মোহাম্মদ হাসান ইমাম
সমাজবিজ্ঞানে নারীবিষয়কে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন অর্থাৎ নারীবাদী পরিক্ষেপের অধিষ্ঠান দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। শ্রেণী, গোষ্ঠী, দল, ব্যষ্টি, সমষ্টি প্রভৃতি প্রত্যয়গুলোর সাহায্যে সমাজকাঠামোকে বিশ্লেষিত করার যে আনুপূর্বিক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় সেখানে জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারেই পুরুষদৃষ্টিকোণ চলে এসেছে।
পুরুষ-প্রাধান্যের বিষয়টি অবশ্য একটু খোলাসা করা দরকার। অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী যে শুধু পুরুষ ছিলেন তাই নয়, তাঁদের সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও একটি সাধারণতা লক্ষ্য করা গেছে। এই সাধারণতা হলো শ্রেণী, গোষ্ঠী, ব্যষ্টি, সমষ্টি, সম্প্রদায় সমন্বয়ে গঠিত সমাজের বিশ্লেষণে নারীর অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত না-করা। নারীর অভিজ্ঞতা লাভের জন্য সবসময় নারীর অবস্থান প্রয়োজনীয় হবে এমনটি আপাতদৃষ্টিতে গ্রাহ্যতা পায়নি। কিন্তু আজকের দিনে তা যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়েছে বিবিধ কারণে। এটি পরিষ্কার হয়েছে যে, পুরুষের সুবিধাজনক অবস্থানের বিপরীতে নারীর অপেক্ষাকৃত নিচু অবস্থান থেকে দেখার বিশেষত্বটি পুরুষের পক্ষে আয়ত্ত করা যথেষ্ট কঠিন। পুরুষ সমাজবিজ্ঞানীদের আলোচনা, সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণে নারীর উপলব্ধিকে সার্থকভাবে তো নয়ই, মোটামুটিভাবেও উপস্থাপন করা সম্ভব হয় নি। একারণেই, নারীব্যতীত নারীর অবস্থান ও অবস্থা যথেষ্টভাবে পরিস্ফুটনের ব্যাপারটি অসম্ভব বলে উচ্চারিত হতে দেখা যায়।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে নারী সমাজচিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের লেখায় যে দৃষ্টিউন্মোচনকারী বিষয়সমূহ উঠে আসে তাতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, প্রায় দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে সমাজবিজ্ঞানের যে প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ তার মধ্যে নারী ও নারীভিত্তিক দৃষ্টিকোণ উপেক্ষিত হয়েছে। এমনকি সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক অসমতার যে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ ও তাত্ত্বিক ইমারত নির্মিত হয়েছে সেখানেও নারী-পুরুষ বৈষম্য ও তার বিবিধ ইঙ্গিত যথেষ্ট পরিমাণে আসে নি। তবে এমন কথা কেউ বলতেই পারেন যে, সমাজবিজ্ঞানে যে-তাত্ত্বিক রূপরেখা বা পরিক্ষেপগুলো লক্ষ্য করা যায় সেগুলো এতো বেশি এবং এতটাই প্রভাবশালী যে, ব্যক্তি-সমাজবিজ্ঞানী সেখানে অনেকটাই তাঁর ঐতিহাসিক-সামাজিক-দার্শনিক মাত্রাবলয়ে আবদ্ধ থেকে গেছেন। তাঁরা মার্কসবাদী, উদারপন্থী, রক্ষণশীল, ক্রিয়াবাদী, কাঠামোবাদী, বিবর্তনবাদী প্রভৃতি নানা নামে বিভক্ত হয়ে গেছেন কালগত, স্থানগত ও পরিবেশগত প্রভাবের কারণে। তবে, একথা মনে হয় অনেকটা গ্রহণযোগ্য যে, জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার বিষয় সমাজ-সংস্কৃতি নিরপেক্ষ নয়। আর কাঠামোগতভাবে যে-সমাজে পুরুষপ্রাধান্য রয়েছে সে সমাজের পুরুষ-সমাজবিজ্ঞানীর চিন্তাচেতনা ও সামাজিকীকরণে নারীর ভাবভাবনা অনুপস্থিত থাকাটাই স্বাভাবিক। এমন যুক্তিও দাঁড় করানো হয়ে থাকে যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেও এমন ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় যখন অনেক কাছের বিষয় নিয়েও দীর্ঘদিনের অজ্ঞতা-অজ্ঞানতা বিরাজ করছিল। সুতরাং, নারীর নিপীড়ন ও নারীর অধস্তনতা, নারীর অনুভূতি ও নারীর ক্রিয়াশীলতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার ব্যর্থতাকে একটি সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে দেখা উচিত, পুরুষ রাজনীতি বা লৈঙ্গিক রাজনীতি হিসেবে নয়। কারণ, ইতিহাসে এমন দু’চার জন পুরুষ তো অবশ্যই পাওয়া যায় যাঁরা বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন অথবা নারী সমাজচিন্তাবিদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে সহমত পোষণ করেছেন। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় যখন দেখা যায়, নারী-লেখকের সত্যানুসন্ধানকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে ব্যক্তিগতভাবে, দলগতভাবে। এমন পরিস্থিতি নারীবাদী লেখকের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, বিষয়গত বৈধতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সক্রিয়তার প্রয়োজনীয়তাকে সমাজগ্রাহ্যতা দান করে।
সমাজবিজ্ঞানে তাত্ত্বিক ও শাস্ত্রীয় বিকাশের দিকে তাকালে কিছু দিক উন্মোচিত হতে পারে যা এ বিজ্ঞানের চরিত্র রূপায়ণে সাহায্য করেছে। প্রথমেই ধরা যাক দীপ্তিযুগের বিজ্ঞানবাদের সীমাবদ্ধতার কথা। নিউটনীয় যান্ত্রিক বিশ্ববিশ্লেষণ সামাজিক বিজ্ঞান এবং সমাজ-অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত যে প্রভাব ফেলে তার মূল কথা হয়ে দাঁড়ায় অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের উপর গুরুত্ব আরোপ। ঊনিশ শতকে সমাজবিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষবাদী চিন্তায় এমন ধারণার উপস্থিতি দারুণভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ-থেকে যে পদ্ধতিতাত্ত্বিক প্রমিতকরণের সূচনা হয় তা সমাজকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো একটি বাহ্যিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রপঞ্চ হিসেবে প্রত্যক্ষ করতে উৎসাহিত করে এসেছে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো নিয়ম ও সূত্র আবিষ্কারের নেশা এতোটাই সমাজবিজ্ঞানীদেরকে পেয়ে বসে যে, সামাজিক জীবনের আশু সমস্যাসমূহকে মোকাবিলা করার চেয়ে সামাজিক ঘটনা ও তাদের পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত সূত্র লাভ প্রাধান্য পেতে থাকে। সামাজিক সমস্যার প্রতি দৃষ্টিদানের ব্যর্থতা অনেক সামাজিক দুরাচার ও দুর্নিয়মকে অনাবিষ্কৃত রেখে দেয়। সমাজে নারী-পুরুষের ব্যবধান ও তার সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব আড়ালে থেকে যাওয়ার এটি একটি কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। বলে রাখা ভালো সমাজবিজ্ঞানের শাস্ত্রীয় বিকাশের ইতিহাস সমাজতত্ত্বের ইতিহাসের সমসাময়িক। সেকারণে, প্রত্যয়নিষ্ঠভাবে প্রস্তাবনার আলোকে একটি সুষ্ঠু ব্যাখ্যা প্রদানের প্রচেষ্টাকে সমাজবিজ্ঞানে ন্যূনতম তাত্ত্বিক অভিধা অর্জনের মাপকাঠি মনে করা হয়।
অগুস্ত কোঁতের সময় থেকে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রাকাল ধরে নিলে দেখা যায় এ-ধরনের তাত্ত্বিকতাও সমাজজীবনের সরলপাঠকে ব্যাহত করেছে। একটা সাধারণ সত্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঊনিশ শতকের সমাজবিজ্ঞানীরা তাঁদের নানাবিধ তত্ত্বে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিলেও সাহিত্যে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের দেশের তৎকালীন বাংলা উপন্যাসেও যথেষ্টরূপে তা এসেছে। সাহিত্য যা এতো সহজেই করতে পারলো সমাজবিজ্ঞান তা না পারার একটি বড় কারণ হচ্ছে বিজ্ঞান হিসাবে তার প্রতিষ্ঠা লাভের ঐকান্তিকতা। এরকম আরেকটি ভুল পরিবেশের গুরুত্বের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের সমাজ-অধ্যয়নে সমাজ গুরুত্ব পেলেও সমাজের ভৌত ও জৈব পরিবেশ এবং সমাজ ও পরিবেশের আন্তঃক্রিয়া গুরুত্ব পায় নি দীর্ঘদিন। বিশ শতকের ষাট দশক তাই শুধু নারীবাদী সমাজতত্ত্ব নয়, পরিবেশবাদী সমাজতত্ত্বেরও উন্মেষকাল।
একটি বিষয় চমকপ্রদ মনে হতে পারে যদি দেখা যায় সমাজবিজ্ঞানের উন্মেষকালে মহিলা সমাজবিজ্ঞানীরা কোন কোন বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছেন। বৃটিশ সমাজবিজ্ঞানী হ্যারিয়েট মার্টিন্যু (১৮০২-৭৬) এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য বিবেচিত হয়েছেন শুধুমাত্র মহিলা হিসেবে নয়, সমাজবিজ্ঞানের একজন স্থপতি হিসেবেও। আর ধ্রুপদী সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাঁরা হলেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী শার্লট পারকিন্স গিলম্যান (১৮৬০-১৯৩৫), জেন আডামস্ (১৮৬০-১৯৩৫), অ্যানা জুলিয়া কুপার (১৮৫৯-১৯৬৪), ইভা ওয়েলস্ বারনেট (১৮৬২-১৯৩১), জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাঙ ভেবরের স্ত্রী ম্যারিয়েন স্কনিৎগার ভেবর (১৮৭০-১৯৫৪) ও ইংল্যান্ডের সমাজতন্ত্রী সমাজবিজ্ঞানী বিয়েট্রিস্ পোটার ওয়েব (১৮৫৮-১৯৬৪)।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা শুধুমাত্র মার্টিন্যু সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো। তবে এঁদের মধ্যে যে সাধারণ চিন্তা ও উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেছে তার উল্লেখ প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানী জর্জ রিৎজার এ প্রসঙ্গে বলেন যে, এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে লিঙ্গ সচেতনতা ও সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁদের লিঙ্গ-পরিচিতিগত অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। তাঁদের বিশ্লেষণে রয়েছে অবস্থানগত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সজ্ঞানতা এবং অন্যদের সুবিধাজনক অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা; সামাজিক অসমতার অনুশীলন সম্পর্কে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সংস্কারের সংকল্প এবং শেষত সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমাজবিজ্ঞানচর্চার সংকল্প। এখানে পরিষ্কারভাবে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় বলে মনে করা হয়েছে।
হ্যারিয়েট মার্টিন্যুকে সমাজবিজ্ঞানের জননী বলা হয়েছে। তিনি সমাজ-অধ্যয়নের জন্য ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বিষয়ক বিজ্ঞানের কথা বলেছেন, যা সামাজিক কর্তব্যবোধ ও সামাজিক সুখের সূত্র সন্ধান করবে এবং একটি নৈতিক বিজ্ঞান হিসেবে আমাদের নৈতিক দর্শনের সংস্কারে উদ্যোগী হবে। মার্টিন্যুর মতে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হবে সমাজে মানুষের সামাজিক জীবন এবং তার ধরন, কারণ, ফলাফল ও সমস্যাবলী। সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নির্ধারণে তাঁর বক্তব্য কোঁতে ও স্পেনসারের বক্তব্যের সাথে তুলনীয় হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে নারীর অবস্থানকে চিহ্নিত করে দেয়। তিনি নারী ও অন্যান্য নির্যাতিত গোষ্ঠীর সামাজিক সুবিচার প্রাপ্তির জন্য নারীবাদী নীতির কথা বলেন। সমাজে নারী ও পুরুষের বর্তমান অবস্থানের প্রেক্ষাপটে একক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতার প্রকৃতি ও ব্যবহার জানা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। শ্রেণী, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি সুবিচারের উপর গুরুত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি অসম অধিকারের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক বলে বিবেচনা করেছেন। সমাজকে এগুতে হলে সুবিচারের নীতি গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। কোঁতে ও স্পেন্সারের দার্শনিক কৃৎকৌশলিক বক্তব্যের বিপরীতে মার্টিন্যুর বক্তব্য অনেক বেশি বাস্তব, সহজবোধ্য, সমস্যাশ্রয়ী সূক্ষ্মদর্শী ও সংস্কারধর্মী। তাঁর বক্তব্যে সমাজব্যবস্থার সাধারণীকৃত ‘আদর্শরূপ’ বা সমাজের কল্পিত প্রকারভেদ বা সমাজবিকাশের স্তরসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তিনি অর্থনীতি, সরকার, শিক্ষা, আইন, বিয়ে, ধর্ম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যেমন জানার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে মানুষের আন্তরিকতাবোধ, আতিথ্য, ভ্রমণ, বিনোদন, প্রকৃতি ও অর্থের প্রতি মনোভাব, যৌনভিত্তিক সম্পর্ক, শিশুদের সদাচরণ প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত তরল বিষয় সম্পর্কে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর রচনার প্রধান বিষয় আচার-আচরণ ও নৈতিকতাবোধ। এসব দিকের মধ্যে দিয়ে সমাজসমূহকে গভীরভাবে এবং গুণগতভাবে জানবার ও তুলনা করবার সুযোগ পাওয়া যায় বলে তাঁর ধারণা।
একজন মহিলা সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর কাছ থেকে যে লৈঙ্গিক-সচেতনতার লক্ষণ পাওয়া যায় তা সমাজে নারীর অবস্থান, শ্রেণী ও লিঙ্গের দ্বৈত প্রভাব ও লেখকসত্তা কিভাবে লিঙ্গীয় মূল্যায়নের শিকার তা সুন্দরভাবে তুলে ধরে। তাঁর লৈঙ্গিক সচেতনতার এমন বহুমাত্রিকতা আজকের দিনের নারীবাদের মূল অভিধার সাথে মিলে যায়। যখন কোন পুরুষ সমাজবিজ্ঞানীর মধ্যে এমন বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত দেখা যায় তখন ভাবতেই হয় নারীর অবস্থান উপলব্ধির ও প্রকাশের জন্য নারী লেখক কেন অপরিহার্য। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, একজন শ্বেতকায় স্ত্রী শুধুমাত্র তাঁর স্বামীর দ্বারা শাসিত অথবা আঘাতপ্রাপ্ত হলেও একজন দাসের স্ত্রীকে অবশ্যই তাঁর স্বামীর পূর্বে স্বীয় প্রভুকে মেনে চলতে হয় এবং তাঁর স্বামী কোনভাবেই তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারে না। অর্থাৎ নারীর ক্ষেত্রে বর্ণ ও শ্রেণীগত অবস্থান লিঙ্গগত অবস্থানের শোচনীয় অবনতি ঘটাতে পারে। যখন একজন মানুষ নারী, কৃষ্ণকায় ও নিচু শ্রেণীর হয়ে পড়ে তখন তাঁর অবস্থান সহজ-সাধারণ এমনটা ভাবার কারণ নেই, বরং বিশেষ অবস্থাগত প্রেক্ষাপটে তা মূল্যায়নেরও দাবী রাখে।
মার্টিন্যু মার্কিন সমাজ সম্পর্কে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন তাতে সেদেশের নারীর অবস্থা বিশেষভাবে অংকিত হয়েছে। তিনি বিয়ে ও সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কযুক্ত করে মার্কিন সমাজের গতিপ্রকৃতি দেখতে চেয়েছেন। সে দেশের কৃষ্ণকায় জনগোষ্ঠীর শোচনীয় অবস্থা তাঁকে বর্ণ ও লৈঙ্গিক সম্পর্ক নির্ধারণে উৎসাহিত করেছে। আরবীয় হারেমের অমানবিকতা থেকে শুরু করে বৃটেনের পতিতাবৃত্তির অশ্লীলতা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। মহিলা মজুরি শ্রমিকদের অবস্থা গবেষণা করে তিনি শ্রেণী ও লৈঙ্গিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি একে ‘দ্বৈত নির্যাতন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। লিঙ্গায়িত জীবনের অভিজ্ঞতা ও নারীকেন্দ্রিক উপলব্ধিক্ষমতা তাঁর এমন বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণকে ধারালো করেছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি নিজের প্রতি ও নিজের রচনার প্রতি অন্যের মনোভাবটিকেও লিঙ্গীয় রূপরেখায় দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই শেষ না করে তিনি তাঁর সার্বিক নারীকেন্দ্রিক সচেতনতাকে নারী কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। নারীশিক্ষার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন যে, পুরুষের তুলনায় নারীকে অপেক্ষাকৃত নিচুমানের শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যে পূর্বানুমানটি শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে কাজ করে তা হলো নারীর নিচুমানের স্বভাবপ্রকৃতি এবং সক্ষমতা। মার্টিন্যু তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে নারী পুরুষ বিভেদের অর্থহীন অর্গলটি ভাঙ্গতে চাইলেও পুরুষপ্রাধান্যের জোরে সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাস তাঁর অবদানকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
সমাজবিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে তাই অগুস্ত কোঁতে যতটা পরিচিত, হারিয়েট মার্টিন্যু ঠিক ততটাই অপরিচিত। এখানে মার্টিন্যুয়ের অবদানকে সার্বিকভাবে মূল্যায়নের অবকাশ নেই এবং সেটি আমাদের উদ্দেশ্যও নয়। আমাদের উদ্দেশ্য এ সত্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে, একজন সমাজবিজ্ঞানী নারী হবার কারণে তাঁর কাছ থেকে নারীকেন্দ্রিক লিঙ্গীয় অসাম্যের যে সমাজচিত্র পাওয়া যায়, অনেক পুরুষ সমাজবিজ্ঞানীর কাছ থেকে তা পাওয়া যায় না। আরেকটি প্রশ্ন হলো একটি ‘অগ্রসরমান’ সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান কিভাবে মার্টিন্যুয়ের এই ‘বিস্মৃতিকে’ মূল্যায়ন করবে?
সমাজবিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সার্থকভাবে ক্রমযোজিত জ্ঞানের ভাণ্ডার সৃষ্টিকারী বিজ্ঞান হতে পারেনি বলে কেউ কেউ মনে করেন। এর মূল কারণ শত মত ও শত পথ। বহুবিধ প্যারাডাইম-পার্সপেক্টিভ-তাত্ত্বিক অভিমুখীনতা সমাজবিজ্ঞানকে অনেক দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছে, দিয়েছে বিচিত্র রূপরেখা। দীপ্তিযুগ-উত্তর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজবিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অনেক সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছে। এধরনের উদ্যোগ ‘অমানবিক’ তথাকথিত ‘বস্তুনিষ্ঠ’ ও অপ্রয়োজনীয় ‘ইতিবাচক’ শাস্ত্রনির্মাণের প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত হয়েছে। ক্রিটিক্যাল স্কুল সমাজবিজ্ঞানের এই বৈজ্ঞানিকতাকে সমালোচনা করে বলেছে, এমন কাজের উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে উপায় হিসেবে নয় বরং লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা। এদের মতে সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিশেষত অভিজনদের অপরিবর্তন চেয়েছে, আপন কাঠামোকে অতিক্রম করতে চায় নি এবং নির্যাতিতের প্রতি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যক্তি-সমাজ আন্তঃক্রিয়ার অপর্যাপ্ত উদ্ভাবন, লিঙ্গ-সম্পর্কের অনুল্লেখ ও শ্রেণীসম্পর্কের সতর্ক বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানের শতাব্দীপ্রাচীন পাপ হিসেবে গণ্য হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের মাইক্রো ও ম্যাক্রো পর্যায়ের তত্ত্বায়ন ও বিশ্লেষণ দারুণভাবে মানবক্রিয়ার সমরূপচিন্তার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেছে। এমন ধারণা কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যাবলীর সর্বজনীন ধারণা সরবরাহ করেছে। এটি সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এতোসব জাঁকজমকপূর্ণ সমাজবিজ্ঞানের পরিক্ষেপ নিদারুণভাবে আন্তঃক্রিয়া, স্বার্থ, প্রত্যক্ষণ ও প্রজ্ঞাবিকাশের লৈঙ্গিক ব্যবধানকে অবজ্ঞা করেছে। পরিণতিতে আরেক ধরনের ‘ভুল সচেতনতার’ সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় লাগবে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্মিথ একে সচেতনতার ক্ষতি বা ভ্রান্তিরেখা বলতে চেয়েছেন। বার্নাড মনে করেন ‘সেঙিজম’ হলো আসল অদৃশ্য প্যারাডাইম যা সমাজবিজ্ঞানের বহু প্যারাডাইমভিত্তিক সাইন্টিজমকে গ্রাস করেছিল। লিঙ্গ-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যগত দ্বান্দ্বিকতাকে অবহেলার মধ্য দিয়ে তাই সমাজবিজ্ঞান একটি স্বঘোষিত মূল্য-নিরপেক্ষ, অ্যান্ড্রোকেন্দ্রিক, অন্ধলৈঙ্গিক ও পুরুষ-প্রভাবিত শাস্ত্রশরীরে পরিণত হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞান নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বকে ক্ষমতা, আধিপত্য, শ্রেণীশোষণ, এলিটতত্ত্বের মতো সাফল্যজনকভাবে বিবেচনায় আনতে পারে নি-যা নারীবাদ পেরেছে। এছাড়া, সামাজিক-রাজনৈতিক ও উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে নারীবাদের উত্থানের পেছনে বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। পশ্চিমা ‘উন্নয়ন’ প্রচেষ্টায় নারীর অংশগ্রহণ ও অবস্থান নিয়ে অনেক ভাবান্তর ঘটেছে। ষাট দশকের প্রবৃদ্ধিবাদী উন্নয়ন চিন্তা, নারীর পুনরুৎপাদনী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও কল্যাণমুখী নারী-উন্নয়নের মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয় করা হয়েছে, কারণ এগুলোর কোনটিই কার্যকর সামাজিক অগ্রসরতা প্রদান করতে পারেনি। সত্তর দশকের নারীউন্নয়নকে বলা হয়েছে ‘সমতামুখী’ অধিগম যার সমান্তরাল হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মৌলিক চাহিদার পরিপূরণ। মূলত এসময়েই, ‘উন্নয়নে নারী’ ধারণাটি দ্বিতীয় স্তরে উন্নীত হয় এবং নারীবাদের সংগঠিত হবার সময় নির্দেশ করে। এরপর, যথাক্রমে নারী ও উন্নয়ন; লিঙ্গ ও উন্নয়ন; নারী, পরিবেশ ও উন্নয়ন, প্রভৃতি স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে নারী-উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ও নারীবাদের বিভিন্ন বিকাশ ঘটেছে। মোটকথা, নারীবাদের বিকাশ সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান নির্ণয়ের কৌশলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। ‘উন্নয়নে নারী’ যেখানে উদারপন্থী নারীবাদপুষ্ট ছিল সেখানে মার্কসবাদী নারীবাদ ‘উন্নয়ন ও নারী’ কৌশলকে পরিপুষ্ট করেছে। এরপরে ‘লিঙ্গ ও উন্নয়ন’ পর্যায়ে আশির দশকে বিচিত্র নারীবাদের সমাবেশ ঘটে এবং সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ প্রাধান্য পায়। নারীবাদ ক্রমাগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতার সাথে নারীর সম্পৃক্তকরণের কৌশলগত অবস্থানের নিরিখে বিবর্তিত একটি প্রচেষ্টাতে পরিণত হয়। এটি নিছক বিদ্যায়তনিক বা প্রত্যয়গত অনুশীলনের বিষয় থাকেনি। সমাজবিজ্ঞান যত বেশি ‘উন্নয়ন’ বিষয়ক অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত হয়েছে, নারীবাদী দৃষ্টিকোণের প্রয়োজনীয়তা তত বেশি প্রবলতা পেয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত পরিক্ষেপসমূহ সেকারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা একটি একক বিশ্বজনীন সামাজিক তত্ত্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তত্ত্বে গ্রহণযোগ্যতা দানের জন্য ভিন্নভিন্নভাবে অবস্থিত মানুষের অভিব্যক্তির অনুপুঙ্ক্ষ পর্যবেক্ষণনির্ভর হবার পরামর্শ দিয়েছেন। ধ্রুপদী সমাজবিজ্ঞান, সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব ও পরিক্ষেপসমূহের ইউরোপকেন্দ্রিকতা, পুরুষকেন্দ্রিকতা ও প্রথাগত বিশ্লেষণপ্রবণতা নারীর পুুরুষনির্মিত ভূমিকাকে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। নারী, পরিবার ও যৌনতা তাই কোনো সমস্যামূলক গতিময় অভিধা লাভ করতে পারেনি। তবে ষাট দশক থেকে শুরু করে পরবর্তীতে নারীবাদী সমাজতত্ত্ব বা লৈঙ্গিক সমাজতত্ত্ব ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। আজকের সমাজবিজ্ঞানে তাই নারীর অধস্তনতা, পুরুষপ্রাধান্য, নারীর ক্ষমতায়ন, সমতাভিত্তিক সমাজ কায়েমের কর্মপরিকল্পনার মতো বিভিন্ন বিষয়গুলোকে সামনে রেখে দৃষ্টিকোণ ও প্রত্যয়সমূহের ব্যাপক সম্মিলন ঘটেছে। প্যাট্রিয়ার্কি, পুঁজিবাদী প্যাট্রিয়ার্কি, শ্রেণী ও লিঙ্গজনিত নির্যাতন, যৌনতা, আধিপত্য, প্রভৃতি প্রত্যয় নারীবাদী তত্ত্বায়নের সহায়ক হয়েছে। লৈঙ্গিক বিস্তৃত বিষয়কে অনুধাবনের জন্য ভূমিকা, ভাবমূর্তি ও অর্থের সামাজিক নির্মাণ বিশেষভাবে সহায়ক হতে পেরেছে। নারীবাদ যেসব উপপ্রপঞ্চের উদ্ভাবন করেছে-যেমন, বর্ণ-পরিচয়, এথনিক-পরিচয়, জরাতত্ত্ব, যৌন অভিমুখীনতা, অবস্থানের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, নারী কর্তৃক নারীনির্যাতন-সেগুলো নিবিড়ভাবে সমাজ অবলোকনের সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নারীবাদের
আন্তঃসম্পর্ক, পরস্পর-গ্রাহ্যতা ও পরস্পর-ভিন্নতা সমাজবিজ্ঞানের জন্য আরো সমস্যা-অনুসন্ধানী হবার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পরিশেষে বলা যায়, নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ মাইক্রো-ম্যাক্রো তাত্ত্বিক বিভাজনের সমাপ্তি টানার ক্ষেত্রে সাফল্য দাবি করতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
এমন দাবি করা হচ্ছে যে, ম্যাক্রো পর্যায়ের পুরুষ মডেলকে মাইক্রো পর্যায়ে ব্যবহার করে মেয়েদের ‘অসাধারণ’ ক্রিয়া, নিষ্ক্রিয়তা, ভূমিকা-অবলম্বন, সাড়াপ্রদানের ধরনপ্রকৃতির আবিষ্কার মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ম্যাক্রো জগৎ সৃষ্টি ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নারীর আলাদা কোনো ভাব, ভাবনা, মনোভাবের ও সক্রিয়তাকে গ্রাহ্য করা হয়নি। পাবলিক স্পেস ও পুরুষভাবনা সম্মিলিতভাবে এমন এক পুরুষপ্রভাবিত বিশ্লেষণী ফ্রেম প্রদান করে, যা দিয়েই মাইক্রো-পরিসরের জগতকে বিশ্লেষণ করতে দেখা গেছে। নারীবাদ পুরুষপ্রভাবিত ফ্রেমের অসমর্থতা ও মাইক্রো-পরিসরে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থানগত গুরুত্বকে অস্বীকার করার বিষয়টিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলে।
সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের সাথে নারীবাদের সম্পর্ক নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, লৈঙ্গিক-রাজনীতির কারণে প্রথম থেকেই এ শাস্ত্রটিকে মহিলা সমাজবিজ্ঞানীরা কোণঠাসা করে ফেলেন। সেকারণেই ধ্রুপদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে মহিলাদের নাম অনেকদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। অগুস্ত কোঁতের ‘পিতৃত্বকে’ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন মায়েদের অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। পরবর্তীতে কতিপয় মহিলা ও পুরুষ নারীবাদী তাত্ত্বিকের প্রান্তিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আর শেষাবধি এ শাস্ত্রের জাঁদরেল তাত্ত্বিকেরা নারীবাদের প্রশ্নে রক্ষণশীল আচরণ অব্যাহত রেখেছেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দীর্ঘদিন মহিলা সমাজবিজ্ঞানীদের লেখা প্রকাশিত হয় নি অথবা হলেও শাস্ত্রীয় সমর্থন পায়নি। সামাজিক ভাষ্যকার, প্রতিবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, সামাজিক সংস্কারবাদী ও প্রতিষ্ঠিত পুরুষ সমাজবিজ্ঞানীদের সহযোগী হিসেবে অবশ্য মহিলা সমাজবিজ্ঞানীদের উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। ম্যারিয়েন ভেবর এগারোটি গ্রন্থ লিখলেও সেগুলো ইংরেজীতে অনূদিত হয়নি এবং ম্যাঙ ভেবরের স্ত্রী হিসেবেও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন নি। কারণ হিসেবে পুরুষ-অধ্যুষিত সমাজবিজ্ঞানের লৈঙ্গিক রাজনীতিকেই দায়ী করা হয়েছে।
নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ মূলত সমকালীন নারীবাদী তত্ত্ব ও প্রত্যয় সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই তা লিঙ্গ-পার্থক্য (নারীর অবস্থান ও অভিজ্ঞতার পার্থক্য), লৈঙ্গিক-অসমতা (নারীর কম সুবিধাজনক ও পুরুষের তুলনায় অসম অবস্থা), লিঙ্গ-নির্যাতন (নারীরা পুরুষ কর্তৃক নির্যাতিত ও তাদের অধস্তন), এবং শেষত অবস্থানভেদে এই পার্থক্য, অসমতা ও নির্যাতনের পার্থক্য সংক্রান্ত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করে থাকে। যাহোক, নারীবাদী সমাজতত্ত্বের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ক. আলাদা ধরনের জ্ঞানের সমাজতত্ত্ব; খ. ম্যাক্রো পর্যায়ে সমাজ-সংগঠনের বিশেষ মডেল; গ. নারীর আপেক্ষিক অবস্থার অুনসন্ধান যা মাইক্রো পর্যায়ের আন্তঃক্রিয়ার উদ্ভাসিত ধারণার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ; ঘ. সাবজেকটিভ সমাজতাত্ত্বিক ধারণার সংশোধন।
নারীবাদী জ্ঞানের সমাজতত্ত্ব মনে করে না যে, সব মানুষ একইভাবে জ্ঞান লাভ করবে। একজন ব্যক্তির সমাজকাঠামোগত অবস্থান তার জ্ঞান আবিষ্কারকে প্রভাবিত করে। জ্ঞানকে সম্পূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ না ভেবে আংশিক ও স্বার্থমূলক ভাবাটাই সঠিক হবে। সামাজিক অবস্থান ও দ্রষ্টার পার্থক্যের কারণে জ্ঞানের পার্থক্য ঘটে থাকে। এছাড়া, মানুষের ক্ষমতা সম্পর্ক অর্থাৎ ব্যক্তির ক্ষমতা কাঠামোগত অবস্থানও তার জ্ঞানকে প্রভাবিত করে। অনুরূপভাবে ম্যাক্রো সমাজ বাস্তবতায় নারীবাদী সমাজতত্ত্ব মনে করে ব্যক্তির বাস্তবতা সম্পর্কীয় প্রত্যক্ষণ সমাজকাঠামো ও মতাদর্শের প্রভাব বহন করে। লৈঙ্গিক অসমতার ধরন এই ম্যাক্রো কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত বলে মনে করা হয়েছে। সমাজে প্রচলিত অধিপতি-অধস্তন সম্পর্ক টিকে থাকার পেছনে মতাদর্শ প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। আর স্বাভাবিকভাবেই পিতৃতন্ত্র, পুরুষপ্রাধান্য ও পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে কাঠামোগতভাবে নির্মিত ও নিয়মায়িত হয়ে থাকে।
নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি মাইক্রো সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে আন্তঃক্রিয়ার প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে না যে, ব্যষ্টি বা সমষ্টি পর্যায়ে কেউ সব সময় উদ্দেশ্যমুখী আচরণ করবে বা করতে পারবে। ম্যাক্রো-বাস্তবতায় পেশকৃত ও প্রচলিত সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-মতাদর্শ মাইক্রো বাস্তবতাকে প্রভাবিত করবে এবং সবাই বিশেষ উদ্দেশ্য অবলম্বনের মতো নিয়মিত আচরণ করে যাবে-এমনটি ভাবা যায় না। কারণ, ব্যক্তি বা সমষ্টিসমূহ সর্বত্র একই রকম বাস্তবতা ও মানসিক অবস্থায় থাকে না। বিশেষত, নারীর জীবন, বিবাহ, স্বামীর আচরণ, সন্তানের আচরণ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, বৈধব্য জীবন ও মজুরিভিত্তিক পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা তাদেরকে দারুণভাবে বৈচিত্র্যময় এবং পরিবর্তনশীল জীবনবোধের মুখোমুখী করে দেয়। সুতরাং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্রিয়া সম্পাদনের রূপটি উদ্দেশ্যমুখী না হয়ে সাড়াপ্রদানমূলক হয়ে থাকে। আরেকটি বিষয় হলো, পুরুষরা যেভাবে দৈনন্দিন জীবনে তাদের ক্ষুদ্র-পরিসর আন্তঃক্রিয়ার জগতে প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত থাকে এবং মুখোমুখী দেখা সাক্ষাৎ ঘটে, নারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সেরূপ নয়। দেখা যায় নারীরা দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন ও একাকী থাকে অথবা গৃহাভ্যন্তরে কাজ করে, ফলে মুখোমুখী ও সমভাবনা বা সমঅভিজ্ঞতা-সম্পন্ন অন্য নারীদের সাথে তাদের তেমন আন্তঃক্রিয়ার সুযোগ ঘটে না। এদের আন্তঃক্রিয়ার একটি বিরাট অংশ কল্পনা, ভাবনা ও সাড়াপ্রদানের মতো বৈশিষ্ট্যসম্বলিত। তাই, তারা ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো অবিচল, নৈমিত্তিক ও মুখোমুখী নয়, বরং বিরতিমূলক, আংশিক ও অনিয়মিত। ম্যাক্রো-বাস্তবতার প্রচলিত ধারণা এমনটা ভাবতে উৎসাহিত করে যে, আন্তঃক্রিয়াশীল ভুবনে মানুষ ক্রমাগত প্রদত্ত বিধানসমূহ গ্রহণ করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ আচরণ করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে একই সমতলে ও বৈষম্যহীন ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু, নারীবাদী সমাজতত্ত্ব মনে করে ম্যাক্রো-বাস্তবতা দারুণভাবে মাইক্রো পর্যায়ের আন্তঃক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। নারী তাদের সমাজকাঠামোগতভাবে নির্ধারিত অধন্তন অবস্থায় পুরুষের সাথে সমতাভিত্তিক আচরণ করবার ও পারবার সুযোগ পায় না। তাদেরকে সতত আধিপত্যশীল, ক্ষমতাবান, ও উপার্জনকারী পুরুষদের সাথে আন্তঃক্রিয়ায় লিপ্ত হতে হয়, যা কোনভাবেই আন্তঃ-ব্যক্তিক সমতার ধারণা তৈরী করে না। লিঙ্গ-বৈষম্য নারীর দৈনন্দিন জীবনের একটি চরম অভিজ্ঞতা যা সামাজিক সমতার কষ্টসাধ্য কল্পনাকে তিরোহিত করে দেয়। তাছাড়া, লিঙ্গ-বৈষম্য প্রাত্যহিক জীবনের নানারকম কথোপকথন, সম্বোধন, শিষ্টাচার, আসনগ্রহণের মতো বিস্তৃত বিষয়গুলোকেও প্রভাবিত করে থাকে।
প্রচলিত আরেকটি ধারণা হলো আন্তঃক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যৌথ অর্থ (সবধহরহম) নির্মাণ করে চলে। যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে এই অর্থ সাধারণ্যে পরিব্যাপ্ত হয়। কিন্তু নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এমন সাধারণ অর্থনির্মাণের বিষয়টি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, কারণ নারীর প্রাত্যহিক ক্রিয়া ও সম্পর্ক ঘটে প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত অনুধাবনের প্রেক্ষাপটে। এটি ম্যাক্রো-বাস্তবতানিঃসৃত ও নিয়ন্ত্রিত। নারী-পুরুষ আন্তঃক্রিয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর কর্মকাণ্ডের যে অর্থ করে তা পুরুষের মতাদর্শপুষ্ট ম্যাক্রো-বাস্তবতাসঞ্জাত। সাদাচোখে নারীর ক্রিয়া, আন্তঃক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডে মূল্যায়ন করার মতো দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষ তার লিঙ্গ-মতাদর্শের কারণে খুঁজে পায় না। নারী তার বিশেষ অভিজ্ঞতা ও ভাবগত অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে পুরুষের অনুরূপ অবস্থান ও অর্থকরণের চেষ্টা করে যাতে তার জীবনে একটি ভারসাম্য, সদ্ভাব ও সমঝোতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। তবে এমন অবস্থায় বিচিত্র ধরনের বিপত্তি, উদ্বেগ ও দ্বন্দ্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে। মূলকথাটা হলো, সাধারণ অর্থনির্মাণের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ স্তরিত অর্থনির্মাণের বাস্তবতাকে চিত্রিত করে থাকে।
প্রথাগত সমাজবিজ্ঞান মনে করে আন্তঃক্রিয়ার ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ অথবা নিজেকে প্রত্যাহার করবার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে সুযোগ ও পছন্দের সমান স্বাধীনতা ভোগ করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এমন সরল ভাবনা দ্বারা তাড়িত হবার অবশ্য কারণও রয়েছে। কিন্তু নারীবাদী গবেষণা প্রমাণ করতে চায় যে, একই অবস্থানে অবস্থিত নারীদের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগের সুযোগই কেবল সত্যিকার জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে নারীদের স্বাধীনভাবে অর্থনির্মাণে সক্ষম করে তুলতে পারে। এমন সংসর্গের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক, আবেগগত ও সমধর্মী অভিজ্ঞতা এবং সমর্থন পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু বাস্তবে নারীরা এমন আয়োজনে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ তেমন পায় না। পুরুষতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক নিয়মনীতি ও মতাদর্শের বলয় নারীর স্বাধীনভাবে সংঘবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে সীমিত ও অন্তর্লীন করে দেয়। অনেক সময় তাই এমন নারী সংগঠন অথবা যোগাযোগের পরিসর নিদারুণভাবে অদৃশ্যই থেকে যায়। সুতরাং মাইক্রো-বাস্তবতায় নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় সীমিত ও জটিল।
সমাজবিজ্ঞানে সাধারণভাবে সাবজেক্টিভিটির ব্যাপারটিকে ম্যাক্রো পর্যায়ে সংস্কৃতি ও মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত, আর মাইক্রো পর্যায়েই তার প্রধান অবস্থান বলে মনে করা হয়। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তির লক্ষ্য ও সম্পর্ক বিষয়ক অনুধাবনকে প্রচলিত সাংস্কৃতিক ও মাইক্রো-আন্তঃক্রিয়ামূলকভাবে প্রদত্ত সংজ্ঞার উজানস্রোত হিসেবে প্রত্যক্ষ করা হয়। মাইক্রো-সামাজিক জগতে ভূমিকাগ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষ অন্যের চোখে নিজেকে আবিষ্কার করে বলে মনে করা হলেও, নারীবাদী সমাজতত্ত্ব বলতে চেয়েছে যে, নারীরা পুরুষের চোখে নিজেদেরকে দেখতে অভ্যস্ত। কারণ, সামাজিকীকরণ তেমন শিক্ষাই দিয়ে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একজন নারী পুরুষ-প্রভাবিত সম্প্রদায়গত নীতিনিয়মকেই সাধারণ হিসেবে প্রত্যক্ষ করে, যা তাকে পুরুষের অধস্তন হিসেবে চিত্রিত করতে বাধ্য। সুতরাং, পুরুষের জন্য যা সমধর্মী ও সব অর্থেই ‘সাধারণ’-নারীর অভিজ্ঞতায় তা ‘সাধারণ’ নয়। এছাড়া, সামাজিক অংশগ্রহণকারী সত্তা হিসেবে পুরুষদের মতো নিত্যজগতকে তাদের ইচ্ছামাফিক আয়ত্ত করার ক্ষমতাও নারীর থাকে না। নারী তার নিচু অবস্থানের কারণে বিশ্বকে জানা ও জানানোর বিষয়টি অর্থহীন ও অসম্ভব বলে মনে করে। এটিই স্বাভাবিক যে, একজন নারী ক্রমাগত বিশ্বকে আপোস ও নিজের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রভূমি বিবেচনা করতে বাধ্য থাকবে। সেকারণে, তারা প্রাত্যহিক জীবনের একক সচেতনতা ধারণ করে না, বরং দ্বিধাবিভক্ত বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে। একটি তাদের নিজস্ব, জীবন্ত ও অভিজ্ঞতালব্ধ সচেতনতা, আর অপরটি সমাজে প্রচলিত সাধারণজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা। এই অপরটি দিয়েই তারা তাদের নিজের সচেতনতাকে দেখার চেষ্টা করে বটে। তবে প্রচলিত সামাজিক সচেতনতার ধরনটি সংস্কৃতি ও মতাদর্শপুষ্ট হলেও তা দিয়ে নারীর সচেতনতার ধরন ও মর্মার্থ বোঝা সম্ভব নয়। নারী অবশ্য একটিকে যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ ও অপরটিকে আনুষ্ঠানিক ও আধিপত্যশীল বলে মনে করে।
সার্বিক বিবেচনায় নারীবাদী সমাজতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সত্তাতত্ত্ব ও পদ্ধতিতত্ত্বের আবশ্যকতার উপর গুরুত্ব দেয়। আর সেখানে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে পুরুষদের দৃষ্টিকোণ, গবেষণা ও ফলাফল সমাজতাত্ত্বিক হলেও আংশিক ও অসস্পূর্ণ থেকে যায়। এমন অবস্থায় বলা যায় সমাজবিজ্ঞানে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক পরিক্ষেপের সূচনা সমাজবিজ্ঞানের উত্তরোত্তর সম্পূর্ণতার সুযোগ এনে দেয়। নারীবাদের নিজস্ব প্রত্যয়গত ও তত্ত্বগত গতিময়তা এবং নারীবাদী সমাজতত্ত্বের নিজস্ব অস্থিরতা গবেষণার মাধ্যমে আরো স্থিত অভিধা লাভ করবে এমন আশাই সকলের।
নারীবাদী সমাজতত্ত্বের বিরোধিতা করে ‘সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদে’র যৌক্তিকতা দেখানোর প্রচেষ্টাও দুর্লভ নয়। নারীবাদের উত্থানে সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণরা বেশি আবিষ্ট হয়ে পড়েছেন বলে মনে করা হয়। এঁরা নারীবাদের উত্থানে সমাজবিজ্ঞানের অবদানকে খাটো করে দেখাতে চান। যেমন, জি.এইচ. মিডের ‘অহম’ বা সি. রাইট মিলস্-এর মানবীয় প্রণোদনা সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া উচিত, কারণ ঘটনা বা প্রপঞ্চের ‘সামাজিক নির্মাণ’ এদের লেখায় অনেক আগেই এসেছে। ষাট দশকে বার্জার ও লাকম্যানের দি সোশ্যাল কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড রিয়ালিটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর একই দশকে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে থেকে ‘যৌনতার সমাজিক নির্মাণ’ নিয়ে কথা ওঠে। এরপর ‘লিঙ্গের সমাজতত্ত্ব’ পুরুষ ও নারীসুলভ গুণাগুণের সামাজিক নির্মাণ নিয়ে পরবর্তীতে লেখালেখি শুরু হয়। নারীবাদী ডামাডোলের মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক পরিক্ষেপসমূহের অবদান ঢাকা পড়ে যায় বলে মনে করা হয়। ‘সমাজতাত্ত্বিকভাবে ইনফর্মড্ নারীবাদ’ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের অজ্ঞতা ও অবজ্ঞাকে নারীবাদী সমাজতত্ত্বের সূত্রপাতের কারণ বলে মনে করা হয়েছে। লিঙ্গ-পৃথকায়িত শ্রমবাজার, পরিবারের মধ্যে ক্ষমতা ও শোষণের সমস্যাসমূহ, যৌন সহিংসতা প্রভৃতি বিষয়গুলো যখন সত্তর দশকে নারীবাদীদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করে, তখন সেগুলো সমাজবিজ্ঞানের অনুসন্ধানেরও বিষয় ছিল।
সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদের প্রবক্তরা বিশ্বাস করেন যে, সমাজবিজ্ঞানের ব্যাপক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নারীবাদের উৎপত্তি হয়েছে। যেমন, নারীর অধস্তনতার বিষয়টি মার্কসবাদী প্রত্যয়সমূহের আলোকেই প্রধানত বিশ্লেষণের চেষ্টা সেসময়ে করা হয়েছিল। মার্কসবাদ নারীনির্যাতনের সমাজব্যবস্থাগত ও সমাজকাঠামোগত বিশ্লেষণই করেছে। পরবর্তীতে পুরুষের সহিংসতাসহ নানা সমস্যা নিয়ে মার্কসবাদী বিশ্লেষণ হয়েছে যা নারীবাদী তত্ত্বায়নকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তবে, এটি অনস্বীকার্য যে, এ ব্যাপারে মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়। মোটকথা, যারা সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদকে সত্যিকার অর্থেই পুরোগামী ভাবতে চান এবং করতে চান, তাঁরা সমাজের সামাজিক নির্মাণ, ‘সামাজিকে’র অর্থনীতি-সংস্কৃতি-সংলগ্নতা এবং অর্থনীতির সামাজিক ভিত্তির উপর গুরুত্ব প্রদানের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। পার্থক্যটা শুধু লিঙ্গীয় নয়, শ্রেণীগত এবং নরগোষ্ঠীগতও বটে। তাই পার্থক্যের যাবতীয় ধরন ও প্রকৃতিকে বিশ্লেষণের জন্য ম্যাক্রো ও মাইক্রো সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব ও পরিক্ষেপসমূহের সমান গুরুত্ব রয়েছে। যৌনতার সামাজিক নির্মাণকে বুঝতে হলে কাঠামোর দিকটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা আবশ্যক। কারণ, অসমযৌনতার (যবঃবৎড়ংবীঁধষরঃু) প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মধ্য দিয়ে যৌনতা নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। জ্যাকসন এ প্রসঙ্গে তাঁর আলোচনায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, অসমযৌনতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি মর্মগতভাবেই লিঙ্গীয়। কারণ, এটি নারী ও পুরুষের সামাজিক ও যৌন সম্পর্কের নির্দিষ্ট ধরনসমূহের অনুমিত স্বাভাবিকতার উপর নির্ভর করে। এটি লিঙ্গীয় অসমতা এবং গৃহস্থালী ও মজুরি শ্রমের লিঙ্গীয় বিভাজনকে ছুঁয়ে যায়। যৌনতার যেমন একটি সাধারণ আলোচ্য অর্থ রয়েছে, তেমন প্রাত্যহিক জীবনে এর নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ-অনুশীলনের প্রকৃত স্বরূপও রয়েছে। সে অর্থেই যৌনতা অনুধাবনের পর্যায় সামাজিকভাবে নির্মিত একটি বিষয়, যা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াসমূহের মাধ্যমে পরিস্ফুটিত। এটি আমাদের যৌন ও লিঙ্গীয় প্রত্যাশা ও পরিচয় সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদে সমাজতাত্ত্বিক অনুধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সমস্যার সামাজিক রূপকে প্রত্যক্ষ করার কথা বলা হয়। সমাজতাত্ত্বিক অনুধ্যানই ব্যক্তিগত লিঙ্গীয় সমস্যাকে সামাজিকভাবে-নির্মিত লিঙ্গীয় বিভাজন হিসেবে দেখতে সাহায্য করে। ‘ব্যক্তিগত ব্যাপার তখনই রাজনৈতিক হবে যখন তা সামাজিক হিসেবে বিবেচিত হবে।’
শেষ কথা এভাবেই বলা যায় যে, নারীবিহীন সমাজবিজ্ঞান বলতে নারীর অভিজ্ঞতা ও নারী সম্পর্কীয় অভিজ্ঞতাহীন সমাজবিজ্ঞান চর্চার যে সমাজ-বাস্তবতা, পদ্ধতিতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে অপর্যাপ্ত ও অপূর্ণ। নারীবাদী সমাজতত্ত্ব হোক আর সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদই হোক, লাভ সমাজবিজ্ঞানেরই। শাস্ত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞানকে অগ্রসর হতে হলে অবশ্যই এমন অনেক অপূর্ণতাকে জয় করতে হবে।
তথ্যসূত্র
ঐড়বপশবৎ-উৎুংফধষব, ঝঁংধহ ১৯৯২, ঐধৎৎরবঃ গধৎঃরহবধঁ: ঋরৎংঃ ডড়সধহ ঝড়পরড়ষড়মরংঃ, ঘব িণড়ৎশ: ইবৎম.
ঔধপশংড়হ, ঝঃবার ১৯৯৯, ্তুঋবসরহরংঃ ঝড়পরড়ষড়মু ধহফ ঝড়পরড়ষড়মরপধষ ঋবসরহরংস্থ, ঝড়পরড়ষড়মরপধষ জবংবধৎপয, ঠড়ষ. ৪, ঘড়. ৩.
ঝসরঃয, উড়ৎড়ঃযু ১৯৮৭, ঞযব ঊাবৎুফধু ডড়ৎষফ ধং চৎড়নষবসধঃরপ: অ ঋবসরহরংঃ ঝড়পরড়ষড়মু, ইড়ংঃড়হ: ঘড়ৎঃযবধংঃবৎহ টহরাবৎংরঃু চৎবংং.
জরঃুবৎ, এবড়ৎমব ১৯৯৬, ঝড়পরড়ষড়মরপধষ ঞযবড়ৎু, ঘব িণড়ৎশ. ঞযব গপএৎধ িঐরষষ ঈড়. ওহপ.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন