আবুল কাসেম ফজলুল হক | ২০১৪-০৬-২৯ ইং
রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) কাল থেকে বাংলা ভাষায় লেখকদের মধ্যে ধারণা
যে, ইউরোপ উন্নত, বাংলা অনুন্নত। বাংলাকে উন্নতি করতে হলে ইউরোপকে আত্মস্থ করতে
হবে। দেশটাতে তখন ছিল ইংরেজ শাসন। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও
সাহিত্য আয়ত্ত করে, সেখান থেকে প্রেরণা নিয়ে বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টি
ছিল বাংলার লেখকদের আন্তরিক প্রচেষ্ট। তখন ইউরোপের প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রতিই
বাঙালি লেখকরা আকৃষ্ট হতেন। বাংলা সমাজে রক্ষণশীল ধারাও ছিল। প্রগতিশীল ও
রক্ষণশীলদের বিরোধ ছিল।
তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, রক্ষণশীলরাও প্রগতিরই পক্ষে, তবে এদের বিচার-বিবেচনা বেশি, ঐতিহ্যপ্রীতি বেশি এবং অগ্রগতি মন্থর। রামমোহন, ভবানীচরণ, ঈশ্বরগুপ্ত, প্যারীচাঁদ, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, জগদীশবসু, প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, লুত্ফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ লেখকদের সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বাংলা ভাষার এ লেখকরা ইংরেজ থেকে কী ভীষণভাবে গ্রহণ করেছেন। তারা গ্রহণ করেছেন জাতীয় ঐতিহ্য ও স্বকীয় সত্তায় থেকে। ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইউরোপে বহমান ছিল রেনেসাঁসের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবধারা, তাতে প্রগতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবেচনা বিশেষ গুরুত্ব পেত। বাংলা ভাষার লেখকরা ইউরোপের সেই চিন্তাধারার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা পেতেন।
তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, রক্ষণশীলরাও প্রগতিরই পক্ষে, তবে এদের বিচার-বিবেচনা বেশি, ঐতিহ্যপ্রীতি বেশি এবং অগ্রগতি মন্থর। রামমোহন, ভবানীচরণ, ঈশ্বরগুপ্ত, প্যারীচাঁদ, অক্ষয়কুমার, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, জগদীশবসু, প্রফুল্লচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, লুত্ফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ লেখকদের সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বাংলা ভাষার এ লেখকরা ইংরেজ থেকে কী ভীষণভাবে গ্রহণ করেছেন। তারা গ্রহণ করেছেন জাতীয় ঐতিহ্য ও স্বকীয় সত্তায় থেকে। ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইউরোপে বহমান ছিল রেনেসাঁসের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবধারা, তাতে প্রগতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবেচনা বিশেষ গুরুত্ব পেত। বাংলা ভাষার লেখকরা ইউরোপের সেই চিন্তাধারার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা পেতেন।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হতে না হতেই ইউরোপে দেখা দিতে থাকে কাউন্টার রেনেসাঁস।
আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ রেনেসাঁসবিরোধী কাউন্টার রেনেসাঁসের মনোভঙ্গি নিয়ে
বিকাশমান।
আধুনিকতাবাদ সীমাবদ্ধ ছিল শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মতবাদরূপে। জীবন-জগত্ সম্পর্কে
চরম নৈরাজ্যবাদকে রূপায়িত করা ছিল আধুনিকতাবাদীদের মূল কর্মনীতি। দুই বিশ্বযুদ্ধের
পটভূমিতে জীবন ও সমাজের রুগ্ণতাকে তারা শিল্প-সাহিত্য চিত্রিত করতে চেয়েছেন।
সমর্থক দৃষ্টি নিয়ে তাঁরা তাকাতে পারেননি জীবন-জগতের প্রতি। আধুনিকতাবাদের ধার
একটি মূলনীতি কলাকৈবল্যবাদ। কেবল কলা বা রূপগত সৌন্দর্য নির্ভর করে তাঁরা উত্কৃষ্ট
সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। বিষয়বস্তু তুচ্ছ হলে কিছু আসে- যায় না। কেবল
উত্কৃষ্ট কলাগুণ থাকলেই কোনো রচনা, কোনো শিল্পকর্ম উত্কৃষ্ট বিবেচিত হবে। কার্যত
কেবল অলঙ্কার সৃষ্টির দিকেই তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্রীভূত থেকেছে, এবং কলাগুণে
উত্কৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টিতে তাঁরা অসাধারণ কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন।
নৈরাজ্যবাদ ও কলাকৈবল্যবাদ অবলম্বন করে বাংলা ভাষায়ও সাহিত্য স্থান হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু
প্রমুখ বাংলা ভাষার সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক।
বাংলা ভাষার আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা ১৯২৩ সালে প্রকাশিত কল্লোল
পত্রিকার মাধ্যমে। পরে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বুদ্ধদেব বসু। আধুনিকতাবাদীদের
কলাকৈবল্যবাদ এখনো পুরো মাত্রায় প্রচলিত।
আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলন হয়েছিল ফ্রান্সে— দুই
বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। ১৮৯০-এর দশকে। দুই বিশ্বযুদ্ধের কালে এটি বিকশিত ও
পরিপুষ্ট হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র— সব রাজধানী
ও বড় শহরে।
ফ্রান্সে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে যুগে, দেরিঙ্কা ও জঁপ ফ্রাঁসোয়া লিয়োতার উদ্ভাবন
করেন উত্তরাধুনিকতাবাদ। ক্রমে তা বিকশিত হয় ও ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সব মহাদেশ ও দেশে।
উত্তরাধুনিকতাবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব বিষয়কে এবং শিল্প-সাহিত্যকে নিজের মধ্যে টেনে
নেয়। ঢাকায় ও বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও সাহিত্যচর্চা ও গবেষণায় লেখকরা জ্ঞাতসারে
অথবা অজ্ঞাতে উত্তরাধুনিকতাবাদের অনুশীলন করে চলছেন।
বাংলা ভাষার আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের পাশাপাশি রেনেসাঁস ও প্রগতিবাদের
অনুশীলনও বহমান থাকে। রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্র আধুনিকতাবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে
করেননি। রেনেসাঁসের স্পিরিটই কার্যকর ছিল তাঁদের সৃষ্টির মূলে। বেগম রোকেয়া,
মোহাম্মদ লুত্ফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, নজরুল ইসলাম ও সওগাত গোষ্ঠীর লেখকদের মধ্যে
রেনেসাঁসের ও প্রগতির চেতনাই ক্রিয়াশীল ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ
মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যও রেনেসাঁসের ও প্রগতির ধারায় সক্রিয় ছিলেন।
প্রগতিবাদীদের পাশাপাশি পাকিস্তানবাদী ধারাও ছিল। গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমেদ ও
তমুদ্দুুন মজলিশের লেখকরা পাকিস্তানবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।
মার্ক্সবাদীরাও প্রগতিবাদেরই ধারক ছিলেন। আধুনিকতাবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ,
প্রগতিবাদ, মার্ক্সবাদ, পাকিস্তানবাদ ইত্যাদি সব ধারার সাহিত্য প্রয়াস ও সাহিত্য
সৃষ্টির ইতিহাস যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে রচনা করলে অনেক কিছু স্পষ্ট হতো এবং ভবিষ্যত্
নতুন সৃষ্টির জন্য তা কল্যাণকর হতো। কিন্তু ইতিহাস চেতনার অভাব আছে বাংলা ভাষার
লেখকদের মধ্যে। তাছাড়া অভাব আছে সমালোচনার। সাহিত্যচর্চা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার
অভ্যন্তরে ভালো অর্থে আলোচনা-সমালোচনা থাকলে তা সৃষ্টির ও বিকাশের জন্য পরম
কল্যাণকর হতো।
সাহিত্য ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ লেখকদের দেয় বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও
মানসিকতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা মূল্যবোধ এবং যুক্তি অবলম্বনে অনীহ, প্রগতিতে
আস্থাহীন, সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে উদাসীন। যুক্তি অবশ্য
উত্তরাধুনিকতাবাদীরা অবলম্বন করেন— তবে
মূল্যবোধ ও সদর্থক সিদ্ধান্তের প্রতি অনীহ থাকার ফলে তাঁদের অবলম্বন হয় নেতিবাদ
কিংবা মূল্যবাদ।
উত্তরাধুনিকতাবাদে জটিল সব পারিভাষিক শব্দের দুরূহ বাগাড়ম্বর আছে। তাঁদের যেটুকু
নতুনত্ব, তা তাঁদের পরিভাষা সৃষ্টিতে ও প্রকাশভঙ্গিতে। যেসব বিষয় নিয়ে তাঁরা
চিন্তা করেছেন, সেগুলো নিয়ে চিন্তা আগেও ছিল। পরিভাষা ভিন্ন ছিল, সন্ধ্যিত্সার ধরন
ও উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল।
উত্তরাধুনিকতাবাদীরা বিতর্কপ্রিয়। বিতর্ক সৃষ্টি করেই তাঁরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ
করেন। সাধারণতা বিতর্কে তাঁদের লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার দিকে। সত্যের
সন্ধানে বিতর্ক, আর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার জন্য বিতর্ক— দুটো এক
প্রকৃতির নয়।
উত্তরাধুনিকতাবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব বিষয়কে এবং শিল্প-সাহিত্যকে নিজের পক্ষে টেনে
নেয় এবং এবারের চর্চার জন্য চর্চাকারীকে চিন্তার ছক বেঁধে দেয়, মেনে চলার মতো
নীতি-বিধিও দিয়ে দেয়, চর্চাকারীর দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিকতাকে বৈশিষ্ট্যেও স্থির করে
দেয় এবং চলার পথ দেখিয়ে দেয়। এতে স্বাধীনতার চিন্তা করার সুযোগ অল্পই অবশিষ্ট
থাকে। মুক্ত চিন্তা চর্চার কথা বলা হলেও উত্তরাধুনিকতাবাদীদের চিন্তাশক্তি মোটেই
মুক্ত থাকে না— সুনির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। আর
আধুনিকতাবাদীদের চিন্তা আবদ্ধ থাকে কেবল রূপ-রীতি ও আঙ্গিকের দিকে— বিষয়বস্তুকে
তাঁরা কোনো গুরুত্বই দেন না। ফলে তাদের রচনাবলি হয় বিষয়গৌরবহীন ও অন্তঃসারশূন্য।
যে মতাদর্শেই হোক, প্রচারমূলক রচনা সাহিত্য হয় না।
উত্তরাধুনিকতাবাদ কিংবা আধুনিকতাবাদ অবলম্বনে বড় কোনো সৃষ্টি, মহান কোনো সৃষ্টি সম্ভব
হবে এটা আশা করা যায় না। বড় সৃষ্টির জন্য, মহান সৃষ্টির জন্য রেনেসাঁসের স্পিরিট ও
প্রগতির চেতনা অপরিহার্য। অতীতের রেনেসাঁসের পুনরুজ্জীবন কিংবা পুনরাবৃত্তি নয়,
আমরা চাই নতুন কালের নতুন রেনেসাঁসের মধ্যে প্রগতির তাড়না থাক।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন