‘নিমজ্জন : একটি থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট’
মাসউদ ইমরান মান্নু
প্রস্তাবনা
ঢাকা থিয়েটারের ‘নিমজ্জন’-এর
প্রদর্শনী দেখতে দেখতে আমি দারুণ দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যাই। আমার এক দিশেহারা অবস্থা। তাই ব্যক্তিগত
মতামতকে উপজীব্য করেই লেখা শুরু করলাম। কারণ ‘নিমজ্জন’ দেখার পূর্ব পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতায় ছিল থিয়েটার
সর্ব্বৈভাবেই ‘নির্দেশকের’। আর নাট্য নির্দেশক হিসেবে নাসির উদ্দীন ইউসুফের মূল্যায়ন করতে গিয়ে
সেলিম আল দীন একটি সফল মঞ্চায়নে নির্দেশকের ভূমিকার বিষয়টি পক্ষান্তরে তুলে ধরেন। তা
হলো- ‘সমকালীন বাঙলা নাট্য নির্দেশনায় নান্দনিক ক্ষেত্র
বিবেচনায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ বিশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র।
নির্দেশক-সৃষ্ট মঞ্চ শিল্প-রীতি,
নাট্য দর্শন ও নিজ শিল্পভূমিতে স্ব-সৃষ্টির উদ্ভাসন তাঁর নান্দনিক ক্ষেত্র রচনা করে।
বহু বিচিত্র অনুষঙ্গকে একটি শৈল্পিক চলমান রেখায় সাঙ্গীকৃতপূর্বক একজন প্রকৃত নির্দেশক
মঞ্চে সার্বভৌম হয়ে ওঠেন। নির্দেশক যখন স্রষ্টা, নাট্যের অনুষঙ্গ সমূহ তিনি নাট্যের
বহির্ভাগ থেকে আহরণ না করে নাট্যের অন্তর্গত উপাদান কিংবা সম্ভাব্যতার সর্বোচ্চ লক্ষণ
সমূহ থেকে তা আবিষ্কার করেন। এর ফলে তাঁর রচিত নাট্য নির্দেশনায় একটা মহৎ অথচ নিরাভরণ
সংগীতের সৃজন হয়। নাসির উদ্দীন ইউসুফ সমকালীন বাঙলা নাট্যমঞ্চে এই সুরটি যোজনা করেছেন
তাঁর সৃষ্ট নির্দেশনা শিল্পের ক্রমবহমানতায়।’(সেলিম আল দীন ২০০০ : ০৭)
নির্দেশকের ভূমিকা বিষয়ক প্রবন্ধে
আতাউর রাহমান বলেন, ‘এক কথায় তিনি (নির্দেশক) হলেন দর্শকের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য,
চলমান, দৃশ্যমান, অভিনীত নাটকটির প্রধান ব্যক্তিত্ব। যিনি নাটকের পাণ্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ
হৃদয়ংগম করে, প্রয়োজনবোধে নিজস্ব ব্যাখ্যায় এবং প্রয়োগ কৌশলে দর্শককে একটি নিটোল ও
নির্মেদ ফল উপহার দেন। তাই সফল ও রসোত্তীর্ণ নাটকের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্বের দাবিদার
নির্দেশকই।’(আতাউর রাহমান ১৩৪৮ বাং : ৬৮)
এইচ. কে. চিনুই-এর মতে, নির্দেশক হল
এমন একক এক সৃজনশীল শক্তি যে, তাঁর সামগ্রিক অভিজ্ঞতার নিরিখে উপস্থিত পরিবেশ সমূহকে
শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থিয়েটারকে তাঁর চূড়ান্ত সত্যনিষ্ঠ আঙ্গিকে উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট হন।(The
Impact of the Drector on American Plays, Playwrights and Theatres, 1963) জন্ মেস ব্রাউন-এর মতে, ‘পরিচালক হলেন একজন সক্রিয় সমালোচক’।
(আতাউর রাহমান ১৩৪৮ বাং : ৭০)
টায়রন গাথরির মতে, ‘পরিচালক হলেন একজন আংশিক শিল্পী যিনি একদল শিল্পীর পৌরোহিত্য করেন এবং
সেই শিল্পীরা কেউবা ছেলে মানুষ, কেউবা উচ্ছৃঙ্খল আবার কেউবা মুহ‚র্তের ব্যবধানে উত্তেজিত, উদ্দীপিত বা নির্বাপিত’। (পূর্বোক্ত) এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে
নির্দেশক হলেন একমাত্র পরিকল্পক যাঁর অনুমোদন ব্যতীত মঞ্চে কোনো কিছুই সংগঠিত হয় না।
আবার এটাও ঠিক যে, নির্দেশকের চিন্তাকে অতিক্রম করে যায় অভিনেতা যার উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য।
এ ক্ষেত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, হুমায়ূন ফরীদি, জহিরউদ্দিন পিয়ার, শিমূল ইউসুফ প্রমুখের
কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
এবার মঞ্চ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এ-রকমই
নির্দেশকের চিন্তার অতিক্রান্ত এক কাজ করেছেন ঢালী আল মামুন। তিনি নিমজ্জন নাটকে শিল্প
নির্দেশনা শিরোনামের অধীনে যা করেছেন তা বাংলা থিয়েটারের এক অনবদ্য ঘটনা। মঞ্চসজ্জা,
লাইট, সাউন্ড, গোয়ের্নিকার অংশ বিশেষ প্রক্ষেপণ এবং মঞ্চের সকল স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন
নানাভাবে এবং ইউসুফ মঞ্চসজ্জাকে মাথায় রেখে সিমেট্রিক্যালি অভিনীত স্থানকে বিন্যস্ত
করেছেন। ইউসুফের এতদিনের অর্জন-নিরাভরণ মঞ্চের চরিত্রকে পাল্টে দিলেন মামুন। তবে তাতে
ইউসুফের নিরাভরণ থিয়েটারের বৈশিষ্ট্যকে কোনোভাবে পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র পরিবেশনগত
রূপান্তর ঘটিয়েছেন। সাথে যুক্ত হয়েছে আল দীনের নিজ ভাষ্য মতে, ‘ননজেনেরিক’ (নিমজ্জন
প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার।) কেন্দ্রীয় গল্পহীন গল্পমালা। এই কেন্দ্রীয়
গল্পহীন গল্পগুলোর কথা-ভাষ্যে আল দীন পৃথিবীর তাবৎ গণহত্যার ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন।
এই নাট্য অথবা কাজে অন্বিষ্ট হয়েছে মানব সভ্যতা ও ইতিহাসের রক্তস্রোতের ইতিবৃত্ত। (পূর্বোক্ত) একে যথার্থই থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট
হিসেবে ব্যাখ্যান বর্তমান লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য। ১৯৯০ উত্তর বাংলাদেশের থিয়েটারকে জামিল
আহমেদ চিহ্নিত করেছেন নিরীক্ষণ পর্ব। (জামিল
আহমেদ ১৯৯৫ : ৪১) এ নিরীক্ষণের একটি উচ্চাঙ্গ পরিণতি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে ইউসুফ-মামুনের
‘নিমজ্জন: থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট’।
আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের থিয়েটার-ইন্সটেলেসন
আর্ট বিষয়টিকে ইতিহাস ও ফর্মের ভিত্তিতে আলোচনা জরুরি মনে করায় লেখার প্রথমেই বিষয়টি
পরিষ্কার করে নিচ্ছি।
আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলন এবং ইন্সটেলেসন
আর্ট
১৯ ও ২০ শতকের শিল্প ও সংস্কৃতি আভাঁ-গাখ্দ
ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। আভাঁ-গাখ্দ শিল্পকর্মের উৎস ভূমি ফ্রান্স এবং ইতালি। ১৯২০-এর উত্তাল সময়ে এই আভাঁ-গাখ্দ
‘আন্দোলন’ হিসেবে দ্রুত ইউরোপ থেকে রাশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকান
সংস্কৃতিরও একটি জরুরি অংশ হয়ে ওঠে আভাঁ-গাখ্দ শিল্প-ভাবনা। যদিও আমেরিকাতে বিস্তৃতভাবে
চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এই আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলন। (http://irmeli.hautamaki.kaapeli.fi)
আভাঁ-গাখ্দ আর্টের নানা রূপ রয়েছে।
তবে এটা বলা মুশকিল যে, আভাঁ-গাখ্দ আর্ট অন্য কোনো আর্টের সাথে তুলনীয়। যদিও ফ্রেন্স
স্যুরিয়ালিজম, রাশিয়ার কন্সট্রাকটিভিজম, জার্মান এক্সপ্রেসনিজম বা ভিয়েনিজ সেসিসন (secession) আন্দোলনের সাথে এর কোনোই মিল
নেই। বরং আভাঁ-গাখ্দ আর্টের প্রভাবে এই আর্ট আন্দোলনগুলো নিজ নিজ মতাদর্শিক অবস্থানকে
সংহত করতে পেরেছে। আভাঁ-গাখ্দ আর্ট ফর্মকে আবার রেনেসাঁস উৎপাদিত দীর্ঘ ঐতিহাসিক স্টাইলের
সাথে সম্পৃক্ত করতে পারা যায় না। অবশ্য বহু শিল্পকলা-ইতিহাসবিদ এই ‘স্টাইল’কে আলাদা কোনো ধারা হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী নন।
আভাঁ-গাখ্দ আর্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবিত আর্ট
ফর্ম হল ‘ইন্সটেলেসন
আর্ট’।
ইন্সটেলেসন আর্টকে বলা যেতে পারে, Ô… an artistic genre of site-specific,
three-dimensional works designed to transform a viewer's perception of a space.[i] (Education and Community Programmes,
Irish Museum of Modern Art, IMMA) আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের সাথে
অপরাপর যেসব আর্ট ফর্ম সম্পৃক্ত তা হল- SUPERMATISM, CONSTRUCTIVISM, DADA, SURREALISM Ges FUTURISM|
১৯১২ থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে করা পিকাসোর
Still Life with Chair Canning এবং Sheet of Music and Guitar কাজ দুটো নিয়ে সমালোচকগণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান যে
এ শিল্পকর্মকে তারা চিত্রকলা, ভাস্কর্য বা ছাপচিত্র অর্থাৎ কোন দলভুক্ত করবেন। নিমজ্জন
নিয়ে আমার অবস্থাও তৈরি হয়েছে ঠিক একই। আল দীনও নিজের রচনাকে একইভাবে চিহ্নিত করেছেন
‘ননজেনেরিক’।
ফটো
১৯১৪ সালে ডাডাবাদী শিল্পী ডুশোঁ-এর
Bottlerack কাজের ভেতর এর একটি
পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ হয়। একে শিল্প-সমালোচকগণ শিল্পের ইতিহাসে প্রথম ‘ইন্সটেলেসন আর্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী।
ফটো
ইউরোপের শিল্পচর্চায় ১৯ শতকের শেষ
ভাগে ইমú্রসেনিজম-এর চর্চার মাধ্যমে প্রথাগত শিল্পকলার একাডেমিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে
আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের সূচনা হয়। আর ডুশোঁ তাই অবজেক্টকে প্রথাগত শিল্পের ধারণা থেকে
বের হয়ে এসে তার শিল্পকে দেখতে বাধ্য করলেন। যেমন- বোতল রাখার জন্য বটলরেক বা মূত্র
ত্যাগের জন্য ইউরিনাল। ডুশোঁর কাজ যে সমসাময়িক ও পরবর্তী শিল্পীদের ভেতরে প্রভাব ফেলেছিল
তা ১৯২০ সালের কর্ট শ্বিটার্স-এর কাজে প্রতিফলিত হয়। ডাডাবাদী শিল্পী কর্ট ১৯২০ সালে
জার্মানির হ্যানোভার শহরে একটি ঘরের মধ্যে আবর্জনা জড়ো করতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর
সময়ে ১৯৪৩ সালে তার এই শিল্পকর্মটি ধ্বংস হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে চলে এসে তিনি ১৯৪৭ সালে
একই কাজের নতুন সংস্করণ তৈরি করেন। ১৯৪৮-এ শিল্পী মারা গেলে তার অসমাপ্ত কাজটি হ্যাটন
গ্যালারিতে স্থাপন করা হয়। ইন্সটেলেসনের আদিরূপ হলো কর্ট শ্বিটার্স-এর এই ‘মার্জ বাউ’ কাজটি যা ইন্সটলেসনের ইতিহাসে ‘উপাদানের স্বাধীনতা’ বিষয়টিকে সংযুক্ত করেছে। (সঞ্জয় চক্রবর্তী ২০০৯
: অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভ)
ফটো
তবে ইন্সটলেসন আর্ট ওল্ডেনবার্গ-এর
The Store শীর্ষক কাজের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে একটি একক শিল্প মাধ্যম
হিসেবে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে যা আজও একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পকলা হিসেবে পরিচিত। (পূর্বোক্ত)The Store-এ ওল্ডেনবার্গ দেখান যে, প্রদর্শনী স্থলের মেঝেতে,
দেয়ালে, সিলিংসহ সব স্থান থেকেই বস্তুসমূহের আয়োজন করেন ফলে সমগ্র ঘরটি জুড়ে একটি আবহ
তৈরি হয় যা দর্শকের প্রথাগত শিল্প দেখার দৃষ্টিকে নাড়া দেয়। এ কাজের বড় দিকটি হলো পরিবেশ
তৈরি করা। মামুনের কাজের ভেতরেও আমি এই প্রবণতা দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে
পারে: কাপ্তাই নিয়ে ইন্সটলেসন আর্ট বা নিমজ্জন: থিয়েটার-ইন্সটেলেসন আর্ট।
ফটো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত
সকল আর্ট হয়েছে গ্যালারি কেন্দ্রিক এবং শিল্প ছিল মূলত স্থায়িত্বের উপযোগী। শিল্পের
এই বিপণন যোগ্যতাকে অস্বীকার করে জন্ম নিয়েছে ইন্সটলেসন আর্ট।(পূর্বোক্ত) কেননা দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে ইউরোপে রাজনৈতিক অস্থিরতার কালে প্রথাগত ‘সুন্দর’ বা ‘নান্দনিক’ শিল্পের প্রয়োজনীয়তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। যেখানে
যুদ্ধের বীভৎসতা নশ্বর পৃথিবীর ক্ষণিকতাকে রূপায়িত করেছিল সেখানে শিল্পীদেরও এই অনুধাবন
এসেছিল যে, কীসের প্রয়োজনে শিল্পের সৃষ্টি? এই পরিস্থিতি ছিল ইন্সটলেসন আর্টের প্রেক্ষাপট।
কারণ ইন্সটলেসন আর্টের যে চিত্র বিশ শতকের মধ্যভাগে এসে দাঁড়িয়েছিল তাতে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য
প্রকাশ পাচ্ছিল যার মধ্যে ছিল নয়া-নয়া মাধ্যমের প্রয়োগ। ইন্সটলেসন আর্ট মূলত অস্থায়ী
বা ক্ষণস্থায়ী এবং ক্ষেত্র বিশেষে নির্দিষ্ট জায়গার প্রেক্ষাপটে তৈরি। আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের
নানা মাত্রিক প্রভাবে যেমন: MINIMALISM, ENVIRONMENTAL ART, LAND ART, CONCEPTUAL
ART Ges PERFORMANCE ART-এর
প্রভাবে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।। আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের মতো ইন্সটেলেসন আর্টও আধুনিকতাবাদের
সমস্যাসমূহকে প্রতিরোধ করতে আগ্রহী হয়ে পড়ে।
১৯৬০-১৯৭০ সালের মধ্যে ইন্সটেলেসন
আর্টের সাথে ক্রিটিক্যাল তত্ত¡সমূহ যেমন: FEMINISM, POSTCOLONIAL THEORY এবং POSTSTRUCTURALISM হয়ে আধুনিকতাবাদী শিল্পের ধারণাকে
চ্যালেঞ্জ করে। ৯০-এর দশকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের ইন্সটলেসন চর্চায় মামুন এক অন্যতম
নাম। তিনি তার কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিপর্যয়কে ইন্সটলেসন
আর্টের মাধ্যমে প্রতিবাদী কৌশলে রেপ্রিজেন্ট করেন। বাঙালির আধিপত্যবাদী মনোভাবকে প্রতিরোধে
এই শিল্পকর্মকে প্রতিবাদী শিল্পকর্ম হিসেবে রেপ্রিজেন্ট করেছেন।
ইউসুফ-মামুনের ‘নিমজ্জন’কে উত্তর-কাঠামোবাদী ‘থিয়েটার-ইন্সটেলেসন আর্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে যেখানে প্রথাগত কেন্দ্রীয়
গল্প পরিত্যাজ্য কথা-ভাষ্যকে থিয়েটারের প্রায় সকল প্রথাকৃত কাঠামোকে ভেঙ্গে রেপ্রিজেন্ট
করেছে। পরবর্তী পর্বে এ বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে বর্তমান লেখায়।
থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট এবং নিমজ্জন
ইন্সটলেসন
এমন এক আর্ট ফর্ম যেখানে নির্দিষ্ট কোনো কাঠামোকৃত সংজ্ঞায়ন প্রায় অসম্ভব। এ ফর্মটি
ধারণ করেছে এখনও পর্যন্ত নানা ধরনের বিষয়কে। তাই মাধ্যম অনুযায়ী একে বিভিন্ন
বিষয়ের সাথে যুক্ত করে চিহ্নিত করেন বিভিন্ন সমালোচক। তা হলো- Video, Internet,
Projector, Film, Painting, Sculpture, Architecture, Theatre cÖf„wZ|[ii] (Education
and Community Programmes, Irish Museum of Modern Art, IMMA)
১৯৬৪ সালে Per Kirkeby-এর En jugendfidus – A Jugend Hoax শিল্পকর্মকে থিয়েটার স্পেসকে
ব্যবহার করে প্রথম থিয়েটার এবং ইন্সটেলেসন আর্টের সমন্বিত শিল্পকর্ম হিসেবে চিহ্নিত
করা যায়। এখানে পেইন্টিং এবং টয় থিয়েটারের সমন্বয়ে Happening এবং পারফর্মেন্সকে ইন্সটল করা হয় যা সিনিক আর্টের
ঠিক বিপরীত-ধর্মী।
(A happening is a performance, event or situation meant to be
considered art,
usually as performance
art. Happenings take place anywhere, and are often
multi-disciplinary, with a nonlinear narrative and the active participation of the audience. Key
elements of happenings are planned, but artists sometimes retain room for improvisation. This new media art aspect to
happenings eliminates the boundary between the artwork and its viewer.
Henceforth, the interactions between the audience and the artwork makes the
audience, in a sense, part of the art.
১৯৬৫ সালে ঘটে যায় থিয়েটার ইতিহাসে
এক যুগান্তকারী ঘটনা। Jørgen Leth-এর
নির্দেশনায় এবং Per kirkeby-এর শিল্প নির্দেশনায়
প্রদর্শিত হয় ‘হ্যামলেট’। এখানে লেথ পারফর্মেন্সকে নানাভাবে পরিবর্তন করে
দেন। যেমন প্রধান চরিত্রের বিখ্যাত সব ডায়ালগগুলো অভিনেতাকে ড্রামের সিগনালের মাধ্যমে
থামিয়ে নির্দেশক নিজেই আবৃত্তি করে দেন। আর মঞ্চসজ্জার ক্ষেত্রে কিরকেবি ফ্লোর, দেয়াল,
সিলিং এবং দর্শকদের বসার জায়গা সহ সমগ্র থিয়েটারকে ‘নীল’ রং করে দেন। পোশাকের ক্ষেত্রে কিরকেবি পুরুষ অভিনেতাদের বিভিন্ন ফেন্সি
পোশাক পড়ান। আর নারী অভিনেত্রীদের লাল, নীল, কালো প্রভৃতি রংয়ের রিবন দিয়ে সজ্জিত করে
দেন। চরিত্র ও দেহের ব্যাখ্যা অনুযায়ী চিহ্নায়ক বিভিন্ন রংকে ব্যবহার করেন।
‘নিমজ্জনে’র ক্ষেত্রেও কাছাকাছি চিত্র দেখতে পাই। ‘নিমজ্জন’ থিয়েটার-ইন্সটেলেসন আর্ট-এর পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ
নিম্নে বিবৃত হল:
* সমগ্র মঞ্চকে বটগাছ এবং বটগাছের পুরুষ্ট ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে যেন
প্রতিটি বড় আকৃতির ঝুড়িই এক একটি পূর্ণাঙ্গ গাছ। এর মাধ্যমে বটগাছের কেন্দ্রিকতাকে
ভেঙে দিয়েছেন মামুন। মঞ্চে তৈরি হয়েছে অসংখ্য কেন্দ্র। ঝুড়িগুলোর সাথে সাথে ঝুলে আছে
মানুষের মস্তক। সমগ্র মঞ্চটি সাদা রং ধারণ করেছে। সাথে পেছনের বিশাল সাদা ক্যানভাস।
ফ্লোরও সম্পূর্ণ সাদা। মঞ্চে আগত সকল অভিনেতার সজ্জাতেও সাদার আধিক্য। মামুনের এই গাছ
ব্যবহারকে জাপানি কিম মানরির আভাঁ-গাখ্দ থিয়েটার ফর্মের প্রযোজনার সাথে তুলনীয়। কিম
মানরি মালয়শিয়ার শারীরিক-প্রতিবন্ধী শিল্পীদের মাধ্যমে তার থিয়েটারকে উপস্থাপন করেছিলেন।
ফটো
নিমজ্জন, ঢাকা থিয়েটার
* বিশ্ব ভ্রমণ শেষে এক আগন্তুক মৃত্যুশয্যায় শায়িত বন্ধুর কাছে আসবে বলে
ত্রি-নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এক শহরে এসে হাজির হয়। মামুন তার শিল্প নির্দেশনা দিয়ে কোনো
নির্দিষ্ট সংস্কৃতির বা জাতির স্থানকে সিম্বলাইজ না করে স্থান বিহীন এক ‘স্থান’ রচনা করেছেন যা পৃথিবীর সকল নিপীড়িত মানুষের রক্তাত্ব
প্রান্তরকে তুলে ধরে হাজারও কেন্দ্রিকতাকে নির্মাণ করে। প্রপস, আলোক প্রক্ষেপণ, পোশাক
এবং মঞ্চের তলসমূহ এই কেন্দ্রবিহীন কেন্দ্রিকতাকে সম্পূর্ণ রূপে সহযোগিতা করে এক দারুণ
সমন্বয় তৈরি করেছে।
* বন্ধুটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাজনৈতিক মতবাদের জন্য সেই শহরের
বø্যাক ডেথ স্কোয়াড অব কারাভাঁর লোকেরা নির্যাতনের পর তার মেরুদণ্ডে পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
আগন্তুক ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে দেখতে পায় এক কুলির ঝুলন্ত লাশ, অদ্ভুতদর্শন এক বৃদ্ধ,
স্টিমারের হলোকাস্ট, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসা এক রূপসী নারী- যতবার তাকে কবরে শোয়ানো হয়
ততবার সে মৃত্যু থেকে উঠে বসে। ইউসুফ তার স্পেসকে বিন্যস্ত করেন এমটি/খালি স্পেসকে
বিন্যাসের মাধ্যমে অভিনেতাদের প্রপসের মতো করে ব্যবহার করে। সাথে পোশাককে এমনভাবে নির্দিষ্ট
করা হয় যেনও কোনো স্পেস-বিহীন পরিচিত স্পেসের মানুষের গল্প যা সর্বক্ষণ ব্যথিত করে।
এ ক্ষেত্রে আল দীনের বক্তব্য প্রণিধান যোগ্য, ‘পিটার
ব্রুকের কোন কোন ধারণা স্বীকার না করলেও বলা যায় গ্রোটভস্কির নাট্যচিন্তা, আর্তুদের
শিল্প কৌশলকে আত্মস্থ করে তিনি (ইউসুফ) এমন এক নির্দেশনা নন্দন রচনা করেছেন যা একালের
থিয়েটারের সংকটকে লাঘব করেছে অনেকাংশে। বিশ্ব নাটকে নির্দেশনার একটা নতুন ভূমিরও সন্ধান
আছে তাতে’। (সেলিম
আল দীন ২০০০ : ০৯)
* তবে ইউসুফ নিজেকে বা তার দর্শককে ভুলতে পারেন নি বলে অধ্যাপককে দিয়ে
রাবীন্দ্রিক আচরণ ও উত্তরীয়কে চাদরের মতো ব্যবহার করান। অথবা ধর্ষিতা নারীর শাড়ির সাজেশন।
একে সংযুক্তির অসংযুক্তিও বলা যেতে পারে। এটা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণীয়, কারণ, থিয়েটারের
এই পরীক্ষণ যে-ভূমিতে হয়েছে সেই ভূমির সিগনেচার থাকা জরুরি হয়ে পড়ে। তাহলে শিল্পী অর্থাৎ
ইউসুফ এর মাধ্যমে পার্টিসিপেন্ট হয়ে পড়েন। ইউসুফের স্ব-ভূমিতে ফেরার রাজনীতিও এর মাধ্যমে
চলমান থাকে। আল দীনও এ চরিত্র তৈরির মাধ্যমে নিজেই অংশগ্রহণ করেছেন বলা যেতে পারে।
আলোচ্য বক্তব্যর পক্ষে ইউসুফের নির্দেশনা
নিয়ে আল দীনের একটি বক্তব্যকে এখানে তুলে ধরতে আগ্রহী। তা হল- ‘নির্দেশনা রীতির বিশ্বজনীন আবেদন স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় দেশকাল সামাজিকের
রুচি, কোন জনপদের নান্দনিক স্পৃহা কেবল শুদ্ধ পাশ্চাত্যের নির্দেশনা রীতির অনুকরণ দ্বারা
পূর্ণ হবার নয়। ঠিক সেই জায়গাটাতে এসে আমাদের ভাবতে হয় বাঙলা মঞ্চে নাট্য নির্দেশনায়
আমাদের করণীয় কি, আমাদের দেশ কাল সমাজের নান্দনিক তাগিদটা কী ধরনের। বিশ্ব-নাট্য নির্দেশনায়
একজন বাঙালি নির্দেশকের পক্ষে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র খুঁজে দেখা প্রয়োজন কি না। কিংবা
উত্তর-উপনিবেশীয় নব্যকালের শিল্প-তাড়নার ফলে একটি নতুন সম্ভাবনা বাঙলা নাট্যমঞ্চে সৃষ্টি
হচ্ছে কি না।’ (সেলিম
আল দীন ২০০০ : ১০)
* আগন্তুক বরফের চাঙরের ভেতর একান্নটি শিশুর লাশ, আট কি নয় বছরের গায়িকা
এক শিশুকে ধর্ষণের পর তার জিভ কেটে নেয়া, কান্দাহারের মমি, মাদ্রিদের গণহত্যা, চিলির
কবি নেরুদার ফিন্দেমুন্দোর শোক-গীতি, স্টেডিয়াম গ্যালারিতে প্রায় দেড় দুই হাজার দর্শক
ক্ষুরে কেটে খুন, ত্রিশ হাজার টন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টি এন টি’র বিস্ফোরণে ষোলো কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুস্তরে আগুন ধরে যাওয়া শহরটির
ক্রম নিমজ্জন দেখতে পায়। সমগ্র চিত্রটিকে ইউসুফ তার এতদিনকার অর্জন পাঁচালি ও বর্ণনাত্মক
রীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে উপস্থাপন করেন। তবে তিনি মামুনের শিল্প নির্দেশনাকে অতিক্রম করেন
নি বা করতে পারেন নি অথবা করতে চান নি। মঞ্চের নিম্নতলের দু’পাশে ঝুলন্ত দুটো বটের পুরুষ্ট ঝুড়ির ডানে ও বামে স্পেস থাকার পরেও ইউসুফ
বøকিংয়ে সেই স্পেসকে অস্বীকার করেছেন। তিনি নাটককে মঞ্চ-ইন্সটলেসনের অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন।
কোথাও প্রপস বা সাউন্ড বা অন্য কোনো অবজেক্টকে অভিনেতাদের অবস্থান, ডায়ালগ প্রক্ষেপণ
বা বর্ণনার কোথাও অতিক্রম করেন নি। এক্ষেত্রে বøকিং সিমেট্রিক হয়ে পড়ে। তাই অভিনেতাদের
একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান তৈরি হয়। নাটক রচনা এবং শিল্প-নির্দেশনায় যা সম্পূর্ণই অস্বীকার
করা হয়েছে। এখানে বলা যায় ইউসুফ হয়তো উত্তর কাঠামোবাদী আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলন বিষয়ে বøকিংয়ের
ক্ষেত্রে একেবারেই সচেতন ছিলেন না। এ কারণে লেখার প্রথমেই ইউসুফের নির্দেশনার একক কর্তৃত্বের
উপর আঙুল তুলে মামুনকে নিমজ্জনের সমান ভাগীদার করেছি। মূলত শিল্প-বন্ধুত্ব শিল্পের
কাঠামোকে ভাঙতে সবসময়ই সহায়ক যা শুধুমাত্র হুকুম দেয়া ও হুকুম পালন-এর মাধ্যমে অর্জন
সম্ভব নয়। লেথ ও কিরকেবির কাজেও একই বিষয় লক্ষণীয়।
ফটো : নিমজ্জন, ঢাকা থিয়েটার
* এবং পরিশেষে সূর্য-প্রার্থনার মধ্য দিয়ে রচিত হয় এ নাট্যের অন্তিম দৃশ্য।
আল দীনও সম্ভবত ইউসুফের মতো কেন্দ্রিকতাকে ভাঙার ব্যাপারে সর্বক্ষেত্রে সচেতন ছিলেন
না। তা মানব ইতিহাসের ক্ষেত্রে তিনি সূর্যকে একটি কেন্দ্রীয় জায়গায় দেবতা হিসেবে দাঁড়
করিয়েছেন। এটা বিবর্তনবাদী (মাসউদ ইমরান :
২০০৯) ক্রিটিকাল তত্ত্বচিন্তা, ঢাক: মাওলা ব্রাদার্স।) গ্রান্ড থিউরিতে সাইকিক ইউনিটি
অফ ম্যানকাইন্ড-এর তত্ত্বীয় ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে করা হয়। ফ্রেঞ্চ বোয়াস তার হিস্টরিকাল
পার্টিকুলারিজম (পূর্বোক্ত)-এর থিওরাইজেসনের
মাধ্যমে এ ধরনের গ্রান্ড থিওরিকে অস্বীকার করেছেন। আল দীন সম্ভবত ক্রিটিক্যাল থিওরির
এ বিষয়টি নিয়ে সচেতন ছিলেন না। সম্ভবত তিনি রচনার নন্দনতাত্তি¡ক অবস্থানের পরীক্ষণে
নিমগ্ন ছিলেন। ইউসুফের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অসচেতনতা লক্ষণীয়। সম্ভবত ইউসুফ এ নাটক
নির্দেশনার সময়ে থিয়েটারের নান্দনিকতাকে অর্থাৎ তার অতি প্রিয় ‘মঞ্চ ইমেজ’ ও ‘মঞ্চ কবিতা’ তৈরিতে
বেশি সচেতন ছিলেন। তাই তার কাজ যে আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠছে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা
ভেঙে সমগ্র পৃথিবীকে অসংখ্য কেন্দ্রে রূপান্তর যে তার কাজ থেকে ঘটে যাচ্ছে তা তার এই
যবনিকা অংশটি ক্রিটিক্যাললি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। এ কারণেই ইউসুফকে অসচেতন হিসেবে
এখানে উল্লেখ করছি। এখনও পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসে বহুল আলোচিত সভ্যতাগুলোতে সূর্যকে
কেন্দ্রীয় দেবতা হিসেবে দীর্ঘ সময়ে টিকে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু এর বাইরেও বহু সভ্যতা
বা সংস্কৃতি আছে যেখানে দেবতাদের পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন। ইউসুফ ও আলোক পরিকল্পক এ বিষয়টিকে
স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন যা মামুনের প্রজেক্টেড গোয়ের্নিকা বা সাউন্ডের ভেতরে ছিল
না। মামুন কাঠামোকে ভেঙে ফেলার আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের বিষয়ে সচেতন থাকায় মঞ্চ পরিকল্পনায়
এ ধরনের ত্রুটি খুঁজে পাই না।
* আল দীন নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘চাকা থেকে অতি সম্প্রতি লেখা ঊষাউৎসব বা স্বপ্নরমণীগণ
পর্যন্ত-পূর্ণাঙ্গ নাটকরূপে অভিধেয় হবার মতো নয়। আবার সেগুলো যে নাটক নয় তা নয়।’ (নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭) আল দীনের কাজ নিয়ে প্রথাগত ছক
তৈরি না করার সাথে আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের ভেতর থেকে উৎসারিত পিকাসো ও ডুঁশোর কাজের ক্ষেত্রেও
একই সমস্যার কথা লেখার প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। আজ যা ইন্সটলেসন আর্ট হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়েছে। অবশ্য আল দীন নিজেই তাঁর রচনার একটি চিহ্নায়ণ তৈরি করেছেন, ‘ননজেনারিক শিল্প রচনা’ (পূর্বোক্ত)।
* আল দীনের ‘নিমজ্জন’ নিয়ে পূর্বোক্ত বক্তব্যকে গ্রহণ করা গেলেও ইউসুফ-মামুনের
‘নিমজ্জন’ বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের
প্রথম নিরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তাই একে আমি ‘থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। পশ্চিমা থিয়েটারে এ
নিরীক্ষণের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। এমনকি জাপানি থিয়েটারেও ঘটে গেছে এ নিরীক্ষণের এক দীর্ঘ
পরীক্ষণ। ঢাকা থিয়েটার বাংলা থিয়েটারকে দিল, ‘থিয়েটার-ইন্সটলেসন
আর্ট’-এর ‘নিমজ্জন’। আল দীন ইউসুফের নির্দেশনা রীতির নান্দনিক পরিচয়
খুঁজতে গিয়ে তাঁর নাট্য-সৃষ্টিকে চারটি পর্বে বিভাজিত করে আলোচনা করেছেন। (সেলিম আল দীন ২০০০ : ০৮) তা হলো- প্রথমত জন্ডিস
ও বিবিধ বেলুন (১৯৭২), সংবাদ কার্টুন (১৯৯৩) এবং মুনতাসির (১৯৭৬) তাঁর প্রস্তুতি পর্বের
পরিণতি। শকুন্তলা (১৯৭৮) ও কিত্তনখোলা (১৯৮০) তাঁর দ্বিতীয় পর্বের নির্দেশনা ধারার
অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়ত কিত্তনখোলা (১৯৮১), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৫), এবং হাত হদাই (১৯৮৯) এই
পর্বে তাঁর নির্দেশনার ধারায় দৃশ্যকল্প রচনার দুঃসাহসিক প্রয়াস, চরিত্র চিত্রণের কুশলতা
নিঃসন্দেহে বাঙলা মঞ্চে অভিনব যোজনা। চতুর্থ-পর্ব যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৪) থেকে একাত্তরের
পালা (১৯৯৪) হয়ে বনপাংশুল (১৯৯৮) পর্যন্ত পূর্বোক্তধারারই ক্রম পরিশীলনগত উচ্চ-চূড়
আরোহণ। আল দীন ইউসুফকে নিয়ে ২০০০ সালে লেখা প্রবন্ধ উত্তরকালে যদি আজকের ‘নিমজ্জন’ নিয়ে লিখতেন তা হলে নিশ্চিতভাবে ইউসুফের নির্দেশনার
পঞ্চম উত্তরণ হিসেবে চিহ্নিত করতেন ‘নিমজ্জন’কে। যাকে আমি বর্তমান লেখায় ইউসুফের ‘থিয়েটার-ইন্সটেলেসন আর্ট’-এর পরীক্ষণ হিসেবে পরিচিত করতে আগ্রহী।
* যদিও আমি আল দীনের ‘নিমজ্জন’ নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। তার একটি ব্যাখ্যা
রয়েছে। আল দীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ পৃথিবীর তাবৎ জেনোসইড নিয়ে কথা বলেছেন যার বেশ
কিছু সময়ের বিচারে ১৯৭১ উত্তরকালে সংঘটিত। কিন্তু আল দীন নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হয়েছেন
বা প্রবলভাবে এড়িয়ে গেছেন। কারণ তিনি তার বনপাংশুলসহ বিখ্যাত রচনাসমূহে বার বার ক্ষুদ্র
জাতিসত্তাকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রবল বাঙালি কর্তৃক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর এখন পর্যন্ত
একাধিক জেনোসাইডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাঁর নিমজ্জনের অধ্যাপক সমগ্র পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন
এবং হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করে গেছেন একমাত্র নিজভূমির বা জাতির মানুষদের দ্বারা
সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ নজরে পড়েনি।
* যদিও ইউসুফ তার নির্দেশকের নিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘... বিগত ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি
তথা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান- উদীচী, ছায়ানট, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ
বোমা ও গ্রেনেড হামলা এবং টুইন টাওয়ার আক্রমণ, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কসভো, প্যালেস্টাইন,
ইরাক ও আফগানিস্তানে সৃষ্ট রক্তাক্ত অধ্যায়- যা অনেকের মতো আমাকেও সমান বিচলিত করেছে।
বিশেষ করে ছায়ানট এবং আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় রাস্তায় ‘পরে নিহত নিরীহ মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার চোখের
ক্যানভাসে এক নতুন গোয়ের্নিকা এঁকে দেয়। এই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতায় নিজের ভেতর থেকেই নিমজ্জনের
অর্থ সাবটেক্সট এবং দৃশ্যরূপের সন্ধান পাওয়া গেল শেষাবধি।’ অবাক করা বিষয়, নির্দেশকের
এই উপলব্ধি তার নিজ প্রযোজনায় নাটকের রচয়িতার মতই নিমজ্জিত হয়ে গেছে। নির্দেশক ইচ্ছে
করলেই এসকল বিষয় তার প্রযোজনা স্ক্রিপ্টে যুক্ত করতে পারতেন। অথচ ইউসুফ দৃশ্যরূপের
সন্ধান পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন। পাশাপাশি তিনি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপরে প্রবল বাঙালির
জেনেসাইডের বিষয়টি থিয়েটার প্রযোজনাতে নিজ বক্তব্যেও উপস্থাপন করেন নি। (নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার)
যদিও তার সাম্প্রতিক ‘দ্য টেম্পেস্ট’ প্রযোজনাটিও
এরকম এক জাতিসত্তার শিল্প কৌশল ব্যবহার করে করা যা আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এরকম
ছকবাঁধা পলায়ন-পরতা আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের প্রথাগত চরিত্রকে ভেঙে ফেলার শিল্প-বিপ্লবীর
চরিত্রের সাথে একেবারেই বেমানান। এ কারণেই ইউসুফ হয়তো নির্দেশনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র
‘পোয়েট্রি অন স্টেজ’ বা ‘ন্যারেটিভ ভিজুয়াল নির্মাতা’ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করতে আগ্রহী যা রাজনৈতিকভাবে তাকে সেইফ/নিরাপদ
রাখে। ইউসুফের এ ধরনের শিল্পকৌশলকে দেখে প্রশ্নের উদ্রেক হয়- তবে কী তিনি আল দীনের
ধাক্কায় কিছুটা উত্তর-উপনিবেশবাদী হবার চেষ্টা করেছেন মাত্র? আর উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনীতির
অংশ হবার সুবিধা হলো, প্রতিপক্ষ সম্যক নয় এবং একই সাথে ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হবার আধুনিকতাবাদী
ফ্যাশনের সাথে সম্পৃক্ত করে প্রগতিশীল হবার পাঁয়তারা করা যায়। একে নয়া-উপনিবেশবাদের
উপসর্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
* এসব বিচারে মামুনের কাজে খুঁজে পাওয়া যায় রাষ্ট্রকে। তিনি নিজেই বাঙালি
সাম্রাজ্যবাদী আচরণের প্রতিরোধী হিসেবে ‘কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের’ রাজনীতিকে নিয়ে সরাসরি ইন্সটলেসন করেছেন। একই সাথে নিমজ্জনে প্রপস ব্যবহারের
ক্ষেত্রে নিজ ল্যান্ডস্কেপের ধারণা ব্যবহার করেছেন। নিমজ্জনে তাঁকে শিল্প-নির্দেশক
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যা যথার্থই বলে আমি মনে করি। তিনি ইউসুফের সাথে সংযুক্ত হয়ে
বাংলাদেশের এবং বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে একটি সফল থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্টের জন্ম দিয়েছেন।
* আল দীন নিমজ্জনকে ‘ননজেনেরিক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাকে কেন্দ্রিয় গল্পহীন অসংখ্য
গল্পের অসংখ্য কেন্দ্রের নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। এখানে চিন্তার বিবর্তনী পদ্ধতিকে
বাদ দিয়ে একটি মেটা ন্যারেসন তৈরির চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু ইউসুফ লেখকের এই প্রচেষ্টাকে
নিজের মতো করে বিবর্তনবাদী চিন্তার অধিনে একটি কেন্দ্র নির্মান করে উপস্থাপনের চেষ্টা
করেছেন। এর বড় উদাহরণ হলো, একটি বিবেকবান চরিত্রকে দিয়ে সম্পূর্ণ এখানে স্পেসকে তিনি
অস্বিকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
* ইউসুফের কাজকে যদি অভিনয় শিল্পীগণ আরও তত্ত্বীয় ও রাজনৈতিকভাবে সচেতনতার
জায়গা থেকে গ্রহণ করতেন তা হলে বুঝতে পারতেন যে তারা বাংলা থিয়েটারের একটি ইতিহাসের
সাথে যুক্ত হচ্ছেন তা হলো থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট। তা হলে, ইউসুফ-মামুনের পরিশ্রমকে
আরও গুরুত্বের সাথে নিতেন। বিশেষ করে, ইউসুফ শরীরী ছন্দের ব্যবহারের মাধ্যমে থিয়েটারে
লিরিকাল বডি ল্যাংগুয়েজ পোয়েট্রি রচনার যে ডিজাইন করেছেন তা চর্চার কমতি এবং পারফর্মারদের
শারীরিক অযোগ্যতার কারণে পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন: কাট হুইলের
মতো একটি সহজ কাজকেও সঠিকভাবে প্রদর্শন করতে বেশিরভাগ শিল্পীই ব্যর্থ হয়েছেন। ইউসুফ
যদি আরও সচেতনভাবে এ নাটকের আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের পরীক্ষণের অধীনে থিয়েটার-ইন্সটলেসন
আর্টের বিষয়ে অবগত করতেন তা হলে হয়তো অভিনয় শিল্পীদের কাছ থেকে আরও সহযোগিতা পেতেন।
এক্ষেত্রে ঢাকা থিয়েটারের অভিনয় শিল্পীদের আরও অভিনয়ের বিষয়ে মনোনিবেশ করা জরুরি, না
হলে ইউসুফের এরকম অমর সৃষ্টি হারিয়ে যাবে।
* রশীদ হারুন নিমজ্জন নিয়ে আলোচনায় ইউসুফের এতদিনের অর্জন নিরাভরণ নাট্য-রীতি
ব্যাহত হয়েছে বলে বিতর্কে অবতীর্ণ হবার অবকাশ খুঁজছেন। (রশীদ হারুন ২০১২ : ৩৮) তবে
তিনি হয়তো খেয়াল করেননি যে, শিল্প নির্দেশনায় আছেন মামুন। এটা মামুন ও ইউসুফের একাঙ্গিত/ফিউশন
কাজ। আর ফিউশন বেশ কিছু ধারণাকে ডিফিউজ করে নয়া ধারণা নির্মাণে উদ্যোগী হয়। এখানে একটি
ধারণার উপর আরেকটি ধারণা কর্তৃত্বশীল হয়ে ওঠে। নিমজ্জনেও মামুনের শিল্প নির্দেশনা এভাবে
কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠেছে। তবে এটা যে নিরাভরণ নাট্য-রীতিকে অনুসরণ করেনি তা কী বলা যাবে?
অবশ্য হারুন একটি বিষয় পরিষ্কার করে উল্লেখ করেন নি যে, ‘নিরাভরণ’ বলতে তিনি কী বুঝতে আগ্রহী? তবে আল দীন নাট্য নির্দেশক
ঔবৎমু এৎড়ঃড়ৎিংশু-এর চড়ড়ৎ ঞযবধঃৎব-এর বাঙলা পাঠ হিসেবে নিরাভরণ থিয়েটার করেছেন। (Eugenio
Barba (ed.) (1975) Towards a Poor
Theatre, Jerzy Grotowrsky, London: Methuen and Co.
Ltd. P.15.) উনিশ শতকের বাহুল্যপূর্ণ রোম্যান্টিক-রিয়ালিস্টিক
শিল্প ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ রঙ্গমঞ্চ (১৩৯২
বাং) বিচিত্র প্রবন্ধ, রবীন্দ্র রচনাবলী, পঞ্চম খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলিকাতা: ভারত, পৃষ্ঠা:
৪৪৯।) প্রবন্ধে সমালোচনা করে বলেছেন, ‘... ইউরোপীয় বাস্তব সত্য নহিলে নয়। কল্পনা যে কেবল
তাহাদের চিত্তরঞ্জন করিবে তাহা নয়, কাল্পনিককে অবিকল বাস্তবিকের মতো করিয়া বালকের মতো
তাহাদিগকে ভুলাইবে। কেবল কাব্যরসের প্রাণদায়িনী বিশল্যাকরণীটুকু হইলে চলিবে না, তাহার
সঙ্গে বাস্তবিকতার আস্ত গন্ধমাদনটা পর্যন্ত চাই। এখন কলিযুগ, সুতরাং গন্ধমাদন টানিয়া
আনিতে এঞ্জিনিয়ারিং চাই- তাহার ব্যয়ও সামান্য নহে। বিলাতের স্টেজে শুদ্ধ মাত্র এই খেলার
জন্য যে বাজে খরচ হয়, ভারতবর্ষের কত অভ্রভেদী দুর্ভিক্ষ তাহার মধ্যে তলাইয়া যাইতে পারে’।(পূর্বোক্ত : ৪৫২।) এ ধরনের Synthetic-থিয়েটারকে
Grotowrsky Rich Theatre (মেদবহুল থিয়েটার) ও ত্রুটিপূর্ণ থিয়েটার হিসেবে
অভিহিত করেছেন।(Eugenio
Barba (ed.) 1975 : 19) নিচে উদাহরণ
হিসেবে উনিশ শতকের মঞ্চ সফল প্রযোজনা ‘হারনেইন’-এর ফটোগ্রাফ সংযুক্ত হলো। ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা
যাবে- এ ফটোগ্রাফে বিষয়টিকে পরিষ্কার করছে।
ফটো :
(Alfred
Bates (ed) (1906) The Drama: Its History, Literature and Influence on
Civilization, vol.,9. London: Historical Publishing Company, pp.20-23.)
Grotowrsky সিনথেটিক থিয়েটারের
ব্যাখ্যানুযায়ী এবং উনিশ শতকের বাহুল্যপূর্ণ রিয়ালিস্টিক ধারণার শিল্প-ভাবনার বিচারে
কোনোভাবেই ‘নিমজ্জন’কে মেদবহুল রিয়ালিস্টিক থিয়েটারের অধীন করা সম্ভব
নয়। আর ‘নিরাভরণ’ শব্দের আভিধানিক অর্থের উপর দাঁড়িয়ে যদি ইউসুফ-মামুনের
‘নিমজ্জন’কে ব্যাখ্যার চেষ্টা কর হয় তবে অবশ্য ইউসুফের এতদিনের
অর্জন যে নিরাভরণ থিয়েটারের চর্চা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতে পারে। ‘নিমজ্জন’-এর শিল্পভাবনাতে শুধুমাত্র হুইল চেয়ার ব্যতীত আর
কোনো প্রপস্ বা পোশাককে রিয়ালিস্টিক চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়
নি। এ ছাড়া শিল্প-ভাবনাকে দৃশ্যগত করবার জন্য যত-ধরনের বস্তুগত উপাত্ত ব্যবহার করা
হয়েছে তা বাজারি-মূল্যের বিচারে খুবই সুলভ। তবে শিল্প-নির্দেশক হিসেবে মামুন যদি বেশ
মোটা অংকের লেনদেনের সাথে যুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে বিষয়টি মেদবহুল থিয়েটারের ধারণাকে
প্রতিস্থাপন করবে। ঢাকা থিয়েটারের ‘নিমজ্জন’ বিষয়ক প্রচার-পত্রে এরকম কোন তথ্য নজরে আসে নি।
দ্বিতীয়ত ঢাকা থিয়েটার কোনো রেপার্টরি থিয়েটার গ্রুপও নয়। অথবা কোন থিয়েটার কোম্পানিও
নয়। এখনও পর্যন্ত এই থিয়েটারটি ক্ষয়িষ্ণু গ্রুপ থিয়েটারের ধারণাকে ধারণ করেই প্রযোজনা
মঞ্চায়িত করে আসছে। এ সব বিচারে হারুনের অভিযোগটি গ্রহণ করা যায় না। অর্থাৎ ইউসুফ তার
এতদিনের অর্জন ‘নিরাভরণ থিয়েটার’-এর চর্চা
থেকে দূরে সরে এসেছেন। বরং বলা যেতে পারে এক শতক পূর্বে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চে বাস্তবতার
অতিরঞ্জনকে বাতিল করে দিয়ে যে স্ব-ভূমিজ শিল্প-রীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন ইউসুফ তার এক
সফল রূপকার। ‘নিমজ্জন’-এর প্রচারপত্রে ঢাকা থিয়েটার যথার্থই উল্লেখ করেছে,
‘রবীন্দ্রমহাভুবনের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি’। (নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র,
২০০৭) রশীদ হারুন নিমজ্জনকে ‘এক্সপ্রেসনিজম’ ও ‘স্যুররিয়ালিজম’-এর প্রভাব পুষ্ট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (রশীদ হারুন ২০১২ : ৩৮) যা আমি আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের
অন্যতম সৃষ্টি ইন্সটলেসন আর্ট-এর অংশে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে প্রকাশ করেছি। তাই
হারুনের উল্লেখিত ‘নিমজ্জন’- এক ভিন্ন-মাত্রিক মঞ্চ-ভাষ্যকে আমি পর্যালোচনামূলক
ব্যাখ্যানে অভিহিত করেছি ‘থিয়েটার-ইন্সটলেসন আর্ট’।
পরিশেষে, ইউসুফ ও আল দীন যদি উত্তর-কাঠামোবাদী
এবং আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের মাধ্যমে উৎসারিত কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বিহীন বহুত্ববাদী শিল্পচর্চার
প্রতি আরও কিছুটা অনুরক্ত হতেন তবে উল্লিখিত সমস্যাগুলো এড়ানো যেতো। তারা এসব বিষয়ে
সচেতন নন তা উল্লিখিত আলোচনা এবং তাদের নিজেদের বয়ানের সাপেক্ষে বেশ হলফ করে এখানে
উল্লেখ করলাম। মামুন শিল্প-নির্দেশক হিসেবে এসব দোষ দ্বারা দুষ্ট নন। আর মামুন তার
শিল্প-নির্দেশনার অধীন করে নিয়েছেন ইউসুফের বর্ণনাত্মক থিয়েটারের পরিবেশনাকে। ঢাকা
থিয়েটারের ‘নিমজ্জন’কে তাই ইউসুফ-মামুনের একটি আভাঁ-গাখ্দ আন্দোলনের
পরীক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘থিয়েটার-ইন্সটেলেসন আর্ট’ হিসেবে অভিহিত করাই বর্তমান প্রবন্ধের ইরাদা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
ঢাকা থিয়েটারের বন্ধু ওয়াসিম আহমেদ-এর
বারবার তাগাদা এবং ‘নিমজ্জন’-এর ফটোগ্রাফ ও প্রচারপত্র দিয়ে সহযোগিতা করায় বর্তমান
লেখাটি আলোর-মুখ দেখতে পেলো। এ ছাড়া ইন্সটলেসন আর্ট নিয়ে বন্ধু সঞ্জয় চক্রবর্তী, শিক্ষক,
চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর অপ্রকাশিত অভিসন্দর্ভর অংশ বিশেষ পড়বার
ও তথ্যসমূহ ব্যবহারের অনুমতি দেয়ায় তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এ ছাড়া নাসির
উদ্দীন ইউসুফকে নিয়ে লেখা সেলিম আল দীনের গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির সন্ধান ও বিভাগীয় সেমিনার
লাইব্রেরি থেকে ফটোকপির সুযোগ করে দেয়ায় নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগের সভাপতি, খায়রুজ্জাহান
মিতুর প্রতি জানাই সালাম।
তথ্যসূত্র
১। সেলিম আল দীন (২০০০) বাঙলা নাট্য নির্দেশনা শিল্পরীতি: নাসির উদ্দীন
ইউসুফ, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ববিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা,
পৃষ্ঠা: ০৭
২। আতাউর রাহমান (১৩৪৮বাং) নাট্য প্রযোজনা ও নির্দেশকের ভূমিকা, শিল্পকলা,
ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, পৃষ্ঠা: ৬৮
৩। The Impact of the Drector on American Plays,
Playwrights and Theatres, 1963.
৪। আতাউর রাহমান (১৩৪৮বাং) নাট্য প্রযোজনা ও নির্দেশকের
ভূমিকা, শিল্পকলা, ঢাকা: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, পৃষ্ঠা: ৭০
৫। পূর্বোক্ত
৬। নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার।
৭। পূর্বোক্ত
৮। জামিল আহমেদ(১৯৯৫) বাংলাদেশের নাটক: পঁচিশবছর, শিল্পকলা, ঢাকা: বাংলাদেশ
শিল্পকলা একাডেমী, পৃষ্ঠা:৪১
১০। Education and Community Programmes, Irish Museum of
Modern Art, IMMA
১১। সঞ্জয়চক্রবর্তী (২০০৯) বাংলাদেশেরইন্সটলেসনআর্ট, এমএফএ, অপ্রকাশিতঅভিসন্দর্ভ,
রবীন্দ্রভারতীবিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত।
১২। পূর্বোক্ত
১৩। পূর্বোক্ত
১৪। Education and
Community Programmes, Irish Museum of Modern Art, IMMA
১৫। A happening is a performance, event or situation meant to be considered art, usually as performance art.
Happenings take place anywhere, and are often multi-disciplinary, with a nonlinear narrative and the active participation of the audience. Key
elements of happenings are planned, but artists sometimes retain room for improvisation.
This new media art aspect to happenings eliminates the boundary between
the artwork and its viewer. Henceforth, the interactions between the audience
and the artwork makes the audience, in a sense, part of the art.
১৬। সেলিম আলদীন (২০০০) বাঙলা নাট্য নির্দেশনা শিল্পরীতি: নাসির উদ্দীন ইউসুফ,
থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, পৃষ্ঠা:
০৯
১৭। সেলিম আল দীন (২০০০) বাঙলা নাট্য নির্দেশনা শিল্পরীতি: নাসির উদ্দীন
ইউসুফ, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা,
পৃষ্ঠা: ১০
১৮। মাসউদ ইমরান (সম্পাদিত) (২০০৯) ক্রিটিকাল তত্ত্ব চিন্তা, ঢাকা : মাওলা
ব্রাদার্স
১৯। পূর্বোক্ত
২০। নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার
২১। পূর্বোক্ত
২২। সেলিম আল দীন (২০০০) বাঙলা নাট্য নির্দেশনা শিল্পরীতি: নাসির উদ্দীন
ইউসুফ, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা,
পৃষ্ঠা: ০৮
২৩।পূর্বোক্ত
২৪। নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার
২৫। রশীদ হারুন (২০১২) সেলিম আল দীনের নাট্য নির্দেশনা, নন্দনভাষ্য ও শিল্পরীতি,
ঢাকা : ইছামতি প্রকাশনী, পৃষ্ঠা: ৩৮
২৬। Eugenio Barba (ed.) (1975) Towards a Poor Theatre, Jerzy Grotowrsky,London: Methuen and Co. Ltd. P.15.
২৮।পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৪৫২
২৯।Eugenio Barba (ed.) (1975) Towards a Poor Theatre, Jerzy Grotowrsky, London: Methuen and Co. Ltd. pp.19.
৩০। Alfred Bates (ed) (1906) The Drama: Its History,
Literature and Influence on Civilization, vol.,9. London: Historical Publishing
Company, pp.20-23.
৩১। নিমজ্জন প্রযোজনার প্রচারপত্র, ২০০৭, ঢাকা থিয়েটার
৩২। রশীদ হারুন (২০১২) সেলিম আল দীনের নাট্যনির্দেশনা, নন্দনভাষ্য ও শিল্পরীতি,
ঢাকা: ইছামতি প্রকাশনী, পৃষ্ঠা:৩৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন