রাশিদ
আশকারী
উত্তরাধুনিকতাবাদ (Postmodernism)
সমকালীন
চিন্তাজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি শব্দ। একটি বহু-বিতর্কিত অভিধা। স্তুতি, নিন্দা,
সমর্থন, অসমর্থন নির্বিশেষে উত্তরাধুনিকতাবাদ একটি বিপুল আলোচিত/সমালোচিত তথা
বিতর্কিত একাডেমিক প্রপঞ্চ। অতি অল্পসময়ে বিষয়টি এতো প্রচার ও প্রসার পেয়েছে যে
তার সাথে একমত কিংবা দ্বিমত পোষণ করা সহজ, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করা সহজ নয়।
অবশ্য তা হয়ওনি। তবে যা হয়েছে, তা হলো অতি স্তাবকতা অথবা অতি কুৎসা কিংবা যথেচ্ছ ব্যবহার; সাহিত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, সমালোচনাতত্ত্ব , ইতিহাস ও দর্শনের জগতে। উমবার্তো ইকো যথার্থই বলেছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদ একটি দুর্ভাগ্যজনক শব্দ (bon a© tout faire)। আমার এ ধারনা জন্মেছে যে, আজকাল ব্যবহারকারীরা এই শব্দকে যেখানে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করছে। অধিকন্তু, মনে হচ্ছে যে, এটিকে ক্রমাগত অতীতমুখি করবার চেষ্টা চলছে। প্রথমে এটি মুখ্যত গত বিশ বছরের কতিপয় লেখক ও শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিলো; তারপর ক্রমাগত তা শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৌছয়; তারপর আরো পেছনে। এবং এই উল্টোযাত্রা যেভাবে চলছে, তাতে মনে হয় শীঘ্রই উত্তরাধুনিকতাবাদ হোমারকেও সংযুক্ত করবে।১ এসব টানাপোড়েনে উত্তরাধুনিকতাবাদের যথার্থ তাত্তি্বক বিকাশ সাধিত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছেনা। এ্যান্ডিয়াস হাইসেন সতর্ক করে দিয়েছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদকে নিয়ে স্তব কিংবা বিদ্রুপ কোনোটাই করা উচিত নয়। তাকে অবশ্যই তার সমর্থক এবং নিন্দুক উভয়ের হাত থেকেই বাঁচাতে হবে।
২
উত্তরাধুনিকতাবাদের ইতিহাসে প্রধান গুরুত্ত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৯৮০ সালে সমকালীন জার্মান তাত্তি্বক হ্যাবারমাস কতর্ৃক উপস্থাপিত 'আধুনিকতা _একটি অসমাপ্ত প্রকল্প' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। হ্যাবারমাস মনে করেন যে, আধুনিক কাল আলোকপর্বেও (Enlightenment) সাথে শুরু হয়, যার সময়সীমা মধ্য সতের থেকে মধ্য আঠারো শতক পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী, যখন মানব সমাজের উন্নয়নকল্পে যুক্তিবাদের প্রভাবে জনমনে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিলো। এইসকল ধারনা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো জার্মানীতে কান্ট, ফ্রান্সে ভলতেয়ার ও দিদেরো এবং বৃটেনে লক ও হিউমের দর্শনে। বৃটেনে যুক্তির (The Age of Reason) বলতে এখনো ঐ সময়কেই বোঝায়। তথাকথিত আলোকপর্বের প্রকল্প বলতে বুঝি সনাতনী ঐতিহ্য, অন্ধ অনুকরণ, জীর্ণ আচার এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও নিষেধাজ্ঞার প্রতি দাসোচিত আনুগত্য অস্বীকারের মধ্য দিয়ে নির্মোহ-নিরাসক্ত ব্যক্তির দ্বারা যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ, যা সামাজিক সমস্যাবলীর উন্নততর সমাধান দিতে সমর্থ। হ্যাবারমাস আধুনিকতাবাদ বলতে এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই বুঝিয়েছেন। এই তত্ত্ব পরীক্ষা করার প্রথম উদ্যোগ হিশেবে দেখা যেতে পারে ফরাসী বিপ্লবকে। হ্যাবারমাস মনে করেন যে, বিশ শতকে যেমন একদিকে লক্ষ করা গেছে যুক্তিবাদে আস্থা আর প্রগতির সম্ভাবনা, অন্যদিকে তেমনি দেখা গেছে দুর্যোগের ঘনঘটা। আধুনিকতাবাদ নামে পরিচিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই প্রকল্পের সাথে এই মর্মে একাত্ন হয়েছিলো যে, এটি হৃত উদ্দেশ্যের জন্যে, হৃত সঙ্গতির জন্যে, হৃত মূল্যবোধের জন্যে এক ধরনের অনুশোচনার জন্ম দিতে পেরেছে। হ্যাবারমাস আরও মনে করেন যে, দেরিদা ও ফুকোর মতো সত্তর দশকের উত্তর-কাঠামোবাদী ভাবুকেরাও আলোকর্পেবর আধুনিকতার ব্যাপারে এক ধরনের বিশেষ অস্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন। তাঁর(হ্যাবারমাস) মতে, তাঁরা(দেরিদা ও ফুকো) যুক্তিবাদ, স্পষ্টবাদীতা, সত্যান্বেষণ ও প্রাগ্রসরতার আদর্শসমূহকে আক্রমন করেছিলেন এবং এভাবে ন্যায়ানুসন্ধানের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। হ্যাবারমাস তাঁদেরকে 'তরুণ রক্ষণশীল' (Young Conservatives) বলে অভিহিত করেন। 'উত্তরাধুনিকতাবাদ' শব্দটি ১৯৩০-এর দিকে প্রথম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর বর্তমান জাত্যার্থ ১৯৭৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ফ্রাঙ্কো লিওতারের The Postmodern Condition: A Report on Knowledge শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশের সাথে শুরু হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। লিওতারের প্রবন্ধ “Answering the Question: What is Postmodernism?” ১৯৮২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ; ১৯৮৪ সালে দ্য পোস্টমডার্ন কনডিশন গ্রন্থের পরিশিষ্ট হিশেবে সংযুক্ত হয় এবং ১৯৯২ সালে ব্রুকারের মডার্নিজম/পোস্ট-মডার্নিজম গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রবন্ধটি মুখ্যত আলোকপর্ব বিষয়ক বিতর্ক কেন্দ্রিক এবং ঈষৎ তীর্যকভাবে হ্যাবারমাসকে সমালোচনা করে রচিত। লিওতার এমন একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন যা কার্যত সেই বিতর্ককে সংঘর্ষে রূপান্তরিত করে। প্রতিপক্ষকে যথার্থ রক্ষণশীল হিশেবে প্রমান করার জন্যেই তিনি তা করেন। তিনি বলেন: "সব দিক থেকেই আমরা পরীক্ষণ শেষ করবার জন্যে প্ররোচিত হচ্ছি।" কতিপয় দৃষ্টান্ত সহযোগে তিনি হ্যাবারমাস সম্পর্কে বলেন: আমি একজন খ্যাতিমান ভাবুক সম্পর্কে পড়েছি, যিনি তাঁর কথিত ইয়াং-রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে আধুনিকতাবাদকে সমর্থন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, উত্তরাধুনিকতাবাদের ব্যানারে সেই রক্ষণশীলেরা আধুনিকতাবাদ এবং আলোকপর্বের অসমাপ্ত প্রকল্প থেকে মুক্তি পেতে চাইবে। ৩ লিওতার অভিযোগ করেন যে, হ্যাবারমাস অনেকের মতো শৃংখলা, একতা, পরিচিতি ও নিরাপত্তার জন্যে শৈল্পিক পরীক্ষণের পরিসমাপ্তি ডেকেছেন। তাঁরা মূলত আঁভগার্দের উত্তরাধিকারের বিনাশ সাধন করতে চান। লিওতার মনে করেন, আলোকপর্বের যে প্রকল্প হ্যাবারমাস বহাল রাখতে চান, তা আসলে খৃস্টবাদ ছাড়া আর কিছু নয় । বস্তুত, মার্কসবাদ অথবা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পুরাণের মতো বস্তুর একটি কতর্ৃত্বব্যঞ্জক এবং সমগ্রবাদী ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা ও পুনর্নিশ্চয়তা জ্ঞাপনের দাবীদার এই অধি আখ্যানগুলো (Meta narratives) বস্তুত অধ্যাস এবং পৃথকত্ব, বিরোধ ও বহুত্বকে দমন করার জন্যে লালিত। এ কারণে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা লিওতার নির্নয় করেছেন মেটান্যারেটিভের প্রতি অবিশ্বাস হিশেবে। কাজেই উন্নয়নের মহা-আখ্যানগুলো (Grand narratives) এবং মনুষ্য উৎকর্ষ আর কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। লুসি নিয়ালও এই অভিমতকে সমর্থন করেন। তাঁর ভাবনায়: উত্তরাধুনিক মানস হলো 'সত্য' এবং 'মূল্য' বিষয়ক সকল উপাদানকে ভুলে যাওয়ার মানস। আমরা যাকে আজ 'সত্য' বলে চিনি তা আসলে 'উন্মত্ত ক্ষমতাধর এবং তাদের চামচা ভাঁড়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের নির্বাচিত সংস্করণের মাধ্যমে চিরস্থায়ীকৃত বিচ্ছিন্ন মিথ্যায় ভরা।' আমাদের আজকের পৃথিবী বুঝার জন্যে প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে ঐ সকল তথাকথিত সত্য প্রকাশ করা হচ্ছে। 'মূল্য' কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রভাব। সুতরাং তথাকথিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের অধীনে দমিত না হবার জন্যে আজ নৈরাশ্যবাদী হওয়া জরুরি। ৪ এমতাবস্থায় আমরা যা সবের্াচ্চ আশা করতে পারি, তা হলো, ক্ষুদ্র আখ্যান পরম্পরা (A series of mini narratives) যা সাময়িক, অস্থায়ী, আপতিক, আপেক্ষিক ও অনিশ্চিত, যা বিশেষ স্থানীয় পরিস্থিতিতে বিশেষ দলের কর্মকান্ডের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করে। উত্তরাধুনিকতাবাদ এভাবে আলোকপর্বের মৌলিক উদ্দেশ্যকে বিনির্মান (Deconstruct) করে যা হলো: ইতিহাসের এবং কোনো বিষয়ের একটি একত্ববাদী উদ্দেশ্যের ধারনা। উত্তরাধুনিকতাবাদের আরেকজন বড়ো তাত্তি্বক হলেন সমকালীন ফরাসী লেখক জাঁ বোদ্রিলার। তাঁর গ্রন্থ Simulations (১৯৮১, অনুদিত ১৯৮৩) উত্তরাধুনিকতাবাদের অঙ্গনে অনুপ্রবেশের ইঙ্গিতবাহী, যা সচরাচর বাস্তবের লোকসান (the loss of the real) বলে পরিচিত। বোদ্রিলার মূলত তারই সাথে সম্পৃক্ত যার উদ্দেশ্য হলো: সমকালীন জীবনে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের পরিব্যাপক প্রভাবকে সত্য ও কল্পনার, বাস্তব ও ভ্রমের, ওপর ও ভেতরের মধ্যকার প্রভেদজনিত লোকসানের দিকে ঠেলে দেয়া। ফলাফল হলো একটি অতিবাস্তবতার (hyper reality) সংস্কৃতি, যেখানে এগুলোর মধ্যকার তফাৎসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তাঁর মতামত সবিস্তারে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর “Simulacra and Simulations” শীর্ষক প্রবন্ধে, যা ১৯৯২ সালে ব্রুকারে সংক্ষেপিতভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়। সম্পূর্ণতার একটি অতীত যুগ স্মরণ করে তিনি শুরু করেছেন যখন একটি চিহ্ন ছিলো অন্তর্নিহিত গভীরতার বা বাস্তবতার সূচক। কিন্তু তাঁর জিজ্ঞাস্য হলো: যদি কোনো চিহ্ন একটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতার সূচক না হয়ে কেবলমাত্র অন্যান্য চিহ্নের সূচক হয় তাহলে কি হবে ? তাহলে পুরো পদ্ধতিটিই তাঁর ভাষায় হবে একটি ধান্দা সৃষ্টিকারী প্রতিমূর্তি (Simulcrum)। বাস্তবতার লোকসানের এই উত্তরাধুনিক শর্তটিকে যদি প্রকৃত ঘটনা হিশেবে গ্রাহ্য করা হয়, তাহলে সাহিত্যতত্ত্বের জন্যে কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে, কারণ মার্কসীয়, নারীবাদী, কাঠামোবাদী ইত্যাদি সাহিত্য ব্যাখ্যানের সকল পদ্ধতিই মূলত বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ-এর মধ্যকার, টেক্েস্টর বাইরের ও ভেতরের অর্থের মধ্যকার প্রভেদ নির্মানের ওপর নির্ভর করে। আমরা যা দেখি তার সবটুকুই আমরা পাই বলে যদি আমরা ধরে নিই, তাহলে স্পষ্টতই একজন সাহিত্য সমালোচক বা তাত্তি্বক অত্যন্ত অল্পই করতে পেরেছে বলে দাবী করা যায়। অধিকন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদের জন্যে কিছু নিত্য-উপস্থিত জিজ্ঞাসা ও কিছু অনুশর্ত আছে। চূড়ান্ত বোদ্রিলারিয় ফর্মে 'বাস্তবতার লোকসান'কে দুর্ভোগের প্রতি উদাসীন নিস্পৃহতাকে বৈধকারী বলে মনে হতে পারে। একটি কুখ্যাত ঘোষণায় বোদ্রিলার সমর্থন করেন যে, উপসাগরীয় যুদ্ধ কখনোই ঘটেনি; যা আসলেই ঘটেছিলো তা এক ধরনের টেলি-ঐক্ষিক (televisual) বাস্তবতা। একইভাবে যদি আমরা বাস্তবতার লোকসান, বাস্তবতার পতন এবং ভানকে বাস্তবতা বলে ধরে নেই, তাহলে হলোকাস্টের (Holocaust) কি হবে? এটাও কি সেই প্রতিচ্ছবি নেটওয়ার্কে হারিয়ে যাওয়া বাস্তবতার অংশ হবে? অন্য কথায়, উত্তরাধুনিকতাবাদের আক্রমণের লক্ষবস্তু কতিপয় ধারনায় (যেমন ইতিহাস, বাস্তবতা, সত্য ইত্যাদি) বিশ্বাস ছাড়া আমরা আমাদেরকে ভালোভাবেই মোটামুটি বিকর্ষী সংসর্গে খুঁজে পেতে পারি। ওপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, আলোকপর্ব আর আধুনিকতাবাদের অসমাপ্ততা কিংবা অসম্পূূর্ণতার ভিত্তিমূলে প্রোথিত এক একাডেমিক প্রতিক্রিয়া হিশেবে সূত্রপাত ঘটেছে উত্তরাধুনিক ভাবনার। বস্তুত, উত্তরাধুনিকতাবাদ ব্যাখ্যা করা একটি দুঃসাধ্যপ্রায় কর্ম। আরো অনেক মতবাদের মতো এটি প্রকৃতিতে অনিয়তাকার। তবে তা আধুনিকতা থেকে আলাদা, এমনকি আধুনিকতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। সাধারনত উত্তরাধুনিকতাবাদ বলতে ভাবনার জগতের সেই সকল পরিবর্তন, উন্নয়ন ও প্রবনতাকে বুঝায় যেগুলো সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ শতকের চলি্লশ অথবা পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত হয়েছিলো এবং এখনো হচ্ছে। উত্তরাধুনিকতাবাদের আলোচনায় একথা মনে হতে পারে যে আধুনিকতাবাদ বুঝি শেষ হয়ে গেছে। তা কিন্তু ঠিক নয়। এ দ'ুয়ের ব্যাপারে কোনো পরিস্কার সীমারেখা নেই। তবে উত্তরাধুনিকতাবাদকে আধুনিকতাবাদের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিশেবে ধরে নেয়া যায়। বস্তুত, উত্তরাধুনিক তত্ত্ব, সমালোচনা, শিল্পকলা, সবকিছুই শিল্পের অরাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের আধুনিক অঙ্গনের এবং মূল্যমুক্ত কাজ হিশেবে তত্ত্ব ও সমালোচনার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মৌলিকভাবে সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে আঁভগার্দ (Avant-garde) আন্দোলনসমূহ ছিলো আধুনিকতাবাদী। আঁভগার্দ প্রভাব চলছেই। তবে বলা যেতে পারে যে নয়া আঁভগার্দ (New Avant-garde) চলছে। উত্তরাধুনিকতাবাদও চলছে। সেদিক থেকে উত্তরাধুনিকতাবাদকে নয়া আঁভগার্দ হিশেবে বিবেচনা করা অসমীচিন নয়। উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হলো সাহিত্য, শিল্পকলা ও দর্শন। ডেভিড এ্যান্টিন যথার্থই বলেছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদের একটি অন্যতম মৌলিক কাজ হলো শিল্পকলার রাজত্ব কোথায় হওয়া উচিৎ এবং কিভাবে তারা সামাজিক এবং এমনকি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সমসীমাযুক্ত হয়, সে প্রশ্ন আরেকবার খতিয়ে দেখা। সাহিত্যের জগত থেকে কিছু উত্তরাধুনিক উপাদান বের করা যেতে পারে। চার্লস রাসেল বলেছেন: উত্তরাধুনিক সাহিত্য চিনতে পারে যে, সকল উপলব্ধি, অবধারণ, ফর্ম এবং রূপায়ণ সমাজ ব্যবস্থা কতর্ৃক গঠিত। সংস্কৃতির কোনো সাধারণ বৈপরীত্য থাকতে পারেনা, ভাষার কোনো অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত থাকতে পারে না, থাকতে পারেনা কোনো একক আত্দসংজ্ঞা; কারণ, সবকিছুই তাদের অর্থ খুঁজে পায় একমাত্র একটি সামাজিক অবকাঠামো থেকে।৬ উত্তরাধুনিক সাহিত্যে এই সামাজিক ঐতিহ্যের বিরোধিতা আছে। এমন সাহিত্যকর্ম আছে যা অনৈতিহ্যিক এবং সকল কতর্ৃপক্ষ কিংবা অর্থবোধকতার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। নয়া উপন্যাস (nouveau roman) এবং প্রতি উপন্যাস (anti -novel)-এ প্রদর্শিত নিরীক্ষাধর্মী কলাকৌশলগুলোকে উত্তরাধুনিকতার লক্ষনাক্রান্ত মনে করা যেতে পারে। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোকে স্থুল জনপ্রিয়তা লাভের হাস্যকর কৌশল মনে হতে পারে। উত্তরাধুনিক উপন্যাস সমগ্র আন্তসম্পর্কিত ধারনা-পরম্পরায় সন্দেহ পোষণ করে, যা সুবিধাজনকভাবে উদারনৈতিক মানবতাবাদের মোড়কে আচ্ছাদিত ধারনার সাথে সম্পর্কিত, যথা: স্বায়ত্ত্বশাসন (autonomy), অতীন্দ্রিয়তা (transcendence), নিশ্চয়তা (certainity), কতর্ৃত্ব (authority), একত্ব (unity), সামগ্রিকায়ন (totalization), পদ্ধতি (system), সর্বজনীনীকরণ (universalization), কেন্দ্র (center), ধারাবাহিকতা (continuity), পরমকারনবাদ (teleology), সমাপ্তি (closure), ক্রমাধিকারতন্ত্র (hierarchy ) সমজাতীয়তা (homogeneity) অনন্যতা (uniqueness), মূল (origin)।৭ এই ধারনাগুলোকে সন্দেহ করার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে তাদেরকে অস্বীকার করা। এর অর্থ কেবলমাত্র অভিজ্ঞতার সাথে তাদের সম্পর্ক কতোটুকু তা শনাক্ত করা। উত্তরাধুনিক জগতে সাহিত্য হলো অন্য একটি টেক্স্ট।৮
বস্তু-কবিতার (Concrete poetry) ক্ষেত্রেও এ ধরনের নিরীক্ষা লক্ষ করা যায়। অবশ্য একদিক থেকে বস্তু-কবিতায় বিশেষভাবে উত্তরাধুনিক কিছু, এমনকি আধুনিক কিছুও নেই । কারণ খৃষ্টপূর্ব চার শতকেই রোডেসের সিমিয়াস ঐ ধরনের কবিতা নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। নাটকের বেলায়ও আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এরকম নিরীক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন: Theatre of the Absurd, Total Theatre Ges Theatre de Complicite। উত্তরাধুনিকতাবাদের অন্যান্য বোধগম্য বৈশিষ্টসমূহের মধ্যে সারগ্রাহী পন্থা (eclectic approach), আপতিক রচনা (aleatory writing), লালিকা (parody) এবং পাঁচমিশালি সঙ্গীত (pastiche) অন্যতম। অধিকন,্তু কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতার (magic realism) প্রয়োগ বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর (science fiction) নতুন ধারা এবং নয়া গোথিক (neo-Gothic) এবং ভৌতিক গল্পের (horror story) সাম্প্রতিক বিন্যাসে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কসবাদী, নারীবাদী ও মনোবিশ্লেষণী সমালোচনার বিকাশকে উত্তরাধুনিকতাবাদের আরেকটি দিক হিশেবে গ্রাহ্য করা যায়। উত্তরাধুনিকতাবাদ আরো বলে সমালোচনায় সমালোচনার অবস্থানের কথা, যার সাথে উত্তর-কাঠামোবাদের (post-structuralism) মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাঠামোবাদ (structuralism) ও বিনির্মান (deconstruction)- এ প্রকাশিত দর্শন ও সাহিত্য সমালোচনার বৈপ্লবিক তত্ত্বসমূহ। পিটার বেরী তাঁর ‘Beginning Theory’ গ্রন্থে উত্তরাধুনিক সমালোচকের কর্মপ্রণালীকে ছয়টি পর্যায়ে দেখিয়েছেন: প্রথমত, তাঁরা বিশ শতকের সাহিত্যকর্মের ভেতরে উত্তরাধুনিক বিষয়, প্রবনতা এবং মনোভাব আবিষ্কার করেন এবং তাদের নিহিতার্থ অনুসন্ধান করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা কথাসাহিত্যকে সামনে আনেন বাস্তবের অন্তর্ধানের (disappearance of the real) ধারনাটি দৃষ্টান্ত সহকারে ব্যাখ্যা করার জন্যে, যেখানে পরিবর্তনশীল উত্তরাধুনিক উপকরণসমূহ সাহিত্য-ধরনের (genre) মিশেলে দৃষ্টিগোচর হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রোমাঞ্চোপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প, পৌরাণিক গাথা এবং বাস্তব মনস্তাত্তি্বক উপন্যাস ইত্যাদি। তৃতীয়ত, তাঁরা তুলে ধরেন যাকে বলা যেতে পারে সাহিত্যের আন্তগ্রন্থিক উপাদান (intertextual elements) যেমন লালিকা (parody), পাঁচ মিশালি সঙ্গীত (pastiche) এবং উল্লেখপঞ্জি (allusion) যেগুলোর সবার মধ্যেই বিপুল পরিমানে আন্তগ্রন্থিক উল্লেখ রয়েছে।
চতুর্থত, উমবার্তো ইকো বর্নিত আইরনি (irony )- এর ধারনার সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁরাও আইরনি ব্যবহার করেন। যথা, আধুনিক সমালোচকবৃন্দ যেখানে অতীতকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেন; উত্তরাধুনিকতাবাদীরা সেখানে অনুকরন করেন যে অতীতের পুন:দর্শন হওয়া দরকার, তবে কেবলমাত্র 'আইরনির সাথে'। পঞ্চমত, ন্যারেটিভ টেকনিকের ক্ষেত্রে তাঁরা নার্সিসিজমের (narcissism) উপাদানকে তুলে ধরেন যেখানে উপন্যাসসমূহ মনোযোগ দেয় তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়াসমূহের দিকে, তাদেরকে নিয়ে বিতর্ক করে এবং এভাবে তাদের বিষয়বস্তুকে বি-নৈসর্গীকৃত (de-naturalise) করে। ষষ্ঠত: তাঁরা উঁচু এবং নিচু সংস্কৃতির বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং সেই সকল টেক্স্টের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যেগুলো ঐ দুই সংস্কৃতির সঙ্কর মিশ্রন হিশেবে কাজ করে। ৯ যাই হোক, উত্তরাধুনিকতাবাদের সংজ্ঞা, পরিধি ও আলোচ্য বিষয়কে নির্দিষ্ট ছকে আটকে রাখা যাবে না। নতুন অাঁভগার্দের সমার্থক হিশেবে তা ভাবনার ক্রমবিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছেই সামনের দিকে; অংশ নিচ্ছে বিবিধ বৌদ্ধিক অনুশীলনে। তবে সজ্ঞায়িত না করা গেলেও তত্ত্ব প্রদান করা দরকার উত্তরাধুনিকতাবাদের। যেমন, ইহাব হাসান বলেছেন: যদিও সংজ্ঞা দান করা যাবেনা, তবুও সময় এসেছে একটি সাংস্কৃতিক ধারনার মর্যাদাপ্রাপ্তি ছাড়াই বিব্রতকর নবশব্দ থেকে শস্তা গতানুগতিক শব্দে পর্যবসিত হওয়ার আগেই উত্তরাধুিনকতাবাদের তত্ত্বায়ন দরকার।১০ নিশ্চিত করে বলা চলে যে, বিশ্বের ইতিহাসে আধুনিকতাবাদ ও আলোকপর্ব যে স্বপ্নসৌধ গড়ে তুলেছিলো, যে মহান আখ্যানের জন্ম দিয়েছিলো, তা যে কতো অন্তঃসারশূন্য, কতো মোহান্ধ, কতো ভয়ঙ্কর তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উত্তরাধুনিকতাবাদ। উত্তরাধুনিকতাবাদ প্রধানত আধুনিকতাবাদ ও আলোকপর্বের মিথ্যে আশাবাদের বিপরীতে সৃষ্ট নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার একাডেমিক আলোচনা। তাই উত্তরাধুনিকতাবাদের দর্শন ও উত্তরাধুনিক ভাবুকেরা জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করবে মহান আখ্যান থেকে ক্ষুদ্র উপাখ্যানে অবতরনের মাধ্যমে। তবে, যেভাবেই হোক না কেনো, উত্তরাধুনিক ভাবনা বিলীন হয়ে যাবার আশংকা নেই। অসংখ্য সীমাবদ্ধতার ভেতরেও উত্তরাধুনিক ডিসকোর্সের অনেক শক্তিও আছে। সেই শক্তি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। হ্যাবারমাসের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন : সেই কার্যক্ষেত্র কোথায়, যা উত্তরাধুনিকতাবাদের নঞর্থক শ্লোগানকে পূর্ণ করতে পারে একটি সদর্থক শ্লোগান দিয়ে? লিন্ডা হাচানের উত্তর : সর্বত্রই; আজকের কথাসাহিত্য, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, নৃত্যকলা, স্থাপত্য, কবিতা, নাটক, এবং দুরদর্শনে।১১ লিন্ডার যুক্তি ফেলে দেবার নয়।
অবশ্য তা হয়ওনি। তবে যা হয়েছে, তা হলো অতি স্তাবকতা অথবা অতি কুৎসা কিংবা যথেচ্ছ ব্যবহার; সাহিত্য, শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, সমালোচনাতত্ত্ব , ইতিহাস ও দর্শনের জগতে। উমবার্তো ইকো যথার্থই বলেছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদ একটি দুর্ভাগ্যজনক শব্দ (bon a© tout faire)। আমার এ ধারনা জন্মেছে যে, আজকাল ব্যবহারকারীরা এই শব্দকে যেখানে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করছে। অধিকন্তু, মনে হচ্ছে যে, এটিকে ক্রমাগত অতীতমুখি করবার চেষ্টা চলছে। প্রথমে এটি মুখ্যত গত বিশ বছরের কতিপয় লেখক ও শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছিলো; তারপর ক্রমাগত তা শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৌছয়; তারপর আরো পেছনে। এবং এই উল্টোযাত্রা যেভাবে চলছে, তাতে মনে হয় শীঘ্রই উত্তরাধুনিকতাবাদ হোমারকেও সংযুক্ত করবে।১ এসব টানাপোড়েনে উত্তরাধুনিকতাবাদের যথার্থ তাত্তি্বক বিকাশ সাধিত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছেনা। এ্যান্ডিয়াস হাইসেন সতর্ক করে দিয়েছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদকে নিয়ে স্তব কিংবা বিদ্রুপ কোনোটাই করা উচিত নয়। তাকে অবশ্যই তার সমর্থক এবং নিন্দুক উভয়ের হাত থেকেই বাঁচাতে হবে।
২
উত্তরাধুনিকতাবাদের ইতিহাসে প্রধান গুরুত্ত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৯৮০ সালে সমকালীন জার্মান তাত্তি্বক হ্যাবারমাস কতর্ৃক উপস্থাপিত 'আধুনিকতা _একটি অসমাপ্ত প্রকল্প' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। হ্যাবারমাস মনে করেন যে, আধুনিক কাল আলোকপর্বেও (Enlightenment) সাথে শুরু হয়, যার সময়সীমা মধ্য সতের থেকে মধ্য আঠারো শতক পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী, যখন মানব সমাজের উন্নয়নকল্পে যুক্তিবাদের প্রভাবে জনমনে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিলো। এইসকল ধারনা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো জার্মানীতে কান্ট, ফ্রান্সে ভলতেয়ার ও দিদেরো এবং বৃটেনে লক ও হিউমের দর্শনে। বৃটেনে যুক্তির (The Age of Reason) বলতে এখনো ঐ সময়কেই বোঝায়। তথাকথিত আলোকপর্বের প্রকল্প বলতে বুঝি সনাতনী ঐতিহ্য, অন্ধ অনুকরণ, জীর্ণ আচার এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও নিষেধাজ্ঞার প্রতি দাসোচিত আনুগত্য অস্বীকারের মধ্য দিয়ে নির্মোহ-নিরাসক্ত ব্যক্তির দ্বারা যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ, যা সামাজিক সমস্যাবলীর উন্নততর সমাধান দিতে সমর্থ। হ্যাবারমাস আধুনিকতাবাদ বলতে এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই বুঝিয়েছেন। এই তত্ত্ব পরীক্ষা করার প্রথম উদ্যোগ হিশেবে দেখা যেতে পারে ফরাসী বিপ্লবকে। হ্যাবারমাস মনে করেন যে, বিশ শতকে যেমন একদিকে লক্ষ করা গেছে যুক্তিবাদে আস্থা আর প্রগতির সম্ভাবনা, অন্যদিকে তেমনি দেখা গেছে দুর্যোগের ঘনঘটা। আধুনিকতাবাদ নামে পরিচিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই প্রকল্পের সাথে এই মর্মে একাত্ন হয়েছিলো যে, এটি হৃত উদ্দেশ্যের জন্যে, হৃত সঙ্গতির জন্যে, হৃত মূল্যবোধের জন্যে এক ধরনের অনুশোচনার জন্ম দিতে পেরেছে। হ্যাবারমাস আরও মনে করেন যে, দেরিদা ও ফুকোর মতো সত্তর দশকের উত্তর-কাঠামোবাদী ভাবুকেরাও আলোকর্পেবর আধুনিকতার ব্যাপারে এক ধরনের বিশেষ অস্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন। তাঁর(হ্যাবারমাস) মতে, তাঁরা(দেরিদা ও ফুকো) যুক্তিবাদ, স্পষ্টবাদীতা, সত্যান্বেষণ ও প্রাগ্রসরতার আদর্শসমূহকে আক্রমন করেছিলেন এবং এভাবে ন্যায়ানুসন্ধানের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। হ্যাবারমাস তাঁদেরকে 'তরুণ রক্ষণশীল' (Young Conservatives) বলে অভিহিত করেন। 'উত্তরাধুনিকতাবাদ' শব্দটি ১৯৩০-এর দিকে প্রথম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর বর্তমান জাত্যার্থ ১৯৭৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ফ্রাঙ্কো লিওতারের The Postmodern Condition: A Report on Knowledge শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশের সাথে শুরু হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। লিওতারের প্রবন্ধ “Answering the Question: What is Postmodernism?” ১৯৮২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ; ১৯৮৪ সালে দ্য পোস্টমডার্ন কনডিশন গ্রন্থের পরিশিষ্ট হিশেবে সংযুক্ত হয় এবং ১৯৯২ সালে ব্রুকারের মডার্নিজম/পোস্ট-মডার্নিজম গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রবন্ধটি মুখ্যত আলোকপর্ব বিষয়ক বিতর্ক কেন্দ্রিক এবং ঈষৎ তীর্যকভাবে হ্যাবারমাসকে সমালোচনা করে রচিত। লিওতার এমন একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন যা কার্যত সেই বিতর্ককে সংঘর্ষে রূপান্তরিত করে। প্রতিপক্ষকে যথার্থ রক্ষণশীল হিশেবে প্রমান করার জন্যেই তিনি তা করেন। তিনি বলেন: "সব দিক থেকেই আমরা পরীক্ষণ শেষ করবার জন্যে প্ররোচিত হচ্ছি।" কতিপয় দৃষ্টান্ত সহযোগে তিনি হ্যাবারমাস সম্পর্কে বলেন: আমি একজন খ্যাতিমান ভাবুক সম্পর্কে পড়েছি, যিনি তাঁর কথিত ইয়াং-রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে আধুনিকতাবাদকে সমর্থন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, উত্তরাধুনিকতাবাদের ব্যানারে সেই রক্ষণশীলেরা আধুনিকতাবাদ এবং আলোকপর্বের অসমাপ্ত প্রকল্প থেকে মুক্তি পেতে চাইবে। ৩ লিওতার অভিযোগ করেন যে, হ্যাবারমাস অনেকের মতো শৃংখলা, একতা, পরিচিতি ও নিরাপত্তার জন্যে শৈল্পিক পরীক্ষণের পরিসমাপ্তি ডেকেছেন। তাঁরা মূলত আঁভগার্দের উত্তরাধিকারের বিনাশ সাধন করতে চান। লিওতার মনে করেন, আলোকপর্বের যে প্রকল্প হ্যাবারমাস বহাল রাখতে চান, তা আসলে খৃস্টবাদ ছাড়া আর কিছু নয় । বস্তুত, মার্কসবাদ অথবা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পুরাণের মতো বস্তুর একটি কতর্ৃত্বব্যঞ্জক এবং সমগ্রবাদী ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা ও পুনর্নিশ্চয়তা জ্ঞাপনের দাবীদার এই অধি আখ্যানগুলো (Meta narratives) বস্তুত অধ্যাস এবং পৃথকত্ব, বিরোধ ও বহুত্বকে দমন করার জন্যে লালিত। এ কারণে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা লিওতার নির্নয় করেছেন মেটান্যারেটিভের প্রতি অবিশ্বাস হিশেবে। কাজেই উন্নয়নের মহা-আখ্যানগুলো (Grand narratives) এবং মনুষ্য উৎকর্ষ আর কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। লুসি নিয়ালও এই অভিমতকে সমর্থন করেন। তাঁর ভাবনায়: উত্তরাধুনিক মানস হলো 'সত্য' এবং 'মূল্য' বিষয়ক সকল উপাদানকে ভুলে যাওয়ার মানস। আমরা যাকে আজ 'সত্য' বলে চিনি তা আসলে 'উন্মত্ত ক্ষমতাধর এবং তাদের চামচা ভাঁড়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের নির্বাচিত সংস্করণের মাধ্যমে চিরস্থায়ীকৃত বিচ্ছিন্ন মিথ্যায় ভরা।' আমাদের আজকের পৃথিবী বুঝার জন্যে প্রযুক্তি ও মিডিয়ার মাধ্যমে ঐ সকল তথাকথিত সত্য প্রকাশ করা হচ্ছে। 'মূল্য' কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রভাব। সুতরাং তথাকথিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের অধীনে দমিত না হবার জন্যে আজ নৈরাশ্যবাদী হওয়া জরুরি। ৪ এমতাবস্থায় আমরা যা সবের্াচ্চ আশা করতে পারি, তা হলো, ক্ষুদ্র আখ্যান পরম্পরা (A series of mini narratives) যা সাময়িক, অস্থায়ী, আপতিক, আপেক্ষিক ও অনিশ্চিত, যা বিশেষ স্থানীয় পরিস্থিতিতে বিশেষ দলের কর্মকান্ডের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করে। উত্তরাধুনিকতাবাদ এভাবে আলোকপর্বের মৌলিক উদ্দেশ্যকে বিনির্মান (Deconstruct) করে যা হলো: ইতিহাসের এবং কোনো বিষয়ের একটি একত্ববাদী উদ্দেশ্যের ধারনা। উত্তরাধুনিকতাবাদের আরেকজন বড়ো তাত্তি্বক হলেন সমকালীন ফরাসী লেখক জাঁ বোদ্রিলার। তাঁর গ্রন্থ Simulations (১৯৮১, অনুদিত ১৯৮৩) উত্তরাধুনিকতাবাদের অঙ্গনে অনুপ্রবেশের ইঙ্গিতবাহী, যা সচরাচর বাস্তবের লোকসান (the loss of the real) বলে পরিচিত। বোদ্রিলার মূলত তারই সাথে সম্পৃক্ত যার উদ্দেশ্য হলো: সমকালীন জীবনে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের পরিব্যাপক প্রভাবকে সত্য ও কল্পনার, বাস্তব ও ভ্রমের, ওপর ও ভেতরের মধ্যকার প্রভেদজনিত লোকসানের দিকে ঠেলে দেয়া। ফলাফল হলো একটি অতিবাস্তবতার (hyper reality) সংস্কৃতি, যেখানে এগুলোর মধ্যকার তফাৎসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তাঁর মতামত সবিস্তারে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর “Simulacra and Simulations” শীর্ষক প্রবন্ধে, যা ১৯৯২ সালে ব্রুকারে সংক্ষেপিতভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়। সম্পূর্ণতার একটি অতীত যুগ স্মরণ করে তিনি শুরু করেছেন যখন একটি চিহ্ন ছিলো অন্তর্নিহিত গভীরতার বা বাস্তবতার সূচক। কিন্তু তাঁর জিজ্ঞাস্য হলো: যদি কোনো চিহ্ন একটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতার সূচক না হয়ে কেবলমাত্র অন্যান্য চিহ্নের সূচক হয় তাহলে কি হবে ? তাহলে পুরো পদ্ধতিটিই তাঁর ভাষায় হবে একটি ধান্দা সৃষ্টিকারী প্রতিমূর্তি (Simulcrum)। বাস্তবতার লোকসানের এই উত্তরাধুনিক শর্তটিকে যদি প্রকৃত ঘটনা হিশেবে গ্রাহ্য করা হয়, তাহলে সাহিত্যতত্ত্বের জন্যে কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে, কারণ মার্কসীয়, নারীবাদী, কাঠামোবাদী ইত্যাদি সাহিত্য ব্যাখ্যানের সকল পদ্ধতিই মূলত বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ-এর মধ্যকার, টেক্েস্টর বাইরের ও ভেতরের অর্থের মধ্যকার প্রভেদ নির্মানের ওপর নির্ভর করে। আমরা যা দেখি তার সবটুকুই আমরা পাই বলে যদি আমরা ধরে নিই, তাহলে স্পষ্টতই একজন সাহিত্য সমালোচক বা তাত্তি্বক অত্যন্ত অল্পই করতে পেরেছে বলে দাবী করা যায়। অধিকন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদের জন্যে কিছু নিত্য-উপস্থিত জিজ্ঞাসা ও কিছু অনুশর্ত আছে। চূড়ান্ত বোদ্রিলারিয় ফর্মে 'বাস্তবতার লোকসান'কে দুর্ভোগের প্রতি উদাসীন নিস্পৃহতাকে বৈধকারী বলে মনে হতে পারে। একটি কুখ্যাত ঘোষণায় বোদ্রিলার সমর্থন করেন যে, উপসাগরীয় যুদ্ধ কখনোই ঘটেনি; যা আসলেই ঘটেছিলো তা এক ধরনের টেলি-ঐক্ষিক (televisual) বাস্তবতা। একইভাবে যদি আমরা বাস্তবতার লোকসান, বাস্তবতার পতন এবং ভানকে বাস্তবতা বলে ধরে নেই, তাহলে হলোকাস্টের (Holocaust) কি হবে? এটাও কি সেই প্রতিচ্ছবি নেটওয়ার্কে হারিয়ে যাওয়া বাস্তবতার অংশ হবে? অন্য কথায়, উত্তরাধুনিকতাবাদের আক্রমণের লক্ষবস্তু কতিপয় ধারনায় (যেমন ইতিহাস, বাস্তবতা, সত্য ইত্যাদি) বিশ্বাস ছাড়া আমরা আমাদেরকে ভালোভাবেই মোটামুটি বিকর্ষী সংসর্গে খুঁজে পেতে পারি। ওপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, আলোকপর্ব আর আধুনিকতাবাদের অসমাপ্ততা কিংবা অসম্পূূর্ণতার ভিত্তিমূলে প্রোথিত এক একাডেমিক প্রতিক্রিয়া হিশেবে সূত্রপাত ঘটেছে উত্তরাধুনিক ভাবনার। বস্তুত, উত্তরাধুনিকতাবাদ ব্যাখ্যা করা একটি দুঃসাধ্যপ্রায় কর্ম। আরো অনেক মতবাদের মতো এটি প্রকৃতিতে অনিয়তাকার। তবে তা আধুনিকতা থেকে আলাদা, এমনকি আধুনিকতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। সাধারনত উত্তরাধুনিকতাবাদ বলতে ভাবনার জগতের সেই সকল পরিবর্তন, উন্নয়ন ও প্রবনতাকে বুঝায় যেগুলো সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্য, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশ শতকের চলি্লশ অথবা পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত হয়েছিলো এবং এখনো হচ্ছে। উত্তরাধুনিকতাবাদের আলোচনায় একথা মনে হতে পারে যে আধুনিকতাবাদ বুঝি শেষ হয়ে গেছে। তা কিন্তু ঠিক নয়। এ দ'ুয়ের ব্যাপারে কোনো পরিস্কার সীমারেখা নেই। তবে উত্তরাধুনিকতাবাদকে আধুনিকতাবাদের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিশেবে ধরে নেয়া যায়। বস্তুত, উত্তরাধুনিক তত্ত্ব, সমালোচনা, শিল্পকলা, সবকিছুই শিল্পের অরাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের আধুনিক অঙ্গনের এবং মূল্যমুক্ত কাজ হিশেবে তত্ত্ব ও সমালোচনার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মৌলিকভাবে সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে আঁভগার্দ (Avant-garde) আন্দোলনসমূহ ছিলো আধুনিকতাবাদী। আঁভগার্দ প্রভাব চলছেই। তবে বলা যেতে পারে যে নয়া আঁভগার্দ (New Avant-garde) চলছে। উত্তরাধুনিকতাবাদও চলছে। সেদিক থেকে উত্তরাধুনিকতাবাদকে নয়া আঁভগার্দ হিশেবে বিবেচনা করা অসমীচিন নয়। উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হলো সাহিত্য, শিল্পকলা ও দর্শন। ডেভিড এ্যান্টিন যথার্থই বলেছেন: উত্তরাধুনিকতাবাদের একটি অন্যতম মৌলিক কাজ হলো শিল্পকলার রাজত্ব কোথায় হওয়া উচিৎ এবং কিভাবে তারা সামাজিক এবং এমনকি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে সমসীমাযুক্ত হয়, সে প্রশ্ন আরেকবার খতিয়ে দেখা। সাহিত্যের জগত থেকে কিছু উত্তরাধুনিক উপাদান বের করা যেতে পারে। চার্লস রাসেল বলেছেন: উত্তরাধুনিক সাহিত্য চিনতে পারে যে, সকল উপলব্ধি, অবধারণ, ফর্ম এবং রূপায়ণ সমাজ ব্যবস্থা কতর্ৃক গঠিত। সংস্কৃতির কোনো সাধারণ বৈপরীত্য থাকতে পারেনা, ভাষার কোনো অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত থাকতে পারে না, থাকতে পারেনা কোনো একক আত্দসংজ্ঞা; কারণ, সবকিছুই তাদের অর্থ খুঁজে পায় একমাত্র একটি সামাজিক অবকাঠামো থেকে।৬ উত্তরাধুনিক সাহিত্যে এই সামাজিক ঐতিহ্যের বিরোধিতা আছে। এমন সাহিত্যকর্ম আছে যা অনৈতিহ্যিক এবং সকল কতর্ৃপক্ষ কিংবা অর্থবোধকতার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। নয়া উপন্যাস (nouveau roman) এবং প্রতি উপন্যাস (anti -novel)-এ প্রদর্শিত নিরীক্ষাধর্মী কলাকৌশলগুলোকে উত্তরাধুনিকতার লক্ষনাক্রান্ত মনে করা যেতে পারে। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোকে স্থুল জনপ্রিয়তা লাভের হাস্যকর কৌশল মনে হতে পারে। উত্তরাধুনিক উপন্যাস সমগ্র আন্তসম্পর্কিত ধারনা-পরম্পরায় সন্দেহ পোষণ করে, যা সুবিধাজনকভাবে উদারনৈতিক মানবতাবাদের মোড়কে আচ্ছাদিত ধারনার সাথে সম্পর্কিত, যথা: স্বায়ত্ত্বশাসন (autonomy), অতীন্দ্রিয়তা (transcendence), নিশ্চয়তা (certainity), কতর্ৃত্ব (authority), একত্ব (unity), সামগ্রিকায়ন (totalization), পদ্ধতি (system), সর্বজনীনীকরণ (universalization), কেন্দ্র (center), ধারাবাহিকতা (continuity), পরমকারনবাদ (teleology), সমাপ্তি (closure), ক্রমাধিকারতন্ত্র (hierarchy ) সমজাতীয়তা (homogeneity) অনন্যতা (uniqueness), মূল (origin)।৭ এই ধারনাগুলোকে সন্দেহ করার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে তাদেরকে অস্বীকার করা। এর অর্থ কেবলমাত্র অভিজ্ঞতার সাথে তাদের সম্পর্ক কতোটুকু তা শনাক্ত করা। উত্তরাধুনিক জগতে সাহিত্য হলো অন্য একটি টেক্স্ট।৮
বস্তু-কবিতার (Concrete poetry) ক্ষেত্রেও এ ধরনের নিরীক্ষা লক্ষ করা যায়। অবশ্য একদিক থেকে বস্তু-কবিতায় বিশেষভাবে উত্তরাধুনিক কিছু, এমনকি আধুনিক কিছুও নেই । কারণ খৃষ্টপূর্ব চার শতকেই রোডেসের সিমিয়াস ঐ ধরনের কবিতা নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। নাটকের বেলায়ও আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এরকম নিরীক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন: Theatre of the Absurd, Total Theatre Ges Theatre de Complicite। উত্তরাধুনিকতাবাদের অন্যান্য বোধগম্য বৈশিষ্টসমূহের মধ্যে সারগ্রাহী পন্থা (eclectic approach), আপতিক রচনা (aleatory writing), লালিকা (parody) এবং পাঁচমিশালি সঙ্গীত (pastiche) অন্যতম। অধিকন,্তু কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতার (magic realism) প্রয়োগ বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর (science fiction) নতুন ধারা এবং নয়া গোথিক (neo-Gothic) এবং ভৌতিক গল্পের (horror story) সাম্প্রতিক বিন্যাসে উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কসবাদী, নারীবাদী ও মনোবিশ্লেষণী সমালোচনার বিকাশকে উত্তরাধুনিকতাবাদের আরেকটি দিক হিশেবে গ্রাহ্য করা যায়। উত্তরাধুনিকতাবাদ আরো বলে সমালোচনায় সমালোচনার অবস্থানের কথা, যার সাথে উত্তর-কাঠামোবাদের (post-structuralism) মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাঠামোবাদ (structuralism) ও বিনির্মান (deconstruction)- এ প্রকাশিত দর্শন ও সাহিত্য সমালোচনার বৈপ্লবিক তত্ত্বসমূহ। পিটার বেরী তাঁর ‘Beginning Theory’ গ্রন্থে উত্তরাধুনিক সমালোচকের কর্মপ্রণালীকে ছয়টি পর্যায়ে দেখিয়েছেন: প্রথমত, তাঁরা বিশ শতকের সাহিত্যকর্মের ভেতরে উত্তরাধুনিক বিষয়, প্রবনতা এবং মনোভাব আবিষ্কার করেন এবং তাদের নিহিতার্থ অনুসন্ধান করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা কথাসাহিত্যকে সামনে আনেন বাস্তবের অন্তর্ধানের (disappearance of the real) ধারনাটি দৃষ্টান্ত সহকারে ব্যাখ্যা করার জন্যে, যেখানে পরিবর্তনশীল উত্তরাধুনিক উপকরণসমূহ সাহিত্য-ধরনের (genre) মিশেলে দৃষ্টিগোচর হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, রোমাঞ্চোপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প, পৌরাণিক গাথা এবং বাস্তব মনস্তাত্তি্বক উপন্যাস ইত্যাদি। তৃতীয়ত, তাঁরা তুলে ধরেন যাকে বলা যেতে পারে সাহিত্যের আন্তগ্রন্থিক উপাদান (intertextual elements) যেমন লালিকা (parody), পাঁচ মিশালি সঙ্গীত (pastiche) এবং উল্লেখপঞ্জি (allusion) যেগুলোর সবার মধ্যেই বিপুল পরিমানে আন্তগ্রন্থিক উল্লেখ রয়েছে।
চতুর্থত, উমবার্তো ইকো বর্নিত আইরনি (irony )- এর ধারনার সাথে সঙ্গতি রেখে তাঁরাও আইরনি ব্যবহার করেন। যথা, আধুনিক সমালোচকবৃন্দ যেখানে অতীতকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেন; উত্তরাধুনিকতাবাদীরা সেখানে অনুকরন করেন যে অতীতের পুন:দর্শন হওয়া দরকার, তবে কেবলমাত্র 'আইরনির সাথে'। পঞ্চমত, ন্যারেটিভ টেকনিকের ক্ষেত্রে তাঁরা নার্সিসিজমের (narcissism) উপাদানকে তুলে ধরেন যেখানে উপন্যাসসমূহ মনোযোগ দেয় তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়াসমূহের দিকে, তাদেরকে নিয়ে বিতর্ক করে এবং এভাবে তাদের বিষয়বস্তুকে বি-নৈসর্গীকৃত (de-naturalise) করে। ষষ্ঠত: তাঁরা উঁচু এবং নিচু সংস্কৃতির বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং সেই সকল টেক্স্টের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যেগুলো ঐ দুই সংস্কৃতির সঙ্কর মিশ্রন হিশেবে কাজ করে। ৯ যাই হোক, উত্তরাধুনিকতাবাদের সংজ্ঞা, পরিধি ও আলোচ্য বিষয়কে নির্দিষ্ট ছকে আটকে রাখা যাবে না। নতুন অাঁভগার্দের সমার্থক হিশেবে তা ভাবনার ক্রমবিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছেই সামনের দিকে; অংশ নিচ্ছে বিবিধ বৌদ্ধিক অনুশীলনে। তবে সজ্ঞায়িত না করা গেলেও তত্ত্ব প্রদান করা দরকার উত্তরাধুনিকতাবাদের। যেমন, ইহাব হাসান বলেছেন: যদিও সংজ্ঞা দান করা যাবেনা, তবুও সময় এসেছে একটি সাংস্কৃতিক ধারনার মর্যাদাপ্রাপ্তি ছাড়াই বিব্রতকর নবশব্দ থেকে শস্তা গতানুগতিক শব্দে পর্যবসিত হওয়ার আগেই উত্তরাধুিনকতাবাদের তত্ত্বায়ন দরকার।১০ নিশ্চিত করে বলা চলে যে, বিশ্বের ইতিহাসে আধুনিকতাবাদ ও আলোকপর্ব যে স্বপ্নসৌধ গড়ে তুলেছিলো, যে মহান আখ্যানের জন্ম দিয়েছিলো, তা যে কতো অন্তঃসারশূন্য, কতো মোহান্ধ, কতো ভয়ঙ্কর তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উত্তরাধুনিকতাবাদ। উত্তরাধুনিকতাবাদ প্রধানত আধুনিকতাবাদ ও আলোকপর্বের মিথ্যে আশাবাদের বিপরীতে সৃষ্ট নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার একাডেমিক আলোচনা। তাই উত্তরাধুনিকতাবাদের দর্শন ও উত্তরাধুনিক ভাবুকেরা জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করবে মহান আখ্যান থেকে ক্ষুদ্র উপাখ্যানে অবতরনের মাধ্যমে। তবে, যেভাবেই হোক না কেনো, উত্তরাধুনিক ভাবনা বিলীন হয়ে যাবার আশংকা নেই। অসংখ্য সীমাবদ্ধতার ভেতরেও উত্তরাধুনিক ডিসকোর্সের অনেক শক্তিও আছে। সেই শক্তি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। হ্যাবারমাসের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন : সেই কার্যক্ষেত্র কোথায়, যা উত্তরাধুনিকতাবাদের নঞর্থক শ্লোগানকে পূর্ণ করতে পারে একটি সদর্থক শ্লোগান দিয়ে? লিন্ডা হাচানের উত্তর : সর্বত্রই; আজকের কথাসাহিত্য, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, নৃত্যকলা, স্থাপত্য, কবিতা, নাটক, এবং দুরদর্শনে।১১ লিন্ডার যুক্তি ফেলে দেবার নয়।
1.
Hutcheon, Linda. A Poetics of Postmodernism, History,
Theory, Fiction. New York & London : Routledge, ১৯৮৮, পৃ-৪২
2.
প্রাগুক্ত,
Preface
3.
Brooker, Peter. ed. Modernism/Postmodernism, Longman, ১৯৯২, পৃ-১৪১
4.
Lucy Niall. Postmodern Literary Theory, An Introduction.
Oxford : Blackwell Publishers, 1997, Preface
5.
Hutcheon, Linda. A Poetics of Postmodernism, History,
Theory, Fiction. New York & London : Routledge, 1988, পৃ-৩৮
6.
প্রাগুক্ত,
পৃ-৫১
7.
প্রাগুক্ত,
পৃ-৫৭
8.
Lucy Niall. Postmodern Literary Theory, An Introduction.
Oxford : Blackwell Publishers, 1997, Preface
9.
Barry, Peter. Beginning theory An introduction to
Literary and cultural theory. N. Y : Manchester University Press ১৯৯৫, পৃ-৯১
10.
Hutcheon, Linda. A Poetics of Postmodernism, History,
Theory, Fiction. New York & London : Routledge, 1988, পৃ-৩
11.
প্রাগুক্ত,
পৃ-২৩১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন