রোহিত মিশ্র
ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনে ভারতীয় সমাজের শ্রেণিবিশ্লেষণ ও বুর্জোয়াশ্রেণির চরিত্র নিয়ে বিতর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। বিশেষত বিগত প্রায় ৪৫ বছর ধরে ভারত রাষ্ট্রকে আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক হিসেবে এবং ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণিকে মুৎসুদ্দি বলে চিহ্নিত করার অবস্থান ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরে জোরালোভাবেই বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সংশোধনবাদী বামদলগুলির কেউ কেউ, কমিউনিস্ট বিপ্লবী শিবিরের কোনো কোনো সংগঠন, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গ ভারতকে মূলত একটি স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে ও এদেশের বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণিকে স্বাধীন বা জাতীয় বুর্জোয়া বলেও চিহ্নিত করেছেন।
ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণেই এই মতপার্থক্যের সূত্রপাত। বর্তমান আলোচনাটি আমরা মূলত ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণির উদ্ভব, বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও চরিত্র নির্ধারণে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। আলোচনার শুরুতে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কালে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির পুঁজিপতিদের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র নির্ধারণ ও সর্বহারার কর্তব্য নির্ধারণে কমিন্টার্ন-এর অবস্থান ও বিতর্কগুলি থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করব। তারপর আমরা সেই ধারণা অনুযায়ী ১৮৮৫-১৯৪৭ সাল এর মধ্যে ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণির গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এবং তার প্রকৃতি ও চরিত্রের বিশেষত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
ঔপনিবেশিক ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণেই এই মতপার্থক্যের সূত্রপাত। বর্তমান আলোচনাটি আমরা মূলত ভারতের পুঁজিপতি শ্রেণির উদ্ভব, বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও চরিত্র নির্ধারণে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। আলোচনার শুরুতে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কালে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির পুঁজিপতিদের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র নির্ধারণ ও সর্বহারার কর্তব্য নির্ধারণে কমিন্টার্ন-এর অবস্থান ও বিতর্কগুলি থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করব। তারপর আমরা সেই ধারণা অনুযায়ী ১৮৮৫-১৯৪৭ সাল এর মধ্যে ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণির গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এবং তার প্রকৃতি ও চরিত্রের বিশেষত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে উপনিবেশের পুঁজিপতিশ্রেণির চরিত্রায়ন সম্পর্কে চর্চা: কমিন্টার্ন-এর প্রথম পর্ব
রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের আগে পর্যন্ত প্রাচ্যের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট আন্দোলন তেমনভাবে উপস্থিত ছিল না। বিপ্লব-পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাশিয়ার সহযোগিতায় তৈরী হওয়া কমিন্টার্নই প্রথম প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক-আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বাম আন্দোলন গড়ে তোলার কাজটিকে গুরুত্বসহকারে হাজির করে। এইপর্বে বিশ্বজোড়া বিপ্লবী আন্দোলনের ঢেউ বিশেষত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেনের শপ শেফার্ড আন্দোলন, ইতালির ফ্যাক্টরি কাউন্সিল আন্দোলন, হাঙ্গেরির শ্রমিক সোভিয়েত, জার্মানি-অস্ট্রিয়ার আন্দোলন এই সময়ে সার্বিকভাবে এক সর্বহারা বিশ্ববিপ্লবের আবহ গড়ে তোলে। এইরকম এক সময়েই ১৯১৯ সালে কমিন্টার্নের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে প্রাচ্যকে মূলগতভাবে সমাজতান্ত্রিক ইউরোপের অনুষঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কিছুদিন বাদেই জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিতে বিপ্লবপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং বিশ্ববিপ্লবের স্বপ্ন ও বাস্তবতা দুই-ই প্রবল ধাক্কার সম্মুখীন হয়। নতুন পরিস্থিতি তত্কালীন কমিন্টার্ন-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সামনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়।(১) শ্রমজীবী জনগণের রাজনৈতিক জাগরণের স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবতার অভাবে কেন্দ্রীভূত সংগঠন গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়। এই ব্যর্থ বিপ্লবের যুগে যেহেতু সোভিয়েত রাশিয়াই বিশ্বসমাজতন্ত্রের শেষ দূর্গ হয়ে দাঁড়ায়, তাই কমিন্টার্নের মধ্যে প্রশ্নাতীতভাবে রুশীয় মডেলের অনুকরণ ব্যাপক অর্থেই বৃদ্ধি পায়। লেনিনকে লেখা এক চিঠিতে ক্লারা জেটকিন এই ক্রমবর্ধমান ‘রুশিকরণ’ নিয়ে তাঁর তীব্র উদ্বেগ ব্যক্ত করে বলেন,
“…কার্যনির্বাহী কমিটি যাতে তাদের চিঠিপত্র এবং বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকে, আমি তার জন্য আপনাকে আপনার প্রভাব খাটাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি। কখনো কখনো তাদের হস্তক্ষেপের চরিত্রটা এমন কঠোর এবং জোরালো হয় যে তাতে তৎসম্পর্কিত বাস্তব অবস্থার ব্যাপারে তাদের তখনকার ধারণাটা গরহাজির থাকে”। (২)
এইরকম এক পরিস্থিতির মধ্যেই কমিন্টার্নে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির বুর্জোয়াদের সম্পর্কে সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মূল্যায়নের প্রশ্নটি গভীরভাবে সামনে এসে উপস্থিত হয়। সাধারনভাবে প্রাচ্যের এই দেশগুলিতে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ শ্রেণিসংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার মত শক্তিশালী ও সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির অনুপস্থিতি ছিল। এই সমস্ত বাস্তব অবস্থার টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই ১৯২০-১৯২৮ সাল অবধি সময়পর্বে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে কমিন্টার্ন-এর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। তাই আমাদেরও কমিন্টার্নের সিদ্ধান্তগুলিকে সেই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে, কোন বিচ্ছিন্ন নির্দেশ হিসাবে দেখলে চলবে না।
কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেস: উপনিবেশ-আধা উপনিবেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন উদ্যোগ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত কমিন্টার্ন-এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে ঔপনিবেশিক-আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট কর্তব্যের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে উত্থাপিত হয় এবং কমঃ লেনিন এই আলোচনাতে পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। প্রাথমিকভাবে এই বিষয়ে আলোচনার জন্য কমরেড লেনিন একটি খসড়া প্রস্তুত করে প্রতিনিধিদের বিতরণ করেন। লেনিনের খসড়ার প্রত্যুত্তরে কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ও এই কংগ্রেসে একটি খসড়া পেশ করেন। এই দু’টি খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ফলে উপনিবেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রশ্নটি একটি নতুন দিশা পায় এবং বাস্তবত এই দুটি খসড়াই কিছু সংশোধনী সহকারে সর্বসন্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তাঁর প্রাথমিক খসড়াতে লেনিন উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে কমিন্টার্ন কর্তৃক সমর্থনের পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছিলেন:
“প্রথমত, সমস্ত কম্যুনিস্ট পার্টিগুলির দিক থেকে এই দেশগুলিতে চলমান বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনগুলিকে সাহায্য করা উচিত এবং সবচেয়ে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার কর্তব্যটি প্রাথমিকভাবে বর্তায় সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকদের উপর, যার উপর পশ্চাদপদ দেশটি ঔপনিবেশিকভাবে বা আর্থিকভাবে নির্ভরশীল;…” (৩) (১১ নং থিসিস)
যদিও ঐ একই থিসিসের ২, ৩, ৬ এমনকি ১১ নং নিবন্ধে লেনিন প্রলেতারীয় আন্দোলনের স্বাধীন উত্থানের উপরও জোর দিয়েছিলেন। এই লেখাতে লেনিন সর্বহারা কর্তব্য ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কর্তব্যের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে সুস্পষ্ট করে তোলেন। লেনিন বলেন,
“… কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক-এর দিক থেকে ঔপনিবেশিক এবং পশ্চাদপদ দেশগুলির বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করা উচিত শুধুমাত্র এই শর্তেই যে— সেসব দেশগুলিতে, নামেই শুধুমাত্র কম্যুনিস্ট নয় এরকম ভবিষ্যতের সর্বহারা পার্টিগুলোর উপাদানসমূহকে একত্রিত করা হয়েছে এবং তাদের বিশেষ কর্তব্যগুলিকে বুঝতে শেখানো হয়েছে, যেমন, নিজের দেশের ভিতরেই বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা”। (৪)
এই থিসিসে লেনিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সর্বতোভাবে সমর্থন করার কথা বলেন,আবার অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে প্রলেতারীয়দের স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের পক্ষেও সওয়াল করেন। এই অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও কমিন্টার্নের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ লেনিনের খসড়ার এক গঠনমূলক সমালোচনা রাখেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পেশ করা খসড়াটিতে তিনি ভারতের মত উপনিবেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন না করে শুধুমাত্র প্রলেতারীয় আন্দোলনকে সমর্থন করার প্রস্তাব রাখেন। লেনিনের সঙ্গে দু’টি বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। প্রথমতঃ লেনিনের মতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি মনে করতেন যে গান্ধীর দ্বারা পরিচালিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পূর্ণভাবেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের সাথে যুক্ত ছিল।(৫) দ্বিতীয়তঃ, এম এন রায় মনে করতেন যে ভারতে বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য ভারতীয় সর্বহারারা ঐ সময়েই জনসংখ্যায় ও শ্রেণিচেতনায় বেশ অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছিল, যে বক্তব্য লেনিন ঠিক বলে মনে করতেন না। রায়ের নিম্নলিখিত বক্তব্য থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়,
“…জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তি যে প্রকৃত শক্তি, সে কখনোই নিজেকে উপনিবেশের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ পরিসরে আটকে পড়তে দেয় না। উপনিবেশের বৃহত্তর অংশে ইতিমধ্যেই উপস্থিত রয়েছে সংগঠিত বিপ্লবী পার্টিগুলি, যারা শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংসর্গ রেখে কাজ করে …”। (৬)
যদিও সর্বহারা শ্রেণির সম্বন্ধে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের এই বক্তব্যে কিছুটা অতিভাষণ ছিল যা এম এম রায় পরবর্তীকালে স্বীকারও করেছিলেন।(৭) তবুও এটা অনস্বীকার্য যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কিত তাঁর সমালোচনাটি লেনিনের খসড়ার অভিমুখের একটি গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটায়। এই প্রথম উপনিবেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দেখার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি দিশা ঠিক হয়। লেনিন বলেন যে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুটি ধারা আছে— একটি সংশোধনবাদী ধারা যারা ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধে; আর আরেকটি ধারা যারা এই শাসকদের বিরোধিতা করে জাতীয় মুক্তির জন্য লড়াই করে। তাই, দ্বিতীয় কংগ্রেসের চতুর্থ অধিবেশনে কমঃ লেনিন সুস্পষ্টভাবে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন যে,
“…তৃতীয়ত, পশ্চাদপদ দেশগুলির বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্নের উপর আমি জোর দিতে চাইছি। এটাই হলো সেই বিষয় যেটা কিছুমাত্রায় ভিন্ন মতামতের জন্ম দিয়েছে। পশ্চাদপদ দেশগুলির বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন জানানো কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর কর্তব্য- এই বক্তব্য ঘোষণা করা নীতিগত এবং তত্ত্বগতভাবে সঠিক কিনা এটাই ছিল আমাদের তর্ক-বিতর্কের বিষয়। এই আলোচনার পরিণতি হিসেবে আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলন নয়, শুধুমাত্র জাতীয়-বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কেই এই কথাবার্তা চলতে পারে। এই বক্তব্য সম্পর্কে কোনরকম সন্দেহ থাকতে পারেনা যে যেকোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধুমাত্র একটি বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনই হতে পারে; তার কারণ পশ্চাদপদ দেশগুলির জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ কৃষকদের দ্বারা গঠিত, যা বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে। যদি পশ্চাদপদ দেশগুলিতে সর্বহারার পার্টির উত্থান আদৌ সম্ভব হয়, তাহলে এইসব দেশগুলিতে কৃষক আন্দোলনের সাথে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক ব্যতীত, তাকে প্রকৃতপক্ষে সমর্থন ব্যতীত তারা কম্যুনিস্ট রণকৌশল এবং কম্যুনিস্ট কর্মনীতি সম্পন্ন করতে পারবে, এটা ভাবা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আপত্তি তোলা হয়েছে এই ব্যাপারে যে যদি আমরা ‘বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক’ কথাটি ব্যবহার করি, সেক্ষেত্রে আমরা সংস্কারপন্থী এবং বিপ্লবী আন্দোলনের ফারাকটি হারিয়ে ফেলবো; এই ফারাকটি ইদানিংকালে পশ্চাদপদ দেশগুলি এবং উপনিবেশগুলিতে বেশ স্পষ্ট হয়েছে শুধু এই কারণেই যে নিপীড়িত জনগণের মধ্যে থেকেও একটি সংস্কারপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া তার সাধ্য অনুযায়ী সমস্তকিছু করে চলেছে। শোষক দেশগুলির বুর্জোয়াদের সাথে উপনিবেশগুলির বুর্জোয়াদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধরনের বোঝাপড়া উদ্ভূত হয়েছে, যার ফলে প্রায়শই, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, নিপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়ারা, যদিও তারাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করে, তথাপি সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সমঝোতার ভিত্তিতে, অর্থাৎ এক কথায় তাদের সাথেই, সকল বিপ্লবী আন্দোলন এবং বিপ্লবী শ্রেণির বিরদ্ধে লড়াই চালায়। এই ব্যাপারটি কমিশনে সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং আমরা বিশ্বাস করি যে এই পার্থক্যটি বিবেচনার মধ্যে নিয়ে আসা এবং প্রায় সব জায়গায় ‘বুর্জোয়া-গণতন্ত্র’ শব্দদুটিকে ‘জাতীয়-বিপ্লবী’ কথাটি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা – এটাই একমাত্র সঠিক উপায়। এই সম্পর্কিত বিষয়টি হলো যে কম্যুনিস্ট হিসেবে আমরা ঔপনিবেশিক দেশগুলির বুর্জোয়া স্বাধীনতা আন্দোলনগুলিকে শুধুমাত্র তখনই সমর্থন করবো যদি এই আন্দোলনগুলি প্রকৃত অর্থেই বিপ্লবী হয় এবং তাদের প্রতিনিধিরা কৃষকদের বিপ্লবী পদ্ধতিতে শিক্ষিত এবং সংগঠিত করতে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ না করে। কিন্তু যদি তেমন কোন অর্থ না থাকে, তাহলে সেখানেও কম্যুনিস্টদের কর্তব্য থাকছে সংস্কারবাদী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর, যেই ধারায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নায়করাও পড়ে…’’ (৮)
অর্থাৎ দ্বিতীয় কংগ্রেসেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুই ধারার মধ্যে লেনিন পার্থক্য করেছেন শ্রেণিদ্বন্দ্বের ভিত্তিতে, শুধু তাই নয়, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটিকেও তিনি চলমান শ্রেণিসংগ্রামের এক পরিবর্তনশীল ও দ্বান্দ্বিক বিষয় হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তাই তিনি স্পষ্টভাবেই বলেন যে ক্ষমতায় আসতে গেলে উপনিবেশের বুর্জোয়াদেরও সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মেলাতেই হয়। এটা বুর্জোয়াশ্রেণি হিসেবেই তার অন্তর্নিহিত চরিত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও লেনিনেরই কথা অনুযায়ী, সর্বহারা ও উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতি ঔপনিবেশিক দেশের বুর্জোয়াদের দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ করে তাদের সমর্থনও করা যেতে পারে। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের তোলা আরেকটি বিষয় নিয়ে লেনিন নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে বলেন যে, যেহেতু উপনিবেশগুলিতে সর্বহারারা এখনও শ্রেণিসংগ্রামের জন্য যথেষ্ট তৈরী নয়, তাই উপনিবেশগুলিতে তিনি সর্বহারাদের স্বাধীন বিকাশকে ও নেতৃত্বকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না করেও কৃষকদের সমস্যার উপর আলাদা গুরুত্ব আরোপ করতে চান। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রস্তাবিত খসড়াটিতে সর্বহারার শ্রেণির প্রস্তুতির প্রসঙ্গে কিছু অতিভাষণ থাকলেও সেটি শুধুমাত্র এই কারণে কমিন্টার্নে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় যে উপনিবেশগুলির সর্বহারাদের স্বাধীন শ্রেণি হিসাবে অগ্রগামী হওয়ার ধারণা তীব্রভাবে এতে উপস্থিত ছিল।
ঔপনিবেশিক দেশের বুর্জোয়াদের চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে লেনিনের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ দ্বিতীয় কংগ্রেসে আসা আরও অনেক সদস্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। কোরিয়ার প্রতিনিধি পাক-চিন-সুন জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কোরীয় জাতীয় বুর্জোয়াদের অন্তর্দ্বন্দ্ব শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির আলোকে অনবদ্যভাবে বর্ণনা করেন,
“…এখানে যেকটা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তার কয়েকটির কার্যকর বাস্তবায়নের উপর আমি একটু অল্প সময় ব্যয় করতে চাই কারণ যে প্রশ্নগুলিকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, বিপ্লবী আন্দোলন আমাদের সেই একই প্রশ্নের সামনে ঠেলে দিয়েছে। দশ বছর আগে কোরিয়ার জনগণ কোরিয়ার দখলের প্রশ্নে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন ছিল। গণতন্ত্র সম্পর্কে জ্বালাময়ী ভাষণ, কোরিয়া দেশটির স্বাধীনতা এবং একটি স্বাধীন ও সুখ-সমৃদ্ধির জীবন সম্পর্কে তারা একইভাবে নিস্পৃহ ছিল। আর বর্তমানে হঠাৎ করে তারা বিগত আঠারো মাস যাবৎ লড়াই চালাচ্ছে এবং দৃষ্টান্তমূলকভাবে আত্মনিবেদন ও আত্মত্যাগের উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা এটা বলতে পারি না যে দশ বছরের একটি সময়কালে কোরিয়ার জনগণের সাধারণ সাংস্কৃতিক মান এতটা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। এই দশ বছরের সময়পর্বে জাপানিরা কোরিয়ার জনগণের শ্রেণি চেতনার উন্নতি করতে অক্ষম থেকেছে শুধু নয়, তারা সর্বজনীন জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তুলতেও অক্ষম হয়েছে। যদি এখানে আমাদের শিক্ষকেরা বলে গিয়ে থাকে যে বিপ্লবই হলো ইতিহাসের চালিকাশক্তি, সে ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় বলবো যে ইতিহাসের পথ ধরে যে জ্বালানি এই চালিকাশক্তিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা হলো অর্থনীতি।
বর্তমানে, দখলীকৃত অবস্থায় কোরিয়া এখন একটি অসুখী দেশ। আমরা কৃষক সম্প্রদায়ের উদাহরণ ধরি। তারা যে করের বোঝায় আজ ভারাক্রান্ত, তা দখলের আগের পরিস্থিতির তুলনায় ৩০০ থেকে ৩৫০ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এটা কৃষিজীবী সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং জাপানি কৃষি ব্যাঙ্ক-এর যে নীতি, যা মূল জাপানি ভূখন্ড থেকে কোরিয়াতে বাধ্যতামূলক অভিবাসন চালু করতে চাইছে, তা কোরিয়ার অধিকাংশ কৃষকদের, বিশেষত মধ্য কৃষকদের খেপিয়ে তুলেছে। তদুপরি, জাপানিরা কোরিয়াবাসীদের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে উপযুক্ত কোন শিক্ষালাভের সুযোগ দেয় না এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেখানে ইঞ্জিনিয়ার এবং ভালো ভালো সামরিক উপদেষ্টাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে নবীন ছাত্রদের প্রবেশ নিষেধ। এই কারণেই শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ নয়, সমগ্র ছাত্রসমাজ এই দখলদারির বিরুদ্ধে। চলুন, আমরা এবার বুর্জোয়াদের অবস্থা দেখি। কোরিয়াকে উপনিবেশ হিসেবে দেখার তার যে ঔপনিবেশিক নীতি, তার মাধ্যমে জাপানিরা কোরিয়ার বুর্জোয়াদের নিজেদের দেশে কারখানা এবং শিল্প স্থাপন করার সকল সম্ভাবনা হরণ করে নিচ্ছে। জাপানের সাথে কোরিয়ার বুর্জোয়াদের বৈরিতার এটাও একটা বড় কারণ। এই সমস্ত কারণের জন্য কোরিয়ার বুর্জোয়ারা শ্রমজীবী জনগণের সাথে একজোটে লড়াই করেছে এবং বিগত তিন কি চার বছরে আমরা এই দুই শ্রেণির মধ্যে সীমারেখা টানতে ব্যর্থ হয়েছি। যতক্ষণ অবধি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই প্রচেষ্টাকে অসম্ভব বানিয়ে রাখবে, ততক্ষণ আমরা এই কাজে ব্যর্থই থাকব। এই শ্রেণি বিভাজনকে সম্পন্ন করা এবং এই যে বিপ্লবী আন্দোলন, যা কোরিয়াতে একটি কৃষি আন্দোলনের ছাপ বহন করছে, তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার এই কঠিন কাজটি আমাদের পার্টি অধ্যবসায়ের সাথে করবে। কোরিয়ার প্রতিটি জমিদার এবং জমির অধিপতি আজকে জানে যে কোরিয়াতে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে কাকে অভিহিত করা হয়। এই আন্দোলনটির অভিমুখ শুধুমাত্র জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়, তাদের নিজস্ব বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেও, যা কোরিয়া দেশে প্রধানত বড় জমির মালিকদের দ্বারা গঠিত। … পরিশেষে, যখন কোরিয়া দেশের জাতীয় জোয়াল ভেঙ্গে বেরোনোর সময় আসবে, তখন স্বাধীন কোরিয়া যে কখনই তাদের মধ্যে আশানুরূপ সেই আনন্দ নিয়ে আসতে পারবে না, এই কথাটি অনুধাবন করতে বুর্জোয়াদের জন্য হয়তো দু থেকে তিন বছরই যথেষ্ট। সে জানে যে একটি স্বাধীন কোরিয়া দেশের অর্থ হলো তাদের সমস্ত প্রতিপত্তি ও সুযোগসুবিধের প্রত্যাহার এবং এই কারণেই তারা কোরীয় বিপ্লবের বিরুদ্ধে এবং তারা তাদের ভাগ্য জাপানি সাম্রাজ্যবাদের সাথে বেঁধে রাখে…”। (৯)
এখানে পাক-চিন-সুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিভিন্নতার সাথে সাথে জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কোরীয় বুর্জোয়াদের সম্পর্কের পরিবর্তনের এক সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথমদিকে তারা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের খাতিরেই সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়াদের মতো লড়েছে কিন্তু জাতীয় আন্দোলন যখনই বিপ্লবী দিশায় ঝুঁকতে শুরু করল তখনই তারা জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে বোঝাপড়া করতে লাগল। আয়ারল্যান্ড-এর প্রতিনিধিরাও আইরিশ জনগণের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সম্পর্কটি পাক-চিন-সুনের মতই তুলে ধরেন।(১০) কানাডাতেও সেই দেশের বুর্জোয়াশ্রেণি গড়ে ওঠার সময়পর্বে তাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের এক ধরনের গাঁটছড়া ছিল। (১১)
দ্বিতীয় কংগ্রেস-পরবর্তী অধ্যায়ে কমিন্টার্নে ঔপনিবেশিক প্রশ্নে অবস্থান :
দ্বিতীয় কংগ্রেসের দু’মাস পরে বাকুতে অনুষ্ঠিত ‘প্রাচ্যের জনগণের প্রথম কংগ্রেস’-এও ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া প্রশ্নে লেনিনের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসৃত হয় এবং জাতীয় বুর্জোয়া, কৃষক সমস্যার মত বিষয়গুলি বিশদে আলোচিত হয়। লেনিনের মূল বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও কমঃ মাতুশেভ উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলিতে জাতীয় বুর্জোয়াদের সমর্থন করার পাশাপাশি এটাও বলেন যে
“উপরোক্ত প্রবন্ধগুলি সঠিকভাবে আরো দেখাচ্ছে যে আন্দোলনের এই ধারাগুলি মেহনতিদের শৃঙ্খলমোচন করতে সক্ষম হবেনা। এই আন্দোলন কখনো প্রকৃত মুক্তি আনতে পারবেনা। তদুপরি, প্রবন্ধগুলি এই মুক্তির সামাজিক ভিত্তির দিকে ইঙ্গিত করে এবং এই মুক্তির প্রধান আলম্ব যে কৃষি প্রশ্ন, সেই দিকে নির্দেশ দেয়”। (১২)
১৯২১ সালের তৃতীয় কংগ্রেস ঔপনিবেশিক প্রশ্নে বিশদ আলোচনা না করলেও ১৯২২-এর চতুর্থ কংগ্রেস কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসে। সেই সময় মানবেন্দ্রনাথ রায়, যিনি কমিন্টার্নে এই প্রশ্নে এক অগ্রণী বক্তা হয়ে উঠেছিলেন, চতুর্থ কংগ্রেসে গৃহীত ‘Thesis on the eastern question’-এর সঙ্গে কিছু বিষয়ে অসহমত প্রকাশ করেন। চতুর্থ কংগ্রেসে গৃহীত ঐ দলিল জাতীয় বুর্জোয়াদের দোদুল্যমান চরিত্র সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েও ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের উপর জোর দেয়। কৃষিবিপ্লবের উপর ভিত্তি করে কৃষক-সমস্যার সমাধান ও উপনিবেশগুলির সর্বহারাদের সংগঠিত করার কর্মসূচী নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির কমিউনিস্ট পার্টিগুলির জন্য দ্বিবিধ কর্মপন্থা নেওয়া হয়—
“প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক দেশের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি, যারা এখনো কমবেশি ভ্রূণাকারে রয়েছে, তাদের প্রত্যেকটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা উচিত যার মাধ্যমে তারা জনগণের কাছে পৌঁছয়ে পারবে। একইসাথে শ্রমিক ইউনিয়নের ভিতর যে পুরুষতান্ত্রিক ও হস্তশৈল্পিক-দক্ষতা সম্পর্কিত সংস্কারগুলি এবং বুর্জোয়া প্রভাব বর্তমান সেগুলির বিরুদ্ধে তাদের প্রবল সক্রিয়ভাবে প্রচার অভিযান চালাতে হবে. সংস্কারবাদী ঝোঁকের হাত থেকে উপরোক্ত ভ্রূণাকারের সংগঠনগুলিকে রক্ষা করা এবং সেগুলিকে ব্যাপক গণভিত্তিক লড়াকু সংগঠনে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে”। (১৩)
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দলিল ‘প্রাচ্যের প্রশ্নে রিপোর্ট’, উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলির বিভিন্নতার দিকগুলি তুলে ধরে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কর্মপন্থা নেওয়ার উপর জোর দিয়ে এক নতুন দিশা উন্মোচন করে। ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কংগ্রেস অব্দি এই নতুন কর্মপন্থাই কমিন্টার্নে প্রাধান্যকারী ছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ প্রয়োজন, এম এন রায় ভারত, মিশর ও তুরস্কের মত দেশের সমস্ত বুর্জোয়াদেরই প্রতিবিপ্লবী মনে করতেন।(১৪) কিন্তু রায় এই বক্তব্য রেখেছিলেন ভারতীয় সর্বহারা শ্রেণির অত্যধিক বিকাশের এক ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে।(১৫)
চতুর্থ কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উল্লেখিত দলিলটি এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল যে যে কমিন্টার্ন-এর ৫ম কংগ্রেসের খসড়া দলিলের ক্ষেত্রে কমঃ স্তালিন কমঃ মানুইলিস্কির (তদানীন্তন প্রাচ্য কমিশনের নেতা) দেওয়া খসড়ার কঠোর সমালোচনা করেন। কমঃ মানুইলিস্কির দেওয়া ঐ খসড়ায় উপনিবেশগুলিকে সম-অবস্থাপন্ন ধরে নিয়ে একই রকম লাইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল। এমনকি জাতীয় বুর্জোয়াদেরই উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার মূল শক্তি হিসাবে বিচার করে তাদের সঙ্গে কমিন্টার্ন-এর সুসম্পর্কস্থাপনে জোর দেওয়া হয়েছিল। এম এন রায়ের বক্তব্য ছিল ঠিক এর বিপরীত। রায়কে সমর্থন করে কমঃ স্তালিন এক ৩১শে জুলাই, ১৯২৪-এর খসড়া সংশোধনী এক চিঠিতে কমঃ মানুইলিস্কিকে লেখেন,
“…তুমি রায়ের (মানবেন্দ্রনাথ) সাথে বৈসাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছ, যিনি উপনিবেশগুলির সংগ্রামের সামাজিক দিকের উপর জোর দিয়েছেন। আমি জানি না কীভাবে এই পার্থক্যগুলি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে। কিন্তু আমি এটা নিশ্চয়ই বলব যে কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবে এমন কিছু নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে, যার সাথে আমি একমত নই বিশেষতঃ সামাজিক দিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিষয়ে। আমি বিশ্বাস করি যে ভারতের মতো উপনিবেশগুলিতে, যাদের বুর্জোয়ারা হলো আপসকামী এবং যেখানে এই আপসকামী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিজয়ই হলো সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির প্রধান প্রাকশর্ত, সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বহারার আধিপত্য উপস্থাপিত করার প্রশ্নটি উত্থাপন করার সময় এসে গিয়েছে…ভারতের মতো উপনিবেশে যে নতুন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তার মূল বৈশিষ্ট্য হল যে জাতীয় বুর্জোয়ারা বিপ্লব সম্পর্কে ভীত এবং নিজের দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য সম্পূর্ণ করার জন্য বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের সাথে একটা বোঝাপড়ায় যেতে তারা পছন্দ করে..”। (১৬)
অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ভারতের ‘জাতীয় বুর্জোয়া’রা বিপ্লবের ভয়ে ভীত হয়ে যে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস-সমঝোতার রাস্তায় স্বাধীনতা অর্জন পছন্দ করবে সেই বিষয়টি কমরেড স্তালিনের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। এমনকি সিপিআই-এর কর্মসূচী সম্বন্ধে ECCI-এর ৬ই এপ্রিল, ১৯২৫-এর অবস্থানের [কংগ্রেস ও স্বরাজ পার্টির বামপন্থী অংশের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠন (১৭)] কড়া সমালোচনা করে কমঃ স্তালিন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ধারণার সপক্ষে দু’টি বক্তব্য রাখেন। প্রথমটি ৯ই মে বলশেভিক পার্টির চতুর্দশ সভায় ও অন্যটি KUTV-র ছাত্রদের প্রতি তাঁর ১৮ই মে’র বক্তৃতায়।(১৮) স্তালিন বলেন,
“অন্য ভাবে বলতে গেলে, ব্যাপারটা হলো ভারতের মতো উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য সর্বহারাদের প্রস্তুত করা। এই আন্দোলনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি থেকে বুর্জোয়া এবং তার মুখপত্রদের ধাপে ধাপে হঠাতে হবে। এই কাজের উদ্দেশ্য হলো একটি বিপ্লবী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ব্লক সৃষ্টি করা এবং এই ব্লকে সর্বহারার আধিপত্য নিশ্চিত করা। এই ব্লক-টি কখনো একইসাথে একটি শ্রমিক এবং কৃষকদের পার্টি, আনুষ্ঠানিকভাবে যা একই প্লাটফর্ম দ্বারা আবদ্ধ, সেই রকম পার্টির রূপ গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সব সময় যে এমন ঘটনা ঘটতে হবে এমন নয়। সেই সব দেশগুলিতে কম্যুনিস্ট পার্টির স্বাতন্ত্র হওয়া উচিত অগ্রণী কম্যুনিস্টদের স্লোগান কারণ সর্বহারার আধিপত্য একমাত্র কম্যুনিস্ট পার্টির মাধ্যমেই প্রস্তুত এবং বাস্তবায়িত করা সম্ভব”। (১৯)
সুতরাং এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে উপনিবেশগুলির ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কমঃ স্তালিনের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল। তার বিচারে ভারত এমন একটি বিশেষ দেশ ছিল যেখানে সর্বহারারা বেশ কিছুটা পরিমাণে বিকশিত হয়েছিল অথচ সেই দেশের বুর্জোয়াদের একটা বড় অংশই সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে আপোষ করেছিল— যেটা এমনকি চীনেও হয়নি। আমরা ঔপনিবেশিক ভারতের বিশেষত্ব সম্পর্কে স্তালিনের ১৯২৫ সালের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চাই। কিন্তু কমঃস্তালিন এমএন রায়ের মতো সব বুর্জোয়াদেরই পুরোপুরি প্রতিবিপ্লবী এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মানতে রাজি ছিলেন না।(২০) যদিও ১৯২৫ সালে রায়ের সঙ্গে একই সুরে সর্বহারাদের স্বাধীন উদ্যোগ বিকাশের সপক্ষে তিনি সওয়াল করেন। বাস্তবতঃ স্তালিন ১৯২৮ অব্দি লেনিনের দ্বান্দ্বিক অবস্থানই অনুসরণ করেছিলেন। ১৯২৭-এর দ্বিতীয় চীন বিপ্লব সম্পর্কিত এক বিবৃতিতেও স্তালিন ঐ একই ধারণার উল্লেখ করেন।(২১)
উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে বুর্জোয়াদের চরিত্রায়ন সম্পর্কে কমঃ মাও-সে-তুং-এর অবস্থান :
চীনের মতো একটি দেশে বুর্জোয়াদের চরিত্রায়নের কাজটি কমঃ মাও-ৎসে-তুং গভীর যত্নসহকারে করেছিলেন। কমঃ মাও-এর রচনাগুলিতেই আমরা প্রথম ‘মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া’ শব্দাবলীর সাথে পরিচিত হই। তত্কালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে চীন বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায় ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কমঃ মাও সেদেশের বুর্জোয়াদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভিন্ন কর্মকৌশলের ব্যাখ্যা করেছেন এই লেখাগুলোতে। মাও-এর মতে—
“… বিভিন্ন মুৎসুদ্দি-বুর্জোয়ারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অধীন। এইসব বিভিন্ন মুৎসুদ্দি গ্রুপগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলিকে সুযোগে লাগানো প্রয়োজন, প্রথমে ওদের মধ্যে একজনের সাথে সাময়িক সঙ্গ নিয়ে তারপর প্রধান এবং আশু শত্রুর লক্ষ্যে আঘাত করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, অতীতে, চীনা মুৎসুদ্দি-বুর্জোয়াদের মধ্যে ব্রিটেনের স্বপক্ষে, মার্কিনদের স্বপক্ষে এবং জাপানিদের স্বপক্ষে বিভিন্ন দল ছিল। জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়ে আমরা একদিকে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদিকে জাপানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তাকে কাজে লাগিয়েছি, প্রথমে জাপানি আক্রমণকারী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল মুৎসুদ্দি দলগুলিকে আঘাত হেনে পরাজিত করেছি। তারপর আমরা মার্কিন এবং ব্রিটিশ আক্রমণকারীদের আঘাত হানার এবং মার্কিন ও ব্রিটিশদের স্বপক্ষে মুৎসুদ্দি দলগুলিকে খতম করার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ঘুরে গেলাম”। (২২)
এইবার দেখা যাক মাও কীভাবে জাতীয় ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের মধ্যে ফারাক করছেন—
“জাতীয় বুর্জোয়া হলো একটি শ্রেণি, যে একই সাথে দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী। একাধারে সে সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত ও সামন্তবাদ দ্বারা শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং সেই অনুসারে তাদের দুজনের সাথেই দ্বন্দ্বরত। এই প্রেক্ষিতে সে বিপ্লবী শক্তিদের মধ্যে একটি উপাদান বটে। চীন বিপ্লব চলাকালীন সাম্রাজ্যবাদ এবং আমলাশ্রেণি ও যুদ্ধবাজদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য সে একটা পরিমাণ উত্সাহ প্রদর্শন করেছিলো। কিন্তু অন্যদিকে পুরোদস্তুর সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদ বিরোধিতা তার সাহসে কুলায় না কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সে তখনো দুর্বল এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সাথে তার অর্থনৈতিক বন্ধন তখনো অবধি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এটা আরো স্পষ্ট হয় যখন জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতা আরো শক্তিশালী রূপ গ্রহণ করে…জাতীয় বুর্জোয়ার দ্বৈত চরিত্র অনুসারে সে কোন নির্দিষ্ট পর্বে এবং একটি নির্দিষ্ট সীমা অবধি সাম্রাজ্যবাদ এবং আমলাশ্রেনি ও যুদ্ধবাজদের সরকারগুলির বিরুদ্ধে বিপ্লবে অংশ নিতে পারে এবং একটি বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হতে পারে, কিন্তু আবার অন্যান্য পর্বে মুৎসুদ্দী বৃহৎ বুর্জোয়ার পশ্চাদ্ধাবন করা এবং প্রতিবিপ্লবে তার দোসর হওয়ার বিপদ থাকতে পারে”। (২৩)
কমঃ মাও-এর কাছে জাতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র হচ্ছে— প্রথমতঃ যেহেতু এরা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের দ্বারা পিষ্ট হয়, তাই এরা বিপ্লবী শক্তির পাশে সাময়িকভাবে দাঁড়ায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। চীন ছাড়াও আয়ার্ল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় বুর্জোয়াদেরও আমরা এই একই উদ্যমে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছি। কিন্তু দ্বিতীয়তঃ, সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এদের অর্থনৈতিক বন্ধন খুবই ঘনিষ্ঠ বলে এরা কখনই সর্বহারা শ্রেণির মত সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণ বিরোধিতা করতে পারে না। জনগণের প্রবল আন্দোলনের জোয়ারের সময় এদের এই দোদুল্যমান চরিত্র অনাবৃত হয়ে যায়। কিন্তু ভারতীয় বুর্জোয়ারা প্রাক-স্বাধীনতা কালে এরকম আচরণ করেনি। তারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। একদিকে তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা করত আবার অন্যদিকে নিজেদের বিকাশের জন্য বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখত। কমঃ মাও-এর মতে শুধু মুৎসুদ্দি নয়, জাতীয় বুর্জোয়ারাও সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে কিছু নির্ভরতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? কমরেড মাও এর মতে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া মানে—
‘‘মুৎসুদ্দি বৃহৎ বুর্জোয়ারা হল এমন একটি শ্রেণি যারা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষভাবে সেবা করে এবং তাদের দ্বারা সযত্নে লালিত হয়’’ (২৪) এবং বাস্তবতঃ “মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কুকুর’’ (২৫) এবং, ‘‘মুৎসুদ্দি শ্রেণিটি সর্বতোভাবে আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াশ্রেণির লেজুড়, নিজেদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখা ও উন্নতির জন্য সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল’’ (২৬)।
কমঃ মাও-এর মতে মুৎসুদ্দি ও তার প্রভু সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যে কোন বৃহৎ দ্বন্দ্ব থাকে না। কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়াদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কিছু সহযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও তাদের সাথে সংঘাতটাই একটি পর্বের জন্য সম্পর্কের প্রধান দিক হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবেই মাও কমিন্টার্ন-এর ষষ্ঠ ও তৎপরবর্তী কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের সমস্ত বুর্জোয়াদের সমসত্ত্বভাবে বিবেচনা করার একমাত্রিক অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এসম্পর্কে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থিত করেছিলেন। কমরেড মাও কিন্তু বারবার করে চীনের নির্দিষ্ট বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ার ধারণাটিকে উপস্থিত করছিলেন। মাও-এর বিচারে চীনের সেই বাস্তবতায় প্রতিটি মুৎসুদ্দী পুঁজিপতি-ই এক বা একাধিক প্রভু সাম্রাজ্যবাদী দেশের অধীন ছিল। ফলত মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার ধারণা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার আগে পারিপার্শিক বাস্তবতা বিবেচনা করেই করা উচিত।
‘মুৎসুদ্দি’ বুর্জোয়ার ধারণাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার প্রশ্ন
বর্তমান একচেটিয়া পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিকীকরণের যুগে (internationalization of monopoly capital) ‘মুৎসুদ্দি’ শব্দটিকে যারা পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছেন, তাদের ব্যাখ্যায়…
“একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের বুর্জোয়া এবং তার মুৎসুদ্দিদের মধ্যেকার বন্ধন অবিচ্ছেদ্য ধরনের নয় : মুৎসুদ্দির চরিত্র হিন্দু পুরাণের সতী স্ত্রী-এর মতো নয়। নিজস্বার্থরক্ষার চাহিদা অনুযায়ী সে পুরোনো প্রভুর জায়গায় একজন নতুন প্রভুকে সেবা করার কাজ বেছে নিতে পারে। যখন কোনো বিরল ক্ষেত্রে মুৎসুদ্দি এবং তার দ্বারা সেবিত সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বৈরিতামূলক জায়গায় গিয়ে পৌঁছয়, তখনও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদীব্যবস্থার ওপর নির্ভরতার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না, কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটা কোনো দ্বন্দ্ব নয়, এটা হল উপনিবেশ বা আধা-উপনিবেশের জনগণের ওপর শোষণ ও নিপীড়ন চালাবার উদ্দেশ্যে একটা অশুভ আঁতাত— সেটাই সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া এবং মুৎসুদ্দির মধ্যেকার সম্পর্কের প্রধান দিক।” (২৭)
এই সংজ্ঞাটি কমঃ সুনীতিকুমার ঘোষ রচিত। কমঃ ঘোষের মুৎসুদ্দী সম্বন্ধে ঐ বক্তব্য আজকের একচেটিয়া পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের যুগে কোরীয়, কানাডীয়, পর্তুগীজ, লাতিন আমেরিকা … যেকোনো দেশের জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির জন্যই প্রযোজ্য। আজকের বিশ্বায়িত একচেটিয়া পুঁজির যুগে কোনো ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াই ঐ বন্ধন ছিন্ন করতে পারে কি? কিন্তু শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদের সাথে এই যোগসাজশই তাকে ‘মুৎসুদ্দি’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। যদি “সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে উপনিবেশের জনগণকে শোষণের” প্রসঙ্গ ওঠে সেটি বুর্জোয়া হিসেবেই তার অন্তর্নিহিত সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কমঃ মাও আরও বলেছিলেন যে,
“জাতীয় বুর্জোয়ারা আমাদের বিরুদ্ধ শক্তি। চীনে জনপ্রিয় প্রবাদ আছে, বিরুদ্ধ শক্তি সর্বদা পরস্পর মিলিত হয়। চীন বিপ্লবের এক অভিজ্ঞতা হল জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে চলায় সতর্কতা প্রয়োজন। এরা যেমন শ্রমিকশ্রেণিকে বিরোধিতা করে, তেমনই এরা সাম্রাজ্যবাদেরও বিরোধিতা করে ….জাতীয় বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে আগ্রহী নয় কারণ এদের জমিদারশ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা রয়েছে। এর অতিরিক্ত ব্যাপার হল, এরা শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন ও শোষণ চালায়”। (২৮)
বাস্তবতঃ সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের বুর্জোয়াশ্রেণির এক প্রান্তে যদি জাতীয় বুর্জোয়ারা থাকে, তবে মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ারা সম্পূর্ণ বিপরীতপ্রান্তে অবস্থান করে। আর এর মাঝে থাকে বিভিন্ন দেশের সেইসব বুর্জোয়ারা যারা সাম্রাজ্যবাদের সাথে বিভিন্ন মাত্রার নির্ভরশীলতা ও সংঘাত-এর সম্পর্ক নিয়ে চলে। বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়ারা তাদের দেশের ভিন্নতা অনুযায়ী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখায়। জাতীয় বা মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া কোনটির সাথেই এই বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পূর্ণ মেলে না। এবং আমরা দেখেছি যে ১৯২৮ সালের আগে পর্যন্ত কমিন্টার্নের বেশীর ভাগ নেতাই বিভিন্ন উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশগুলিতে পুঁজিবাদের ভিন্ন-ভিন্ন বিকাশের তত্ত্বকেই তাত্ত্বিকভাবে সঠিক বলে মনে করতেন। বুর্জোয়া শ্রেণির জন্ম ও বিবর্তনের এই জটিল প্রক্রিয়ায় কোন একটি দেশে মুৎসুদ্দী হিসেবে জন্ম নেওয়া বুর্জোয়া শ্রেণি কোনো একটা সময় মুৎসুদ্দী না-ও থাকতে পারে, আবার কোনো জাতীয় বুর্জোয়াও মুৎসুদ্দিতে পরিণত হতে পারে। এমনও হতে পারে যে কোন এক উপনিবেশের বুর্জোয়াদের সঙ্গে উপনিবেশকারীদের সরাসরি বড় সংঘাত থাকলেও তারা হয়তো নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। উপনিবেশের বুর্জোয়াদের সম্পর্কিত এই দ্বান্দ্বিক ধারণার উপর ভিত্তি করেই আমরা এখন ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির জন্ম থেকে শুরু করে তার যাত্রাপথের বিচার করে তার চরিত্র নির্ণয় করার চেষ্টা করব।
প্রাক্-স্বাধীনতা কালপর্বে ভারতীয় পুঁজিবাদী শ্রেণির জন্ম ও বিকাশ:
ঐতিহাসিক ভাবে ভারতীয় পুঁজিবাদী শ্রেণির জন্ম ও বিকাশকে দু’টি অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে— একটি হল প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্ব অর্থাৎ ১৯১৪-র আগে পর্যন্ত এবং আরেকটি ১৯১৪-১৯৪৭ অব্দি। এই দুই পর্বের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পর্কের কিছু পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। এবং এই দুই পর্যায়ের মধ্যেকার সর্পিল গতিপথে ভারতের পুঁজিবাদী বিকাশএর ভিত্তি এক বিকৃত রূপ ধারণ করে।
এই বিকাশের বিশ্লেষণ করবার আগে মার্কসীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া আবশ্যক। প্রতিটি সামাজিক বিকাশেরই তার নিজের স্থান-কালের বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে কিছু সাধারণ এবং কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। এখানেই কোন একটি সামাজিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার সময় ‘পদ্ধতি’ (Method) ও ‘প্রকল্প’ (Model)-এর মধ্যে পার্থক্য তৈরী হয়। ‘পদ্ধতি’-এর ক্ষেত্রে আমরা একটি ঘটনার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে অনুসন্ধান করি, মার্কসবাদের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির নাম হল মার্কসীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি। কিন্তু ‘প্রকল্প’-এর ক্ষেত্রে সময়-কাল অনুযায়ী তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য এর সাথে সাথে সমস্ত বিশেষ বৈশিষ্ট্যও উপস্থিত থাকে। আমরা মার্কসীয় পদ্ধতি (Method) অনুসরণ করে দেখব যে বিকাশটির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হাজির আছে না নেই।(২৯) মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন,স্তালিন মাও-এর বর্ণিত ‘প্রকল্প’গুলি তাঁদের সময়-কাল অনুযায়ী বিশেষ বাস্তবতা নিয়ে হাজির ছিল। সুতরাং এখন আমরা বর্তমান সময়-কালে সেই ‘প্রকল্প’-গুলিকে সরাসরি প্রয়োগ করে কোনো সামাজিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর নয়, কিন্তু তাদের প্রদর্শিত ‘পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে সাধারণ বৈশিষ্ট খোঁজাই মার্কসবাদের সঠিক প্রয়োগ। মার্কসীয় ধারণা অনুযায়ী স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণি উদ্ভবের দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমটি হল — বৃহদায়তন শিল্পবিকাশ ও সঞ্চয়ন; এবং দ্বিতীয়টি হল— দেশীয় বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ। কমঃ লেনিন রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরল পণ্য উত্পাদন (simple commodity production) থেকে শুরু করে প্রাথমিক পুঁজিবাদী উত্পাদন (capitalist enterprise) হয়ে বৃহৎ পুঁজিবাদী শিল্প (large scale industry)— তৈরী হওয়ার একটি মডেল রাশিয়ার ক্ষেত্রে বর্ণনা করেছিলেন।(৩০) ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সময়ে ক্ষুদ্রশিল্প থেকে ক্রমে বৃহৎশিল্প বিকশিত হওয়ায় এটি একটি নির্দিষ্ট মডেল। কিন্তু ঐরকম একটি মডেল ভারতের ক্ষেত্রে অচল- কারণ, প্রথমতঃ, ভারত ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকায় প্রতিযোগিতা এবং শ্রেণিবিভাজনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে এখানে পুঁজির সঞ্চয়ন সম্ভব ছিল না। ভারতীয় পুঁজিবাদের প্রথম পদক্ষেপ যেগুলো হতে পারতো যথা মুঘল আমলের ছোটখাটো হস্তশিল্প বা উত্পাদনশিল্পগুলিকে ব্রিটিশরা নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিনষ্ট করেছিল।(৩১) দ্বিতীয়তঃ, যেহেতু ভারতীয় শিল্প বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে পুঁজিবাদ আন্তর্জাতিকভাবে অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ অতিক্রম করে একচেটিয়ায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল, তাই ঘরোয়া বাজারে প্রতিযোগিতা অসম্ভব ছিল এবং যেকোনো বড়শিল্প স্থাপনের জন্য বৃহৎপুঁজির একান্ত প্রয়োজন ছিল। (এখানে সপ্তদশ শতকের ইউরোপের মতো কোনো স্বাধীন ইওমান কৃষকের অস্তিত্ব কোনভাবেই সম্ভব ছিল না যে নিজের জমি বেচে দিয়ে সেই পুঁজিতে একটা ছোটখাটো পুজিবাদী উত্পাদনের জন্ম দিতে পারে) আর এই পুঁজিলাভের জন্যই ভারতীয় বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের কাছে হাত পাততে হত। কিন্তু এই সঞ্চয়ন হয়ে যাওয়ার পর এবং ১৯১৪-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থা পেয়ে ভারতীয় পুঁজিপতিরা ঘরোয়া বাজারের জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সাথে সংঘাত শুরু করল যা ১৯১৪-১৯৪৭ পর্যন্ত এই শ্রেণির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই সংঘাত-সংগ্রামে কিন্তু ভারতীয় বুর্জোয়ারা তাদের নিজস্ব শ্রেণি নিয়মের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা কখনোই বুর্জোয়াশ্রেণির (তা সে মুৎসুদ্দী হোক বা জাতীয় অথবা নির্ভরশীল যাই হোক) তরফ থেকে শ্রমিকশ্রেণির তুল্য কোনো সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী সংগ্রাম আশা করতে পারি না। ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে তারা একদিকে কখনই জাতীয় বুর্জোয়াদের মতন শ্রমিক-কৃষকের সাথে যৌথ বিপ্লবী ফ্রন্ট গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি অন্যদিকে তারা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের মতন যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রশ্নে কোনো নির্দিষ্ট ‘প্রভু’ সাম্রাজ্যবাদী দেশের পদলেহন করে যাননি।(৩২) তারা দেশীয় বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করার লক্ষ্যে ‘স্বাধীনতা’র জন্য দর-কষাকষি করেছেন। তারা নিজস্ব শ্রেনিস্বার্থেই বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। পাশাপাশি, ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণি জনগণের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী গণআন্দোলনে বারংবার সমঝোতাকারীর ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই গণআন্দোলনগুলির বিপ্লবী সম্ভাবনাকে ভোঁতা করে দিয়ে সরকারের সাথে নিজেদের স্বার্থে সুবিধাজনক ধরনের সমঝোতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। একদিকে তারা বিভিন্ন প্রশ্নে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করেছেন নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে অন্যদিকে আবার তারা বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের উপর নির্ভর থেকেছেন শ্রেণি হিসেবে নিজেদের বিকশিত করার প্রয়োজনে। সুতরাং লেনিন বর্ণিত পুঁজিবাদ বিকাশের নির্দিষ্ট মডেল এর সঙ্গে না মিললেই এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগের দৃষ্টান্ত থাকলেই ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণিকে মুৎসুদ্দি হিসেবে আখ্যায়িত করে দেওয়ার কোন যুক্তি নেই। কিন্তু ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণি তাদের বিকাশের সমগ্র পর্যায় জুড়ে একবারের জন্যও চীন বা কোরিয়ার জাতীয় বুর্জোয়া অংশের মতন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে লড়াই চালায়নি। তারা নিজেদের বিকাশের লক্ষ্যে প্রযুক্তি ও পুঁজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল থেকেছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী দেশের উপর নয়। ভারতীয় বুর্জোয়াদের মুৎসুদ্দি প্রমান করার জন্য বেশ কিছু তাত্বিক বিদেশী প্রযুক্তির উপর তাদের নির্ভরশীলতার উদাহরণ দেন। কিন্তু খোদ ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রযুক্তি জার্মানি-ফ্রান্স সহ গোটা পশ্চিম ইউরোপে রফতানি হয়েছে এবং এইসব দেশের পুঁজিবাদী বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।(৩৩) কিন্তু সে কারণে নিশ্চয়ই সমগ্র ইউরোপের বুর্জোয়ারা ব্রিটেনের মুৎসুদ্দিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি।
আসলে ভারতবর্ষের নিজস্ব কিছু আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলোও ভারতীয় বুর্জোয়াদের এই বিশেষ ধরনের বিকাশের জন্য দায়ী। ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে ভারতবর্ষে এক জোরালো রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠেছিল, যেই রাষ্ট্রকাঠামো এদেশের সুবিশাল দেশীয় বাজার নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। দেশীয় বাজারের এই ধরনের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণিকে অন্যান্য আধা ঔপনিবেশিক-ঔপনিবেশিক দেশের তুলনায় অনেক দৃঢ়ভাবে সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিল। চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহ কেউই ঠিক এইরকম ছিল না।১৯৪৯-এর বিপ্লবের পূর্বে চীন বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের সরাসরি উপনিবেশিক অঞ্চল এবং বিভিন্ন সমরনায়কদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিছু আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকাঠামোর কোনো ছবি সেখানে ছিল না। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি স্বাধীনতা অর্জন করে উনবিংশ শতকেই। কোনো একটি দেশের শ্রেণিগঠন ও শ্রেণিসংগ্রামে সেদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর যে কী গভীর ভূমিকা থাকে তা ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদের উত্থানের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়। কেন ইউরোপে সমস্ত দেশ বাদ দিয়ে ইংল্যান্ডেই পুঁজিবাদের প্রথম উত্থান হল তার উত্তর কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে তত্কালীন ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রকাঠামো এবং এই রাষ্ট্রকাঠামোয় বিভিন্ন শ্রেণির শক্তির ভারসাম্যের মধ্যে।(৩৪) সুতরাং ভারতীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর এই বিশেষত্ব যে ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণির বিশেষ বিকাশের একটি কারণ তা এককথায় অনস্বীকার্য। আরো একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যুদ্ধ ছাড়াই বিকাশ লাভের সুযোগ করে দিয়েছিল। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাটি হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন। এর ফলে একদিকে যেমন কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় পুঁজিপতিরা প্রাক-স্বাধীনতা পর্যায়ে ভারতীয় বাজারকে দেশীয় বাজারের মতন ব্যবহার করেছে অন্যদিকে নিজেদের প্রয়োজনে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার আপাত স্বাধীনতা পেয়েছে। সুতরাং এই সমস্ত বিশেষত্ব মাথায় রেখেই আমাদের ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির ক্রমবিকাশকে বুঝতে হবে। এবার দেখা যাক বিকাশের প্রথম পর্বে ভারতীয় পুঁজিবাদীদের যাত্রাপথ।
প্রাক্ বিশ্বযুদ্ধ পর্বে শিল্পবিকাশ : প্রাথমিক সঞ্চয়নের সময়কাল
১৮৫০ সালের পূর্বে কিছু বিদেশীদের স্থাপিত কিছু বস্ত্রবয়ন শিল্প ও আটাচাকী বাদ দিলে ভারতে প্রায় কোনো শিল্পোদ্যোগ ছিল না। বিদেশী পুঁজির সহায়তায় পার্সীরা বোম্বেতে প্রথম বস্ত্র-শিল্প স্থাপন করে এবং এটাই ছিল ভারতে শিল্প স্থাপনের প্রথম প্রয়াস। “ব্রিটিশ মডেলকে দ্রুত অনুসরণ করে পার্সীরা প্রথম পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং পরে হিন্দু দালাল আর মহাজনরা তাদের অনুসরণ করেছিলো”। (৩৫) কিন্তু অল্পকিছুদিনেই ভারতীয় উদ্যোগে ব্রিটিশ সহযোগিতায় স্থাপিত এই শিল্প ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় যখন মূল্যবৃদ্ধির জন্য ইউরোপে তুলা রপ্তানি কমে যায়, তখন পার্সীরা বিপুল পরিমাণে ফাটকা পুঁজি লাভ করে। পরবর্তীতে তারা এই বিপুল অর্থ বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ করে ক্রমে বোম্বের বস্ত্রশিল্পে অগ্রণী হয়ে ওঠে। শিল্প কমিশনের বক্তব্যে এই তথ্য স্পষ্টতই ধরা পড়ে—
“১৯১৬-১৯১৮ সালে ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমিশন যেভাবে চিহ্নিত করেছিল যে, সুতাকল শিল্পের ক্ষেত্রে পুঁজির বেশিরভাগ পরিমাণটাই এসেছিল চীনে আফিম ব্যবসায় লাভ থেকে এবং ফুলেফেঁপে ওঠা তুলোব্যবসা বম্বেতে যে পুঁজির সমাগম ঘটিয়েছিল, তা থেকে।’’ (৩৬)
সুতরাং এইভাবে ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের মতন প্রতিযোগিতামূলক সঞ্চয়নের দীর্ঘ পথ যাত্রা না করেই মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীর মতন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ব্যবসার মাধ্যমে ভারতীয় বণিকেরা এক বিরাট অঙ্কের প্রাথমিক-পুঁজি জোগাড় করে ফেলে। এই পুঁজির সাহায্যেই প্রথম ভারতীয় মালিকানায় প্রথম বৃহৎ শিল্প স্থাপিত হয়। অর্থাৎ লেনিন বর্ণিত বৃহৎ শিল্পস্থাপনের পূর্বোক্ত মডেলের থেকে আলাদা ভাবেই ভারতে বৃহৎ শিল্প স্থাপন হয়। এই কারণে কোনো কোনো তাত্ত্বিক এই মুৎসুদ্দি ‘ব্যবসার’ উপায়ে অর্জিত পুঁজির ‘পবিত্রতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন কিন্তু স্বয়ং মার্কস নিজেই পুঁজি গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে বলেছেন,
“এর ফলে, ধারাবাহিকভাবে, একটি তিন ধরনের উত্ক্রমণ প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমত, বণিকরা প্রত্যক্ষভাবে শিল্প পুঁজিপতিতে পরিণত হল। কারুশিল্পভিত্তিক ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা সত্যি, বিশেষত, বিলাসদ্রব্য উত্পাদনকারী কারুশিল্প মারফত এবং বণিকদের দ্বারা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কাঁচামাল ও শ্রমিক মারফত…”।
সুতরাং মার্কসের ধারণানুযায়ী একজন বণিক সরাসরি ব্যবসার মাধ্যমেই অর্জিত পুঁজির দ্বারা শিল্পপতি হয়ে যেতে পারে তা সেই ব্যবসা যেরকমই হোক না কেন।(৩৭) শিল্পবিকাশের এই প্রথম যুগে বস্ত্রশিল্প বেশ দ্রুতগতিতে বিকশিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে ১৮৮২ সালে বিদেশী বস্ত্রের উপর আমদানি কর ছাড় ও ১৮৯৬ সালে ভারতীয় বস্ত্রের উপর কর ধার্য করা হয় কিন্তু তদসত্ত্বেও ঐ গতি বজায় থাকে। ১৮৮২-১৮৯২ সালের মধ্যে কারখানার সংখ্যা ৬২ থেকে ১২৭ হয় এবং উত্পাদন দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং ১৮৯০ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় তা প্রায় চারগুণ হয়ে যায়।(৩৮) প্রথমে ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা না থাকলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় পুঁজিবাদীরা যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে প্রতিযোগিতাও বাড়তে থাকে। এই প্রতিযোগিতার ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ল্যাঙ্কাশায়ারের পুঁজিবাদীরা শ্রম আইন ভঙ্গের জন্য ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে আর্জি জানায়। তারা ব্রিটিশ সরকারকে ভারতীয় বস্ত্রের উপর উঁচুদরে কর বসানোর জন্য চাপ দেয়।(৩৯) কিন্তু ভারতীয় বস্ত্রশিল্প সেইসময় ব্রিটিশদের কর্তৃক পরিচালিত বস্ত্রশিল্পের মেশিন ও উপকরণের শিল্পের মূল খদ্দের ছিল বলে তাদের সেই চাপপ্রদান ব্যর্থ হয়ে যায়। টমলিনসনের মতে,
“ব্রিটিশ কারিগরি পণ্যের বাজার হিসেবে ভারতের গুরুত্ব একটি বিভাগ হতে আরেক বিভাগে পরিবর্তিত হয়… বস্ত্রশিল্পের যন্ত্রপাতির বাজার হিসেবে ভারতের বাজার এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ক্ষেত্রটি হলো একটিমাত্র ক্ষেত্র যেখানে ব্রিটিশ উত্পাদক সারা বিশ্ব জুড়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে এবং ১৯১৩ সালে ব্রিটেনের সাধারণ কারিগরী পণ্যের সমগ্র রপ্তানির যে মূল্য তার প্রায় এক চতুর্থাংশ এই ক্ষেত্র থেকে আসে….”।
তাই সেই মেশিন উত্পাদনকারী পুঁজিবাদীদের পাল্টা চাপে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিকাশ অব্যাহত থাকে। ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে এই জটিল ও বিশেষ ধরণের শ্রেণি-প্রক্রিয়াটি লক্ষ্য করার মতো। যদিও ভারতীয় বস্ত্রশিল্পপতিদের সাথে ল্যাঙ্কাশায়ারের পুঁজিপতিদের প্রতিযোগিতা-সংঘাত ছিলো কিন্তু এই ল্যাঙ্কাশায়ারএর শিল্পপতিরা ভারতীয় বস্ত্র শিল্পের বিকাশ আটকাতে পারেননি কারণ ভারতীয় বস্ত্রশিল্প আবার ব্রিটিশ টেক্সটাইল মেশিনারি শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই ধরণের নির্ভরশীলতা ও প্রতিযোগিতার জটিল সমাহার একমাত্র ভারতের মত দেশেই সম্ভব যেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রায় ২০০ বছর ধরে বজায় ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যাবতীয় ঐতিহাসিক আনুকূল্যের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বস্ত্রবয়নশিল্প নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশীয় বাজারের সম্পূর্ণ দখল পেয়ে ভারতীয় পুঁজিবাদীরা পরবর্তীকালে তাদের স্বার্থবিরোধী ওটাওয়া চুক্তি, বোম্বে-ল্যাঙ্কাশায়ার চুক্তি ইত্যাদির বিরোধিতা করে ঔপনিবেশিক সরকারের সাথে সংঘাতে যান। (৪০)
এই প্রাথমিক বিকাশের যুগে সাম্রাজ্যবাদীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সুযোগে আরেকটি যে শিল্প গড়ে উঠেছিল সেটি হল লৌহ-ইস্পাত শিল্প। বস্তুত ’১৮৯০-এর দশকেই আমেরিকা ও জার্মানী লৌহ-ইস্পাত শিল্পে ব্রিটেনের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। ১৮৯৫-৯৬ নাগাদ বেলজিয়ামও এই শিল্পে ব্রিটেনকে ছাপিয়ে চলে যায়। এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই জার্মান ও মার্কিন লৌহ-ইস্পাত শিল্প ব্রিটিশ বাজারেরও দখল নিয়ে নেয়। নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া ব্রিটিশ শিল্পপতিরা এর কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারেনি।(৪১) এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার জে.এন. টাটাকে ইস্পাত শিল্পগঠনে এগিয়ে আসতে বলেন। টাটা প্রথমে বিদেশী সাহায্য চাইলেও সেই সময়ে লন্ডনের শেয়ার বাজার আর্থিক মন্দায় ভুগছিল। এই কারণে টাটা শিল্পস্থাপনের জন্য গোয়ালিয়ারের রাজার মত সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নেন।(৪২) এই ঘটনা টাটাকে ব্রিটিশদের থেকে একটা আংশিক স্বাধীনতা দিল এবং তিনি ব্রিটিশদের ‘বাণিজ্যিক শত্রু’ আমেরিকার থেকে এই শিল্পের সমস্ত মেশিন ও প্রযুক্তিসামগ্রী কিনলেন। আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের সাহায্যেই টিস্কো (TISCO) ১৯১২ সাল থেকে পিগআয়রন নির্মাণ শুরু করল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বাজারের জন্য টাটা গোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবেই ব্রিটিশের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯০৫ সালে টাটার থেকে বার্ষিক ২০,০০০ টন ইস্পাত কিনবে বলে ব্রিটিশ সরকার ১০ বছরের জন্য চুক্তি করে। এর সিংহভাগই কিনত ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত ভারতীয় রেল বোর্ড। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইস্পাতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্প টাটার হাতে বিপুল পুঁজি এনে দিল এবং তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ অতিক্রম করে নতুন বাজারের সন্ধান পেল। ১৯১৬ সালে টিস্কো-র উত্পাদন ৫০শতাংশ বেড়ে যায় এবং তারা জাপানে ইস্পাত রপ্তানি শুরু করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই পর্বে টাটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নিজেদের নির্ভরতার তথা ‘বিশ্বস্ততার’ চিহ্ন বজায় রেখে ‘অতি-মুনাফা’র সুযোগ ছেড়ে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় টিস্কো ও ব্রিটিশ সরকারের পারস্পরিক নির্ভরতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯১৯ সালে লর্ড চেমসফোর্ড এক বয়ানে স্পষ্ট করে বলেন —
“বিগত ৪ বছরে আমরা যা করেছি তা ভাবাই যেত না যদি টাটা কোম্পানি আমাদের শুধু মেসোপটেমিয়ার জন্যই নয়, এমনকি ইজিপ্ট, প্যালেস্টাইন এবং পূর্ব আফ্রিকার জন্য ইস্পাতরেল দিতে সক্ষম না হত”। (৪৩)
এই নির্ভরতা পরে আরও বেড়ে যায় কারণ ফ্রান্স, জার্মানী, বেলজিয়ামের মত ব্রিটেনের প্রতিযোগী দেশগুলি যুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠে ইস্পাত উত্পাদন প্রায় দ্বিগুণ করে তোলে, কিন্তু ব্রিটিশ ইস্পাতশিল্প তখনও মন্দায় ধুঁকছিল। সুতরাং এই প্রতিযোগিতার অবস্থায় টিস্কোই ছিলো ব্রিটিশ সরকারের একমাত্র ভরসার জায়গা এবং এর ফলে টাটা ব্রিটিশদের থেকে নিজস্ব দেশীয় বাজারের মতনই সুবিধা আদায় করে নেয়। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে ১৯২৪ সালে ভারতীয় বাজারে বিদেশী ইস্পাতের উপর ৩৫.৫% কর বসানো হয় এবং টিস্কো-কে ভর্তুকি দেওয়া শুরু হয়। ১৯২৭ সালে এতে কিছু পরিবর্তন হলেও টাটা দেশীয় বাজারের রাশ বেশ ভালোভাবেই ধরে রাখে। এই পারস্পরিক প্রয়োজনের কারণেই টাটার সঙ্গে ঔপনিবেশিক সরকারের কোনো সরাসরি সংঘাত হয়নি। বাস্তবত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই ব্রিটিশ সরকার টাটাকে দেশীয় বাজার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করে গেছে। এবং টাটাও কোনো সরাসরি সংঘাত ছাড়াই শুধুমাত্র দেশীয় বাজারই দখল করেনি বরং ব্রিটিশ সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে দর-কষাকষি করে বিশ্ব-বাজারে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছে। টাটার আদিম সঞ্চয়নের সময় সামন্তরাজাদের থেকে নেওয়া সাহায্যের প্রশ্নে আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন কমঃ মাও-এর ব্যাখ্যা—
“…জাতীয় বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রের সাথে লড়াই করতে মোটেই আগ্রহী নয় কেননা জমিদারশ্রেণির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।” (৪৪)
সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর নির্ভরশীল থেকেই টাটার বিকাশ হয়েছিল যা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির বিশেষ ধরণের বিকাশেরই অংশ।
লৌহ-ইস্পাতের পাশাপাশি টাটা-রা জলবিদ্যুত উত্পাদনও শুরু করে। এই সময়ে ভারতীয় পুঁজিপতিরা জাহাজ, সিমেন্ট, সার ইত্যাদি শিল্প গড়ে তোলে। যদিও সেগুলি সংখ্যায় স্বল্প ছিল, তবুও এগুলি ভারতে শিল্পবিকাশের সূচনা করে। তার বিশদ আলোচনা আমরা অন্য কোনো লেখায় তুলে ধরব। কিন্তু মূল কথা হল যে এই পর্বে এইসব সত্ত্বেও ভারতের বিপুল আয়তনের তুলনায় সার্বিক শিল্পস্থাপন খুবই কম ছিল। বাকি অন্যান্য সংগঠিত ক্ষেত্র যেমন পাট, চা, রাবার ইত্যাদিতেও ব্রিটিশ পুঁজিই প্রধান্যকারী জায়গায় ছিল। আমরা আপাতত এই পর্বের জন্য বস্ত্র ও লৌহ-ইস্পাত শিল্পে ভারতীয় পুঁজিপতিদের বিকাশের রাস্তাটি তুলে ধরলাম।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে এগুলিই ছিল ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মূল গতিপথ। কিন্তু অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ও আদর্শগত উপরিকাঠামোয় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বাস্তবত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদ কে ‘বিরোধিতা’ করে গড়ে উঠছিল। দাদাভাই নওরোজি, জি.ভি.জোশী, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে, জি.কে.গোখলের মত জাতীয়তাবাদী নেতারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে মতামত উপস্থিত করেন। এঁদের মধ্যে চিন্তার বিস্তর ফারাক থাকলেও একটি সুর সবার মধ্যে একই ছিল, তা হোলো— ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকবাদই হল ভারতের উন্নতির পথে মূল বাধা’। তাঁদের প্রতিটি লেখাতেই পুঁজিবাদী মানসিকতার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট এবংরুশ বিপ্লব-পূর্ববর্তী সেই সময়েই তাঁদের রচনায় সাম্যবাদ বিরোধিতা ছিল খুবই প্রখর। জোশীর কথাই ধরুন—
“…ভারতবর্ষে দারিদ্রের প্রধান কারণ কিন্তু সম্পদের অসম বন্টন নয়, যেমন পশ্চিমের কিছু দেশে রয়েছে…আমাদের পরিস্থিতি হলো একটু বিশিষ্ট ধরনের। এখানে একটি সমগ্র দেশ আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছে…”। (৪৫)
দাদাভাই নওরোজির ‘Drain Theory’’ খুব সুস্পষ্ট ভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাকে ভারতের দারিদ্রের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে এবং এই ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে রমেশচন্দ্র দত্ত এই তত্ত্বের আরও বিকাশ ঘটান।(৪৬) ১৯০৪ সালে আন্তর্জাতিক সোসালিস্ট কংগ্রেসে দাদাভাই স্পষ্টভাবে বলেন,
“…ভারতবর্ষের স্বায়ত্তশাসনের মধ্যেই সমাধানটি লুকিয়ে রয়েছে। ভারতীয়রা ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে কিন্তু তারা কখনই এই দাসসুলভ মনোভাবকে সহ্য করবে না…”
এই বক্তব্য ভারতের জাতীয়তাবাদী বৃত্তে খুবই আলোড়ন তৈরী করে। ১৯০৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বেনারস সম্মেলনে তিনি আবার একই বক্তব্য জোরের সাথে রাখেন,
“…স্বায়ত্তশাসন ব্যতিরেকে ভারতীয়রা কখনই এই ক্ষরণ এবং তারই ফল অনুসারে দারিদ্র, দুর্দশা ও ধ্বংসের হাত থেকে নিস্তার লাভ করবে না….শুধুমাত্র একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে মানুষের অংশগ্রহণ এই ক্ষরণ রোধ করতে সক্ষম….”। (৪৭)
সুতরাং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বরাজের দাবী তখন থেকেই জাতীয়তাবাদী মহলে প্রবল ছিল। প্রথম প্রথম ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় পুঁজিবাদীরা এই আন্দোলনকে মদত দেয়। এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ তৈরী হওয়া উদ্দীপনা ভারতীয় মালিকানায় বৃহৎশিল্প গঠনে ভূমিকা রাখে। যদিও এই সমস্ত ভারতীয় শিল্পোদ্যোগগুলি শেষ বিচারে সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের উপরই নির্ভরশীল ছিল।
পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে এই জাতীয়তাবাদী নেতাদের আদর্শগত প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুগভীর। বাস্তবত ব্রিটিশ শাসনে থাকাকালীন খনি, যানবাহন, বৃহৎশিল্প প্রভৃতি গঠনের মত প্রাথমিক দেশীয় পুঁজির যথেষ্ট অভাব ছিল। এখন এই অবস্থায় কীভাবে একদিকে বিদেশী পুঁজির আগ্রাসনকে রোখা যাবে আর অন্যদিকে শিল্প ও বানিজ্যের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যাবে-এই দুই ছিল প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির মূল প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তরও দাদাভাই এবং জোশী দেন অনেক আগেই— তাদের দাবি ছিল, একটি জাতীয় সরকার গঠন করে তার নেতৃত্বে খনি, বৃহৎশিল্পগুলি, পরিবহনের জাতীয়করণ করতে হবে। তাঁরা আসলে একটি ‘স্বল্পস্থায়ী রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ চেয়েছিলেন যা ভারতের উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণিকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য খানিকটা সময় দেবে।(৪৮) এর সঙ্গে আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মিলিয়ে দেখতে পারেন ৫০ বছর পরবর্তী ‘বোম্বে প্ল্যান’ ও স্বাধীন ভারতের নীতির মিলগুলি। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে ‘বোম্বে প্ল্যান’ ও স্বাধীন ভারতের প্রথমদিকের আর্থিক নীতিগুলি তাঁদের সেই সমাধানগুলিকেই একটু অদলবদল করে পেশ করে। এতটাই ছিল ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণির উপর এই নেতাদের আদর্শগত প্রভাব।
সুতরাং সারাংশে বলা যায় যে, এই প্রাক-বিশ্বযুদ্ধকালেই ভারতীয় বুর্জোয়াদের বিকাশের অর্থনৈতিক ও আদর্শগত ভিত্তি তৈরী হয়ে উঠেছিল। এই বিশেষ ধরণের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই ভারতে বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশের যাত্রা শুরু হয়।
শিল্পবিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় : ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতালাভের কালপর্ব
১৯১৪-১৯৪৭-র মধ্যে বিশ্ব রাজনীতির বিরাট ও দ্রুত পটপরিবর্তন ভারতীয় বুর্জোয়াদের দেশীয় বাজারের সম্পূর্ণ দখল নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় এনে দিল। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং ’৩০-এর বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্প ও ব্যবসার চেনা ছকগুলো পাল্টে দিল। এখন আমরা এই পর্বে ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
১) এই পর্যায়কালটিতে আন্তর্জাতিক বানিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের অংশগ্রহণএর চরিত্রটির আমূল পরিবর্তন ঘটলো, সাথে সাথে বদলে গেলো বানিজ্যের উপকরণ সামগ্রীও। ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে ভারত ছিলো ব্রিটিশ শিল্প-সামগ্রীর এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। কিন্তু এই পর্বের মধ্যে দিয়ে খুব ধীরেধীরে ভারত তার বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য উত্পাদনেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।(৪৯) এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার বেশির ভাগটাই ছিল দেশীয় পুঁজির নিয়ন্ত্রাধীন।(৫০) প্রথম পর্বে ভারত মূলতঃ তুলা, পাট, চা, চামড়া, বাদাম ইত্যাদি রপ্তানী করত। ১৯৩০-এর দশকের মন্দার সময়ে এগুলির রফতানি অর্থনীতি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে ১৯৩৬ সালে এসে শুধুমাত্র চা ও চামড়াই রফতানি দ্রব্যের তালিকায় টিকে থাকে। প্রথম দিকের আমদানীর বস্তু গুলো ছিল সুতো, চিনি, সাবান, সিমেন্ট, ইস্পাত, কেরোসিন, দেশলাই ইত্যাদি। ১৯২০ সাল পর্যন্ত আমদানির চরিত্র একই রকম থাকলেও ১৯৩০-এ তা ব্যাপক ধাক্কা খায় এবং আমদানি উপকরণের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তনও আসে। ১৯২৫-২৬ সাল নাগাদ ভারতের আমদানীর ৫৪ শতাংশ ছিল ভোগ্যপণ্য (খাদ্য, চা, তামাক, কাগজ, বস্ত্র, যানবাহন), ১৫.৬ শতাংশ কাঁচামাল (রাবার, রেশম, উল, আঠা, কাঠ, রেসিন, তেল, রঞ্জকপদার্থ) এবং ২৩.২শতাংশ পুঁজিদ্রব্য (capital goods) (যথা— বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মেশিন)। ১৯৩১-৩২ সালে এগুলি যথাক্রমে ৫১.৬ শতাংশ, ২৩.৪ শতাংশ ও ২১.৭ শতাংশ ছিল; ১৯৩৮-৩৯ সালে হয় যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ, ২৮.৮ শতাংশ ও ২৬.৯ শতাংশ।(৫১) সুতরাং শিল্পায়নের এই পর্বে একদিকে প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যাপক অর্থে হ্রাস পায় অন্যদিকে মাঝারি কিছু ভোগ্যপণ্য ও পুঁজিদ্রব্যের আমদানি বিভিন্ন শিল্পে যেমন বস্ত্র, লৌহ-ইস্পাত,সাবান, চিনি, সিমেন্ট, রঞ্জকপদার্থ, কাগজ, কাঁচ, সালফিউরিক এসিড প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়।
এক কথায় বলতে গেলে মোট আমদানীর পরিমাণ ক্রমাগত কমছিল এবং সেই সঙ্গে রপ্তানীতে উত্পাদিত মালের পরিমাণ বাড়ছিল। একই সাথে রফতানিতে কাঁচামালের পরিমাণ কমে এবং আমদানিতে শিল্পপণ্য ও কাঁচামালের পরিমাণ বেড়ে যায়। সুতরাং যুদ্ধ এবং ১৯৩০-এর মন্দা ভারতীয় অর্থনীতিকে অনেকটাই পাল্টে দিল এবং ১৯৪৫-এ এসে ভারত পৃথিবীর দশম বৃহত্তম উত্পাদক হয়ে উঠলো।(৫২) এর অর্থ মোটেই এটা নয় যে সেই সময় ভারত খুবই প্রাচুর্যময় এবং শিল্পোন্নত দেশ হয়ে উঠেছিল। এমনকি ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারতের মাথাপিছু উত্পাদন ছিলো মিশরের ১/৪ ভাগ এবং মেক্সিকোর ১/১০ ভাগ।(৫৩) কিন্তু এই মাথাপিছু তথ্য দিয়ে ভারতীয় বুর্জোয়াদের দেশীয় বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ মোটেই পরিমাপ করা যায় না। ভারতীয় বুর্জোয়ারা দেশীয় বাজারে এই কালপর্বে আধিপত্য ভোগ করত এবং ভারতের পশ্চাদপদতা সত্ত্বেও তার বিরাট বাজার এবং বিপুল জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী বাজারে দরাদরি করবার ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু পুঁজিদ্রব্য ও প্রযুক্তির জন্য তখনও তারা প্রধানত বিবিধ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপরই নির্ভরশীল ছিলো। এগুলোই হচ্ছে ভারতবর্ষের বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশের বিশেষত্ব। আসলে আমাদের মনে রাখা উচিত যে অর্থনীতির অসম বিকাশ, বৈষম্য,ভঙ্গুরতা,দুর্বলতা এগুলো আসলে পুঁজিবাদেরই একটি সাধারণ লক্ষণ।(৫৪) ভারতীয় অর্থনীতির এই অসম বিকাশ তথা দুর্বলতার কারণ তার মুৎসুদ্দি চরিত্র নয়, বরঞ্চ ভারতের বিশেষ ধরণের বিকৃত পুঁজিবাদী বিকাশের ফলেই এই বৈষম্য ও দুর্বলতা তৈরী হয়েছে। আর বিকৃতির মূল কারণ হল, ইউরোপের পথে আভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে ভারতের পুঁজিবাদী বিকাশ না হয়ে তা হয়েছে একচেটিয়া পুঁজির আমলে।
২) আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই পর্বে শিল্পগুলির অন্তর্মুখি চরিত্র তৈরী হওয়া অর্থাৎ তারা মূলতঃ দেশীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উত্পাদন করতে শুরু করে। এর পিছনে দু’টি কারণ ছিল। প্রথমতঃ পাটের মত রপ্তানি নির্ভর শিল্পগুলি অর্থনৈতিক স্থবিরতায় ভুগছিল। দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য দেশীয় শিল্পগুলির জন্য নতুন নতুন কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছিল যেগুলো মূলতঃ দেশীয় বাজারের জন্যই উত্পাদন করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেমন যখন বোম্বেতে প্রথম দিকে তৈরী হওয়া বস্ত্রবয়ন শিল্পগুলি সুদূর প্রাচ্যে রপ্তানি করছিল, তখন সদ্য স্থাপিত আমেদাবাদ, কানপুর, কোয়ম্বুত্তুরের কারখানগুলি ঘরোয়া বাজারের জন্য উত্পাদন করছিল।(৫৫) এই কালপর্বে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৯২০-৩৯-এর মধ্যে এই বাণিজ্যে চিনির ব্যবসা প্রায় ৩ গুণ এবং ইস্পাত, বস্ত্র এবং সিমেন্ট ২ গুণ বৃদ্ধি পায়।(৫৬)
সারণী ১
কিছু সামগ্রীর বাণিজ্য : সমুদ্রপথে ব্রিটিশ ভারতে আমদানি
সামগ্রী
|
একক
|
১৯২০-২১
|
১৯২৪-২৫
|
১৯২৮-২৯
|
১৯৩২-৩৩
|
১৯৩৬-৩৭
|
১৯৪০-৪১
|
১৯৪৪-৪৫
|
সুতির সামগ্রী পিস হিসেবে | মিল ইয়ার্ড (গজ) | ১,৫১০ | ১,৮২৩ | ১,৯৩৭ | ১,২২৫ | ৭৬৪ | ৪৪৭ | ৫ |
লক্ষ টাকা | ৮৩,৭৮ | ৬৯,৪২ | ৫৩,৮১ | ২১,২৬ | ১৩,৩৭ | ৮,০৮ | ৩২ | |
লৌহ ও ইস্পাত | টন (’০০০) | ৭১২ | ৮৬৯ | ১,১৭০ | ৩২৬ | ৩৬৩ | ১৮৩ | ৮৭ |
লক্ষ টাকা | ৩১,২৯ | ১৮,৯৩ | ২০,২৪ | ৫,৩০ | ৫,৯৪ | ৬,৮৩ | ৩,৬০ | |
চিনি | টন (’০০০) | ৩৪৪ | ৭২৮ | ৯৩৭ | ৪০২ | ২৩ | ১৯ | … |
লক্ষ টাকা | ১৮,৫০ | ২০,৬৭ | ১৬,০৯ | ৪,২৩ | ২৪ | ৩৬ | … | |
সাবান | সেন্টামওয়েট (’০০০) | ৩১৩ | ৩৬১ | ৪০৬ | ২৯৬ | ৪৮ | ২৫ | ৩ |
লক্ষ টাকা | ১,৪১ | ১,৩২ | ১,৫৮ | ৮৩ | ২৭ | ১৮ | ২ | |
দেশলাই | মোট বাক্স (’০০০) | ১২,৩৯৯ | ৭,২৬৫ | ১,৫৩২ | ৫৭ | ৫৫ | ১,৯২০ | … |
লক্ষ টাকা | ১,৬৭ | ৮৯ | ১৭ | ১ | … | ৩৬ | … | |
সিমেন্ট | টন (’০০০) | ১৩১ | ১১৪ | ১২৭ | ৮৩ | ৫১ | ৫ | … |
লক্ষ টাকা | ১,৩৯ | ৬৯ | ৬৮ | ২৯ | ১৯ | ৫ | ১ | |
রঞ্জক (আল-কাতরা থেকে) | পাউন্ড. (’০০০) | ১০,৬৩০ | ১৮,৭১২ | ১৯,৫৯১ | ১২,৯৫৭ | ১৬,৯৪৯ | ১৩,৩৩০ | ৮,৮১১ |
লক্ষ টাকা | ৩,৩৭ | ২,৫৬ | ২,২৮ | ২,১৭ | ২,৬১ | ৪,৫৫ | ৬,৪১ | |
ইলেক্ট্রিক তার | লক্ষ টাকা | ১,২২ | ৬৭ | ৯৯ | ৫৯ | ৯৪ | ১,০২ | ১,২০ |
মদ | গ্যালন (’০০০) | ৫,৭৪৫ | ৫,৩২০ | ৬,৭৯০ | ৫,৪১৫ | ৫,০৬৯ | ৩,৯৬৫ | ১,০০৫ |
লক্ষ টাকা | ৪,৯০ | ৩,২৮ | ৩,৫৭ | ২,২৬ | ২,৪০ | ১,৯৯ | ১,৪৭ | |
মেশিন | লক্ষ টাকা | ২২,৩৮ | ১৪,৭৪ | ১৮,৩৬ | ১০,৫৪ | ১৪,১৪ | ১১,১৫ | ১৫,১৫ |
কেরোসিন তেল | গ্যালন (’০০০) | ৫৭,১৯২ | ৭১,৯৮০ | ১,০৪,৬৬০ | ৫৯,৪৯৪ | ৬২,২০৯ | ১,৭১,৮৮৩ | ৯৬,২২৩ |
লক্ষ টাকা | ৪,৩১ | ৪,৭৮ | ৫,৭৬ | ২,৫৪ | ১,৯৬ | ৭,৯৭ | ৬,৪৯ | |
কাগজ ও পিচবোর্ড | সেন্টাম ওয়েট (’০০০) | তথ্য নেই | ১,৬৯৯ | ২,৩১৩ | ২,৬৪০ | ৩,২০৩ | ২,১০৩ | ৬৭১ |
লক্ষ টাকা | ৭,৩০ | ৩,০৩ | ৩,৩০ | ২,৮৬ | ২,৮২ | ৩,৯৪ | ২,৬১ | |
কাঁচা তুলো | টন (’০০০) | ৯ | ২০ | ২৯ | ৮৫ | ৬৫ | ৮৯ | ৯০ |
লক্ষ টাকা | ১,৬৯ | ৪,২৫ | ৩,৯০ | ৭,২৬ | ৫,৮৫ | ৯,৪৩ | ২৪,০১ | |
কার্পাস সুতো ও অন্য সুতো | পাউন্ড (’০০০) | ৪৭,৩৩৩ | ৫৫,৯০৭ | ৪,৩৭,৬৬৬ | ৪৫,১০৩ | ২৮,৫২০ | ১৯,৩৩৫ | ১৯২ |
লক্ষ টাকা | ১৩,৫৮ | ৯,৬৬ | ৬,২৯ | ৩,৭৯ | ২,৫৫ | ২,১৮ | ৪ | |
মোটর গাড়ি | টি | ১৫,৪৩২ | ৯,৩৮০ | ১৯,৫৬৭ | ৬,২০১ | ১২,৯২৯ | ৫,০৫৮ | ১৩ |
লক্ষ টাকা | ৭,৮২ | ২,২০ | ৪,২১ | ১,২৯ | ২,৪৩ | ১,১৫ | ১ |
সারণী ২
কিছু সামগ্রীর বাণিজ্য : সমুদ্রপথে ব্রিটিশ ভারত থেকে রপ্তানি
দ্রব্য
|
একক
|
১৯২০-২১
|
১৯২৪-২৫
|
১৯২৮-২৯
|
১৯৩২-৩৩
|
১৯৩৬-৩৭
|
১৯৪০-৪১
|
১৯৪৪-৪৫
|
পাটের বস্তা | টি (মিলিয়ন হিসেবে) | ৫৩৪ | ৪২৫ | ৪৯৮ | ৪১৫ | ৫৬৭ | ৬৭৮ | ৩৮৭ |
লক্ষ টাকা | ২৩,৯১ | ২৩,২১ | ২৪,৯৩ | ১১,১৬ | ১২,০৯ | ২০,৩১ | ২৪,৫০ | |
কাপড় | গজ (মিলিয়ন) | ১৩৫৩ | ১৪৫৬ | ১,৫৬৮ | ১০১২ | ১৭০৮ | ১৫৪৬ | ১৩০৪ |
লক্ষ টাকা | ২৮,৫৪ | ২৮,২৮ | ৩১,৬৪ | ১০,২৪ | ১৫,৪৭ | ২৪,১৬ | ৩৪,৪৫ | |
তিসি | টন (’০০০) | ১৮৮ | ৩৭১ | ১৫৭ | ৭২ | ২৯৬ | ২৩৮ | ৯২ |
লক্ষ টাকা | ৬,১৪ | ৯,৭৪ | ৩,৩১ | ৯১ | ৪,৩৬ | ৩,৬৯ | ২,৭৪ | |
কাঁচা চামড়া* | টন (’০০০) | ৩০ | ৪৫ | ৬০ | ২৭ | ৪৩ | ২৭ | ১২ |
লক্ষ টাকা | ৫,২৪ | ৬,৭৩ | ৯,৪৭ | ২,৭৬ | ৪,৩৫ | ৩,০৮ | ৩,৯৫ | |
ম্যাঙ্গানিজ আকরিক | টন (’০০০) | ৭৮০ | ৬৩৯ | ৬৮১ | ১৯৮ | ৬৭৭ | ৫১০ | ১৫৭ |
লক্ষ টাকা | ১,৭৮ | ১,৬২ | ১,৯৭ | ৪৮ | ১,৩১ | ১,৪৭ | ৫৩ | |
অভ্র | সেন্টামওয়েট (’০০০) | ৭১ | ৮২ | ৯৬ | ৪০ | ১৮০ | ১৩৯ | ৭৭ |
লক্ষ টাকা | ১,০১ | ১,০৩ | ৯০ | ৩২ | ৯৪ | ১,৪৭ | ৫৩ | |
চা | পাউন্ড. মিলিয়ন | ২৮৫ | ৩৪০ | ৩৬০ | ৩৭৯ | ৩০২ | ৩৪৯ | ৪১৫ |
লক্ষ টাকা | ১২,১৫ | ৩৩,৩৯ | ২৬,৬০ | ১৭,১৫ | ২০,০৪ | ২৭,৭৯ | ৩৮,১২ | |
লাক্ষা | সেন্টামওয়েট মিলিয়ন | ৩০৯ | ৪২৭ | ৭৪৩ | ৪১৮ | ৮৩৪ | ৫৯৪ | ৪৩৮ |
লক্ষ টাকা | ৭,৫৮ | ৭,৫৫ | ৮,৬৪ | ১,২৪ | ২,৩৪ | ২,২৫ | ৪,৩২ |
সারণী ৩
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যসামগ্রীর ভারতে (ব্রহ্মদেশ ব্যতীত) আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য*
দ্রব্য | ১৯২০-২১ | ১৯৩৩-৩৪ | ১৯৩৫-৩৬ | ১৯৩৭-৩৮ | ১৯৩৯-৪০ | ১৯৪১-৪২ | ১৯৪৩-৪৪ |
গম | ৩৪,৯২৩ | ১৯,৭০২ | ২২,১৯২ | ৩২,৫৬২ | ২৭,৫০২ | ২৯৯০৫ | ২৪৯৭৯ |
চিনি (গুড় ব্যতীত) | ৫,১৫৯ | ১৭,১৫০ | ১৮,০৩১ | ২৩,১৪৯ | ১৫,৬৫২ | ২৪,৯০৭ | ১৭,০৭৯ |
সিমেন্ট | তথ্য নেই | ১২৩১১ | ১৭৭৬৮ | ২২,৭৪২ | ২৫৬৩৮ | ৩৩৯৩২ | ২২২৯০ |
তুলো পিস হিসেবে | ৫,৯৫৩ | ৯,৪৪১ | ১০,১৩২ | ১১,১৯০ | ১১,২৯৪ | ১১,৪৪৪ | ১১,০০৪ |
কয়লা এবং কোক কয়লা | ৩,৭৩,১০০ | ৩৪৫৯৬৪ | ৩৮৬৭৯২ | ৪৬৪২৮৬ | ৪৯৬৫১৩ | ৪৯৪২৪৪ | ৪৪০৭৫৯ |
লৌহ ও ইস্পাতের বার, পাত, গার্ডার এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য | ২১,১৬৪ | ৩০,৩৯২ | ৪০,৫০৪ | ৩৮,৬৫৫ | ৪১৯৮৭ | ৩৮০৫১ | ২৮৮১৩ |
কাঁচা চামড়া | ১,৬১৭ | ২৬৯১ | ২৫০৬ | ২৯৭০ | ৩৩৮৩ | ৩৬৩৭ | ৩০৯৭ |
প্রক্রিয়াজাত চামড়া | ১১৩ | ৬৭৮ | ৬১২ | ৬১০ | ৮৬৯ | ৮৬৪ | ৫৩ |
* এই সংখ্যাতত্ত্ব প্রকাশ ১৯২২ সালে বন্ধ হয় এবং পুনরায় ১৯৩৩-এ শুরু হয়।
সারণী ৪
বন্দর বাণিজ্য : ব্রিটিশ ভারত (ব্রহ্মদেশ ব্যতীত) (লক্ষ টাকার হিসেবে)
বন্দর বাণিজ্য : ব্রিটিশ ভারত (ব্রহ্মদেশ ব্যতীত) (লক্ষ টাকার হিসেবে)
১৯৩৫-৩৬ | ১৯৩৭-৩৮ | ১৯৩৯-৪০ | ১৯৪১-৪২ | ১৯৪৩-৪৪ | ১৯৪৪-৪৫ | ||
পণ্যদ্রব্য | আমদানি | ৩৭,৬২ | ৪১,৬২ | ৩৪,৪৫ | ২৭,৮৬ | ৪১,১৭ | ৯৮,২৬ |
রপ্তানি | ৩৮,৭০ | ৪১,২৯ | ৩৪,৮৬ | ২৯,৪৫ | ৪৭,৩১ | ১,০২,৬৬ | |
বিদেশী পণ্যদ্রব্য | আমদানি | ৪,৮১ | ৫,৮৩ | ৫,২৫ | ৫,৩১ | ৬,৩৩ | ১১,০০ |
রপ্তানি | ৬,৪০ | ৭,৬৭ | ৭,১৬ | ৭,৫৩ | ১০,৮২ | ১২,৪৭ | |
মোট (বিদেশী এবং ভারতীয়) | আমদানি | ৪২,৪৪ | ৪৭,৪৫ | ৩৯,৭০ | ৩৩,১৭ | ৪৭,৫০ | ১,০৯,২৫ |
রপ্তানি | ৪৫,১০ | ৪৮,৯৬ | ৪২,০২ | ৩৬,৯৮ | ৫৮,১৩ | ১,১৫,০৭ |
source-S.Subramanian and P.W.R Homfray, “Recent Social and Economic Trends In India”(new delhi, 1946), pg-47-50
৩) এই কালপর্বে শিল্প বাদ দিয়ে অন্যান্য বিভাগ যেমন বানিজ্য, মহাজনী কারবার, জমিদারি ইত্যাদিতে একটা আপেক্ষিক স্থিরাবস্থা এসে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সরকার আমদানীর উপর কর বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল এবং এটা দেশীয় শিল্পকে ব্যাপক বিকাশের সুযোগ করে দেয়। সুতরাং সামন্ত এবং মহাজনেরা নবগঠিত শিল্পে বিনিয়োগ করে। টাটার ক্ষেত্রে যেমন গোয়ালিয়রের মহারাজ বিনিয়োগ করেছিলেন ঠিক তেমনই অনেক রাজাই একই পথের পথিক হন। (৫৭)
৪) ভারতে বিদেশী পুঁজির আগমনের অঙ্ককে আমাদের অনেক বিপ্লবী ঐতিহাসিকরা বাড়িয়ে বলেন। আসলে এই অঙ্কটা কখনই খুব বেশি ছিল না এবং শিল্পের ক্ষেত্রে বাস্তবিক তা নগণ্য ছিল অন্তত এই কালপর্বের জন্য। যদি আমরা শুধু পুঁজির ক্ষেত্রে দেখি তাহলে দেখব যে ১৯২০-র বৃদ্ধির পর এই আমদানি কমতে শুরু করে এবং ১৯৩০-এর মধ্যে বিদেশী পুঁজির বহিঃনির্গমন শুরু হয়ে যায়।(৫৮) ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ লেখক মাইকেল কির্দনের কথায়,
“১৯৩১ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরবর্তীতে বিদেশি পুঁজি ভারত ছাড়া শুরু করে।২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তার অব্যবহিত পরে, নির্দিষ্টভাবে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের পর্বে ও ১৯৪৬ সালের মে মাসে ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ার পর থেকে এবং শেষত ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ‘মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান’-এর মধ্যবর্তী পর্যায়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরিমাণে বেড়েছিল। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ব্রিটিশ পুঁজির ১৩৫০ কোটি টাকা জাহাজে করে বাইরে পাড়ি দিয়েছিল। এর মধ্যে ৭২০ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ছিল বেসরকারী ঋণ ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেওয়া বাবদ টাকা”।(৫৯)
শুধু আর্থিক ক্ষেত্রে নয়, খনি ও পাটের মত বিদেশী শিল্পও ভারতীয়দের দখলে চলে যায়। কির্দনের মতে
“ভারতীয় বিনিয়োগ বিদেশি নিয়ন্ত্রণের সাবেক ক্ষেত্রগুলিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল পর্যন্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মূলত উল্টে দিতে পারে নি; কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ মোটেই চূড়ান্ত ছিল না। ভারতীয় শেয়ারহোল্ডারদের চাপের ফলে তাদের মালিকানাস্বত্ব যে প্রভাব বিস্তারকারীতে রূপান্তরিত হয়েছিল তা সম্পূর্ণত অস্বীকার করা চলে না। ফলস্বরূপ, ভারতীয় ডিরেক্টরদের অনুপাত ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি জুট মিলগুলিতে ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫১ শতাংশে পরিণত হয়েছিল; গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি কয়লা কোম্পানিতে ৫ শতাংশ বেড়ে থেকে ৫৪ শতাংশে উঠেছিল; বিদেশি মালিকানাধীন চা বাগানে অল্প একটু বেশি সময়কালে ১৯২০ সাল থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশে উঠেছিল।” (৬০)
এটাই ছিল ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রের উপর বিদেশী দখলদারির বাস্তব চিত্র, এমনকি ব্রিটিশদের সবচেয়ে পছন্দের শিল্পগুলিতেও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের থেকে নেওয়া ব্রিটেনের ঋণ ১৯৪৬ সালে প্রায় ১৭০০ কোটি স্টারলিং-এ পৌঁছায়। ১৯৩৪-এ স্টারলিং ঋণ মোট জনঋণের ৪৩ শতাংশ হলেও, ১৯৪৫-এ তা মাত্র ৪ শতাংশ ছিল অর্থাৎ ৯৬ শতাংশ জনঋণ দেশের ভেতর থেকেই শোধ করা হয়েছিল। (৬১)
সারণী ৫
জাতীয় অর্থব্যবস্থা : সরকারি ঋণ (ব্রিটিশ ভারত)
জাতীয় অর্থব্যবস্থা : সরকারি ঋণ (ব্রিটিশ ভারত)
আর্থিক বছরের শেষে | কেন্দ্রীয় | প্রাদেশিক* | |||
(লক্ষ টাকা) | মোট (লক্ষ টাকা) | ||||
মোট (লক্ষ টাকা) | আভ্যন্তরীণ (লক্ষ টাকা) | বিদেশী পাউন্ড (’০০০) | |||
১৯২৭-২৮ | ৮,৭০,৯৭ | ৪,১,১৭৭ | ৩৪৪৩৯৬ | ১৬,৩৭ | ৮,৮৭,৩৪ |
১৯২৮-২৯ | ৯,০৫,০৬ | ৪,৩৩,৮৮ | ৩,৫৩,৩৮২ | ১৬,৩৬ | ৯,২১,৪২ |
১৯২৯-৩০ | ৯,৫৫,১৮ | ৪,৭০,৩৬ | ৩৬৩৬১২ | ১৬,৩৪ | ৯,৭১,৫২ |
১৯৩০-৩১ | ৯,৯৫,৭১ | ৪,৭৮,৫১ | ৩,৮৭,৯০০ | ১৬,৩২ | ১০,১২,০৩ |
১৯৩১-৩২ | ১০,৩৪,৭৬ | ৫,২৯,৩৮ | ৩৭৯০৩৫ | ১৬,২৯ | ১০,৫১,০৫ |
১৯৩২-৩৩ | ১০,১২,৬২ | ৫,০৮,৪৬ | ৩৭৮১১৬ | ১৪,৮০ | ১০,২৭,৪২ |
১৯৩৩-৩৪ | ১০,০৫,৪৫ | ৪,৯৪,৬৭ | ৩,৮৩,০৮৫ | ১৬,১৬ | ১০,২১,৬১ |
১৯৩৪-৩৫ | ১০,০৪,২৩ | ৪,৯২,৬৫ | ৩৮৩৬৮৮ | ১৬,১২ | ১০,২০,৩৫ |
১৯৩৫-৩৬ | ৯,৫৯,৯৬ | ৪,৫৮,৩১ | ৩,৭৬,২৩৩ | ৬,৭৮ | ৯,৬৬,৭৪ |
১৯৩৬-৩৭ | ৯,৪২,৮৩ | ৪,৬৬,৪২ | ৩,৫৭,৩০৭ | ৮,৭২ | ৯,৫১,৫৫ |
১৯৩৭-৩৮ | ৯,৪৪,৭২ | ৪,৭৬,৮৩ | ৩৫০৯২০ | ১২,৬৪ | ৯,৫৭,৩৬ |
১৯৩৮-৩৯ | ৯,৪৯,৭৭ | ৪,৮৪,৮৩ | ৩,৪৮,৭১২ | ১৬,৫৭ | ৯,৬৬,৩৪ |
১৯৩৯-৪০ | ৯,৪৪,৬২ | ৫,০৫,৫১ | ৩২৯৩২৮ | ২১,৪১ | ৯,৬৬,০৩ |
১৯৪০-৪১ | ১০,০৩,৩৭ | ৬,৬২,২৬ | ২,৫৫,৮৩৩ | ২৩,৮৫ | ১০,২৭,২২ |
১৯৪১-৪২ | ৯,৫৮,৭৯ | ৭,৫১,৮৬ | ১,৫৫,২০০ | ২৪,০৪ | ৯,৮২,৮৩ |
১৯৪২-৪৩ | ১১,০৪,৫৮ | ১০,১৬,৭০ | ৬৫,৯১২ | ৩২,০৭ | ১১,৩৬,৬৫ |
১৯৪৩-৪৪ | ১১,৯০,৫৭ | ১১,২২,২৯ | ৫১,২১০ | ৬৯,০৪ | ১২,৫৯,৬১ |
* খোলা বাজারে লোনের হিসেব
এই স্টারলিং উদ্বৃত্ত এবং লন্ডনের আর্থিক বাজার থেকে আপাত স্বাধীনতাকে ভারতীয় বুর্জোয়ারা খুশী মনে স্বাগত জানিয়েছিল। সেই সময়ের একজন অগ্রণী পুঁজিবাদের প্রবক্তা পুরুষোত্তম ঠাকুরদাস বলেছিলেন,
“টাকাকে আরও বেশী স্বাতন্ত্র প্রদান ভারতকে স্টার্লিং-এর বাঁধন থেকে মুক্ত করবে এবং ভারতীয় কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসার উপযোগী মুদ্রানীতি নিতে সাহায্য করবে”।
এমনকি তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করতে পারবে এমন একটি ‘জাতীয়’সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথাও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।(৬২)
৫) ভারতীয় বুর্জোয়াদের আরেকটি সুবিধা ছিল ক্ষুদ্রশিল্পের বিস্তার ও সমৃদ্ধি। যদিও বৃহৎ-শিল্পের ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছিল এই সময়ে তবুও ১৯৪১ সাল অব্দি ক্ষুদ্রশিল্পের মোট আয় ছিল তুলনামুলকভাবে বেশি। মিশর বা ইন্দোনেশিয়ার থেকে ভারতের মূলগত পার্থক্য ছিল যে ওখানের ক্ষুদ্রশিল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল গ্রীক বা জাপানী বা ইউরোপীয়দের হাতে কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সেটা দেশী পুঁজির হাতেই ছিল। এটা ভারতীয় বুর্জোয়াদের ক্ষমতা ছিল যে তারা ছোটখাটো ঝামেলা এড়িয়ে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বুর্জোয়াদেরও নিজেদের মধ্যে শামিল করে নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা ভারতীয় বাজারে অক্ষুণ্ণ রাখে।(৬৩)
সুতরাং ১৯১৪-১৯৪৭ সাল অব্দি ভারতের অর্থনীতির বিকাশকে এইভাবে সারাংশে বলা যায়— ক) ১৯২০-র পর এমন কিছু শিল্পক্ষেত্রের উদ্ভব (চিনি, সিমেন্ট, কাগজ, ইস্পাত) ঘটে যেগুলি সম্পূর্ণভাবে দেশী-পুঁজির নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়েছিল;(৬৪) খ) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ অধীনে থাকা কিছু শিল্পের (পাট, খনি, ব্যাঙ্কিং, জীবনবীমা) মধ্যে ভারতীয় পুঁজিবাদীদের অনুপ্রবেশ।(৬৫) এটা দু’রকম ভাবে হয় — ১) বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩০-র মন্দার কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রম-দুর্বলতা; ২) সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির আভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে দেশীয় শিল্পের করছাড় ও অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা প্রাপ্তি। তাই ব্রিটেন নিজের প্রতিযোগীদের কাছে বাজার না খুলে দিয়ে ভারতীয় শিল্পকে বাড়তে দিয়েছিল। জাপান, জার্মানি, আমেরিকা, বেলজিয়ামের মত প্রতিযোগীদের রুখতে ইস্পাত, চিনি, দেশলাই, তুলার মত শিল্পগুলিকে বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল।(৬৬)
শ্রেণি সংগঠনের বিকাশ : ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি
প্রতিটি শ্রেণি সংগঠনই সেই বিশেষ শ্রেণির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচায়ক। সুতরাং কোন শ্রেণির শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করতে হলে আমাদের তাদের শ্রেণি সংগঠনের বিভিন্ন বক্তব্যের উপর গুরুত্ব সহকারে নজর দেওয়া। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রকৃত শ্রেণি সংগঠন ছিল ফিকি (FICCI – Federation of Indian Chambers of Commerce and Industries)।
সুনীতি কুমার ঘোষের পূর্বোল্লিখিত বইটির ‘দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা’-য় লেখক জাতীয় বুর্জোয়াদের (মাঝারি ও ছোট পুঁজিপতি) সাথে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের (ভারতীয় বড় পুঁজিপতি) এক অত্যন্ত সংঘাতমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করবার জোরদার প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু আসল ঘটনা হল যে ভারতীয় বড় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ফিকি-র ছাতার তলায় সব ধরনের ভারতীয় বুর্জোয়ারাই উপস্থিত ছিল। আসলে ভারতীয় বড় পুঁজিপতিদের দক্ষ নেতৃত্বেরই ফলেই, যে কোন বড় ধরনের মতবিরোধ ছাড়াই ফিকি-র মত একটি একক ঐক্যবদ্ধ সংগঠনে তারা সবাইকে ধরে রাখতে পেরেছিল। তারা নিজেদের বুর্জোয়া স্বার্থের বিঘ্ন না ঘটিয়ে যতদূর সম্ভব ছোট-মাঝারি বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছিল। কেবলমাত্র ১৯৪৪ এবং ১৯৪৬— এই দুই বছরে বিতর্ক ওঠে যখন ছোট ব্যবসায়ীরা ফেডারেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে ফেডারেশন কেবলমাত্র শিল্পপতিদের স্বার্থই দেখছে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে না। কমঃ সুনীতি কুমার ঘোষের উল্লিখিত ‘মধ্য বুর্জোয়া’ মনু সুবেদারের বক্তব্যটি সেই বিশেষ সময়েরই পরিচায়ক ছিল, তা কোন সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল না। (৬৭) এমনকি ব্রিটিশ সরকার যখন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিভাজিত করতে যায় তখন ফিকি তার বিরোধিতা করে। যদিও ব্রিটিশ সরকার এবং মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় মুসলিম বণিকদের একটি আলাদা সংগঠন গঠিত হয়, তবুও স্বাধীনতা অব্দি সেটি ফিকি–র সাথেই সংযুক্ত ছিল। সুতরাং ১৯২৭ সালেই ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের স্বার্থবাহী এক শ্রেণি সংগঠন বানিয়ে ফেলেছিল। যদিও তার প্রস্তুতিপর্ব দীর্ঘদিন ধরেই চলেছিল। ভারতের বহুবিধ জাতিগত এবং ধর্মগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির এই ঐক্যবদ্ধ শাসকশ্রেণি রূপে আবির্ভূত হওয়ার ইতিহাস একমাত্র মার্কিন পুঁজিপতিদের সাথেই তুলনা করা যায় যাদের মধ্যে ইতালীয়, ব্রিটিশ, পোল, জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন সত্ত্বা উপস্থিত।(৬৮) সামগ্রিকভাবে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির এই ঐক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের ইতিহাসে এটা দুর্লভ ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদের উপর এই সংগঠিত শ্রেণি বেশ নির্ভরশীল হলেও তাদের ঐক্যের কারণে তারা ভারতীয় বাজারে নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারত। এই বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতাও ভারতে পুঁজিবাদের বিকৃত বিকাশের জন্য দায়ী। সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীলতা ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে উত্থানের কারণেই ঐ ধরনের বিকাশ ধ্রুপদী পুঁজিবাদী বিকাশের থেকে বিকৃত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে এই শ্রেণি সংগঠনের সংস্কারপন্থী আপোষই পুঁজিবাদী বিকাশের পথ প্রশস্ত করে (যা অবশ্যই বিকৃত ছিল)। এটাই ছিল ভারতের পুঁজিবাদী বিকাশের বিশেষত্ব যা ১৯২৫ সালে স্তালিন এবং ১৯২৮ সালের আগে কমিন্টার্নের বুখারিন ও অন্যান্যরা উল্লেখ করেছিলেন।
ফিকি শুধুমাত্র আংশিক অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের এক ইউনিয়ন ছিল না, তা ছিল বুর্জোয়াদের সুবিধামত রাজনৈতিক অর্থনীতিকে সাজিয়ে নেওয়ারও এক হাতিয়ার। আর এই লক্ষ্যে তার মূল বাধা ছিল ব্রিটিশ শাসন। ফিকি-র দ্বিতীয় বার্ষিক সভায় ফিকি–র তৎকালীন সভাপতি পুরুষোত্তম দাস এই দিকটি তুলে ধরেন এইভাবে—
“আমরা আর আমাদের অর্থনীতির থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারব না …. ভারতের বাণিজ্য এবং শিল্প জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এবং তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ- যা এর শক্তিবৃদ্ধির সাথে বাড়বে এবং শক্তিশালী হবে।” (৬৯)
পুরুষোত্তম দাসের এই অভিমুখ ফিকি–র বাকি নেতাদের ভূয়সী প্রশংসা পায় এবং ফিকি–র একটি নির্ধারক নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩০ সালে ভারতীয় বুর্জোয়াদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ফিকি-র সভাপতি জি.ডি.বিড়লা আরো জোর দিয়ে বলেন,
“বর্তমানে …আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় সরকারকে আমাদের মতের পক্ষে আনা অসম্ভব…একমাত্র সমাধান …হল যারা আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে- ব্যবসায়ীরা তাদের হাত শক্ত করুক।”
জাতীয় সংগ্রামের বিপ্লবী দিশাকে পাল্টে ভারতীয় বুর্জোয়ারা তাদের নিজেদের স্বার্থানুকূল আপোষের দিকে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে সেই লক্ষ্যেই ফিকি কাজকর্ম করতে থাকে। তারা সবসময়ই ভারতের স্বাধীনতাকে তাদের দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য বলে ঘোষণা করলেও ক্ষণিকের সুবিধা লাভের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে হাত মেলায়। এই ছোটখাটো রফা-আপোষগুলির লক্ষ্য ছিল গণআন্দোলনগুলিকে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে আন্দোলনগুলোকে এক নরমপন্থী অভিমুখ প্রদান করা। ব্রিটিশবিরোধী গণআন্দোলনগুলির সম্ভাব্য বৈপ্লবিক পরিণতির কথা ভেবে তারা আন্দোলনগুলিতে নিজেদের আধিপত্যের মাধ্যমে অভিমুখ পাল্টে দেয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই রফাগুলো সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বা মুৎসুদ্দিপনা ছিল না। জাতীয় বুর্জোয়ার চরিত্র সম্পর্কে কমঃ মাও-এর কথাগুলি মনে করুন আরেকবার—
“তারা সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করতে ভয় পায় কারণ সে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের সাথে আর্থিক বন্ধনে যুক্ত। এটা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে যখন জনগণের বিপ্লবী শক্তিগুলি জোরদার হয়ে ওঠে।” (৭০)
সুতরাং এমনকি জাতীয় বুর্জোয়ারাও ‘গণবিপ্লবী আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠলে’ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা নিয়ে ইতস্ততঃ করে। এটা শুধু মুৎসুদ্দিদের চরিত্র নয় বরং বলা ভালো যে এটা সামগ্রিকভাবেই বুর্জোয়াদের চরিত্র। উপরন্তু তৎকালীন গণআন্দোলনকে তারা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। তারা এইসময় সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে প্রচুর সুবিধাসুযোগ আদায় করে। সুতরাং উপর উপর ধারাবাহিকভাবে ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা এবং ক্ষণিকের সুবিধা লাভের জন্য ব্রিটিশদের সাথে হাত মেলানোর’ কৌশলের মাধ্যমেই ভারতীয় বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তারা কখনই বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তাদের বন্ধনকে দুর্বল করে দেয়নি। আমরা এখন সেরকমই দু’-একটি উদাহরণ দেখাব।
১৯৩১ সালে বুর্জোয়ারা গান্ধী-আরউইন চুক্তির সঙ্গে সহমত হয়ে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি আইন অমান্য আন্দোলনের অগ্রগতিকে আটকানো সমর্থন করে এবং সাংবিধানিক আলোচনার জন্য রাজী হয়। কিন্তু তারা কেন্দ্রীয় আইনসভার মন্ত্রীদের হাতে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষমতা দানের জন্য দাবী করতে থাকে।(৭১) এর কিছু সময় পরেই ‘ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার সংক্রান্ত সংযুক্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট’-কে প্রত্যাখ্যান করে FICCI। তারা এই প্রস্তাবকে, “এমনকি শ্বেতপত্রের প্রস্তাবনার থেকেও বেশী প্রতিবিপ্লবী” (৭২) বলে চিহ্নিত করে যেহেতু এই সংস্কার তাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থবিরোধী ছিল। আবার ১৯৩২ সালে তারা ব্রিটিশ সরকারের ল্যাঙ্কাশায়ারের সুবিধার্থে বানানো ‘ওটাওয়া চুক্তি’-কে প্রত্যাখ্যান করে দেয় যেহেতু সেটা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের জন্য ক্ষতিকারক ছিল। (৭৩)
তাদের এই ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান বজায় রেখে ১৯৩৫ সালে তারা ভারত সরকারের সাংবিধানিক সংস্কার সংক্রান্ত সংযুক্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট ও ‘বোম্বে-ল্যাঙ্কাশায়ার চুক্তি’কে প্রত্যাখ্যান করে। ওপর একটা উদাহরণ থেকে বোঝা যাবে যে কীভাবে ভারতীয় বুর্জোয়ারা গণআন্দোলনগুলোকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগিয়েছিল। ভারত ছাড় আন্দোলনের ঠিক চার দিন আগে ৫ই আগস্ট, ১৯৪২-এ ভাইসরয়কে লেখা এক চিঠিতে পুরুষোত্তম দাস, জামশেদ টাটা, জি.ডি.বিড়লারা লেখেন যে উত্তাল গণআন্দোলনকে দমিত করতে গেলে ব্রিটিশ সরকারের উচিত,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝেও ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া।(৭৪) আমরা আদৌ মনে করি না যে এই চিঠির মাধ্যমে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়াদের দেশকে স্বাধীন করবার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী লড়াইয়ের কোনো আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা যথেষ্ট শ্রেণিসচেতন ছিল এবং শাসক হিসেবে তারা জানত যে কখন ও কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে রফা করতে হয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নির্ভরশীলতায় কোনরকম বিঘ্ন না ঘটিয়েই।
এই কালপর্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলির প্রতি বুর্জোয়াদের মনোভাবের যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছিল আগের তুলনায়। ১৯০৪-০৫ সালের স্বদেশী আন্দোলনের সময় সক্রিয় বয়কটকে সমর্থন না করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তারা প্রকৃত বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই যাবতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলির সমর্থন করে কারণ এই সময়ের মধ্যে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিল ও নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পেরেছিল। কিন্তু তাই বলে যে তাদের সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যোগসাজশ ছিল না তা নয় কারণ এগুলো তাদের স্বার্থের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল। সুতরাং ভারতীয় বুর্জোয়াদের এই দ্বৈততাকে কমঃ লেনিন ও কমঃ মাও-এর দ্বন্দ্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখতে হবে, একবগ্গা ভাবে দেখলে কখনই তাদের চরিত্রের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়-আমাদের মাথায় রাখতে হবে কমিন্টার্ন-এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে কমঃ লেনিনের সেই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য—
“…শোষণকারী দেশের বুর্জোয়া এবং উপনিবেশের বুর্জোয়াদের মধ্যে একটা সমঝোতা তৈরী হয়েছে যার ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিপীড়িত দেশের বুর্জোয়ারা জাতীয় আন্দোলনকে সমর্থন করলেও বিপ্লবী আন্দোলন এবং বিপ্লবী শ্রেণির বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সঙ্গে একসাথে লড়াই করে।” (৭৫)
পরের উদাহরণটি দেখে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রকৃত পরিচয় সহজেই পাওয়া যায়। ভারতে কম্যুনিজ়মের উত্থানকে আটকাতে ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘জন সুরক্ষা বিল’ নামক একটি বিলের দ্বারা ব্রিটিশ সরকারকে অসীম ক্ষমতা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বিলের উদ্দেশ্য নিয়ে একমত হলেও ভারতীয় বুর্জোয়ারা এর বিরোধিতা করে কারণ তারা ভয় পায় এই ভেবে যে এই বিলের প্রদত্ত ক্ষমতা জাতীয়তাবাদীদের উপরও প্রযুক্ত হতে পারে নানানরকম অজুহাতে। ভারতীয় বুর্জোয়ারা ঐ রকম এক অস্ত্রের সাহায্যে কখনই বলশেভিকবাদকে ধ্বংস করতে চায়নি। জি.ডি.বিড়লা স্পষ্টই বলেন,
“আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে একটি বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী সংগঠনই কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে যথার্থ সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্তিম শক্তি”। (৭৬)
ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে কৌশলে লড়াই করে। তারা জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশকে সমর্থন করে এমন এক সময়ে যখন কংগ্রেসের তথাকথিত ‘বাম-ঘেঁষা বুলি-কপচানো’ অংশটি কিছু পরিমাণে বৈপ্লবিক স্পৃহা দেখাচ্ছিল। ১৯৪২ সালে ভারতের বিকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নে পুঁজিবাদীদের উদ্যোগে তৈরি হওয়া ‘যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক বিকাশ কমিটি’ ‘কম্যুনিজ়মকে ’ আটকানোর বুর্জোয়া সমাধান-সূত্র হাজির করে। তারা আরও বলে,
“সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যা যা ভালো এবং সম্ভবপর এবং দেখা যে কতদূর পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের দাবীগুলোকে পুঁজিবাদের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সমর্পণ না করে মানিয়ে নেওয়া যায়”।
এই জন্যই ‘বোম্বে প্ল্যান’-এ এই সমস্ত বিষয়গুলির আংশিক সমাধান করা হয় কিছুটা সমবণ্টন ও কিছুটা জাতীয়করণের মাধ্যমে।(৭৭) এভাবেই বিদেশী শাসকদের থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবেই নিজেদের শ্রেণি আধিপত্য জাহির করবার জন্য ভারতীয় বুর্জোয়ারা কম্যুনিজ়মের বিরুদ্ধে নিজেদের মত করে কৌশল অবলম্বন করে।
এবার আসা যাক অন্তিম প্রসঙ্গটিতে— সামন্ততন্ত্রের প্রতি বুর্জোয়া শ্রেণির মনোভাব। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের সাহায্য নিয়েই বুর্জোয়ারা সঞ্চয়ন করেছিল তবুও পরবর্তীকালে তারা কিন্তু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সামন্ততন্ত্রকেও রেয়াত করেনি। জমির প্রশ্নে বুর্জোয়াদের অভিমত ছিল একদম স্পষ্ট। ১৯৩১ সালে মৌলিক অধিকার নিয়ে করাচী কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আম্বালাল সারাভাই বলেন,
“জমিদার শ্রেণি, যারা… চাষিদের শ্রমের উপর বেঁচে থাকে… তাদের অবলুপ্ত করতে হবে… জাতীয়করণ বা যথাযোগ্য পুনর্বাসন দিয়ে বাধ্যতামূলক জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে”।(৭৮)
উত্তরপ্রদেশের কৃষি-সঙ্কট নিয়ে ১৯৩১ সালের ২৫ জুন ফিকি ভাইসরয়কে এক পত্রে লেখে যে যেভাবে সরকার দমনমূলক নীতির দ্বারা জমিদারদের সাহায্য করছে তাতে তারা মোটেই খুশি নয়।(৭৯) ১৯৩৪ সালে জি.ডি.বিড়লা জমি আইনে পরিবর্তন এনে কর কমাতে ও জমি-ব্যাঙ্ক স্থাপন করতে বলেন।(৮০) ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নেওয়া ভূমি সংস্কারের কর্মসূচীর আসল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ জমিদারদের ক্ষমতা হ্রাস করা। যদিও ভূমিসংস্কার বুর্জোয়াদের বেশিরভাগ সংস্কারের মতই অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল তবুও এর মানে এটা নয় যে বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রের দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছিল। সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়ারাও যে সত্যিকারের লড়াই করে না তা কমঃ মাও-এর কথাতেই পরিষ্কার—
“জাতীয় বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইচ্ছুক নয় কারণ তাদের সাথে জমিদার শ্রেণির নিবিড় বন্ধন আছে।”
ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি, যারা কোন পর্বেই এমনকি জাতীয় বুর্জোয়াদের মত বিপ্লবী ছিল না, তাদের কাছ থেকে এই লড়াই-এর আশা করাটা বাতুলতা। সংস্কারের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্র দুর্বল অবশ্যই হয় এবং সংস্কারের ফলে আধা-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক পরিমাণগত ও গুণগত ভাবে বদলে গিয়ে পুঁজিবাদ কোন দেশের আধিপত্যকারী শক্তিতে পরিণত হতে পারে না, মার্কসীয় তত্ত্ব এমন বক্তব্য সমর্থন করে না। ‘প্রুশীয় পথ’ এবং সংস্কারের উপযোগিতা নিয়ে এঙ্গেলস বলেছেন,
“এটা বাস্তব যে প্রাশিয়ান রাষ্ট্র তখনো পর্যন্ত একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, অথচ বোনাপার্টিজম মানে হল সমস্ত ক্ষেত্রেই, রাষ্ট্রের একটি আধুনিক রূপ যা সামন্ত্রতন্ত্রের অবসান ছাড়া টিকতে পারে না। তাই প্রাশিয়াকে অবশ্যই ঠিক করতে হবে যে সে তার য়ুঙকারতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে সামন্ততন্ত্রের অসংখ্য অবশেষকে দূর করতে পারবে কিনা। এটা স্বাভাবিকভাবেই করতে হয় যথাসম্ভব নমনীয়তম রূপে এবং ‘সর্বদা ধীরগতিতে সামনের দিকে’ বলে জনপ্রিয় গানের সুরে… যদি সবকিছু ভালো চলে, এবং পৃথিবী সুন্দর ও শান্ত থাকে, এবং আমরা সকলে যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়ে পড়ি, তা সত্ত্বেও আমরা এটা দেখার জন্য বেঁচে থাকতে পারি যে— ১৯০০ সাল নাগাদ প্রাশিয়া সরকার সত্যিসত্যিই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পরিত্যাগ করে শেষপর্যন্ত সেই বিন্দুতে পৌছবে, ১৭৯২ সালে ফ্রান্স যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।” (৮১)
বিতর্ক করা যেতে পারে যে— বিশেষতঃ উপনিবেশগুলিতে, এই একচেটিয়া পুঁজির যুগে নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা ব্যতিরেকে এটা সম্ভব কিনা? কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে পুঁজিবাদের চরিত্র হল যে সে একাধারে সামন্ততন্ত্রকে ক্ষয়িষ্ণু করে এবং অন্যদিকে বজায় রেখে গুণগতভাবে উৎপাদনের উপকরণের বদল ঘটায়। ভারতের ক্ষেত্রেও বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রকে রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল করতে সচেষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৫ সালের আইনের প্রস্তাব অনুযায়ী সাংবিধানিক প্রশ্নে রাজাদের ভেটোদানের অধিকারের নিন্দা করে ফিকি। এক কথায় বলা যায় যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা সামন্তশ্রেণির প্রতি বুর্জোয়াসুলভ ব্যাবহারই করেছিল কারণ বুর্জোয়ারা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের জন্য সামন্ততন্ত্রকে একাধারে ক্ষয় ও রক্ষা দু’টোই করে থাকে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসানের পর সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল দেশীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণির হাতে স্বাধীন ভারতের শাসনভার চলে যায়।
উপসংহার:
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র খুবই জটিল ভাবে বিকাশলাভ করেছে এবং অবশ্যই তা কোনো চিরাচরিত গতে এগোয়নি। এবিষয় আরও গভীর বিশ্লেষণ অনেক বেশি ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে উপস্থিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা মূলত ভারতে যে পশ্চাৎপদ ও বিকৃত পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে, সাম্রাজ্যবাদের ওপর তার নির্ভরশীলতার ধরণটিকে ‘মুৎসুদ্দি’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিনা, সে বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক বোঝাপড়া উপস্থিত করতে চেয়েছি। মুৎসুদ্দিদের যে প্রভু সাম্রাজ্যবাদী দেশের থেকে ভিন্ন বা বিরোধী কোন উদ্দেশ্য থাকতেই পারে না— একথা কমঃ মাও আমাদের শিখিয়েছেন। আবার ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ করছে যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা কখনই স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণির মত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি বরঞ্চ অনেকাংশেই অর্থনৈতিকভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল ছিল। বিশ্ব-ইতিহাসের জটিল আবর্তের কারণেই সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল থেকেও ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি কোনরূপ বিপ্লবী সংগ্রাম ব্যতিরেকেই ব্রিটিশদের থেকে তাদের নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থ কে সুসংহত করতে পেরেছিল। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনকে তারা চমৎকারভাবে তাদের সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরশীল পুঁজিবাদী বিকাশের সংস্কারপন্থী দিশায় কাজে লাগিয়েছিল। এবং এই কারণেই ভারতে নির্ভরশীল ও বিকৃত পুঁজিবাদ এবং বিকৃত পুঁজিবাদী শ্রেণির বিকাশ হয়। ‘সাম্রাজ্যবাদ— পুঁজিবাদের উচ্চতম পর্যায়’ নামক গ্রন্থে কমঃ লেনিন এই ধরণের নির্ভরতার ছবি খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন,—
“…পর্তুগালে একটা ভিন্নধরনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার সাথে রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপস্থিতি দেখা যায়। পর্তুগাল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও আসলে স্পেনীয় যুদ্ধ (১৭০১-১৪)-এর পর থেকেই সে ব্রিটিশদের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র। ফ্রান্স এবং স্পেনের মত প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ব্রিটেন নিজেকে আরও সুরক্ষিত করে তোলবার জন্যই পর্তুগাল এবং তার উপনিবেশগুলিকে রক্ষা করে এসেছে। বিনিময়ে ব্রিটেন পেয়েছে পর্তুগাল এবং তার উপনিবেশসমূহে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা, দ্রব্যসামগ্রী এবং পুঁজি আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়; বন্দর, দ্বীপ এবং টেলিগ্রাফ ইত্যাদি সুবিধা। বড় এবং ছোট রাজ্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের সম্পর্ক সবসময়ই থেকেছে, কিন্তু পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের যুগে এটা একটা সাধারণ ব্যবস্থা হয়ে গেছে যেখানে ‘পৃথিবীকে ভাগবাটোয়ারা করার’ সম্পর্কের গোটাটার তারা একটা অংশ এবং বৈশ্বিক লগ্নিপুঁজির ক্রিয়াকর্মের শৃঙ্খলার তারা একটা যোগসূত্র হয়ে উঠেছে।” (৮২)
সুতরাং এই ধরনের নির্ভরতা লেনিনের অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু কখনই এই ধরণের নির্ভরতার জন্য লেনিন পর্তুগালের বুর্জোয়াদের মুৎসুদ্দি বিবেচনা করে পর্তুগালকে এক নির্ভরশীল আধা-ঔপনিবেশিক দেশ বলে বর্ণনা করেননি; বরঞ্চ তিনি পর্তুগালের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষেই সওয়াল করেছেন, যদিও তিনি বলেছেন যে সামগ্রিকভাবে পর্তুগাল সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং ঐ রকম বিপুল আর্থিক নির্ভরশীলতা থাকলেই ভারতীয় বুর্জোয়াদের ‘মুৎসুদ্দি’ বা ভারতকে ‘আধা-ঔপনিবেশিক’ দেশ বলে চিহ্নিত করে দেওয়া যায় না।
তথ্যসূচী:
১) The International newsletter of “Historical studies on comintern, communism and Stalinism” (9-13), 1997-98, pg73-83
২) Cited in Shovonlal Dutta Gupta’s – Comintern and the Destiny of Communism in India; 1919-1943 pg-57
৩) Draft thesis on national and colonial question – Lenin collected Works, Vol 31, thesis no.11,http://www.marxist.org,
৪) ibid
৫) M.N.Roy, “Disagreement with Lenin”, in The Radical Humanist (Calcutta) 16thno. 1952, pg292
৬) Minutes of the 2nd congress of the communist international, 4th session, supplementary thesis –by M.N.Roy, point no.8, history archive, http://www.marxist.org,
৭) Roy later admitted his error. See M.N.Roy – ‘Heresies of the twentieth century’ ( Bombay, renaissance Publication Vora & co.Ltd,1943), Pg-118-119
৮) Minutes of the 2nd congress of the communist international, 4th session, comment of Lenin, History Archive, http://www.marxist.org, (Emphasis-author)
৯) Minutes of the 2nd congress of the communist international, 5th session,28th july, comment of Pak chin sun, history archive, http://www.marxist.org,
১০)ibid
১১) “Canadian capitalism: a study of power in the Canadian business establishment”- by Jorge Niosi, look at the 1st chapter “formation of the Canadian Bourgeoisie”
১২) To see ‘The Dawn:Baku,1920-first congress of the People of the East’- edited by John Riddel,(new York: pathfinder press, 1993) pg 169
১৩) Cited in Shovonlal Duttagupta’s book pg-88-89
১৪) Selected works of M.N.Roy, (oxford university press, 1987, delhi) pg-473-481
১৫) Interested reader may consult the writings of M.N.Roy in this period, India in Transition(1922), what do we want?(1922), etc, look at M.N.Roy internet archive in http://www.marxist.org,
১৬) The Comintern and the East: Struggle for the leninist Strategy and Tactics in Natioal liberation movement ( Moscow, progressive publisher,1979 pp 169-170)
১৭) Indo-Russian relations 1917-1947, part 1, Purabi Roy (ed.) pg210-211
১৮) Selected works of Stalin, vol-7 Moscow,1954 pg-108, pg 148-150
১৯) ibid, pg 148-150
২০) ibid, pg-108, emphasis ours
২১) Selected works of Stalin, vol-9, Moscow, 1954, pg-238 – “Concerning questions of Chinese Revolution. Reply to Com. Marchulin”
২২) ‘Some Experiences in Our Party’s History’-selected works of Mao Tse Ttung, vol 5, pg 327 Foreign Languages Press, Peking,1977
২৩) “Chinese Revolution And Chinese Communist Party”-Selected works of Mao Tse Tung, vol-2,pg-320, Foreign Languages Press, Peking,1965
২৪) ibid, pg 320
২৫) ‘Some Experiences in Our Party’s History’-selected works of Mao Tse Ttung, vol 5, pg 327 Foreign Languages Press, Peking,1977
২৬)”Analysis of classes in Chinese society’’ Selected works of Mao Tse Tung vol-1, pg-13, Foreign Languages Press, Peking,1965
২৭) “ The Indian Big Bourgeoisie- It’s genesis, growth and character”-Suniti kumar Ghosh, New Horizon Book trust, jan 2000, pg-21
২৮) Selected works of MaoTse Tung, vol-5, pg 328, Foreign Languages Press, Peking,1977
২৯) This same type of argument was given by Utsa Patnaik, see ‘’Agrarian Relations and Accumulation”, edited by U. Patnaik, Oxford university press, 1990, pg 85-86
৩০) Karl Marx –“Capital” vol-1, chapter 25, 26. Lenin collected works, vol-3, ‘Development of capitalism in Russia’, pg 331-332
৩১) Irfan Habib, “Colonization of Indian Economy, 1757-1900”, Social Scientist, March, 1975
৩২) Just remember the specific characters of National and Comprador Bourgeoisie enumerated by Com.Mao descrided in previous points
৩৩) ‘The Migration of British capital to 1875’-by L.H.Jenks, 1963,specially see chapter-vi -‘Cosmopolitan enterprise’
৩৪) see ‘The Brenner Debate’ edited by Apton and Philipin, Cambridge 1985
৩৫) D.D.Koshambi, “Introduction to the Study of Indian History”, Bombay, revised 2nd edition, 1975, pg-395
৩৬) “The Indian Big Bourgeoisie- It’s genesis, growth and character”- Suniti kumar Ghosh, pg-155
৩৭) In his book “ The Indian Big Bourgeoisie- It’s genesis, growth and character”-Com. S.K. Ghosh tried to show the Comprador nature of the Indian Traders. See chapter -3 of his book.. And later he argued about the character of this merchant capital earned through such compradorship when they were invested in the industries set up by Indians. And moreover by citing the example of the LENIN’S model of development of capitalist industry he tried to question the nature of indian big industry. See chapter -7 of his book..
So I refer Marx in this concept. Karl Marx, Capital, vol-3, chapter-20, pg-228,internet pdf versionhttp://www.marxist.org.,
৩৮) S.D. Meheta, “The Cotton Mills of India 1854-1954”, Bombay, 1954, pg-138-139
৩৯) ibid
৪০) See B.R. Tomlinson- “The Political Economy of The Raj-1914-1947”pg-3; Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the making of Indian capitalist class,1920-1947” chapter-7
৪১) E.J.Hobsbawm “Industry and Empire”, Harmondsworth, 1976, reprint, pg-181, Michael Barratt Brown “The Economics of Imperialism” pg-161
৪২) F.R.Harris, “Jamsetji Nusserwanji Tata- A Chronicle of his life”, Bombay, 1958, edi,pg-170-190
৪৩) ibid, pg-217
৪৪) Selected works of Mao Tse Tung, vol-5, pg 328, Foreign Languages Press, Peking,1977
৪৫) “Writings and Speeches of G.V. Joshi”, Puna 1912 Pg-818
৪৬) Dadabhai Naoroji-”Poverty and Un-British Rule in India”, London, 1901; R.C.Dutta- Economic History of India- Early British Rule”1956,
৪৭) Bengali translation of Bipan Chandra’s “The Rise and Growth of Economic Nationalism in India”, K.P.Bagchi and company, 1998, pg-402, 403
৪৮) ibid, pg 56.
৪৯) A.K.Bagchi, “Private Investment in India, 1900-1939”, Cambridge, 1972, pg 440-441,
৫০) Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” pg-23
৫১) S.Subramanian and P.W.R Homfray, “Recent Social and Economic Trends In India”(New Delhi, 1946),pg-47-50, a rare copy of this book is still available in ISI, Kolkata, central library.
৫২) See B.R.Tomlinson-“ The Political Economy of The Raj-1914-1947”, 1979, Macmillan, London, pg-30-32
৫৩) United Nations Department of Economic and Social Affairs, “Processes and Problems of Industrialization in Underdeveloped Countries”(New York,1955) pg-139
৫৪) The whole of Marx’s economic writings are precisely aimed to lay bare the crippled and uneven nature of the capitalist economy as a whole. To see further George Novach “Understanding History” specially chapter- 3. Disproportions Of American Development
৫৫) A.K.Bagchi, “Private Investment in India, 1900-1939”, Cambridge, 1972, Chapter 3, 7, specially pg-83 and 433; see also Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” chapter 8
৫৬) See the tables . sources- S.Subramanian and P.W.R Homfray, “Recent Social and Economic Trends In India”(New Delhi, 1946),pg-47-50
৫৭) Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” pg, 24–25
৫৮) ibid pg, 25-26
৫৯) Michael Kidron- “Foreign Investments In India”, oxford university press, London, 1965, pg-53-54
৬০) ibid, pg-40
৬১) See- S.Subramanian and P.W.R Homfray, “Recent Social and Economic Trends In India” pg-75. Also B.R.Tomlinson-“ The Political Economy of The Raj-1914-1947”, 1979, Macmillan, London, pg-155.
৬২)’Purshotamdas Thakurdas Paper, pg-381”, cited in Aditya Mukherjee’s book, pg-26
৬৩) S. Shivasubramoian, “Income from secondary sectors in India, 1900-1947”, IESHR, vol-14.4, oct-dec, table-20, cited in Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the making of Indian capitalist class,1920-1947” pg-29
৬৪) A.K.Bagchi, “Private Investment in India, 1900-1939”, Cambridge, 1972, see chapter 3, 6.. Specially page 83, 192.
৬৫)Michael Kidron- “Foreign Investments In India”, oxford university press, London,1965, chapter-2
৬৬) Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” Chapter-6
৬৭) The Indian big bourgeoisie” by Suniti kr. Ghosh, see the ‘preface to the 2nd edition’, pg-XXIII
৬৮) Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” pg-38
৬৯) FICCI, Annual Report-1928, pg-4
৭০) “Chinese Revolution and Chinese Communist Party”-selected works of MaoTtse Tung,vol-2,pg-320, Foreign Languages Press, Peking,1965
৭১) FICCI, Annual Report, 1931-pg-3,8,97
৭২)FICCI, Proceedings of EC, 1934, pg-33-34.
৭৩) Aditya Mukherjee, “Imperialism, Nationalism, and the Making of Indian Capitalist Class,1920-1947” chapter-6
৭৪) ibid- pg-58
৭৫) Minutes of the 2nd congress of the communist international, 4th session, comment of Lenin, History Archive, http://www.marxist.org,
৭৬) G.D.Birla to Purshotamdas, 30th july 1929, PT Papers, fl-42,pt-V
৭৭) John Mathai to Purshotamdas, PT papers, fl-292, pt-I
৭৮)Walchand Hirachand Papers.fl-8(2)
৭৯) ibid
৮০) G.D.Birla as the president of FICCI, FICCI, Annual Report, 1934, pg-174
৮১) F. Engels- “Peasant War In Germany”, preface to the 2nd edition, 1874 pg-8, PDF version,http://www.marxist.org.
৮২) Lenin Collected Works, vol-22, Progressive publisher, Moscow 1964, page 263-264
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন