নাসরীন জাহানের ‘নেচে ওঠে আদমের সাপ’

নিয়তিক্রান্ত মানুষের সমাচ্ছন্ন কথাকল্পতরু

জীবন বৈচিত্র্যময়। জীবনের আগাপাছতলায় কখন কোথায় কীভাবে ভূতপূর্ব কিংবা অভূতপূর্ব স্বাভাবিক আচরণের পাশাপাশি মাথা তুলে জানান দেয় অপার্থিব আধ্যাত্মিক, তা অনেক সময়ই মস্তিষ্কের সুতোয় বাঁধা ফাতনায় ধরা দেয় না। নাসরীন জাহান স্পর্শকাতর পর্যবেক্ষণে তুলে নিয়ে আসেন অব্যাখ্যেয় রহস্যঘেরা গল্পসূত্র। নেচে ওঠে আদমের সাপসেই ধারাবাহিকতায় আরেকটি সংযোজন। এই গ্রন্থের বেশিরভাগ গল্পই আবর্তিত হয়েছে মৃত্যু ঘিরে। যা স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক নিকৃষ্ট অপমৃত্যু হিং¯্র সাপের মতো নেচে উঠে উঠে চরিত্রগুলোকে দংশন করে আঁধারে ঠেলে দিলেও লেখক হতাশ হননি কোথাও।

উড়ক্কু উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন নাসরীন জাহানউপন্যাসের পাশাপাশি লিখে গেছেন গল্প। নিজের লেখার ভিত্তি সেই গল্পের সঙ্গে তার চিরন্তন চলাটাকে তাঁকে ভিন্ন এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। মোট ১০টি গল্পের সংকলন নেচে ওঠে আদমের সাপ। প্রতিটি গল্প অনন্য, শতেক বৈচিত্র্য থাকা সত্বেও কোথাও যেন চরিত্রগুলো মিলে গেছে একই আচ্ছন্নতায়। এটাই যেন নাসরীনীয় স্টাইল। শুরু থেকেই তাঁর লেখায় জাদুবাস্তবতার মোড়কে দেহ-মনঃপীড়নের দহন অত্যাশ্চর্য ভাষার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। আমাদেরই মানুষ বাতাস রোদ জীবনবাস্তবতার নিষ্ঠুর প্রয়োগ ঘটান কখনো এ দেশের, কখনো বাইরের দেশের লেখকদের লেখার আবহে উদ্দীপক হয়ে, সুররিয়ালিজমের তরঙ্গের মধ্যে প্রবহমানতার মাধ্যমে।
প্রথম গল্প গুম। পল্লীবাংলার সুঠাম কুস্তিগীরের প্রেম, জীবন সংগ্রাম আর নি¤œবিত্ত মানুষের আকাক্সক্ষার বিপরীতে চূড়ান্ত উপহাসের দৃশ্যচিত্র ইব্রাহীমকে কেন্দ্র করে রচিত গল্পটি। গল্পের নায়কের দিকে এক জোড়া স্থির চোখ এমন মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছিল, ফাতনার কাঁপনের চাইতেও হাজারগুণ কাঁপনে জীবনে প্রথম তার জ্বর জ্বর বোধ হয়েছিল।কিন্তু জ্বরের ঘোর কাটতেই সে দেখে সেই নারীর চোখে মুগ্ধতার বদলে সেখানে বিষাদ। সমস্ত মুগ্ধতা গ্রাস করে গ্রামের মাতবর। পরের গল্প একটি মৃত্যু-তার পরের অথবা আগের কথন এ পূর্ববর্তী গল্পের মৃত্যু এসে ঢুকে পড়ে সন্তর্পণে। ভগ্নসংসারে নতুন বাবার আগমন নিয়ে জেসমিনের তুমুল বিরোধ মায়ের সাথে, বার কয়েক আত্মহত্যার চেষ্টা অবশেষে সমাপ্ত হয় ফ্যানে ঝুলন্ত মায়ের পদতলে। জেসমিন বিশ্বাস করেনি মাকে, কিন্তু যখন লম্পট পিতার চরিত্র প্রকাশিত হয় তখন মা বিষাদ নিয়ে উড়াল দিয়েছেন সিলিং ফ্যানের ডানায় ভর দিয়ে। ছিপছিপে দেহের শারমিনের মুখের মায়া ছিল জাদুকরীময় আকর্ষণীয়এই আকর্ষণের তোড়ে ভেসে গেছে জয়তী। যখন দিনে দিনে শারমিনের অদ্ভুদ শিহরণময় অনুভবে বুঁদ হয়ে যায় জয়তীতখন পারিপার্শে¦ও প্রশ্ন উত্তোলিত হয়। আধিভৌতিকতার ধোঁয়াশা আর বাস্তবতার টানাপড়েনে পড়ে জয়তী নবস্বামী আবিরের বুকে কাঁপতে থাকে, যদিও সেখানে কোন দৈহিক সুখ নেই। সুখের সমস্ত নদী উপনদী গিয়ে মিশেছে জয়তী-শারমিনের প্রেমমোহনায়। অরণ্যপ্রেমিক যুগলগল্পে দুজন নারীর সঞ্চরণশীল অনুভূতি কি সমকাম না সমপ্রেম বুঝতে অসুবিধা হয় না পাঠকের।
পরের গল্প রক্ত খোয়াবের চক্করে জাদুবাস্তবতার এক নিরেট দৃশ্যকাব্য।  স্বামীশূণ্যতায় সুদীপের দুবাহুর আকর্ষণ ছিল অলীক কিন্তু অমোঘ। অবৈধদের রূপ কতটা ভয়াবহ হয়?’ এই প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত নওরীনকে নিয়ে যায় রূপমন বিবি নামের এক প্রতারক গণকের কাছে, যে আশ্বাস দেয় নওরীনের সন্তান মুনিয়াকে মরদ জ্বিনগুলোর আছড় থেকে ছাড়িয়ে আনার। কিন্তু জানা যায় যে সম্মোহনী শক্তির রূপমনের জিনের গল্প সাজানো। প্রচ্ছন্ন প্রভাবের তোড়ে গল্পে দেখতে পাই একজন মায়ের অসীম ভালোবাসা আর সন্তানের সুস্থতার জন্য সংগ্রাম। ডিভোর্সি নিশির ভারাক্রান্ত গল্পের ভিতর এসে হানা দেয় মমতাদির করুণ গল্প। ক্রমেই ছেলেকে নিয়ে এক সংসারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মমতা। মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলের সঙ্গে ফ্রয়েডের দর্শন, রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে তর্ক চলে মায়ের। সান্ধ্যমুখোশ গল্পে সন্ধ্যার প্রচ্ছায়ায় মাঠ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস জানালা বেয়ে কর্মক্লান্ততায় মেয়েটির ওড়না খসা অবস্থা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখা ফ্রক বুকর অর্গল উড়িয়ে নিয়ে যায়নিজের মধ্যে দাউ দাউ জ্বলে ওঠা আগুন নিমিষেই ছাই করে দেয় একটি বালিকার বাৎসল্য, সম্ভ্রম এবং জীবনস্পন্দন। মাটিচাপা মেয়েটির বুকের উপর গোলাপের গাছ রোপন করে লোকটি ভাবে সব ওই নির্জন সন্ধ্যার ভ্রম। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোলাহলে হঠাৎই যে নিস্তব্ধতা চুর চুর হয়ে যায় যখন দেখে দরজায় সেই মুখোশ পরা বালিকাটি এসে দাঁড়িয়েছে...। নিমতলী থেকে চিঠির উড়াল পুরানঢাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবুল হকের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জীবন যুদ্ধের কাঠ কয়লার ছবি। বারবার রাষ্ট্রের অধিপতিদের কাছে চিঠি লিখে কোনবারই তিনি কোন উত্তর পাননি। স্বভাবতই আবুল হকের মনে প্রশ্ন জাগে এ দেশ থেকে কি জীবনের জন্য ডাক ব্যবস্থা উঠে গেছে?’। সবশেষে নিমতলীল অগ্নিকা-ে সব হারিয়ে বিষাদগ্রস্থ, হতাশ, পাগলপ্রায় মুক্তিযোদ্ধা আবুল হক ঘরের আধপোড়া ময়নাকে নিয়ে আবারো লিখতে বসেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ময়নাটির যন্ত্রণা আর কান্না আমি আর সইতে পারছি না। দয়া করে এটাকে হত্যার ব্যবস্থা করুন।হক সাহেব আসলে কাকে হত্যা করতে বলছেন অর্ধদগ্ধ ময়না রূপী তাকেই না এই ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ, রাষ্ট্রকে, প্রশ্নটি পাঠকের হৃদয়ে মাছির মতো ভন ভন করতে থাকে।

সোনামিয়া গল্পে উচ্ছন্নে উদ্যত ভাষাসৈনিক সোনামিয়ার উত্তরাধিকার শিমুলের দ্বিধা, বিহ্বলতা ও পলিটিক্সে পলিউশন ঢুকে যাওয়ার আতঙ্ক ও নিরাশার অনুপম চিত্র প্রতিভাত। প্রেমটেমে অবিশ্বাসী নিতু আর আদর্শ নায়ক, নাস্তিক স্বর্ণেন্দুর ভালোবাসা ধর্মের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যায়। হিন্দু মুসলমানের বিভেদ রোদেলা ও শওকত রক্ত দিয়েও দূর করতে পারে না। প্রেমে কাতর দিগশূণ্য, চেতনাশূণ্য এক প্রেমিকার গহীনে মনের মানুষ খোঁজার যে অনুসন্ধানী ভ্রমণ তাই বলগ দিয়ে উঠতে দেখি প্রেমের সীমা পরিসীমাহীন মনচক্কর গল্পের উপরিতলের বুদবুদে। জীবনের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রূপার বয়ানে উঠে আসে দার্শনিক বচন এ এক আজব রহস্য, যা আমি নিজেও যখন পুরাটা বুঝি না, ততক্ষণ বেদন, ততক্ষণ স্বপ্ন হাহাকার। যারে নিয়ে এই মরণ উড়াল পাড়াল কষ্ট তারে না পাইলে মরণ...। নাসরীন জাহানের কথায় কথায় প্রাণ পায় আমাদের নিত্যদিনের সংবাদপত্র, টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদে উঠে আসা মানুষগুলোর দুঃখ কষ্ট নিপীড়ন ক্ষোভ হতাশার ছবি। অলীক স্বপ্নকল্পনার রাজ্য থেকে কোন অবাস্তবকাহিনী হাজির না করে লেখক শিল্পকুশলতায় নির্মাণ করেন আমাদের চারপাশে সাপের মতো নৃত্যরত নিয়তিক্রান্ত আদমের লৌকিক জীবনের সংকট, দ্বিধা আর বিষাদে সমাচ্ছন্ন কথাকল্পতরু।

-মুবিনুর রহমান

নেচে ওঠে আদমের সাপ ।। নাসরীন জাহান ।। বেঙ্গল পাবলিকেশনস্ লিমিটেড ।। প্রচ্ছদ-তরুণ ঘোষ ।। প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৩ ।। ১৫০ টাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন