উত্তর-ঔপনিবেশিকতার আলোকে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্ট

কামালউদ্দিন নীলু



ভূমিকা

উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বটি উপনিবেশ স্থাপনকারী ও উপনিবেশের শোষিতদের মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তেজনা এবং মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষের ফসল। আমি মনে করি, এই তত্ত্বটি ভেঙে ফেলবে ইউরোপকেন্দ্রিকতাকে এবং খোলা চোখে দেখিয়ে দেবে ইউরোপীয় মূল্যবোধ ও ইউরোপীয়দের তৈরিকৃত মানদণ্ড কোনোভাবেই সর্বজনীন নয়। এটা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বুঝিয়ে দেবে একই ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় যথাক্রমে ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, জাতিগত মানদণ্ড ও মূল্যবোধ অনুসারে, যেখানে গৃহীত মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়ে পড়বে পুনঃস্থাপনের ওপর ভর করে, যা চিহ্নিত করবে একটি পুনর্নির্মাণ কাঠামো, এই পুনর্নির্মাণ কাঠামো তৈরি হবে একটি সংস্কারধারার মধ্য থেকে। আমার বিশ্বাস, এই প্রবন্ধটি প্রশ্নবিদ্ধ করবে ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রদত্ত কারণগুলোকে। আমি মনে করি, এটা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে ভিত্তি করে গঠিত পূর্বের কাঠামোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, যা প্রকাশ করে দেবে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে; যে স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিকতাবাদ।
পাশ্চাত্য ডিসকোর্সকে সামনে রেখে আমি সমালোচনার দৃষ্টিতে যাচাই করবো ক্যালিবানের সংস্কৃতির পুনঃউপস্থাপনকে। দ্য টেম্পেস্ট নাটকে সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টাসমূহের ভাবাদর্শগত সম্পর্ক প্রদান করে, যেটাকে একটি প্রাচীন বিশ্বের উন্নয়ন সাধনের তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। ‘অন্য’কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কৌশলটির লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত ক্যালিবান, যেখানে ক্যালিবান উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণরূপে বর্বর হিসেবে, যে প্রবলভাবে প্রকাশ করে জাতিগত বিদ্বেষ। সুতরাং শেক্সপিয়র অন্তর্নিহিতভাবেই ঔপনিবেশিক প্রচেষ্টাকে বৈধতা দিয়েছেন, কারণ পরিপূর্ণ মানবতাবর্জিত ক্যালিবানের মতো একজন ব্যক্তি বিবেচিত হতে পারে ইতিহাস ও সংস্কৃতিহীন একজন মানুষ হিসেবে, আর এ-কারণেই তার সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি যুক্তিসংগত দাবি নেই। এটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে যে ‘অন্য’র প্রতি দৃষ্টিগোচর করাতে গিয়ে শেক্সপিয়র পাশ্চাত্য মতবাদেরই একটি লক্ষণমূলক উপলব্ধি সৃষ্টি করেছেন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণের মাধ্যমে।
আলোচ্য অধ্যায়গুলোতে আমি অদৃশ্যকে পুনর্গঠন এবং ঔপনিবেশিকতাবাদকে ব্যাখ্যা করবো উপনিবেশের শোষিতদের দৃষ্টিকোণ থেকে, যা ‘দানব’ ক্যালিবানেরই দৃষ্টিকোণ। একদিকে আমি দেখাবো ক্যালিবান শুধু শোষণের শিকার নয়, বরং একজন স্বাভাবিক মানুষের উত্তরাধিকারী হিসেবে সক্রিয় ও সহিংস বিরোধিতার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতাকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ। অন্যদিকে দেখাবো, প্রসপেরোর বিরুদ্ধে ক্যালিবানের প্রতিরোধ। যে-প্রতিরোধ পরবর্তীকালে তাকে প্রসপেরোর নিয়ম-ব্যবস্থার মধ্যে আটকে ফেলে। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি প্রসপেরো ও ক্যালিবানের মধ্যে সৃষ্টি করে একটি ‘তৃতীয় স্থান’। এই তৃতীয় স্থানটি সৃষ্টি হয় অনুকরণের মাধ্যমে, যার ফলটাই হচ্ছে ‘হাইব্রিডিটি’। আমি পরবর্তীকালে বিশ্লেষণ করে দেখাবো কীভাবে উপনিবেশ স্থাপনকারী উপনিবেশের শোষিত ক্যালিবানকে বোঝাতে বাধ্য করে যে প্রসপেরোর সংস্কৃতিই হলো একমাত্র আদর্শ সংস্কৃতি; এর পাশাপাশি, আমি কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবো কীভাবে উপনিবেশের অধিবাসী ক্যালিবান উপনিবেশ স্থাপনকারীর সংস্কৃতিকে অনুকরণ করে এবং যার ফলে সে হয়ে পড়ে উপনিবেশ স্থাপনকারীর ব্যবস্থারই একটি অংশ। ক্যালিবানের এই দ্বৈত পরিচয়ের কারণে হাইব্রিডিটি মোড় নেয় ক্যালিবানের বিরুদ্ধে। যে-কারণে হাইব্রিড স্থান সবসময়ই পরাভূত করে দেয় ঔপনিবেশিকতায় শাসিত উপনিবেশের অধিবাসীকে।



‘অন্য’ সম্পর্কে ধারণা - নিজ ও ‘অন্য’কে নিরূপণ

শেক্সপিয়রের টেম্পেস্ট শুধু যে কৌতুকবোধের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ তা নয়, বরং এতে আরো রয়েছে তথাকথিত ‘অন্যে’র প্রতি পাশ্চাত্যদের ভীতির ইঙ্গিত। যে-কারণে পাশ্চাত্যের উপনিবেশ স্থাপনকারীরা সংগতভাবেই দূরত্ব তৈরি করে উপনিবেশের অধিবাসীদের সঙ্গে। যেটা স্বভাবতই বলা যায়, একটি অস্বাভাবিক দূরত্ব, এবং এই দূরত্বটাই প্রমাণ করে যে, উপনিবেশের অধিবাসীরা মানুষ নয়, এমনকি তাদের সমগোত্রীয়ও নয়। যে-কারণে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এই ধারণার মধ্য দিয়ে তারা তাদের ঔপনিবেশিক কার্যক্রম প্রকটভাবে যুক্তিসিদ্ধ করার চেষ্টা করে, কারণ ক্যালিবানের মতো একজন মানুষ, যার অবস্থা অনিশ্চিত এবং সকল মানবিক জায়গা থেকে বঞ্চিত, সে পরিগণিত হতে পারে ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিহীন একজন মানুষ হিসেবে। আবার অন্যদিকে আমরা দেখি ক্যালিবান স্বাধীনতারও দাবিদার। ঔপনিবেশিকরা তাদের উপনিবেশের অধিবাসীদের কেন চিহ্নিত করে বর্বর হিসেবে? কারণ হিসেবে বলা যায়, ঔপনিবেশিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে উপনিবেশের অধিবাসীরা সার্বিকভাবেই ভিন্ন; যেহেতু তারা মনে করে এদের আকৃতি বেমানান, ভাষা অদ্ভুত, সংস্কৃতিতে রয়েছে মার্জিত রুচির অভাব। পশ্চিম গোলার্ধের তুলনায় দ্বীপটি হলো সভ্য সমাজের একটি পটভূমি, আর এর বাসিন্দারা হলো উপনিবেশের অধিবাসী, এক্ষেত্রে যেমনটি এ-নাটকের ক্যালিবান, যে কিনা মানবজাতির একজন বহিষ্কৃত প্রতিনিধি। শেক্সপিয়রের সময়ে ঔপনিবেশিক বিশ্বটা ইউরোপীয় মানুষগুলো যেভাবে কল্পনা করেছে বা চেয়েছে ঠিক সেভাবেই গড়ে উঠেছে।
একটি উঠতি ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে ক্যালিবান প্রতিনিধিত্ব করে ‘অন্য’ হিসেবে। তাকে উপস্থাপিত করা হয় প্রসপেরোর ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, একটি ‘বন্য ও বিকলাঙ্গ ক্রীতদাস’১ হিসেবে, যা অতিপ্রাকৃত সত্তার বিরোধী। প্রসপেরো ও এরিয়েল তাকে বর্ণনা করে ‘রোদে পোড়া কুকুর-ডাইনির পেটে জন্ম, মানুষের মর্যাদাহীন’২ হিসেবে; যা কিনা তার ‘ক্যালিবান’ নামকরণটা আমাদেরকে ‘ক্যানিবাল’কেই (নরখাদক) স্মরণ করিয়ে দেয়, যে একজন বন্য ও যার ভেতরে মানবশিক্ষার কিছুই নেই। ক্যালিবানের বর্বরতা কিংবা তার দানবিক রূপ উপনিবেশ স্থাপনকারী ও নব্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারী উভয়ের মাধ্যমেই সৃষ্ট, যখন তারা তাকে ‘ঘৃণ্য ক্রীতদাস’ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। আবার অন্যদিকে তার শারীরিক গন্ধের কারণে ‘শয়তান’, ‘বন্য’, ‘মাছ’ এবং ‘চার পা’৩ এসব মিলিয়ে ক্যালিবানের সার্বিক রূপটা আমাদের সামনে ধরা দেয় এক ভয়ানক ‘দানব’ হিসেবে।
আমি মনে করি, শেক্সপিয়র সচেতনভাবেই ক্যালিবানকে উপস্থাপন করেছেন ‘অন্য’ হিসেবে, সে যেন এক বিচ্ছিন্ন, বিকৃত প্রাণী। যেটা ক্যালিবানের মানবচরিত্রের অনস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলার মতোই ঘটনা। শেক্সপিয়র এই অস্বীকৃতিকে জাগিয়ে দিয়ে অসৎ ও কুৎসিত কাজ করেছেন বললেও কম বলা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ মিরান্ডা যখন ক্যালিবান সম্পর্কে তার অনুভূতিটা বলে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে :



মিরান্ডা : এ এক ভয়ংকর দুর্বৃত্ত, দানবতুল্য,

তাকাবো না ওর দিকে কোনোভাবেই।৪


এসব কিছুর পরেও ক্যালিবান যে বর্বর নয় তার প্রমাণ মেলে নতুন আসা উপনিবেশ স্থাপনকারীদের সঙ্গে যখন সে তাদের ভাষায় কথা বলে। পাশাপাশি ক্যালিবান অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিস্মিত করে তোলে তার মানবীয় গুণাবলি প্রদর্শনের মাধ্যমে। এসবের ভেতর থেকে খুব সহজেই যুক্তি দাঁড় করানো যায় যে, ক্যালিবান আসলে পশু হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বরং একজন আদিম মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে উঠেছে।



নিজ ও অন্যের অনিশ্চিত জ্ঞাতিত্ব

চিনুয়া আচেবে এ-সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত নিজের ও অন্যের মধ্যে স্পষ্ট দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা থাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত দুজনের অবস্থান স্ব-স্ব জায়গাতেই থাকবে। একটি প্রাণীকে বর্বর অবস্থায় আবিষ্কার করা এবং সেটার মানবীয় গুণাবলি অবলম্বন করাটা অনিশ্চয়তার দিকেই ধাবিত করে। কারণ তাকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মূল্যবোধ এবং সুস্পষ্টতা - যা মানবজাতিকে সঠিকভাবে নিরূপণ করে, তা হয়ে পড়ে সামঞ্জস্যহীন ও নড়বড়ে।
চিনুয়া আচেবে তাঁর সমালোচনামূলক নিবন্ধ হার্ট অব ডার্কনেসে ‘অন্য’ এবং উপনিবেশ স্থাপনকারীর মধ্যে সাধারণ পূর্বপুরুষ ও জ্ঞাতিত্বের দিকেই নির্দেশ করেছেন, যেটা শেক্সপিয়রও করেছেন, কিন্তু অতিসূক্ষ্ম পথে। নিচের উদ্ধৃতিটি ক্যালিবানের যথেচ্ছাচারিতা ও লালসার প্রকাশ ঘটায়, যা তার আদিম চরিত্রকেই সমর্থন করে, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি পশুর সহজাত প্রবৃত্তি :
প্রসপেরো : আমার ভূমিতে থেকে সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করেছিস তুই আমারই কন্যার।
ক্যালিবান : যদি বা করা যেতো তাই যদি বাধা না দিতেন,
এই দ্বীপ ভরে যেতো কিন্তু ক্যালিবান আর ক্যালিবানে।৫
দ্য টেম্পেস্ট উপনিবেশকে উপস্থাপন করে ‘অন্য পৃথিবী’ হিসেবে, যা ইউরোপের সম্পূর্ণ উলটো দিক, যা সভ্য জগতেরও উলটো ছবি। ক্যালিবান চরিত্রটি শুধু উপনিবেশের অধিবাসী এবং মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নকেই চিহ্নিত করে তা নয়, বরং সে মনুষ্যত্বহীন বর্বরের প্রতিনিধিত্বও করে। উপনিবেশ স্থাপনকারীরা এমনভাবে ‘অন্য’দের চরিত্র উপস্থাপন করে যার মাধ্যমে তারা তাদের পরিচয়টাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, অর্থাৎ তারাই একমাত্র উৎকৃষ্ট মানুষ আর অন্যরা নিকৃষ্ট প্রাণী।



ফাঁদে আটকেপড়া ক্যালিবান

ইউরোপকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্বীকৃতি মানে অন্যদের সামাজিক সম্পর্কের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়, শুধু সেটাই নয়, বরং ধাপে-ধাপে শোষণের মাধ্যমে তাদের ফাঁদে আটকে ফেলা হয়। এটা ঘটানো হয় ভালোবাসা ও ভয়ের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ভালোবাসা (শিক্ষা বিতরণের অর্থে) উপনিবেশের অধিবাসীদের বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ। ভয়, পরবর্তী পদক্ষেপ। যার ভেতরে বসবাস করে শোষণ, হিংস্র আচরণ ও নির্যাতন। আর এটা করা হয় উপনিবেশের অধিবাসীদের সঙ্গে, যেমন ক্যালিবান (যদি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে)। সমকালীন দৃষ্টিতে আমরা দেখি তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই নব্য ইঙ্গ-মার্কিন জাতীয়তাবাদের চলমান প্রভাবটি একইভাবে প্রতিফলিত হয় দ্বীপটির অধিবাসীদের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমেও। এরপরও উপনিবেশের অধিবাসীরা মন্দ ও বর্বর হওয়া সত্ত্বেও উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়, যা প্রতিফলিত হয় প্রসপেরোর সংলাপে :


প্রসপেরো : আমরা ওকে হারাতে চাই না :

ও আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়ে দেয়
কাঠ সংগ্রহ করে আনে,
কতো কাজ করে দেয় আমাদের,
পুরোটাই লাভ।৬
এখানে সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ প্রদান করে প্রসপেরোর প্রচেষ্টার ভাবাদর্শগত সম্পর্ক, যেটাকে উপনিবেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রসপেরোর ক্যালিবানকে শিক্ষিত করার মনোভাবটা কখনোই তাকে প্রসপেরোর সমপর্যায়ের মানুষে উন্নীত করা নয়, বরং তার সঙ্গে কেবল যোগাযোগ করার মতো একটি অবস্থা সৃষ্টি করা, যেন তাকে কাজে খাটানো যায়, অর্থাৎ এটা হলো চূড়ান্তভাবে তাকে অপব্যবহার করা। প্রসপেরোর অন্তত ক্যালিবানকে তার ভাষা শেখাতেই হবে, তা না হলে ক্যালিবান তার আদেশ-নিষেধ কিছুই বুঝবে না। ফলাফল স্বরূপ, ক্যালিবানের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ইতিহাস বিকৃত ও নিষ্পেষিত হয়ে পড়ে ঔপনিবেশিকতার শক্তির কাঠামোর নিচে।



ক্যালিবান ও প্রসপেরোর মধ্যে প্রভুত্ব

স্থাপন ও অবসান
ফ্রান্টজ ফ্যাননের মতে, ‘নির্যাতন, হিংস্রতা কিংবা হত্যাকাণ্ডের সম্ভাবনা ছাড়া ঔপনিবেশিকতাবাদ উপলব্ধি করা যায় না।’৭ ফ্যানন বোঝাতে চেয়েছেন, উপনিবেশের অধিবাসীরা প্রতিরোধ ছাড়া কখনোই তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর দ্বারা শাসিত হতে চাইবে না, আর প্রতিরোধ-প্রতিহত করতে হলে প্রয়োজন নির্যাতন, হিংস্রতা, হত্যাকাণ্ড। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক ঘাটতি সম্পর্কে সচেতন নয়, এবং যে-কারণে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করার চেষ্টা করে। ফলে উপনিবেশ স্থাপনকারীরা কখনোই পশ্চাদপসরণ এবং তাদের শাসনব্যবস্থা প্রত্যাহার করে না। আর এ-কারণে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ উপনিবেশ স্থাপনকারী ও উপনিবেশের অধিবাসী উভয়কেই আঘাত করে।
দ্য টেম্পেস্ট নাটকে প্রসপেরো এবং দ্বীপের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা উভয়ই প্রভাবশালী উপনিবেশ স্থাপনকারী এবং ইতিহাসের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানসিক ও শারীরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পক্ষাবলম্বন করে একটি সাংস্কৃতিক আদর্শের, যেটা ক্যালিবানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ক্যালিবান আদিম মানবজাতির একজন অনভিজ্ঞ উত্তরাধিকারী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যাকে সহিংস শিক্ষার মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হয়। যে-কারণে ক্যালিবানের চরিত্রের অন্যতম দিক হলো, উপনিবেশ স্থাপনকারীর ভাষা ও সংস্কৃতির সৃজনশীল ব্যবহার, যেটা নিচের অংশটুকুতে বোঝা যায় :



ক্যালিবান : যে কষ্টদায়ক শিশির আমার মা

নোংরা জলায় ভেসে থাকা
দাঁড়কাকের পালক দিয়ে মুছে দিতো,
আপনাদের ওপর পড়–ক তা।
দক্ষিণ-পশ্চিমা হাওয়া এসে আঘাত করুক
আপনাদের গা’য়।৮
এই উদ্ধৃতিটি অন্তর্নিহিতভাবে দর্শকদের গ্রহণ করতে আহ্বান করে শয়তান ক্যালিবানের ইউরোপকেন্দ্রিক প্রতিমূর্তিকে, সমর্থন করতে আহ্বান করে তার ওপর আধিপত্য করার ভাবনাটাকে। পরবর্তী সময়ে, ক্যালিবান পরোক্ষভাবে প্রসপেরোর কটূক্তিপূর্ণ অভিশাপবর্ষণকেই বৈধতা দেয় :



প্রসপেরো : এর জন্যে, মনে রাখিস,

আজ রাতে হবে তোর
পাঁজরে যন্ত্রণা, পারবি না নিঃশ্বাস নিতে,
সারারাত খোঁচাবে তোকে সজারু,
কাঁটার আঘাতে মৌচাকের মতো হয়ে পড়বে তোর শরীর,
মৌমাছির বিষাক্ত হুলের চেয়েও কষ্টের হবে তা।৯



ক্যালিবান ও প্রসপেরোর মধ্যের সংলাপটি এই দ্বীপের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সহযোগিতার অসমর্থতাকে প্রকাশ করে, কারণ স্পষ্টভাবে কোনো সাধারণ স্বার্থ নেই, শুধুমাত্র দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার জন্য অন্যকে তাড়া করা কিংবা নিজস্ব সংস্কৃতিকে অবলম্বন করতে বাধ্য করা ছাড়া। ক্যালিবান আবারো নিগৃহীত হয়ে পিছিয়ে আসে এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠে :



ক্যালিবান : খাবার খেতে হবে এখন আমার,

এই দ্বীপ আমার,
আমার মা সিকোরাক্সের মাধ্যমে পেয়েছি এটা,
যা আপনি কেড়ে নিয়েছেন অনুপ্রবেশের প্রথম দিনেই।১০



এখানে ক্যালিবান দুটো উক্তি সূত্রবদ্ধ করেছে, প্রথমটি প্রকাশ করছে একটি প্রয়োজন, আর দ্বিতীয়টি একটি দাবি। ‘খাবার খেতে হবে এখন আমার’ এবং ‘এই দ্বীপ আমার, আমার মা সিকোরাক্সের মাধ্যমে পেয়েছি এটা,’ এই দুটো উক্তি ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ বহন করে। খাবার খাওয়ার হঠাৎ অত্যাবশ্যকতা তার দাবিকে একটু বেশি পরিমাণে দুর্বল করে দেয়। ক্যালিবান এখনো একধরনের উপায়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে সে নিজেকে নিয়তির হাতে সমর্পণ করে দিয়েছে। সে অভিব্যক্ত করে বেপরোয়া মনোভাব ও নিদারুণ যন্ত্রণা, কিন্তু অবিরতভাবে তার মন্দ স্বভাবের পরোক্ষ ইঙ্গিত তার অবস্থার প্রতি সমবেদনাকে নষ্ট করে দেয়। তবুও শেক্সপিয়র ক্যালিবানকে তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছেন। অন্যান্য সাহিত্যকর্ম, বিশেষ করে দ্য হার্ট অব ডার্কনেসের তুলনায় ক্যালিবানের একটি কণ্ঠস্বর আছে, যা তার রাগ প্রকাশ করতে সমর্থ :



ক্যালিবান : আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন আপনি

প্রশ্রয় দিতেন অনেক,
ফলের রস খাওয়াতেন,
আর শেখাতেন বড়ো আলোর নাম কী
ছোট আলোটাকেই বা কী বলে,
ওরা যে দিন আর রাত যখনই বুঝলাম,
তখনই ভালোবাসলাম আপনাকে।
দেখিয়ে দিলাম এই দ্বীপের সকল কিছু,
বিশুদ্ধ ঝরনা, নোনা পানির গহ্বর,
কোন জমি নিষ্ফলা
আর কোনটা উর্বর।১১
এই সংলাপের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে ওঠে উপনিবেশের অধিবাসীদের হতাশাটা, যেটা তাদের নিজেদের মানুষগুলোর প্রতারণার ফল। ক্যালিবান এখানে উন্মোচন করে দেয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা কেমন করে উপনিবেশের অধিবাসীদের ওপর নিপীড়ন চালায় সেটার সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়াকে। প্রথমেই প্রসপেরো অজ্ঞ ক্যালিবানের প্রতারণাপূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করে এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির সুবিধাগুলো সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হয়। তারপর সে ক্যালিবানকে শিক্ষা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে বলে। এটা করার মাধ্যমে প্রসপেরো আসলে ক্যালিবানকে সাহায্য করার ছলে তার সাংস্কৃতিক ঘাটতিকে দূর করতে চায়। এখানে ধরেই নেওয়া যায়, ক্যালিবান আসলে আশা করেছিল সে প্রসপেরোর সমাজের সভ্য সদস্যের পর্যায়ে উন্নীত হবে এবং তার সাংস্কৃতিক অগ্রগতির সুফল সে পাবে। কিন্তু ক্যালিবান অজ্ঞ ছিল যে ব্যাপারে তা হলো, প্রসপেরোর উদ্দেশ্যগুলো মোটেই পরোপকারী ছিল না, বরং তা ছিল স্বার্থপরতা। যখনই ক্যালিবান শিক্ষার একটি স্তরে পৌঁছে গেল, প্রসপেরো তার শারীরিক শক্তিকে ব্যবহার করতে শুরু করলো, আর ক্যালিবান এই ব্যাপারটিকে মোকাবিলা করতে লাগলো ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার সঙ্গে।
উপনিবেশের অধিবাসীদের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন ও তাদের দমনের আরো লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায়, যেখানে ক্যালিবানের সঙ্গে স্টেফানোর প্রথম দেখা হয়। ক্যালিবান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মিনতি করে : ‘আমাকে অত্যাচার করবেন না’,১২ যা প্রসপেরো সম্পর্কে তার ভীতি ও দুর্ব্যবহারকেই প্রকাশ করে। স্টেফানো তাকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করার সম্ভাব্যতার দিকেই দৃষ্টি দেয় : ‘ওকে পোষ মানিয়ে নেপলস নিয়ে যাবো। সম্রাটের জন্য ও হবে এক শ্রেষ্ঠ উপহার।’১৩
দ্বীপে শুধু ক্যালিবান ও সিকোরাক্সই ছিল না, যাদের উপনিবেশের অধিবাসী বলা যায়। আরো কয়েকটি নাম-না-জানা অতিপ্রাকৃত সত্তা ছিল, যারা প্রসপেরোর আশ্রয়ে বাস করতো, বিশেষ করে নিরাবয়ব এরিয়েল। ক্যালিবান ও এরিয়েলের মধ্যে ছিল একটি বড়োমাপের পার্থক্য, ক্যালিবান মরণশীল মনুষ্য প্রকৃতির, কিন্তু এরিয়েল তা ছিল না। অতিপ্রাকৃত সত্তা মানুষের অবয়ববিহীন, প্রকৃতভাবেই অলীক, এ নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। তারা মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির বাইরে বাস করে, এ-কারণেই মানুষের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার প্রয়োজন তাদের নেই। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন তারা নির্যাতিত হচ্ছে, কারণ উপনিবেশ স্থাপনকারীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। এরিয়েলের রয়েছে জাদুর শক্তি, যেটা প্রসপেরো ব্যবহার করতে পারে। প্রসপেরো এরিয়েলকে সিকোরাক্সের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছে। আর এ-কারণেই সে এরিয়েলের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্যাপারটি ঠিক ক্যালিবানের মতো নয়। এরিয়েল তার কাজের বিনিময়ে মুক্তি প্রত্যাশা করে। তার এমন একটি গুণ আছে যা তাকে ক্যালিবানের থেকে উচ্চে স্থান দিয়েছে। সাময়িক দাসত্ব সত্ত্বেও প্রসপেরো এরিয়েলের অপরিহার্য কার্যক্রমের ব্যাপারে সচেতন এবং সে তাকে ক্যালিবানের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এসব সত্ত্বেও এরিয়েল প্রসপেরোর প্রতারণাপূর্ণ স্বার্থপরতার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে :



এরিয়েল : কঠোর পরিশ্রম করবো আরো?

শুধু কষ্টই দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।
প্রতিশ্র“তি মনে করিয়ে দিচ্ছি আপনার,
যা পূরণ হয়নি এখনো।
প্রসপেরা : তাই? রাগ দেখাচ্ছো?
কী চাও?
এরিয়েল : মুক্তি।
প্রসপেরো : সময়ের আগেই?
এরিয়েল : অনুনয় করছি,
স্মরণ করে দেখুন, কতো সেবা করেছি;
মিথ্যা কথা বলিনি,
ভুল করিনি আদেশ পালনে।১৪



প্রসপেরোর প্রতি দায়িত্ব পূরণ করার পরে এরিয়েলকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে প্রসপেরো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্র“তি দিয়েছে কিনা সেটা সুস্পষ্ট নয়। বিশেষত, প্রসপেরো এবং এরিয়েলের মধ্যে চুক্তির শর্ত সম্পর্কিত কোনো ইঙ্গিতও নেই, যেটা উপনিবেশের অধিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অবহেলাকেই প্রকাশ করে। প্রসপেরো শুধু যে স্বার্থপর তাই নয়, সে এরিয়েলের মুক্তি ও স্বাধীনতার গুরুত্বকে উপেক্ষা করে, কারণ উপনিবেশ স্থাপনকারী প্রসপেরো সেই সময়টা গণনা করছে যখন তার ক্রীতদাসেরা তাদের দেনা পরিশোধ করবে। আচরণের এই রীতিটি ইউরোপকেন্দ্রিক আধিপত্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং পরিণতিতে উপনিবেশের অধিবাসীদের কাছ থেকে আসে অনিবার্য প্রতিরোধ।



প্রতিরোধ, গৃহীত মূল্যবোধের ভেঙে পড়া

এবং তৃতীয় স্থানের সৃষ্টি
প্রসপেরোর বিরোধিতা করার মানে হলো তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং তার নিয়ম ব্যবস্থায় আটকে যাওয়া। হোমি ভাভার মতে, ঔপনিবেশিক অবস্থাটা সবসময়ই উপনিবেশ স্থাপনকারী ও উপনিবেশের অধিবাসীদের মধ্যে শক্তি বিস্তারকে জড়িত করে প্রতিপক্ষ ও তাদের সংস্কৃতির মধ্যে একটি ‘তৃতীয় স্থান’ সৃষ্টির মাধ্যমে। তিনি মনে করেন, সত্যের নির্মাণ ও ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আত্মনিষ্ঠতার সাহায্যে বাঁধাধরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। যেটা দেখা যায় প্রসপেরো ও ক্যালিবানের মধ্যে দ্বীপের বৈধ মালিকানা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্যে কিংবা ক্যালিবানের সমাজভুক্তিকে শ্রেণিবিন্যস্ত করার মাধ্যমে। নির্মাণ বা গঠন সাধারণত অস্থিতিশীল এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার ক্ষেত্রে শুধু একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। যদিও বাঁধাধরা ব্যবস্থা উদ্দেশ্যকে দৃঢ় এবং প্রসপেরোকে ক্ষমতা প্রদান করে। এই ব্যবস্থা পুনরাবৃত্তিকেও ধারণ করে, যেটা সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ করে ও সংশয়াপন্ন অবস্থাকে পরিবর্তনশীল করে তোলে। প্রসপেরোর ক্ষমতা একসময় ভেঙে পড়ে, যদিও ক্যালিবানের কাছ থেকে কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ আসে না।
প্রথমত, ভাষা স্বভাবতই পরিবর্তনশীল। শেক্সপিয়র ক্যালিবানের ভাষাগত দক্ষতার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সৃষ্টি করেননি। শেক্সপিয়র কেন এমন সামঞ্জস্যহীন চরিত্র সৃষ্টি করলেন? তিনি কেন অত্যন্ত মানবসুলভ গুণাবলির সঙ্গে বর্বর প্রকৃতি যুক্ত করলেন? ঘৃণ্য ক্রীতদাস, যে ক্রমাগত বর্বর ‘অন্য’ হিসেবে চিত্রিত হয়ে আসছে, সে ধারণ করে আছে মানুষের সবচেয়ে বড়ো একটি দক্ষতাকে, আর তা হলো ভাষা। ক্যালিবানের ভাষা উপস্থাপিত হয়েছে বিস্ময়করভাবে বহুমুখী হিসেবে, যেটা চিহ্নিত হয়েছে তার বুদ্ধিদীপ্ত জবাব প্রদানের মাধ্যমে। অন্য অনেক সাহিত্যকর্মে, দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় যে, আফ্রিকীয়-মার্কিন ভাষাকে জোর দেওয়া হয়। আর এটা করা হয় সংস্কৃতির ঘাটতি কিংবা নিু সামাজিক অবস্থানকে বোঝানোর জন্য। নিচের উদ্ধৃতিতে দেখা যায় কীভাবে উপনিবেশ স্থাপনকারী প্রসপেরো ও মিরান্ডা ক্যালিবানের উন্নতির জন্য তাকে ভাষা শেখানোর চেষ্টা করে এবং পরবর্তী সময়ে তারা উভয়েই দেখে যে তাদের প্রত্যাশিত সাফল্যটি আসেনি।



মিরান্ডা : তোকে কথা বলতে শিখিয়েছি,

প্রতিদিন কতো কিছুই না চিনিয়েছি।
ছিলি তো অসভ্য বর্বর,
কিছুই বুঝতি না।
পশুর মতো শব্দ করতি,
তখন তোকে ভাষা শিখিয়েছি।
কিন্তু তুই হচ্ছিস জঘন্য প্রাণী,
যদিও শিখেছিস, ভালো কিছুই হয়নি তোর।
ক্যালিবান : তুমি ভাষা শিখিয়েছো
তাতে লাভ হয়েছে আমার,
অভিশাপ দিতে পারি এখন।
প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণ করো,
তোমার ভাষা শেখাবার জন্য আমাকে।১৫



ক্যালিবানের স্পষ্ট কথাবার্তা ঔপনিবেশিক অবস্থায় প্রকাশ করে দেয় যে, ক্যালিবান প্রসপেরোর ভাষার মধ্যে ফাঁক খুঁজে পেয়েছে এবং এটার অপব্যবহার করেছে। ক্যালিবান আরো স্পষ্ট করে দেয় যে, ভাষা তার মৌলিক স্বভাব কিংবা সংস্কৃতিকে উন্নত করবে না, যেটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল। এর পেছনে কারণটা হলো, ভাষা নিজেই একটি নির্মাণ, যেটা স্থির নয়। আর এটা কখনোই সভ্যর বৈশিষ্ট্য হতে পারে না, কারণ এটা বর্বর অসভ্যরা ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া, ভাষা তার ব্যবহারকারীর মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে এবং উপনিবেশ স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ক্যালিবান এখন তার শয়তানি যে শুধু তার কাজের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে পারে তা নয়, বরং ভাষার মাধ্যমেও প্রকাশ করতে পারে। ভাষা প্রসপেরো ও ক্যালিবানকে একই পাল্লায় স্থাপন করেছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে, প্রসপেরো ও মিরান্ডার বোঝা উচিত ছিল যে, অঙ্গীভূত হওয়াটা নির্ভর করে উপনিবেশের অধিবাসীদের প্রতি ব্যক্তিগত সহযোগিতার ওপর। ক্যালিবান নিঃসন্দেহে অঙ্গীভূত হওয়াটাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ভাষাকে ব্যবহার করে প্রতিরোধের একটি প্রবেশপথ হিসেবে।



প্রসপেরোর ক্ষমতার অস্থিতিশীল গঠন

ক্যালিবানের আচরণ নিশ্চিতভাবেই প্রসপেরোর ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। প্রসপেরোর ক্ষমতার দাবি সে যে বিশ্ব থেকে এসেছে সেটার পুরোহিততান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই প্রোথিত। তার ক্ষমতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং এ-কারণেই স্বতঃসিদ্ধ, ফলে তার সামাজিক অবস্থান আইনসিদ্ধ কিনা সে-প্রশ্নের মুখোমুখি সে কখনো হয়নি। কিন্তু তার নতুন বিশ্ব এবং তার পুরনো ধারণাগুলো সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এর ফলে তার ক্ষমতা হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। একদিকে, একজন রাজা তার ক্ষমতার অধিকারকে রক্ষায় বারবার আত্মসমর্থন করতে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু প্রসপেরো তার ক্ষমতার অনুমোদন চায়। অন্যদিকে, উপনিবেশের অধিবাসীরা কখনোই বিদেশি রাজার শাসনে থাকতে চায় না, কারণ তারা প্রকৃতপক্ষেই দ্বীপের মুক্ত অধিবাসী। যারা প্রসপেরোর মাধ্যমে নির্যাতিত তারা তার আদেশ পালন করতে চাইবে না, সুতরাং প্রসপেরোর তাদের তার শাসন মেনে নিতে বাধ্য করা প্রয়োজন, সেটা বলপ্রয়োগ করেই হোক কিংবা বখশিশ দিয়েই হোক না কেন। ক্যালিবানকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে ও বন্দি করে রাখা হয়েছে প্রসপেরোকে মান্য করার জন্য, আর এরিয়েলকে কাজের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হবে - এই প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছে। যদিও ক্যালিবান পরাধীন, সে পরোক্ষভাবে প্রসপেরোর দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করে, কারণ সে তার ওপর নির্ভরশীল।


ক্যালিবান : শুধু পরাধীন বলতে আমিই এখানে,

আমিই ছিলাম রাজা।
এই আমাকেই শক্ত পাথরে বেঁধেছেন,
কেড়ে নিয়েছেন এই দ্বীপ।১৬



প্রসপেরোর তার অধস্তনদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার আসল কারণটা প্রতিফলিত করে তার হুমকিগ্রস্ত, টলায়মান কর্তৃত্বকে। একজন শাসনকর্তার ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন নির্ভর করে অধীনদের আনুগত্যের ওপর। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রসপেরো ক্যালিবানের বিরুদ্ধে তার ক্ষমতাকে বারবার সুসংহত করতে চায় এবং একই সময়ে সে নিজেকে বোঝায় যে তার কর্তৃত্ব ন্যায্যতাপ্রাপ্ত হয়েছে :



প্রসপেরো : তুই মিথ্যাবাদী জানোয়ার,

তোর প্রয়োজন বেত্রাঘাত, দয়ামায়া নয়!
তোকে যতœ করেছি মানুষের মায়া মমতায়,
থাকতে দিয়েছি আমার সাথে।১৭



ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন তর্কবিতর্কে লিপ্ত হওয়া যে-কোনো শাসনকর্তার জন্যই একটু অস্বাভাবিক। যদি প্রসপেরো যথেষ্ট পরিমাণে আত্মবিশ্বাসী হতো তাহলে এই উস্কানিমূলক কথাটা উপেক্ষা করতে পারতো, কিন্তু সে অপ্রত্যাশিতভাবে তার ক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রতি একটি হুমকি দেখতে পায়।

হোমি ভাভা দাবি করেছেন, ‘জাতীয়তা গড়ে ওঠে আখ্যানের মতো করে, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থেকে নয়,’১৮ আর এ-কারণেই এটা ভঙ্গুর। শুধু জাতীয়তাই নয়, ক্ষমতার সম্পর্কও গড়ে ওঠে আখ্যানের মতো করে। একটি ‘তৃতীয় স্থান’ সৃষ্টির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রসপেরোর রাজনৈতিক উচ্চাশা এবং পরিবর্তিত হয়ে যায় তার উপলব্ধি। সে বুঝতে পারে শেখার মতো কোনো সাধারণ রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সত্য নেই, কারণ রাজনৈতিক মূল্যবোধের স্থায়ী আধিপত্যপরম্পরার কোনো সঙ্গতিপূর্ণ রূপায়ণ নেই।


প্রসপেরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্যালিবান প্রচেষ্টা

দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে স্পষ্ট বোঝা যায়, ক্যালিবান প্রসপেরোর সমাজে নিশ্চিতভাবেই আটকে গেছে। সে অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠে যখন সে তার ঔপনিবেশিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে চায়। জাহাজডুবিতে ভেসে আসা দুজন মানুষের সঙ্গে ক্যালিবানের দেখা হয়, এবং তার দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের একটি সুযোগ সে দেখতে পায়।
বিস্ময়করভাবে, সে এখানে পুরো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব করার চেয়ে তার প্রভুর প্রতিস্থাপন চায়। সে ট্রিনকালো ও স্টেফানোকে প্রসপেরোর সমপর্যায়ের ধরে নেয়, যেটা প্রমাণ করে পুরো ব্যবস্থা ও পুরোহিততন্ত্রের কাঠামোকে সে গ্রহণ করেছে, কারণ বেঁচে থাকার এটাই একমাত্র পথ। পরোক্ষভাবে, সে নিজেকে শাসনকর্তা হিসেবে যথেষ্ট মনে করে না। শুরু থেকেই ক্যালিবান অত্যন্ত বাধ্য আচরণ করে, তার বশ্যতাকে প্রকটভাবে বুঝিয়ে দেয়, কেননা স্বল্প ক্ষমতার একজন প্রভুর কাছ থেকে সে পুরস্কৃত হতে চায় :



ক্যালিবান : দ্বীপের সব উর্বর জমি দেখাবো,

আপনাদের পায়ে চুম্বন করবো,
আপনারাই দেবতা।১৯
...
ক্যালিবানের আছে
নতুন প্রভু, নতুন মানুষ এবার।২০



একদিকে ক্যালিবান নীচতার মধ্যেই কাজ পেতে চায় শুধু প্রসপেরোর কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, যেটা প্রকাশ করে তার গভীর হতাশা। অন্যদিকে সে তার অধিকতর খারাপ অবস্থা অর্থাৎ প্রসপেরোর অধীনতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ দেখতে পায়। ক্যালিবান একটি সাধারণ স্বার্থ খুঁজে পায়, তা হলো : তারা দুই পক্ষই বর্তমান শাসককে উৎখাত করতে চায় এবং প্রসপেরোর পতন থেকে সুবিধা ভোগ করতে চায়। এছাড়াও ক্যালিবান আরো বেশিকিছু বুঝতে পেরেছে, স্টেফানো ও ট্রিনকালোর জাদুবিদ্যা নেই, এবং এটা তাকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে, যা হীনতাভাব থেকে স্বল্প পরিমাণে হলেও মুক্তি দিয়েছে। সে তাদের ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাটাকে উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে তাদের শাসকের অনুভূতির স্বাদ দিয়েছে। সবশেষে সে তাদের ষড়যন্ত্র করার উৎসাহ দিয়েছে। প্রসপেরো সম্পর্কে ক্যালিবানের ধারণাটা স্পষ্ট :

ক্যালিবান : আমি এক অত্যাচারী জাদুকরের অধীন,
সে আমাকে ঠকিয়ে এই দ্বীপটি কেড়ে নিয়েছে।২১



ক্যালিবান প্রসপেরোকে শুধু যে শক্তিমত্তায় শ্রেষ্ঠ মনে করে তাই নয়, বরং বুদ্ধিমত্তাতেও শ্রেষ্ঠ মনে করে। প্রসপেরো তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতায় ক্যালিবানকে ধোঁকা দিয়েছে এবং দ্বীপের অধিকারবঞ্চিত করেছে। নিষ্ঠুর আচরণ উপনিবেশ স্থাপনকারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যে তার শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে লাভবান হয় বিশ্বাস প্রবণতার সুযোগ গ্রহণ ও উপনিবেশের অধিবাসীদের রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতার মাধ্যমে। এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে, ক্যালিবান প্রসপেরোর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে এবং নিপীড়নমূলক ক্ষমতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার প্রথম সুযোগটি লুফে নিতে চায়। প্রসপেরো ক্যালিবানের শুধু প্রভু নয়, উপনিবেশ স্থাপনকারীর ক্ষমতা প্রতিরোধে তার ব্যর্থতার মূর্ত প্রকাশ। প্রতিশোধ, প্রসপেরোর বিদায় এবং তার কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ক্যালিবানের স্বাভাবিক আকাক্সক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।

উপনিবেশের একজন আদর্শ অধিবাসীর মতো ক্যালিবান একাকী প্রসপেরোর বিরোধিতা করতে অসমর্থ, এজন্য তার সাহায্য প্রয়োজন। আর এখন, আরো বেশি অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণে ক্যালিবান বুঝতে পারে অন্য মানুষকে নিজের পক্ষে ভিড়িয়ে তার কার্যসিদ্ধির জন্য তাদের ব্যবহার করা যাবে। সে আন্তরিকভাবেই তার শক্তিকে উপনিবেশ স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে চালিত করে এবং চক্রান্ত করতে শুরু করে। একদিকে, ক্যালিবান প্রসপেরোর কথা বলতে গিয়ে বারবার ‘ধ্বংস’ শব্দটি ব্যবহার করে প্রসপেরোর ক্ষমতাকে জোর দেওয়ার জন্য : ‘আমার পরাক্রমশালী প্রভুকে আমি ধ্বংস করবো,’২২ অন্যদিকে, প্রসপেরোর নিজেরই তিলে-তিলে মৃত্যুর দিকে যাওয়া প্রসঙ্গে বলে : ‘তার এই নিস্তেজ অবস্থাই তাকে ধ্বংস করে ফেলবে।’২৩ এখানে ‘ধ্বংস’ করার অর্থ সহাবস্থানকে দূরে সরিয়ে তাকে বিদায় করে দেওয়া, কারণ এর পেছনে রয়েছে উপনিবেশের অধিবাসীর যন্ত্রণা, মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা ও হতাশা। এ-সত্ত্বেও ক্যালিবানের পরাজয় ঘটে শেষ দৃশ্যে যখন হঠাৎ করেই ক্যালিবান প্রসপেরোকে ভয় পেতে শুরু করে এবং বুঝতে পারে তাকে ধ্বংস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বেঁচে থাকার আশায় সে উপনিবেশ স্থাপনকারীর শাসনের নিচেই তার জীবনকে অতিবাহিত করতে থাকে।


অনুকরণ

আগেই যেটা বলেছি, যুগ্ম-বিরোধিতা ও অনড় উদ্দেশ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে যদি উপনিবেশের অধিবাসীরা সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ না করে। অনুকরণ সম্পর্কে ভাভার ধারণা, ‘উপনিবেশ স্থাপনকারীরা ভাবে যে তাদের সংস্কৃতিটাই আদর্শ সংস্কৃতি এবং উপনিবেশের ওই সমস্ত অধিবাসী এই সংস্কৃতিকে অনুকরণ করার মাধ্যমে এটার সমকক্ষ হতে চেষ্টা করে।’ প্রসপেরো উপনিবেশের তুলনায় নিজেকে ভিন্ন মনে করে এবং ক্যালিবানকে সামাজিক কাঠামো, আধিপত্যপরম্পরা ও ভাষা অবলম্বন করতে শেখায়। সংস্কৃতির সঙ্গে ক্যালিবানের এই অঙ্গীভূত হওয়াটা নতুন উপদ্রবকারীদের প্রতি আচরণের মাধ্যমে লক্ষ করা যেতে পারে :


ক্যালিবান : চমৎকার মানুষ এরা, নিশ্চয়ই প্রেতাত্মা নয়,

মনে হয় দেবদূত, হাতে স্বর্গীয় সুধা :
নতজানু হয়ে থাকবো আমি।



এখানে ক্যালিবানের অনুকরণ প্রকাশিত হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই মদ্যপানের কারণে এবং এটার প্রতি স্পষ্টত আসক্তির কারণে। আরো একটি ব্যাপার, ক্যালিবান কোনো এক দেবতার প্রতি তার বিশ্বাসকে প্রকাশ করে, যার সামনে সে নতজানু হয়ে থাকতে চায়। দেবতার প্রতি নতজানু হয়ে থাকাটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি অবলম্বিত ধর্মীয় প্রথা, যা ক্যালিবানও অবলম্বন করেছে।

অনুকরণের ধারণাটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, যেহেতু এটা প্রমাণিত যে উভয়ই একে অপরকে প্রভাবিত ও নকল করে। দ্বিধাবিভক্ত পরাধীন মানুষ ও অনুকরণের ধারণাগুলোর মধ্যে যদিও তর্কের অবকাশ রয়েছে তবুও বলা যায়, অনুকরণের ক্ষেত্রে সবসময়ই গোগ্রাসে গেলার একটি ব্যাপার থাকে, যা ক্যালিবানের ক্ষেত্রে জোর করে প্রয়োগ করা হয়েছে। অনুকরণ ধীরে-ধীরে ঔপনিবেশিকতার মতবাদকেই অনুসরণ করতে শুরু করে এবং উপনিবেশের মানুষের জন্য সৃষ্টি করে একটি নতুন হাইব্রিড পরিচয়।


হাইব্রিডিটি - প্রসপেরো ও ক্যালিবানের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ

নতুন কিছু সৃষ্টি করার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থার একটি সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে হাইব্রিডিটি বলা হয়। প্রসপেরোর পরিচয়, জাতীয়তা, জাতিতাত্ত্বিকতা এবং ঔপনিবেশিক উপাদান - প্রধানত ক্যালিবান, স্থানান্তর করেছে অস্পষ্ট হাইব্রিড সংস্কৃতির গঠনকে, যেটার উৎপত্তি হয়েছে একটি তৃতীয় স্থান থেকে। কিন্তু দ্য টেম্পেস্টে তৃতীয় স্থানটি উপনিবেশে বসবাসরত অধিবাসীর সংস্কৃতির আত্মীভূত হওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়নি, যদিও এটা স্থানান্তরের একটি জায়গা তৈরি করে, যেখানে সামাজিক কাঠামোর তৈরি হওয়াটা পুরোপুরি সফল হয় না। হাইব্রিডিটি আসলে ঔপনিবেশিক শক্তি অধিগ্রহণের পরিকল্পনাকে ধারণ করে।
প্রসপেরো নিজেকে ঔপনিবেশিকতা থেকে ভিন্ন মনে করে, কিন্তু এরপরও ক্যালিবান ও দ্বীপের অন্যান্য অধিবাসীকে উপনিবেশ স্থাপনকারীর নৈতিকতা, সামাজিক কাঠামো, আধিপত্যপরম্পরা, বিনিময়মূল্য, ধর্ম, এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদও অবলম্বন করতে জোরজবরদস্তি করে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জোর করে ভাষা শিখতে।
তত্ত্বগতভাবে ঔপনিবেশিক অবস্থাটা হতে পারে হাইব্রিড, কিন্তু ঔপনিবেশিকতাবাদের জীবন্ত বাস্তবতা সবসময় হাইব্রিডিটির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় না। উপনিবেশ স্থাপনকারীর ওপর ক্যালিবান একটি ছবি প্রতিফলিত করে, যেটা তার ও প্রসপেরোর মধ্যে একটি সাদৃশ্য সৃষ্টি করে। ফলে ক্যালিবান কটূক্তিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে এবং ভেবে নেয় তার ও উপনিবেশ স্থাপনকারীর মধ্যে একটি পার্থক্য সৃষ্টি হবে। উপনিবেশের অধিবাসীরা মানবজাতির অংশ হলেও প্রকৃতভাবে মানুষ হিসেবে গৃহীত নয়। প্রসপেরো, অন্যদিকে সাদৃশ্যকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ক্যালিবানকে তার ক্ষমতা ও পরিচয়ের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখতে পায়, কারণ ওই ক্ষমতা ও পরিচয় একটি ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যেটা সব সত্ত্বেও একটি ভঙ্গুর গঠনে পরিণত হয়। ভিন্নতার ওই ভঙ্গুর গঠনটা যদি ভেঙে পড়ে তাহলে একেবারেই কোনো ভিন্নতা থাকবে না, আর যদি কোনো ভিন্নতা না থাকে তাহলে অন্য সংস্কৃতিকে শাসন করার বৈধতাও থাকলো না। প্রসপেরো তার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ-কারণে তাকে বলপ্রয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্যালিবানকে পরাভূত করতে এবং এর ফলে সে তার ভিন্নতা ও কর্তৃত্ব জোর গলায় ঘোষণা করতে সমর্থ হবে।



ক্যালিবানের বেপরোয়া অবস্থা চূড়ান্তভাবে তাকে ফাঁদে আটকে ফেলে

ক্যালিবান ইতোমধ্যেই প্রসপেরোর সমাজে আটকে গেছে এবং তার ক্ষমতার কাঠামোর কাছে পরাজিত হয়েছে, যদিও এটা থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষণস্থায়ী প্রচেষ্টা তার ছিল। জাহাজডুবির পরে দ্বীপে ভেসে আসা স্টেফানো ও ট্রিনকালোর সঙ্গে ক্যালিবানের দেখা হওয়াটা দ্বীপের বৈধ মালিকানার ব্যাপারে তার কর্তৃত্বকে বোঝানোর একটি সুযোগ ক্যালিবান পেয়েছিল। প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে তার বক্তব্যে সে দাবি করে যে, প্রসপেরো তার কাছ থেকে দ্বীপটি কেড়ে নিয়েছে। ক্যালিবান এবার তার প্রভু প্রতিস্থাপনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে এবং এটা সে করে বিদ্যমান যে সামাজিক কাঠামোতে সে আছে সেটাকে দূর না করেই : ‘আপনি হবেন প্রভু, আর আমি সেবা করবো আপনার।’২৪ ক্যালিবান শুধু অন্য আরেক প্রভুর গোলামি করতে চায় তার বর্তমান জীবনব্যবস্থা থেকে মুক্তির আশায়। সর্বোপরি, সে নিজেকে সমাজের নিুশ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয় যে, সে একটি নিকৃষ্ট প্রাণী। প্রসপেরোর কর্তৃত্বের আগ্রাসী প্রতিরক্ষা শেষ পর্যন্ত সফল হয়, কারণ এটা ক্যালিবানের আচরণে সৃষ্টি করে একটি প্রধান পরিবর্তন। ক্যালিবানের পরাস্ত অবস্থাটা তার শেষ কথা পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে ঠিক এমনই :


ক্যালিবান : এখন থেকে আমি ভালো কাজ করবো,

আপনাকে মান্য করবো।
আমি এতোটাই গাধা
এই মাতালকে দেবতা ভেবেছি,
পূজা করেছি।২৫
ক্যালিবানের পিছিয়ে আসাটা অনিবার্য ছিল যখন সে প্রসপেরোর সঙ্গে সমন্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলে। তার পিছিয়ে আসা, বিশেষ করে যখন সে বলে : ‘এখন থেকে আমি ভালো কাজ করবো’২৬ প্রকাশ করে দেয় যে, সে উপনিবেশ স্থাপনকারীর ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে গেছে। তার ভালো কাজ প্রোথিত আছে প্রসপেরোর শিক্ষাপ্রদানে। যা তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে নেই। তার পরাজয় শুধু সামাজিক নয়, সাংস্কৃতিক স্তরেও ঘটেছে। প্রসপেরো ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি তার দুর্বলতা ও প্রতিরোধহীনতা উত্তর-ঔপনিবেশিকতাকেই নির্দেশ করে, যেখানে হাইব্রিডিটি সৃষ্টি হয় ক্যালিবানের টিকে থাকার একটি পথ হিসেবে। আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, প্রসপেরোর সঙ্গে মেলামেশার ফলে ক্যালিবান এক ধরনের নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। ক্যালিবানের পরবর্তী উন্নয়ন আরো অধিক পরিমাণে হবে। যদি সে তার প্রকৃত সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ছেঁটে ফেলে এবং ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রলেপ পড়ে তার গায়ে, আর ফলে সৃষ্টি করে একটি হাইব্রিড সংস্কৃতি।



উপসংহার

আমার আলোচনাটি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দ্বীপটির সামাজিক পরিবর্তনের মুহূর্তটির ওপর। এটা স্পষ্ট যে, পরিবর্তনের রূপান্তরযোগ্য তাৎপর্য নিহিত আছে উপাদানগুলোর স্থানান্তরের ভেতরে, আর এটাই একে অপরের পাশাপাশি রয়েছে উভয়ের অবস্থাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে। একদিকে ক্যালিবান তার ভূখণ্ড হারায়, অন্যদিকে সে লাভ করে শিক্ষা, যা তাকে ক্ষমতার দিকে যাওয়ার প্রবেশপথ দেখায়। সে এই ক্ষমতা তার শিক্ষক প্রসপেরোর আসন টলিয়ে দিতে ব্যবহার করে। প্রতিরোধ করতে উদ্যত হওয়ার পরে ক্যালিবান তার আকাক্সক্ষাকে চিহ্নিত করার, বাতিল করার, প্রবর্তন করার এবং তার নিজস্ব বিরুদ্ধ মতামত প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতাকে হারিয়ে ফেলে।
স্থানান্তর প্রক্রিয়াটা ঔপনিবেশিকতা রূপায়ণে আরেকটি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করে। শাসন প্রক্রিয়ার ঐতিহ্যে প্রসপেরোর ভাষা হয়ে পড়ে হাইব্রিড। ক্যালিবান, উপনিবেশের একজন অনির্ভরযোগ্য পরাধীন অধিবাসী হিসেবে সৃষ্টি করে ঔপনিবেশিকতার সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বের প্রতি সাংস্কৃতিক ভিন্নতার একটি জটিল সমস্যা। উপনিবেশ স্থাপনকারী যতোই অন্যকে নিরূপণ করতে চায় ততোই সাদৃশ্য অনিবার্যভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এটা ঘটে ঠিক সেই সময় যখন উপনিবেশ স্থাপনকারী ক্যালিবানের সঙ্গে নিজের জাতির তুলনা করতে যায়। শুধু প্রসপেরোই নয়, ক্যালিবানও তার বিশ্বটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভীত, যেখানে তারা উভয়েই অন্য জাতির তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করবে নিজেকে। সবশেষে, উপনিবেশের নির্যাতিত অধিবাসী পরাজিত হয়েছে, কারণ তার প্রতিরোধের একটি অংশ উপনিবেশ স্থাপনকারীর ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে।



তথ্যপঞ্জি

Achebe, Chinua. ‘An Image of Africa.’ The Norton Anthology of Theory and Criticism. Ed. Vincent B. Leitch et al. New York : W.W Norton & Company, 2001. 1783-1794
Bhabha, Homi. ‘The Commitment to Theory’ The Norton Anthology of Theory and Criticism. Ed. Vincent B. Leitch et al. New York : W.W Norton & Company, 2001. 2379-2397
Shakespeare, William. The Tempest. Ed. Frank Kermode. London: Routledge, 1988. 2-134.
Fanon, Frantz. ‘Toward the African Revolution : Political Essays.’ Grove Press/ Atlantic Monthly Press. New York
১. উইলিয়াম শেক্সপিয়র, The Tempest, ed. Frank Kermode (London, Routledge, 1988) 2.
২. শেক্সপিয়র ২৮।
৩. শেক্সপিয়র ৬৪।
৪. শেক্সপিয়র ২৯।
৫. শেক্সপিয়র ৩২।
৬. শেক্সপিয়র ২৯।
৭. Frantz Fanon, Toward the African Revolution: Political Essays (New York: Grove Press/Atlantic Monthly Press, 1969)66.
৮. শেক্সপিয়র ৩০।
৯. শেক্সপিয়র ৩০।
১০. শেক্সপিয়র ৩১।
১১. শেক্সপিয়র ৩১।
১২. শেক্সপিয়র ৬৪।
১৩. শেক্সপিয়র ৬৫।
১৪. শেক্সপিয়র
১৫. শেক্সপিয়র ২৫।
১৬. শেক্সপিয়র ৩১।
১৭. শেক্সপিয়র ৩২।
১৮ Homi Bhabha, “The Commitment to Theory.” The Norton Anthology of Theory and Criticism, ed. Vincent B. Leitch et al, (New York: Norton & Company, 2001) 2377.
১৯. শেক্সপিয়র ৬৭।
২০. শেক্সপিয়র ৬৯।
২১. শেক্সপিয়র ৮০।
২২. শেক্সপিয়র ৮০।
২৩. শেক্সপিয়র ৮৩।
২৪. শেক্সপিয়র ৮০।
২৫. শেক্সপিয়র ১৩১।
২৬. শেক্সপিয়র ১৩১।

২টি মন্তব্য: