বাংলাসন ১৩৩৪-এ শ্রীজগদীশচন্দ্র গুপ্তের গল্পের বই ‘বিনোদিনী’
প্রকাশিত হইলে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রংশসা করছিলেন “ছোটগল্পের বিশেষ
রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম” বইলা। এর প্রেক্ষিতে
জগদীশ গুপ্ত ১৩৩৮-এ ছাপা হওয়া তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লঘু-গুরু’র এক কপি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে পাঠান। বই পইড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এইটা নিয়া পরিচয়
পত্রিকায় লিখেন। জগদীশ গুপ্তের উপন্যাসরে ভিত্তি কইরা তিনি সাহিত্যে
অতি-রোমাণ্টিসজমের বিপরীতে অতি-রিয়ালিজমের সমালোচনা করেন। বাস্তবতা কী এবং
কতোটা সাহিত্যে অ্যাকোমোডেড করা উচিত, এই বিষয়ে উনার মতামত দেন। জগদীশ
গুপ্তও এই সমালোচনার একটা উত্তর করেন এর পরের বছর, তাঁর ‘উদয়-লেখা’
গল্প-সংকলনের (বাংলা ১৩৩৯) ভূমিকায়। উনারা দুইজনেই রিয়ালিজম/রিয়ালিস্টিক
শব্দটাই লেখেন, কারণ সম্ভবত তখনো ইংরেজী ১৯৫২ সন আইসা হাজির হইতে পারে নাই।
রবীন্দ্রনাথের মূল জিজ্ঞাসা, যা সমাজে নাই, তা কেন সাহিত্যে থাকবে?
জগদীশ গুপ্তের কাল্পনিক সমাজরে (যথা, পিটাইয়া বউ মারা, বেশ্যারে বিয়া করা
এবং তারে উন্নত-নারী’র রূপে হাজির করা, ইত্যাদি) তিনি বাস্তবতা মানতে রাজি
না। এইটারে ‘বিদেশ’ বইলা তিনি সন্দেহ করছেন। সাহিত্য-বিচার বাদ দিলেও
অর্থনৈতিক দিক দিয়া রবীন্দ্রনাথের এবং জগদীশ গুপ্তের শ্রেণী-বাস্তবতা একই
হওয়ার কথা না; কিন্তু এই গ্যাপটারে ‘বিদেশ’ পর্যন্ত এক্সটেন্ড করতে পারাটা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক কৃতিত্ব-ই না, সামাজিক অপমানের শ্লেষ বইলাও
পড়া যাইতে পারে।
বিষয় সেইটা না। সাহিত্যে লেখকের ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা জড়িতই থাকার কথা,
কিন্তু এইক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাবি আসলে এনজিও-সাহিত্যের; যে,
সমাজে (লেখকের ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার বাউন্ডারিতে) যা যা ঘটতেছে তার
বর্ণনা-সম্ভাব্যতার ট্রুথের ভিতরেই সাহিত্যেরে অপারেট করতে হবে। এইটারে
সাহিত্যের রিয়ালিজম হিসাবে নিলে যেকোন নতুন সাহিত্যিক বাস্তবতারেই
অতি-রিয়ালিজম হিসাবে দেখাটা সম্ভব।
সমাজ-বাস্তবতা দিয়া সাহিত্য হয় না, বরং সাহিত্যিক কল্পনা দিয়াই
সমাজে এক ধরণের বাস্তবতা উৎপাদিত হইতে থাকে। এইভাবে দেখলে, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের রিয়ালিজমের দাবি আসলে সাহিত্যিক পুনরুৎপাদনের; সমাজ-বাস্তবতা হইলো
তা-ই, সাহিত্য তারে যতোটা নিতে পারে! এই কারণে দেখবেন রবীন্দ্র-উপজাত
বাংলাসাহিত্যে পশ্চাতদেশে বায়ুনির্গমনেই রিয়ালিটি পয়দা হয়; পাদ দেয়া এখনো
পর্যন্ত অতি-রিয়ালিজমই হইয়া আছে।
অন্যদিকে জগদীশ গুপ্ত, যেহেতু রিয়েলি রিয়ালিজম নিয়া তটস্থ; মিনতি
করলেন – সাহিত্যের রিয়ালিটি দিয়া সমালোচক রবীন্দ্রনাথ যাতে জীবনের
রিয়ালিটিরে উৎখাত না করেন!
- ইমরুল হাসান।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরিচয়, কার্ত্তিক/১৩৩৮
যে-বই পড়ার জবাবদিহি আছে, সে-বই পড়তে সহজে রাজি হইনে। আমার বয়সে i কর্তব্যের চেয়ে অবকাশের মূল্য অনেক বেশি। বিশেষতঃ, যে কর্তব্য আমার অবশ্য-দায়িত্বের বাইরে।
তবু, লেখকের অনুরোধ রক্ষা করেছি, তাঁর “লঘু-গুরু” বইখানা পড়ে দেখলুম।
লেখবার ক্ষমতা তার আছে, এ কথা পূর্বেই জানা ছিল। এবারেও তার পরিচয় পেয়েছি।
লেখকের ক্ষমতা আছে বললে বোঝায়, লেখক যেটাকে লেখেন, সেটাকে পাঠ্য করে
তুলতে পারেন, সেটা পথ্য না হলেও। সাহিত্য সর্ম্পকে পথ্য কথাটা বলতে এ বোঝায়
না যে, জ্ঞানের দিক থেকে সেটা পুষ্টিকর, বা নীতির দিক থেকে সেটা
স্বাস্থ্যজনক। যেটাকে মন সম্পূর্ণ সায় দিয়ে গ্রহণ করতে পারে, সেটাই পথ্য।
মন যেটাকে বিশ্বাস করতে পারে, সেটাকেই গ্রহণ করে। এস্থানে নিজের অভিজ্ঞতার
সঙ্গে মিললে তো কোন কথাই নেই, নইলে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের দরকার। সে-প্রমাণ
মিথ্যে সাক্ষ্যের মতো বানিয়ে তোলা হলেও চলে, কিন্তু, তাতে সত্যের স্বাদ
থাকা চাই। সাহিত্যিক এই বলে হলফ করে, আমার কথা যতই মিথ্যে হোক, তবু সেটা
সত্য।
লঘু-গুরু গল্প সম্বন্ধে যদি জজিয়তি করতেই হয়, তা হলে গোড়াতেই আমাকে কবুল
করতে হবে যে, এই উপন্যাসে যে লোকযাত্রার বর্ণনা আছে, আমি একেবারেই তার
কিছু জানিনে। সেটা যদি আমারই ক্রুটি হয়, তবু আমি নাচার। বলে রাখছি, এ-দেশে
লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে কাটালুম, এই উপন্যাসের অবলম্বিত সমাজ তার পক্ষে
সাত-সমুদ্র-পারের বিদেশ বললেই হয়। দূর থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও
হয়তো বা অনতিপরিচতের সন্ধানে রাস্তা ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও-জায়গায় উঁকি
মেরে এসেছেন। আমার এই সন্দেহের কারণ হচ্ছে এই যে, লেখক আমাদের কাছে তাঁল
বক্তব্য দাখিল করেছেন, কিন্তু, তার যথেষ্ঠ সমর্থন যোগাড় করতে পারেননি। যেটা
দেখাতে চেয়েছেন, তিনি নিজে তার সবটাই যে দেখেছেন এমন লক্ষণ অন্ততঃ লেখা
থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
গল্পের প্রথম নায়ক বিশ্বম্ভর তার ভগিনীপতি লালমোহনকে নিয়ে দেখা দিলে।
লেখকের কাছ থেকে কোনো একটা অভিজ্ঞানপত্র নিয়ে আসেনি। তার থেকে ঠিক করে
নিলুম, আমাদের দেশে সচরাচর যাদের ভদ্রলোক বলে থাকে, দেখা হলেই যাদের বলে
থাকি, এই যে মশায়, ভালো আছেন তো, এও তাদেরই দলের। অতএব চৌকিটা এগিয়ে দেবার
পূর্বে প্রশ্ন করার দরকার নেই।
আরো খানিকটা গিয়ে যে পরিচয়টুকু পেলুম, তাতে জানা গেল, মদের আসরের উপকরণ
জোগাতে আলস্য করছিল বলে বিশ্বম্ভর তাড়া করাতে গর্ভিণী স্ত্রী পড়ে গিয়ে
সাংঘাতিক আঘাতে মারা যায়। যাদের আমরা চৌকি এগিয়ে দিই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ
এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ করেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। অতএব বিশ্বম্ভরকে
ভদ্দরশ্রেণীর লোক বলে মেনে নিতে এখনও সন্দেহের কারণ ঘটল না।
তারপর হঠাৎ শুনি, বিশ্বম্ভর খেয়া পার হবার সময় “উত্তম” নামধারিণী এক
বেশ্যাকে দেখে মুগ্ধ হোলো। এটাও ভদ্দরলোকের লক্ষণে বাধে না। কিন্তু,
বেশ্যাকে যখন নিজের শিশু-মেয়ের বিমাতা পরিচয় দিয়ে ঘরে তুলে নিলে এবং পাড়ার
মেয়েরা প্রথমটা ছি, ছি করেও অবশেষে একদিন সয়ে গেল, তখন মনে ভাবনা এলো এই
যে, স্ত্রী-হত্যা প্রভৃতি ধর্মবিরুদ্ধ অপরাধ ভদ্দরলোকের পক্ষে মার্জনীয়
বটে, তবু বেশ্যাবিবাহের মতো সমাজবিরুদ্ধ অপরাধ তো তেমন চুপচাপে সমাজে পার
হয় না। তখন মনে হোলো যে, নায়কের যে পরিচয় এটা সম্ভব মনে হতে পারত, গল্পের
গোড়া থেকেই সেই বিশেষ পরিচয়টা সাজিয়ে রাখা উচিত ছিল। সেটা না হওয়াতে
মানুষটার প্রতি নেহাৎ অবিচার করা হয়েছে। হয়তো অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে লোকটা
সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য – তবু, আমরা যে ওকে কিছুমাত্র সন্দেহ করতে পারলুম,
বিশ্বম্ভরের দোহাই মেনে সেই তার প্রতি সন্দেহের সম্ভাবনাটুকু চুকিয়ে রাখা
উচিত ছিল।
তারপরে ভাবে, ভঙ্গিতে বোধ হচ্ছে, এককালে উত্তমের সমাজ বিশ্বম্ভরের
সমাজের চেয়ে শিক্ষায়, আচরণে উপরের স্তরের ছিল। সেটাও লেখকের জবানবন্দী উপর
বিশ্বাস করে ধরে নিতে হয়। উত্তমের এই দিককার ছবিটা একেবারে বাদ দিয়েই সুরু
করা হয়েছে। উত্তম যদি সাধারণ বেশ্যার মতোই হত, তা হলে পাঠকের কল্পনার উপরে
বরাৎ দিয়ে ইতিহাস অসম্পূর্ণ রাখলে কোনো অসুবিধা ঘটত না। কোনো এককালে তার
পতন হয়েছে বলেই যে, সে মেয়ে একেবারে নষ্ট হবে, এমন কথা নেই, কিন্তু সেটা
প্রমাণের দায় লেখকের পরে। অর্থাৎ, পতনের ইতিহাসটাকে একেবারে চাপা দিয়ে
রাখলে মনে হয় যে, পতিতা নারীর মধ্যেও সতীত্বের উপাদান অক্ষুন্ন থাকতে পারে
এই তত্ত্বটাকে একটা চমক-লাগানো অলঙ্কারের মতোই ব্যবহার করা হয়েছে। সাধুতাকে
ভাবরসের বর্ণ-বাহুল্যে অতিমাত্রায় রাঙিয়ে তোলায় যত বড়ো অবাস্তবতা, লোকে
যেটাকে অসাধু বলে, তাকে সেন্টিমেন্টের রসপ্রলেপে অত্যন্ত নিষ্কলঙ্ক,
উজ্জ্বল করে তুললে অবাস্তবতা তার চেয়ে বেশি বই কম হয় না। অথচ শেষোক্তটাকে
রিয়ালিজমের নাম দিয়ে একালের সৌখীন আধুনিকতাকে খুসি করা অত্যন্ত সহজ। যেটা
সহজ, সেই তো আর্টের বিপত্তি ঘটায়।
দেশাভিমানকে রচনায় প্রশয় দিয়ে কালবিশেষে মোহ উৎপাদন করা সহজ, এইজন্যই
দেশাভিমানী কাব্যে, গল্পে আর্ট জিনিষটা প্রায়ই বেকার হয়ে থাকে। দুঃখে,
অপমানে উত্তমের প্রায়শ্চিত্তই এই আখ্যানের প্রধান বস্তু, এইজন্যেই উত্তমের
চরিত্রকে সুপষ্ট সপ্রমাণ করা আবশ্যক ছিল। বেশ্যাবৃত্তিতে যে-মেয়ে অভ্যস্থ,
সে-ও একটা যে-কোনো ঘরে ঢুকেই সদ্য গৃহিণীর জায়গা নিতে পারে, এই কথাটাকে
স্বীকার করিয়ে নেবার ভার লেখক নিয়েছেন, কিন্তু ধরেই নিয়েছেন, আমরা নিজেরাই
এগিয়ে গিয়ে স্বীকার করব। তারো কারণ, আধুনিক রিয়ালিজমের সেন্টিমেন্টালিটিতে
এই কথাটির বাজার দাম বাঁধা হয়ে গেছে।
এই গল্পে দুইজন পুরুষ নায়ক, বিশ্বম্ভর ও পরিতোষ। একজন স্বভাবসিদ্ধ ইতর,
আর একজন কোমর-বাঁধা সয়তান। বিশ্বম্ভরের ছবিটা ইরতার নোংরা রঙে বেশ
মূর্তিমান। মানুষটি অকৃত্রিম ছোটলোক, সম্পূর্ণ অসঙ্কুচিত। ইতর পদার্থটা
সংসারে সুলভ, তার নানা পরিচয় নানাবেশে চারিদিকেই দেথা যায়, কিন্তু খাঁটি
সয়তানী এত সামান্য নয়, খাঁটি সয়তানী এত সামান্য নয়, খাঁটি সাধুতার মতোই সে
দুস্পাপ্য। সয়তানীর পাঁচফোড়নে সাঁৎলিয়ে তৈরি মানুষ হাজার হাজার আছে, কিন্তু
হাড়ে, মাসে ষোল আনা সয়তানী যাদের ক্ষণ-জন্মা বললেই হয়, ভাগ্যক্রমে পথেঘাটে
তাদের দর্শন মেলে না। অতএব তাদের বিশ্বাসযোগ্য ছবি বিশেষ যত্ন করে না
আঁকলে বাস্তবতার তৃপ্তি পাওয়া যায় না। বিশ্বম্ভরেরে পালার পটপরিবর্তনের
পরেই এল পরিতোষ, যে-উত্তম অন্তরে সাধ্বী, বাহিরে অসতী, যেন তাকেই শাস্তি
দেবার জন্য ধর্মরাজ ঐ জীবটিকে টাটকা বানিয়ে পাঠিয়েছেন, শাস্তির প্যাঁচকলে
একটা পাকের পরে আরো একটা পাক দেবার অভিপ্রায়ে। কিন্তু, নিঃসন্দিগ্ধ দলিল
চাই। এ কথা কেউ যেন মনে না করে যে, রবিবাসরিক খৃষ্টান স্কুলের হেডমাষ্টার
লোকশিক্ষার জন্যে ওকে জুজু সাজিয়ে পাঠিয়েছেন।
যাই হোক, এ কথা মানতে হবে, রচনা-নৈপুণ্য লেখকের আছে। আধুনিক আসরে
রিয়ালিজমের পালা সস্তায় জমাবার প্রলোভন যদি তাঁকে পেয়ে বসে, তবে তাঁর ক্ষতি
হবে। সাহিত্যের শ্রীক্ষেত্রে বাস্তব-প্রবণতা বা ভাবপ্রবণতা নিয়ে জাতিভেদের
মামলা তোলা প্রায় আধুনিক কম্যুনলিজমের মতোই দাঁড়িয়েছে। অথচ, সাহিত্যে ওর
মধ্যে কোনটারই জাতিগত বিশেষ মর্যাদা নেই। সাহিত্যে সম্মানের অধিকার
বহিনির্দিষ্ট শ্রেণী নিয়ে নয়, অন্তনির্হিত চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ, পৈতে নিয়ে
নয়, গুণ নিয়ে। আধুনিক একদল লেখক পণ করেছেন তাঁরা পুরাতনের অনুবৃত্তি করবেন
না। কোনোকালেই অনুবৃত্তি করাটা ভালো নয়, এ কথা মানতেই হবে। নরসংহিতাসম্মত
ফোঁটা-তিলকটা, আধুনিকতাও গতনুগতিক হয়ে ওঠে। সোটার অনুবৃত্তিও দুর্বলতা।
চন্দনের তিলক যখন চলতি ছিল, তখন অধিকাংশ লেখা চন্দনের তিলকধারী হ’য়ে
সাহিত্যে মান পেতে চাইত। পঙ্কের তিলকই যদি সাহিত্যসমাজে চলতি হয়ে ওঠে, তা
হলে পঙ্কের বাজারও দেখতে দেখতে চড়ে যায়। বঙ্গবিভাগের সময় দেশী চিনির চাহিদা
বেড়ে উঠল। ব্যবসায়ীরা বুঝে নিলে, বিদেশী চিনিকে মাটি মিশিয়ে দেশী করা সহজ।
আগুন জ্বালিয়ে রসে পাক দেওয়া অনাবশ্যক, কেননা, রসিকেরা মাটির রং দেখলেই
অভিভুত হবে। সাহিত্যেও মাটি মেশালেই রিয়ালিজমের রং ধরবে এই সহজ কৌশল বুঝে
নিতে বিলম্ব হয়নি। মানুষের এমন সব প্রবৃত্তি আছে, যার উত্তেজনার জন্য
গুণপনার দরকার পড়ে না। অত্যন্ত সহ বলেই মানুষ সেগুলোকে নানা শিক্ষায়,
অভ্যাসে, লজ্জায়, সঙ্কোচে সরিয়ে রেখে দিতে চায়, নইলে বিনা-চাষেই যে-সব
আগাছা ক্ষেত ছেয়ে ফেলতে পারে, তাদের মতোই এরা মানুষের দুর্মূল্য ফসলকে চেপে
দিয়ে জীবনকে জঙ্গল করে তোলে। এই অভিজ্ঞতা মানুষের বহুযুগের। কিন্তু,
সাহিত্য-বিচারে এ-সম্বন্ধে নৈতিক ক্ষতির কথা তুলতে চাইনে। আমার বলবার কথা
এই যে, যে সকল তাড়িখানায় সাহিত্যকে শস্তা ক’রে তোলে, রিয়ালিজমের দোহাই দিয়ে
তার ব্যবসা-চালানোয় কল্পনার দুর্বলতা ঘটবে। এ-রকম শস্তা মাদকতা সাহিত্যে
মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে, সমাজেও। আজকের য়ুরোপ তার প্রমাণ। সেখানে অন্যযুগেও
ক্ষণে ক্ষণে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদ্যাসুন্দরও ii
সেই জাতের সাহিত্য, এককালে বাংলাদেশে প্রচুর বাহাবা পেয়েছিল। তখনকার
বাবুয়ানাও ছিল ঐ ছাঁদের, নাগরিকতা যাকে বলা হত, তার ইংরেজি প্রতিশব্দ
সিটিজেনশিপ নয়। হুতুম প্যাঁচার নকসায় iii
তখনকার আবহাওয়ার একটা আমেজ পাওয়া যায়। একটা বাঁন-ছেঁড়া মাতামাতি, তার
মধ্যে বৈদগ্ধ ছিল না, কেবলমাত্র ছিল বেআব্রুতা। কিন্তু, তবু সেটা টিকল না।
সেই নব কলিকাতার নবীন যুগের কাদাগোলা জলে সাহিত্যকে হোলিখেলা দেখতে দেখতে
সরে পড়তে পড়তে হলো। তার কারণ, ফ্যাশানের চড়ি-মন্দির উপরেও যে একটা
নিত্যরসের পসরা, বাজারদর যতই বাঁক ফিরিয়ে চলুক, তারই আমদানী হয় বারে বারে
ফিরে ফিরে, বস্তুতঃ সেই হচ্ছে নিত্য আধুনিকের সামগ্রী। আজ এই কথাটাকে
অবজ্ঞা করা সহজ, কিন্তু কালকের দিন আজকের দিনের এক প্রহরের পায়ের তলায়
কাদা-চাপা পড়েনি।
একটা কথা বলা উচিত, প্রসঙ্গক্রমে রিয়ালিজম নিয়ে যে কথাটা উঠে পড়ল, তার
সমস্তটা “লঘু-গুরু” বইটি সম্বন্ধে খাটে না। এই উপাখ্যানের বিষয়টি সামাজিক
কলুষঘটিত বটে, তবুও কলুষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার উৎসাহ এর মধ্যে নেই। পূর্বেই
বলেছি যে, গল্পের চেহারাটি নিঃসন্ধিগ্ধ সত্যের মতো দেখাচ্ছে না, এইটেতেই
আমার আপত্তি।”
শ্রীজগদীশচন্দ্র গুপ্ত
নিবেদন
আমার “লঘু-গুরু” বইখানি সম্বন্ধে জজিয়তি করিতে বসিয়া বিভিন্ন জজগণ যে
রায় দিয়াছেন, তাহার মধ্যে পরিচয়ে প্রকাশিত রায়টিই প্রধান – কারণ, তাহার
ঘোষক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ; এবং দ্বিতীয় কারণ, বিচার্য বিষয় ছাড়িয়া তাহা
বিপদগামী হইয়াছে, অর্থাৎ, আসামীকে ত্যাগ করিয়া তাহা আসামীর নির্দোষ জনককে
আক্রমণ করিয়াছে! কিন্তু আপিল নাই।
রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেনঃ “লঘু-গুরু গল্প সম্বন্ধে যদি জজিয়তি করতেই হয়, তা
হলে গোড়াতেই আমাকে কবুল করতে হবে যে, এই উপন্যাসে যে লোকযাত্রার বর্ণনা
আছে, আমি একেবারেই তার কিছু জানিনে। সেটা যদি আমারই ক্রুটি হয়, তবু আমি
নাচার। বলে রাখছি, এ-দেশে লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে কাটালুম, এই
উপন্যাসের অবলম্বিত সমাজ তার পক্ষে সাত-সমুদ্র-পারের বিদেশ বললেই হয়। দূর
থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও হয়তো বা অনতিপরিচতের সন্ধানে রাস্তা
ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও-জায়গায় উঁকি মেরে এসেছেন।
পুস্তকের শেষ অংশের চেহারাটাকে তার অভদ্র হুলের দরুণ নিঃসন্দিগ্ধ পুস্তক-পরিচয়ের মত দেখাইতেছে না – ইহাতেই আমার আপত্তি।
“অনতিপরিচিত” এবং “ও-জায়গা” শব্দ দু’টী অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক সন্দেহ নাই –
কারণ,… “বিশ্বম্ভর খেয়া পার হবার সময় ‘উত্তম’ নামধারিণী এক বেশ্যাকে দেখে
মুগ্ধ হোলো।” “লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে এতকাল” আমাকে কাটাইতে হইয়াছে
সেখানে “স্বভাবসিদ্ধ ইতর” এবং “কোমর বাঁধা শয়তান” নিশ্চয়ই আছে; এবং
বোলপুরের টাউন-প্ল্যানিং-এর দোষে যাতায়াতের সময় উঁকি মারতে হয় নাই,
“ও-জায়গা” আপনি চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু, তথাপি আমার আপত্তি এই যে, পুস্তকের
পরিচয় দিতে বসিয়া লেখকের জীবন-কথা না তুলিলেই ভাল হইত, কারণ, উহা সমালোচকের
“অবশ্য-দায়িত্বের বাইরে” এবং তাহার “সুস্পষ্ট প্রমাণ” ছিল না।
স্থানাভাবে এই নিবেদনটি ইতিপূর্বে ব্যক্ত করিতে পারি নাই।
বোলপুর। ১৮ই চৈত্র, ১৩৩৯।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন