ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ
সকালগুলো এখন বেশ তরতাজা। ঝকঝকে রোদ। শরৎকালীন নানা ফুলের সুবাস। মন বেশ ফুরফুরে থাকে এসময়। দূর এক গ্রামে স্কুলে পড়াই। এখন মাঠভরা আধকাঁচা ধান। বেশ খানিকটা যেতে হয় লাল মোরাম ধরে। গোলদীঘি। তালগাছ আর বিস্তৃত সবুজ শস্যভরা মাঠ। রাতের হিম লেগে থাকে ধানের শিসে। বাতাসে মৃদু দোলে। কঠোর শহর থেকে এখানকার বাসস্টপে পা রাখলে চোঁখ জুড়ায়। এসময়ে গাঁ-দেশ অদ্ভুত সুন্দরী।বেঁচে আছে গ্রাম, তার দারিদ্র, অভাব অনটন নিয়ে, তার সরল সৌন্দর্য নিয়ে, তাই কখনো কখনো নাগরিক ক্লান্তির পরে কোন জমির আইলে শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
এ অনুভব কি আমার একার?
যারা একটু সেনসিটিভ? তা নয়। সাজানো ব্যস্ততায়, যান্ত্রিকতায় ডুবে থাকা মন। ধীরে ধীরে
মরে যাচ্ছে সুক্ষ্ম চেতনা। তখন সবাই, সবাই থমকে দাঁড়াই এই সরলতার কাছে। আমাদের শিকড়ের
কাছে। তাই তো জমির আইলে দাঁড়িয়ে এই কবিতা মনে আসে :
‘ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে / কোমল ধানের চারা রুয়ে
দিতে গিয়ে/ ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কৃষাণী আমার।‘ (প্রকৃতি)
হ্যাঁ, আমার তো এখন আল
মাহমুদই পড়ার কথা। কারণ, ‘আমার চেতনা জুড়ে খুঁটে খায় পরস্পরবিরোধী আহার’ (ঐ।
সোনলি কাবিনের কবিতায় কবিতায়,
সনেটগুচ্ছে এই ‘পরস্পরবিরোধী’ অনুভবের
কি সুতীক্ষ্ম লড়াই! এই মননমাঠ ঘাট বিল শস্য নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আন্তর্জাতিকায়। গ্রাম্য
শব্দের কি অনায়াস চলন। অথচ কোথাও গ্রাম্যতা নেই। নাগরিক মননে স্নাত শব্দগুলি। যেন এক
শহুরে বালক ঘোর লাগা চোঁখে দেখে গ্রাম। শুধুকি ‘সুন্দর’ দেখেন কবি? তা তো নয়। দেখেন ‘কাঁপতে থাকে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার’ (বাতাসেরফেনা) দেখেন এই চিৎকারের অন্তরে আবহমান যন্ত্রণা। খোঁজেন,
সমাধান। চৌদ্দটি সনেটের ভিত ভূমি তৈরী হয়।
০২.
কতোটা ভালো আছে গ্রাম?
কিষাণ-কিষাণীরা? কতোটা ফসল ভরা মাঠ? ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির আগ্রাসী রূপ এখন। চলে যাচ্ছে
জমি ও শস্যের অধিকার। প্রচণ্ড অসুখী আজ নাগরিক মানুষও। বিভ্রান্ত? মোঃ ইয়ানের নোবেল
প্রাপ্তি, সাহিত্যের দোরে ঢুকিয়ে দিল একটা শব্দ: হ্যালুসিনেটিক রিয়ালিজম। বিভ্রমের
আবহ নিয়েই কি বুঝতে হবে বাস্তবতাকে! উত্তর আধুনিকতা কবিতায় কবিতায় বিষয়ের এত ঘুরপথ!
ভ্রান্তির গলি খুঁজি। অথচ আঙ্গিক ফ্যাশনেবল মডেলের মতো ঝা চকচকে। শব্দের চমক।বহিরাঙ্গের
এই চাকচিক্যই তো চায় এই ব্যবস্থা। পণ্য হোক সব।আর গুলিয়ে দাও সব। বিভ্রম! অথচ‘ কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার‘ (কবিতা এমন)। -এর মতোই সহজ, সুন্দর। ছিন্নমূল সংস্কৃতি আমাদের, শ্যাওলার
মতো ভেসে থাকে। শান্তি নেই, তৃপ্তি নেই। শিকড় থেকে কারা এত দূরে সরিয়েদিল আমাদের তাই
বারবার আল মাহমুদে ফিরে যাব আমি। কি বেদনা নিয়ে বলেছেন আহা- ‘ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায়বারবার / বর্গীরা লুটছে ধান নিম খুনে
ভরে জনপদ। তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গীঁ, শস্যের বিপদ।’ (সনেট: ৯)
অর্থনৈতিক আগ্রাসন কেড়ে
নিচ্ছে গ্রাম বাংলার বেঁচে থাকার অধিকার। ধর্মীয় গোঁড়ামি ধসিয়ে দেয় সংস্কৃতির ভিত-ভূমি।
অথচ মহাকালের কাছে কতো তুচ্ছ এসব। কবি অমোঘ দার্শনিকতায় বলেন, ‘কিছুই থাকে না’। বলেন, ‘গাঁয়েরঅক্ষয় বট উপড়ে যায় চাটগাঁর দারুন তুফানে/ চিড়
খায় পলেস্তরা, বিশ্বাসের মতন বিশাল / হুড়হুড় শব্দে অবশেষে ধসে পড়ে আমাদের পাড়ার মসজিদ!’ (বাতাসের ফেনা)
বলতে পারেন: ‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ’ (সনেট: ৪) কারণ, ‘হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে নাকো সুর।‘ (সনেট: ১৪)
০৩.
জমির আইলে বসে ভাবি, কই
একবারও তো মনে হয় না এসব বাঁধাগতের রাজনৈতিক উচ্চারণ। যেখানে পক্ষপাত দুষ্টতায় ‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ’ (সনেট: ৭) সেখানে একমাত্র কবিই পারেন বিষাক্ত হৃদয়ের তলদেশ থেকে তুলে
আনতে ভাষার অমৃত। এভাষা স্বতন্ত্র। বিশ্বায়ন আর উদারীকরণের নিনাদে ঢাকা পড়ে যায় আমাদের
আত্মপরিচয়ের ভাষা। আমরা পালাচ্ছি সংস্কৃতি থেকে, জীবন থেকে কোন এক উদ্দেশ্যহীনতার দিকে।
ঠিক তখনি বিদ্যুৎ চমকের মতন কানে আসে: ‘জীবনের পক্ষে তাই সারাদিন দরজাধরে থাকি‘ (পলাতক)।
কি ভালবাসা ও জীবনকে। মানুষকে,
শ্রমজীবি মানুষ। এ মাটিকে। শিরা-উপশিরায় প্রবহমান
গ্রাম বাংলার নদী। মাংস-মজ্জায় ‘আইল বাঁধা জমিন‘ চাষ করে
চলে কিষাণ-কিষাণী। দেখেন ‘জলডোরা সাপ’ সবুজ ফড়িং’বৃষ্টি
পড়ে…। ‘বর্ষণে ভিজছে মাঠ, যেন কার ভেজা হাতখানি। রয়েছে আমার
পিঠে’ (প্রকৃতি) এত স্বচ্ছ এতপরিস্কার নির্মল শব্দের আয়না!
কোথায় ভ্রান্তি! জসীম উদদীনের সরলতার উত্তরসূরি আধুনিক গভীর মননে দেখেন জীবনকে।
সনেটগুচ্ছ শুরু হয় একান্ত
নারীর কাছে প্রেম নিবেদনে। এ নারী নাগরিক প্রেয়সীর
প্রতীকে ভালবেসেছেন।যেখানে সমর্পণ আছে, আত্মবিক্রয়নেই। যৌনতার সুমহান ডাক আছে: ‘সুনীল চাদরে এস দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি’ (সনেট: ৩) সঙ্গে সাবধান বাণী: ‘এ তীর্থে
আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী/ মুকুন্দরামের রক্তমিশে আছে এ মাটির গায়’ (সনেট: ৪) শিকড়!
০৪.
অপমানিত এ বঙ্গদেশ। কুৎসায়,
অপবাদে। যেখানে নাকি পূর্বপুরুষেরা সম্রাটের দাসত্ব করতেন আর ‘বিবেক বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়।’ (সনেট: ৬)
‘সেই অপবাদে আজও ফুসে ওঠে বঙ্গের বাতাস‘ (ঐ)। এই কবি সব অপনাম সুচিয়ে দিতে চান আলাওলের কথায়, লালনের গানে। প্রেয়সীকে
আহ্বান করেছেন এই বঙ্গভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের সেপাই যদিও জানেন, রক্তস্নাত এইদেশ। তবু
‘যে রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে। ধুয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
নির্ভয়ে, নির্বাণে।‘
প্রেম চান, চান নির্ভার
যৌনতা। তবু, শ্রেণীবিভাজিত এই ব্যবস্থায় তা কি সম্ভব? তাই বুঝি প্রেয়সীকে বলেন,‘সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে’ (সনেট: ৬) অপমানে দীর্ণ এক বাঙ্গালী হৃদয় প্রেমে, কামে,সাম্যে, শস্যে
পরিক্রমা করে। তাঁর লড়াইয়ে সাথী করেন প্রেয়সীকে। ডাক দেন, ‘পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ’ (সনেট: ১০)
এক সোনালি স্বপনের ভোর
হবে জানেন কবি। শিশিরক্লান্ত। একান্ত নারীকে তখন ডেকে নেবেন ক্ষেতের আড়ালে। বেঁচে থাকার
যুদ্ধ শেষে মানুষ তো ফেরে প্রেমের কাছে, মহান শরীরের কাছে। তখনি হয় প্রকৃত মিলন। সাম্যভূমিতে
প্রকৃত মর্যাদা পায় প্রেম। আর তাই এবার: ‘বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল।গাঙের ঢেউয়ের
মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল‘ (সনেট: ১৩) আর বেঁচে থাকে জীবনের শপথ। সেকথার খেলাপ
যদি হয় কোনদিন, তবে: ‘এ বক্ষ বির্দীণ করে নামে যেন তোমার তালাক’ (সনেট: ১৪)
কোন চুক্তিপত্র নয়। এ শপথ
ভাষার, এ শপথ প্রেমময় কাব্যের ...
-----------------------------------
জনৈক স্কুল শিক্ষকের লেখা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন