রবার্ট ফ্রস্ট : কবিকে দেখতে যাওয়া

মূল : অক্টাভিও পাজ
ভাষান্তর : রায়হান রাইন

বিকাল তিনটার সূর্যের নিচে রাজপথ ধরে কুড়ি মিনিট হাঁটার পর শেষটায় বাঁকে পৌঁছলাম। ডানে মোড় নিয়ে উঠতে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে। মাঝেমধ্যে রাস্তার ধারের গাছগুলো মৃদু শীতলতা দিচ্ছে। লতাগুল্মের ভেতর একটা ছোট ঝর্নায় গিয়ে মিশে যাচ্ছে জল। আমার পায়ের নিচে চিক চিক করছে বালি। সর্বত্রই সূর্যালোক। বাতাসে পিপাসা, উষ্ণ বেড়ে ওঠা, আর সবুজের গন্ধ। না একটা গাছ না পাতা, কিছুই নড়ছে না। নীল, তরঙ্গহীন উপসাগরে কিছু মেঘ ভারি হয়ে নোঙর ফেলে আছে। একটা পাখি গেয়ে উঠল। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হলাম: এই এলমের নিচে সটান শুয়ে পড়তে পারলে কী চমৎকার হয়! ওই মৃদু জলশব্দ সব কবির শব্দাবলির চেয়ে মূল্যবান। আমি আরও দশ মিনিট হাঁটলাম। যখন খামার বাড়িটাতে পৌঁছলাম কিছু সুদৃশ্য-চুলের ছেলেমেয়ে একটা বার্চ গাছকে ঘিরে খেলছিল। তাদের খেলায় বাধা না দিয়ে কর্তাব্যক্তিটির কথা জিগ্যেস করলাম, তাদের জবাব, ঐ যে উপরে, কেবিনে।

তারা পাহাড়ের শিখরের দিকে দেখাল। আমি আবার চলতে শুরু করলাম। এখন হাঁটছি ঘন লতাগুল্মের ভেতর দিয়ে যেগুলো আমার হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে। যখন চূড়ায় পৌঁছলাম ছোট উপত্যকার সমস্তটা দেখা গেল; নীলচে পাহাড়, ঝর্না, উজ্জ্বল সবুজ সমতল, এবং একদম শেষদিকে বনভূমি। বাতাস বইতে শুরু করল, সবকিছু আন্দোলিত হচ্ছে, প্রায় উল্লাসভরে। পাতারা গান গাইছে। কেবিনের দিকে এগুলাম। ওটা একটা কাঠ দিয়ে বানানো কুটির, পুরনো, রঙচটা, বয়সের কারণে ধূসর। জানালাগুলো পর্দাশূন্য; আমি ছোট ছোট গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে ভেতরে তাকালাম। ভেতরে, ইজি চেয়ারে বসে একজন বয়েসী মানুষ। তার পাশে বসে আছে একটা পশমী কুকুর। আমাকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং অন্যপাশ দিয়ে যেতে ইশারা করলেন। আমি তাই করলাম এবং দেখলাম তিনি আমার জন্য তার কেবিনের দরজায় বসে অপেক্ষা করছেন। কুকুরটা আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য লাফিয়ে উঠল। আমরা খানিকটা সরু গলি পার হয়ে একটা ছোট কক্ষে পৌঁছলাম: চাকচিক্যহীন মেঝে, দুটো চেয়ার, একটা নীল ইজি-চেয়ার অন্যটা লালচে, কিছু বইসহ একটা লেখার টেবিল, কাগজ এবং চিঠিপত্রসহ আরেকটা ছোট টেবিল। দেয়ালে তিন কি চারটে খোদাইয়ের কাজ, কিছুই উল্লেখ্য নয়। আমরা বসলাম।
যা গরম, বিয়ার খাবে?
হ্যাঁ, সেই ভালো হয়। আধ-ঘন্টা ধরে হেঁটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
আমরা বিয়ার খাচ্ছিলাম অল্প অল্প করে। চুমুক দিতে দিতে আমি দেখছিলাম তাকে। তার শাদা শার্ট খোলা- ধবধবে শাদা শার্টের থেকে পরিচ্ছন্ন কিছু আছে কি আর? তার দুচোখ নীল, নিষ্পাপ, পরিহাস চটুল, তার দার্শনিকের মাথা এবং কৃষকের হাত, তাকে দেখতে প্রাচীন বিজ্ঞের মতো, সেই ধরনের যারা জগৎকে দেখতে ভালোবাসে এক নিভৃত নির্জনতা থেকে। কিন্তু তার তাকানোর মধ্যে তপস্বীর কোনোই ছাপ নেই বরং আছে এক মানবীয় প্রশান্তি। সেখানে তিনি থাকেন তার কেবিনে, জগৎ থেকে বিমুক্ত হয়ে কিন্তু তাকে প্রত্যাহার করতে নয় বরং তাকে ভালোভাবে দেখে নিতে। তিনি নির্জবাসী কোনো সন্ন্যাসী নন, আর এই পাহাড় নয় মরুভূমির ভেতরের কোনো পাথরপিণ্ড। তিনটি কাক... তার খাবার জন্য রুটি সংগ্রহ করে আনে না, গাঁয়ের দোকান থেকে তিনি নিজে তা কিনে আনেন।
বাস্তবিক এ এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। এটাকে প্রায় বাস্তবই মনে হয়। এই ভূদৃশ্য আমাদের মেহিকোর থেকে খুব আলাদা, এটা মানুষের দেখার জন্যে বানানো। দূরত্বগুলোও আমাদের পায়ের জন্য। আমার কন্যা আমাকে বলেছে, তোমার দেশের ভূদৃশ্য খুব নাটকীয়।
প্রকৃতি সেখানে খুব প্রতিকূল। যা বিপুল, অথচ আমরা স্বল্প এবং দুর্বল। মানুষ সেখানে ভূদৃশ্যের বিপুলতার ভেতর নিঃশেষিত, আপনি যখন ক্যাকটাসের মাঝ দিয়ে হাঁটবেন, আপনার পায়ে পায়ে থাকবে বিপদ।
ওরা আমাকে বলল, মানুষ সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে প্রায় কিছুই না করে।
বিকালবেলা তাদের দেখবেন একদম স্থির, রাস্তার পাশে কিংবা শহরগুলোর প্রবেশমুখে।
ওভাবেই কি তারা ভাবে?
সে এক দেশ যা একদিন পাথরে পর্যবসিত হতে চলেছে। গাছপালা, উদ্ভিদ সবই পাথরে পরিণত হতে যাচ্ছে, মানুষেরই মতো। আর জীবজন্তুগুলোও: কুকুর, নেকড়ে, সর্পকুল। আছে শুকনো কাদার মতো ছোট্ট পাখিরা। তাদের উড়তে দেখা, গান গাইতে শোনা খুব আশ্চর্যের, কারণ তারা যে জীবন্ত পাখি তা আপনি কখনো ধারণাই করতে পারবেন না।
আমার বয়স যখন পনের, আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। আমার প্রথম কবিতা। জানো কি, কী বিষয়ে ছিল সেটা? দুঃখ ভারাতুর রাত (ষধ হড়পযব ঃৎরংঃব), আমি তখন প্রেসকট পড়ছিলাম, এবং সম্ভবত তাকে পড়াটা তোমার দেশ সম্পর্কে ভাবনায় আমাকে উসকে দিয়েছিল। তুমি কি প্রেসকট পড়েছ?
ওটা আমার পিতামহের প্রিয় গ্রন্থগুলোর একটি, তাই আমি সেটা বালক বয়সেই পড়ে ফেলেছি, আবারও তাকে পড়বার ইচ্ছা আছে আমার।
বইয়ের পুনঃপঠন আমিও ভালোবাসি। যেসব লোক পুনঃপাঠ করে না, আর যারা গাদা গাদা বই পড়ে তাদের উপর আমার আস্থা নেই। এটা আমার কাছে ক্ষেপামো বলে মনে হয়, একটা আধুনিক উন্মাদনা, এটা কেবল উন্নাসিক পণ্ডিতের সংখ্যাই বাড়াবে। তোমাকে ভালোভাবে পড়তে হবে কিছু বই এবং বারংবার।
এক বন্ধু আমাকে বলল, তারা দ্রুতপাঠ উন্নয়নের এক উপায় আবিস্কার করেছে। তারা সম্ভবত স্কুলগুলোতে পদ্ধতিটা অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
তারা উন্মাদ। কীভাবে ধীরে পড়তে হয়, সেটা বরং লোকদেরকে শেখাতে হবে আর শেখাতে হবে বেশি পড়ার জন্য অধৈর্য না হতে। তুমি কি জান কেন তারা এসব জিনিস আবিস্কার করে? কারণ তারা আতঙ্কগ্রস্থ। লোকেরা কোনো জিনিসের কাছে থামতে ভয় পায়, কেননা এই থামা তাদেরকে আপোষ করায়। এ কারণেই তারা গ্রাম থেকে পালায় এবং শহরে আসে। তারা তাদের নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।
হ্যাঁ। জগৎটা আতঙ্কে ভরা।
এবং যারা ক্ষমতাশালী তারা ওই আতঙ্ককে কাজে লাগায়। ব্যক্তিজীবন কখনোই এত ঘৃণার কিংবা শাসকগোষ্ঠী কখনোই এত শ্রদ্ধার নয়।
অবশ্যই, একা বেঁচে থাকা সহজতর, একা নিজে সিদ্ধান্ত নেয়া। এমনকি মৃত্যুটাও সোজা, যদি অন্য কারো মূল্যে আপনি মরতে চান। ভয়ের আক্রমণে আমরা দিশেহারা। আছে সাধারণ মানুষের ভয়, সে শক্তিমানের কাছে সমর্পিত হয়। কিন্তু আছে আরেক রকম ভয়, যা ক্ষমতাবান লোকেরা অনুভব করে, তারা সাহসী হয় না একা থাকতে। কারণ তারা শঙ্কিত, তারা ক্ষমতার সঙ্গে আটকে রাখে নিজেদের।
এখানে দেশগাঁ ছেড়ে মানুষ যায় কারখানায় কাজ করতে এবং যখন ফিরে আসে তখন গ্রামকে আর ভালোবাসতে পারে না। জীবন সেখানে কঠোর। তোমাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়, দায়িত্বশীল থাকতে হয় সবকিছুতে, কারখানার মতো কেবল একটিমাত্র অংশের জন্য নয়।
আর তাছাড়া, গাঁয়ের অভিজ্ঞতা এক সর্বব্যাপী নিঃসঙ্গতার। আপনি ছবি দেখতে যেতে পারছেন না কিংবা বারে যেতে পারছেন না, যা হতে পারে ঝঞ্ঝাট এড়ানোর এক নিপাট আশ্রয়।

ঠিক তাই। ওটা হলো স্বাধীন হবার অভিজ্ঞতা। কবিতার মতো। যখন একজন কবি কবিতা লেখেন, জীবন তখন কবিতার মতো। অপরিচিতের আমন্ত্রণের মতো তার শুরু: প্রথম লাইন লেখা হবার পর কী আসছে, তা থাকে অজানা। এটা অনিশ্চিত, আমাদের জন্য দ্বিতীয় পঙক্তিতে কবিতা অপেক্ষা করছে নাকি বিফলতা। মরণশীলতার ওই বিপদের ধারণা একজন কবিকে তার অভিযাত্রার প্রতিটি পদে সঙ্গ দিয়ে চলে।
প্রতিটি পঙক্তিতে একটি সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করে, এবং যাতে সহজাত ধারণা নিজের মতো কাজ করে যেতে পারে সেজন্যে দুচোখ বন্ধ রাখাকে আমরা মেনে নিতে পারি না। কবিতার অনুপ্রেরণা গড়ে ওঠে এক সতর্ক ভারসাম্যে।
প্রতিটি লাইনে, প্রতি শব্দবন্ধে ঘাপটি মেরে থাকে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা। এই ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা কেবল আলাদা করে ওই লাইনের জন্য নয় বরং গোটা কবিতার জন্যও। আমাদের জীবন যেরকম: প্রতিটি মুহূর্তে থাকে তাকে হারাবার সম্ভাবনা। প্রতিটি মুহূর্ত বয়ে চলে মৃত্যুর ঝুঁকি। প্রত্যেক তূর্ণকাল বিকল্পের আধার।
আপনার কথা যথার্থ, কবিতা হলো স্বাধীন হবার অভিজ্ঞতা। কবি নিজেকেই বাজি রাখেন, কবিতার সবকিছুতে বাজি রাখেন তার সকল কিছুকে- তার লেখার প্রতিটি লাইনে।
এবং তুমি তোমার রায় পাল্টাতে পারো না। প্রতিটি কাজ, প্রতিটি পদ অপ্রত্যাহারযোগ্য, চিরকালীনভাবে। প্রত্যেক পঙক্তিতে কোনো কিছু চিরকালের জন্যই ঘটে। কিন্তু লোকেরা এখন দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছে। কেউই নিজের জন্য সিদ্ধান্ত দেয় না। সেইসব কবিদের মতো, যারা তাদের পূর্বজদের নকল করে।
 আপনি কি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী নন?
হ্যাঁ, কিন্তু প্রত্যেক কবিই জন্মে নিজস্ব কিছু বলবার জন্যে এবং তার আদি কর্তব্য হলো পূর্বজদের অস্বীকার করা, যারা তার আগে জন্মেছেন তাদের অলঙ্কারাদিকে পরিত্যাগ করা। আমি যখন লিখতে শুরু করি, দেখলাম বুড়ো লেখকদের শব্দসম্ভার আমার কোনো কাজে আসছে না, আমার জন্য দরকার আমার নিজস্ব একটি ভাষা সৃষ্টি করা। এবং সেই ভাষা যা কিছু লোককে বিস্মিত করে এবং বিপদে ফেলে- সে ভাষা আমার গোষ্ঠীর লোকের ভাষা, যে ভাষা আমার শৈশব এবং কৈশোরকে ঘিরে ছিল। আমার নিজস্ব শব্দসম্ভার পেতে আমাকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তোমাকে ব্যবহার করতে হবে প্রত্যহের ভাষা...
কিন্তু তা ঘটবে আলাদা একটা চাপের মুখে। যেন প্রতিটি শব্দের সৃষ্টি হয়েছে কেবল বিশেষ একটি মুহূর্তকে ব্যঞ্জনা দিতে। কারণ শব্দের রয়েছে নিজস্ব এক প্রকারের অবশ্যম্ভাবিতা। একজন ফরাসী লেখক বলেন, রূপকল্পকে খুঁজে পেতে হয় না, তারা দৃশ্যমানই থাকে। আকস্মিকতা সৃষ্টিকর্মের উপর পৌরহিত্য করে, তিনি এমন বুঝিয়েছেন এটা আমার মনে হয় না বরং নিয়তি-নির্দিষ্ট বিকল্পই আমাদের শব্দের দিকে চালিত করে।
কবি তার নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করেন। তাই তার কর্তব্য পূর্বজদের অলংকারাদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সে তার নিজের শৈলীর কাছেও আত্মসমর্পণ করবে না।
কাব্যশৈলী বলেও কিছু নেই। যখন আপনি কোনো শৈলীতে আটকে যান, তখন সাহিত্য থেকে কবিতা বিচ্যূত হয়।
আমি যখন লিখতে শুরু করি, আমেরিকান কবিতার তখন সেই দশা ছিল। সেখানেই আমার সব বিপত্তি ও সফলতার শুরু। এবং এখন প্রয়োজন, আমরা যে কাব্যভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত করেছি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। পৃথিবী ঘুরে ওঠে এবং গতকাল যা ছিল ভিতরে আজ তা বাইরে। এসব কিছুকে নিয়েই তোমাকে খানিকটা কৌতুক করতে হবে। সবকিছুকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেবার দরকার নেই, এমনকি সব ধারণাকেও না। অথবা, সঠিকভাবে বলতে গেলে, এতটা গুরুভার এবং আবেগপ্রবণ হবার কারণেই বরং আমাদেরকে নিজেদের নিয়ে ঈষৎ হাস্য করা উচিৎ। তাদের তুমি বিশ্বাস কোরো না, যারা হাসতে জানে না।
এবং তিনি হাসলেন সেই মানুষের হাসি, যে বৃষ্টি দেখেছে এবং সেই মানুষেরও যে ভিজেছে বৃষ্টিতে। আমরা উঠলাম এবং খানিকটা পথ হাঁটতে বেরুলাম। আমরা নামলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। কুকুরটা লাফিয়ে এলো আমাদের সামনে। আমরা বাইরে এলে তিনি আমাকে বললেন: তাদের প্রায় কেউই বিশ্বাস করে না, যারা জানে না কীভাবে নিজেদের নিয়ে হাসতে হয়। ঐশ্বরিক গাম্ভীর্যে ন্যুব্জ কবি, বিরসমুখো অধ্যাপক, ধর্মগুরু যারা কেবল চিৎকার করতে আর বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিতে জানে, তারা সবাই খুব বিপজ্জনক মানুষ।
আপনি কি সমসাময়িকদের লেখা পড়েন?
আমি সব সময় কবিতা পড়ি। তরুণ কবিদের কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগে। এবং কিছু দার্শনিকের লেখা। কিন্তু আমি উপন্যাসে স্থির হতে পারি না। আমার মনে পড়ে না আমি কখনো কোনো একটা শেষ করেছি।
আমরা সামনে এগোই। যখন খামারঘরের নিকটে গেলাম, ছেলেমেয়েরা জড়ো হলো আমাদের ঘিরে। কবি এখন আমাকে বলছেন তার শৈশব সম্পর্কে- সানফ্রানসিসকোর বছরগুলো, তার নিউ ইংল্যান্ডে ফিরে আসা।
এই আমার দেশ এবং আমি বিশ্বাস করি এটি সেই জায়গা যেখানে জাতির শিকড় প্রোথিত আছে। সব কিছুরই জন্ম হয় এখান থেকে। তুমি কি জান ভারমন্ট রাষ্ট্রটি মেহিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল? হ্যাঁ, সবকিছুরই জন্ম হয় এখান থেকে। এ সেই জায়গা যেখানে কারো অপরিচয়ে নিমজ্জনের ইচ্ছা এবং তোমার নিজের সঙ্গে একাকী থাকার ইচ্ছার উন্মেষ ঘটে। আমাদের উচিৎ সেইখানে ফেরা আমরা কি ছিলাম তা যদি আমরা সংরক্ষণ করতে চাই।
এটা আমার কাছে খানিকটা কঠিন মনে হয়। আপনি এখন একজন ধনী লোক।
বছর কয়েক আগে আমি এক ছোট্ট দেশে যাবার কথা ভেবেছিলাম, যেখানে লোকেদের হল্লা কানে আসে না। আমি পছন্দ করেছিলাম কোস্টারিকা; যখন যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি জানলাম সেখানেও আমেরিকান কোম্পানি যথারীতি ভিত গেড়েছে। আমি যাইনি। সে কারণেই আমি এখানে, এই নিউ ইংল্যান্ডে।

আমরা বাঁকে এসে পড়লাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম: দুঘণ্টার বেশি সময় পার হয়ে গেছে।

আমাকে যেতে হবে এখন। নিচে ব্রেডলৌফে তারা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। তিনি হাত বাড়ালেন। পথ চিনবে তো?

হ্যাঁ। আমি বললাম এবং হাত নাড়লাম। কয়েক পা এগোবার পর তার কণ্ঠ শোনা গেল:

শিগগির এসো আবার। আর নিউইয়র্কে গিয়ে লিখো আমাকে। ভুলো না কিন্তু।

আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম। তাকে দেখলাম পথ বেয়ে উঠছেন কুকুরটার সঙ্গে খেলা করতে করতে। এবং তার বয়স সত্তুর, আমি ভাবলাম। ফিরে যাবার পথে অন্য এক কবি, অন্য আরেকজনকে দেখতে যাবার কথা স্মরণ করলাম। আমার ধারণা রবার্ট ফ্রস্ট আন্তোনিও মাচাদোকে জেনে থাকবেন। কিন্তু তারা পরস্পরকে বুঝবেন কী করে? একজন স্পেনবাসী যিনি ইংরেজি বলেন না এবং একজন আমেরিকান যিনি হিস্পানি ভাষা জানেন না। তা কোনো বিষয় নয়, তারা হাসি বিনিময় করে থাকবেন। আমি নিশ্চিত তারা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন এভাবেই সরাসরি। আমি রোকাফোর্টের বাড়িটির কথা স্মরণ করলাম, ভ্যালেনসিয়ায়, জঙ্গুলে, অবহেলিত উদ্যান, শোবার ঘর এবং ধূলিধূসর আসবাব। এবং মাচাদো, মুখে সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। স্পেনের লোকটিও একজন প্রাচীন, জগতের কাছ থেকে নিয়েছেন অবসর, আর তিনিও জানেন কীভাবে হাসতে হয় এবং তিনিও আনমনা। আমেরিকানের মতো তিনিও দার্শনিকীকরণ ভালোবাসেন, কিন্তু তা স্কুলে নয়, নিজের চৌহদ্দিতে। এই দুই জ্ঞানবৃদ্ধ সবার জন্য: আমেরিকান তার কেবিনে, স্পেনবাসী তার প্রাদেশিক ক্যাফেতে। মাচাদো ঐশ্বরিক গাম্ভির্যের মধ্যকার ভয়াবহতাকে দেখিয়ে দেন এবং তারও আছে একই হাস্যময় অহং। হ্যাঁ, অ্যাংলো স্যাক্সন যিনি তার আছে পরিচ্ছন্নতর শার্ট এবং দৃশ্যপটের মধ্যে আছে প্রচুর বৃক্ষ। কিন্তু অন্যজনের হাসি বিষণ্ণতর এবং আরো সুন্দর। এইজনের কবিতায় প্রচুর তুষার, অন্যজনের আছে ধূলিচূর্ণ, প্রত্নবস্তু এবং ইতিহাস। ওই ধুলো ক্যাস্তাইলের, ওই ধুলো মেহিকোর, তা যখন তুমি ছুঁতে যাবে, মিলিয়ে যাবে হাতের মধ্যে... ।
লেখাটি অক্টাভিও পাজের অন পোয়েটস এন্ড আদারস (১৯৮৬) গ্রন্থ থেকে অনুদিত। মূল হিস্পানি থেকে গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মিখাইল স্মিথ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন