কবি তো সে-ই
যার আকাঙ্ক্ষার সীমা নেই,
কামনার শেষ নেই,
প্রতিদিন যার জীবন নতুন একটি বাঁকবদলের দিকে ছুটে
যায়।
... ... ... ... ... ... ...
কবি তো সে-ই
কারো কাছে যে বিপদ নিয়ে অভিযোগ করে না;
সারা পৃথিবীর কবিকুলকে শ্রদ্ধা জানাবার ভাষা দিয়েই
কবি ও কামিনী উপন্যাসটির শুরু। কথাশিল্পী জাকির তালুকদার ইসলামপূর্ব আরবের কবি ইমরুল
কায়েসকে নিয়ে রচনা করেছেন এক অনবদ্য প্রেমোপাখ্যান। পৃথিবীর যে-কোন উপকরণের চেয়ে কবির
কাছে শ্রেষ্ঠতম তার প্রেমের সুতীব্র আবেগ।
অসংযত জীবনে কোনো তিয়াসাই মেটে না কবির কাছে। অপমান, জ্বালা, প্রতিশোধের অনির্বাপিত আগুন কবির মনের মতই স্বচ্ছ ও সত্য সেখানে। আবেগময় বিশৃঙ্খল, ছকে না বাঁধা জীবনচেতনা যার সে-ই তো কবি। কবিরা আগুন নিয়ে খেলতে ভালবাসে। কবি আল মাহমুদ যেমন সংরক্ত ও সহজাত বাসনায় প্রকাশ করেন, ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; / দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা উপশিরা’। (‘সোনালী কাবিন’)
অসংযত জীবনে কোনো তিয়াসাই মেটে না কবির কাছে। অপমান, জ্বালা, প্রতিশোধের অনির্বাপিত আগুন কবির মনের মতই স্বচ্ছ ও সত্য সেখানে। আবেগময় বিশৃঙ্খল, ছকে না বাঁধা জীবনচেতনা যার সে-ই তো কবি। কবিরা আগুন নিয়ে খেলতে ভালবাসে। কবি আল মাহমুদ যেমন সংরক্ত ও সহজাত বাসনায় প্রকাশ করেন, ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; / দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা উপশিরা’। (‘সোনালী কাবিন’)
ষড়যন্ত্র জেনেও যে পরাজিত হয় না সে-ই অপরাজেয় এক
কবিসত্তার নাম ইমরুল কায়েস। বাসনায় প্রেমে ভালবাসায় যে রক্তাক্ত, আহত-বিক্ষেপে তার
পদচারণা শুষ্ক মরু আরবে। কাম ও প্রেমে জর্জর এক কবি-হৃদয় কখনো মরুদ্যান কখনো যেন বিশুষ্ক
ধূলিরাশি। সমস্ত আরব-সুন্দরীর হৃদয় জয়কারী কবি সে। তার প্রেমে আত্মাহুতি দিতেও যেন
দ্বিধা নেই তাদের। বহির্মুখি, নারী-প্রেম ও সম্ভোগে অস্থির অথচ কারো বাহুডোরে বন্দিত্ব
তার স্বভাবে নেই। কিন্তু উম্মুল জুনদব নামক এক নারীর দুয়ারে হোঁচট খেল সে। প্রত্যাখ্যাত
হবার ভয় তাকে জুনদবের আচলে বাঁধে। বন্ধনভীরু কবি-মনের অভিব্যক্তি, “যে জীবন আমি যাপন করছিলাম, সেই জীবনে বৈভব আছে কিন্তু প্রশান্তি নেই।
উত্তেজনা আছে কিন্তু পরিপূর্ণ আনন্দ নেই।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ১৭) কিন্তু একে একে তিনজন নারীর
আত্মহননের খবর তাকে দুর্বল-চিত্ত করে মিখলাফের পথে উনায়জার দিকে ধাবিত করে। প্রথমদিকে
উনায়জার আপত্তি সত্ত্বেও ‘প্রেমে দোহে মিলি পরস্পরে’ কবির হাত দিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিষিদ্ধ প্রেমের কাব্য।
কেন যে এমন
লাগে! উনায়জা, রূপসী সে নারী
আমার দেহের
ভাঁজে মিশে আছে তার প্রেমশিখা,
মনের অতলে
যেন নিবু নিবু অগ্নির দাহিকা,
আমাকে জ্বালায়, আমি রূপে জ্বলি তারই।
জীবনের বহুদিন অজস্র নারীর মায়া-ডোরে
নিজেকে বেঁধেছি আমি। কিন্তু সেই ‘জুলজুল’ দিন
সমস্ত দিনের শেষে এখনো রঙিন
উজ্জ্বল জ্যোতির মতো ফুটে আছে স্বর্ণের মুকুরে।
(কবি ও কামিনী, পৃ. ৪৫, ৪৬)
ইমরুলের খাতায় এ-কবিতা আবিষ্কারে উম্মুল জুনদবের
হৃদয় ক্ষয়ে যায়। প্রেম পরিণত হয় ঈর্ষায়, সংঘর্ষে— পরিণাম
যার ভয়াবহ প্রতিশোধ। উম্মুল জুনদব সে-ই প্রেয়সীর নাম যে প্রেমে, কাব্যবোধে ও প্রতিশোধের
আগুন জ্বালাতে বদ্ধ পরিকর। ইমরুল কায়েসের গায়ে ছলনাপূর্বক তার পরিয়ে দেয়া বিষমাখা কাপড়ের
পরিণাম অনন্ত মৃত্যুর দিকে কবির ঝুঁকে পড়া। ভাবতে শরীরের রোমকুপ শিউরে ওঠে— যাকে ভালবাসা যায় তার প্রতি কি নেয়া যায় এই নিষ্ঠুর প্রতিশোধ?
উম্মুল জুনদব প্রেমিক হত্যায় দ্বিধাহীন চিত্ত, খলনায়িকার
বদনাম বহনকারী অন্যরকম এক আরব নারী। অন্যদিকে কবি আল-কামাহ্ উম্মুল জুনদবের প্রণয়াকাঙ্ক্ষী।
তারই প্রেমে উন্মাদ এক কবি-সত্তা আল কামাহর বাহুলগ্না নারী উম্মুল জুনদব শতচ্ছিন্ন
করে কবি ইমরুল কায়েসের হৃদয়। কবির লড়াইয়ে ইমরুলের হারার কারণও সে-বিষয়ে সন্নিহিত। কিন্দ
গোত্রের গোত্রপতি হজর-পুত্রের পরাজয় ঘটে নিতান্ত দরিদ্র কবি আল কামাহ্র কাছে। যে ইমরুল
কায়েসের কাছে কেবলি তুচ্ছ ‘হুদা গীতি’ অর্থাৎ উটচালকের গান লেখার ক্ষমতা রাখে মাত্র, বড়
কবি হবার যোগ্যতা সে-ই আল কামাহর কোথায়?
দুটো ঘটনার বিস্তার ঘটে উপন্যাসটির আখ্যানভাগে। সমান্তরালে
ইমরুল কায়েস-উনায়জা-উম্মুল জুনদব এবং ইমরুল কায়েস-উম্মুল জুনদব-আল কামাহ্ দুই ত্রিভূজ-প্রেমের
মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে কাহিনি। ইমরুল কায়েসের বিদ্রুপ সত্ত্বেও একসময় আরব-কাব্যের সকল
ছন্দ ভেসে ওঠে আল কামাহর মধ্যে। অথচ একটি নারীর আগ্রাসী প্রেমের ক্ষমতার কাছে সে যেন
মজনু হয়ে গেছে। লেখকের ভাষায়, ‘লাত-মানাত-ওজ্জার শপথ, প্রেমে পড়েছে আল কামাহ।’ ইমরুল কায়েস নামটি তার কাছে এখন তীব্র ঘৃণা। পৃথিবীর কোন কিছুই তার
কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ নয় এক উম্মুল জুনদব ছাড়া। গোত্রের সবাই ভীষণ চিন্তিত তার জন্য।
কারণ কোন কবিকে তারা ধ্বংসের দিকে যেতে দিতে চায় না। ‘ঈশ্বরের অনুগ্রহপ্রাপ্ত কবি আপনি। এমন অবিবেচকের মত আচরণ করছেন কেন?’— উম্মুল জুনদবের এমন প্রশ্নেরও উত্তর তার জানা নেই। মরুভূমির বিপদ-সঙ্কুল
বালিয়াড়িতে লুটিয়ে পড়া আল কামাহর দেহ খুঁজে পায় গোত্রের মানুষ। পরিশেষে আল কামাহর সেই
অভীষ্ট দিন আসে। উনায়জার প্রতি প্রেমের কবিতা আবিষ্কারে উম্মুল জুনদব প্রতিশোধের আগুনে
ইমরুল কায়েসকে পরিত্যাগ করে।
আগরেবাতুল আরাব বা কালো বর্ণের আরব কবি আনতারাহ্
ও ফখরিয়া উপাখ্যানটি মূলকাহিনিতে ভিন্নস্রোতের সৃষ্টি করেছে। হজর-পুত্র কবি ইমরুল কায়েসের
প্রেমিকসত্তার সঙ্গে হাবশি দাসী-পুত্র আনতারাহ্ বিন শাদ্দাদের প্রেম-বিষয়ক জটিলতা ও
ব্যক্তিত্বের দীপ্তি মিলেমিশে একাকার। বনু আসাদ গোত্র-কর্তৃক পিতা হজরের হত্যাকাণ্ডের
পর প্রতিশোধ পরায়ণ উন্মাদ ইমরুল কায়েস পাঠকের মনে ট্র্যাজিক সুর রচনা করে। নির্বান্ধব
ও ভগ্নহৃদয় ইমরুলের বিরুদ্ধে তলোয়ার চালনাকারীদের সম্মুখে দাঁড়ায় এক বেদনাহত যুবক।
সে আবস গোত্রের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কবি আনতরা। হাবশি দাসীর গর্ভে জন্মা আনতরাকে প্রত্যাখ্যান
করে আবস গোত্রের সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ফখরিয়া। তার গোত্রপতি চাচা শদ্দাদের ঔরসে জন্মালেও
ওরফে এক ক্রীতদাস আনতরা। ফখরিয়া বলে চলে,
“তুমি পুত্র নও। দাস। তুমি তার হাবশি দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া একজন আগরেবাতুল
আরাব (কালো বর্ণের আরব)। আর দাসীর পুত্র সবসময় দাসই হয়। একজন দাস হয়ে কোন সাহসে আমার
মতো সম্ভ্রান্ত নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাও? প্রেমের পয়গাম পাঠাও? ... আমার উচিত ছিল
আব্বাজানকে বলে তোমার চোখ উপড়ে নেবার ব্যবস্থা করা।” (কবি
ও কামিনী, পৃ. ৬৮)
এ অপমান সইতে পারে না কোনো কবি। স্বয়ংবরা সভায় কবিতা
পাঠে জিতে তবেই সে ফখরিয়াকে বশে আনে। কিন্তু অপমানিত কবি-হৃদয়ের ক্ষতস্থানটি তো মুছে
যায় না। তাই প্রতিশোধের বিষমাখা তীর সে ছুড়ে দেয় ফখরিয়ার দিকে।
ওকাজ মেলায় রাতের অন্ধকার নেমে আসে, আলোকসজ্জিত মঞ্চের
চারপাশে ভিড় করে নেকাবে মুখাবৃত মরুনারীর সঙ্গে ফখরিয়া বসা। শ্রেষ্ঠ কবিকে আজ সে বরণ
করে নেবে। কবিদের প্রতিযোগিতায় জয়ী আনতরা। তার হৃদয় ফখরিয়ার দিকে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু
আজই যেন তার প্রতিশোধ নেবার উপযুক্ত সময়—
“আর এগিওনা। আমি চাই না তোমাকে! চাই না তোমার প্রেমহীন বরমালা! তুমি যাও
সরে যাও আমার সম্মুখ থেকে! কোনো কবির সহধর্মিণী হওয়ার মতো মন তোমার নেই। আমি তোমাকে
প্রত্যাখ্যান করছি! প্রত্যাখ্যান করছি!” (কবি ও কামিনী, পৃ. ৮২)
প্রেমাস্পদকে
কাছে পেয়েও এমন প্রতিশোধ যার সে-কি ভালবেসেছিল? আনতরার ভেতরে প্রেমের আগুন ছিল
বলেই পথে বিপথে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই অস্বীকার তার নিজস্ব সত্তার স্বীকৃতি। ইমরুল কায়েসের
কাছে আনতরার নিজের প্রেমের বর্ণনায় তার ভেতরে সে-ধরনেরই আকুতি ছিল।
হাবশি কৃতদাস হবার কষ্টকে সে নিজের ভেতরে চালনা করে
হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য এক মানব। নিজের মনিব ও পিতার কাছে স্বীকৃতি পাবার আশায় সে উদ্বেলিত
হয়। কিন্তু তিনি তাকে চাকরের মতই জ্ঞান করেছেন। এটাই তৎকালীন আরব-সংস্কৃতি। কিন্তু
যোদ্ধা ও কবিশ্রেষ্ঠ আনতরা আপন ক্ষমতা দিয়েই প্রমাণ করেছে তার ভেতরের শক্তিতে। বদ্ধ
শৃঙ্খলিত সমাজে সে মানব-মুক্তির দূত। কিন্তু সুবিধাভোগী নয় বলে দাস-মুক্ত হবার পরও,
শদ্দাদের স্বীকৃতি পাবার পরও, এমনকি মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বয়ংবর সভা জিতেও ফখরিয়াকে
প্রত্যাখ্যান— তার অপ্রতিরোধ্য হার না মানা হার্দিক শক্তিরই অনন্য
পরিচয়। ইমরুল কায়েসের চরিত্রের তুলনায় তাকেও লেখক কম দীপ্তি দিয়ে তৈরি করেননি। দুই
বিপরীতমুখি সত্তার মিলন ও চাওয়া-পাওয়ার ভিন্নতায় জীবনের বিশাল বৈচিত্র্যকেই যেন স্থাপন
করা হয়েছে।
ধনী অভিজাত অসংযত আবেগী কবিকুল শিরোমণি ইমরুল কায়েসের
পার্শ্বে আনতরা ও আল কামাহর প্রেমাবেগে যে ঐশ্বর্য— তা লেখক
তাদের চরিত্র-দৃঢ়তা দিয়ে, অন্তরের কবিত্বশক্তির গুণে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রেণিব্যবধানের
সকল সূত্র অবহেলা করা কবি আনতরা যেন সমকালীন আরব-সমাজের প্রথার বুকে পদাঘাত। পিতৃস্নেহ-বঞ্চিত
আনতরা জন্মদাতার কাছে পেয়েছিল নিঃসীম নিগ্রহ, মালিকসুলভ আভিজাত্য আর কর্কশতা। আনতরাকে
গোত্র অধিবাসীরা অনারব বলেই অবজ্ঞা করতে চেয়েছিল। ‘শিরার
নিচ দিয়ে রক্ত নয়, বয়ে চলে কবিতার স্রোত’— সে-কাব্যশক্তিতে দেদীপ্যমান হয়েই সে যেন আত্মপ্রতিষ্ঠার
মহান বাণীকে গ্রহণ করেছে। সে-সঙ্গে মুক্তির বার্তা ঘোষণা করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে
শত বছরের শৃঙ্খলে বন্দি অন্ধকার-আরবকে। পিতা ও মালিক শদ্দাদকে গজল-কাসিদার পরিবর্তে
সে প্রদর্শন করে তার পরাধীনতার যন্ত্রণাদগ্ধ আবেগ—
“এখন কবিতা হবে না।
কেন এখন হবে না কেন? আমি চাইছি। তবু কবিতা হবে না
কেন?
“কবিতা কারো হুকুমে তৈরি হয় না। কবিতা স্বাধীন। কোনো গোলামের কণ্ঠে কখনো
কবিতা আসে না। এখন আমার কণ্ঠেও আসবে না।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ৭৩-৭৪)
কিন্তু যুদ্ধে যারা মালিক-পক্ষের হয়ে অস্ত্র ধারণ
করে তারা তো আনতরার মত ক্রীতদাসরাই। আক্রমণকারীরা এলে মালিক শদ্দাদ তাই তাকে হুকুম
করে অস্ত্রধারণের জন্য। কিন্তু আনতরা আজ অস্ত্র ধারণ করবে না। শিল্পীর চৈতন্য জগতের
অনিয়মের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এতদিনের প্রশ্নহীন অস্তিত্বকে এবার সে জেগে তুলে
নিজেকে তুলাদণ্ডে মাপার সুযোগ অর্জন করে। তার প্রশ্ন—
“কেন যুদ্ধ? কার জন্য যুদ্ধ? যুদ্ধে জিতলে কার লাভ? লাভ শুধু মালিকেরই।
আনতরা যে গোলাম সেই গোলামই থেকে যাবে। সে কেন
অন্যের যুদ্ধ লড়তে যাবে?” (কবি ও কামিনী, পৃ. ৭৫)
পরিশ্রমের ফসল যখন তাদের পাওনা নয় মালিকের পক্ষে
যুদ্ধ করা তখন অবান্তর। নিছক ক্রীতদাসত্বের বোঝা বইয়ে চলা আনতরা তাই সুযোগ বুঝেই তার
ও তার মায়ের মুক্তি ছিনিয়ে নেয়।
অন্যদিকে কবি আল কামাহ দারিদ্র্যের চরম অসহনীয়তা
নিয়েও প্রজ্জ্¦লন্ত এক অগ্নিপ্রাণ প্রেমিকসত্তা। সামান্য খাদ্যের সংস্থান নেই তার ঘরে।
দরিদ্র পিতার দাঁড়িতে বিশীর্ণভাবে লেগে থাকে ছাগলের বাটে দুধ পানের রেখা। দুফোটা ছাগলের
দুধ নষ্ট হবার ভয়ে পাত্রে না রেখে সরাসরি পান করে পিতা। জীর্ণকুটিরে আল কামাহর বাস।
কিন্তু দারিদ্র্যের চেয়েও মহান তার প্রেমাভিষেক।
কবি ও কামিনী প্রেমোপাখ্যানকে ঔপন্যাসিক কবিত্বের
দারুণ শক্তির মোড়কে আবৃত করেছেন। আরব-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ঝলকানিতে গড়ে ওঠা উপন্যাসের
বর্ণনার পরতে পরতে ইসলামপূর্ব যুগের আরবকে খুঁজে পাওয়া যায়। জাকির তালুকদারের বর্ণনার
গুণে সে আরব যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। প্যাগান-সংস্কৃতির আরবেও ছিল শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে
মানুষের সুতীক্ষ্ণ অনুভব। কবিতা ও শিল্প যেন রুক্ষ মরুতে আশা ও ভালবাসার মরুদ্যান।
আরব-সংস্কৃতির এক বিশ্বস্ত বর্ণনা উপন্যাসের শুরুতেই
দিয়েছেন লেখক। আরবদের প্রিয় বাদ্য মরু-সন্ধ্যায় বেজে ওঠা দফ। সে-বাজনায় পরিশ্রুত হয়
পরিশ্রান্ত আরব-বেদুঈনের শরীর-মন। উটের পাখির বাসা নষ্ট করার সামান্য ঘটনা নিয়ে তঘলিব
ও বকর গোত্রের মধ্যে চল্লিশ বছরব্যাপী ঘটে বসুসের যুদ্ধ। উম্মুল জুনদব ব্যতিক্রম হলেও
আরবজাহানে নারীর অবস্থা অবরুদ্ধ শায়খ বেধা পাখির মত। এ-প্রসঙ্গগুলো উপন্যাসে নির্মাণ
করে বিশ্বস্ত পটভূমি।
প্রতিবছরের ওকাজ মেলায় ঘটে কবিদের অংশগ্রহণ, কবিতা
পাঠ, তীব্র প্রতিযোগিতা। গোত্রে-গোত্রে যুদ্ধপ্রিয় আরবেও কবিরা সম্মানীত। বছরের শ্রেষ্ঠ
কবিতাকে তারা ঠাঁই দেয় লাত-মানাত-ওজ্জা দেবতা-অধ্যুষিত কাবাঘরের দেয়াল গাত্রে। উৎকৃষ্ট
সোনালী মিশরীয় বস্ত্রে কবিতা-উৎকীর্ণ হয়ে আচ্ছাদিত হয় কাবাঘর। লেখকের ভাষায়,
“আরবদের শরীরে চামড়ার তলা দিয়ে কেবল রক্তের নদী নয়, বয়ে চলে কবিতারও নদী।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ২৩)
আরবদের কবিতায় রয়েছে নানা মনোমোহিনী ছন্দ। তভিল,
মদিদ, বসিত, ওয়াফির, কামিল, হজজ, রজজ, রমল, স’রি, মুনসরিহ,
খফিফ, মুদারি, মুক্তদিব, মুজতস, মুতাকারিব, মুতাদারিক— ষোল রকম ছন্দে কবিতার নহর বইয়ে দেয় আরব কবিকুল। একজন কবি আরবদের কাছে
অনির্বচনীয় শান্তিসুধা বহনকারী অমৃত-ঝরঝর মানবাত্মা। উপন্যাসের বর্ণনায়,
“কবি হচ্ছে সে-ই, যার রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা। সে পারে শব্দ দিয়ে মানুষের
বুকের মধ্যে অনুভূতির নতুন নতুন নহর সৃষ্টি করতে। একজন কবিই কেবল হতে পারে তার গোত্রের
সবসময়ের মুখপত্র; শান্তির পথপ্রদর্শক আর মন্ত্রণাদাতা; যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যের
প্রতীক। কবি না হলে কেউ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে পারে না, জ্যোতির্বিদ্যার রহস্য শিখতে পারে
না, দেবতার অস্ফুট ইঙ্গিতের রহস্য উন্মোচন করতে পারে না।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ২২)
উপন্যাসে বর্ণনায়, চরিত্রের অন্তর্লোকের সৌন্দর্য
আবিষ্কারে ও বিষয়বস্তুর গঠনে জাকির তালুকদার সর্বাঙ্গে আধুনিক এক প্রেমকাহিনি উপহার
দিয়েছেন। নাটকীয় সাসপেন্সে ভরপুর এ-আখ্যানের কাহিনি আরব-ভূগোলের উপল-বন্ধুর পরিবেশে
চোরাগোপ্তা টানে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। তিনি বহু পুরনো এক কাহিনির নব-নির্মাণ করেছেন।
আধুনিক উপন্যাস হলেও এর নামকরণে মধ্যযুগের শিল্পকৃতির স্বীকৃত ‘উপাখ্যান’ নামটিই তিনি নির্বাচন করেন। এজন্য তা হয়ে ওঠে আইয়ামে
জাহেলিয়ার প্রেমোপাখ্যান। লাইলি-মজনু, শিরি ফরহাদ, ইউসুফ-জুলায়খা, গুলে বকাওলি প্রভৃতি
মধ্যযুগের আরব-ইরানের কাব্যচ্ছটা এ-উপন্যাসের পরতে পরতে।
১. “আল কিন্দি মরুদ্যানে যেন নেমে এসেছে সহস্র রংধনুর
বর্ণালী। ইয়াকুতের আতরদানিতে মৃগনাভি বিতড়িত হচ্ছে হাতে হাতে। ঝরনার পানিতে মেশানো
হয়েছে মেশ্ক-আম্বর। আলোক-পিছলানো পোষাকসজ্জিত নারী-পুরুষ অজস্র ধারায় বর্ষণ করছে ফুল,
হাসি আর শুভকামনা।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ১১)
২. “গরমের শ্বাসের চেয়ে ঢের কামনার দারাতে জুলজুলের শীতল
ইশারা। পুকুরের পাড়ে পৌঁছেই শীতের ঝরাপাতার মতো টুপটাপ ঝরে পড়ে একচল্লিশ যুবতীর অঙ্গের
বসন। ব্যগ্র আগ্রহে অপেক্ষা করে সবাই দারাতে জুলজুলের পানিতে। যেন একদল রাজহংসী অপেক্ষা
করছিল পানিতে নামার জন্য। আবার পানিও যেন অপেক্ষা করছিল তাদের স্পর্শের জন্যই পানির
জলছলাৎ আর যুবতী কণ্ঠের কলকাকলীতে ভয় পেয়ে খেজুর পাতার আড়াল থেকে উড়তে শুরু করে পাখির
ঝাঁক। টলটলে জল-পিছলানো যুবতী শরীরে সূর্যকিরণ ঠিকরে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সূর্যেরই।” (কবি ও কামিনী, পৃ. ৪০)
আরব-পটভূমি না হলে দ্বিতীয় স্তবকের বর্ণনায় স্নানরতা
উনায়জা ও সখীদের দেহসৌষ্ঠবে ভারতীয় রাধার প্রতিমূর্তি অঙ্কন করা অসম্ভব নয়। কাব্যবোধের
অসাধারণত্বে লেখকের স্বীয় ভূগোলের প্রভাব এ-বর্ণনাকে আরো জীবন-ঘনিষ্ঠ করে তোলে। উপন্যাসে
ধ্রুপদী কাব্য-ভাষা যেন আধুনিক গদ্যে রূপান্তরিত। এ-উপন্যাসের বর্ণনা ও কথনভঙ্গির আড়ালে
ঝরঝরে গদ্যশৈলীতে পুরনোগন্ধি শাব্দিক ব্যঞ্জনা দুর্লক্ষ নয়। উপন্যাসের আকার না দিলে
এ-আখ্যানের ভাষাভঙ্গির ধ্রুপদ চালে কাহিনিমূলক প্রেমকাব্য লেখা যেত অনায়াসে।
অন্যদিকে মধ্যযুগের অলৌকিক মেদ নির্ভারতা থেকে এ-আখ্যানের
মুক্তি ঘটে। মায়ের আদেশে ‘যুলখলস্বহ’ মন্দিরে ইমরুল কায়েসের উপস্থিতি, পিতৃহত্যার প্রতিশোধে
না-বোধক তীর ওঠানো— বিষয়গুলো অলৌকিকতার মোড়কে অঙ্কন করা। আমর বিন লুইয়ার
স্বপ্নযোগে দৃশ্যমান জেদ্দার খাড়িতে আটকা পড়া মূর্তি আরব জাহানে স্থাপিত হয়েছিল। আরবদের
কাছে তার সম্মান অনেক, তারা এ-মন্দিরকে বলে ‘ইয়ামেনের কাবা’। কিন্তু
আধুনিক উপন্যাসের শরীর-সংস্থানে লেখক তাকে অতিক্রম করেন ইমরুল কায়েসেরই অপ্রতিরোধ্য
আবেগের প্রাবল্যে। তাই যুলখলস্বহ মন্দিরের কাহিন (পুরোহিত)-এর নিষেধবাণী উপেক্ষা করে
প্রতিশোধ-জর্জর ইমরুল কায়েস পিতৃহত্যার বদলা নিতে চায়।
জাকির তালুকদার একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ভিন্নভূগোলের
এক কাহিনি নির্মাণে নানাদিক থেকেই মুন্সিয়ানার সাক্ষর রেখেছেন। একটি কবিসত্তার অন্তর্গূঢ়
নির্ঝরনী যেন বহমান তার ঔপন্যাসিক সত্তায়। কবি ইমরুল কায়েসের উচ্চ- স্বভাব, ভোগাকাঙ্ক্ষা,
কামনার অনিঃশেষ প্রবহমানতা সত্ত্বেও সে পাঠকের সহানুভূতি হারায় না কখনো, এখানেই এ-চরিত্রের
শক্তি। তাকে ঘিরে শেষপর্যন্ত টিকে থাকে যে অসীম বেদনাবোধ তা প্রত্যেকটি অনুভূতিপ্রবণ
পাঠক-চিত্তে চিরজাগরূক থাকে। উম্মুল জুনদবের পরিয়ে দেয়া বিষময় পোষাকের পরিণতিতে শরীরী
বাঁধন খসে পড়া ইমরুল কায়েসের মুখ দিয়ে শুধু কবিতাই উচ্চারিত হয়। কিন্তু হিংস্রতা অপেক্ষা
করছে তার দেহ-বিগলিত মাংস ছিড়ে খাবার জন্য। নির্মম-পরিণতির শিকার সে-ই কবিই যখন আকাশে
উড্ডীন শকুনকে ‘ফ্যাঁসফ্যাঁসে কণ্ঠে বলে— কবিতা শুনবি?’— তখন অনিঃশেষ এক কবিসত্তার স্বীকৃতি এ-কাহিনিতে তৈরি
করে এক শাশ্বত শৈল্পিক আবহ।
লেখক, শিক্ষক
বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : khorshed.ju.bngl@gmail.com
লিঙ্ক : http://www.somewhereinblog.net/blog/KhorshedAlam007/29975854
লিঙ্ক : http://www.somewhereinblog.net/blog/KhorshedAlam007/29975854
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন