উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব


গত তিন দশকব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং উপনিবেশবাদের সমালোচনা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধে লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্য বিশ্লেষণ এবং মতামতের মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকলেও এগুলোকে ‘উত্তর-উপনিবেশবাদী’ বলে শ্রেণীকৃত করা হয়। তার কারণ এসব রচনার সাধারণ আলোচ্য বিষয় ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রক্রিয়া ও কুফল এবং তার প্রতিক্রিয়া ও মোকাবেলা।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশবিরোধী তৎপরতা এবং সংঘর্ষের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং কেতাবি পরিপ্রেক্ষিতকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পর্যালোচনা করে উত্তর-উপনিবেশবাদী এসব রচনা। এই চর্চার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত শেষ পর্যন্ত উত্তর-উপনিবেশবাদকে একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনাতত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। এর মূল উদ্গাতা এডওয়ার্ড সাইদ। পরে যুক্ত হয়েছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমি ভাবা, স্টুয়ার্ট হল, অনিয়া লুম্বা, জ্ঞান প্রকাশ এবং আরও অনেকে।
উত্তর-উপনিবেশবাদ তত্ত্বের উদ্ভব কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয়, তা বলাই বাহুল্য। শুরুতে এটা সাহিত্যতত্ত্বও ছিল না। সাধারণ রাজনৈতিক উপনিবেশবিরোধিতা থেকে এর যাত্রা শুরু, যাকে সর্বপ্রথম কেতাবি রূপ দান করেন ফ্রাঞ্জ ফ্যানন তার বিখ্যাত ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস (১৯৫২) এবং দ্য রেচেড অব দ্য আর্থ (১৯৬১) গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এই মনোরোগ চিকিৎসক তার বইতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী যেসব জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয় সেগুলোকে সূত্রবদ্ধ করেন। তার আলোচ্য বিষয় অবশ্য সম্পূর্ণ রাজনীতিকেন্দ্রিক। তিনি দেখান উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম তিনটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এগোয়। প্রথম পর্যায়ে উপনিবেশিত জাতি রাজনৈতিক চেতনা লাভ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে জাতি তার আÍপরিচয় গড়ে তুলতে চায় নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর তৃতীয় পর্যায়টা হচ্ছে সরাসরি সংঘর্ষের। আলজেরিয়াতে কাজ করতে গিয়ে ফ্যানন লক্ষ্য করেন, ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশিতের ওপর কেবল বস্তুগত শোষণই চালায় না, তার মনের ওপরেও এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, সে নিজেকে অধমর্ণ বলে মনে করে। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরোধিতা ও মোকাবেলাও সক্রিয় হয়, অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশ মানে উপনিবেশের পরবর্তী পর্যায় নয়। যাই হোক, বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক এবং তার পরে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তাদের ওইসব আন্দোলনকে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি দিতে গিয়ে তারা যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক যুক্তি খাড়া করেন সেগুলোই উত্তর-উপনিবেশবাদ তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলে।
এডওয়ার্ড সাইদের বহুল আলোচিত অরিয়েন্টালিজম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। তার এই গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে উত্তর-উপনিবেশবাদ একটি সমালোচনাতত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার দ্য কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন (১৯৭৯), কভারিং ইসলাম (১৯৮১), কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম (১৯৯৩), প্রভৃতি যুগস্রষ্টা বই। সাইদ দেখিয়েছেন, অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব হচ্ছে ‘প্রতীচ্যের একটা বিশিষ্ট চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি, যার মাধ্যমে সে প্রাচ্যের ওপর তার প্রাধান্য বিস্তার করে, তাকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বিনির্মাণ করে, এবং তার ওপর কর্তৃত্ব করে।’ এইভাবে পাশ্চাত্য শুধু প্রাচ্যের ওপর নয়, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর তাবৎ দুর্বল জাতির ওপরেই উপনিবেশ চাপিয়ে দেয় এবং মানব প্রজাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেÑ একদিকে থাকে ‘পাশ্চাত্য’, অন্যদিকে ‘অন্যরা’। উপনিবেশ উপনিবেশিতকে মন-মানসিকতায় এতটাই অধমর্ণ করে তোলে যে সে এমনকি শোষণের প্রতিবাদ করার কৌশল ও ভাষা খুঁজে পায় না। সাইদ বলেন, উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার অর্থ কেবল নিজেদের ভূমি পুনরুদ্ধার নয়, নিজস্ব সংস্কৃতি নির্মাণ করাও। কিন্তু সমস্যা হল, ঔপনিবেশিক শক্তি তার চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এবং মূল্যবিচারপদ্ধতির মাধ্যমে উপনিবেশিতের বস্তুবিশ্ব ও মানসগঠনে মৌলিক রূপান্তর ঘটায় এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে চোখের আড়াল করে রাখে অথবা তাকে অবমূল্যায়িত করে, কিংবা তাতে ভেজাল মিশিয়ে দেয়। সে কারণে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের বিশুদ্ধ ও কার্যকর উপায়-উপকরণ মজুদ থাকে না উপনিবেশিতের হাতের কাছে। তাকে সেটা পুনরাবিষ্কার, পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন করতে হয়। সাহিত্যের প্রসঙ্গ যদি ধরি, তাকে নিজের ছাঁচ তৈরি করতে হয় প্রথমে পুনর্নিমাণ এবং পরে ক্রমান্বয়ে তাকে অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে।
গায়ত্রী স্পিভাক এর সঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্যকে যুক্ত করেন। অন্যদিকে হোমি ভাবার মতে, ঔপনিবেশিক উপনিবেশিতকে ‘তার মতো’ বানাতে চায়, সে পুরোপুরি ‘অপর’ হয়ে থাকবে না; কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনকারীর স্তরেও উঠবে না। তিনি এটাকে সঙ্করায়ন বলেছেন। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত তার ‘অব মিমিক্রি অ্যান্ড ম্যান’ প্রবন্ধে ভাবা বলেছেন, ঔপনিবেশিক চেয়েছে উপনিবেশিত তার আদলে গড়ে উঠুক, তার ‘দ্বিতীয়-স্থানত্ব’ অর্জন করুক, কিন্তু অবশ্যই থেকে যাক সেই ‘অপর’ই যা সে আগেও ছিল।
উপনিবেশবাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ‘বশংবদ’ তৈরি করা। উপনিবেশিত যেন সব সময় মনে করে সে ছোট, তার যা কিছু রয়েছে তার সব কিছুই উৎকর্ষের তুলনায় ঔপনিবেশিকের চেয়ে গৌণ, সে কারণে তার উচিত কেবল অনুকরণ ও অনুসরণ করে যাওয়া। ১৮৩৫ সালে ভারতের ইংরেজ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কর্তা ম্যাকলে বলেছিলেন, ‘প্রাচ্যের তাবৎ সাহিত্যও ইউরোপীয় এক শেল্ফ সাহিত্যের সমান সাংস্কৃতিক মূল্য ধারণ করে না।’ তার এই উক্তি তাদের ঔপনিবেশিক লক্ষ্যের উপস্থাপক। এই যুক্তির বলে উপনিবেশিতের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়িত করে, তাকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে, ইউরোপীয় শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। তার ফল কত মারাÍক হয়েছে তা বোঝানোর জন্য আলেক বেহমার তার ‘পোস্টকলোনিয়ালিজম’ প্রবন্ধে কয়েকটা উদাহরণ দিয়েছেন। নাইজেরীয় ঔপন্যাসিক বেন ওকরি তরুণ বয়সে মনে করতেন ‘ইংল্যান্ড হচ্ছে মহৎ গ্রন্থের দেশ।’ শেকসপীয়র ও ডিকেন্স পাঠ করে তার এই ধারণা জšে§ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ঔপন্যাসিক ভিএস নইপলও প্রথম দিকে ডিকেন্স পাঠের প্রভাবে ইংল্যান্ডকে ‘সাহিত্যের দেশ’ মনে করতেন। দ্য ওভারক্রাউডেড ব্যারাকুন-এ তিনি বলেছেন, ত্রিনিদাদের স্থানীয় ফুল জুঁইকে তিনি বিদেশী ফুল মনে করতেন, আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের ড্যাফোডিল তার মনে এতই উচ্চাসন দখল করেছিল যে সেটাকেই নিজেদের বাগানের সুপরিচিত ফুল বলে মনে হতো। এই উপনিবেশিত মনই রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বকে দিয়ে ইংল্যান্ডের রানীর ভারত আগমন উপলক্ষে লিখিয়ে নিয়েছিলÑ ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা।’ আসলে, তপোধীর ভট্টাচার্য যেমন বলেন, ‘অলিন্দশূন্য বাতায়নশূন্য সুরক্ষিত বন্দিশালায় আমাদের মেধা ও হƒদয় শৃংখলিত হওয়ায় আমরা যে আসলে আধিপত্যবাদী শক্তির পুতুল মাত্র, এই বোধের প্রকাশ ঘটেনি ইপ্সিত মাত্রায়।’ ব্যতিক্রম কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি জানতেন এই ঔপনিবেশিক শক্তি একটি যাঁতাকলের মতো। তাই তিনি সরাসরি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।
একটা সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতির তুলনায় অবমূল্যায়িত করার এই প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ উত্তর-উপনিবেশবাদী লেখকের কাছে লেখনির মাধ্যমে আÍ-সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উপনিবেশ-কাল এবং উপনিবেশ-পরবর্তী-কাল, উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশবাদী মনস্তত্ত্ব উপনিবেশিতের ওপর এতটাই গভীরভাবে প্রভাবশীল থাকে যে, উপনিবেশিত লেখককে এখানে দুটো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। প্রথমত, তার সামনে থাকে আঙিক, ভাষা ও মূল্যবিচার, এমনকি বিষয়েরও, যে কর্তৃত্বশীল প্রকৃতি ও মান স্থির করে দেয়া আছে তাকে অস্বীকার করে টিকে থাকার ঝুঁকি। দ্বিতীয়ত তার প্রতিস্পর্ধী নিজস্ব কোন মানের অনুপস্থিতি। সে কারণে বশংবদ লেখকরা, এমনকি উপনিবেশবিরোধী লেখকরাও অংশত, ঔপনিবেশিকের বিষয়চেতনা, ভাষা, আঙিক, উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প, তার কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে মান্য করেই লিখতে বাধ্য হন।
উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে নিসর্গতত্ত্বের একটা সম্পর্ক আছে। পরিবেশবাদী ভাবনা থেকেই নিসর্গতত্ত্বের উদ্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিশ্বময় যে পরিবেশ সংকট দেখা দিয়েছে তার জন্য দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে আসলে ইউরোপ ও আমেরিকা, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি পাশ্চাত্য। এই কারণে পরিবেশ সংকটকে ঔপনিবেশিক সংকটেরই একটা ফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনের পাঠ ও পর্যালোচনা ‘পরিবেশবাদ’ বা ‘পরিবেশতত্ত্ব’ নামে একটি জ্ঞানশাখার জš§ দেয়। এটি মূলত প্রকৃতি-বিজ্ঞানের একটি বিষয়। এর উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। ষাট এবং সত্তর দশকে শিল্প-কারখানার দূষণ আলোচনার কেন্দ্রে আসে। আশির দশকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টি। এটিকে অবলম্বন করে সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতকে পর্যালোচনা করতে গড়ে উঠছে ‘প্রতিবেশ সমালোচনাতত্ত্ব’, আমি যাকে সহজবোধ্য করতে সংক্ষেপে ‘নিসর্গতত্ত্ব’ বলছি। নিসর্গতত্ত্বে কয়েকটি দার্শনিক বিশ্বাস ও কাক্সক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন জটিল ও কৃত্রিম আধুনিকতা থেকে সরল এবং আসল প্রাকৃতিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন। কোনও কোনও নিসর্গবাদী আরও এগিয়ে বলেছেন, গ্রাম হচ্ছে সাময়িক নিষ্কৃতির জায়গা, আসল ও স্থায়ী নিষ্কৃতি মিলবে স্বর্গে প্রত্যাবর্তনে। নিসর্গতত্ত্ব রোম্যান্টিসিজমকে প্রশ্রয় দেয়। শৈশব, ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবিকা, প্রকৃতিমগ্নতা, আÍ-অচেতনতা, বৌদ্ধিক জাড্যতা এর বৈশিষ্ট্য। এসব কারণে নিসর্গতাত্ত্বিকরা রুশো, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ এবং কিটসকে ভীষণ পছন্দ করেন।
নিসর্গতত্ত্ব এখন পুরোপুরি একটি সাহিত্যিক তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়াতে চাইছে। মার্কিন মুল্লুকে পরিবেশ সংকট নিয়ে উপন্যাস লেখা হচ্ছে। এবং ইতিপূর্বে লিখিত সাহিত্যে পরিবেশ সংকট কীভাবে চিত্রিত হয়েছে তার অনুসন্ধান চলছে। আমরা খুব সহজেই একে উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে মেলাতে পারি। উত্তর-উপনিবেশবাদের একটি মূল লক্ষ্য উপনিবেশিতের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আÍপরিচয় নির্মাণ করা। তার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে নিজস্ব প্রকৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন এবং বিষয়, উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প এই প্রকৃতি থেকে আহরণ করা। আর লোকজ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিনির্ভর। আঙিক ও ভাষাও আসবে এই প্রকৃতি এবং তার মধ্যে জীবনযাপনকারী মানুষের জীবন থেকে। এভাবে একটা পর্যায়ে গিয়ে উত্তর-উপনিবেশবাদ ও নিসর্গতত্ত্ব হাত ধরাধরি করে হাঁটতে বাধ্য। ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব’ সেই নিসর্গচেতনা যার মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনা জড়িয়ে আছে, বা যখন ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতায় নিসর্গ বা নিসর্গচেতনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘আধুনিকতা’ শব্দটির সঙ্গে উপনিবেশবাদের গন্ধ জড়িয়ে আছে। কারণ, এই একটি শব্দ দিয়েই সাহিত্যবিচারের নতুন ইউরোপীয় মানদণ্ড দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় যা ‘অন্যদের’ অর্থাৎ প্রতীচ্যের বাইরের সব সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ‘অনাধুনিক’ ও ‘পশ্চাদপদ’, এবং ‘নিুমানের’ বা ‘বর্তমানে অচল’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা প্রথমে একটি ভাষা তৈরি করে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে এই ভাষার নির্মাণ ও লালন এবং সেই ভাষায় দক্ষ শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলা হয়। এই ভাষা ও শিক্ষা উপনিবেশিতকে শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাংলা সাহিত্যকে গড়ে-পিটে ‘মানুষ’ করার দায়িত্ব এরাই পালন করেন। সুতরাং এই সাহিত্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন, নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত কবিতার, হাজার বছরের ঐতিহ্য থাকলেও তা বিচ্ছিন্ন হয়ে ইউরোপের আদলে নতুন রূপে, নতুন রুচিতে পুনর্নির্মিত হতে থাকে। এটি হচ্ছে ‘ঔপনিবেশিক আধুনিকতা’।
ঔপনিবেশিক আধুনিকতার মোড়কে বাংলা কবিতাকে ‘যোগ্য’ করে তোলার কাজ সাফল্যের সঙ্গে করেন প্রথমত মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার মন এতটাই উপনিবেশিত হয়েছিল যে, তিনি এমনকি ব্যক্তিজীবনের মতো কবিতায়ও পুরোদস্তুর ইউরোপীয় হয়ে উঠতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। কিন্তু তার বিপুল সৃজনক্ষমতা ও রচনার শৈল্পিক উৎকর্ষ সত্ত্বেও তিনি ‘ইউরোপীয়’ মানুষ বা কবির স্বীকৃতি পাননি, ‘অপর’ই থেকে গেছেন। তার মোহভঙ্গ ঘটে, এবং হতোদ্যম হয়ে নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কাছে, এমনকি দেশেও প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন ইউরোপীয় আঙিক, রুচি ও সাহিত্যবিচারের মাপকাঠি। কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ঔপনিবেশিকের অনুকরণ ও অনুসরণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। রবীন্দ্রনাথও ঔপনিবেশিক ধারাকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু তার মধ্যে বিকল্প খোঁজার প্রয়াস লক্ষ্যযোগ্য। তিনি, বিশেষত কবিতায়, অন্তত বিষয়চেতনার দিক থেকে, ইউরোপের হুবহু অনুসরণ না করে প্রাচ্যের দিকে মুখ ফেরান। রবীন্দ্রনাথ বাংলার প্রকৃতিকেও আশ্রয় করেন, কিন্তু তার সাহিত্যিক ক্যারাভান পুরোপুরি উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনার ধারায় চলেনি, কিংবা তার নিসর্গচেতনাও ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করতে পারেনি। নজরুল ইসলামের উপনিবেশবিরোধিতা খুব আলোচ্য ও প্রশংসিত বিষয়। ফ্যানন-কথিত তিনটি বিষয়ই তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এডওয়ার্ড সাইদ, গায়ত্রী স্পিভাক এবং হোমি ভাবার দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন মেলে তার রচনায়। বিষয়চেতনা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প তিনি এই দেশ এবং প্রাচ্য থেকেই সংগ্রহ করেন, কাব্যজগৎ নির্মাণ করেন এদেশের হিন্দু-মুসলমানের হাজার বছরের লালিত ও চর্চিত ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-পুরাণকে আশ্রয় করে। কাব্যভাষা নির্মাণে ঔপনিবেশিক-প্রণোদিত ভাষার সঙ্গে মিশিয়ে দেন সর্বজনের মুখের ভাষা। তার নিসর্গপ্রীতি খুব প্রোজ্জ্বল না হলেও বাংলার প্রকৃতিকে তিনি ইউরোপীয় চোখে দেখেননি, এবং সবচেয়ে বড় কথা তাকে এঁকেছেন উপনিবেশবিরোধী চেতনাসম্পন্ন করে। এরপর বাংলা সাহিত্য এই চার মহারথীর পথেই এগিয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব তার একটি প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে, বলা বাহুল্য, এই চারজনকে আশ্রয় করেই। 
- See more at: http://www.jugantor.com/literature-magazine/2013/05/31/1807#sthash.Dqahabj1.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন