক্ষা সহ্য করিতে চাহেন নাÑ আমার মনে পড়ে প্রায় ২১ বৎসর পূর্ব্বে মিস্টার মর্লি বলিয়াছিলেন, “যদি তাহারা চাঁদের জন্য আবদার করে (If they cry for the Moon), তাহা আমরা দিতে পারি না” ইত্যাদি এবং আমাদের অমুসলমান প্রতিবেশীগণ এখন সাধারণতঃ যেরূপ মুসলমানদের দাবী-দাওয়া সহ্য করিতে পারেন না, সেইরূপ মুসলমান পুরুষগণও নারীজাতির কোন প্রকার উন্নতির অভিলাষ স্বীকার করিতে চাহেন না।”
[বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি সভানেত্রীর অভিভাষণ, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৮]
অন্যত্র তিনি বলেন-
“পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।”
[স্ত্রীজাতির অবনতি, মতিচুর (প্রথম খ-), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১]
অবরোধ-প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ লেখার মধ্যে কোনও না কোনওভাবে এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁর অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থটি অবরোধ-প্রথার কুফল নিয়ে রচিত। কিন্তু তিনি উগ্রপন্থা অবলম্বন করেননি। তিনি নিজে পর্দা করতেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে-

“আমাদের ত বিশ্বাস যে অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। …
অবরোধ-প্রথা স্বাভাবিক নহে নৈতিক। কেননা পশুদের মধ্যে এ নিয়ম নাই। মনুষ্য ক্রমে সভ্য হইয়া অনেক অস্বাভাবিক কাজ করিতে শিখিয়াছে। …ঐরূপ মানুষের ‘অস্বাভাবিক’ সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি।
মোটের উপর আমরা দেখিতে পাই সকল সভ্যজাতিদেরই কোন না কোন রূপ অবরোধ প্রথা আছে। এই অবরোধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? এমন পবিত্র অবরোধ-প্রথাকে যিনি ‘জঘন্য’ বলেন, তাঁহার কথার ভাব আমরা বুঝিতে অক্ষম।
তবে সকল নিয়মেরই একটা সীমা আছে। এদেশে অবরোধ-প্রথা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে।
আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস (ঢ়ৎধপঃরপব) চাই; বিনা অভ্যাসে কোন কাজ হয়? ”
[বোরকা, মতিচুর (প্রথম খ-), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩]
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ এবং রচনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে বেগম রোকেয়া পর্দার বিরোধী ছিলেন না, পর্দার নামে নারীদের গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে তাঁর যত আপত্তি।
“…গোঁড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের অবগতির জন্য দু একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই।সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি।”
[অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫]
অন্য একটি প্রবন্ধে একটি চরিত্রের বাচনে তিনি বলেন-
“আমার মনে হয়, হিন্দুরা আমাদের নিকট অবরোধপ্রথা শিক্ষা করিয়াছেন, এবং কাট-মোল্লারা হিন্দুর নিকট নারীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতে শিখিয়াছেন। নতুবা কোরাণ শরীফের বিধান মানিলে অবলা-পীড়নও চলে না; অন্যায় অন্তঃপুরপ্রথাও চলে না। ”
[নারীপূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৩]
ইউরোপ এবং আমেরিকায় যে নারীবাদী আন্দোলন গতিমান হয়েছিল, বিশেষতঃ প্রথম তরঙ্গের শেষে এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রথমদিকে, তা ছিল মূলতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক চর্চা। বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির চিন্তা ছিল বাস্তবতা-নির্ভর। তবে তাত্ত্বিক ভাবনাও তাঁর মধ্যে পরোক্ষভাবে নিহিত ছিল। এসবদিক থেকে আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর মিল রয়েছে। সেখানে যেমন ১৯৬৬ সালে ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ উইমেন’(NOW) গঠনের মধ্য দিয়ে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়, এখানে তেমনই বেগম রোকেয়া ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ এবং ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেন তাঁর আন্দোলনের প্রসার ও বাস্তব রূপদান কামনায়।

বেগম রোকেয়ার নারীচিন্তার গতি-প্রকৃতি ও তাঁর সাংগঠনিক কর্মকা- গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যকার জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছিলেন। এদিক থেকে তাঁকে তাঁর মৃত্যুর অন্ততঃ তিরিশ বছর পরে উদ্ভূত ‘এসেনশিয়ালিস্ট নারীবাদ’ আন্দোলনের সমগোত্রীয় ভাবা চলে। এসেনশিয়ালিস্টদের মতোই তিনি মনে করতেন, নারী হওয়া কোনও অগৌরবের বিষয় নয়। পুরুষ-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা সামাজিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে নারীকে অনন্য নারী পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। যেসব যুক্তি ও বিষয়কে অবলম্বন করে নারীকে অবনমিত ও বন্দী জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে শনাক্ত ও দূর করতে হবে যেন নারী পুরুষের সমানাধিকার অর্জন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তাঁর বিশ্বাস-
“আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি।”
[অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১]

১৯৬৯ সালে কেটি মিল্লেত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ যৌন রাজনীতি (Sexual Politics) লিখে প্রমাণ করেন যে পুরুষরা সবসময় কিছু-কিছু প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্প এবং ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীকে কোমল, দুর্বল, লজ্জাবনত, কম মেধাসম্পন্ন, আত্মসমর্পিত ও উপভোগ্য হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন। সেই ভাবনাকে বেগম রোকেয়া তার অনেক আগেই (১৯০৫) ধারণ করেছিলেন। তিনি এক প্রবন্ধে পাত্র-পাত্রীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এই ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এইভাবেÑ
গও। ছি! তুমি পাথুরে পথকে ভয় কর, ঢালুপথে গড়াইতে চাও না,ইহা তোমার womanishness (স্ত্রীভাব)।!
নূর। womanish শব্দে আমি আপত্তি করি! ‘ভীরুতা কাপুরুষতা বল না কেন?
[সৌরজগৎ, মতিচুর (দ্বিতীয় খ-), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১]
নারী এবং পুরুষের স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটিকেও তিনি দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে যাচাই করেছেন।
গরহর বলিয়া যাইতে লাগিলেন, “কেবল অবলারা সীমা অতিক্রম করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে ইহাই নহে, পুরুষেরাও স্বীয় কক্ষ লঙ্ঘন করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে।”
জাফ। পুরুষদের গন্তব্যপথ ত সীমাবদ্ধ নহে, তাহাদের আর কক্ষচ্যুত হওয়া কি?
গও। পুরুষেরাও স্বেচ্চাচারী হইতে পারে না। তাহাদেরও কর্ত্তব্য আছে। তুমি কি স্ত্রীপুত্রকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া কোথাও যাইতে পার?
জাফ। না।
গও। তবে কিরূপে বল, তোমার পথ সীমাবদ্ধ নহে?
জাফ। তবু আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে।
গও। কর্ত্তব্যে অবহেলা করিবার ক্ষমতা নাই।
[সৌরজগৎ, মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮]
প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সঙ্গতি ও সমন্বয় এবং নারীত্ব ও মাতৃত্বকে বেগম রোকেয়া অস্বীকার করেননি, বরং সম্মানের বিষয় বলে মনে করেছেন। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে ইকোফেমিনিজম (Ecofeminism)-)-এর সঙ্গে সংযুক্ত করে। তিনি মনে করেন-
“সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে। তাঁহাদের সুখ দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ দুঃখ অন্য প্রকার।”
[অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭]
কিন্তু তিনি ‘সেপারেটিস্ট ফেমিনিজম’ (Separatist Feminism)- এর প্রবক্তাদের মতো নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করে নিতে চাননি। সে কারণে ‘লেসবিয়ান ফেমিনিজম’ (Lesbian Feminism)-এর চিন্তাও তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর চিন্তাধারায় মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদীদের মতো পুঁজিবাদের ঘাড়ে সকল দোষ চাপানোর চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয় না, যদিও তিনি নারীর কর্মসংস্থান এবং অর্থোপার্জনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে, ধর্মের ব্যাপারেও বেগম রোকেয়ার উচ্চ ধারণা ছিল। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করতেন। মেরি ডালির মতো উগ্র নারীবাদীদের ন্যায় তিনি ধর্ম, আইন এবং বিজ্ঞানকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেননি। বরং ধর্মের প্রতি তাঁর পক্ষপাতই পরিদৃষ্ট হয়। তিনি বলেন-
“প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে ধর্ম্ম। ধর্ম্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। ”
[নূর-ইসলাম, মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১]
তিনি বিশ্বাস করতেন-
“…একমাত্র ইসলাম ধর্ম্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে; কিন্তু ভারতবর্ষে সেই মুসলিম-নারীর দুর্দ্দশার একশেষ হইয়াছে।”
[রানী ভিখারিনী, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৫]
ইসলামের পর্দা প্রথা সম্পর্কে তিনি বলেন-
“শাস্ত্রে পর্দ্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত পর্দ্দা প্রথা তদপেক্ষাও কঠোর। যাহা হউক কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দ্দা সে-ই রক্ষা করে, যে সমস্ত মানব জাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে।”
[কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯]
সম্পদে নারীর অধিকার প্রশ্নে তিনি বলেছেন-
“আপনারা ‘মুহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্দ্ধেক ভাগ পাইবে। এই নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিম্বা জমীদারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন কার্যতঃ কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।”
[অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯]
‘সুলতানার স্বপ্ন’তে বেগম রোকেয়া যে ‘নারীস্থান’-এর কল্পনা করেছেন, সেখানে পুরুষ জাতিকে গৃহবন্দী এবং নারীজাতিকে বাইরে স্থাপন করেছেন, ‘পর্দা’র ব্যাত্যয় ঘটাননি।
…এরূপে ধরা পড়ায় আমি লজ্জিত হইলাম। ইতস্ততঃ করিয়া বলিলাম, “আমার কেমন একটু সঙ্কোচ বোধ হইতেছে; আমরা পর্দানশীন স্ত্রীলোক, আমাদের বিনা অবগুণ্ঠনে বাহির হইবার অভ্যাস নাই।”
“আপনার ভয় নাই- এখানে আপনি কোন পুরুষের সম্মুখে পড়িবেন না। এ দেশের নাম ‘নারীস্থান’। এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।”
ওহো! আমার কি ভ্রম! -আপনি আমাদের নিয়ম আচার জ্ঞাত নহেন, একথা আমার মনেই ছিল না। এ দেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।”
[সুলতানার স্বপ্ন, মতিচুর : দ্বিতীয় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪]
তার মানে তিনি নারী ও পুরুষকে পর্দার মাধ্যমে পৃথকভাবেই রাখতে চেয়েছেন। এভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘনের পক্ষপাতী ছিলেন না। ইসলাম সুস্পষ্টরূপে নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং ইসলামী বিধানের ভুল ব্যাখ্যার অপনোদন বা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে (মূলত ইরান ও মিসরে) যে ইসলামী নারীবাদী (Islamic Feminism) আন্দোলন শুরু হয় তার দৃষ্টিভঙির সঙ্গে বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারার মিল পাওয়া যায়। যে কালে এবং যে সমাজপ্রেক্ষিতে বেগম রোকেয়াকে কাজ করতে হয়েছে সে বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখলে তাঁর চিন্তা ও কর্মকা-কে আপসকামী বলার সুযোগ নেই, বরং বৈপ্লবিক না বলে উপায় থাকে না।

বেগম রোকেয়া কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন, কেবল চিন্তার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। তারপরেও তাঁকে চিন্তাবিদ বলতেই হয়, যদিও তিনি দার্শনিক ছিলেন না। আর তিনি তাঁর সকল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। তাঁর এসব সাহিত্যকর্মের প্রায় সবটাই জুড়ে রয়েছে নারীমুক্তিচিন্তা। তাঁর প্রবন্ধগুলোর কথা বাদ দিলে সৃজনশীল সাহিত্য হিসেবে গণ্য প্রধান ও বিখ্যাত তিনটি রচনা হচ্ছে সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ এবং অবরোধ-বাসিনী। এ তিনটি রচনা শিল্পকর্ম হিসেবে কতটা উত্তীর্ণ সে প্রশ্ন থাকলেও এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, এগুলো বাংলা ভাষায় তো বটেই, কাল বিবেচনায় বিশ্বপ্রেক্ষাপটেও, প্রথম দিককার সৃজনশীল নারীবাদী সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমরা আগেই জেনেছি, নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে প্রথমতঃ অতীতের নারী লেখকদের রচনা আবিষ্কার ও মূল্যায়নের মাধ্যমে। তারপর পুরুষ ও নারী লেখকদের রচনায় নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রেক্ষিত ও চারিত্র্য বিশ্লেষণ এবং নারীবাদী দৃষ্টিভঙিতে সাহিত্য রচনাকে উৎসাহিত করা হয়।
‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি স্বল্পায়তনিক রচনা। এটিকে ছোটগল্প বলাই সমীচীন। এটি একটি ব্যাঙ্গ-রসাত্মক সৃষ্টি। একে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বলা চলে। নারী যে কোনও অংশেই পুরুষের তুলনায় কম নয় সেটি একটি কল্পকাহিনীর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া। এই গল্পে নারীরা তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, উদ্যম এবং কর্মতৎপরতার জোরে যে দেশ গড়ে তুলেছেন সেটি ‘নারীস্থান’, অর্থাৎ নারীদের বা নারীশাসিত বা নারী-প্রাধান্যের দেশ। এখানে লেখক নারীকে পুরুষের সমান নয়, বরং তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এই চিন্তা সে কালে এদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেই, একেবারেই অভিনব ছিল। এটি সম্পূর্ণতঃ নারীবাদী চিন্তার ফসল।
পদ্মরাগ উপন্যাসের নায়িকা একজন নারী। সেকালে একজন নারীকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করাও ছিল নতুন ব্যাপার। নায়িকা সিদ্দিকা নারী জাগরণ, নারীশিক্ষা ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মযজ্ঞে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। এটি একটি উদ্দেশ্যবাদী রচনা, এতে যথেষ্ট আবেগও রয়েছে, তথাপি বিষয়গুণে এটি নারীবাদী সাহিত্যের অভাব পূরণ করেছে।
অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থে তিনি যে ছোট ছোট নকশা জাতীয় ব্যাঙ্গরসাত্মক কাহিনী রচনা করেছেন তার প্রত্যেকটিই অবরোধ-প্রথার বাড়াবাড়িকে আক্রমণ করে লিখিত।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত কেটি মিল্লেত-এর যৌন রাজনীতি (Sexual Politics) এবং ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ডালি স্পেন্ডারের উপন্যাসের মাতৃগণ (Mothers of the Novel) এবং জেন স্পেন্সারের মহিলা ঔপন্যাসিকদের উত্থান (The Rise of the Women Noivelists)এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। উরসুলা কে. লা গুইন-এর দি লেফ্ট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস (১৯৬৯), জোয়ানা রাস-এর দি ফিমেল ম্যান (১৯৭০), অক্টাভিয়া বাটলার-এর কিন্ড্রেড (১৯৭৯) এবং মার্গারেট অ্যাটউড-এর হ্যান্ডমেইডস টেল (১৯৮৫) কে নারীবাদী সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অথচ এদের অনেক আগে বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ এবং অবরোধ-বাসিনী রচনা করেছেন। একজন নারীবাদী হিসেবে তাঁর মৌলিকত্ব এবং একজন অগ্রণী নারীবাদী সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর অনস্বীকার্য গুরুত্ব এখানেই।

সহায়ক গ্রন্থসূত্র:
১. রোকেয়া রচনাবলী, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৬, বাংলা একাডেমী
২. Literary Theory and Criticism, Edited by Patricia Waugh, Oxford University Press, First Indian Edition 2006, New Delhi

৩. Star Weekend Magazine, Volume 7, Issue 31; August 1, 2008

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন