শিল্পী ও মিস্তিরি : সৈয়দ শামসুল হক

আমার চিত্রকর বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী একবার একটা কথা বলেছিলেন− ‘আমরা মিস্তিরি মানুষ। এ বাড়িতে পোষালো না, র‍্যাঁদা-করাত-বাটালি চটের থলেতে পুরে অন্য গেরস্তের বাড়ি যাবো।’ কাইয়ুম আর আমি একসঙ্গে বহু পত্রপত্রিকা আর প্রকাশকের বাড়িতে কাজ করেছি; কাজ নিয়ে একবার একজনের সঙ্গে খটাখটি লাগলে, আমি মন খারাপ করলে, ঐ কথাটি তিনি বলেছিলেন।
সত্যি বৈকি− খাঁটি সত্যি কথা।
শিল্পের গাড়ি নিছক প্রেরণায় চাকায় চলে না। তিনি গায়ক হন, লেখক হন কি চিত্রকর, তাঁর ভেতরে নিদ্রাহীন দুই পুরুষ−প্রতিভাবান শিল্পী আর নিপুণ মিস্তিরি।
মিস্তিরির দিকটা বুদ্ধিনির্ভর, আর শিল্পীর দিকটা দিকটা দৃষ্টিনির্ভর। দৃষ্টি আর বুদ্ধি, এ দু’য়ের রসায়নে হয় একটি ছবির জন্ম, কি একটি কবিতার। দৃষ্টি দিয়ে যা আয়ত্ব করলাম, বুদ্ধি দিয়ে তা পৌঁছে দিলাম। অধিকাংশ শিল্পচেষ্টাই যে শেষ পর্যন্ত পৌছোয় না তার কারণ, আমি মনে করি, ওই মিস্তিরিটি ছিল না।
একটি উপমা আমি প্রায়ই দিয়ে থাকি− চেয়ারের চারটে পা যদি মেঝের ওপর ঠিকমতো না-ই বসলো তো সে চেয়ার দেখতে যতই মনোহর হোক আমার তাতে কাজ নেই। চেয়ার বসবার জন্য। মেঝের ওপর জুৎ মতো সেটি বসতে হবে, তার পা চারটে স্থির মতো থাকতে হবে, কোথাও এতটুকু টলমল করবে না; তবে সে চেয়ারে আমি বসবো। বসে তারপর দেখবো আসন কতটা আরামদায়ক, পিঠ কতটা সুখপ্রদ। সে-সব হলো তো দেখব− চেয়ারটির নকশা কেমন, পালিশ কেমন; সবশেষে যাচাই করবো টেকসই করদূর। তবেই সে চেয়ার হবে আমার চেয়ার।
লেখা সম্পর্কেও আমার একই দাবি। লেখাটি মিস্তিরির হাতে ওই চেয়ারের মতো পোক্ত হতে হবে। কবিতা হলে ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার আমি দেখতে চাই; ছন্দ নির্ভুল তো আমি দেখবো কবিতার অন্তর্নিহিত যে যুক্তির সিঁড়ি সেটি আছে কিনা; থাকলে সে সিঁড়ি কতটা মজবুত। তারপর দেখবো কবিতায় বলবার কথাটি জ্যামিতিক সম্পূর্ণতা পেয়েছে কিনা। এই জ্যামিতিক সম্পূর্ণতা বলতে বোঝাতে চাচ্ছি ত্রিভুজ কিংবা বৃত্ত অথবা আয়তক্ষেত্র বা বর্গক্ষত্রের মতো তৃপ্তিকর একটি নির্মাণ।

মার্জিনে মন্তব্য, পরিচ্ছেদ : শিল্পী ও মিস্তিরি; সৈয়দ শামসুল হক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন