জীবনানন্দ দাশের কবিতা

জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কবিতা বই ‘ঝরাপালক’-এর দ্বিতীয় কবিতা : 

নীলিমা
        
রৌদ্র ঝিলমিল,
ঊষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারেবারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!

        উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধুম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলি মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
        মরীচিকা-ঢাকা!
        অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার,—পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসকের কঠিন শৃঙ্খল,—
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্‌ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
        বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
        স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
        মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখ মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
        বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার, 
এই ধূলি,—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়,—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
--শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

শেষ কবিতা বই ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র শেষ কবিতা

হে হৃদ 

হে হৃদয়,
নিস্তব্ধতা?
চারিদিকে মৃত সব অরণ্যেরা বুঝি?
মাথার ওপরে চাঁদ
চলছে কেবলি মেঘ কেটে পথ খুঁজে—

পেঁচার পাখায়
জোনাকির গায়ে
ঘাসের ওপরে কী যে শিশিরের মতো ধূসরতা
দীপ্ত হয় না কিছু?
ধ্বনিও হয় না আর?

হলুদ দু ঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা
ব’লে চলে তবুও জীবন :
বয়স তোমার কত? চল্লিশ বছর হ’ল?
প্রণয়ের পালা ঢের এল গেল—
হ’ল না মিলন?
পর্বতের পথে পথে রৌদ্রে রক্তে অক্লান্ত সফরে
খচ্চরের পিঠে কারা চড়ে?
পতঞ্জলি এসে বলে দেবে
প্রভেদ কী যারা শুধু ব’সে থেকে থেকে ব্যথা পায় মৃত্যুর গহ্বরে
মুখে রক্ত তুলে যারা খচ্চরের পিঠ থেকে প’ড়ে যায়?

মৃত সব অরণ্যেরা ;
আমার এ জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলে :
কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে
নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকণ্ঠ আকাশের নিচে
কেন চ’লে যেতে চাও মিছে ;
কোথাও পাবে না কিছু ;
মৃত্যুই অনন্ত শান্তি হয়ে
অন্তহীন অন্ধকারে আছে
লীন সব অরণ্যের কাছে।

আমি তবু বলি :
এখনো যে ক’টা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি,
দেখা যাক পৃথিবীর ঘাস
সৃষ্টির বিষের বিন্দু আর
নিষ্পেষিত মনুষ্যতার
আঁধারের থেকে আনে কী ক’রে যে মহানীলাকাশ, 
ভাবা যাক—ভাবা যাক—
ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত শত
শত জলঝর্নার খনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন