ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতায় জীবনানন্দ দাশ

রহমান মতি

সাম্রাজ্য বৃদ্ধির বহু অনুশীলনের একটি উপনিবেশ গঠন করা। উপনিবেশবাদ তাই প্রতিষ্ঠিত ধারণা হিসেবে বিশ্বের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রবাহটি এত পরিকল্পিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিসমপন্ন যে বড় থেকে ছোট পরিসরে তার আয়োজন এতটুকুও স্তিমিত হয় না। ভারতবর্ষে পশ্চিমা আধুনিকতার বিকাশ গত শতকের কিছু সময় এবং বর্তমান শতকের সময়ে অভূতপূর্ব রূপান্তরের দিকে যাচ্ছে। উপনিবেশের ধারণাগুলো সেই ইউরোপীয়, ব্রিটিশদের কাছ থেকে এসে ভারতবর্ষের মননে প্রবেশ করেছে। আমরা ভারতীয় উপনিবেশ সমপর্কে একটি মন্তব্য দেখে নিতে পারি—'ভারতীয় উপমহাদেশ, উপনিবেশ সত্ত্বেও ভারতই ছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছরের সেই ভাষা-সাহিত্য, দর্শনশাস্ত্র, তত্ত্ববিদ্যা ইত্যাদির ওপর পাশ্চাত্যবিদ্যার আক্রমণ ঘটেছিল এমন সর্বাত্মক যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভিতসুদ্ধ নড়ে গিয়েছিল'।


শিল্পের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো খুব কম লোকই শিল্পকে বোঝে। যারা বোঝে তারা একে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় আর যারা বোঝে না তারা শিল্পকে যথাসম্ভব পৃষ্ঠপোষকহীন করে তোলে। তাদের মন-মানসিকতার এক ধরনের লক্ষণ থাকে। আচরণ কিংবা প্রয়োগগত পর্যায়ে তারা শিল্পের সম্ভাবনা ও বিস্তৃতি ম্লান করে দিতে চায়। প্রাত্যহিক সামাজিকতার স্বাভাবিক প্রথাসিদ্ধজীবনেই তাদের আস্থা। জীবনানন্দ দাশের উপনিবেশগত অবস্থা ভিন্ন। লেখকের গড়া শিল্পই তাঁর জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। জীবনানন্দ এ সত্যটিকে সমসাময়িক জীবন ও পরিবেশে খুব সচেতনভাবে প্রথম পর্যায়ে গ্রহণ করেননি। যদি গ্রহণ করতেন তাঁর জীবনকাল এত যন্ত্রণাকাতর হতো না। লেখকের উপনিবেশকে তিনি বুঝতে পেরেছেন কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যকার সমপর্ক, আচরণ, প্রাত্যহিক জীবন—এসবের মধ্যে অজস্র অভিজ্ঞতা ও আহরণের পথ ধরে শিল্পের শরীর গঠিত হয়। তবে প্রতিষ্ঠা মননে এবং জনসংযোগ ঘটে চর্চায়। জীবনানন্দ তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে সামাজিকভাবে ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তার সঙ্গে সমকালীন সমাজ পূর্ণভাবে ব্যঙ্গ করেছে। তিনি যে লেখা লিখেছেন তার সঙ্গে মানসিকতা, স্থান-কাল-পাত্রভেদে নানা ভেদ ছিল। কোনোটা প্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি, রাজনৈতিক, মানসিক ইত্যাদি। পত্রের মাধ্যমে চাকরি বা কাজের অনুরোধ করে কোনো সাড়া পাননি জীবনানন্দ। জীবনানন্দ জানান, তিনি নাকি জানতেন মানুষের মধ্যে নৈতিকতা আছে। তিনি মানুষের নৈতিকতায় বিশ্বাসীও ছিলেন—এটি বিভিন্নভাবে বলেছেন। তাঁর বিশ্বাস এবং তখনকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুটির মধ্যে ফারাক ছিল। সাগরময় ঘোষকে কাজের ব্যাপারে বলেছেন, ফল পাননি। 'তোমাকে ভালোবেসে' কবিতাটি পত্রিকায় পাঠানোর পর এটি ছাপানো হয়নি। বাড়তি ট্রাজেডি হলো, কবিতাটি জীবনানন্দের কাছেই আবার ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখনকার কথা যদি বলা যায়, 'তোমাকে ভালোবেসে' জীবনানন্দের অন্যতম রোমান্টিক ও আধ্যাত্মিক কবিতা।

পুঁজিকে জীবনানন্দ মন থেকেই পছন্দ করতেন না। লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে পুঁজি-ই যে শেষ ভরসা তা জীবনানন্দ অনুধাবন করতে চাননি। পুঁজি দেবার মানসিকতা যেমন ছিল না তেমনি তার প্রতিষ্ঠা তো আরও ছিল না। ওপর লেবেলে টাকা বা ঘুষ দেবার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁর ছিল না। এর সুযোগ নিয়ে তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে। 'ক্যামেপ' কবিতা নিয়ে সজনীকান্ত দাস 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় অশ্লীলতার অভিযোগ তুললে জীবনানন্দের চাকরি যাবার মতো প্রসঙ্গও এসে যায়। কবিতা না বোঝা বা তার যথার্থ মূল্যকে বুঝতে না পেরে এরকম অনেকে জীবনানন্দের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। জীবনানন্দ দু-একবার জবাব দিয়েছেন কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এটি লেখকের গড়া উপনিবেশ। প্রতিভা আছে অথচ পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও অনুধাবনযোগ্য, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এ সংক্রান্ত মন-মানসিকতার সমস্যা বেশি। পরশ্রীকাতরতা একটি ফ্যাশনের মতো দাঁড়িয়েছে। এর প্রকাশ সম্ভবত তত্কালীন সময় থেকেই শুরু হয়। জীবনানন্দ কাজ খুঁজেছেন পাননি। অর্থনৈতিক মুক্তির চেষ্টা তাঁর ছিল। চাকরি যেমন হারিয়েছেন চাকরি কম যে পেয়েছেন তা নয়। দিল্লির রামযশ কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ, বরিষা কলেজ—এসব প্রতিষ্ঠান তখন উঁচুমানের ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গাতেও কাজ করেছেন।

প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতার বিষয়টিও ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতার বড় অংশ। যেকোনো প্রতিষ্ঠান মিডিয়া নামক ব্যাপারটিকে প্রভাবিত করে। কারণ, প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিকে উঁচু এবং নীচু দুটিই করতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকলাপ জীবনানন্দ নিজে দেখেছেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। মিডিয়ার অপতত্পরতার শিকার হওয়া তাঁর জন্য তাই স্বাভাবিক যেহেতু তিনি তখন নাম কুড়িয়েছেন। স্বীকৃতি তারপরেও সবার আগের কথা। স্বীকৃতি নেই তো সমাজে কোনো মূল্যই নেই। একবার স্বীকৃতি পেলে তাকে নিয়ে নতুন বাণিজ্য প্রবর্তিত হয়। পাঠককে পুঁজির উপাদান বানানো হয়। পুঁজির উপাদান হলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এই প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষে ছিলেন সজনীকান্ত দাসের মতো মিডিয়কাররা। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন চলেছে। তিনি শুধু জীবনানন্দের কবিতাকে প্যারোডি করেছেন, তা নয়। তাঁর হাত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁরাও বড় সাহিত্যিক হিসেবে সজনীকান্তের মানসিকতার শিকার হন। যদিও তাঁদের সমস্যা তৈরি হয়েছে সামান্যই। কিন্তু স্বীকৃতিহীন জীবনানন্দকে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল ঔপনিবেশিকতার প্রবণতা। প্রতিষ্ঠান যখন এমন আচরণ করেছে জীবনানন্দের পাশে ব্যক্তিবিশেষের ছায়া জরুরি ছিল। তাই বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দীলিপকুমার গুপ্ত, ভূমেন্দ্র গুহ তাঁদের মতো ব্যক্তিত্বরা কর্তব্য মনে করে এগিয়ে আসেন। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বৈত অবস্থানে মধ্যকার জীবনানন্দ দাশ তখন বিশ শতকের অন্যতম প্রধান আলোচিত একজন সাহিত্যিক। এও বাস্তবতা। সমাজটাই ছিল এমন তাই তার বাস্তবতা এত নেতিবাচক। আমাদের বুঝে নিতে হবে বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্যদের মতো মানুষেরা জীবনানন্দের সহযাত্রী এবং প্রাতিষ্ঠানিক আক্রমণের বাইরে ছিলেন। কিন্তু সঙ্গে ওই বাস্তবতাটিকে দেখতে হবে যা সামাজিকতাকে তুলে ধরেছে অনেকটাই অসামাজিক আচার-ব্যবস্থার মাধ্যমে। বুদ্ধদেব বসুরা সেখানে ব্যবস্থাটির প্রতিবাদী সচেতন ব্যক্তিমাত্র।

আমরা এরপর দেখব মানসিকভাবে গ্রহণ করা ঔপনিবেশিক ধ্যানকে। প্রক্রিয়াটি যে ঐতিহাসিক ও ক্রমবিবর্তনমূলক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধারণাগুলো মানসিকতার সূক্ষ্ম অবস্থা এবং বিভক্ত করে দেবার ফল। সে ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। জীবনানন্দকে তত্কালীন সময়ে তাঁর নাম সংক্রান্ত জটিলতাও পোহাতে হয়। বিষয়টি ছিল জীবনানন্দ দাশ নামটির দ্বান্দ্বিক দুই রকমের ব্যবহারের ওপরে। প্রথমটি 'জীবানন্দ' দ্বিতীয়টি 'দাস'। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির প্রবণতা এখনো ব্যক্তি মানসিকতায় কেউ কেউ ধারণ করেন। দাস হিসেবে সমাজ এবং জগতের যাবতীয় কার্যকারিতায় হেয় হিসেবে দেখবার নিম্নগামী মানসিকতা। এটি একজন আধুনিক কবির প্রতি মানসিক আক্রমণ। ফ্রানত্স ফানোর কালো ও সাদা বিষয়ক বর্ণবৈষম্যের করুণ অভিজ্ঞতা কিংবা নওগি ওয়া থিয়োঙ্গোর আফ্রিকার সাহিত্য, ভাষা ও জীবনযাপনে অন্য বা অপর-এর প্রভাব ব্যথিত করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনরূপে। তাহলে জীবনানন্দকে 'দাস' সমর্থন করে তখন যারা মেতেছিলেন তারাও এরকম বোধ থেকে করেছেন। সব যুগের জন্যই তা প্রবহমান সত্য। একটি উদাহরণ আমরা দেখে নিতে পারি :

'শ্রাবণের প্রগতির মাসিকীতে কবি জীবনানন্দ (জীবানন্দ নয়) দাশ সম্বন্ধে লিখিত হইয়াছে (ভাষার দিক দিয়ে জীবনানন্দ অনেক নতুনত্বের আমদানি করেছেন—'ঠান্ডা' 'শাদা' 'ডিম' 'মাইল' প্রভৃতি দেশী শব্দ Serious কবিতায় প্রথম চালান।'

[সজনীকান্ত দাস, শনিবারের চিঠি, শ্রাবণ ১৩৩৬]

সজনীকান্ত দাস তত্কালীন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাকারী একজন ঔপনিবেশিক যিনি উপনিবেশকে আগে মানসিকভাবে গ্রহণ করে তার সাংস্কৃতিক সক্রিয়তাকে বড় করে দেখেন। উপনিবেশের সমপ্রসারিত রূপ উত্তর-ঔপনিবেশিক মানসিকতায় যাকে 'Orientalism'-এ নতুন করে 'আন' বা 'Otherness'-এ পরিণত করা হয়। আমরা সপষ্টত অনুভব করি, সজনীকান্ত পূর্বের অবস্থাটিকে ব্যবহার করেছেন। মানসিকভাবে ঔপনিবেশিকের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের থেকে তাঁদের অর্থাত্ জীবনানন্দ দাশের মতো যাঁরা, তাঁদের নিকৃষ্টরূপে চিত্রিতও করেছে। এই আক্রমণাত্মক সংস্কৃতি উপনিবেশের অনেক বড় প্রতিক্রিয়াশীলতা।

জীবনানন্দ এ কারণে সাম্যকে তাঁর এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যেখানে তত্কালীন অধ্যাপক বা তথাকথিত শিক্ষককে মাইনে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করা হতো, মানুষ হিসেবে অবমূল্যায়ন করা হতো, আন্তরিকতার চরম সংকট ছিল, তার ওপর জীবনানন্দ একা কীভাবে সংগ্রাম করবেন? ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে লেখক-প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিবিশেষের সম্মিলিত উপনিবেশকে জীবনানন্দের পক্ষে দমন করা সম্ভব ছিল না। প্রবন্ধ এবং কবিতা ছাড়াও উপন্যাসে তাঁর দেশ-কাল ভাবনার স্বরূপরূপে উপনিবেশকৃত অবস্থা থেকে সমতার আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে :

'এরকম হতভাগ্য দেশে কোনো ইস্কুল কলেজ না থাকাই ভালো। সব পুলিশ হয়ে যাক, সেপাই হয়ে যাক। ছেলে, অধ্যাপক বা গভর্নিং বডিগুলোকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। দোষ বাংলাদেশের বিশ শতকের ভিতরে যে ধ্বংসের কীট রয়েছে- দিনের পর দিন তার শ্রীবৃদ্ধির।'

[জলপাইহাটি, জীবনানন্দ দাশ]

মাঝখানে দেশবিভাগের মতো একটি বড় বিভাজন ঘটেছে। ব্রিটিশ-ভারত দুটি ভিন্ন দেশে পরিণত হবার পর পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের উভয়সংকটও এ উপন্যাসে আলোচিত হয়। সমাজব্যবস্থা মন্দের দিকে যাবার পরিস্থিতি খুব সহজ-স্বাভাবিক ছিল। বরিশাল ও কলকাতা যে এক নয় সেটিও নতুন বিষয়।

কবিতার কথায় যে 'মহত্কবিতা'র কথা জীবনানন্দ বলেন, মহত্ উদ্দেশ্যকে ধারণ করে বর্বর মানবসভ্যতার প্রতি দায়িত্ববোধ বা নৈতিকতাবোধের বিকাশের জন্যই বলেন। তত্কালীন ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থায় তার লালন কারা কীভাবে করত তার বর্ণনা দেন একটি অপ্রকাশিত কবিতায় :

'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হূদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,

এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহত্ সত্যরীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হূদয়।'

[অদ্ভুত আঁধার এক, অপ্রকাশিত কবিতা]

'চিরপদার্থ'র গুণ রয়েছে কবিতাটিতে। কবিতাটি চিরকালীন এজন্য—এর বক্তব্য চিরকালের সত্যকে ধারণ করে আছে। জীবনানন্দ কবিতাটি রচনা করেন সচেতন দার্শনিক ক্রিয়াশীলতায়। তিনটি প্রবাহ কবিতায় চলে আসে যা এর অর্ন্তগত সত্যকে তুলে ধরে।

বর্তমান যে সময়ে কবি কবিতাটি লিখেছেন, সে সময়ের জন্যও কবিতাটির বক্তব্য আধুনিক ও বর্তমান ছিল। 'আজ', 'আছে' শব্দগুলো বর্তমানজ্ঞাপক।

অতীত কবিতাটি তত্কালীন সমাজব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে যা অতীতকেও একই সঙ্গে বর্ণনা করে। অতীত প্রকাশক ক্রিয়াপদ নেই কিন্তু অতীতের প্রেরণা আছে। পূর্বেও এমন অবস্থা ছিল।

ভবিষ্যত্ ফিউচারিজম কবিতার বড় শক্তি। এর কল্যাণেই আজকের পৃথিবীতেও এটি সত্য। ভবিষ্যতের খোলস উন্মোচনের জন্য যুক্তিযুক্ত।

জীবনানন্দের তত্কালীন সমাজের প্রেক্ষিতে ঔপনিবেশিক আচার সংশ্লিষ্ট মানুষের মূল চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। বৈশ্বিক পরিবর্তন, আগ্রাসী বা ভোগী-মানসিকতা সত্য পরিবেশে বর্ণনাপ্রধান হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষ তার আচরণ কীভাবে পাল্টাবে, চিন্তার এক একটি 'ডাইমেনশন' কীভাবে পাল্টাবে আর নৈতিক মূল্যবোধ কীভাবে বিলুপ্ত হবে, ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে তা কীভাবে ছড়াবে ইত্যাদির সত্যতা কবিতায় আছে। অন্ধ যারা তারা চোখে বেশি দেখছে। তারাই অন্ধ যারা আসল সত্য বা উপযুক্ত ব্যক্তিকে অস্বীকার করে। কম বোঝা লোকেরাই তখন রাষ্ট্রকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনে বসেছিল এবং তারাই ছিল পরামর্শদাতা। তবু কবি তাঁর কাব্যদৃষ্টিতে আস্থাশীল মানুষ খোঁজেন। গভীর আস্থায় যারা মানুষকে মূল্যায়ন করেন, তাদেরও মূল্য নেই। মহত্ সত্য কিংবা শিল্প-সাধনার পূজারী হয়েও তাঁরা সমাজে উপেক্ষিত হন। তাঁদের হূদয়কে 'শকুন' ও 'শেয়াল'-এর উচ্ছিষ্ট খাদ্য বলা হয়েছে। 'শকুন' ও 'শেয়াল' শব্দ দুটি অত্যন্ত ধারালো। পুঁজিবাদী পৃথিবীতে তাঁরা অগ্রহণযোগ্য। আজ থেকে একশ বছর পরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্রমাগত সমৃদ্ধি ঘটবে এবং সভ্যতার উন্নয়ন হবে। তখনকার পৃথিবীর জন্যও এ কবিতার বক্তব্য মানানসই হবে। অসাধারণ কাব্যদৃষ্টিতে জীবনানন্দ স্বকীয় যুগকে তুলে ধরেন এবং অনাগতকালের জন্য তাকে প্রাসঙ্গিক করেন।

জীবনানন্দ দাশের ঔপনিবেশিক বাস্তবতা তাঁর সময়কালের সবচেয়ে রূঢ় সমাজবাস্তবতা। তিনি একসময় যে সাম্যে বিশ্বাস করতেন তার কেন্দ্রে ছিল শিল্প-সাহিত্যচর্চার জন্য অনুকূল সমাজব্যবস্থা। কিন্তু, শিকড়েই ছিল গলদ তাই তাঁর প্রতিষ্ঠাগত পর্যায় অমসৃণ থেকেছে। তাঁর ঔপনিবেশিক অবস্থানের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক করলেও প্রমাণ হয়, তাদের সমাজবাস্তবতা কত নেতিবাচক এবং অসহনীয় ছিল। সাহিত্য যেমন উপনিবেশকে ব্যাখ্যা করে, উপনিবেশ তেমনি সাহিত্যের লেখককে প্রভাবিত করে। জীবনানন্দ দাশের মতো সাহিত্যিকরা উপনিবেশ পেয়েছেন কিন্তু উপনিবেশের উপনিবেশক হতে পারেননি। তাই তাঁর লেখকসত্তা ঔপনিবেশিক সমাজের অভিযোজিত না হওয়া একসত্তা। অতঃপর তাঁর বাস্তবতাও তাঁকে সহ্য করা ব্যতীত আর কিছুই করতে দেয় না।
- See more at: http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMTFfMDhfMTNfNF8yNF8xXzgzOTk4#sthash.yLoaElMu.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন