বিনয় মজুমদার, ১৯৩৪-২০০৬
আগের কিস্তির লিংক
মানস স্যানাল
মানস স্যানাল
বিনয়ের কবিতা নিয়ে বলতে গেলে, তার প্রায় প্রতিটি কবিতা নিয়েই কথা বলা যায়। তিনি হয়তো অত্যন্ত সাংকেতিক ও জ্যামিতিক পৃথিবীতে বাস করে গেছেন। ফলে তিনি যাই বলুন না কেন, হয়ে যায় প্রতীকী।
সকল ফুলের কাছে এত মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
মানবিক চেতনার বিকাশের সাথে সাথে তো আর মানুষের জ্যান্তব কোয়ালিটি মিলিয়ে যায় না। মাংসাশী প্রাণি হিসাবে প্রাণি হত্যায় তার সহজাত প্রবৃত্তি আছে। এইসব দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে ওঠেন। বিষাদের ভারে নুয়ে পড়েন।
ডানা না নেড়েই উর্ধ্বে যে চিল সন্ধান করে ফেরে
তার মতো ক্লান্তি আসে;
অন্যান্য স্লোগানমুখর কবিদের মতো বিনয় মজুমদার কখনো স্লোগান নির্ভর কবিতা লেখেননি। তার কবিতা অনেকটাই আত্মমুখি। ইন্ট্রোভার্ট। বহির্জগতের হাউকাউ, হল্লা, চেঁচামেচি হয়তো তার ভালো লাগতো না। এমন কথা মাঝে মাঝেই তিনি কবিতায় বলেছেন। আরও একটা বিষয় হলো, কবিতায় তার কথা বলার মৌন ভঙ্গি অনেকটাই জীবনানন্দের মতো। যদিও জীবনানন্দের মতো এত বিষাদগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত নয়। তারপরও কোথায় জানি একটা সাদৃশ্য থেকে যায়। হয়তো অন্য অনেকের মতো জীবনানন্দ তারও প্রিয় কবি ছিলেন। জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা তার একটি ভালো ও বহুল পঠিত কবিতাও আছে। একবার কবিতাটির দিকে তাকানো যেতে পারে।
ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় চিল শুধু বলেছিলো, ‘এই জন্মদিন’।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো অক্ষমের গান।
সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরিতকী ফলের মতন
ঝ’রে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল।
এখন সকলে বোঝে মেঘমালা ভিতরে জটিল
পুঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত,
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিল, এখনো রয়েছে, চিরকাল
র’য়ে যাবে; সংগোপন লিপ্সাময়ী, কম্পিত প্রেমিকা—
তোমার কবিতা, কাব্য; সংশয়ে সন্দেহে দুলে দুলে
তুমি নিজে ঝরে গেছ, হরিতকী ফলের মতন।
সংশয়ে সন্দেহে দোদুল্যমানতার যে বিষয়টা জীবনানন্দকে তাড়িয়ে বেড়াতো বলে আমরা আজ জানি, সেই বিষয়টাই হয়তো বিনয়কেও তাড়িত করেছে কবিতাটি লিখতে। আশ্চর্য মিল দুজন কবির মধ্যে। একজন তিরিশের, অন্যজন পঞ্চাশের। সময়ের সীমারেখা ডিঙিয়ে তারা সমসাময়িক হয়ে ওঠেন পাশাপাশি জন্মানো দুইটি হরিতকী ফলের মতন। এমন সহজাত বেদনাবোধ দুজনেরই মাঝে ছিল। তবে গ্রীক ক্লাসিক্যাল ট্রাজেডির ক্যাথারটিক ইফেক্টের মতো কিছু দুজনের কবিতাতেই অনুপস্থিত। এই কবিতাটির দিকে তাকানো যাক।
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রান্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হলে কী প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হয়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয়;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্বলে ওঠে।
অথচ শবের সঙ্গে কথা বলা স্বাভাবিক কিনা
ভেবে ভেবে দিন যায়; চোখাচোখি হলে লজ্জা ভয়ে
দ্রুত অন্য দিকে যাই; কুক্কুপিণ্ট ফুলের ভিতরে
জ্বরাক্রান্ত মানুষের মতো তাপ; সেই ফুল খুঁজি।
আরেকটি কবিতার দিকে তাকানো যেতে পারে:
বেশ কিছুকাল হলো চ’লে গেছ, প্লাবনের মতো
একবার এসে ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি
জীবন যাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরোনো,
দেয়ালে তাকায়ে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
মানুষীর আকৃতির মতো তমি দেখা দিয়েছিলে।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কূজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো; তুমি পুনরায় চলে গেছ।
জীবনানন্দের মতো বিনয়ও অধিকাংশ কবিতাই অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন। শুধু তাই নয় আট মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। সমগ্র কবিতা-জীবনই তিনি এই চর্চা ধরে রেখেছেন। ব্যতিক্রমও আছে। ছড়াগুলোতে ব্যতিক্রম পাওয়া যায়। এবার আসা যাক উপমার বিষয়ে। জীবনানন্দের মতো বিনয়ও উপমার জাদুকর। আমি কাউকে কারো চেয়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখতে চাইছি না কারণ দুজনের উপমাই একজন পাঠককে স্টান করে দেবার জন্য যথেষ্ট। জীবনানন্দের উপমা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বলা যায় বিনয়ের উপমা নিয়েই। কিছু উপমার দিকে একবার তাকানো যাক:
ডানা না নেড়েই উর্দ্ধে যে চিল সন্ধান করে ফেরে
তার মতো ক্লান্তি আসে; কোনো যুগে কোনো আততায়ী
শত্রু ছিলো বলে আজো কাঁটায় পরিবেষ্টিত হয়ে
গোলাপ যেমন থাকে, তেমনি রয়েছ তুমি; আমি
পত্রের মতন ভুলে অন্য এক দুয়ারের কাছে।
অথবা
ব্যর্থ হও, তবু বালি, ভিতরে প্রবিষ্ট বালিটুকু
ক্রমে ক্রমে মুক্তা হয়ে গতির সার্থক কীর্তি হবে।
অথবা
মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝ’রে যাবে।
অথবা
নিষ্পেষণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত।
অথবা
যেসব চিত্রের পক্ষে কোনো
সামাজিক মেলামেশা অসম্ভব তাদের মতন
ত্যক্ত হয়ে যেতে পারো;
বিনয়ের উপমা তার কবিতার মতোই বুদ্ধিজাত। জীবনানন্দের উল্টো। আবেগ বা অনুভূতির চেয়ে বুদ্ধি বা মেধার নেপথ্য কারুকাজ বেশি। মাঝে মাঝে চিন্তাকে উস্কে দেবার মতো কিছু কথা থাকে যা প্রকৃতই প্রমাণ করে কবিতায় কবি বিনয় মজুমদার কতটা নিবেদিত ছিলেন। এমন চিন্তা উস্কানো কয়েকটি পঙ্ক্তির দিকে তাকানো যেতে পারে:
লতারা কীভাবে বোঝে কাছে কোনো মহীরূহ আছে,
তার পর আরোহণ ক’রে তবে জীবন যাপন
করার সফল কীর্তি কীভাবে যে করে, তা জানি না।
তবু বৃক্ষ সনাতন বৃক্ষই, লতাও শুধু লতা,
মৌমাছি ও কুসুমের অভীপ্সার রোমাঞ্চ জানে কি?তার মানে কী? লতারও কি অনুভূতি থাকে? অতি-অনুভূতি? না হলে কীভাবে লতা বোঝে কাছাকাছি কোনো মহীরুহ আছে! এমন নতুন চিন্তার সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায় বিনয়ের কবিতা পড়তে গেলে। যা সমসাময়িক অন্যদের কবিতায় বিরল। মোদ্দা কথা হলো, জীবনানন্দের এক দশক পরেই, অর্থাৎ চল্লিশ বাদ দিয়ে পঞ্চাশে এসেই বাংলা কবিতা পেলো আরেক মহীরূহকে। তার নাম বিনয় মজুমদার। যিনি তার অগ্রজের মতোই একটি পৃথক কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, বাক্য গঠন, পোয়েটিক টার্মিনোলজির ব্যবহার ইত্যাদির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বোঝা যায় কবিতাটি বিনয় মজুমদারের লেখা কি না। যেমন, বলে মনে হয়, কী প্রকার, প্রকৃত প্রস্তাব, পারাবত, পায়রা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের সাথে সাথেই আমাদের মনে উঠে আসে বিনয় মজুমদারের কথা। জীবিত অবস্থাতেই তিনি বাংলা কবিতার এক প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। যদিও সেই প্রবাদ পুরুষে পরিণত হওয়ার আনন্দ বা বেদনা কোনোটাই উদযাপন করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিল না। একা একা থাকতেন। সিজোফ্রেনিয়ার কারণে আচরণেও উন্মাদনা ছিল। আসলে, আজকের সময়ে, তার মৃত্যুর আট বছর পর অনেকেই মনে করেন, বিনয় যে লাইফ লিড করেছেন তা না করলে, বা এতটা নিবিষ্ট না হলে, তার পক্ষে এমন প্রবাদ পুরুষে পরিণত হওয়া সম্ভব ছিল না। পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে প্রথম অবস্থায় সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে অবহেলিত ছিলেন, কিন্তু ছিলেন অন্যতম নিবেদিত প্রাণ। কবিতায় তার নিমগ্নতাই আজ তাকে এতটা মহান করে তুলেছে। কিংবদন্তীতে রূপান্তরিত করেছে।
এই প্রসঙ্গে আমি আরো একজন কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যার হাত ধরে আমি বিনয়ের কবিতার সাথে পরিচিত হই। কবি অমিতাভ পাল। বিনয়ের কবিতার তিনিও বিশেষ অনুরাগী। মনে আছে, বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ট কবিতার বইটি আমি তার কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম। এবং পুরোটা বই ফটোকপি করে পড়েছিলাম। তখন ময়মনসিংহ শহরে হয়তো এক দুইটা লাইব্রেরিতে বিনয়ের গ্রন্থটি ছিল। কিন্তু নতুন বই কেনার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। তখন অনার্সে পড়ি। দুইটা জামা ছিল। একটা টি-শার্ট। পরীক্ষার আগের সময়গুলোতে টিউশনি ছেড়ে দিয়ে পড়তাম। টিউশনি না থাকার সেই সময়টাতে খুব অর্থকষ্টে থাকতে হতো। তার উপর ধূমপানের অভ্যাস। প্রতিদিন কয়েকটা তো লাগেই। সেই অবস্থায় কবি অমিতাভ পালের বাসা থেকে বইটা এনে, ফটোকপি করে, নিজেই সেলাই করে বেঁধে, বইটা তাকে ফেরত দিয়েছিলাম। তার কাছেই দেখেছিলাম, বিনয় মজুমদারের নিজ হাতে লেখা কয়েকটা কবিতার কপি। কোনো এক উপলক্ষ্যে অমিতাভ দাকে পাঠিয়ে ছিলেন। একটা কবিতার কিছুটা আমার মনে আছে, শ্রম থেকে যদি শ্রমিক হয়, তবে ভ্রম থেকে হওয়া উচিৎ ভ্রমিক, তারপর আর মনে নেই। অমিতাভ দার কাছে নিশ্চয়ই এখনো আছে কবিতাগুলি। থাকারই কথা। বিনয়ের কবিতা হারিয়ে ফেলার মতো লোক তিনি না।
যাই হোক, অমিতাভ দাকেও কৃতজ্ঞতা জানাই আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই কবি বিনয় মজুমদারকে। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো একটা মেসেজ পাঠানো যেত— শুভ জন্মদিন। যেহেতু বেঁচে নেই তাই তার কবিতার কথা বললাম। সন্তানকে শুভেচ্ছা জানানোও কি এক অর্থে পিতাকেই শ্রদ্ধা জানানো নয়? শুভ কামনা জানানো নয়! অশুভ পৃথিবীতে বসবাস করতে করতে বিশেষ একটি দিনে শুভ কামনা জানাতে ভালোই লাগে। যে কোনো উঁচু বৃক্ষের বাকলে খোদাই করে লিখে দিতে ইচ্ছা করে— শুভ জন্মদিন কবি বিনয় মজুমদার।
- See more at: http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/326042.html#sthash.fsXNxOKF.dpuf
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন