প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প পোস্টমাস্টার

বাংলা ছোটগল্পের সূচনা পর্বের একজন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের একযুগ পরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং গল্পরচনার সূচনাও করেন কবিগুরুর একযুগ পরে। তিনি রবীন্দ্রযুগের গল্পকার, যদিও রবীন্দ্র-গোত্রের শিল্পী নন। আসলে রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের সাহিত্যিক বলতে সাধারণত কল্লোল যুগের কবি-কথাকারদের বোঝায়। প্রভাতকুমার কল্লোলের শিল্পীদের চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ ছিলেন।

পোস্টমাস্টার গল্পের কথা শুনলেই আমাদের রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্পটির কথাই মনে পড়ে। কিন্তু এর বাইরে প্রভাতকুমারেরও পোস্টমাস্টার নামে একটি ছোটগল্প আছে এবং এই গল্পটিও শিল্পবিচারে অনন্য। কবিগুরুর পোস্টমাস্টার অনুভূতি-প্রধান গল্প, কিন্তু প্রভাতকুমারের পোস্টমাস্টার চরিত্র-প্রধান। প্রভাতকুমার কোন নায়কের গল্প বলেন নি, বরং চতুর ভিলেনকেই গল্পের প্রধান চরিত্র বানিয়েছেন।
প্রভাতকুমারের সৃষ্ট অসাধু পোস্টমাস্টার বিমল অন্যের চিঠি খুলে পড়ত। প্রেমের চিঠি, পরকীয়ার চিঠি পড়াতেই তার অতি আগ্রহ। লেখকের বর্ণনায়, ‘বিমল এই ছয় মাসের মধ্যে বৈধ ও অবৈধ সহস্রাধিক প্রেমপত্র পড়িয়াছে, সে জানে বৈধ প্রেমের চিঠি অপেক্ষা, অবৈধ প্রেমের চিঠিতেই “মজা” বেশি থাকে।’ শুধু তাই নয়, খামের মধ্যে কেউ টাকা পাঠালে তাও আত্মসাৎ করতে ছাড়ত না। একবার এক চিঠির খামে সে দশ টাকা পেয়ে রেখে দেয় এবং টাকাটা বিলাতী মদ্যপানে ব্যয় করে। চিঠিতে উল্লেখ ছিল, ঐ টাকা পত্রলেখকের খোকার দুধ খরচের জন্য পাঠানো।
পোস্টমাস্টার অতীতে বখাটেপনায় তার এলাকায় শীর্ষে আরোহন করেছিল। কোনমতে মেট্রিক পাশ করার পর সুপারিশের দৌলতে তার কর্মযোগ ঘটে। এক গ্রাম্য পোস্ট অফিসের প্রধান হয় সে। ছোট বড় অন্যায় করে দিন তার ভালই যাচ্ছিল। একদিন এক চিঠি পড়ে জানতে পারে, এক বিধবা রমণী অপর এক পুরুষের সাথে পালানোর পরিকল্পনা করছে। পোস্টমাস্টার যথাসময়ে অন্যের প্রণয়িনীকে নিয়ে পালানোর জন্য উপস্থিত হয়। কিন্তু পাপকর্মের ফলস্বরূপ প্রচণ্ড প্রহারে জ্ঞান হারায় এবং ভোর বেলায় নিজেকে পোস্ট অফিসে আবিষ্কার করে। চতুর পোস্টমাস্টার তার অপদস্থ হওয়ার ঘটনাকে পেশাগত উন্নতির জন্য চরমভাবে কাজে লাগায়। সে পুলিশকে বলে, রাতে একদল ডাকাত তাকে প্রহার করে পোস্ট অফিসের তহবিল থেকে ৫৪২ টাকা নিয়ে গেছে আর সম্পূর্ণ টাকাটা সে রেখে দেয়। তার অভিযোগকে জোরালো করার জন্য বলে, স্বদেশী আন্দোলনকারীরা ডাকাতি করেছে। কারণ, সে তাদের নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে শুনেছে। সেসময় শিক্ষিত অনেক ছেলে স্বদেশী আন্দোলন করত যাতে অনেক সময় জাতীয়তাবাদের উগ্ররূপ দেখা যেত। যদিও ডাকাতদের কেউ ধরা পরে না কিন্তু পোস্টমাস্টারকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়।
সাধুভাষায় লেখা পোস্টমাস্টার গল্পটি চিরাচরিত ছোটগল্পের মত হঠাৎ করেই আমাদের গল্পের মাঝখানে নিয়ে ফেলে। ছোটগল্পের গুরুত্বপূর্ণ সব স্তম্ভ এতে শৈল্পিকভাবে আছে। ‘ক্যারেক্টার’ এবং ‘প্লট’ দুটিই খুব শক্তিশালীভাবে সৃজিত। গ্রাম্য পোস্ট অফিস এবং তাতে কাজের বণ্টনের বর্ণনাও এত সুন্দর যে খুব সহজেই গল্পের ‘সেটিংস’ মানসপটে ভেসে ওঠে। পোস্টমাস্টার যখন অন্যের প্রেমিকাকে অপহরণ করতে যায় তখন থেকেই গল্পের ‘কনফ্লিক্ট’ ঘনীভূত হয়। তবে ‘থীম’ প্রসঙ্গে বলতে হয়, এ গল্পটি কোন নীতিশিক্ষার গল্প নয়। বরং জগতে ধূর্ত লোকেরা কিভাবে বৈষয়িক সুবিধা আদায় করে নেয়, সে বাস্তবতার চিত্রই আঁকা আছে। গল্পটিতে একটি সুন্দর বিধবা বিবাহের ঘটনারও উল্লেখ আছে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার এবং প্রভাতকুমারের পোস্টমাস্টার গল্পদুটি তাদের আপন আপন ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষরিত। শুধু এই গল্পদুটি থেকেই প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত কবি আর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আপ্রথম কথাসাহিত্যিক।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন