খো র শে দ আ ল ম
খালেদ হোসাইন |
শিশুসাহিত্য সরল কিন্তু সহজ নয়। শিশু-কিশোর মনোবিশ্ব ধরতে পারা বড় কল্পনাশক্তির ব্যাপার। একসময় মনে হতো বাচ্চাদের ভুতের গল্প বা যে-কোনো আজগুবি গল্প লেখা খুব সহজ। কিন্তু ব্যাপার মোটেও তা নয়। শিশুদের পৃথিবী আমরা বহু আগেই ছেড়ে এসেছি। শৈশব-কৈশোর কার না প্রিয়? কখনো কখনো ধোঁয়াশা কিন্তু শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির ভাললাগা অতুলনীয়। কল্পনার স্মৃতি হাতড়ে সেই বিলীয়মান শৈশবকে লেখনিতে ধারণ করাও কঠিন কাজ। শিশু-কিশোরের জগতে মনটাকে টেনে নিয়ে যেতে হয় গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে। একজন নিবিষ্ট কল্পনাজ্ঞানের অধিকারী সে-জগৎকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারেন।
শিশুসাহিত্যের জন্য ছোটবেলার রোমান্সকর ও বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো স্মরণে রাখা জরুরি। কিন্তু কে জানে— কালে কে শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠবেন? ফলে অনেক বড়মাপের লেখকও শিশুসাহিত্য করতে উৎসাহী হন না। কথাটা আমাকে জানিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি শিশুদের জন্য লিখতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, তাঁর কল্পনার ঘোড়া শৈশব অবধি অতটা পৌঁছাচ্ছে না। যে-কারণে তিনি আর শিশুসাহিত্য লেখায় হাত দেননি। তিনি বললেন- পরে হয়ত আবার লিখবেন যদি সময় করে উঠতে পারেন।
খালেদ হোসাইন একজন কবি। এই কবিত্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর শিশুসাহিত্যের প্রতিভা। শিশুদের জন্য ছড়া লেখবার পাশাপাশি তিনি গল্প লিখেছেন অনেকগুলো। লেখকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়— বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অনেকগুলো শিশুতোষ গল্প বের হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সবগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি স্বভাবসুলভ ঔদাসীন্যের কারণেই তিনি সংগ্রহপ্রবণ মানুষ নন। ফলে এটা তাঁর যেমন নিজের ক্ষতি তেমনি ক্ষতি শিশুসাহিত্যেরও। ২০০০ সালে (এশিয়া পাবলিকেশন্স) প্রকাশিত তাঁর ‘চিড়িয়াখানা’ বইটিতে ১৪টি গল্প আছে। হাতের কাছে পাওয়া এ-বইটি দিয়েই তাঁর শিশু-কিশোর গল্পের কথা বলতে হচ্ছে।
খালেদ হোসাইন আমার শিক্ষক। মেশামিশির সূত্রে তাঁর অনুভূতির জগত কিছুটা হলেও আমার জানা। তাঁর সাহিত্য-নির্মাণের কারুকৌশল নিয়েও তাই আমার ভেতরে তৈরি হয়েছে কিঞ্চিৎ বোঝাপড়া। ব্যক্তি খালেদ হোসাইন খুবই অনুভূতিপ্রবণ একজন মানুষ। যারা তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছেন তাঁরা সবাই তা-ই অন্তত বলবেন। স্বাধীনতাপ্রিয়তা তাঁর চরিত্রের অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। তাঁর সঙ্গে গল্প করতে বা কথা বলতে ভাল লাগে— এ-কথা শুধু আমার নয়, অনেকের। অনুভবের এক গভীর স্রোত তাঁর অন্তর্লোককে উদ্ভাসিত রাখে। সে-অনুভবের ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগলে আপনি মন ভালো হয়ে যায়। তাঁর সহধর্মিনী যাঁকে আমরা বলি আইরিন আপা তিনি একদিন বলছিলেন তাঁর শিশুসুলভতার কথা। শিশু রোদেলা বাবার বুক ছাড়া ঘুমাত না। শিশুসন্তান রোদেলা ও রৌদ্রের সঙ্গে শিশুর মতই আচরণ করতেন তিনি। যেন বাবা নয়, সমবয়সী খেলার সাথী কোনো প্রিয়বন্ধু। তাদের আধো বোল, শিশুসুলভ চপলতা, কল্পনা-রোমান্সের জগত সবই যেন তাঁর করায়ত্ব। আইরিন আপা বলেন যে, তিনি নিজেই অবাক হয়ে বাবা আর ছেলে-মেয়ের কাণ্ড দেখতেন। আমাদেরকে বলেন, কী যে (সব কাণ্ড) করে রোদেলার আব্বু! বাবা-মেয়ে কী (যে) সব বলে আমি সব বুঝি না।’এই স্বভাবটাই তাঁর শিশুসাহিত্য গড়তে কাজ করেছে বলে আমার ধারণা।
‘চিড়িয়াখানা’ বইটিতে বারবারই রোদেলা ও রৌদ্র ঘুরে-ফিরে এসেছে। যেন লেখকের শিশুসাহিত্যের পথ হাঁটবার এক সদর রাস্তা এই দুই আত্মজ। এ-বইয়ের প্রথম গল্প ‘চিড়িয়াখানা’। পরিবারসমেত চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়ে পশুপাখির সঙ্গে চমৎকার দিন কাটানোর গল্প এটি। প্রথমবার দেখতে গিয়ে অদ্ভূত সব জীবজন্তু আর তাদের অদ্ভূত আচরণ তাঁর শিশুসন্তানকে আশ্চার্যান্বিত করে। কিন্তু গল্পের শেষে একটি ম্যাসেজ দেন তিনি। আর তা হল- পথশিশুদের দুরবস্থা। চিড়িয়াখানায় পানি বিক্রি করতে আসা উস্কোখুস্কো চুলের এক বঞ্চিত শিশুর জন্য পাঠক মনে খোঁচা লাগে। অনায়াসে পৃথিবীর এই বঞ্চিত শিশুদের অবস্থা চোখের সামনে ভাসে আমাদের। রোদেলা শিশুটির জন্য মর্মাহত হয়। এই মর্মাহত অবস্থা অন্য শিশুর মনেও একটি শিক্ষণীয় ব্যাপার হতে পারে।
রোদেলাকে নিয়েই মজার একটি গল্প ‘তালা’। আমাদের জীবনে প্রচলিত ভাষা বা প্রবচনগুলো শিশুদেরকে কখনো কখনো দ্বিধান্বিত করে। বস্তুত বাস্তবের সঙ্গে মানুষ বেড়ে ওঠার ফলে যে-বোঝাপড়া তৈরি হয় শিশুরা সেখান থেকে অবস্থান করে বহুদূরে। শিশুদের জগত সরল-সত্য-সুন্দর। তাই কথার মারপ্যাচে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। ‘তিল’গল্পে আছে শিশু জগতের সেই বিপত্তির কথা। ‘মুখে তালা দেয়া’যার অর্থ কথা বন্ধ করা। কিন্তু ছোট্ট রোদেলা তো তা বুঝতে চায় না। ফলে অভিমান করে মুখে সত্যি সত্যি একটি তালা মেরে বাবা-মাকে বিপদে ফেলে সে। গল্পটির নাম ‘তিল’ না হয়ে তালা হলে বরং ভাল হতো। তবে লেখকের সঙ্গে কথা বলে নামের সেই দ্বন্দ্বটি ঘোচানো গেল। তিনি বললেন, ‘তিল থেকে তাল হয়’। অর্থাৎ একটা ছোট ঘটনা কখনো কখনো বড় ঘটনায় রূপ নেয়। রোদেলার মুখে তালা দিয়ে বিপদ ডেকে আনা তো তিল থেকে তাল হবারই মতো।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যতদূর জানি শিশুজীবনকে ভারগ্রস্ত করে তোলা হয় না। আমাদের দেশে যদিও অবস্থাটা স্থানবিশেষে ভিন্ন। শিশুরা তাদের মানবিক অনুভূতি ও অসীম কল্পনাশক্তির বিকাশে ভবিষ্যতের মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে— এটাই হওয়া উচিত। খালেদ হোসাইনের ‘মাইলস্টোন’তেমনি একটি গল্প। শিশুরাই যেন এক একটি মাইলস্টোন হয়ে উঠবে। তার চিহ্নটা তারা পথে পথেই রেখে যায়। পাটা-পুতা বহন করতে গিয়ে দুই বন্ধুর তামাশা-রসিকতা দিয়ে অনেক সিরিয়াস বিষয়কেই যেন লেখক বোঝাতে চান। ‘পাটা’মাইলস্টোন হলেও ‘পোতা’তা হতে পারবে না। কারণ পাটার ভার বেশি, আয়তনও বেশি। তাই পাটারই জয় হবে। কিন্তু ‘আমি’কিশোর চরিত্রটি হাতের পোতাটা পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। কারণ, ‘স্টোন হলেই যে সবাইকে মাইলস্টোন হতে হবে এমন কোন কথা নেই।’শেষপর্যন্ত ভারহীন ও ভাবনাপ্রবণ সৃষ্টিশীল শিশুমনের কথা বলেন লেখক। যে শিশু বা কিশোর সহজাত বিকাশের মধ্য দিয়ে নিরন্তর অন্বেষণ করে চলবে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত পথ।
কৈশোরিক আবেগ উচ্ছ্বাস দুষ্টুমি বোকামি ভীতি মানুষকে আনন্দ দেয়। ‘চু আন চু’, ‘রঙ্গমঞ্চ’, ‘বগা’, ‘দুর্ঘটনা’, ‘ভৌতিক’, ‘পরি’ প্রভৃতি গল্প সেই অনুভূতি আস্বাদনের গল্প। আনন্দ দানের মধ্য দিয়ে কিশোর বয়সের নানা রোমান্সকর স্মৃতি-সমৃদ্ধ এ-গল্পগুলো বিশিষ্ট হয়ে ওঠে এজন্যই। ফেলে আসা কিশোরজীবনের এইসব স্মৃতি লেখকের অনন্য সম্পদ। ঘুরে ফিরে নানা কিশোর বন্ধুর কথা এই গল্পগুলোতে স্থান পেয়েছে। কালে তারা হয়ত অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিংবা অনেকেই হারিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই সময়ের জ্বলজ্বলে স্মৃতিকে লেখক ধারণ করেছেন। হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকেও এখানে স্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছেন তিনি।
কিশোরদের অন্যরকম অনুপ্রেরণা হতে পারে ‘মুক্তিযুদ্ধ’গল্পটি। লেখক তাঁর স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতা তথা মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এ-গল্পে। হারিয়ে যাওয়া স্বজন, মুক্তিযুদ্ধে গুলি খেয়ে শহীদ হওয়া, পাকসেনার অত্যাচার প্রভৃতি প্রসঙ্গ আছে এ-গল্পে। মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় বীর হয়ে জীবন বাজী রেখে লড়েছিলেন অনেকে। তাদের প্রতি তিনি অপরিসীম সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। গল্পে লেখকের মামা এ-রকমেরই একটি চরিত্র। যার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় ‘পশুর মতো বাঁচলে লাভ নাই, মরলেও লাভ নাই। বাঁচতে হবে বীরের মতো, মরতে হবে বীরের মতো।’ যে-কোনো কিশোর মনে যুদ্ধের এই অনিবার্য বাস্তবতা ও শিক্ষা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে কাছে থেকে দেখার ও বোঝার যে-উপলব্ধি এ-গল্পে সঞ্চিত হলো তা ভবিষ্যতের দেশগড়ার প্রদীপ্ত প্রত্যয়ী কিশোর মনকে প্রেরণা যোগাবে।
‘দুনিয়াটা সত্যি একটা আজব জায়গা। কী থেকে যে কী হয়ে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। কোনটা যে ঠিক, আর কোনটা ঠিক নয়, বোঝা যায় না।’এই দার্শনিক বাক্যগুচ্ছ ‘রঙ্গমঞ্চ’গল্পের। আগেই ইঙ্গিত করেছি- খালেদ হোসাইনের কাছে জীবন মানে বিধিবদ্ধ শাসন কিছু নয়। অনেক হারিয়ে, কিছু পেয়ে, কিছু নিয়ে কখনো সব হারিয়ে জীবনের একটি অর্থ তৈরি হয়। তিনি মনেপ্রাণেই সেটা বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, শিশু-কিশোর জগৎ আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও তা নয়। তারাও অনুভূতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আনন্দ-বেদনা সঙ্গে করে বড় হয়। একদিন কথায় কথায় তিনি রৌদ্রের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলছিলেন। যে-কথাটা এখানে না বলে পারা গেল না; তা হচ্ছে- রৌদ্রকে (তাঁর ছেলে) একদিন তিনি পীড়াপীড়ি করছিলেন একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে। সে কাকে বেশি ভালোবাসে— বাবা না মাকে? কিন্তু রৌদ্র মুখ খোলেনি কিছুতেই। খুব রসিকতা করে স্যার তাই মাঝে মাঝে বলতেন, শোনো— ‘শিশুদেরকে যতটা সহজ ভাবো মোটেও তা নয়।’ বস্তুত, সব বয়সের মানুষের প্রতিই অনুভববেদ্যতা দেখেছি খালেদ স্যারের ভেতর। জীবন যেমন তাঁর কাছে কাঠিন্যের ভার নয় তেমনি খুব সহজও নয়; তার সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য লড়বার মনোভাব প্রস্তুত করতে হয়।
খালেদ হোসাইনের কাছে জীবন মানে নিরন্তর সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে যাত্রা করা। তিনি তাঁর শিশুকিশোর গল্পের হাস্য-পরিহাস কিংবা মজা করার মধ্য দিয়ে মানুষকে ভেতর থেকে তৈরি হবার কথাটিও বলেন। আবার অনেক সময় সিরিয়াস কথাও তিনি বলে ফেলেন সরল হাসি দিয়ে। চিড়িয়াখানার গল্পগুলোতে লেখক তাঁর শৈশব-কৈশোর নিংড়ানো একটি চমৎকার জগতকে উপস্থাপন করেছেন। যে-জগতের সঙ্গে পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতার দারুণ এক সংশ্লেষণ তৈরি হয়। বস্তুত, স্বভাব সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন সম্পর্কে বোধ ও উপলব্ধির এক চিলতে আকাশ খালেদ হোসাইনের ‘চিড়িয়াখানা’।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন