মতিন বৈরাগী
দশক ভিত্তিক কবি ও কবিতার আলোচনায় আমার সংশয় আছে। কারণ যে দশক থেকে কবি লেখা শুরু করেন তার পূর্ণতা পরবর্তী দশকগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী দশক এবং তার পরের দশকগুলোতে কবির বয়স অভিজ্ঞতা,দায়িত্ব অনুভব ও প্রকাশের সংযম ইত্যাদির পরিপক্কতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা পাই শিল্পরীতির ঋদ্ধি। তবুও দশক কে ভিত্তি করে কবিদের চিহ্নিত করা হয় কাব্যনির্মাণে তাঁদের শুরুর সময় বিবেচনা করে।
পরবর্তির দশকগুলোতে নতুন কবিদের সংগে তাঁদের সংযোগ, অভিজ্ঞতার বিনিময় নতুন ভাবে প্রকাশ পায়। অগ্রজ কবিদের সৃষ্ট ধারাগুলো অনুজ কবিদের কে উৎসাহিত করে। নির্মাণে অনুসরণ/ অনুকরণ ঘটে। সে হিসেবে একটা সময় কাল ধরে কবিদের কবিতাকর্ম আলোচনার পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে, তবে আমার ধারণা এতে অগ্রজ কবির সর্বদিক থেকে উত্তোরিত কবিতাগুলো আলোচনার অনিবার্য অংশ না হয়ে আড়াল হয়ে যায়। এরকম একটি বিষয়-এর জন্য যে সমযের একান্ত প্রয়োজন তা’ পাওয়া যাবেনা ফলে ৫ এবং ৬-দশকের কবিতা-কঙ্কালের খানিকটাই আলোচ্য হবে।
পরবর্তির দশকগুলোতে নতুন কবিদের সংগে তাঁদের সংযোগ, অভিজ্ঞতার বিনিময় নতুন ভাবে প্রকাশ পায়। অগ্রজ কবিদের সৃষ্ট ধারাগুলো অনুজ কবিদের কে উৎসাহিত করে। নির্মাণে অনুসরণ/ অনুকরণ ঘটে। সে হিসেবে একটা সময় কাল ধরে কবিদের কবিতাকর্ম আলোচনার পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে, তবে আমার ধারণা এতে অগ্রজ কবির সর্বদিক থেকে উত্তোরিত কবিতাগুলো আলোচনার অনিবার্য অংশ না হয়ে আড়াল হয়ে যায়। এরকম একটি বিষয়-এর জন্য যে সমযের একান্ত প্রয়োজন তা’ পাওয়া যাবেনা ফলে ৫ এবং ৬-দশকের কবিতা-কঙ্কালের খানিকটাই আলোচ্য হবে।
মানুষের সামাজিক অবস্থান তাঁর চেতনাকে নির্ধারণ করে’ মানুষ সৃষ্টি করে কেবল মাত্র তাঁর নিজের জন্য নয়, পরবর্তিনের জন্যও। সৃষ্টি মানেই প্রকাশ, এই প্রকাশ আকাঙখা মানুষকে মানুষ স্তরে পৌঁছিয়েছে। প্রাণীকুলের আয়োজন তাৎক্ষণিক মানুষের তা নয়। প্রকাশ শুধু মাত্র মানুষেরই আছে কারণ তার ভাষা আছে। আর ভাষাই চিন্তার বিনিময়, উদ্ভাবনে, নতুন চিন্তার সংযোজনে সভ্যতার বাহন হয়ে ওঠে। ভাষা থাকার কারণে মানুষ তার প্রকাশগুলো রূপগ্রাহী হৃদয়গ্রাহী আনন্দময় করে তুলতে পারে এবং টিকে থাকবার উপযুক্ত কাঠামো তৈরী করতে পারে। ’সাহিত্য সৃষ্টি একজন মানুষের কল্পনা বা খেয়াল নয় বা উত্তজিত মস্তিষ্কের খুশির প্রকাশ নয়, সমকালে প্রচলিত পদ্ধতি ও স্রষ্টার বিশেষ মানসিকতার প্রতিলিপি সাহিত্য’ হিপোলাইত তেইন এমন মত ব্যক্ত করেছেন। মানুষে মানুষে রয়েছে চিন্তার ভিন্নতা এর কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বিভাজিত সমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, অভ্যাস ইত্যাদিতে পার্থক্য বিদ্যমান। লুনাচারস্কির মতে লেখক ‘নিজে যে শ্রেণীর অন্তর্গত সেই শ্রেণীর মনস্তত্ত্ব কোনো না কোনভাবে সহিত্যে সর্বদাই প্রতিফলিত হয়’। ক্রোচের মতে সুন্দর তাকেই বলবো যা দৃষ্টি নন্দন এবং শ্রুতিনন্দন’ যদিও এর বিপরীত মত রয়েছে যে দৃষ্টি নন্দন বা শ্রুতি নন্দন কথাটা আপেক্ষিক, কারণ অসম সমাজে মানব-চিত্তে প্রবৃত্তিগত পার্থক্য রয়েছে। যা সুন্দর তা উপভোগ করার ক্ষমতা সকলের সমান ভাবে থাকে না সামাজিক বৈষম্যের কারণে।
বাংলা কবিতা আলোচনা যেমন ভাবেই হোক খণ্ডিত ভুগোলের উপর দাঁড়িয়ে তা’ পূর্ণাঙ্গ হয় হয় না, কারণ এর অভিজ্ঞতা অখণ্ড। আসলে বাংলা ভাষাভাষি সকল সীমানায় এর বিস্তৃতি। মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ থেকেও শুরু করলে তার পূর্বের অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করা যায় না, যে রকম বর্তমানের মানুষ ভাবতে গেলে প্রাথমিক মানুষদের অগ্রাহ্য করে পূর্ণাঙ্গ ‘মানুষ চিন্তা’ অসম্ভব।। তবু তা’ করতে হয় এজন্য যে স্থান কালের ব্যাবধান, দূরত্ব,বাস্ততা সকল প্রকাশে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। আবার আধুনিক কবিতা প্রসংগে যা বলা হয় ‘রবীন্দ্র পরবর্তি ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত’ তা’ আলোচনা করতে হলে-তো মাইকেল,রবীন্দ্রনাথ অনিবার্য। আধুনিক কবিদের ভাব বিবর্তনে, ভাষা নির্মাণে, নতুন চিত্রকল্প সৃষ্টিতে এবং নান্দনিকতার মিহিন সৌন্দর্যে পৌঁছাতে তারাই আলোক দিয়ে যাচ্ছেন। তাই নানা সময়ে সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা যা কিছু কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে এবং কবিতাকে শুধুমাত্র নান্দনিক তৃপ্তবোধে ব্যাবহার বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের হাতিয়ার তৈরী করে প্রকাশ ম্ত্রাায় সংযোজন তা’ কোন ভাবেই খণ্ডিত নয়, অখণ্ড –বিবর্তনও বিচ্ছিন্ন নয়, ধারাবাহিক।
ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্নে কংগ্রেস মুসলিম লীগের দ্বিমূখী রাজনীতি, সার্থপরতা, ক্ষমতার লোভ, নতুন হিংসার বারুদ বহ্নি জ্বালাতে শুরু করে ও একসময় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভারত খন্ডিত হয়ে হিন্দু আর মুসলিম দুটি জাতির অস্তিত্ব তৈরী হয়। অখন্ড ভারতের বাংলা সংস্কৃতি চর্চার মুল কেন্দ্র কলিকাতা খণ্ডিত হয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানি ঢাকা অভিমূখি হয়ে ওঠে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র চিন্তায় ঢুকে পড়ে ধর্মীয় চেতনা, হিন্দুরা মুসলমানের ঈমান আকিদার বিরোধি, প্রকারন্তে তারা মুসলমানের শত্র“এমন চিন্তা-ভাবনা সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রচার-প্রপাগাণ্ডা রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে চালানো হয়। আবার অন্যদিকে ভারতের শাসকগোষ্ঠিও নানা চানক্য নীতি গ্রহণ করে ক্ষমতার সার্থে সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে থাকে। ফলে লেখকরাও এই সব উদ্দেশ্যমূলক প্রচারে বিভ্রান্ত হয়। তবুও রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে যান বাঙালীর মনে প্রায় অখণ্ড যা ভাঙবার জন্য পাকি¯তানী শাসকগোষ্ঠি নজরুলকে খানিকটা প্রশ্রয়ে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বর্জনের অপকৌশ গ্রহণ করে এবং পাকিস্তানের বাংলা অংশের লেখকদের রবীন্দ্র বিরোধি ভারত বিরোধি করবার জন্য নানা ভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। এতে সাম্প্রদায়িকতা সাহিত্যে প্রকট আকারে না হলেও প্রচ্ছন্নতা পায়। দেশ ভাগের আগে সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রটি বিভক্তির পর যে যোগাযোগ,সখ্য ও সৌহার্দের মধ্যদিয়ে চর্চিত হয়ে সমান তালে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারতো উপরোক্ত কর্মকাণ্ড তাকে থমকে দেয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে ৪৭ এর পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের লেখকরা যারা দেশ ভাগের আগে কলকাতায় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করতেন তারা নিজভূমে ফিরে এলেন এবং নিজদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপ-রেখাটি যে ইসলামী হবে এবং তাতেই রাষ্ট্র, ধর্ম এবং মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারবে এমন বিশ্বাস থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্ম-কাণ্ড গুলো চালাতে শুরু করলেন ৫২-র ভাষা আন্দোলনের আগ পর্য়ন্ত। ফলে সাহিত্যে এলো নানা আরবি, ফারসি, তূর্কি, আফগানি ইসলামি ভাষা। এতে সাহিত্যের অন্তরগত রূপটি পুরোপুরি অ-সাম্প্রদায়িক থাকলো না। সম্প্রদায়গত সুচিতা খানিকটা নষ্ট হলো এবং উন্নত সাহিত্য র্সষ্টিতে বিঘ্ন হলো। ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির চক্রান্তের স্বরূপটি তরুণ বাঙালী মনে নতুন ভাবনার সূচনা করলো এবং ৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রথম একুশ সংকলন প্রকাশের মধ্যদিয়ে তরুণ লেখকদের নব প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের মুল চরিত্রই ছিল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার। ফলে সংস্কৃতির আন্দোলনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং নবতর রাজনৈতিক চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। ৫ দশকের কবিদের মধ্যের আবুল হোসেন,আব্দুল গনি হাজারী, আশ্রাব সিদ্দিকী, আব্দুর রশিদ খান, তালিম হোসেন, ফররুক আহমদ সৈয়দ আলী আহসান (যারা মুলত ৪ দশক থেকেই লেখালিখির সাথে যুক্ত) ও অন্যান্যদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি ওমর আলী, আহসান হাবীব, আল-মাহমুদ, আবুজাফর ওবায়েদ উল্লাহ,আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কবি দিলোয়ার, ফয়েজ আহমদ, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মোঃ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দিন, সৈয়দ আতিকুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান,শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সানাউল হক, প্রমুখ। (নামের অক্ষর ক্রমিকে) দু’পক্ষ একপক্ষ প্রবীণ আর অন্যপক্ষ তরুণ নবীন। একপক্ষ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার চেতনায় খানিকটা আচ্ছন্ন, তরুণ অন্যপক্ষ ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে স্পষ্টতই আলোড়িত। অনিবার্যভাবে কথা সাহিত্য-কবিতার বিষয় ভাবনা ভাবের বিস্তার দুই-ই খানিকটা ভুমি লগ্ন এবং খানিকটা বায়বীয় হয়ে ওঠে। ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব, ডার-উইনের বিবর্তনবাদ, আইনেষ্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, মার্কসের সমাজ তত্ত্ব ইত্যদি কাব্যগঠনে,রূপনির্মাণে, প্রয়োগ পায়। ৫ দশকের শুরুর পর্যায়টি মূলত দুটি স্পষ্ট ধারায় বিদ্যমান থেকেছে একদিকে ইসলামী ভাবধারার উজ্জীবন, অন্যদিকে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যতা, পশ্চিমের বিমূর্ত আধুনিকতা, উদার মানবতাবাদী দায়বদ্ধতা কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ৫২-এর ভাষা আন্দোলন উভয় পক্ষের মধ্যে নতুন বোধের জন্ম দেয় এবং কাব্য-ভাষাও বদলে যেতে থাকে।
যদিও কবিরা কখনই স্বীকার করতে চান না যে কবিতায় রাজনৈতিক চেতনার প্রবল্য থাকা উচিৎ, তবুও তাঁদের সৃষ্টিতে রাজনীতি, নতুনতর রাজনীতি শনাক্ত করে নিতে অসুবিধা হয় না। এজন্যই সম্ভবত চীনা লেখক ল্যূসুন বলেছিলেন ‘কবিতায় রাজনীতিই প্রথম’। আমি আগেই বলেছি যে ৫ এবং পরবর্তি দশকগুলোতে যারা কাব্য জগতে উল্লেখযোগ্য মেধায় বিচরণ করেছেন তাদের মধ্যের কেউ কেউ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে তাদের মুক্তি খঁজেছিঁলেন এবং এ রাষ্ট্রটি টিকে থাকুক শক্তিশালী হোক তাদের মধ্যবিত্ত আকাঙ্খার পূর্ণতা আসুক আর একই সময়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ যাদেরকে ৫ এর কবি বলে শনাক্ত করা হয় তাদের কবিতার দিক বদল ঘটে ’৫২ ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। ভাষা আন্দোলন এদেশে তরুণ কবি শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। লক্ষণীয় যে তখনো পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর বাইরে কোন রাজনৈতিক চিন্তার আকাঙ্খা তাদের সৃষ্টিতে স্পষ্ট ছিল না। যা ছিলো তা’ মধ্যবিত্ত মানসিকতার বিকাশ আকাঙ্খা যা রাষ্ট্রের রাজনীতি লগ্ন হয়েই আবর্তিত হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষীণধারায় সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন আকাঙ্খারও প্রকাশ শিল্প-সাহিত্য কবিতায় কমবেশী প্রতিফলিত হয়েছে।
কবি ফররুখ আহমদ ইসলামের গৌরব একদিন ফিরে আসবে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ইসলামী-সাম্য প্রতিষ্ঠা করে মানবিকতার প্রতিষ্ঠা দেবে এরকম বিশ্বাসে আস্থা রেখে লিখেছেন আশার কবিতা-ফররুখ আহমদ ছিলেন শক্তিমান কবি, তিনি কবিতায় ইসলামী ভাবাদর্শ কোন সংকীর্ণতায় নয়, বরঞ্চ ইসলামের গৌরব কাল প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। সাত সাগরের মাঝি কাব্যটি পাঠকের দৃষ্টি কুড়ায় এবং তাকে খ্যাতিমান করে।
কবি তালিম হোসেন ইসলামী রেনেসাঁর কবি, প্রবল ভাবে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ‘ন্যায়’ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পাবে এবং মানবিকতা রাষ্ট্রটির আদর্শ হবে, যেখানে জুলম, জালিমের হুংকার থাকবে না,এরকম আদর্শ রাষ্ট-বিশ্বাস থেকে তিনি তাঁর কাব্য চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।
কবি সৈয়দ আলী আহসান ইসলামের প্রবহমান ঐতিহ্য থেকে উপাদান আহরণ করে শালীন সাহিত্যের অংগীভূত করা গ্রামীন জীবনকে আরো বেশী সাহিত্যের বিষয় করে তোলা কাব্যে আধুনিক এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তার সমাবেশ, উপমা,উৎপ্রেক্ষা নির্মাণে ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয়া কে প্রধান্য দিয়েছিলেন। বলা হয় তার কবিতায় কলা-কৈবল্যবাদীতার বিপুল সমাবেশ ঘটেছে, এবং পশ্চিমা কাব্য-আধুনিকতার স্পষ্টতা তার কাব্যে লক্ষণীয়। কবি সৈয়দ আলী আহসান যে আবেগ নিয়ে কবিতার শুরু করেছিলেন পরবর্তি কালে সে আবেগ ফিঁকে হয়ে আসে সম্ভবত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোহ তাঁর টুটেছিলো, এবং নতুন ভাবনা নিয়ে অনেক ভালো কবিতা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
রবীন্দ্র কাব্যের বলয় ভেঙে বাংলা কবিতায় যে পাঁচ কবি আধুনিকতার উচ্চ-নাদ তুলেছিলেন সে আধুনিকতা শুধুমাত্র নির্মাণে নয়, ভাবে ভাবনায় রূপে শৈলীতে, যার উপর ভিত্তি করে ৫ দশক এবং তৎপরবর্তি তরুণ কবিরা নতুনের সুর তুলেছিলেন। এঁদের মধ্যে কবি আহসান হাবীবের সংযম তুলনাহীন। তিনি কবিতার স্নিগ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন নরম নম্র স্বর, মিত ভাষণ, লোকজ শব্দের পরিমিত ব্যবহার, আশ-পাশের জীবন থেকে সংগৃহিত কবিতার উপাদান, তাঁর কবিতায় বৈশিষ্ট হয়ে আছে। কবি আবদুল গণি হাজারী কবিতায় স্ব-শ্রেণীর আত্মাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন এবং কবিতায় আধুনিক ভাষাভঙ্গি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কবি সৈয়দ শামসুল হক প্রথম দিকে এবং কবি ফজল শাহাবুদ্দিন-এর কাব্য-নির্মাণে শরীর চেতনা আমরা লক্ষ্য করলেও সৈয়দ হকের পরবর্তি কাব্যে বাক পরিবর্তনের ধারা স্পষ্ট হয় কিন্তু কবি ফজল শাহাবুদ্দিন শরীর চেতনাকে নিয়েই এগিয়ে যান যদিও তার কাব্যে মানুষ,প্রকৃতি,দেশ-চেতনারও উপস্থিতি আছে। আমরা তার কাব্যে ভিন্ন কিছু পাই যা সম্পূর্ণ আলাদা এক মেজাজের। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান,কবি আবু জাফর ওবায়েদ উল্লাহ ও কবি সিকান্দার আবু জাফর-এর কবিতায় জীবনবাদী দৃষ্টি, নতুন সমাজের আকাঙ্খা, মানুষের সংগ্রাম, লড়ে যাবার উদ্দীপনাকে উজ্জ্বল করেছেন। কবি বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন খুব কম, তার কবিতা স্নিগ্ধ এবং জীবনবাদী আকাঙ্খায় ভরপুর। এঁদের মধ্যে কবি সায়ীদ আতিকুল্লাহ লিখেছেন অনেক, তাঁর কবিতা তাঁর মতোই অন্তরমুখি, তিনি কবিতার প্রান্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয়।
সবচাইতে যে দু’জন কবির নাম শুধু ৫ দশক নয়, ৬-দশকও শুধু নয় তার পরে আজো পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে আছে তারা হলেন কবি শামসুর রাহমান এবং কবি আল-মাহমুদ। কবি শামসুর রহমান আর আল-মাহমুদের মধ্যের পার্থক্য যাই থাকুক দু’জনই বাংলাদেশের কাব্য-ভূমিতে প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতির কবি। কবি শামসুর রাহমান এবং কবি আল-মাহমুদের মানস আলাদা তাই দু’জনের কবিতায় আমরা দু’রকম অভিব্যক্তি অনুভব করতে পারি। যদিও তাঁদের কাব্য বৈশিষ্ট নিয়ে এই আলোচনা দীর্ঘ করার সুযোগ নেই তবু বলে রাখা ভালো দু’জনের কাব্য নির্মাণ-ঐক্যে বিরাট পার্থক্য আছে। কবি শামসুর রহমান শহুরে মধ্যবিত্ত উদার মানসিকতার কবি, নাগরিক জীবন, জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অস্থিরতা তাকে আক্রান্ত করেছে, বৈশাদৃশ্যপূর্ণ জীবন যাপন, রাজনৈতিক শিষ্টাচারহীনতা তাকে ব্যথিত করেছে, কিন্তু তিনি তার শ্রেণী অবস্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন জগত দেখতে চাননি। মানবিকতা তার কবিতায় নানা ভাবে উচ্চকিত, উচ্চারিত হয়েছে। তার কবিতায় উচ্চারিত অনেক পঙক্তিমালা কাব্য-প্রেমিদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে আধুনিকতা তাঁর কবিতার অন্যতম গুণ। বিপরীতে কবি আল-মাহমুদ-এর কাব্যে আছে সেই সব অনুসঙ্গ যা আবহমান বাংলার লোক-সমাজে ব্যবহৃত যার প্রতি প্রান্তিক মানুষের রয়েছে তরল আবেগ। শামসুর রহমানের চারপাশে পাকা সড়ক, তাতে নর্দমা আছে, চলবার স্বাচ্ছন্দ আছে, বসবাসে নাগরিক সুবিধা আছে আর আল-মাহমুদের মানুষেরা এসেছে অজ-পাড়া গাঁ থেকে,যেখানের চারিপাশে বর্ষায় ব্যাঙ ডাকে, সাপ-খোপ বেড়িয়ে পড়ে, সটি বনের মধ্যদিয়ে হাঁটা পথে যেতে হয় সড়কে, শহরের রেলগাড়ি ধরতে হয় ভোর রাতে, তিতাসের ম্লান জোছনায় ছইয়া নৌকায় প্রেমিকা-প্রেমিকেরা মাতে উচ্ছ্বলতায়। সুতরাং চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, নির্মাণ শৈলী ইত্যাদির ভিন্নতা আল-মাহমুদকে স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে। শামসুর রাহমান কবিতার বিশুদ্ধতায় বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন,আল-মাহমুদ সময়, পরিস্থিতি পরিবেশ রাজনীতি ইত্যাদিকে স্মরণে রেখেই তাঁর সৃষ্টি জনপ্রিয় করতে পেরেছেন। শহীদ কাদরী চলে যান প্রবাসে, লিখেছেন ও কম, তার পরেও বাংলা কাব্যে তার অবস্থান উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মূলত ৫-দশক-ই আমাদের কাব্য আন্দোলনের গতি, প্রগতি ও আধুনিকতার ভিত্তি তৈরী করে দেয় এবং পরবর্তি দশক ৬-এর তরুণ অধিকতর তরুণ কবিদের জাগরণকে নিশ্চিত করে। ৬ দশকের কবিদের মধ্যে যাঁরা সব চাইতে বেশী আলোচিত হয়েছেন আমি শুধু মাত্র কয়েক জনের নাম উল্লেখ করবো কারণ পরিসর খুব ছোট এবং সময় ধরে দেয়া। অনুল্লেখিত কবিরাও যে উল্লেখের দাবীদার তাঁদের অবদানও যে কোনো ভাবে ছোট নয় সে কথাটা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি এবং ক্ষমাও চেয়ে রাখছি। এঁদের মধ্যের অরুণাভ সরকার, অসীম সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সায়িদ, আবুল হাসান, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, আহমদ ছফা, ইমরুল চোধুরী, ইন্দু সাহা, কাজী রোজি, গগনতানু, নির্মলেন্দু গুণ, ফরহাদ মজহার, বুলবুল খান মাহবুব, মোঃ রফিক, জাহিদুল হক, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা,মুনীর সিরাজ, মাকিদ হায়দার, মাশুক চৌধুরী, মাহবুব সাদিক, মুশারফ করিম, রুবি রহমান, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, সাযযাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, হায়াৎ সাইফ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী,সমুদ্রগুপ্ত, হুমায়ুন আজাদ, হুমাযুন কবির, হেলাল হাফিজ। ( নামগুলো নাম শুরুর অক্ষর অনুযায়ী) এঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব বৈশিষ্টে এবং স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
সারা বিশ্বে ৬-এর দশক ছিল এক বিস্ময়কর জাগরণের, আবিস্কারের, অর্জনের, নতুনের, উদ্ভাবনের। রাজনীতি, সমাজ নীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিদ্রোহ, জ্ঞানের নানা শাখার বিস্তার ব্যাপকতা মানুষের মন-মননে নতুন ভাবনা উদ্দীপনার প্রতীক হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজের নানা রূপ ভাঙ-চুর গঠন-পুনর্গঠনপ্রকট হয় এবং শিল্প সাহিত্যে-নির্মাণে তার মূর্ততা পায়। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তরুণ শিক্ষিত শ্রেণীর মনে নতুন রূপে,নতুন আদলে, নতুন চেতনায় স্থিতি পেতে থাকে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশের এই অংশের মানুষের মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিদ্রোহ ঘৃণায় রূপান্তর হতে থাকে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র,স্বায়াত্বশাসন, ইদ্যাদি মানুষের স্বপ্ন হয়ে ওঠে এবং ৬ দশকেই ‘৬ দফা’ ‘১১ দফা’ প্রণীত হয়। রাষ্ট্র কিন্তু বসে থাকে নি। রাজনীতির লোকদের, কবিদের, শিল্পীদের, আঁকিয়ে-গাইয়ে-বাজিয়ে বুদ্ধিজীবীদের,শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষদের স্বপক্ষভূক্ত করবার জন্য পশ্চিমা শাসক-গোষ্ঠি তাবেদার তৈরীর জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করে। বিএনআর গঠন করে টাকা দিয়ে লেখকদের, কেনার চেষ্টা, বেতারে পত্রিকায় চাকুরি দেয়া, এমন কী দেশের বাইরে পোষ্টিং দিয়ে নানা প্রলোভনে বশিভূত করার চেষ্টা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে চেতনায় জাগরিত মানুষদের জেগে ওঠা স্বপ্নকে দমিত করে লেখক শিল্পীদের মূল স্রোত থেকে প্রকাশের জগৎ থেকে সরিয়ে দেয়া যায় নি। কবিরা নানা আত্ম-সংকটে দোদুল্যমান হয়েছেন, লেখকরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়েছেন, তবু মানুষের জাগরিত চেতনা তাঁদের ক্ষণিক দোদুল্যমানতা কাটিয়ে মনো জগতের স্থবিরতা ভেঙে সচেতন করে তুলেছে এবং সচেতন হয়েই লিখেছেন। বলা যায় সচেতন কবিতার নতুন স্বপ্ন-অঙ্কুর এই দশকের মধ্য-অঙ্কে দ্রুতই বৃক্ষ হয়ে ওঠে এবং ৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান সকল অড়ষ্টতা ভিরুতা দোদূল্যমানতা, সঙকীর্ণতার অচল দেয়াল ভেঙে দেয়। কবিরা হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিনিধি। ৫,৬ দশকে নতুন পুরাতন মিলে পুরাতন নতুন মিলে বাংলাদেশের কাব্যক্ষেত্রটিকে উর্বর মৃত্তিকা লগ্ন করে তোলে যা পরবর্তি দশকে আরো স্পষ্টতর হয়ে সৃষ্টি করে নতুন সম্ভবনা এবং শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় নতুন দশক।
৬-দশকের কবিদের অন্তরচেতনালোক ছিলো প্রগতিবাদী নতুন রাষ্ট্রের চিন্তা। মুল লক্ষণগুলোয় নতুন স্বপ্ন নতুন দেশের। আঙ্গিক ও প্রকরণে, প্রজ্ঞা ও মননে, রুচি ও অভ্যেসে আধুনিকতায় এঁরা আজো অনুকরণীয় হয়ে আছেন। ষাটের উল্লেখিত কবিদের মধ্যে প্রায় সকলেই কবিতাঙ্গনে এখনো সক্রিয় রয়েছেন কেউ কেউ লিখছেন সমানে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব,, মুনীর সিরাজ, সমুদ্রগুপ্ত ৬-এর কবিতায় ভিন্ন ধারার অনেক কবিতা লিখে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যদিও এঁদের মধ্যে কবি নির্মলেন্দুগুণ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, রফিক আজাদ, সমুদ্রগুপ্তের কবিতায় বিষয় ও ভাব-আদর্শ সম-মাত্রিক এবং নান্দনিকতার পেলবতা রয়েছে অন্যদিকে বুলবুল খান মাহবুব, মুনীর সিরাজ, ইন্দু সাহা বিষয়কে উজ্জ্বল করে বানিয়েছেন প্রতিবাদী কবিতা। যা মানুষকে উজ্জীবিত করে।।
[সহায়তা:আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়, দিপ্তী ত্রিপাঠি, ক্রোচের নন্দন তত্ত, মার্কসবাদী সাহিত্য-সমালোচনা টেরী ঈগলটন, পূর্ব-বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, সাইদ উর রহমান, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কবিতা তুলনামূলক ধারা, মাসুদুজ্জামান, শেষ যুদ্ধের ডাক, মহসিন শস্ত্রপাণি, ষাটের কবিতাঃ সন্ত্রস্ত সময়ের শিল্প, জুলফিকার হায়দার, অরনি জানুয়ারি-জুন-২০১১, হালখাতা ৫ম বর্ষ ২য় সংখ্যা এপ্রিল-জুন-২০১১ কবি মোহম্মদ নূরুল হুদা ও কবি ফরিদ আহমদ দুলাল-এর ব্যক্তিগত সহযোগীতা।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন