শাহীন আখতারের শিস ও অন্যান্য গল্প

শিস দিয়ে যাই : মুবিনুর রহমান

অধুনা কিছু কিছু মানুষের চিন্তার সুতোয় ধীরে ধীরে পাক খাচ্ছে মানুষ হিসেবে নারীর সম্মান মর্যাদার মৌলিক দর্শন। পরিবার থেকে সমাজে ধ্বনিত হচ্ছে নারী পুরুষের মার্জিত অবস্থানের সাম্যগীতি। অথচ কয়েক বছর আগেও চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। নারী সম্পর্কে স্টেরিওটাইপ দৃষ্টিভঙ্গির শেকড় বিস্তৃত ছিল অনেক গভীর পর্যন্ত। সময়ের আবর্তে বদলেছে সাহিত্যপাঠ, সাহিত্যিকদের ভাবনা সংবেদশীলতার মাত্রা।

হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মর্মমূলে লালিত নারী পুরুষে বৈষম্য চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। প্রায় দু দশক ধরে উপন্যাসের পাশাপাশি গল্প রচনা করে আসছেন তিনি। তাঁর গল্পের বিষয়, চরিত্র, পরিবেশ পটভূমি সজীব প্রাণ নিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে পাঠকের নজরসীমায়। তিনি অনন্য, ব্যতিক্রমী গল্পসৃষ্টির স্বাতন্ত্র্যে মহিমান্বিত করে তোলেন গল্পের জমিন। শিস অন্যান্য গল্প শাহীন আখতারের স্বাতন্ত্রধর্মী শিল্পীসত্তার অনুপম দৃষ্টান্ত।

শিস অন্যান্য গল্পপ্রায় পনেরো বছরের বাছাইকৃত গল্পের সংকলন। একে বিষয় গল্প বলার ভঙ্গির বৈচিত্র্যময় নথিও বলা যেতে পারে। এই ভাবনায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ থেকে দশটি গল্প ছেঁকে এনে সময়ানুক্রমে সাজানো হয়েছে। বর্তমান থেকে অতীতমুখী পরিভ্রমণে দেখামেলে দলচ্যুত হিজড়া, মৃত বেশ্যা, সাপ স্বপ্নের ছুতোয় আনন্দে উদ্বেল সমকামী নারী প্রাক্তন মাদকসেবীর সঙ্গে অদ্ভুত বা অতি সাধারণ গৃহী মানুষদের। পরস্পরবিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর মধ্যে বিরোধ না থাকলেও মিলও নেই। অমিলই নতুন পুরনো গল্পে গ্রথিত বইটির মূল বৈশিষ্ট্য।

প্রায় প্রতিটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। পুরুষের চোখ দিয়ে দেখা সমাজ, অর্থনীতি মানুষের চারিত্রিক বৈচিত্র্য নিমিষেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে অঙ্কিত করেছেন সাহিত্যিক। শিস গল্পের মূল চরিত্র দু জন নারী। একজন গ্রাম থেকে উঠে আসা সুন্দরী তবে স্মার্ট নন হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা আমিরন আরেকজন শিক্ষার আলোয় দীপ্যমান, স্মার্ট আধুনিক সাহসী শহুরে মীরা। একই সামাজিক বৃত্তে ঘূর্ণায়মান আর্থসামাজিক সহিংসতায় আহত দুই বিপরীত মেরুর নারীর মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কাহিনি শিস। তাজমহল গল্পে সদ্য বিধবা, নিঃসন্তান একজন কর্মজীবী নারীর একাকিত্ব সমাজের প্রচলিত চর্চার উল্টা দিকে দাঁড়ানোর এক অন্তহীন সংগ্রামের কাহিনি। ইয়োগা করতে গিয়ে বোনাস হিসেবে গানের ক্লাসে ঢুকে পড়েন ইতিহাসের অধ্যাপক রোশনি। এক মনোসামাজিক টানাপড়েনে জীবন এগিয়ে নিতে থাকেন তিনি। বছর ঘুরে স্বামীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীও বিস্মৃত হয়ে যায় রোশনির। এই তো জীবন।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নতুন চিত্রণপাঁচটা কাক একজন মুক্তিযোদ্ধা অশুভ সংকেতের প্রতীক হয়ে পাঁচটি কাক উড়ে আসে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা গাঁয়ের সুরমা বুবি নামের একজন বুড়ি এগিয়ে যায় কয়েকটি জীবন রক্ষায়। একজন বেশ্যা খুন হওয়ার পর তার লাশ কবর দেয়া পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কিছু মানবিকতা অমানবিতার মুখোমুখি সংঘর্ষেমেকআপ বাক্সগল্প নির্মিত হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক মল্লিকা বেশ্যাবৃত্তির সহোদরা মালাকে কবরস্থ করার আকাঙ্ক্ষায় লাশ নিয়ে ছুটে যায় শহরের কবরস্থানে। কিন্তুপ্রহরে প্রহরে মেঘ-বৃষ্টি-জ্যোৎস্নার বিচিত্র খেলায়, প্রতিটি কবরস্থান থেকে মল্লিকা ওই একই জবাব পায়।...লাশটা একজন বেশ্যার।

মৃত্যুচিন্তা নিয়ে আবর্তিত গল্পবোনের সঙ্গে অমরলোকে মৃত্যুর ভেতর দিয়েও নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে চান লেখক। অন্যগল্পআমাবাগানের সখাতেও মৃত্যুর খেলা দৃশ্যমান। একজন নেশাগ্রস্থ যুবকের রিহ্যাব সেন্টারের কল্যাণে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে জীবনের জয়গানে গলা মেলানোর কাহিনির ভিতর দিয়ে উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের চালচিত্র।হাতপাখাগল্পটিতে কথকের বাবা তার ভগ্নিপতির লাশ আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে সঙ্গে নিয়ে আসেন তোরঙ্গে গচ্ছিত হাতপাখা। যেখানে সোনামুখি সূঁইয়ের এফোড় ওফোড়ে চিত্রিতসাক্ষী হইও হিজল গাছ নদীর কূলে বাসা/ তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনে যত আশাবাংলার লোকসংস্কৃতির উদাহরণ।সাপ, স্বামী, আশালতা আমরাবাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন। সমকামী নারীর যৌন অবদমনে স্বপ্নে সর্পকূলের উৎপাতে দুধভাত হয়ে আবির্ভূত হয় আশালতা। আশা লতা আশার লতা ছড়িয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর করে তোলে তাদের। তবে একদিন স্বপ্ন ভাঙে, স্বামীদের রাজত্ব কায়েম হয় পূনর্বার।আবারো প্রেম আসছেগল্পটি সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত হিজড়াদের নিয়ে। যাদের সমাজ মানুষ বলতেই নারাজ। সমাজের অমানবিক নিয়ম কানুনের কপাটে বন্ধ তাদের মানবিক মর্যাদার বাতায়ন।

শাহীন আখতার জীবন বাস্তবতায় তার গল্পের বিষয়, কাহিনী, চরিত্র পটভূমিকে দাঁড়া করিয়ে যুঝে নিতে চান মানুষের প্রতি ভালোবাসা সম্মান। পৃথিবী মানুষের, নারী পুরুষের

বেঙ্গল২০১৩  প্রচ্ছদ : দিলারা বেগম জলি  দাম ২১৫ টাকা

- See more at: http://www.alokitobangladesh.com/feature-friday/2013/09/06/20642#sthash.TnhFC2Oe.dpuf


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন