সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক : কচি চোখের মূল্যায়ন

মামুন মিজানুর রহমান 

সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা কাব্যধারার স্রোতবিরোধী একজন কবি। মার্কসবাদী কবিতা চাষের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। তিরিশি জীবনবিচ্ছিন্নতার বিপরীতে বাংলা কাব্যাঙ্গনে তীব্র জীবনঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত প্রধানত তাঁর হাতেই। েবিশ্বব্যাপী বিশ শতকীয় মার্কসবাদের উত্থান বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিবিধ ব্যঞ্জনা। মার্কসবাদে প্রভাবিত বাঙালি লেখকদের রচনায় চেতনে-অবচেতনে প্রকাশিত হয়েছে মার্কসীয় সাম্যবাদ। পৃথিবী জুড়ে লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক শিল্প-আন্দোলন ও সমকালীন নানা তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ। যুগধর্ম ও সমকালের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো লেখকের চিরকালীন বৈশিষ্ট্য।
সুভাষের পূর্বেও সাম্যবাদ বাংলা কবিতায় আশ্রয় পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমর সেন প্রমূখের হাত ধরে। কিন্তু সুভাষপূর্ব সাম্যবাদী কবিগণ নিঃসংশয় সাম্যবাদী ছিলেন না। সুভাষ প্রথম নিঃসংশয় সাম্যবাদী কবি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুভাষও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতিবিদ ও কবির বিরল এক সমন্বয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
‘পদাতিক’ (১৯৪০) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্য। কাব্য বিবেচনার পূর্বে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তি-স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনা অপরিহার্য। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে নিজের মুখ্য পরিচয় কোনটি? কবি সুভাষ, নাকি রাজনীতিবিদ সুভাষ?
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কাব্য বিশ্লেষণ করলে তাঁর রাজনীতিবিদ সত্তাটিই হয়ে ওঠে প্রধান। কেননা একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক ‘তাবলিগ’-এর প্রয়োজনেই বাংলা কবিতায় তাঁর আবির্ভাব। রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তৃতা দিতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন কবিতার মঞ্চে, এমনকি একপর্যায়ে কবিতা থেকে ছুটি নিয়ে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছিলেন রাজনীতিতে। বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের প্রয়োজনে যিনি কবিতা লিখেন এবং রাজনীতির প্রয়োজনে চির বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন কবিতার সাথে, তাঁর কবি পরিচয়ের তুলনায় নিশ্চয়ই রাজনৈতিক পরিচয় প্রধান। তা ছাড়া তাঁর কবিতাও যেহেতু প্রায় সর্বাংশে রাজনীতি-আশ্রয়ী, ফলে সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রধান করে না দেখার উপায় নেই। সুভাষকে একজন কবির বদলে রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত করার সুবিধা এই যে, একজন রাজনীতিবিদ রচিত বক্তৃতা ও শ্লোগানপ্রধান কবিতায় পাঠকের শিল্পপ্রত্যাশাও সীমিত। এক্ষেত্রে পাঠক মহৎ শিল্পের প্রত্যাশা না করে বরং রাজনৈতিক কর্মীর কবিতায় প্রাপ্ত শিল্পরসদকে ‘বোনাস’ হিসেবেই গণ্য করেন।
সুভাষের কবিকীর্তি এতই সুদৃঢ় যে, কবির পরিবর্তে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কবিতায় শিল্পের রসদ ‘বোনাস’ নয়, বরং শিল্পসৌন্দর্য ও বিবিধ কাব্যিক অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাকে নিয়ে গেছে মহৎ শিল্পের চূড়ায়। পাশাপাশি কবিপ্রতিভার প্রাবল্যেই রাজনৈতিক সত্তার চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠেছে তাঁর কবি সত্তাই। বুদ্ধদেব বসুও আমাদের মতোই সুভাষের কবিসত্তা ও রাজনৈতিক সত্তাকে শনাক্ত করেছেন। এই দ্বৈতসত্তার পরিণতি কবিতাকে নান্দনিকতার বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে আশঙ্কা করে বুদ্ধদেব বসু সুভাষকে সাবধান করেছেন, ‘দু-দিক বজায় রাখা চলবে না, এক দিক ছাড়তে হবে। যদি তিনি বিশ্বাস করেন যে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাই তাঁর কর্তব্য, তিনি তা করবেন মানুষ ও কর্মী হিসেবেই, কবি হিসেবে নয়। কিন্তু যখন ও যতক্ষণ তিনি কবি, কবিতার উৎকর্ষই হবে তাঁর সাধনা। হয় তাকে কর্মী হতে হবে, নয়তো কবি।’
বিশ্বব্যাপী সমকালীন মার্কসীয় জোয়ারে গা ভাসিয়ে ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় মার্কসীয় আদর্শে রাজনৈতিক মুক্তি। কবিতার বিষয়, আঙ্গিক ও শিল্পমূল্যের চেয়ে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মার্কসবাদের বিকাশ। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিঘ্নিত হয়েছে শিল্পের নান্দনিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা। মার্কসবাদ প্রসারের চেষ্টা বলে ‘পদাতিক’ কাব্যের কবিতাসমূহে বিষয়বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। এ কাব্যের প্রায় সবগুলো কবিতার বক্তব্য একই ঘরানার। ফলে ‘পদাতিক’ কাব্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি সবচেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে, তা হল এ কাব্য বিষয়বৈচিত্রহীন। প্রতিটি কবিতায় প্রায় একই ধরনের রাজনৈতিক আহ্বান ও বক্তব্যের পুনরুক্তি ঘটেছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্য সাম্যবাদী লেখকদের চেয়ে সুভাষ বেশ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য যেমন বক্তব্যের তীব্রতা ও স্পষ্টবাদিতায়, তেমনই বক্তব্যের পুনরুক্তি ও একঘেয়েমিতায়।
পূর্বসূরী সাম্যবাদী লেখকদের সাম্যবাদ তত্ত্বভারাক্রান্ত এবং অনেকাংশে ভাববিলাসী। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদ মার্কসীয় ভাবনার বিচ্ছিন্ন ও দ্বিধান্বিত প্রকাশ। ‘দ্বিধান্বিত প্রকাশ’ এই অর্থে যে, নজরুল নিজে মার্কসবাদী ছিলেন না। প্রগতি, ধর্ম, সাম্যবাদ প্রসঙ্গে নজরুলের জীবনদর্শন ছিল স্ববিরোধিতাপূর্ণ। সাম্যবাদের বিবেচনায় যেমন নজরুল প্রগতিশীল, তেমনই হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মকেন্দ্রিক রচনার প্রেক্ষিতে তাঁকে প্রগতিবিরোধী বলে শনাক্ত করা যেতে পারে।
সমর সেনের রচনাও মার্কসবাদ বহুল, কিন্তু সুভাষের আগে বাংলা কবিতায় মার্কসবাদ ততটা স্পষ্ট হয়ে উঠে নি। সুভাষই প্রথম স্পষ্ট, নিঃশংসয় মার্কসবাদী কবি। বাংলা সাহিত্যে সুভাষ ছাড়াও মার্কসবাদে দীক্ষিত সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুভাষ-সুকান্ত-মানিকের মধ্যে আদর্শগত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়গত সাদৃশ্য থাকলেও সবারই রয়েছে অনুপম স্বকীয়তা।
মার্কসবাদী ‘তাবলিগ’ ও সমকালীন নানা প্রেক্ষিত তুলে ধরায় সুভাষের কবিতা চিরকালীন হতে পারে নি। সমকালীন নানা প্রেক্ষিতে রচিত বলে ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থটি কেবল একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ ভাষ্যের কাব্য হয়ে ওঠেছে। তা ছাড়া মার্কসবাদী কাব্য হিসেবে সমকালে মার্কসবাদের উত্থান যুগের উত্তেজনায় ‘পদাতিক’ নন্দিত হলেও পরবর্তী সময়ে এই হুজুগ কেটে গেলে স্বভাবতই টান পড়ে কাব্যের বিষয় উপযোগিতায়। আজকের বিশ্বে মার্কসবাদ নিছক একটি ভাববিলাসিতায় রূপান্তরিত হওয়ায় ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থও একটি ভাববিলাসী কাব্য হিসেবে গণ্য হওয়াই স্বাভাবিক।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শব্দ ব্যবহারের মুন্সিয়ানা উচ্চ প্রশংসনীয়। কিন্তু শব্দ ব্যবহারের এই অতি মুন্সিয়ানাও এক অর্থে ব্যর্থতা। কেননা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে শ্লোগানধর্মী কবিতার তিনি সূত্রপাত করেন, যার প্রধান লক্ষ্য মার্কসীয় চেতনার সম্প্রসারণ, গণমানুষের মুক্তির আশায় যে কাব্যকীর্তি, তা শেষ পর্যন্ত গণমানুষের ভাষায় রচিত হয়নি। শব্দ প্রয়োগে সুভাষের অতি দক্ষতাই এই ব্যর্থতার কারণ। সহজ সর্বজনবোধ্য শব্দের পাশাপাশি দুর্বোধ্য, সমাসবদ্ধ ও প্রতীকী অর্থে শব্দও কম প্রয়োগ করেন নি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশেষ ঘরানার ছন্দের অনুশাসন ও শব্দঝংকার রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর কবিতা হারায় সর্বজনবোধ্যতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা। ছন্দের ধমক ও শব্দ প্রয়োগে দক্ষতার ফলে সুভাষের কবিতা বেশ কাব্যমতি হয়ে ওঠলেও তা খটখটে এবং অনেকটাই প্রাণহীন।
এই দিক থেকে লক্ষ করলে নজরুল ও সুকান্তের সাম্যবাদ অনেক বেশি প্রাণময়, গতিময়। নজরুল ও সুকান্তের সাম্যবাদে যে স্পষ্টবাদিতা ও সহজবোধ্যতা, তা শিল্পতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হলেও বক্তৃতার আগুনে পাঠককে ঝলসে দেয়, নিদেনপক্ষে উসকে দেয়। তা ছাড়া এই দুই কবির সাম্যবাদী রচনায় যে অসংখ্য বিষয়বৈচিত্র্য দৃশ্যমান, তা সুভাষের কবিতায় প্রায় অনুপস্থিত।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় গণমানুষের জাগরণের কবিতা লিখেছেন বনেদী ভাষায়। ফলে তার কবিতা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ পাঠকের কাছে দাঁড়াতে পারেনি। শব্দ ব্যবহারে সুভাষের মধ্যে বিপরীতধর্মিতা লক্ষণীয়। ‘পদাতিক’ কাব্যের কোনো কোনো কবিতা সর্বজনবোধ্য হলেও, সহজ-সরল ভাষায় রচিত হলেও দুর্বোধ্য এবং প্রতীকী শব্দ প্রয়োগও কম নয়।
সুভাষের শব্দ প্রয়োগের এই বিপরীতধর্মিতার কারণ হিশেবে তাঁর দুটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছেন বুদ্ধদেব বসু। ‘জনগণের কবি’ হওয়ার বাসনা হয়তো সুভাষের সহজবোধ্য কবিতা রচনার কারণ। অন্যদিকে দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে তিনি কলাকৈবল্যবাদীদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট। নিজের কবিপ্রতিভার প্রমাণ দিয়ে প্রাজ্ঞজনের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টায় তিনি হয়তো দুর্বোধ্য শব্দ, জটিল প্রতীক, রূপকসহ নানা কাব্যিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন।
সমাজবিচ্ছিন্নতা, হতাশা, ক্ষয়, পতন, জীবনবিমুখতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় যখন তিরিশের কবিতা আচ্ছন্ন, সুভাষ তখন সমকালের প্রচলিত প্রবণতার বাইরে আমদানি করেন ব্যক্তি ও সমাজসংশ্লিষ্টতা। তিরিশী প্রবণতাকে প্রায় সম্পূর্ণ বর্জন করে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আশাবাদ ও জয়ের স্বপ্নে বিভোর। তিরিশী বলয়ের বাইরে অবস্থান নিয়ে নিজের স্বকীয়তা তৈরি মূলত সুভাষের শিল্পপরিকল্পনার অংশ নয়, এমনকি এটি তাঁর উচ্চতর শিল্পীসত্তারও পরিচায়ক নয়। বরং রাজনৈতিক প্রয়োজনেই তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে তিরিশী প্রবণতা। কবিতায় স্বকীয়তা অর্জনের লক্ষ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তিরিশি কাব্যধারার বিপরীতে নতুন কোনো ধারা তৈরি করেন নি। শিল্পধারা নয়, মার্কসবাদের প্রয়োজনেই তাঁর ভিন্ন ধারা, ভিন্ন সুর।
তিরিশি প্রবণতা বর্জনের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সফল হতে পারেন নি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘পদাতিক’ কাব্যে তিরিশী কবিদের মতো দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের প্রবণতা লক্ষণীয়। ‘বহ্বারম্ভ’, ‘উল্লাঙ্গুল’, স্বস্তিকা’, ‘নিষ্ঠীবন’, ‘জাপপুস্পক’ ইত্যাদি অপ্রচলিত শব্দ প্রয়োগ সুভাষের মধ্যে তিরিশী প্রবণতারই ইঙ্গিতবাহী।
কেবল তিরিশি প্রবণতা বর্জন নয়, সুভাষ বাংলা কবিতার চিরকালীন ধারার বিপরীতে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রেম ও প্রকৃতি-প্রধান বাংলা কাব্যজগতে ‘পদাতিক’ সর্বপ্রথম প্রেম ও প্রকৃতিমুক্ত কাব্য। প্রেম ও প্রকৃতির কাছে কবিদের যে চিরকালীন আত্মনিবেদন, ‘পদাতিক’ তার বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহও বটে। বুদ্ধদেব বসুর মতো আমরাও সুভাষের এই প্রেম ও প্রকৃতিহীনতাকে বাংলা কবিতার ‘দুর্লক্ষণ’ বলছি। পাশাপাশি এও স্বীকার করছি, ‘পদাতিক’ বিষয়বৈচিত্র্যহীন ও একঘেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কেবল প্রথাবিরোধী বলে প্রশংসার দাবিদার।
বুদ্ধদেব বসু ‘পদাতিক’ কাব্যে কবির দুটি প্রবণতা নির্দেশ করছেন। এ কাব্যে রয়েছে শ্লোগানধর্মী জনপ্রিয় ধারার গণমানুষের জন্য রচিত কবিতা এবং কবিপ্রতিভা প্রমাণের চেষ্টা হিশেবে রয়েছে দুর্বোধ্য শিল্পকুয়াশায় আচ্ছন্ন কবিতাও। অন্য দিকে সমালোচক অমলেন্দু বসুর বিবেচনায় ‘পদাতিক’ কাব্যে রয়েছে তিনটি পৃথক ধারার কবিতা। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে আমি তিনটি সুর শুনতে পাই: ব্যঙ্গতীক্ষ্ন সুর, চড়াগলার সুর, স্বগতোক্তির মৃদুতর সুর।’
অমলেন্দু বসু নির্দেশিত সুভাষের কবিতার এই তৃতীয় ধারাটিই তাঁকে দিয়েছে কবিপ্রতিভার প্রতিষ্ঠা। স্বগতোক্তিমূলক কবিতাসমূহে লক্ষ করা যায় ব্যক্তি সুভাষের নিভৃত অথচ গভীর উপস্থিতি। পাশাপাশি স্বগতোক্তির এই সুর সুভাষের কবিতাকে দিয়েছে চিরকালীনতার আমেজ।
‘সৌভাগ্যবশত সুভাষের কাব্যে তৃতীয় একটি সুরও আছে, যে সুর স্বগতোক্তির সুর, সে-সুরে সুভাষের অনন্যতা নেই কেননা সে-সুর চিরকাল ধ্যানী কবিচিত্তের গীতধর্মী সুর- তবুও সে-সুরের খেলায় সুভাষ উৎকৃষ্ট কবি।’ অমলেন্দু বসুর এই বক্তব্যের সাথে আমাদের একাত্মতা। শ্লোগানপ্রধান কবিতার জন্য সুভাষ রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে বেঁচে থাকলেও বাংলা কাব্যভুবনে তাঁর টিকে যাওয়ার মূল কারণ এই তৃতীয় ধারার স্বগতোক্তিমূলক সুর। এই ধারায় তিনি কিছুটা হলেও রাজনৈতিক স্থ্থূলতা থেকে বেরিয়ে এসে শিল্পের কুসুমাস্তীর্ণ পথে ধাবমান।
গণমানুষের কাব্য হিসেবে ‘পদাতিক’ কাব্যের আত্মপ্রকাশের পথে বড় বাধা ছিল ছন্দের কঠোর শাসন। এ কাব্যে মোঁ আঁশটি কবিতা। উনিশটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ও নয়টি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। কিন্তু গণমানুষের শ্লোগান ও জাগরণের যে গতিময় ছন্দ কিংবা পদাতিক সৈন্যের যে ক্ষিপ্র গতি, স্বরবৃত্তের সেই গতিশীলতা কোনো কবিতায় দেখা যায়নি। ছন্দকুশলতা প্রমাণের প্রচেষ্টার ফলে সুভাষের কবিতার ভাব ও গভীরতা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে।
সত্যেন্দ্রনাথের মতো ছন্দকুশলতা প্রদর্শনের ফলে ‘পদাতিক’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই খটমটে, নিষ্প্রাণ ও ভাবগাম্ভীর্যহীন চটুলতায় পর্যবসিত হয়েছে। ছন্দের অনুশাসনের প্রতি সুভাষের পূর্ণ আনুগত্যের ফলে তাঁর কবিতা হারিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা। ছন্দের কুশলতাও সুভাষের কবিতার ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ। কেননা ছন্দের লাগামের ফলে কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণাধারা হওয়ার বদলে খটখটে, যান্ত্রিক এবং আরোপিত হয়ে ওঠেছে। এই আরোপিত শব্দ ও ছন্দবিন্যাসের ফলে ‘পদাতিক’ সাধারণ পাঠকের পক্ষে সুখপাঠ্য হয়ে উঠে নি, গণমানুষের মুক্তির বাণীর ধারক ‘পদাতিক’ পায়নি গণমানুষের গ্রহণযোগ্যতা।
‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সকলের গান’। কবিতার প্রথম শব্দ ‘কমরেড’ পদাতিক সৈন্যের জন্য মার্কসবাদের প্রেরণার পাশাপাশি গোঁ কাব্যটির বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিতবাহী। প্রথম শব্দটিতেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, এই কাব্যটি পদাতিক কমরেডের কাছে প্রত্যাশায় ঠাসা। পাঠককেও তিনি একজন কমরেড ভাবেন বলেই ‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম উচ্চারণ ‘কমরেড’।
‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।’
‘পদাতিক’ কবিতায় মার্কসবাদের ‘দাওয়াত’ ছাড়াও রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ। মার্কসবাদী কবি হিশেবে মধ্যবিত্তকে তুলোধুনা করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছাড়াও তিনি প্রকাশ করেছেন রোমান্টিক কবিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। রোমান্টিক কবিদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা অতিশয় মার্কসপ্রভাবজাত। রাজনৈতিক কর্মী বলেই রোমান্টিক কবিদের উচ্চতর শিল্পমানসকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। ‘রোমান্টিক’ কবিতায় সুভাষের উচ্চারণ,
‘ছেঁড়া জুতোঁয় ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে
বেঁধে নেই মন কাব্যের প্রতিপক্ষে;
সেই কথাঁই বাধে না নিজেকে বলতে-
শুনবে যে কথা হাজার জনকে বলতে।’
রোমান্টিক কবিদের প্রতি ÿোভ একদিকে যেমন তার তীক্ষ্ন মার্কসবাদের ফল, অন্যদিকে এটি তার অশিল্পীসুলভ মনোভাবেরও পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে কবিসত্তার ওপর সুভাষের রাজনৈতিক সত্তা প্রধান হয়ে ওঠেছে।
রাজনৈতিক কবি হলেও সুভাষের কবিতা অলঙ্কারক্ষরায় আক্রান্ত নয়। রূপক, প্রতীক, উপমা, অনুপ্রাসসহ নানা কাব্যিক অনুষঙ্গে ‘পদাতিক’ ভরপুর। অলঙ্কারবাহুল্য ও অলঙ্কারের সফল প্রয়োগের ফলে কবি সুভাষ অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ সুভাষের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। অলঙ্কার প্রয়োগে সুভাষের সাফল্য নিঃসন্দেহে সমকালীন অনেক কবির চেয়ে এগিয়ে।
‘পশ্চিমের লাল মেঘ অন্ধ হয় পৃথিবীর আশ্চর্য খামারে’ কিংবা ‘চাঁদের পাড়ায় মেঘের দুরভিসন্ধি’ জাতীয় অলঙ্কারবহুল পদের অভাব এ কাব্যে নেই।
সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনা-আশ্রিত কবিতাসমূহের আবেদন ফুরিয়েছে ঘটনা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই। এসব কবিতায় শিল্পের নানা উপকরণ থাকলেও সমকালীন ঘটনার সাথে বাঁধা বলে চিরকালীন আবেদনশূন্য।
‘পদাতিক’ কাব্য নানা কাব্যিক উপাদানে ঠাসা হলেও রাজনৈতিক কারণে এর বিষয়বৈচিত্র্য নেই। একই ঘরানার বক্তব্যের পুনঃপুন ব্যবহার দুর্দান্ত অলঙ্কারমতি এই কাব্যের সমূহ সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেছে। রাজনীতির কারণে শেষ পর্যন্ত সুভাষের কবিতা নিখাঁদ কবিতা হয়ে ওঠে নি, বরং শ্লোগান হয়ে ওঠেছে।

তথ্যঋণ:
১। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: পদাতিক’, বুদ্ধদেব বসু, কবিতা, পৌষ সংখ্যা-১৩৪৭।
২। ‘আধুনিক সাহিত্য’, অমলেন্দু বসু, চতুরঙ্গ, মাঘ সংখ্যা ১৩৬৪।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন