এডওয়ার্ড সাঈদ এবং উত্তর উপনিবেশ বিরোধী লড়াই

হুমায়ুন আজাদের কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক। ...........আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে/আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আমার আপন সুরে/ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিল ওদের শ্যাওলাপড়া সুর/আমি আমার মত স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম/ওরা আমাকে বাধ্য করেছিল ওদের মত ময়লাধরা স্বপ্ন দেখতে/আমি আমার মত দাঁড়াতে চেয়েছিলাম/ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল ওদের মত মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতে/আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম/ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা/আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম/ওরা আমাকে ওদের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে/ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য/ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব/ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক/ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলঙ্কার/আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি/আমি নতজানু হওয়ার বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম/এটা ওদের সহ্য হয় নি/আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি/আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।
........................... 

এডওয়ার্ড সাঈদের ক্ষেত্রে কবিতার চরণগুলো পরিপূর্ণ মিলে যায়। এমন এক সময় এ কিংবদন্তি জন্মেছিলেন, যখন অধিকাংশ মানুষই তার মূল্য দিতে পারেনি। কেননা, তাবৎ জগতের অনেক দূরের ভবিষ্যত সাঈদ দেখতে পেয়েছিলেন। কাজ করেছেন তাকে নিয়েই। অতীতকে বিশ্লেষণ করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সমগ্র জীবন কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। উত্তর-আধুনিকতাবাদী দার্শনিক মিচেল ফুকোর দর্শনে প্রভাবিত হলেও তার চিন্তাধারার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিমত দেখা যায়। কেননা, ফুকো ছিলেন প্রচণ্ড রাজনৈতিক বিমুখ। অন্যদিকে সাঈদ রাজনীতির প্রতি যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন। তার স্বদেশ প্যালেস্টাইনের মুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাধানে তিনি বিশ্বাস করতেন। পশ্চিমাদের প্রাচ্য শোষণ উদঘাটন করতে পোস্ট কলোনিয়াল থিওরির বিকাশ ঘটান। যা তার একাধিক গ্রন্থে দেখা যায়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ওরিয়েন্টালিজমে উত্তর উপনিবেশিক শোষণের গতি প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দার্শনিক, সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবীরা কোন প্রক্রিয়ায় প্রাচ্যকে বিশ্লেষণ করেছেন, তা ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, উত্তর উপনিবেশিক শোষণকে প্রতিষ্ঠিত করতে অর্থনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রাচ্যকে অবদমিত রাখার চেষ্টা হয়েছে। 

সাঈদ ছিলেন একজন যথার্থ বুদ্ধিজীবী। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে বা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র আলোচনায় কদাকার দিকটি উন্মোচিত হয়। কেননা, বহুজাতিক বা সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করাই এদের প্রধান লক্ষ। কিন্তু, সাঈদ ছিলেন তার বিপরীত। এ কারণেই প্রবন্ধের শুরু করা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত কবিতা ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ দিয়ে। অর্থাৎ, সাঈদ তথাকথিত প্রতিষ্ঠাবাদী মনোভাব থেকে সবসময় দূরে ছিলেন। যথার্থ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নিরূপণে অ্যান্তোনিও গ্রামসীর অভিমত নিয়ে আসা যেতে পারে। গ্রামসী তার বিখ্যাত প্রিজন নোটবুকস-এ দু’ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করেছিলেন। তা হচ্ছে- প্রথাগত (traditional or conventional intellectual) এবং মৌলগত(organic) বা সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী। তিনি সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজের বিশাল একটা শ্রেণীকে চি‎িহ্নত করেছেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, পুরোহিতসহ যারা চিন্তা করেন ও প্রচার করেন তাদের সবাই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু, যারা সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় কোন ভূমিকা রাখেন না তারা প্রথাগত বুদ্ধিজীবী। বিপরীতে, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যারা প্রতিনিয়ত কাজ করেন তাদেরকে গ্রামসী সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিচারে এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন নিঃসন্দেহে সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী। তার রিপ্রেজেন্টেশন অব ইন্টেলেকচ্যুয়াল-এ সাঈদের নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। তার মতে, বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিনিধিত্ব করা। সুস্পষ্টভাবে লাঞ্জিত, নিপীড়িত, অবদমিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করাই একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ। যারা ক্ষমতাহীন এবং যাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। 


অরিয়েন্টালিজম-অনবদ্য সৃষ্টি 
 
অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থটি এডওয়ার্ড সাঈদ ১৯৭৮ সালে রচনা করেন। তবে প্রাচ্যবাদ বিষয়ক তত্ত্ব আগে থেকেই ছিল। অরিয়েন্টালিজম এবং সাঈদের কাজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বুদ্ধিজীবী ডক্টর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বেশ কিছু কাজ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি প্রবন্ধ নতুন দিগন্তের জানুয়ারি-মার্চ ২০০৪-এর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম ‘এডওয়ার্ড সাঈদ কেন গুরুত্বপূর্ণ?’ আলোচ্য লেখায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাবনা থেকে কিছু সহায়তা নেয়া হবে। এছাড়া অরিয়েন্টালিজম বইয়ের বাংলা অনুবাদ ইতিমধ্যে আমীনুর রহমান কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে। গ্রন্থটিতে প্রাঞ্জলভাবে সাঈদের ভাবনা উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রাচ্য বলতে মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া মহাদেশকে বুঝানো হচ্ছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য হচ্ছে উত্তর আমেরিকাসহ উইরোপ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্পর্ক নিরূপনে এডওয়ার্ড সাঈদ অরিয়েন্টালিজম বইটি রচনা করেন। গ্রন্থটি রচনার পর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার তৈরি করে। আমরা জানি, দীর্ঘ দুইশ’ বছর ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ শোষণ করে। এ চিত্র শুধু ভারতবর্ষে নয় এশিয়ার অন্যান্য দেশ এবং ল্যাটিন আমেরিকাও এ ভাগ্য বরণ করে। সে সময় ঔপনিবেশিক শক্তি গোটা দুনিয়াকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসে। অর্থনৈতিক লুন্ঠনকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা সাংস্কৃতিকভাবেও অধীনস্ত জাতিগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশিক প্রথা বাতিল হয়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ প্রধান আকারে উপস্থিত হয়। আগের মত দেশ দখল এখন আর হচ্ছে না। শোষণের রূপ পরিবর্তিত হয়ে যায়। যদিও রাজনৈতিকভাবে কথিত স্বাধীনতা এ ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুঁজি লগ্নী থেকে শুরু করে প্রযুক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বাজার দখলের পর্ব সূচিত হয়। বহুজাতিক পুঁজির উদ্ভব ঘটে। ফলে এমন একটা ব্যবস্থা কার্যকর রাখতে সাংস্কৃতিকভাবেও শোষিত জনগোষ্ঠীর উপর অবদমন পরিচালনা অনিবার্য। যদিও সাংষ্কৃতিক এ অবদমন সাম্রাজ্যবাদ পর্বের অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ অবদমনের রূপকে সাঈদ তার অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে উন্মোচিত করছেন। কার্ল মার্কস সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্টভাবে শ্রেণী শোষণ এবং লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতার বিকাশকে সজ্ঞায়িত করেন। কিন্তু, মার্কসের আগেও শ্রেণী শোষণ ছিল। তেমনি, প্রাচ্যবাদ আগে থেকে বিরাজ ছিল। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, সাঈদ প্রাচ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘সৌন্দর্যতাত্ত্বিক, বিদ্যাভিত্তিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক রচনাতে (টেক্সট) প্রাচ্য সংক্রান্ত ভূরাজনৈতিক সচেতনতার বিবরণ বলে। ব্যাপারটা কেবল সাংস্কৃতিক নয়, আদর্শিকও বটে। এবং তা রাজনৈতিক। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই। কেননা, প্রাচ্যবাদের সাথে ক্ষমতার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। ঔপনিবেশিক শাসকরা চেয়েছে, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ক্ষমতা। যার সাথে ঔপনিবেশিক রাজনীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। 
প্রাচ্য এবং প্রাচ্যবাদকে এক সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। কেননা, প্রাচ্য হচ্ছে জীবন্ত। আমরা যে ভূখণ্ডে অবস্থান করছি তাই প্রাচ্য। অন্যদিকে প্রাচ্যবাদ হচ্ছে সেই জীবন্ত সত্ত্বার একটি চিত্র নির্মাণ। যে চিত্র পরিপূর্ণভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত, এবং সে কারণে বিকৃত। সাঈদ দেখিয়েছেন প্রাচ্যবাদী লেখক, সাহিত্যিকরা মনের দিক দিয়ে ঔপনিবেশিক। তারা প্রাচ্যের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এবং সে উদ্দেশ্যে জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। প্রাচ্যের ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি পাঠ করে এবং ভ্রমণে এসে প্রাচ্যবাদীরা বিভিন্ন তথ্য লাভ করেছেন। এর ভিত্তিতে মনগড়া প্রাচ্যবাদী তত্ত্বের সাহায্যে তারা প্রমাণ করেছেন, প্রাচ্য হচ্ছে পশ্চাৎপদ, অলস, ইন্দ্রিয়বিলাসী। প্রাচ্যবাসীরা মানুষ হলেও ঠিক মানুষ নয়। তারা নিজের কথা নিজে বলতে পারে না। তারা বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, প্রাচ্যের মঙ্গলের জন্যই পাশ্চাত্য তাকে শাসন করছে। সাঈদের এই চিন্তন প্রক্রিয়া গড়ে উঠার পেছনে দীর্ঘ এক পটভূমি রয়েছে। তার জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করলে তা স্পষ্ট হয়। সাঈদের জন্মস্থান প্যালেস্টাইনে। ইহুদি দখলদারিত্বের ১৩ বছর আগে তিনি সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। সবারই জানা রয়েছে, পাশ্চাত্য শক্তির মদদে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের উদ্ভব। 

প্যালেস্টাইন এবং উপনিবেশিক বন্দিত্ব 
 
ইসরাইলি জায়নবাদের বিরুদ্ধে প্রতিকি পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এডওয়ার্ড সাঈদ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ফিলিস্তিন ছিল উসমানিয়া সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। তখন থেকে ইউরোপের ধর্নাঢ্য ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে বসতি বিস্তারের উদ্দেশ্যে জমি কেনা শুরু করে। ইতিহাসবিদদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এ প্রক্রিয়া ১৮৭০ সালের কোন এক সময় শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হয়। ফলে উপনিবেশের হাত বদল হয়। প্যালেস্টাইনের নিয়ন্ত্রণ ইংল্যান্ডের অধীনে চলে যায়। ইহুদিদের এই স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে টিওডর হার্জেলের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হার্জেল পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। জিয়নবাদকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা। তিনিই প্রথম দাবি তুললেন প্রস্তাবিত ইহুদি রাজ্যটি প্যালেস্টাইনে হবে। এর আগে ১৯ শতকের শেষ ভাগে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা কিম্বা আফ্রিকার কোন একটি দেশে ইহুদিদের স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ইহুদি ব্যবসায়ীদের বা সমগ্র ইহুদি স¤প্রদায়ের অন্যতম নেতা রথশিল্ডের কাছে ইংরেজ মন্ত্রী বালফুর ইহুদিদের জন্য একটা আলাদা দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে এর পূর্বের কিছু ঘটনা নিয়ে আলোকপাত করা যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯১৫-১৬ সালের দিকে মিশরে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার হ্যানরি ম্যাকমোহন হাশেমীয় গোত্রের প্রধান ও মক্কা-মদিনায় নিযুক্ত ওসমানীয় গভর্নর হুসাইন ইবনে আলীর সাথে যোগাযোগ করেন। এখানে তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। ওই সময় তাদের অঙ্গীকার ছিল, বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোকে অবস্থান নিতে হবে। এর মাধ্যমে জার্মানির মিত্র উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলে তাদের রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হবে। ব্রিটিশ সরকারের ওই সময়কার ভাষ্যমতে, যুদ্ধে জয়লাভ করলে আরব দেশগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হবে। যা হাশেমীয় সাম্রাজ্যের অধীনেই থাকবে। কিন্তু, ব্রিটিশ সরকার আরবদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কেননা, ইহুদিদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালে তার ঐতিহাসিক ঘোষণায় প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মূলত হার্জেলের মতাদর্শ অনুযায়ী, প্রমিস ল্যান্ডের অংশ হিসেবে ইহুদি-ব্রিটিশ সমঝোতা অনুযায়ী সেদিন বালফোর এ ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার নেপথ্যে ইংল্যান্ডসহ সাম্রাজ্যবাদীদের গভীর চক্রান্ত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা ওই সময় দেখা গিয়েছিল, তা লুন্ঠনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসেবে এ আয়োজনের সূত্রপাত। ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে ছিল না, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলো নিজদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার ব্যাপারেও গোপনে আঁতাত করে। 
যুদ্ধের পরপরই জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আরব দেশগুলোর উপর ম্যান্ডেট আদায় করে নেয়। অর্থাৎ ওসমানীয় শোষণের পর এবার শুরু হয় ইউরোপীয় শোষণ। এক্ষেত্রে সিরিয়া, জর্ডান, পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকাসহ যে অঞ্চল নিয়ে আজকের ইসরায়েল গঠিত হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় ব্রিটিশরা। একদিকে প্রস্তাবিত চুক্তির লঙ্ঘন, অন্যদিকে লুন্ঠন-কোনভাবেই আরবরা মেনে নিতে পারেনি। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে অভিবাসিত হওয়া শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি সহযোগিতায় জমি ক্রয়ের মাধ্যমে গড়ে তোলে স্থায়ী আবাস। এ সময় আরবরা তাদের ভূমির উপর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ফলাফল হিসেবে ওই সময় ইহুদি-মুসলমানদের মধ্যে একাধিক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। তাছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন নীতির কারণে, জায়নবাদীদের অভ্যন্তরীণ সংহতি আরো দৃঢ় হয়। যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তারা জোর তৎপরতা চালায়। পরবর্তীতে. পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় লাখো লাখো ইহুদি অল্প সময়েই প্যালেস্টাইনে চলে আসে। 
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নবগঠিত জাতিসংঘে এজন্ডা হিসেবে উঠে আসে। প্যালেস্টাইনি ভূমির ৫৬% এলাকা ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ হবে কিনা তা নিয়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ভোটের আয়োজন হয়। এ সময় ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ইহুদি রাজ্যের পক্ষে ভোট দেবার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। ওই বছরের শেষের দিকে জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী, জায়নবাদীরা প্যালেস্টাইনি জনগণের ভূমি দখল করে নেয়। এখান থেকেই সংকট ক্রমাগত গভীর থেকে গভীরতর হয়। পরবর্তী চারটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরও প্যালেস্টাইনিরা নিজেদের ভূমির অধিকার তো দূরের কথা, বরং নিজেদের যা ছিল তাও হারায়। কিন্তু, প্যালেস্টাইনিরা ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থিত ইহুদিদের কাছে অস্ত্রের জোরে হারলেও নৈতিকভাবে কখনোই পরাজয় বরণ করেনি। ইসরায়েলি ট্যাংকের সামনে বীর বিক্রমে প্যালেস্টাইনি কিশোরের পাথর হাতে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা মাহমুদ দারবিশের সেই কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়- 
লেখো/এবং সবার উপরে/দয়া করে লিখে রাখো/আমি কাউকে ঘৃণা করি না/আমি কেড়ে নিইনি কারো সমূহ সম্পদ/কিন্তু আমি যখন অনাহারী/আমি নিদ্ধিধায় ছিঁড়ে খাই/আমার সর্বস্ব লুন্ঠনকারীর মাংস/অতএব সাবধান/আমার ুধাকে সাবধান/আমার ক্রোধকে সাবধান/যারা ধ্বংস করে/মানুষকে খুন করার নেশায় পাগল হয়ে যায়/সেই বর্বরদের বিরুদ্ধেই কেবল আমরা অস্ত্র ধরি/পৃথিবীটা বদলে গেছে/প্রবল ভূমিকম্পে উপত্যকার পুষ্প ঝরে যাক/তীক্ষ্ম ছুঁরি সংক্ষিপ্ত করুক পাখির কলগীতি/বারুদের গুঁড়োয় পুড়ে যাক শিশুর ভ্রুপল্লব। 

উদ্ভাস্তু জীবন এবং বেড়ে উঠা 
এডওয়ার্ড সাঈদ ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর প্যালেস্টাইনের জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মে ছিলেন খ্রীস্টান। কিন্তু, সমস্ত জীবন তিনি সেক্যুলার আদর্শ ধারণ করেছেন। ইসলাম ধর্ম নিয়ে তার ব্যাপক মাত্রায় কৌতূহল ছিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থ কভারিং ইসলাম-এ তা দেখা যায়। যুদ্ধ, নিপীড়ন ও উদ্ভাস্তু জীবনের মাধ্যমে তার শৈশব অতিক্রান্ত হয়। ১৯৪৮ পরবর্তী হাজার হাজার প্যালেস্টাইনি আরবের মত সাঈদের পরিবারও উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। আগ্রাসনের শিকার হয়ে সাঈদরা চলে আসেন মিশরে। ফলে তার এই উদ্ভাস্তু জীবনের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের পাশবিকতা সম্পর্কে শৈশবেই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। প্যালেস্টাইনের এ পরিস্থিতি তাকে রাজনীতি এবং দর্শনের প্রতি অধিকতর কৌতূহলি করে তোলে। প্যালেস্টাইনের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের হলেও হাজারো বছর ধরে এখানে খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মাবলম্ভীরা এক যোগে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু, ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখানকার গোটা বসতি উচ্ছেদ হয়ে পড়ে। পূর্বের ইহুদিদের কাছেও প্রকৃতপক্ষে নতুন রাষ্ট্রের শাসনকার্যে কোন ভূমিকা ছিল না। অভিবাসী ইহুদিরা এখানকার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। অতীত থেকে বসবাসকারী ইহুদিরা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যায়। ফলে এসব ব্যাপারগুলো সাঈদকে গভীর নাড়া দেয়। এডওয়ার্ড সাঈদকে শতাব্দীর অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিণত করতে এসব ঘটনা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় সময়জুড়ে বসবাস করলেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সাঈদকে কখনোই স্পর্শ করে নি। মুক্ত প্যালেস্টাইনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন আমৃত্যু। 
তার শিক্ষা গ্রহণের প্রথম বিদ্যালয় হচ্ছে প্যালেস্টাইনের এঞ্জেলিকান এসটি জর্জ একাডেমি। মিশরে চলে আসার পর তিনি ভর্তি হন ইংলিশ পাবলিক স্কুলে। পরবর্তীতে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যায়ন করেন। তার সহপাঠীদের মধ্যে এ সময় ছিলেন জর্ডানের বাদশাহ হোসেইন, সিরিয়া, সৌদি আরবের ধর্নাঢ্য শিল্প পরিবারের সন্তানরা। যারা পরে মন্ত্রী বা প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি বড় বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে তার অভিমত হচ্ছে, কলোনিয়াল ধাঁচের শিক্ষার মর্মবস্তু আমি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে ভালভাবে বুঝতে পেরেছি। সাঈদের পোস্ট কলোনিয়ালইজম বা উত্তর উপনিবেশিকতা সংক্রান্ত লেখায় কলোনিয়াল শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। ভিক্টোরিয়া কলেজে সাঈদ খুব বেশিদিন অধ্যায়ন করতে পারেনি। তাকে ১৯৫১-এ ওই প্রতিষ্ঠান হতে বহিষ্কৃত করা হয়। পরবর্তীতে সাঈদ হয়তো এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নের কারণেই পোস্ট কলোনিয়াল শিক্ষার হাল কী রকম তা বুঝতে পেরেছিলেন। সাঈদের বহিষ্কারাদেশ প্রমাণ করে উত্তর উপনিবেশিক ধাঁচের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তিনি একাত্ম হতে পারেন নি। বহিষ্কারের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন, যেখানে তার বাবা-মা পূর্ব থেকে বসবাস করছিলেন। এখানে মাস্যাচুসেটসে অবস্থিত মাউন্ট হ্যারমন স্কুলে ভর্তি হন। সাঈদ ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এবং আরবিতে লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রে সমপারদর্শীতা অর্জন করেন। ১৯৫৭ সালে প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয় হতে গ্র্র্যাজুয়েট এবং তৎপরবর্তী হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। 
এডওয়ার্ড সাঈদ ১৯৬৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ’৭৪ সালে তিনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং শিক্ষক হিসেবে কিছুকাল পড়ান। এছাড়া জন হপকিন্স, ইয়েলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে পড়ান। ১৯৯২ সালে সাঈদ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশ্রেষ্ট শিক্ষকের পদ মর্যাদা অর্জন করেন। তুলনামূলক সাহিত্য পড়াতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ অপরিসীম দক্ষতা অর্জন করেন। বলা হয়ে থাকে, শুধুমাত্র সাহিত্য সমালোচনাই যদি তিনি রেখে যেতেন, তবুও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। সাঈদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য বেশ মনযোগ নিয়ে পড়েছেন। তুলনামূলক পাঠের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাংস্কৃতিক পাঠ। সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে যে সমাজ থাকে এটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু, সমাজের পাশাপাশি যে নিবিড়ভাবে সংস্কৃতিও থাকে, এটা সাঈদ তার বিভিন্ন রচনায় যথার্থভাবে দেখিয়েছেন। 

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে 
 
সাঈদের মতে ব্রিটিশ, স্পেন বা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর আক্ষরিক অর্থে বর্তমানে উপনিবেশ না থাকলেও তাদের শোষণ এবং আগ্রাসন সমান্তরালে চলছে। কিন্তু তার ধরন এখন পরিবর্তিত। আগের মত সরাসরি দেশ দখল না করে তারা বর্তমানে মনস্তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে তাদের বাণিজ্যিক মুনাফা লুন্ঠনের প্রক্রিয়াও সম্পাদিত হচ্ছে। তিনি বলছেন, এসব আধিপত্যকামী রাষ্ট্রগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর জন্য পূর্বের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোকে ৩য় বিশ্ব রূপে চিহ্নিত করেছে। এক্ষেত্রে নিজেদের নাম দিয়েছে প্রথম বিশ্ব হিসেবে। এডওয়ার্ড সাঈদের দর্শন চিন্তার ক্ষেত্রে উত্তর আধুনিকতাবাদী চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়। উত্তর আধুনিকতা দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি উত্তর ঔপনিবেশিক শোষণকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন চমৎকারভাবে। অন্যান্য পোস্ট মডার্নিস্টদের মত জ্ঞান এবং ক্ষমতার মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক তাতে তিনি বরাবরের মত একমত পোষণ করেছেন। রাষ্ট্র বা বিভিন্ন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ক্ষমতাশীলরা নিজেদের প্রয়োজনে জ্ঞানের উদ্ভবের বিষয়ে মিচেল ফুকোদের সাথে তিনি সমভাব পোষণ করেছেন। যা হোক, সাঈদ তার উত্তর ঔপনিবেশিক মতবাদে বলছেন, বর্তমান সময়ে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে যে সাহিত্য এবং জ্ঞান চর্চা হয় তাতেও রয়েছে ঔপনিবেশিক প্রভাব। তার তত্ত্বের মধ্যে এসব সমস্যা যথাযথ চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্তির উপায়ও তিনি বাতলে দেন। বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাঈদ ছিলেন একজন কড়া সমালোচক। ইসরায়েল রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মী হিসেবে সাঈদ রাজপথেও ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৭ থেকে ’৯১ পর্যন্ত সাঈদ পিএলও’র শীর্ষ নির্বাহি ফোরাম প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 
প্যালেস্টাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দু’ রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে সাঈদ ছিলেন অন্যতম প্রস্তাবক। এ ব্যাপারে তিনি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিলের বৈঠকে ভোট দেন। কিন্তু পিএলও যখন অসলো চুক্তিতে অগ্রসর হয় তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। ১৯৯১ সালে মাদ্রিদে যখন অসলো চুক্তির প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন বিরোধের পশাপাশি এক পর্যায়ে পিএলও’র সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি এ সময় পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাতকে চিঠি লিখে বলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে প্যালেস্টাইনি জনগণ ১৯৬৭ সাল পূর্ব অখণ্ড ফিলিস্তিনে প্রবেশ করার যে অধিকার ছিল তা বিক্রি হয়ে গেছে। পাশাপাশি দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীকে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষের সাথে সাঈদের সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়ে যায়। তার বই প্যালেস্টাইনে নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ২০০০ সালে এহুদ বারাকের সাথে আরাফাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিষয়ে অস্বীকৃতি জানালে সাঈদ তা স্বাগত জানান। এর মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক পুনরায় উষ্ণ হয়। 

ফুকো এবং সাঈদের মতপার্থক্য 
মিচেল ফুকোর চিন্তার দ্বারা এডওয়ার্ড সাঈদকে প্রভাবিত হতে দেখা যায়। ফুকো ১৯২৬ সালের ২৫ জুন ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা নিয়ে তার ক্রিটিক্যাল স্টাডিজ, মানসিক রোগের পর্যেষণা ও চিকিৎসা, মেডিসিন, হিউমান সায়েন্স, কারাগার সিস্টেম, হিউম্যান সেক্সুয়ালিটির ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে ফুকোর কাজ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ফুকো নীটসে’র ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার এক স্বাক্ষাতকারে বলতে শুনা যায়, আমি নিটসিয়ান। যা হোক, ফুকো ছিলেন গত শতাব্দীর অসম্ভব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের একজন। ফুকো মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৪ সালে। তার কাজের সময়কালের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এক প্রচণ্ড অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ওই প্রেক্ষাপট অগ্রসর হয়েছে। ৬০-এর দশকের দিকে কাউন্টার কালচার মুভমেন্টের বিকাশ লক্ষ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল তা আর হয়নি। ফলে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়ে একাধিক চিন্তন প্রক্রিয়ার উদ্ভব দেখা যায়। ওই সময় প্যারিসে প্রচণ্ড গতিতে ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। ফুকো নিজেও ওই আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন। সে সময় হিপ্পি কালচার, ফেমিনিজম, নিউ লেফট, কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলন, ভিয়েতনামে যুদ্ধ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি সংঘটিত হয়। কিন্তু, এসব আান্দোলন বাস্তবিক অর্থে দীর্ঘমেয়াদে কোন ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় হতাশা ও বিষণœতা তৈরি হয়। ফুকোর জীবনেও এমন বিষন্নতা দেখা যায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু, অল্পকাল পরেই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে বের হয়ে আসেন। এর আগে মনস্তাত্ত্বিক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় মনোচিকিৎসকের শরাপন্ন হন। এর মাধ্যমে তিনি মনোবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করেন। তারই অংশ হিসেবে স্নাতক ডিগ্রির সমতুল্য একটি লাইসেন্সও অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে সাইকোলজি নিয়ে তিনি আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে কিছুকাল সাইক্রিয়াট্রিস্ট হিসেবেও ভূমিকা রাখেন। যা হোক, এখানেও তিনি খুব বেশি দিন ছিলেন না। ফলে, ফুকো নিজেও অস্থির সময়ের আক্রান্ত হয়েছিলেন। 
“তার মতে, ক্ষমতা কোন এক জায়গায় থাকে না। শিরা-উপশিরা ধরে বহমান রক্তপ্রবাহের মত সমাজদেহের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। কাজেই এতকাল যে ইতিহাস ও জ্ঞানতত্ত্বের মহাকাহিনী রচনার প্রয়াস চলছিল সেটা ভ্রান্ত। দ্বিপাক্ষিকতার পরিবর্তে চাই বহুপাক্ষিকতা। সাধারণীকরণের চেয়ে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে বিবেচনায় এনে নির্দিষ্টরূপে কথা বলা ভালো। ঐক্যের তুলনায় পার্থক্যের অনুসন্ধান অধিক জরুরি। সেটা করতে গিয়ে বিবেচ্য বস্তুটিকে যদি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করতে হয় তবে সে বিভিক্তিকরণে ক্ষতি নেই। বরং মঙ্গল রয়েছে।” (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) ফুকোর আরেকটি বিখ্যাত কাজ হচ্ছে জ্ঞান এবং ক্ষমতার সম্পর্ক। বলা হচ্ছে, জ্ঞান মানুষকে ক্ষমতা দেয়। আবার মানুষই জ্ঞান তৈরি করে নিজস্ব প্রয়োজনে। ফুকো বলছেন একটা সমাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিজেদের মসনদ রক্ষার্থে প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান তৈরি করে। এখানে জ্ঞান অর্থে মূল্যবোধকেও বুঝানো হয়ে থাকে। মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, নর-নারীর সম্পর্ক, ইশ্বর বিশ্বাস থেকে শুরু করে সবকিছুই ক্ষমতাসীনরা চাপিয়ে দেয়। অর্থাৎ এসব মূল্যবোধ জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফুকোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে ডিসকোর্স। সাঈদ বিভিন্নভাবে ফুকোর এসব চিন্তায় প্রভাবিত ছিলেন। মূলত, ফুকোর এ চিন্তাই হচ্ছে উত্তর আধুনকতাবাদী দর্শন। পাশাপাশি ফুকো বিপ্লব এবং সংগঠিত প্রতিরোধ বিশ্বাস করতেন না। যেহেতু ক্ষমতা খণ্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে আছে, ফলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জায়গাটা নির্দিষ্ট কোন স্থানে থাকবে না, থাকবে সর্বত্র। অর্থাৎ, পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে বিরাজনীতিকরণ। রাষ্ট্র ও সমাজে যে দুইটা পক্ষ রয়েছে, তা ফুকোর আলোচনায় অনুপস্থিত। সমাজে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের অবস্থান স্পষ্ট। এ দু’ শ্রেণীর দ্বন্দ্বের ব্যাপারটি ফুকো এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু, সাঈদের ক্ষেত্রে ওই রকম দেখা যায় না। কেননা, সাঈদের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে উপরেই আলোচনা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের মুক্তি আন্দোলনে তার অবস্থান বহুল স্বীকৃত। পাশাপাশি পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার নিয়ে অরিয়েন্টালিজমে তার মত দেখা যায়। 

সাঈদের অন্যান্য কাজ 
সাঈদের প্যালেস্টাইনের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বইও আছে, তা হচ্ছে- দ্যা কোয়েশ্চন্স অব প্যালেস্টাইন (১৯৭৯), দ্যা পলিটিকস অব ডিসপজেসন্স (১৯৯৪), দ্যা অ্যান্ড অব দ্যা পিস প্রসেস (২০০০)। এছাড়া তার অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত বইগুলো হচ্ছে দ্যা আরবস টুডে ঃ অলটারনেটিভ ফর টুডে (১৯৭৩), বিগেনিং ঃ ইনটেনশন অ্যান্ড মেথড (১৯৭৫), লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি (১৯৮০), দ্যা মিডল ইস্ট ঃ হোয়াট চ্যান্স ফর পিস? (১৯৮০), কভারিং ইসলাম (১৯৮১), ক্রিটিসিজম ইন সোসাইটি (১৯৮৭), কালচার অ্যান্ড ইম্পেরিয়ালইজম (১৯৯৩), কালচার অ্যান্ড রেসিস্টেন্স ঃ কনভারসেশান উইথ এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদসহ (২০০৩) আরো একাধিক গ্রন্থ। এ মহান চিন্তানায়ক 
২০০৩-এর ২৫ সেপ্টেম্বর লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে নিউইয়র্কে মৃত্যু বরণ করেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন